জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল পর্ব – ৫ হুমায়ূন আহমেদ

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল পর্ব – ৫

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল পর্ব – ৫

মমিন ট্রেন থেকে নামল ঘোর বৃষ্টিতে। তার হাতে একটা সুটকেস, ট্রেনে দুটা প্রকান্ড বোচকা পড়ে আছে–নামাতে হবে। তার একার পক্ষে নামানো সম্ভব না। সে নেমেছে কুলীর সন্ধানে। নেমেই সে তার বোকামী টের পেল। এইসব গ্রামের মায়ে খেদানো, বাপে তাড়ানো টাইপ ষ্টেশনে কুলী থাকার কোন কারণ নেই। কুলী কুলী বলে চেঁচামেচি করতে করতে ট্রেন ছেড়ে দেবে। গার্ড সাহেব জানালা দিয়ে মাথা বের করে ফেলেছেন।মমিন সুটকেস প্লাটফরমে নামিয়ে আবার ট্রেনে উঠল। মন পড়ে রইল প্লটফরমে। স্যুটকেস কেউ নিয়ে পালিয়ে যাবে নাতো। কাপড় চোপড় যা আছে সবই স্যুটকেসে।

আমি জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের হেড মাষ্টার। ফজলুল করিম। আপনার জিনিসপত্র কি আছে দিন।মমিন এক ঝলক তাকিয়ে দেখল। সৌজন্য আলাপ পড়ে হবে আগে মালপত্র নামানো যাক। মমিন বলল, স্যার এই পুটলিটা একটু ধরুন।বেঞ্চের নীচ থেকে পুটলি টেনে বের করা যাচ্ছে না। এমন ওজন।ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কি আছে এর মধ্যে? স্যার বই।ফজলুল করিম সাহেব সঙ্গে সঙ্গে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। যে শিক্ষকের এত বই সে ভাল শিক্ষক না হয়েই যায় না। তিনি মনে মনেই বললেন–গুড, ভেরী গুড।মমিন বলল, ট্রেন কি ছেড়ে দিচ্ছে স্যার?

ছাড়লেও নামতে পারবেন। গ্রামের ষ্টেশন চলন্ত ট্রেনেই লোকজন ওঠানামা করে।একটা পুটলি বের হয়েছে। মমিন দ্বিতীয় পুটলি ধরে টানাটানি করছে। ফজলুল করিম বললেন, এর মধ্যেও কি বই? জ্বি স্যার।ফজলুল করিম সাহেব আবারো মনে মনে বললেন, গুড ভেরী গুড। ছেলেটি লম্বা, অতিরিক্ত রকমের রোগা, ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় রাগী হবে। হোক। রাগী শিক্ষকই ভাল। ছাত্ররা ভয় পাবে। ভয়ের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক আছে। অদির করে কোলে বসিয়ে শিক্ষা হয় না। প্রাচীন কালে গুরুগৃহে কঠিন শাসন ছিল।স্কুল স্টেশন থেকে কতদূর? আছে সামান্য দূর। পাঁচ মাইলের কম।যাব কি ভাবে? আগে রিকশায় যাওয়া যেত। বর্ষা শুরু হওয়ায় রিক্সা বন্ধ। হেঁটেই যাতায়াত করতে হয়।বলেন কি?

রোজ রোজতো আর স্টেশনে আসা হয় না।ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ফজলুল করিম নতুন সায়েন্স টিচারকে নিয়ে স্টেশনের পাশের টি স্টলে চা খেতে ঢুকেছেন। বৃষ্টি না ধরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একটা মাত্র ছাতা। দুজন এই ছাতায় কুলুবে না। ফজলুল করিম সাহেব লক্ষ্য করলেন নতুন টিচার বেশ আগ্রহ নিয়ে বৃষ্টি দেখছে। নিশ্চয়ই শহুরে ছেলে। গ্রামের বর্ষা দেখেনি। শহুরে ছেলে হলেই ভাল। এরা গ্রাম পছন্দ করে। হয়ত স্কুলে টিকে যাবে। গ্রামের শিক্ষিত ছেলেপুলেদের গ্রাম বেশী অপছন্দ। তারা শুধু খুঁজে শহর।ফজলুল করিম ঝুঁকে এসে বসলেন, আপনি কি গ্রামে ছিলেন কখনো?

জ্বি-না।তাহলে ভাল লাগবে। পল্লীগ্রামের বর্ষা সুন্দর।স্কুলটা কেমন? স্কুলটাও সুন্দর। প্রাচীন স্কুল।সেই সুন্দর জানতে চাচ্ছি না। বেতন টেন রেগুলার পাওয়া যাবে? শুনেছি গ্রামের স্কুলের বেতন খুবই অনিশ্চিত ব্যাপার? ফজলুল করিম সাহেব জবাব দিলেন না। চা খাবার ব্যাপারে অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে পড়লেন। স্কুলের অবস্থা শুধু যে ভাল না, তাই না–স্কুলের অবস্থা শোচনীয়। এই খবর দিয়ে শুরুতেই ভড়কে দেবার দরকার কি? স্যার কিছু বলছেন না যে স্কুলের অবস্থা কেমন? আছে মোটামুটি। তবে ইনশাআল্লাহ্ অবস্থা ভাল হবে।কি ভাবে ভাল হবে? স্কুলের নাম ডাক ছড়ালেই ছাত্র আসতে থাকবে।মমিন বিস্মিত হয়ে বলল, ছাত্র সব চলে গেছে নাকি?

না না তা না। আসুন বৃষ্টি কমেছে, রওনা দেয়া যাক। জিনিস পত্র থাকুক, পরে নোর ব্যবস্থা করব।আমার থাকার ব্যবস্থা কোথায় হয়েছে? আপাতত ইরতাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে থাকবেন। অতি সজ্জন। আরবী এবং ইসলামিয়াতের শিক্ষক। খাওয়া দাওয়া উনার এখানে থাকা খাওয়ার কোন খরচ নাই।কেন? পল্লীগ্রামতো–এখানে শিক্ষকদের খুব মর্যাদা। সভ্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের বাড়িতে শিক্ষকদের রাখেন। আদর যত্ন করেন।জায়গীর? বিনিময়ে প্রাইভেট টিউশনি?

অনেকটা সে রকমই। তবে আপনাকে ছাত্র পড়াতে হবে না।মামুন হতাশ গলায় বলল, কিছু মনে করবেন না স্যার অবস্থাতো আমার কাছে মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না। মনে তো হচ্ছে পেটে ভাতে চাকরি।সরকারী ডি এ আছে। ছাত্রদের কাছ থেকে কিছু কালেকশন হয়। বাজার কমিটির চাঁদা…. তাছাড়া পল্লীগ্রাম খরচও তো তেমন নেই।আবার ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছে। একটা ছাতায় বৃষ্টি মানছে না। মামুন বলল, ছাতা বন্ধ করে ফেলুন স্যার। আধাভেজা হয়ে যাবার চেয়ে পুরোপুরি ভিজে যাওয়াই ভাল। আমারতো বৃষ্টিতে ভিজতে ভালই লাগছে।ফজলুল করিম সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নতুন সায়েন্স টিচার টিকে যাবে বলে মনে হচ্ছে। এমন ঘন বর্ষণে ভিজতে যার খারাপ লাগছে না তার হয়ত কোন কিছুতেই খারাপ লাগবে না। কোন সায়েন্স টিচারই এই স্কুলে টিকে না। গত একবছরে তিনজন চলে গেল।

মামুন সাহেব।জ্বি স্যার।আপনার রেজাল্টতো খুব ভাল। এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাশ। গ্রামের স্কুলে আসতে রাজি হলেন ব্যাপারটা কি? ইচ্ছা করেই রাজি হয়েছি। গ্রামের দিকে থাকব নিরিবিলিতে পড়াশোনা করব। আমি বি সি এস দিচ্ছি। বই পত্র নিয়ে এসেছি।ও আচ্ছা। বি সি এস পাশ করলে চলে যাবেন।অবশ্যই। তবে যে কদিন আমি থাকব–ঠিকমতই থাকব। আমি ভাল শিক্ষক।করিম সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। এও থাকবে না। ভাল স্কুলের পূর্ব শর্ত হল ভাল শিক্ষক। দালান কোঠায় স্কুল হয় না। স্কুল হয় শিক্ষকে। মামুন বলল, ঠাণ্ডায় কাহিল হয়ে পড়েছি। স্যার যদি অনুমতি দেন একটা সিগারেট ধরাই।অবশ্যই অবশ্যই সিগারেট ধরাবেন এতে কি। আপনি আমার সহকর্মী।সহকর্মী হলেও আপনি বয়োজৈষ্ঠ। স্যার কি ধুমপান করেন?

জ্বি–না আগে করতাম। হঠাৎ এক সময় মনে হল ছাত্ররাই শিক্ষকদের দেখে শিখবে। আমাকে দেখে যদি সিগারেট খাওয়া শিখে সেটা ঠিক হবে না। ছেড়ে দিলাম।বলেন কি? মাঝে মধ্যে খাই না যে তা না–হঠাৎ হঠাৎ খাই।স্যার, এখন কি একটা খাবেন। আশে পাশে ছাত্র নেই–কেউ দেখবে না।না না। ইচ্ছা করছে না।ইচ্ছা করলেও পারবেন না। এই বৃষ্টির মধ্যে সিগারেট না ভিজিয়ে খাওয়া সহজ কর্ম না। শুধু প্রফেশনালরা পারবে। হা হা হা হা।করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে নতুন সায়েন্স টিচারের হাসি শুনছেন। এমন প্রবল হাসি হাসার মত কি ঘটনা ঘটেছে তাও তিনি বুঝতে পারছেন না।

মামুন সাহেব।জ্বি স্যার।ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী জানেন না-কি? মামুন বিস্মিত হয়ে বলল জ্বি–না জানি না। ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী দরকার কি? মামুন এই প্রথম হেডমাষ্টার সাহেবকে ভালমত লক্ষ্য করল। পাঁচ মাইল হেঁটে ইনি তাকে নিতে এসেছেন। এতক্ষণ ব্যাপারটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নি, এখন মনে হচ্ছে। স্কুলের দপ্তরীকেও তো উনি পাঠাতে পারতেন। বৃদ্ধ বয়স্ক একজন মানুষ ঝড় বৃষ্টির দিনে এতটা কষ্ট করবেন কেন? স্বার্থ ছাড়া মানুষ সচরাচর কষ্ট করতে রাজি হয় না। এই মানুষটার স্বার্থ কি? মামুন বলল, আর আপনি নিজে আমাকে নিতে এসেছেন কেন? কোন দরকার ছিল না।

করিম সাহেব কিছু বললেন না। তাঁর মাথায় ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী কি সেটাই ঘুরছে। বয়সের লক্ষণ। বেশী বয়সে মাথায় কিছু ঢুকে গেলে সেটা বেরুতে চায় না। প্যাচ কেটে যাওয়া রেকর্ডের মত এক জায়গায় বাজতে থাকে।স্যার আপনার স্কুলের ছাত্র কতজন? একশ তেইশ। আগামী কাল একজন ভর্তি হবে–একশ চব্বিশ হবে।স্যার কিছু মনে করবেন না–ব্যক্তিগত কৌতুহল থেকে প্রশ্নটা করছি আপনি কি এই একশ চব্বিশ জন ছাত্রের নাম জানেন? ফজলুল করিম সাহেব তৎক্ষণাৎ বললেন, জানি।মামুন সিগারেট ফেলে দিতে দিতে বলল, আমিও এ রকমই অনুমান করেছিলাম।

মওলানা ইরতাজউদ্দিন হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে ঢুকলেন। তার পেছনে বোকা বোকা চেহারার এক যুবক। যুবকের গা থেকে বিড়ির কড়া গন্ধ আসছে। তার দাঁত হলুদ হয়ে আছে। দাঁত মাজার ব্যাপারটি সে সম্ভবত জানে না, আর জানলেও তার প্রয়োজন বোধ করে না। মাথা ভর্তি চুল। সেই চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। এই চুল সে নিশ্চয়ই উকুনের চাষের জন্যে বড় করছে।মওলানা বললেন, রহমত! স্যারকে সালাম কর।রহমত টেবিলের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার ঝাপ দেয়া দেখেও ফজলুল করিম সাহেব আঁৎকে উঠলেন। এর চলাফেরা, কাজ কর্ম সব কিছুর মধ্যেই পশু ভাব আছে। পশুদের গায়ে যেমন কড়া গন্ধ থাকে এর গায়েও আছে। টক টক গন্ধ।মওলানা বললেন, স্যার এর কথাই আপনাকে বলেছিলাম।কি বলেছিলেন? ঐ যে রেশমীর সঙ্গে…

ও আচ্ছা আচ্ছা মোটরের ভাল মেকানিক। ওস্তাদ কারিগর। অন্যের গ্যারেজে কাজ করে, টাকা পয়সা জোগাড় করতে পারলে সে নিজেই নেত্রকোনা শহরে স্বাধীন ব্যবসা করবে।ভাল খুব ভাল।আপনাকে দেখানোর জন্যে খবর দিয়ে এনেছি।ভাল করেছেন খুব ভাল করেছেন।মওলানা রহমতের দিকে তাকিয়ে বললেন, রহমত তুমি বারান্দায় একটু দাঁড়াও আমি স্যারের সঙ্গে একান্তে দুটা কথা বলি।রহমত তার সব কটি হলুদ দাঁত বের করে হেসে ফেলল। ফজলুল করিম সাহেব হাসি দেখেও চমকালেন।

এটা তো হাসি না, যেন কামড়াতে আসছে। রহমত বারান্দায় চলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে বিড়ি ধরাল। বিড়ির কড়া গন্ধে ঘরে থাকাই মুশকিল।মওলানা বললেন, স্যার ওকে এনেছি রেশমীকে দেখানোর জন্যে। দেখে যদি পছন্দ হয় আজ রাতেই আমি বিয়ে পড়িয়ে দেব। রহমত বৌ নিয়ে চলে যাবে।কি বলছেন আপনি? ওর সঙ্গে এরকমই কথা হয়েছে।হুট করে বিয়ে? গরীব মানুষদের বিয়ে এরকম হুট হাট করেই হয়।এর সঙ্গে রেশমীর বিয়ে হতে পারে না।কেন?

ছেলেটাকে আমার পছন্দ না।আপনার পছন্দের কথা তো এখানে আসছে না। রেশমীর পছন্দ নিয়ে কথা।ওর তো পছন্দের প্রশ্নই উঠে না। পছন্দ করার মত কি আছে এই ছেলের মধ্যে? অনেক কিছুই আছে। ছেলের রোজগার ভাল। ভাল টাকা কামায়। এই জাতীয় ছেলে নেশাভাঙ করে। তার সে বদঅভ্যাস নেই।ফজলুল করিম সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, খামাখা একটা বিষয় নিয়ে পিড়াপিড়ি করছেন কেন? ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়নি। পও শ্রেণীর মানুষ বলে মনে হয়েছে। জেনেশুনে এমন একজনের সঙ্গে রেশমীর বিয়ে দেয়া যায় না। ওকে চলে যেতে বলুন।একটু ভেবে বলুন স্যার।ভেবে বলাবলির কিছু নেই।জি আচ্ছা স্যার।

স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে এটাও তো খুব আপত্তিজনক কথা। আমার নিষেধ আছে শিক্ষকরাও ছাত্রদের সামনে ধূমপান করবেন না। খারাপ ব্যাপারগুলি ছাত্রদের আগে আকৃষ্ট করে। আপনি বের হয়ে রহমত না কি যেন নাম, তাকে একটা কড়া ধমক দিন, তার পর চলে যেতে বলুন।জি আচ্ছা।ওকে বিদেয় করে আসুন আপনার সঙ্গে কথা আছে।জ্বি আচ্ছা।ইরতাজউদ্দিন ফিরে এলেন। তাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আমাদের নতুন টিচারকে কেমন লাগছে।ভাল।এক শব্দে জবাব দেবেন না। কেন ভাল সেটা বলুন।যুবক মানুষ। উৎসাহ আছে।পড়াচ্ছে কেমন? ভাল।

আপনার যে এক শব্দে জবাব দেবার একটা বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে তার কি করা যায় বলুনতো। খোঁজ নিয়েছেন ভাল, না-কি খোঁজ না নিয়েই বলেছেন ভাল।খোঁজ নেই নাই, অনুমানে বলেছি।অনুমানে কিছু বলবেন না। যা বলবার অনুসন্ধানের পর বলবেন। প্রথমে অনুমান তারপর অনুসন্ধান এই কাজটা করবেন না। প্রথমে অনুসন্ধান। তারপর অনুমান। বুঝতে পারলেন? জ্বি স্যার। এখন যদি অনুমতি দেন উঠি।আচ্ছা যান। ভাল কথা ব্যাঙের ডাকের আরবী কি বলুনতো।বুঝতে পারছি না কিসের আরবী? ব্যাঙের ডাকের।

ইরতাজউদ্দিন সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না। হেডমাস্টার সাহেব আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছেন। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি তিনি ব্যাঙের ডাকের আরবী জানতে আগ্রহী। মানুষটার মাথায় কি গোলমাল হচ্ছে? মাথার অসুখ হঠাৎ করে শুরু হয় না। আস্তে আস্তে শুরু হয়।সেকেন্ড পিরিয়ড শুরু হবার ঘণ্টা পড়ল। ঘণ্টা ঠিকমত পড়ল। সুন্দর আওয়াজ হল। হরিপদ স্কুলের ঘণ্টা খুঁজে পেয়েছে। ফজলুল করিম সাহেব ফাইন মাফ করে তাকে চিঠি দিয়েছেন। সেকেন্ড পিরিয়ডে ক্লাস নাইনের সঙ্গে তাঁর ক্লাস-ইংরেজী ফাস্ট পেপার। আজ পড়াবেন কবিতা।তেত্রিশজন ছাত্র ছিল ক্লাসে, আজ সেখানে বারজন ছাত্র বসে আছে। সব কটা বেঞ্চ ফাঁকা। নীলগঞ্জ হাইস্কুল চালু হয়েছে। ছাত্ররা দল বেঁধে চলে যাচ্ছে। মাত্র দুমাসে এই অবস্থা। সারভাইভেল ফর দি ফিটেস্ট। যে ফিট সে টিকে থাকবে। যে আনফিট তাকে চলে যেতে হবে। এটা জগতের কঠিন নিয়মের এক নিয়ম।

ফজলুল করিম সাহেব ডায়াসের চেয়ারে চুপচাপ বসে রইলেন। পড়ানো শুরু করতে ইচ্ছে করছে না। ক্লাস ভর্তি থাকবে ছেলেমেয়ে তবেই না পড়িয়ে আরাম। অল্প কটা ছেলেকে তিনি কি পড়াবেন? তিনি হাসতে চেষ্টা করলেন। পড়ানো শুরু করার আগে শিক্ষকরা হাসি হাসি মুখে থাকলে ছাত্ররা ভরসা পায়। ছাত্ররা তেমন ভরসা পেল বলে মনে হল না। তিনি বললেন, সবাই দেখি নতুন স্কুলে যাচ্ছে। তোমরা যাচ্ছি না কেন? একজন বলল, আমরা স্যার যাব না।ফজলুল করিম সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। ছেলেটা কথা বলেছে বেয়াদবের মত। উঠে দাড়ায়নি। স্যারের সঙ্গে কথা বললে–উঠে দাড়াবে। যা বলবে স্পষ্ট করে বলবে।তোমার নাম ফরহাদ উদ্দিন না?

জ্বি স্যার।শোন ফরহাদ উদ্দিন। তুমি যে বললে, তোমরা যাবে না। শুনে আমি সঙ্গত কারণেই খুশি হয়েছি। কিন্তু কথাগুলি তুমি বলেছে বসে বসে। অত্যন্ত বেয়াদবের মত কাজ করেছ। ভবিষ্যতে আর কখনো করবে না।জি আচ্ছা স্যার।এখন বল তোমরা যাবে না কেন? এই স্কুলই ভাল।নীলগঞ্জ স্কুল যে খারাপ এটা তো তুমি বলতে পার না। কারণ তুমি ঐ স্কুলে পড়নি। পড়েছ?

জি না।তাহলে বললে কেন এই স্কুলই ভাল? যা মনে আসে তাই বলে বসবে। কথা বলার আগে অবশ্যই আমাদের অনেক সাবধান হতে হবে। কথা বলাটাও শিক্ষারই একটা অঙ্গ। মনে থাকবে?

জ্বি স্যার!

আজকে আমরা কি পড়ব?

ইংরেজী কবিতা।

কবিতার নাম কি?

The Sands of Dee.

যে কবি কবিতাটা লিখেছেন তার নাম কি? কেউ জান না। জানা উচিত ছিল না-কি? কবির নাম চার্লস কিংসলে। সবাই এক সঙ্গে বল চার্লস কিংসলে।সবাই এক সঙ্গে বলল, চার্লস কিংসলে।আবার বল।ছাত্ররা আবার বলল।ফজলুল করিম সাহেব বোর্ডের কাছে গেলেন। চক দিয়ে বড় বড় করে লিখলেন Charles Kingsley.কবির নামের নিচে লিখলেন কবিতার নাম The sands of Dee. প্রথমে স্রষ্টা তারপর তার সৃষ্টি। কাজটা কি ঠিক করলেন? সৃষ্টি কি বেশির ভাগ সময়ই স্রষ্টাকে ছাড়িয়ে যায় না? জীবনকৃষ্ণ বাবুর চেয়েও কি জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল অনেক গুরুত্বপূর্ণ নয়?

তিনি মিষ্টি গলায় কবিতার প্রথম চার লাইন আবৃত্তি করলেন।

O Mary, go and call the cattle home.

And call the cattle home,

And call the cattle home,

Across the sands of Dee.

বাবারা বল Dee মানে কি? নদীর নাম স্যার।হ্যাঁ। ইংল্যাণ্ডের একটা নদীর নাম। লিভারপুলের কাছে এই নদী সমুদ্রে পড়েছে। এই কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের দেশের এক কবিও অসাধারণ একটা কবিতা লিখেছিলেন। তোমরা কেউ সেটা জান? ছাত্ররা চুপ করে আছে। কেউ জবাব দিচ্ছে না। ফজলুল করিম সাহেব বিষণ্ণ গলায় বললেন, কবিতাটা তোমরা ক্লাস সেভেনে পড়েছ। তোমাদের পাঠ্য ছিল

শোন মা আমিনা, রেখে দে রে কাজ, ত্বরা করে মাঠে চল

এল মেঘনায় জোয়ারে বেলা এখনি নামিবে ঢল।

নদীর কিনারা ঘন ঘাসে ভরা,

মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা,

করিস না দেরি আসিয়া পড়িবে সহসা অথই জল।

মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় তৃরা মেম্বনায় নামে ঢল।

ফজলুল করিম সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ভাল লাগছে না। কিছু ভাল লাগছে না। ঘণ্টা পড়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বোর্ডের দিকে তাকালেন। ভুল করেছেন। কবির নামের আগে কবিতার নাম থাকা উচিত ছিল।

 

Read more

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল পর্ব – ৬ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *