জোছনা ও জননীর গল্প পর্ব – ২৬ হুমায়ূন আহমেদ

জোছনা ও জননীর গল্প পর্ব – ২৬

নৌকা বড় একটা বাঁক পার হলো আর তখনি দেখা গেল একুশ-বাইশ বছর বয়েসি মাথায় টুপি পরা এক যুবক ছুটতে ছুটতে আসছে। হাত উঁচিয়ে ইশারা করছে নৌকা থামানোর জন্যে। নৌকা থামানো হলো। যুবক বলল, আপনাদের যে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, আমি সেই বাড়ির ছেলেমেয়েদের কোরান শরিফ পড়াই। আপনাদের বিপদ দেখে আমার মন খারাপ হয়েছে।

আপনারা কি আমার বাড়িতে উঠবেন? আমার ছোট্ট একটা ঘর আছে। আমি একা থাকি।আয়েশা বেগম সঙ্গে সঙ্গে বললেন, উঠব। তাঁর বড় ছেলে বলল, এই লোক যে গভীর রাতে ডাকাত খবর দিয়ে আনবে না বা আমাদের মিলিটারির হাতে ধরিয়ে দেবে না–তার নিশ্চয়তা কী?

আয়েশা বেগম বললেন, একটা লোক আশ্রয় দিতে চাচ্ছে, আল্লাহর নাম নিয়ে তার বাড়িতে উঠ।সবাইকে নিয়ে রাত দশটার দিকে গভীর জঙ্গলের ভেতর এক বাড়িতে আয়েশা বেগম উঠলেন। স্বামীর মৃত্যু বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না। উড়া উড়া খবর এসেছে।

কেউ নিশ্চিত হয়ে কিছু বলছে না। তিনি সারা রাত তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে কোরান পাঠ করলেন। তাঁর দুই ছেলে রাইফেলে গুলি ভরে পাহারায় থাকল। ভোরবেলা পাংখাপুলার রশিদ এসে উপস্থিত। তার চোখ লাল, মুখ শুকনা। রশিদকে দেখে আয়েশা বেগম বললেন, তোমার সাহেবের খবর কী? উনি কোথায়?

রশিদ চুপ করে রইল।

উনি কি বেঁচে আছেন?

রশিদ বলল, জি আম্মা। (এটা রশিদের মিথ্যা ভাষণ। সে সব জেনেই এসেছে। পরিবারটিকে গভীর বেদনার সংবাদ দিতে পারছে না।) আয়েশা বেগম বললেন, বেঁচে আছেন, তাহলে উনি কোথায়?

পলাতক আছেন। আম্মা শুনেন, উনার কথা এখন চিন্তা করে লাভ নাই। আপনাদের বিষয়টা এখন চিন্তা করা দরকার। অনেক সন্ধান করে আপনাদের পেয়েছি। এইখানে আমি আপনাদের রাখব না। অন্য জায়গায় নিয়ে যাব।গোয়ারেভখার পীর সাহেবের বাড়িতে নিয়া যাব। উনাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আপনারা নিরাপদে থাকবেন।কখন নিয়ে যাবে?

এখন নিয়া যাব। আমি নৌকার ব্যবস্থা করতেছি। আম্মা অস্থির হয়েন না। আমি আছি। আমি আপনাদের জন্যে জীবন দিয়া দিব। আপনাদের কোনো বিপদ হইতে দিব না। নবিজির কসম, আল্লাহপাকের কসম।রশিদ এই অসহায় পরিবারটিকে গোয়ারেভখার পীর সাহেবের কাছে নিয়ে গেল। তাদের সে বাড়িতে স্থায়ী করে ফিরে গেল পিরোজপুরে। এসডিপিও সাহেবের বাসা থেকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে আসবে।

রশিদকে পিরোজপুর শহরে ঢোকার মুখেই অ্যারেক্ট করে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসডিপিও সাহেবের পরিবার কোথায় আছে সেই খবর বের করা হবে। পিরোজপুরের মিলিটারি কমান্ডের প্রধান কর্নেল আতিক (ফুটবল প্লেয়ার– পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের একজন ) এসডিপিওর ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া তিন ছেলেমেয়েকে খুঁজছে।

তাকে খবর দেয়া হয়েছে পিরোজপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং-এ তারাও ছিল। তারা ট্রেনিং নিয়েছে।কর্নেল আতিককে সাহায্য করছে পিরোজপুর থানার ওসি। এই ওসি সাহেব খুব সম্ভব জীবন রক্ষার জন্যেই মিলিটারিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। রশিদের সঙ্গে ওসি সাহেবের নিম্নোক্ত কথাবার্তা হলো–

এসডিপিও সাহেবের ফ্যামিলি কোথায় আছে?

স্যার, আমি জানি না।

অবশ্যই তুমি জানো। আমার কাছে খবর আছে তুমি জানো। তুমি যে শুধু জানো তাই না। তুমি তাদের দেখভালও করছি।

স্যার, আমি জানি। কিন্তু বলব না।

মিলিটারি কী ভয়ঙ্কর জিনিস তুমি জানো। এই খবর না দিলে কিন্তু ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে।

স্যার, আমি কিছুই বলব না!

আরে ব্যাটা নিজের জীবন বাঁচা। এখন ইয়া নফসি সময়। বলে দে তারা কোথায় আছে?

আমি কোনোদিন ও বলব না।

রশিদকে সেই দিনই সন্ধ্যায় হুলারহাট লঞ্চঘাটে নিয়ে গুলি করে মেরে

ফেলা হলো।

*মূল নাম ব্যবহার করছি না। এই মানুষটির নিদায়তা ও নিষ্ঠুরতার অপরাধ আমার মা ক্ষমা করেছেন। বলে অ্যামিও ক্ষমা করলাম।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে বেগম আখতার সোলায়মান করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন–পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালানো ছাড়া পাকিস্তান সরকারের অন্য কোনো উপায় ছিল না। তিনি বলেন, মার্চের প্রথম দিকে যখন ধারণা করা হচ্ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন, তখন তিনি ঢাকায় গিয়ে তার মরহুম পিতার দোহাই দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে এ ধরনের মারাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

পাকিস্তান সরকার স্বীকার করে ৩০ হাজার পুলিশ বাহিনী সদস্য, ১৪ হাজার নিয়মিত বাহিনী সদস্য, ৪ হাজার ইপিআর পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।

সূত্র : দৈনিক পাকিস্তান

পূর্ব পাকিস্তান গভর্নর লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান রাজাকার অর্ডিনেন্স জারি করেন।

রাজাকার বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাহায্যকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে। তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করা হবে। তারা প্রধানত গেরিলাদের খুঁজে বের করা, তাদের আশ্রয়দাতাদের খবর সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়া, রেললাইন, ব্রীজ পাহারা দেবে।*

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩ জন শিক্ষক এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে খুবই বিনম্র সহানুভূতিশীল আচরণ পাচ্ছেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পেছনে প্রদেশের জনগণের কোনো সমর্থন ছিল না এবং নেই।*

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা আমাদের প্রিয় ভূমি পাকিস্তানকে খণ্ড করার অভিসন্ধির তীব্র নিন্দা করছি। রাজনৈতিক চরমপন্থীদের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণায় আমরা দুঃখ পেয়েছি ও হতাশ হয়েছি।*

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক কাজে যোগ দেন। তারা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছেন এই মর্মে বিবৃতি দেন।

* আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দিতে আগেও পছন্দ করতেন। এখনো করেন।–লেখক

জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বললেন, মানব ইতিহাসের সবচে বিষাদময় ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে।

ভ্যাটিকান সিটি থেকে জন পোপ পল পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।*

* বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মুসলিম দেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান কোনো নেতা মুখ খোলেন নি। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের লেনিন পুরস্কারপ্রাপ্ত প্ৰখ্যাত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ডন পত্রিকায় পাকিস্তানি মিলিটারিদের নৃশংসতার প্রতিবাদ করে একটি রচনা লিখেন। তিনি সংগ্রামী বাংলাদেশীদের উদ্দেশ করে একটি কবিতাও রচনা করেন যার শিরোনাম।–পাও সে লাহুকো ধো ডালো– পা থেকে রক্ত ধুয়ে ফেলো।

গভর্নর টিক্কা খান সকল বাঙালি দোষীদের জন্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। দেশত্যাগীদের ফিরে আসার জন্যে অভ্যর্থনা শিবির খোলার কথা বলা হয়। এক ইস্তাহারে বলা হয়–খাঁটি পাকিস্তানিরা নিৰ্ভয়ে দেশে ফিরতে পারবেন।তাদের ফিরে আসার সুবিধার জন্যে তিনি অভ্যর্থনা শিবির খোলার নির্দেশ দেন।

কবি শামসুর রাহমান ভেতরের দিকের একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে আছেন। গ্রামের নাম পাড়াতলী। নরসিংদীর পাড়াতলীর যে বাড়িতে তিনি বাস করছেন সেটা মাটির। তার জানালা আছে। গ্রামের মানুষ বড় জানালা পছন্দ করে না। রেলের টিকিটঘরের জানালার মতো ছোট্ট জানালা। সেই জানালায় ঘরের ভেতর আলো-বাতাস কিছুই আসে না। তবুও তো জানালা।

কবি জানালার পাশে বেতের মোড়ায় বসে আছেন। বেতের মোড়াটা এই বাড়ির সবচে আরামদায়ক। একটাই সমস্যা–হেলান দেয়া যায় না। সবসময় ঋজু অবস্থানের কথা মনে রাখতে হয়। অবশ্যি এখন যে সময় সেই সময়ে ঋজু থাকারই কথা। তিনি উঠোনের দুটো বেগুন গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন।

বেগুন গাছে বেগুন হয়েছে–অদ্ভুত বেগুন। হাঁসের ডিমের মতো ধবধবে সাদা রঙ। এই জিনিস তিনি আগে দেখেন নি। মনে হচ্ছে গাছে ডিম ফলে আছে। তিনি নাগরিক মানুষ। এখন গ্রামে পড়ে আছেন। গ্রামগঞ্জের অনেক খুঁটিনাটি তাকে আকৃষ্ট করছে। কোনো একটি বিশেষ দৃশ্যে যখন তাঁর চোখ আটকাচ্ছে তিনি মনে মনে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা আবৃত্তি করছেন—

Heaven gives Her glimses only to those

Not in a position to look too close.

কবি সাহেব কি আছেন? কবি সাহেব! কেউ কি তাঁকে খুঁজছে? নাকি তিনি ভুল শুনছেন? মেয়েলি ধরনের এই পুরুষগলা তিনি কি আগেও শুনেছেন? যেখানে তিনি অজ্ঞাত বাস করছেন সেখানে কবি সাহেব হিসেবে কেউ তাকে চেনার কথা না! অপরিচিত কেউ ডাকছে?

কবি চমকালেন। এখন দুঃসময়। দুঃসময় অপরিচিত আহ্বানের জন্যে ভালো না।কবি খালি গায়ে আছেন। কড়া সবুজ রঙের লুঙ্গি নাভির উপর পরেছেন। অন্ধকারে তাঁর ফর্সা দুধসাদা শরীর জ্বলজ্বল করছে। এই অবস্থাতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। গায়ে কিছু দেবার কথা তাঁর মনে হলো না। এই গণ্ড গ্রামে নাগরিক সভ্যতা ভব্যতা দেখাবার কিছু নেই। সুরুচি? দুঃসময়ে সুরুচি প্রথম নির্বাসনে যায়।কবি কি আমাকে চিনেছেন? আমি শাহ কলিম। আপনার খাদেম।আমার খাদেম মানে কী? আমি কি পীর সাহেব?

আমার পীর তো অবশ্যই।কলিমুল্লাহ কদমবুসি করার জন্যে নিচু হলো। কবি চমকে সরে গিয়েও কদমবুসির হাত থেকে বাঁচতে পারলেন না। কলিমউল্লাহ হাসিমুখে বলল, আপনাকে দেখে কী যে ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে লিভিংস্টোনের সাক্ষাৎ পেলাম।তার মানে?

আমাজানের জঙ্গলে লিভিংস্টোন হারিয়ে গিয়েছিলেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি থেকে কমিশন করে একজনকে আমাজানে পাঠানো হলো। তিনি অনেক ঝামেলা করে লিভিংস্টোনের খোঁজে উপস্থিত হলেন। গভীর অরণ্যে একদল কালো মানুষের মধ্যে একজন সাদা মানুষ দেখে তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন,। presume you are Dr. Livingstone.

কবি কলিমউল্লাহর দিকে তাকিয়ে আছেন। মানুষটা হড়বড় করে কী বলছে কিছু তার মাথায় ঢুকছে না। সবচে বড় সমস্যা হচ্ছে, মানুষটাকে তিনি চিনতে পারছেন না। দাড়ি রাখার কারণে কি তা হয়েছে? আজকাল অনেকেই দাড়ি রেখে চেহারা পাল্টে ফেলছে। দাড়ি, চোখে সুরমা, মাথায় টুপি। নতুন লেবাস।

লিভিংস্টোন সাহেবের মতোই আপনার গায়ের রঙ। পড়েও আছেন বলতে গেলে আমাজানের জঙ্গলে। কবি বোধহয় আমাকে চিনতে পারেন নাই। দৈনিক পাকিস্তান অফিসে আপনার সঙ্গে পরিচয়। আপনার একটা কবিতা ঝাড়া মুখস্থ বলেছিলাম। আসাদের শার্ট। মনে পড়েছে?

শামসুর রাহমান হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বুঝালেন তিনি চিনেছেন। আসলে মোটেই চিনতে পারেন নি।আপনাকে মনে মনে খুঁজছিলাম, এইভাবে যে পেয়ে যাব ভাবি নাই।কীভাবে পেয়েছেন? সে এক বিরাট ঘটনা। বসে বলি? ঘরে কোথাও গিয়ে বসি?

শামসুর রাহমান বিব্ৰত ভঙ্গিতে বললেন, অবশ্যই অবশ্যই।শাহ কলিম নামের মানুষটাকে তিনি এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। নিজে দুহাতে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দূর থেকে যে কেউ দেখলেই ভাববে, শাহ কলিম যেন ভেতরে ঢুকতে না পারে। সেইজন্যে তিনি দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছেন।কবি বললেন, চা খাবেন? শাহ কলিম বাংলাঘরের বিছানায় পাতা পাটিতে বসতে বসতে বললেন, চায়ের ব্যবস্থা কি আছে?

আছে, গুড়ের চা।বাহ ভালো। গুড়ের চা অনেক দিন খাই না। চা খাব। আপনার সঙ্গে বসে চুঢ়া খাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মহা ভাগ্য! কবি চায়ের কথা বলতে গেলেন। সার্ট গায়ে দিতে হবে। খালি গায়ে এই মানুষের সামনে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। চা খেয়েই যে বিদায় হবে তাও মনে হয় না। এই লোকটা অবশ্যই খুঁটি গেড়ে বসা টাইপ লোক।কলিমউল্লাহ গুড়ের চায়ে চুমুক দিয়ে আহ বলে তৃপ্তির শব্দ করল।

চা ভালো হয়েছে। গুড়ের গন্ধ চায়ের গন্ধ মিলে একাকার হয়ে গেছে। এই চা এক কাপ খেলে হবে না। আরেক কাপ খাব।শামসুর রাহমান হতাশ গলায় বললেন, অবশ্যই খাবেন। তবে আমি ব্যস্ত আছি। আপনাকে বেশি সময় দিতে পারব না।স্যার, আমাকে কোনো সময়ই দিতে হবে না। আপনি আপনার কাজে যান। আমি আছি। চা খাব। কবি-কুটিরে কিছুক্ষণ থেকে চলে যাব।আমার খোঁজ পেয়েছেন কীভাবে?

সেটা স্যার ইতিহাস পর্যায়ের ঘটনা। আমি চড়নদার হিসেবে একটা ফ্যামিলি নিয়ে যাচ্ছি গ্রামে। এক পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহেবের ফ্যামিলি। তাঁর স্ত্রী, তিন মেয়ে, এক ছেলে। আপনার গ্রামে এসে ইন্সপেক্টর সাহেবের ছোট মেয়ে মাসুমা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। নাকে রুমাল চেপে ধরলে কিছুক্ষণের মধ্যে রুমাল রক্তে লাল। এই গ্রামে তাদের আত্মীয় বাড়ি আছে। সেখানে আপাতত উঠেছি।

মাসুমাকে ডাক্তার দেখিয়ে আবার রওনা দেব। আমরা যাচ্ছি ফরিদপুরের দিকে। মাসুমাদের আদি বাড়ি ফরিদপুরে।ও আচ্ছা।পাশ করা কোনো ডাক্তার পেলাম না। হিন্দু এক ডাক্তার ছিল। হরি বাবু নাম। সে তার গুষ্ঠী নিয়ে মিলিটারির ভয়ে ইন্ডিয়া পালিয়ে গেছে। এটা একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে–বন্যেরা বনে সুন্দর, হিন্দুরা হিন্দুস্থানে।এটা কেমন কথা?

কথার কথা বলেছি স্যার। এটা গুরুত্বের সঙ্গে নিবেন না। মূল বিষয়টাই আপনাকে বলা হয় নাই, কীভাবে আপনার খোঁজ পেলাম। মাসুমার এক খালু বললেন, আপনি এই গ্রামে লুকিয়ে আছেন। তবে স্যার লুকিয়ে থাকার জন্যে জায়গাটা ভালো না।ভালো না কেন?

কেউ যদি আপনাকে খুঁজে বের করতে চায়, তার চোখ বেঁধে দিলে সে চোখ বাধা অবস্থায় আপনাকে খুঁজে বের করতে পারবে। কারণ আপনি পালিয়ে আছেন আপনার নিজের গ্রামের বাড়িতে। পালানোর সবচে ভালো জায়গা কি জানেন স্যার?

না।

পালানোর সবচে ভালো জায়গা হলো হিন্দুস্থান। দাগি লোকজন সব বর্ডার পার হয়ে যাচ্ছে।

দাগি লোকজন মানে?

এন্টি পাকিস্তান লোকজন।

আপনি নিজে কোন দিকের মানুষ?

স্যার শুনেন, আমার দাড়ি, চোখের সুরমা সবই লেবাস। লেবাস পরে পাকিস্তানি সেজেছি। বাঁচার উপায় একটাই।–লেবাস পরিবর্তন। খোলস দেখে বিভ্রান্ত হবেন না স্যার।কবি নিঃশ্বাস ফেললেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। লোকটি সত্যি কথা বলছে না মিথ্যা বলছে তাও ধরা যাচ্ছে না।গ্রামে বাস করতে কি ভালো লাগছে?

কবি মাথা নাড়লেন। গ্রাম তার ভালো লাগছে কি লাগছে না—তা তাঁর মাথা নাড়া থেকে ঠিক বোঝা গেল না।স্যার, আপনার উচিত শহরে চলে যাওয়া।কেন? যেখানে অনেক মানুষ থাকে, সেখানে গোপনে বাস করা যায়। গ্রামে গোপনে থাকতে পারবেন না। দেখেন না। আমি কীভাবে চট করে আপনাকে খুঁজে বের করে ফেলেছি।

হুঁ।পত্রিকা অফিসে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করে দেন। কেউ আপনাকে ঘাটাবে না। আপনি নিজের মনে থাকবেন। কবিতা লিখবেন। মিলিটারির দিক থেকে আপনার কোনো ভয় নেই।ভয় নাই কেন? আপনার মতো সম্মানিত কবিকে মিলিটারি কিছু বলবে না। তারা পৃথিবীকে দেখাতে চায় ঢাকা স্বাভাবিক। আমার কথাটা স্যার রাখেন। ঢাকায় চলেন।আপনার স্বাৰ্থ কী?

আপনি নিরাপদে আছেন। নিজের মনে লেখালেখি করছেন–এইটাই আমার স্বাৰ্থ। গ্রামে আপনার নিরাপত্তা নাই। শান্তি কমিটি আলবদর কত কিছু তৈরি হচ্ছে। কখন আপনাকে ধরে নিয়ে যায়—এইটাই আমার ভয়। এরা যদি ধরে নিয়ে যায় তার হিসাব থাকবে না। মিলিটারি ধরলে তার হিসাব থাকবে।আপনার কি চা খাওয়া হয়েছে? জি। দিব আরেক কাপ?

না থাক, মনে হয় আপনি আমার ওপর নারাজ হয়েছেন। কবি, আপনি আমার ওপর নারাজ হবেন না। আমি নিজে কবিতা লিখি, আমি জানি আপনি কী! আমি নারাজী হই নি।কবিতা লেখেন না? মিলিটারির ক্রাকডাউনের পরে কিছু লিখেছেন? হুঁ।যে-কোনো একটা কবিতা কি আমি পড়তে পারি? আমার খুবই ইচ্ছা! ক্ৰাকডাউনের পরে লেখা একটা কবিতা পড়ি।কেন?

কবিদের বলা হয় দেশের আত্মা। আমি কথাটা বিশ্বাস করি। যারা সত্যি সত্যি কবি, তারা অবশ্যই দেশের আত্মা। আমি না। আমি কবি হিসেবে দুই নম্বরি, দেশের আত্মা হিসেবেও দুই নম্বরি। আপনি তা না। আপনার এখনকার কবিতা পড়লে বোঝা যাবে দেশের অবস্থা কী? সত্যি সত্যি পড়তে চান? জি।

কয়েকদিন আগে দুটা কবিতা একসঙ্গে লিখেছি। আমার কাছে এরা দুই যমজ কন্যার মতো।কবি, কবিতার খাতাটা নিয়ে আসেন পড়ি। আর যদি তেমন তাকলিফ না হয় তাহলে আরেক কাপ গুড়ের চা।কবি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর যাবার ভঙ্গিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। যেন তিনি ধরতে পারছেন না। এই মানুষটাকে তাঁর দুটি অতিপ্ৰিয় কবিতা শোনানো ঠিক হবে কি-না।

কলিমউল্লাহ অনেকক্ষণ বসে রইল। কবিতার খাতা নিয়ে আসতে এত সময় লাগার কথা না। মনে হচ্ছে কবি একই সঙ্গে কবিতা এবং চা নিয়ে ঢুকছেন। কলিমউল্লাহর ভালো ক্ষিধা লেগেছে। গুড়ের চায়ে এই ক্ষিধা যাবার কথা না। গুড়ের চা খেলে উল্টা ক্ষিধা বাড়ে। গ্রামের এই সমস্যা–চায়ের সঙ্গে খাওয়ার জন্যে কিছুই থাকে না। বিস্কুট-চানাচুর কিছু না। দুএক জায়গায় পাকা পেপে কেটে দেয়। চায়ের সঙ্গে পাকা পোপে খাওয়া যায় না। গ্রামের বেকুবরা এটা বোবে না।

কবি নিজেই চা নিয়ে ঢুকলেন। এক কাপ চা, আরেকটা পিরিচে দুটা মুড়ির মোয়া। কবি চা এবং মুড়ির মোয়া কলিমউল্লাহর সামনে রাখতে রাখতে বললেন, আজ কবিতা শোনাতে ইচ্ছা হচ্ছে না।কলিমউল্লাহ মুড়ির মোয়াতে কামড় দিয়ে বলল, ইচ্ছা না হলে থাক। কবির ইচ্ছার উপরে কোনো কথা চলে না।গ্রামে বসে কবি শামসুর রাহমান যে দুটা কবিতা লিখেছিলেন তার একটির নাম স্বাধীনতা।

স্বাধীনতা তুমি

রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।

স্বাধীনতা তুমি

কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো

মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা—

স্বাধীনতা তুমি

শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা

স্বাধীনতা তুমি

পতাকা-শোভিত স্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।

স্বাধীনতা তুমি

ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।

স্বাধীনতা তুমি

রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্ৰাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।

স্বাধীনতা তুমি

মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশি।

স্বাধীনতা তুমি

অন্ধকারের খা-খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।

স্বাধীনতা তুমি

বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর

শাণিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।

স্বাধীনতা তুমি

চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।

স্বাধীনতা তুমি কালবোশোখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।

স্বাধীনতা তুমি

শ্রাবণে অকুল মেঘনার বুক

স্বাধীনতা তুমি

পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।

স্বাধীনতা তুমি

উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্ৰ শাড়ির কাঁপন।

স্বাধীনতা তুমি

বোনের হাতের নাম পাতায় মেহেদির রঙ।

স্বাধীনতা তুমি

বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার

স্বাধীনতা তুমি

গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,

হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদাম।

স্বাধীনতা তুমি

খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,

খুকির অমন তুলতুলে গালে

রৌদ্রের খেলা।

স্বাধীনতা তুমি

বাগানের ঘর, কোকিলের গান,

বয়সী বটের ঝিলিমিলি পাতা

যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা

প্ৰায় সন্ধ্যা।

কলিমউল্লাহ ফিরে যাচ্ছে। অনেকটা পথ হেঁটে বাজারে উঠলে রিকশা-ভ্যান পাওয়া যাবে। কাঁচা রাস্তায় রিকশা-ভ্যানে চড়াও এক দিগদারি। বাকুনির চোটে কলিজা ফুসফুস হৃৎপিণ্ডের মধ্যে ধাক্কাধাব্ধি হয়। এরচে হেঁটে যাওয়া ভালো। কলিমউল্লাহর হাঁটতে সমস্যা হয় না। তার শরীর-স্বাস্থ্য ভালো! ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে হাঁটতে পারে। একটাই শুধু অসুবিধা–হাঁটার সময় তার মাথায় কবিতা আসে না। এই সময় পাকা রাস্তায় রিকশা করে যেতে পারলে অতি দ্রুত তার মাথায় কবিতা আসত। তার অধিকাংশ কবিতাই চলমান রিকশায় পাওয়া।

আজ একটা কবিতা মাথায় আসা প্রয়োজন। খুবই প্রয়োজন। আজ তার বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ক্র্যাক ডাউনের পর বিয়ের সিজন চলছে। অবিবাহিত মেয়েদের বাবা-মা অতি দ্রুত বিয়ে দিয়ে ফেলছে। যেন বিয়েই সব সমস্যার সমাধান। বিপদ শুধু কুমারী মেয়েদের। বিবাহিতদের কোনো সমস্যা নাই। গাধারা বুঝে না মিলিটারিদের কাছে কুমারী, বিবাহিত বা বিধবা কোনো ব্যাপার না। সবই তাদের কাছে–আওরাত।

মাসুমার সঙ্গে যদি সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে এটাকে আল্লাহর রহমত হিসেবে ভাবা যেতে পারে। অতি ভালো মেয়ে। বেশি চালাক–এটা একটা সমস্যা। স্ত্রী হলো সঙ্গিনী। সঙ্গিনী বেকুব হলেও সমস্যা। চালাক হলেও সমস্যা। শাখের করাত দুদিকে কাটে।

কলিমউল্লাহর মাথায় হাঁটতে হাঁটতেই একটা কবিতার লাইন চলে এলোসঙ্গী ছিল না কেউ পাশে। লাইনটা খারাপ না, দশ মাত্ৰা দিয়ে শুরু। ষোল মাত্রা করা দরকার। সঙ্গী ছিল না কেউ পাশে, আবেগে সন্তাপে। এটা কেমন হয়? ষোল মাত্রা। শেষ তিনটা শব্দে একারের মিল— পাশে, আবেগে সন্তাপে।রিকশা-ভ্যানের ভাড়া নিয়ে দরদরি করার কারণেই হয়তো কবিতার লাইন মাথা থেকে পুরোপুরি মুছে গেল। ভ্যান চলছে।

সে বেশ আরাম করেই ভ্যানে বসেছে। রাস্তা তেমন উঁচু-নিচু না। বাকুনি হচ্ছে না। পরিবেশ ভালো। সন্ধ্যা নামছে। আরামদায়ক বাতাস মাথায় নামছে। মনে মনে কবিতা তৈরির জন্যে অতি উত্তম ব্যবস্থা। অথচ মাথা পুরোপুরি ফাঁকা। কবিতাটা তৈরি হয়ে গেলে ভালো হতো। সে যদি কোনো দিন বড় কোনো কবি হয়ে যেত, তাহলে ইন্টারভিউতে বলতে পারত–এই কবিতাটার পেছনে একটা বিশেষ ঘটনা আছে।

ঘটনা কী হয়েছে শোন–১৯৭১ সন। অতি দুঃসময়। কবি শামসুর রাহমান গ্রামে পালিয়ে আছেন। হঠাৎ তাকে দেখতে ইচ্ছা হলো। ঢাকা ছেড়ে প্রায় জীবন হাতে নিয়ে কবির গ্রামের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। কবির কাছে তো খালি হাতে যাওয়া যায় না। রিকশা-ভ্যানে বসে বসে একটা কবিতা লিখলাম। কবিতা পকেটে নিয়ে যাচ্ছি। তখন সন্ধ্যা। তোমাদের রবীন্দ্রনাথের ভাষায়–প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস।

রিকশা-ভ্যান প্রবল ঝাকুনি খেল। কলিমউদ্দিন ভ্যান থেকে উল্টে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলাল। কবিতা নিয়ে চিন্তা করা আর ঠিক হবে না। চোখ-কান খোলা রেখে বসে থাকতে হবে। হাত-পা ভাঙা কবি কোনো মজার ব্যাপার না। তাছাড়া আজ রাতে তার বিয়ের সমূহ সম্ভাবনা। হাত-পা ভাঙা পাত্রের বিয়ে হবে কীভাবে?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *