জোছনা ও জননীর গল্প পর্ব – ২৩ হুমায়ূন আহমেদ

জোছনা ও জননীর গল্প পর্ব – ২৩

মানুষের জীবন এমন যে একবার জট পাকিয়ে গেলে জট বাড়তেই থাকে। রাত জেগে আসমানী বেশ কয়েকটা চিঠি লিখল। শাহেদকে, তার মাকে, নীলগঞ্জে শাহেদের বড়ভাইকে, চিটাগাং-এর ছোটমামাকে। চিঠিতে নিজের ঠিকানা জানাল। কীভাবে মুন্সিগঞ্জের অজপাড়াগায়ে চলে এসেছে তা লিখল। ডাক বিভাগ কোনো দিন চালু হবে কি-না তা সে জানে না। যদি কখনো চালু হয়, তাহলে যেন আসমানীর আত্মীয়স্বজনরা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারেন আসমানী কোথায় আছে।

দেশের অবস্থা কি ভালো হবে? যদি হয় সেটা কবে? কত দিন আসমানীকে একটা অপরিচিত জায়গায় একদল অপরিচিত মানুষের সঙ্গে থাকতে হবে? আসমানী জানে না। শুধু আসমানী কেন, দেশের কেউই বোধহয় জানে না।বিবিসি থেকে ভয়ঙ্কর সব খবর দিচ্ছে। সারাদেশে নাকি গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। একটা গৃহযুদ্ধ কত দিন চলে? ছয় মাস, এক বছর, সাত বছর? বাংলাদেশের এই গৃহযুদ্ধ কত দিন চলবে? সাত বছর যদি চলে, এই সাত বছর তাকে মুন্সিগঞ্জের দারোগাবাড়িতে পড়ে থাকতে হবে?

আর পাগলটা যখন-তখন তার মেয়েকে ভয় দেখাবে? তার অতি আদরের মেয়েকে বান্দি ডাকবে? শাহেদকে লেখা চিঠির সে দুটা কপি করল। একটা যাবে বাসার ঠিকানায়, একটা অফিসের ঠিকানায়। কোনো না কোনোদিন শাহেদ নিশ্চয়ই অফিসে যাবে। অফিসে যাওয়া মাত্রই সে যেন চিঠিটা পায়। শাহেদের চিঠি সম্বোধনবিহীন। বিয়ের আগেও আসমানী শাহেদকে অনেক চিঠি লিখেছে।

তার কোনোটিতেই সম্বোধন ছিল না। কী লিখবে সে? প্রিয়তমেষু, সুপ্রিয়, সুজনেষু, নাকি সাদামাটা শাহেদ। তার কখনো কিছু লিখতে ইচ্ছে করে নি। আসমানীর ধারণা শাহেদের জন্য যে সম্বোধন তার মনে আছে সেই সম্বোধনের কোনো বাংলা শব্দ তার জানা নেই।আসমানী চিঠিতে খুব সহজ-স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে। এমনভাবে চিঠিটা লিখেছে যেন সে পিকনিক কালতে মুন্সিগঞ্জের এক গ্রামে এসেছে। পিকনিকে খুব মজা হচ্ছে। পিকনিক শেষ হলেই ফিরে আসবে।

সে লিখেছে–

তুমি নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে আমাদের খুঁজে বেড়ােচ্ছ। অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আমরা ভালো আছি। খুব ভালো। নিজেদের জন্য আমাদের দুশ্চিন্তা নেই, তবে তোমার জন্য খুব দুশ্চিন্তা করছি।কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে এসেছি বলে আবার রাগ করছি না তো? প্লিজ, রাগ করো না। আর রাগ করে তো লাভও কিছু নেই। দূর থেকে তোমার রাগ ভাঙাবার জন্য কিছু করতে পারছি না। যে রাগ কেউ জানতে পারছে না, সেই রাগ করাটা অর্থহীন নয় কি?

ও, আমরা কোথায় আছি সে-খবর এখনো তোমাকে দেওয়া হয় নি। আমরা ঢাকার খুব কাছাকাছিই আছি। জায়গাটার নাম মুন্সিগঞ্জ। মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাট থেকে দশ মাইল যেতে হয়। গ্রামের নাম সাদারগঞ্জ। যে বাড়িতে আছি সেই বাড়িরও একটা নাম আছে। দারোগাবাড়ি। যিনি এ বাড়ি বানিয়েছেন তিনি একসময় দারোগা ছিলেন। তার নাম সরফরাজ মিয়া।

ভদ্রলোক এখনো জীবিত! কিঞ্চিৎ মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়েছে। যখন-তখন বন্দুক নিয়ে বের হয়ে আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি করেন। আমরা এ বাড়িতে আসার পরদিনই এই কাণ্ড করেছেন। এখন তার বন্দুকের সব গুলি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বন্দুকটাও লুকিয়ে ফেলার কথা হচ্ছিল–শেষ পর্যন্ত লুকানো হয় নি। কাবণ সবার ধারণা বন্দুক লুকিয়ে ফেললে তার পাগলামি আরো বেড়ে যাবে।

এখন তোমাকে বলি দারোগাবাড়িতে কীভাবে এলাম। তোমার সঙ্গে রাগ করে আমি আমার বান্ধবী কুমকুমাদের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। তাদের বাড়ি গেণ্ডারিয়ায়। কুমকুমের বাবা মোতালেব সাহেব আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। কুমকুমের মা-ও আমাকে তার মেয়ের মতোই দেখেন। ২৫ মার্চের ভয়াবহ ঘটনার পর কুমকুমের বাড়ির সবাই গেল ঘাবড়ে। আশপাশের সবাই পালাচ্ছে।

তারাও পালাবার জন্য তৈরি। এদিকে তোমার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আমাদের বাসা তালাবন্ধ করে কোথায় যে তুমি পালিয়েছ তুমিই জানো। শুধু যে আমাদের বাসা তালাবন্ধ তাই না–মার বাড়িও তালাবন্ধ।এরকম অবস্থায় আমি বাধ্য হয়ে মোতালেব চাচার সঙ্গে চলে এসেছি। দারোগাবাড়ির সরফরাজ মিয়া হলেন মোতালেব চাচার বাবা।

যা-ই হোক, মোতালেব চাচার গেণ্ডারিয়ার বাসায় মজনু বলে একজন আছে। তার দায়িত্ব হচ্ছে রোজ একবার তোমার খোজে যাওয়া। আমার ধারণা ইতিমধ্যে সে তোমার খোঁজ পেয়ে গেছে এবং তুমি জানো আমরা কোথায় আছি, কীভাবে আছি।

রুনি তোমাকে খুব মিস করছে। তবে মিস করলেও সে ভালো আছে। মন নিশ্চয়ই ভালো নেই।— কিন্তু শরীরটা ভালো। যে-অবস্থার ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি সে অবস্থায় শরীরটা ভালো রাখা ও কম কথা না। কী বলো? তুমি ভালো থেকে। অনেক অনেক আদর।

ইতি

আসমানী

আসমানীর ইচ্ছা করছিল–অনেক অনেক আদর-এর জায়গায় সে লেখে অনেক অনেক চুমু। লজ্জার জন্য লিখতে পারল না। তার মনে হচ্ছিল। কেউনা-কেউ তার চিঠি খুলে পড়ে ফেলবে। সেটা খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।চিঠিটা শেষ করার পরপরই আসমানীর মনে হলো যেন আসল কথাটাই লেখা হয় নি। যদিও সে জানে না। আসল কথাটা কী। সে আরেকটা চিঠি লিখতে শুরু করল। এই চিঠির সম্বোধন আছে। সম্বোধন লিখতে লিখতেই তার চোখ ভিজে গেল। সে লিখল–

এই যে বাবু সাহেব, তুমি কোথায়, তুমি কোথায়, তুমি কোথায়? আমি মরে যাচ্ছি। তোমাকে না দেখতে পেলে আমি মরে যাব। আমি সত্যি মরে যাব। তুমি কি জানো এখন আমি কারো কথাই ভাবি না। মার কথা না। বাবার কথা না। ভাইবোন কারো কথাই না। আমি সারাক্ষণ ভাবি তোমার কথা। এই বাড়িতে খুব সুন্দর একটা পুকুর আছে। পুকুরের ঘাট বাঁধানো।

অনেক রাতে আমি রুনিকে ঘুম পাড়িয়ে ঘাটে এসে বসে থাকি। তখন শুধু তোমার কথাই ভাবি। আমি দেশের স্বাধীনতা চাই না–কোনো কিছু চাই না। শুধুই তোমাকে চাই। কেন এরকম হলো? কেন আমি তোমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলাম? তোমার দেখা পেলে আর কোনোদিন তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। আমি আর পারছি না। তুমি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরো। কবে আসবে, কবে আসবে, কবে আসবে?

তোমার আসমানী

কয়েকদিন থেকেই আসমানী খুব চেষ্টা করছে রুনির মন থেকে সরফরাজ মিয়ার ভয় ভাঙানো। যাতে সে রাতদিন ঘরে বসে না থেকে বাড়ির বাগানে হেঁটে বেড়াতে পারে। শহরের ঘিঞ্জিতে যে মেয়ে বড় হয়েছে গ্রামের খোলামেলায় সে মহানন্দে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। রুনি তা করছে না। সে দোতলা থেকে একতলায়ও নামবে না। মাঝেমধ্যে বারান্দায় এসে ভীত চোখে সরফরাজ মিয়াকে দেখবে, তারপর আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকে যাবে।

এই বয়সে মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেলে সেই ভয় কিছুতেই দূর হয় না। ভয় গাছের মতো মনের ভেতর শিকড় ছড়িয়ে দেয়। সেই শিকড় বড় হতে থাকে। ভয়টাকে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলা দরকার। কীভাবে তা করা যাবে তা আসমানী জানে না। সরফরাজ মিয়া যদি রুনিকে কাছে ডেকে আদর করে দুটা কথা বলেন, তাতে কি কাজ হবে?

আসমানী পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তারপরও সে সরফরাজ মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গেল। বৃদ্ধ মানুষটা মোটামুটি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আসমানীর সঙ্গে কথা বললেন।খুপরি দিয়ে তিনি জবা গাছের নিচের মাটি আলগা করে দিচ্ছিলেন। আসমানী সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, কেমন আছ গো মা?

আসমানী বলল, জি ভালো আছি।সম্পর্কে তুমি আমার নাতনির মতো, তারপরও মা বললাম। রাগ করবা না মা। যে-কোনো মেয়েকে মা ডাকা যায়। রাগ করব না। বুঝছি রাগ করব না।জি-না, আমি রাগ করব না।এই বাড়িটা তোমার নিজের বাড়ি–এরকম মনে করে থাকবা। আমি দেখি প্রায়ই তুমি দিঘির ঘাটলায় বসে থাক। ঘাটলাটা কি তোমার পছন্দ?

জি খুব পছন্দ।শুনে আনন্দ পেলাম। অনেক যত্ন করে বাড়ি বানিয়েছি। দিঘি কেটেছি। ঘাট বানিয়েছি। বাগান করেছি–দেখার কেউ নাই। আমি এক পড়ে থাকি। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া যে সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। সংগ্রাম শুরু হয়েছে বলেই তোমরা এসেছ। ঠিক না মা?

জি ঠিক।ঐ দিন তোমার মেয়েটা বড় ভয় পেয়েছে। আমি খুবই শরমিন্দা। মাঝেমাঝে কী যে হয়–মাথার ঠিক থাকে না। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে। বয়সের কারণে এসব হয়; বয়স খুব খারাপ জিনিস।আপনি আমার মেয়েটাকে ডেকে একটু আদর করে দিন।করব গো মা। করব। সময় হলেই করব। সব কিছুরই একটা সময় আছে, জ্যৈষ্ঠ মাসে আম পাকে, কার্তিক মাসে পাকে না–বুঝলা মা? আসমানী বলল, আমি যাই?

সরফরাজ মিয়া মুখ না তুলেই বললেন, আচ্ছা মা যাও। একটা কথা— মন প্রস্তুত করো। আমাদের জন্য খুব খারাপ সময়। বিষয়টা আমি স্বপ্নে পেয়েছি। স্বপ্নে আমি অনেক জিনিস পাই। দেশে আগুন জ্বলবে গো মা— আগুন জ্বলবে। তোমার কন্যাকে কোলে নিয়ে তোমাকে পথে পথে ঘরতে হবে। এইটা কোনো পাগল ছাগলের কথা না। স্বপ্নে পাওয়া কথা।আসমানী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটা এইসব কী বলছেন?

বিকৃত মস্তিষ্ক একজন মানুষের কথাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার কোনোই কারণ নেই। তারপরেও কেমন যেন লাগে।বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আরেকটা কথা গো মা। তোমার স্বামী কাছে নাই। তোমার চেহারা সুন্দর। তোমার অল্প বয়েস। মেয়েদের প্রধান শক্ৰ তার সুন্দর চেহারা আর অল্প বয়েস। তুমি অনোর বাড়িতে আশ্রিত। এই অবস্থায় নানান বিপদ আসতে পারে। নিজেরে সামলায়ে চলবা।

আসমানী বৃদ্ধের এই কথা ফেলে দিতে পারছে না। সে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সমস্যা আঁচ করতে পারছে। সমস্যাটা এরকম যে কাউকে বলতেও পারছে না। কারো কাছে পরামর্শও চাইতে পারছে না। তার বান্ধবী কুমকুমের বাবার ভাবভঙ্গি তার একেবারেই ভালো লাগছে না। সাত্ত্বনা দিতে গিযে তিনি প্রায়ই আসমানীর পিঠে হাত রাখেন। আসমানী তার কন্যার বান্ধবী। তিনি অবশ্যই পিঠে হাত রাখতে পারেন। কিন্তু আসমানী জানে এই স্পর্শটা ভালো না।

মেয়েরা ভালো স্পর্শ মন্দ স্পর্শ বুঝতে পারে।একদিন আসমানী পুকুরে গোসল করছিল। মোতালেব সাহেব হঠাৎ গামছা হাতে উপস্থিত। তিনিও পুকুরে নামবেন। আসমানী সঙ্গে সঙ্গে উঠে যেতে চাচ্ছিল। তিনি বললেন, উঠবা না উঠবা না, ঘাট খুব পিছল। আমি তোমাকে ধরে ধরে নামব। বলতে বলতেই তিনি এলেন। আসমানীর হাত ধরলেন। হাত ছেড়ে দিয়ে পরের মুহূর্তেই তিনি আসমানীর বুকে হাত রাখলেন। যেন এটা একটা দুর্ঘটনা। হঠাৎ ঘটে গেছে।

আসমানী চট করে সরে গেল। তার হাত-পা কাঁপতে লাগল। তার মনে হলো, এক্ষুনি সে মাথা ঘুরে পুকুরের পানিতে পড়ে যাবে। মোতালেব সাহেব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, পানি তো দেখি ঠাণ্ডা। তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না? আসমানী জবাব দিল না। সে উঠে আসবে কিন্তু তার পা এখনো স্বাভাবিক হয় নি। পা নড়াতে পারছে না। মোতালেব সাহেব বললেন, মিলিটারির ঘটনা শুনেছি? চকের বাজার পর্যন্ত এসে পড়েছে। হিন্দুর বাড়িঘর টার্গেট করেছে।

মেয়েগুলিরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ধরেই কী করে শোন, সব কাপড়াচোপড় খুলে নেংটা করে ফেলে। তারপর বড় একটা ঘরে রেখে দেয়। ঘরের দরজা বন্ধ করে না। গায়ের কাপড়চোপড় নাই–এই অবস্থায় তারা পালাতেও পারে না। দিনের বেলায় মিলিটারিরা অপারেশন করে। রাতে মেয়েগুলারে নিয়ে ফুর্তি করে। ভয়াবহ অবস্থা।আসমানী পুকুর থেকে উঠে আসছে। মোতালেব সাহেব পেছন থেকে ডাকলেন, যাও কোথায়? পাঁচটা মিনিট থাকে।

গোসল সেরে এক সঙ্গে যাই। আমার বয়সে পুকুরে একা একা গোসল করা ঠিক না। কখন ষ্ট্রোক হয় কে বলবে। স্ট্রোক হয়ে পানিতে পড়ে গেলে তুমি টেনে তুলতে পারবে? সে এখন কী করবে? চাচিকে গিয়ে বলবে, চাচি, আপনার স্বামী আমার বুকে হাত দিয়েছেন।আসমানীর শরীর কেমন যেন করছে। সে বাড়িতে পা দিয়েই বমি করল। মাথা এমন করে ঘুরছে যে তাকে বসে পড়তে হলো।

সে এখন প্রায় নিশ্চিত যে, হঠাৎ তার এই শরীর খারাপের কারণ শুধু মোতালেৰ চাচা না—তার শরীরে নতুন একটা প্রাণের সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে রওনা হবার সময়ই তার ক্ষীণ সন্দেহ ছিল। এখন আর সন্দেহ নাই।আসমানী বসে আছে। উঠে দাঁড়াবার মতো জোর সে পাচ্ছে না।ফজরের নামাজ সময়মতো পড়তে পাবেন নি, এ জাতীয় দুর্ঘটনা ইরতাজউদ্দিনেব দীর্ঘ জীবনে কখনো ঘটে নি। সব মানুষের শরীরের ভেতর একটা ঘড়ি আছে।

সেই ঘড়ি নিঃশব্দে টিকটিক করে সময় রাখে। যখন যা মনে করিয়ে দেবার মনে করিয়ে দেয়। ইরতাজউদ্দিন সাহেবের ঘড়িতে কোনো গোলমাল হয়েছে। ফজর নামাজের ওয়াক্তে তার ঘুম ভাঙল না। যখন ঘুম ভাঙল তখন বেশ বেলা হয়েছে। পায়ের কাছে রোদ ঝলমল করছে। লজা ও অনুশোচনার তার সীমা রইল না। কী ভয়ঙ্কর কথা! ফজরের নামাজ ছাড়া তার দিন শুরু হতে যাচ্ছে?

গতরাতে ঘুমোতে যেতে অনেক দেরি হয়েছিল। এই কারণেই কি ভোরে ঘুম ভাঙে নি? এটা কোনো যুক্তি না। মানুষ একটা ভুল করলে ভুলের পক্ষে একের পর এক যুক্তি দাঁড়া করায়। এটা ঠিক না। ভুলকে ভুল হিসেবে স্বীকার করে নেয়াই ভালো। ইরতাজউদ্দিন মন খারাপ করে অজু করলেন। নামাজ পড়লেন। নামাজের সময পার হয়ে যাবার পরেও তাকে কাজ পড়তে হলো না।

কারণ আমাদের নবি–এ-করিম একবার অতিরিক্ত ঘুমের কারণে ফজরের নামাজ সময়মতো পড়তে পারেন নি। তার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যেই এই বিশেষ ব্যবস্থা। ফজরের নামাজ কাজা ছাড়াই দুপুর পর্যন্ত পড়া যাবে। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে ইরতাজউদিনের মনে হলো, কী অসাধারণ মানুষ ছিলেন আমাদের নবি! তার প্রতিটি কাজ, প্রতিটি কর্ম কত না শ্ৰদ্ধা কত না ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।

ইরতাজউদ্দিন নিজেকে শাস্তি দেবার জন্যে সকালে নাশতা খেলেন না। স্কুলের দিকে বাওনা হলেন ঠিক সাড়ে নটায়। স্কুলে পৌঁছতে পনেরো মিনিট লাগে। তারপরেও হাতে থাকে। পনেরো মিনিট। ক্লাস শুরু হয় দশটায়। এখন অবশ্যি কোনো ক্লাস হচ্ছে না। ছাত্ররা আসছে না। স্কুল বন্ধ থাকবে না খোলা থাকবে–এধরনের কোনো সরকারি ঘোষণাও নেই। কিছু শিক্ষক আসেন। কমনরুমে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে যে যার বাড়ি চলে যান।

গল্পগুজবের একমাত্র বিষয়–দেশের কী হচ্ছে? শিক্ষকদের প্রায় সবাইকেই দেখা যায় আনন্দিত ভঙ্গিতে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। পাকিস্তানি মিলিটারি যে ভয়াবহ জিনিস–এ ব্যাপারে তারা অতি দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছেন। কোনো এক বিচিত্র কারণে পাকিস্তানি মিলিটারির শৌর্যবীর্যের কথা বলতে এদের ভালো লাগে।

শুনেছেন না-কি, সব তো একেবারে শোয়ায়ে ফেলেছে। যেদিকে যাচ্ছে একেবারে শ্মশান বানিয়ে যাচ্ছে।জ্বালাওপোড়াও বলে এত যে লাফালাফি ঝাঁপঝাঁপি, এক ধাক্কায় শেষ। পাকিস্তানি মিলিটারি কী জিনিস যে জানে সে জানে।এদের মধ্যে কিছু আছে যাদের এরা অন্ধকারে চেইন দিয়ে বেঁধে রাখেসাক্ষাৎ আজরাইল। দরকারের সময় ছাড়ে–তখন আর কোনো উপায় থাকে না। এদের এখনো ছাড়ে নাই। ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ লাগলে ছাড়বে। তার আগে ছাড়ার দরকার নাই।

দয়ামায়া বলে এক বস্তু এদের মধ্যে নাই। এরা হলো ধর তক্তা মার পেরেক টাইপ। তক্তা একবার ধরলে পেরেক মেরে ছেড়ে দিবে।পেরেক মারতে মারতে আসছে। পেরেক মেরে বাঙালি সিধা করে দেবে। বাঙালি ভেবেছিল সিংহের সাথে সাপলুড়ু খেলবে। সিংহ সাপলুড়ু খেলে না।মিলিটারিবিষয়ক আলাপ-আলোচনার শেষে ঝালমুড়ি দিয়ে চা খাওয়া হয়। আগে পত্রিকা নিয়ে টানাটানি করা হতো, এখন পত্রিকা আসছে না বলে সেই পর্ব হয় না।

অংক স্যার ছগিরউদ্দিন এক দুই দান দাবা খেলেন স্কুলের ইংরেজি স্যার কালিপদ বাবুর সঙ্গে। কালিপদ বাবু তুখোড় খেলোয়াড়–কাজেই প্ৰতিবারই তিনি হারেন এবং হেরে কিছু চিল্লাচিল্লি করেন। এই হলো এখনকার স্কুলের রুটিন। রুটিনের তেমন কোনো হেরফের হয় না। উত্তেজনাহীন জীবনে মিলিটারি। আসছে। এই একমাত্র উত্তেজনা। এই নিয়ে কথা বলতেও তাদের ভালো লাগে। এতেও কিছুটা উত্তেজনা পাওয়া যায়। খারাপ ধরনের উত্তেজনা। তাতেই বা ক্ষতি কী? মিলিটারি নীলগঞ্জে কবে নাগাদ আসবে?

দেরি নাই। আসলো বলে। ময়মনসিংহ চলে এসেছে। যে-কোনোদিন নীলগঞ্জ চলে আসবে। খবর দিয়ে তো আসবে না। হঠাৎ শুনবেন আজাদহা উপস্থিত। মেশিনগানের ট্যাট ট্যাট গুলি।ভয়ের কথা, কী বলেন? ভয়ের কথা তো বটেই। এরা সাক্ষাৎ আজরাইল। মুখের কথার আগেই গুল্লি। হিন্দু হলে ছাড়ান নাই।হিন্দু মুসলমান বোঝে কীভাবে?

কাপড় খুলে খৎনা দেখে। তারপরে চার কলমা জিজ্ঞেস করে। কলমায় উনিশ বিশ হয়েছে কি গুল্লি।চার কলমা তো আমি নিজেও জানি না।মুখস্থ করেন, তাড়াতাড়ি মুখস্থ করেন। মিলিটারি এসে পড়লে আর মুখস্থ করার সময় পাবেন না। ময়মনসিংহের এডিসির যে দশা হয়েছে সেই দশা হবে।উনার কী হয়েছিল?

চার কলমা জিজ্ঞেস করেছে। কলমা তৈয়ব বলেছে ঠিকঠাক। কলমা শাহাদতে গিয়ে বেড়াছেড়া করল। তখন জিজ্ঞেস করল বেতেরের নামাজের নিয়ত। পারল না–সঙ্গে সঙ্গে গাংগানির পাড়ে নিয়ে দুম দুম দুই গুল্লি।

বেতেরের নামাজের নিয়তও জিজ্ঞেস করে?

সব জিজ্ঞেস করে। পাকিস্তানি মিলিটারি ধর্মের ব্যাপারে খুব শক্ত।

বিপদের কথা।

বিপদ মানে বিপদ, মহাবিপদ।

রোজ কেয়ামত বলতে পারেন। বিপদের আশঙ্কায় কাউকে তেমন চিন্তিত মনে হয় না। নীলগঞ্জ গ্রামের রৌদ্রকরোজুল দিন। ঝকঝকি করছে এপ্রিলের নীলাকাশ। খেতে খামারে কাজ কর্ম হচ্ছে–চিন্তিত হবার কী আছে। শহরে ঝামেলা হচ্ছে। শহরে ঝামেলা হয়েই থাকে। শহরের ঝামেলা গ্রামকে স্পর্শ করে না। রাজা আসে রাজা যায়–এ তো বরাবরের নিয়ম। রাজা বদলের ছোফা শরীরে না লাগলেই হলো। লাগবে। না বলাই বাহুল্য। বড় বড় আন্দোলন শহরে শুরু হয়ে শহরেই শেষ হয়। গ্রাম পর্যন্ত আসে না।

ইরতাজউদ্দিন স্কুলে এসে দেখলেন, স্কুলের শিক্ষকরা সবাই চলে গেছেন। জোর গুজব মিলিটারিরা ময়মনসিংহ থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। একটা বড় দল গেছে হালুয়াঘাট। যে-কোনো সময় নীলগঞ্জে চলে আসতে পারে। স্কুলে আছেন হেডমাস্টার সাহেব। ছাত্র থাকুক না থাকুক। তিনি দশটা-পাঁচটা স্কুলে হাজির থাকেন। ছগির সাহেব এবং কালিপদ বাবুও আছেন।

ছগির সাহেব দাবা খেলছিলেন, আজ তিনি ভালো খেলেছেন। কালিপদ বাবু সুবিধা করতে পারছে না। তার মন্ত্রী আটকা পড়ে গেছে। মন্ত্রী খোয়ানো ছাড়া কালিপদ বাবুর সামনে কোনো বিকল্প নেই। অংক স্যারের মুখভর্তি হাসি। আনন্দ তিনি চেপে রাখতে পারছেন না। ইরতাজউদ্দিনকে দেখে অংক স্যার আনন্দিত গলায় বললেন, নীলগঞ্জে মিলিটারি চলে আসতেছে শুনেছেন না-কি?

ইরতাজউদ্দিন বললেন, তাই না-কি?

হেড স্যারের কাছে যান। উনার কাছে লেটেস্ট সংবাদ আছে।

মিলিটারি আসছে এরকম খবর পাঠিয়েছে?

আরে না। এরা কি খোঁজ-খবর দিয়ে আসে? হুট করে চলে আসবে। এসেই রাজা আটক করে ফেলবে। সরাসরি গজের আক্রমণ। হা-হা-হা।হাসতেছেন কেন? মিলিটারি আসা কি কোনো আনন্দের বিষয়? আমাদের জন্যে সমান। আমরা আমেও নাই ছালাতেও নাই। দেশ শান্ত হলেই খুশি। ছাত্র পড়াব, বেতন পাব। আর কী?

ইরতাজউদ্দিন হেডমাস্টার সাহেবের ঘরের দিকে রওনা হলেন। ছগির সাহেব দাবার বোর্ডের উপর ঝাঁকে পড়লেন। ইচ্ছা করলেই তিনি মন্ত্রীটা খেতে পারেন। খেতে ইচ্ছা করছে না। আটকা থাকুক, ধীরেসুস্থে খাবেন। খাদ্য তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। তিনি গজের চাল দিলেন। তেমন চিন্তা-ভাবনা করে দিলেন না। বিপক্ষের মন্ত্রী আটকা পড়ে আছে, এখন এত চিন্তা-ভাবনার কিছু নেই।

হেডমাস্টার মনসুর সাহেব মাথা নিচু করে কী যেন লিখছিলেন। ইরতাজউদ্দিনকে দেখে মাথা তুললেন। ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনার কী হয়েছে? মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তিনি কথা বলতে চান না। তাঁর ভালো লাগে না। গত তিন রাত ধরে তার ঘুম হচ্ছে না। তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। স্বামী আশেপাশে থাকলে মহিলা অনেকটা সুস্থ থাকেন। এবার তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে।

এখন তিনি স্বামীকে চিনতে পারছেন না। এক রাতে তিনি স্বামীকে ঘরে ঢুকতে দেখে চিৎকার করে উঠলেন– এই তুমি কে? তুমি ঘরে ঢুকলা কেন? খবরদার! খবরদার! মনসুর সাহেব বললেন, আসিয়া আমাকে চিনতে পারছি না? আমি আমি।খবরদার আমি আমি করব না। খবরদার। হেডমাস্টার সাহেব রাতে আলাদা ঘরে ঘুমান। আসয়াকে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। ছাড়া পেলে তিনি একা একা নদীর পাড়ে চলে যান।ইরতাজউদ্দিন বললেন, মিলিটারি নাকি আসছে?

মনসুর সাহেব হাতের কলম নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, আসবে তো বটেই।শুধু শুধু গণ্ডগ্ৰামে আসবে কেন? দেশটাকে নিজের মুঠোয় নিতে হলে আসতেই হবে। কবে আসবে সেটা কথা। শহরগুলোর দখল এরা নিয়ে নিয়েছে–এখন ছড়িয়ে পড়বে। কোনো রেসিসটেন্স পাচ্ছে না, কাজেই ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা দ্রুত ঘটবে।রেসিসটেন্স হবে? অবশ্যই হবে। কে জানে, এখনই হয়তো শুরু হয়েছে। সামনের দিন বড়ই ভয়ঙ্কর ইরতাজ সাহেব। কেউ বুঝতে পারছে না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি।

ভাবি সাহেবের শরীর কেমন? ভালো না। তাকে এখানে আনা ঠিক হয় নাই। মনে হয়। বাপ-ভাইয়ের কাছেই সে ভালো ছিল। তাকে এখানে এনে ভুল করেছি।মানুষের কর্মকাণ্ড কোনটা ভুল কোনটা শুদ্ধ সেই বিবেচনা কঠিন বিবেচনা। মানুষ প্রায়ই এই বিবেচনা করতে পারে না। ভুল এবং শুদ্ধ একমাত্র আল্লাহপাকই বলতে পারেন।

মনসুর সাহেব বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার মতো আল্লাহভক্ত মানুষদের একটা সুবিধা আছে–সব দায়দায়িত্ব আল্লাহর উপর ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বাস করতে পারেন। বড় কোনো বিপদ যদি আসে, তখনও আপনার মতো মানুষরা সবই আল্লাহর হুকুম বলে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করতে থাকে।এইটা কি ভালো না?

না, এটা ভালো না। মানুষকে বিবেক দেয়া হয়েছে। চিন্তা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যুক্তিবিদ্যার মতো কঠিন বিদ্যায় জন্মসূত্ৰেই মানুষ পারদশী। সেই মানুষ যদি সবই আল্লাহর হুকুম বলে চুপ করে থাকে, তাহলে কীভাবে হয়? আল্লাহপাক আমাদের সবুর করতে বলেছেন।ভালো কথা, সবুর করেন। আপনার ছোট ভাইয়ের কোনো খবর পেয়েছেন? শাহেদ না তার নাম?

জি তার নাম শাহেদ। না, কোনো খবর এখনো পাই নাই।এটা নিয়েও নিশ্চয়ই আপনার মনে কোনো দুশ্চিন্তা নাই? সবই আল্লাহর ইচ্ছায় হচ্ছে, তাই না? ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনার মনটা মনে হয় আজ ভালো নাই।মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। মন ভালো আছে–এই কথা প্ৰিয়জনদের জানাতে ইচ্ছা করে। মন ভালো নাই–এই খবর ঢোল পিটিয়ে দিতে ইচ্ছা করে না। মাওলানা সাহেব! জি।কনফুসিয়াসের নাম শুনেছেন? জি-না। বিখ্যাত চীনা দার্শনিক। তিনি পাঁচটি সম্পর্কের কথা বলেছেন। পাঁচটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই পাঁচটা সম্পর্ক কী, জানতে চান?

ইরতাজউদ্দিন উসখুসি করছেন। আসরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। আসরের নামাজের সময় অল্প। পাঁচ সম্পর্কের কথা যদি হেডমাস্টার সাহেব ব্যাখ্যা করে বলা শুরু করেন, নামাজের সময় পার হয়ে যেতে পারে। নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেবের স্ত্রী খবর পাঠিয়েছেন। খুব নাকি জরুরি প্রয়োজন। সেখানেও যেতে হবে। তার সঙ্গে জরুরি প্রয়োজনটা কী তিনি বুঝতে পারছেন না!

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *