সামরিক নির্দেশাবলির পর প্রচারিত হলো যন্ত্রসঙ্গীত। যন্ত্রসঙ্গীতের পর স্বাস্থ্যবিষয়ক কথিকা। বিষয় জলবসন্ত। সোবাহান সাহেব জলবসন্ত বিষয়ক কথিকাও অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শুনলেন। জলবসন্তে এন্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসে না–এই তথ্য তাঁর কাছে হঠাৎ করেই খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। এখন তাঁকে দেখে গত রাতের সোবাহান সাহেব বলে মনে হচ্ছে না।
মনে হচ্ছে মোটামুটিভাবে আনন্দে আছেন এমন একজন মানুষ। যে মানুষটি। কানের কাছে ট্রানজিস্টার রেডিও ধরে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ পেয়েছেন। রেডিওতে পাওয়া খবর অন্যদের জানানোর বিষয়েও তাকে উৎসাহী মনে হচ্ছে। শাহেদকে বললেন, ভালো খবর আছে, আগামীকালও দুঘণ্টার জন্যে কার্ফ তোলা হবে। এমনিতে দুঘণ্টা কম সময় মনে হয়, আসলে কিন্তু অনেক সময়।
দুই ঘণ্টায় দুনিয়ার কাজ করে ফেলা যায়। কাল মনে করে আরো ব্যাটারি কিনবে।মনোয়ারাকে রাতে কী রান্না হবে সেই বিষয়ে বললেন, বৌমা খিচুড়ি রান্না করো। বর্ষা বাদলায় আনন্দের দিনে খিচুড়ি খেতে হয়, আবার বিপদে-আপদেও খিচুড়ি খেতে হয়। পাতলা খিচুড়ি সঙ্গে ডিমভুনা।খিচুড়ি ডিমভুনা খেতে খেতে রাত দশটা বেজে গেল। তার পরপরই উত্তর দিক থেকে প্রবল গোলাগুলির শব্দ আসতে লাগল। গতকালের মতোই অবস্থা।
রাস্তায় ভারী মিলিটারি গাড়ির চলার শব্দ কিছুক্ষণ পরপরই শোনা যাচ্ছে। গোলাগুলির সঙ্গে বুম বুম শব্দের বিকট আওয়াজও কানে আসছে। এই শব্দ কিসের তা সোবাহান সাহেব বুঝতে পারছেন না। তিনি চিন্তিত গলায় শাহেদকে বললেন, বুম বুম শব্দটা কিসের? শাহেদ বলল, জানি না। চাচা। কামান দাগছে না-কি? কামান দাগছে কী জন্যে?
রাত বারটার দিকে শব্দ আসতে শুরু করল পশ্চিম দিক থেকে। এই শব্দ অনেক কাছ থেকে আসছে। গুলি মনে হচ্ছে শী শী শব্দ করে এই বাড়ির ছাদের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সোবাহান সাহেব ভীত গলায় বললেন, সবাই মেঝেতে শুয়ে থাকে। সবাই একঘরে শোও। মহাআজাবের সময় আত্মীয়-অনাত্মীয় নারীপুরুষে কোনো ভেদাভেদ নাই। শাহেদ, তুমিও আমাদের সঙ্গে শুয়ে থাকে।
বসার ঘরের মেঝেতে সবাই শুয়ে আছে। কংকন শুয়েছে শাহেদের পাশে। সে একটা পা শাহেদের গায়ে তুলে দিয়েছে। রুনি এইভাবে ঘুমায় না। সে হাতপা গুটিয়ে পুটলির মতো শুয়ে থাকে। একটা আঙুল থাকে তার মুখে। ঘুমের মধ্যে সে আঙুল চুষতে থাকে। খুবই খারাপ অভ্যাস।
সোবাহান সাহেব অত্যন্ত ভয় পেয়েছেন। ভয়ের কারণে হঠাৎ তার কথা জড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। তিনি বললেন, সবাই একমনে আল্লাহপাকের নাম নাও–আমাদের বড়পীর সাহেব আবদুল কাদের জিলানি সব সময় যে জপ। করতেন। ঐটা করো। এক মনে বলো–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
কংকন বলল, বাতি জ্বালাও, আমার ভয় লাগে। সোবাহান সাহেব বললেন, বাতি জ্বালানো যাবে না।গুলির শব্দ আরো কাছে এগিয়ে এসেছে। মানুষজনের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সোবাহান সাহেব শব্দ করেই জিগির করছেন–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। মাত্র দুঘণ্টার জন্যে কারফিউ-বিরতি।
এই দুঘণ্টায় শাহেদকে অনেক কাজ করতে হবে। যেভাবেই হোক আসমানীর খোঁজ বের করতে হবে। সে নিশ্চিত আজি খোঁজ পাওয়া যাবে। সে যেমন আসমানীর খোঁজ বের করার চেষ্টা করছে, আসমানীও নিশ্চয়ই করছে। প্ৰথমবার কারফিউ তোলা ছিল আকস্মিক । হঠাৎ করে আসমানীরা খবর পেয়েছে দুঘণ্টার জন্যে কারফিউ নেই। তৎক্ষণাৎ কোনো ব্যবস্থা করতে পারে নি। আজকেরটা আগেভাগেই জানা।
কাজেই আসমানী নিশ্চয়ই প্ল্যান করে রেখেছে। শাহেদ ঠিক করেছে সে প্রথমে যাবে শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে কোনো খোঁজ না বের করতে পারলে নিজের বাসায় এসে বসে থাকবে। তবে আজ খবর পাওয়া যাবেই। গতরাতে সে একটা ভালো স্বপ্ন দেখেছে। সেই স্বপ্নের একটাই অর্থ। আসমানীর সঙ্গে দেখা হবে। স্বপ্নে সে নিজের ঘরের বারান্দায় বসে হাউমাউ করে কাঁদছে, এমন সময় তার বড় ভাই ইরতাজউদ্দিন বারান্দায় এসে বিরক্ত গলায় বললেন, কাদছিস কেনরে গাধা?
সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আসমানীর খোঁজ পাচ্ছি না। ইরতাজউদ্দিন বললেন, ঘরে বসে ভেউ ভেউ করে কাঁদলে খোঁজ পাবি কী করে? আয় আমার সঙ্গে। দুজন রাস্তায় নামল। রাস্তায় প্রচুর লোকজন। তাদের মধ্যেই দেখা গেল, একটা ঠেলাগাড়িতে আসমানী বসে আছে। সে খুব সুন্দর করে সেজেছে। তার গা ভর্তি গয়না। মুখে চন্দনের ফোঁটা দেয়া। পরনের শাড়িটাও মনে হচ্ছে বিয়ের শাড়ি। শাহেদ ঠেলাগাড়ির দিকে অতি দ্রুত যাবার চেষ্টা করছে।
এত লোকজন যে যাওয়া যাচ্ছে না। তবে আসমানী তাকে দেখতে পেয়েছে। সে হাসছে।ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। এই স্বপ্ন অবশ্যই সত্যি হবে। শাহেদ অতি দ্রুত হাঁটছে। স্বপ্নে যেমন দেখেছিল রাস্তায় প্রচুর মানুষ, বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। প্রচুর লোক। মনে হয় শহরের সমস্ত লোকজন এক সঙ্গে পথে নেমেছে। রিকশাও নেমেছে, তবে সংখ্যায় কম। খালি রিকশা দেখা মাত্র শাহেদ ছুটে যাচ্ছে।
রিকশা কি কলাবাগান যাবে? প্রতিটি রিকশাওয়ালাই এই প্রশ্নের জবাব দিতে অনেক সময় নিচ্ছে। চট করে বলে দিলেই হয় যাবে না। তা না করে একেকজন আকাশ-পাতাল ভাবছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। রাস্তায় থুথু ফেলছে। কপালের ঘাম মুছছে। তারপর বিড়বিড় করে বলছে–ঐ দিকে যামু। না। রিকশা ঠিক করতে যাওয়া মানে সময় নষ্ট। এখন প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান। মূল্যবান সেকেন্ডের একটিও নষ্ট করা ঠিক না।
সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে এসে শাহেদ রিকশা পেল। এই রিকশা পাওয়া না-পাওয়া একই। জোয়ান রিকশাওয়ালা অথচ সে রিকশা টানতেই পারছে না। পায়ে হেঁটে এরচে দ্রুত যাওয়া যায়। শাহেদ বলল, ভাই একটু তাড়াতাড়ি যান। রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে শাহেদের কথা শুনল। তার রিকশার গতি আরো শ্লথ হয়ে গেল। শাহেদের ইচ্ছা করছে, লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে হাঁটা শুরু করে।
কলাবাগানের কাছাকাছি এসে সে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো একটা ঘোড়ার গাড়ি। গাড়িতে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। গাড়ির ভেতর বার-তের বছর বয়েসী একটা কিশোরী। তার পরনে ঘাঘড়া। চুল লাল। কিশোরীকে ঘিরে চারজন যুবক। সবাই পান খাচ্ছে। তাদের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল। তারা কি কোনো উৎসবে যাচ্ছে? বিয়ের উৎসব নিশ্চয়ই না। অন্য কোনো উৎসব। এরা বিহারি। বিহারিরা উৎসব করতে পছন্দ করে। আজকের এই দুঃসময় তাদের জন্যে না। এরা দুঃসময়ের বাইরে।
শাহেদ শ্বশুরবাড়িতে কাউকে পেল না। বাড়ির সামনের চায়ের দোকানটা খুলেছে। দোকানদার কিছু বলতে পারল না। আশেপাশে চার-পাঁচটা বাড়িতে সে গেল। তারাও কিছু জানে না। একজন শুধু বলল, কালো রঙের একটা প্ৰাইভেট গাড়িতে করে সবাই চলে গেছে। কখন গেছে, কবে গেছে সেটা আবাব বলতে পারছে না।
শাহেদ নিজের বাড়িতে ফিরল কারফিউর মেয়াদ শেষ হবার আধঘণ্টা আগে। গেট খুলে ভেতরে ঢোকার সময় হঠাৎ মনে হলো, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে–এক্ষুনি বোধহয় সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। বাসার সদর দরজায় তালা নেই। বাড়িতে লোক আছে। অবশ্যই আসমানী ফিরেছে। চাবি দিয়ে সদর দরজা খুলেছে। বাড়ির অন্য দরজা-জানোলা সবই বন্ধ। এটাই স্বাভাবিক। এই সময়ে কেউ দরজা-জানালা খোলে না। শাহেদ দ্রুত চিন্তা করছে–চাল-ডাল কি আছে?
আসমানী খুব গোছানো মেয়ে। সবকিছুই থাকার কথা। কেরোসিন আছে কি-না কে জানে। যদি না থাকে এক্ষুণি নিয়ে আসতে হবে। আধঘণ্টা সময় এখনো হাতে আছে। সে দেখে এসেছে রাস্তার মোড়ের বড় দোকানটা খোলা। কেরোসিন চা-পাতা চিনি। আসমানী একটু পর পর চা খায়। কড়া মিষ্টির ঘন চা। শাহেদ ঠিক করতে পারছে না–সে কি বাসায় না। ঢুকে আগে বাজারটা করে নিয়ে আসবে?
না-কি আগে আসমানীর সঙ্গে দেখা করে বলবেভয় নাই আমি আছি। তাকে না দেখে আসমানী নিশ্চয়ই ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। তবে আসমানীর সঙ্গে দেখা হলে একটা বিপদ হবে। রুনি তাকে দেখা মাত্ৰ বাপ দিয়ে কোলে উঠে পড়বে। তাকে তখন কোল থেকে নামানো যাবে না। দোকানে যেতে হলে তাকে কোলে নিয়েই যেতে হবে।সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। শাহেদ অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাবার পর ভেতর থেকে ভীত পুরুষগলা শোনা গেল— কে?
শাহেদ বলল, আমি শাহেদ। দরজা খুলেন।দরজা খুলল। শাহেদ অবাক হয়ে দেখে, দরজার ওপাশে গৌরাঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখভর্তি খোচা খোচা দাড়ি। চোখ হলুদ। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে বিরাট কোনো অসুখ থেকে উঠেছে।শাহেদ বলল, তুমি কোত্থেকে? গৌরাঙ্গ জবাব দিল না। শাহেদ আবার বলল, তুমি কোথেকে? গৌরাঙ্গ এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন সে শাহেদের কথা বুঝতেই পারছে না। শাহেদ বলল, বাসায় আর কেউ আছে? গৌরাঙ্গ বলল, না।শাহেদ বলল, তুমি বাসায় ঢুকলে কীভাবে?
গৌরাঙ্গ বিড়বিড় করে বলল, তালা ভেঙে ঢুকেছি। মিতা, আমার কোনোখানে যাবার জায়গা নাই। তুমি যদি বের করে দাও, মিলিটারিরা আমাকে মেরে ফেলবে।শাহেদ বলল, আমি বের করে দেব কেন? গৌরাঙ্গ জবাব দিচ্ছে না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাহেদের দিকে। শাহেদ বলল, তোমার বৌ-মেয়ে ওরা কোথায়? শাহেদ বিড়বিড় করে বলল, ওরা ভালো আছে।তারা কোথায়?
আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে। আমি তোমার সঙ্গে থাকব।শাহেদ বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে কেন? গৌরাঙ্গ আগের মতোই অস্পষ্ট গলায় বলল, মিতা, আমি তোমার সঙ্গে থাকব। আমার সঙ্গে টাকা আছে। শ্বশুরমশাই যে টাকাটা দিয়েছেন, সবটা আমার সঙ্গে আছে। তুমি টাকাটা নাও। খরচ করো। শুধু আমাকে থাকতে দাও।শাহেদ হতভম্ব গলায় বলল, ঠিক করে বলো তো–ভাবি, বাচ্চ ওরা কোথায়?
গৌরাঙ্গ বলল, বলেছি তো ওরা ভালো আছে। দুজনই ভালো আছে। মেয়েটার জ্বর এসেছিল, এখন মনে হয় জ্বর কমেছে। আমার নিজের শরীরও ভালো না। আমি তোমার এখানে বিশ্রাম নিতে এসেছি। সারাক্ষণ আমার মাথা ঘোরে। মিতা, আমার ক্ষিধাও লেগেছে। তুমি আমাকে কিছু খাওয়াও। টাকা নিয়ে চিন্তা করবে না। আমার কাছে টাকা আছে। মিতা, আমি এখন শুয়ে থাকব। খাবার জোগাড় হলে আমাকে ডেকে তুলবে।
গৌরাঙ্গ সন্ধ্যা পর্যন্ত মরার মতো ঘুমাল। কয়েকবার চেষ্টা করেও শাহেদ তাকে তুলতে পারল না। সন্ধ্যার পর পর সে নিজেই জেগে উঠল। শাহেদ বলল, এখন শরীর কেমন? মাথা ঘোরা কমেছে? গৌরাঙ্গ বলল, শরীর ভালো আছে। আমার বাচ্চাটাকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে—এই জন্যে মনটা সামান্য খারাপ।ভাবি? ভাবি কোথায়?
ওরা তাকে তুলে নিয়ে গেছে। বঁচিয়ে রেখেছে কি-না। আমি জানি না। মেরে ফেললে তার জন্যেও ভালো, সবার জন্যেই ভালো। আমার শ্বশুরসাহেবও মারা গেছেন। মিতা, তোমাকে স্থা বলেছি। সব গোপন রাখবে। মিলিটারি যদি শুনে তাদের নামে আজেবাজে কথা বলছি, তাহলে তারা রাগ করবে। আমাকেও ধরে নিয়ে যাবে। মিলিটারিদের দোষ কী! ওরা হুকুমের চাকর। ওদের যেভাবে হুকুম দিয়েছে, ওরা সেইভাবে কাজ করেছে। তাই না?
শাহেদ বলল, ভাবিকে যখন ওরা নিয়ে যাচ্ছিল তুমি কোথায় ছিলে? আমি দরজার আড়ালে বসে ছিলাম। ওরা সব ওলট পালট করে দেখেছে, শুধু দরজার আড়ালটা দেখে নাই। সবই ভগবানের লীলা। মিতা, তোমাকে যা বললাম সব গোপন রাখবে। কোনে কিছুই যেন প্ৰকাশ না হয়। মিলিটারির কানো গেলে তোমার বিপদ। আমারও বিপদ।
শাহেদ বলল, ভাত-ডাল রান্না করেছি, খেতে আসো।গৌরাঙ্গ বলল, ঠিক আছে। খুবই ক্ষুধা লেগেছে। ইলিশ মাছের পাতুরি খেতে ইচ্ছা করছে। গরম ধোঁয়া উঠা ভাত, ইলিশ মাছের পাতুরি।কথা শেষ করেই গৌরাঙ্গ বিছানায় শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম। শাহেদ তার পাশেই বসে আছে। মানুষটা ঘুমের মধ্যে কাঁদছে। ঘুমের মধ্যে কাদার দৃশ্যটা যে দেখতে এত ভয়ঙ্কর তা শাহেদ আগে কখনো বুঝতে পারে নি।
রাত বাড়ছে। ইলেকট্রসিটি সন্ধ্যা থেকেই নেই। ঘর অন্ধকার না। শাহেদ টেবিলের উপর পাশাপাশি দুটা মোমবাতি জ্বলিয়েছে। মোমবাতি পাওয়া গেছে রান্নাঘরের তাকে। আসমানী রান্নাঘরের দরজায় লিস্ট টানিয়ে রেখেছে। কোন জিনিসটি কোথায় তার তালিকা। প্রায়ই সে বাবার বাড়ি চলে যায়, তালিকাটা সে জন্যেই। আজ এই তালিকা পড়তে গিয়ে শাহেদের চোখে পানি এসে গেছে।
চাল, ডাল, মুড়ি–টিনে ভরা। রুনির ঘরে। চৌকির নিচে।কাপড় ধোবার সাবান, মোমবাতি, দেয়াশলাই— রান্নাঘরের তাকে। সর্ববামে।মশলা, লবণ–রান্নাঘরের তাকে। সর্ব ডানে। কৌটার গায়ে কী মসলা নাম লেখা আছে।চা, চিনি–মিটাসেফের উপরে।পেয়াজ, রসুন, আদা— মিটসেফের পাশের খলুইয়ে।সরিষার তেল–চুলার পাশে।ভালোবাসা–আমার কাছে। আমি যেখানে থাকি সেখানে।
আসমানীর পক্ষেই সম্ভব কাজের কথা লিখতে লিখতে হঠাৎ মজার কিছু লিখে ফেলা। তেল, মসলার কথা লিখতে লিখতে লেখা ভালোবাসা–আমার কাছে। আমি যেখানে থাকি সেখানে।বিয়ের রাতেও সে এরকম মজা করল। বাসর হচ্ছে আসমানীদের কলাবাগানের বাড়িতে। দোতলার বড় একটা ঘর। ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। ঘরে পা দিয়েই শাহেদের মনে হলো— আসমানী কি এত সুন্দর! সে আগেও তো কয়েকবার দেখেছে।
এত সুন্দর তো তাকে কখনো মনে হয় নি? শাহেদ খাটে বসতে বসতে বলল, আজ কী রকম গরম পড়েছে দেখেছ? (সে ঠিক করে রেখেছিল প্রথম যে বাক্যটি বলবে তা হচ্ছে–আসমানী কেমন আছ? বলার সময় সম্পূর্ণ অন্য কথা বের হয়ে এলো। বলার সময় বলে বসল— আজি কী গরম পড়েছে দেখেছি? যেন সে দেশের আবহাওয়া নিয়ে খুবই চিন্তিত।)
শাহেদের কথার উত্তরে আসমানী মুখ তুলে তাকাল। শান্তগলায় স্পষ্টভাবে বলল, গরমের সময় গরম তো পড়বেই। গরমকালে গরম পড়বে, ঠাণ্ডাকালে ঠাণ্ডা। আপনার জন্যে তো আল্লাহ আবহাওয়া বদলে দেবেন না।শাহেদ হতভম্ব! হড়বড় করে এইসব কী বলছে? বিয়ের টেনশনে, অত্যধিক গরমে কি তার মাথা আউলায়ে যাচ্ছে?
আসমানী বলল, চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? কোনো পুরুষমানুষ এইভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার রাগ লাগে। আমি কিন্তু চোখ গেলে দেব।আতঙ্কে অস্থির হয়ে শাহেদ খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই আসমানী হোসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, সরি। কিছু মনে করো না। আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করেছি। আমি আমার দুই খালাতো বোনের সঙ্গে বাজি ধরেছি।
বাসর রাতে আমি যদি তোমাকে ভয় দেখাতে পারি, তাহলে তারা আমাকে একশ টাকা দেবে। ওরা দুজনেই জানালার ফাঁক দিয়ে আমাদের দেখছে। তুমি দাড়িয়ে আছ কেন? বসো।শাহেদ বসল। সে তখনো পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে অদ্ভুত সুন্দর এই মেয়েটি আবারও উদ্ভট কিছু করবে। আসমানী বলল, তুমি কি রাগ করেছি?
শাঙ্গেদ ভীত গলায় বলল, না।আসমানী বলল, প্রথম রাতেই তোমাকে ভয় দেখিয়ে দিলাম। কাজটা খুব খারাপ করেছি। এতে কী হবে জানো–সারাজীবন তুমি আমাকে ভয় করে চলবে।শাহেদ এসে বারান্দায় বসেছে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। গুমোট গরম কমতে শুরু করেছে; ভেতর থেকে মাঝে মাঝে গৌরাঙ্গ গোঙানির মতো শব্দ করছে। যেন কেউ তার গলায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সে চিৎকার করতে গিয়েও করতে পারছে না। একটা ব্যাপার দেখে শাহেদ খুবই অবাক হচ্ছে–গৌরাঙ্গের ভয়াবহ দুঃসময় তাকে তেমন স্পর্শ করছে না। যেন গৌরাঙ্গের এই সমস্যায়। তার কিছু যায় আসে না। ভয়াবহ দুর্যোগের সময় মানুষ কি বদলে যায়? তখন নিজের সুখ নিজের দুঃখই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়? দেশের সব মানুষই কি বদলাতে শুরু করেছে? আসমানী বদলে যাচ্ছে? রুনি বদলে যাচ্ছে?
শাহেদ আসমানীর কথা ভাবতে চাচ্ছে না। আসমানীর কথা মনে করলেই বুকের ভেতর কেমন জানি করছে। কী একটা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আসমানী এখন আছে কোথায়? কী করছে? সেও কি তার মতো জেগে আছে। গল্পের বই পড়ছে না-কি? নিশিরাতে গল্পের বই পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠা তার পুরনো রোগ। একবার তো আসমানীর কান্নার শব্দে সে ঘুম ভেঙে উঠে বসে নাই। ঘুমাও। গল্পের বই পড়ে কাদছি।কী বই? তারাশংকর লেখা একটা বই, নাম–বিপাশা।বই পড়ে কাদার কী আছে?
আমার স্বভাবই এরকম। নিজের দুঃখে আমি কাদি না। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রদের দুঃখে আমি কাদি।তোমার মাথা কিন্তু সামান্য খারাপ আছে।তা তো আছেই। পুরোপুরি সুস্থ মাথার একটা মেয়েকে বিয়ে করো। তোমরা সুখে সংসার করো। আমি দূর থেকে দেখে খুব মজা পাব।শাহেদ বিরক্ত হয়ে বলল, এইসব কী ধরনের কথা? আসমানী বলল, খুবই ভালো কথা। আমি নিজে এসে তোমাদের সংসার সাজিয়ে দিয়ে যাব। বিয়ে করবে? প্লিজ প্লিজ।
বাতি নেভাও। বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে আসো।
না, ঘুমাব না। বইটা আমি আবার পড়ব।
এখন?
হ্যাঁ এখন। গল্পের শেষ না জেনে পড়ার এক ধরনের আনন্দ। আবার শেষ জেনে পড়ার অন্য ধরনের আনন্দ। বাতি জ্বলিয়ে রাখলে তোমার যদি অসুবিধা হয়, তাহলে আমি বরং অন্য ঘরে যাই।যা ইচ্ছা করো।বৃষ্টি বাড়ছে। সঙ্গে সামান্য বাতাসও আছে। বাতাসে ছাতিম গাছের পাতা নড়ছে। বারান্দা থেকে গাছটাকে এখন জানি কেমন ভৌতিক লাগছে। এই গাছ দেখে একবার আসমানী খুব ভয় পেয়েছিল।
রাতের বেলা তার ঘুম ভেঙেছে, সে এক গ্রাস পানি হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে বসেছে। কিছুক্ষণ পরই বিকট চিৎকার। ঘুম ভেঙে শাহেদ ছুটে এসে দেখে, আসমানী থারথার করে কাঁপছে। তার হাত থেকে পানির গ্রাস পড়ে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়েছে। শাহেদ বলল, কী হয়েছে? আসমানী বিড়বিড় করে বলল, গাছটা মানুষের মতো হাত নেড়ে ডেকেছে।শাহেদ বলল, বাতাসে পাতা নড়েছে, তোমার কাছে মনে হয়েছে। অন্য কিছু।আসমানী কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি ছোট বাচ্চা না, আমি জানি কী হয়েছে।ভয়ে সেই রাতেই আসমানীর জ্বর উঠে গেল।
না, সে এখন আসমানীর কথা ভাববে না। সে নিশ্চয়ই ভালো আছে। সে আছে তার বাবা-মার সঙ্গে। একজন সন্তান সবচে নিরাপদে থাকে যখন সে বাবা-মার সঙ্গে থাকে। তার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না–কাল অবশ্যই দেখা হবে। আগামীকাল কারফিউ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সে যাবে মিরপুর দশ নম্বরে। সেখানে আসমানীর এক খালা থাকেন। তিনি নিশ্চয়ই কোনো খবর দিতে পারবেন। আসমানীর সরাসরি কোনো খবর না পেলেও তার অন্য আত্মীয়দের ঠিকানা তার কাছ থেকে নেবে।
মিরপুর যাবার পথে সোবাহান সাহেবদের খোঁজ নিয়ে যেতে হবে। তারা নিশ্চয়ই আজও অপেক্ষা করে বসেছিলেন। সোবাহান সাহেবদের নিরাপদ কোনো জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে।গৌরাঙ্গ! তার ব্যাপারটা কী? গৌরাঙ্গ কি তার কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাবে? না-কি এখানে থাকবে? এখানে থাকতে কোনো সমস্যা নেই। যতদিন ইচ্ছা থাকতে পারবে। আসমানী যদি এর মধ্যে চলে আসে, তাহলে কোনো অসুবিধাই হবে না। আসমানীর মেজাজ যখন ঠিক থাকে, তখন সে অসাধারণ একটি মেয়ে। গৌরাঙ্গের ভয়াবহ কষ্ট অনেকখানি কমিয়ে দেয়া কোনো ব্যাপারই না।
মিতা! মিতা!
ভারী গলায় গৌরাঙ্গ ডাকছে। শাহেদ ভেতরে গেল। গৌরাঙ্গ খাটে বসে। আছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। তার মুখও হা হয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। শাহেদ বলল ভাত-ডাল রান্না করেছি। কিছু খাবে?
গৌরাঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে বলল, হুঁ।
নামো বিছানা থেকে। দাড়াও আমি ধরছি।
শাহেদ ধরাধরি করে গৌরাঙ্গকে নামাল। গৌৰাঙ্গ বলল, মিতা, আমার স্নান করতে হবে। আমি তিনদিন স্নান করি নাই।শাহেদ বলল, বাথরুমে পানি আছে, সাবান আছে। গরম পানি করে দেব? দাও। মিতা শোন, আমি কিন্তু তোমার এখানে থাকব। আমি অন্য কোনোখানে যাব না।কোনো অসুবিধা নেই। থাকবে।আগারগাঁও-এ আমার এক মামা থাকেন। ওয়্যারলেস অফিসার না-কি কী যেন। আমি উনার কাছেও যাব না।
তোমার যত দিন ইচ্ছা তুমি থাকবে।মিতা আমার বুকে ব্যথা করছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।গরম পানি দিয়ে গোসল করে। গোসল করলে আরাম পাবে।গৌরাঙ্গ ক্ষীণ গলায় বলল, আচ্ছা। মিতা আমার হাত-পা কেমন শক্ত হয়ে গেছে। হাত-পা নাড়তে পারছি না। এই দেখ, আঙুল বঁকা করতে পারছি না।গৌরাঙ্গ হাত উচু করে দেখাল। তার আঙুল ঠিকই বঁকা হচ্ছে।
মিতা দেখেছি আঙুল বাঁকছে না।
শাহেদ বলল, ঠিক হয়ে যাবে।
গৌরাঙ্গ বলল, কখন ঠিক হবে?
শাহেদ বলল, ভোর হোক।
গৌরাঙ্গ বলল, আচ্ছা।
আরেকটি ভোর হয়েছে। আগে একটি ভোরের সঙ্গে আরেকটি ভোর আলাদা করা যেত না। এখন আলাদা করা যায়। এখন মনে হয় প্রতিটি ভোর আলাদা।কারফিউ উঠেছে। লোকজন রাস্তায় নেমেছে। শাহেদ বের হয়েছে। গৌরাঙ্গকে নিয়ে। গৌরাঙ্গের শরীরের অবস্থা ভালো না। তাঁর গায়ে জ্বর। কিন্তু সে এক কিছুতেই বাসায় থাকবে না। একা বাসায় বসে থাকলে সে না-কি ভয়েই মরে যাবে। রাস্তায় নেমেও আরেক বিপদ, সে একটু পর পর বলছে–মিতা ফিরে চল। মিতা ভয় লাগছে, ফিরে চল। শাহেদের খুবই বিরক্ত লাগছে।
ফিরে যাবার প্রশ্নই উঠে না।যে করেই হোক আসমানীদের খোঁজ বের করতে হবে। প্রথমে যেতে হবে মিরপুর দশ নম্বর, তার খালার বাড়িতে। বাড়ির নাম্বার সে জানে না। আগে দুবার এসেছে, কাজেই তার ধারণা সে বাড়ি চিনবে। তবে মিরপুর যাবার আগে তাকে সোবাহান সাহেবের খোজে যেতে হবে। এরা নিশ্চয়ই আতঙ্কগ্ৰস্ত হয়ে অপেক্ষা করছে। গতকাল শাহেদ যায় নি। বৃদ্ধ ভদ্রলোক নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করছেন।
সোবাহান সাহেবদের বাড়ির সদর দরজায় তালা ঝুলছে। বেশ বড় তালা। মনে হচ্ছে তারা গতকাল বাসা ছেড়ে নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে গেছে। ঢাকা শহরের মানুষ কোনোখানেই এখন নিশ্চিন্তু বোধ করছে না। তারা শুধুই জায়গা বদল করছে। দরজায় তালাবন্ধ, তারপরেও শাহেদ অনেকক্ষণ কড়া নাড়ল। ঢাকা শহরে আরেকটি নিয়ম এখন চালু হয়েছে। সদর দরজায় তালা লাগিয়ে বাড়ির ভেতরে বসে থাকা। মিলিটারি যদি আসে তাহলে যেন তালা দেখে মনে করে এই বাড়িতে লোকজন নেই।
গৌরাঙ্গ বলল, মিতা চল, বাসায় ফিরে যাই। কেউ তো নাই।
শাহেদ বলল, আমাকে মিরপুর যেতেই হবে।
গৌরাঙ্গ বলল, মিতা, আমার খুব ভয় লাগছে।
ভয় লাগলে তুমি বাসায় চলে যাও। আমাকে যেতেই হবে। যে করেই হোক আমাকে আসমানীর খোঁজ বের করতে হবে।মিতা, আমি একা বাসায় থাকব না। আমি ভয়েই মরে যাব। আমি খুবই ভীতু।শাহেদ জবাব দিল না। কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় তার হাতে নেই। তাকে এখন কোনো বেবিট্যাক্সি খুঁজে বের করতে হবে। বেবিট্যাক্সি না পাওয়া গেলে শক্ত-সমর্থ শরীরের কোনো রিকশাওয়ালা, যে তাকে অতি দ্রুত মিরপুর পৌঁছে দেবে। হাতে সময় অল্প। বারোটা থেকে আবার কারফিউ শুরু হবে।
Read more