জোছনা ও জননীর গল্প পর্ব – ৩৪ হুমায়ূন আহমেদ

জোছনা ও জননীর গল্প পর্ব – ৩৪

তাদের এই প্ৰতিহিংসার লালসা থেকে রেহাই পান নি কর্নেল জিয়ার ভায়রা শিল্পোন্নয়ন সংস্থার সিনিয়র কো-অর্ডিনেশন অফিসার জনাব মোজাম্মেল হক।চট্টগ্রাম শহর শক্ৰ কবলিত হবার পর বেগম খালেদা জিয়া যখন বোরখার আবরণে আত্মগোপন করে চট্টগ্রাম থেকে স্টিমারে পালিয়ে নারায়ণগঞ্জে এসে পৌঁছেন, তখন জনাব মোজাম্মেল হকই তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেদিন ছিল ১৬ই মে। ঢাকা শহরে কারফিউ। নারায়ণগঞ্জেও সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। এরই মধ্যে তিনি তার গাড়িতে রেডক্রস ছাপ এঁকে ছুটে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ টার্মিনালে।

বেগম জিয়াকে নিয়ে আসার দিন দশেক পর ২৬শে মে শিল্পোন্নয়ন সংস্থায় হক নাম সংবলিত যত অফিসার আছেন সবাইকে ডেকে পাক সেনারা কর্নেল জিয়ার সঙ্গে কারোর কোনো আত্মীয়তা আছে কিনা জানতে চায়। জনাব মোজাম্মেল হক বুঝতে পারলেন বিপদ ঘনিয়ে আসছে। তিনি সেখানে কর্নেল জিয়ার সাথে তাঁর আত্মীয়তার কথা গোপন করে অসুস্থতার অজুহাতে বাসায় ফিরে আসেন এবং অবিলম্বে বেগম জিয়াকে তার বাসা থেকে সরাবার ব্যবস্থা করতে থাকেন।

কিন্তু উপযুক্ত কোনো স্থান না পেয়ে শেষপর্যন্ত ২৮শে মে তিনি তাকে ধানমণ্ডিতে তার এক মামার বাসায় কয়েক দিনের জন্য রেখে আসেন এবং সেখান থেকে ৩রা জুন তাকে আবার জিওলজিক্যাল সার্ভের এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর জনাব মুজিবুর রহমানের বাসা এবং এরও কদিন পরে জিওলজিক্যাল সার্ভের ডেপুটি ডিরেক্টর জনাব এস কে আব্দুল্লাহর বাসায় স্থানান্তরিত করা হয়।

এরই মধ্যে ১৩ই জুন তারিখে পাক বাহিনীর লোকেরা এসে হানা দেয় জনাব মোজাম্মেল হকের বাড়িতে। জনৈক কর্নেল খান এই হানাদার দলের নেতৃত্ব করছিল। কর্নেল খান বেগম জিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং জানায় যে, এই বাড়িতে তারা বেগম জিয়াকে দেখেছে। জনাব হকের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর না পেয়ে তার দশ বছরের ছেলে ডনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ডন কর্নেল খানকে পরিষ্কারভাবে জানায় যে, গত তিন বছরে সে তার খালাকে দেখে নি।

সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হলে খান সেনারা তার বাড়ি তল্লাশী করে। কিন্তু বেগম জিয়াকে সেখানে না পেয়ে হতোদ্যম হয়ে ফিরে যায়। যাবার আগে জানিয়ে যায়, সত্যি কথা না বললে আপনাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হবে।এরপরই জনাব হক বুঝতে পারেন সর্বক্ষণ তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। যেখানেই যান। সেখানেই তার পেছনে লেগে থাকে। ফেউ। এই অবস্থায় তিনি মায়ের অসুখের নাম করে ছুটি নেন। অফিস থেকে এবং সপরিবারে ঢাকা ছেড়ে যাবার ব্যবস্থা করতে *यकिक।

ব্যবস্থা অনুযায়ী ১লা জুলাই গাড়ি গ্যারেজে রেখে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে তারা দুটি অটোরিকশায় গিয়ে ওঠেন। উদ্দেশ্য ছিল ধানমণ্ডিতে বেগম জিয়ার মামার বাসায় গিয়ে আপাতত ওঠা। কিন্তু সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত আসতেই একটি অটোরিকশা তাদের বিকল হয়ে যায়।

এই অবস্থায় তারা কাছেই গ্ৰীনরোডে এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে ওঠেন। কিন্তু এখানে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল এক বিরাট বিস্ময়। জনাব হক এখানে গিয়ে উঠতেই তাঁর এই বিশিষ্ট বন্ধুর স্ত্রী তাঁকে জানান যে, কর্নেল জিয়ার লেখা চিঠি তাদের হাতে এসেছে। চিঠিটা জনাব হককেই লেখা এবং এটি তার কাছে পাঠাবার জন্যে কয়েকদিন ধরেই তাকে খোঁজ করা হচ্ছে।

তার কাছে লেখা কর্নেল জিয়ার চিঠি এ বাড়িতে কেমন করে এলো তা বুঝতে না পেরে তিনি যারপরনাই বিস্মিত হন এবং চিঠিটা দেখতে চান। তাঁর বন্ধুর ছেলে চিঠিটা বের করে দেখায়। এটি সত্যই কর্নেল জিয়ার লেখা কিনা বেগম জিয়াকে দিয়ে তা পরীক্ষা করিয়ে নেবার জন্যে তিনি তাঁর বন্ধুর ছেলের হাতে দিয়েই এটি জিওলজিক্যাল সার্ভের জনাব মুজিবর রহমানের কাছে পাঠান।

এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় জনাব হক তাঁর এই বন্ধুর বাসায় রাতের মতো আশ্রয় চান। তাদেরকে আরো নিরাপদ স্থানে রাখার আশ্বাস দিয়ে রাতে তাদেরকে পাঠানো হয় সূত্রপুরের একটি ছোট্ট বাড়িতে। তাঁর বন্ধুর ছেলেই তাদেরকে গাড়িতে করে এই বাড়িতে নিয়ে আসে। এখানে ছোট্ট একটি ঘরে তারা আশ্রয় করে নেন।কিন্তু পরদিনই তারা দেখতে পেলেন পাক-বাহিনীর লোকেরা বাড়িটি ঘিরে ফেলেছে। জনা দশেক সশস্ত্র জওয়ান বাড়িটার সামনে দাড়িয়ে। এই দলের প্রধান ছিল ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ আর ক্যাপ্টেন আরিফ।

তারা ভেতরে ঢুকে কর্নেল জিয়া ও বেগম জিয়া সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। জনাব হক ও তার স্ত্রী জিয়ার্থ সাথে তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে যান। কিন্তু ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ জনাব ও বেগম হকের সাথে তোলা বেগম জিয়ার একটি গ্রুপ ছবি বের করে দেখালে তারা জিয়ার সাথে সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। তবে তারা জানান কর্নেল ও বেগম জিয়া কোথায় আছেন তা তারা জানেন না।

এই পর্যায়ে বিকেল পাঁচটার দিকে জনাব হক ও তার স্ত্রীকে সামরিক বাহিনীর একটি গাড়িতে তুলে মালিবাগের মোড়ে আনা হয় এবং এখানে মৌচাক মার্কেটের সামনে তাদেরকে সন্ধ্যে পর্যন্ত গাড়িতে বসিয়ে রাখা হয়। এখানেই তাদেরকে জানান হয় যে বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর তাদেরকে দ্বিতীয় রাজধানী এলাকা ঘুরিয়ে আবার সুত্রাপুরের বাসায় এনে ছেড়ে দেয়া হয়। এখান থেকে রাতে তারা গ্রীনরোডে জনাব হকের বন্ধুর বাসায় আসেন এবং সেখান থেকে ফিরে আসেন খিলগাঁয়ে তার নিজের বাসায়।

উল্লেখযোগ্য যে এই দিনই জনাব এস কে আব্দুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে বেগম জিয়া ও জনাব আব্দুল্লাহকে এবং একই সাথে জনাব মুজিবর রহমানকেও পাক-বাহিনী গ্রেফতার করে। এবং ৫ই জুলাই তারিখে জনাব মোজাম্মেল হক অফিসে কাজে যোগ দিলে সেই অফিস থেকেই ক্যাপ্টেন সাজাদ তাকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।

ক্যান্টনমেন্টে তাঁকে এফ আই ইউ (ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিট) অফিসে রাত দশটা পর্যন্ত বসিয়ে রাখা হয় এবং দশটায় তাকে স্কুল রোডের সেলে নিয়ে যাওয়া হয়।সেলে প্রবেশের আগে তাঁর ঘড়ি, আংটি খুলে নেয়া হয় এবং মানিব্যাগটিও নিয়ে নেয়া হয়। সারাদিন অভুক্ত থাকা সত্ত্বেও তাকে কিছুই খেতে দেয়া হয় নি।

পরদিন সকালে তাকে এক কাপ মাত্র ঠাণ্ডা। চা খাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাপ্টেন সাজাদের অফিসে। সাজ্জাদ তাঁর কাছে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানতে চায়। তিনি তাঁর কোনো পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করেন। ক্যাপ্টেন সাজাদ। এতে তাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করে এবং শাস্তি হিসেবে তাকে বৈদ্যুতিক শক দেবার হুমকি দেখায়।

কিন্তু এরপরও কোনো কথা আদায় করতে না পেরে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ তাঁকে হাজার ওয়াটের উজ্জ্বল আলোর নিচে শুইয়ে রাখার হুকুম দেয়।হুকুম মতো রাতে তাকে তাঁর সেলে চিৎ করে শুইয়ে মাত্র হাত দেড়েক ওপরে ঝুলিয়ে দেয় পাঁচশ পাওয়ারের দুটি অত্যুজ্জ্বল বান্ধ। প্ৰায় চারঘণ্টা অসহ্য যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে হয়।

পরদিন আবার তাকে ক্যাপ্টেন সাজাদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সাজাদ। আবার তার পরিকল্পনার কথা জানতে চায়। জানতে চায় শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার কী কী কথা হয়েছে, তিনি ভারতে চলে যাবার পরিকল্পনা বকরেছিলেন। কিনা। জনাব হক এসব কিছুই অস্বীকার করলে ক্যাপ্টেন সাজাদ তার ঘাড়ে প্ৰচণ্ড আঘাত হানে।

এরপর তার সেলে চব্বিশ ঘণ্টা হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলিয়ে রাখার হুকুম দেয়।বেলা একটায় তাকে সেলে এনেই বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ঘণ্টা কয়েক পরেই তিনি অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকেন। চিৎকার করে তিনি একটি কথাই বলতে থাকেন–আমাকে একবারেই মেরে ফেল। এভাবে তিলে তিলে মেরো না।

তিনি যখন অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন, তখন তাঁর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল একজন পাঠান হাবিলদার। তার এই করুণ আর্তি বোধ হয় হাবিলদারটি সইতে পারে নি। তারও হৃদয় বোধহয় বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল মানুষের ওপর মানুষের এই নিষ্ঠুর জুলুম দেখে। আর তাই বোধহয় সে সেন্ট্রিকে ডেকে হুকুম দিয়েছিল বাতি নিভিয়ে দিতে।

বলেছিল, কোনো জীপ আসার শব্দ পেলেই যেন বাতি জ্বালিয়ে দেয়, আবার জীপটি চলে যাবার সাথে সাথেই যেন বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়।এরপর ক্যাপ্টেন সাজাদ তাকে আরো কয়েকদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং নতুন ধরনের নির্যাতন চালায়। তার কাছ থেকে সারাদিন ধরে একটির পর একটি বিবৃতি লিখিয়ে নেয়া হয় এবং তার সামনেই সেগুলি ছিঁড়ে ফেলে আবার তাকে সেগুলি লিখতে বলা হয়।

এবং যথারীতি আবার তা ছিঁড়ে ফেলে আবার সেই একই বিবৃতি তাকে লিখতে বলা হয়। এবং আবার তা ছিঁড়ে ফেলা হয়। এই অবস্থায় ক্লান্তি ও অবসন্নতায় তিনি লেখার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। এদিকে হাজার ওয়াটের উজ্জ্বল আলোর নিচে থাকার ফলে তিনি দৃষ্টিশক্তিও প্রায় হারিয়ে ফেলেন। দিন ও রাতের মধ্যে কোনো পার্থক্যই বুঝতে পারতেন না।

২৬শে জুলাই বিকেলে তাকে ইন্টার স্টেটসস্ক্রিনীং কমিটির (আই এস এস সি) ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে একটি ছোট্ট কামরায় তাবা মোট ১১০ জন আটক ছিলেন। বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁকে বের করে রান্নাঘরের বড় বড় পানির ড্রাম ভরার কাজ দেয়া হয়।

এই কাজে আরো একজনকে তার সাথে লাগানো হয়। তিনি হচ্ছেন, জিওলজিক্যাল সার্ভের জনাব এস কে আব্দুল্লাহ। তাঁরা দুজনে প্ৰায় পেয়া মাইল দূরের ট্যাপ থেকে বড় বড় বালতিতে করে পানি টেনে তিনটি বড় ড্রাম ভরে দেন। রাতে লাইন করে দাঁড় করিয়ে তাঁদেরকে একজন একজন করে খাবার দেয়া হয়। এতদিন পরে এই প্ৰথম তিনি খেতে পান। গরম ভাত ও গরম ডাল।

পরদিন সকালে তার এবং তৃণরো অনেকের মাথার চুল সম্পূর্ণ কামিয়ে দেয়া হয়।এখানে বিভিন্ন কামরায় তাকে কয়েকদিন আটকে রাখার পর ৬ই আগস্ট নিয়ে যাওয়া হয়। ফিন্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে (এফ আই সি)। মেজর ফারুকী ছিল এই কেন্দ্রের প্রধান এবং এখানে সকলের ওপর নির্যাতন করার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিল সুবেদার মেজর নিয়াজী।

ফারুকী এখানে তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তাকে বিবৃতি দিতে বলে। কিন্তু বিবৃতি লেখানোর নাম করে সেই পুরনো নির্যাতন আবার শুরু হয়। একটানা তিনদিন ধরে তিনি একই বিবৃতি একের পর এক লিখে গেছেন এবং তাঁর সামনে তা ছিঁড়ে ফেলে আবার এই একই বিবৃতি তাঁকে লিখতে বলা হয়েছে।

৯ই আগষ্ট তাঁকে দ্বিতীয় রাজধানীতে স্থানান্তরিত করা হয় এবং এখানে বিভিন্ন কক্ষে তাঁকে প্ৰায় দেড়মাস আটক রাখার পর ২১শে সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ৩০শে অক্টোবর তিনি মুক্তি পান।

ইতিমধ্যে রাজাকাররা তিন দফা তাঁর বাড়িতে হামলা চালিয়ে সর্বস্ব লুটপাট করে নিয়ে যায়। সর্বশেষ গত ১৩ই ডিসেম্বর তারা তার গাড়িটিও নিয়ে যায়।

সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ

দলিলপত্র : ৮ম খণ্ড (পৃষ্ঠা : ৪৭৬)

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়

কলিমউল্লাহ তার স্ত্রী, শাশুড়িকে নিয়ে বর্তমানে নিউ পল্টনে যে বাড়িতে বাস করছে সেই বাড়ির নাম হেনা কুটির। বাড়িটা দোতলা। সব মিলিয়ে আটটা কামরা। দুটা দক্ষিণমুখি। একটা দক্ষিণমুখি ঘরে সে তার স্ত্রী মাসুমাকে নিয়ে থাকে। অন্যটায় তার শাশুড়ি, বড় মেয়ে মরিয়ম, ছোট মেয়ে মাফরুহ এবং ছোট ছেলেটাকে নিয়ে থাকেন।

মরিয়মের জন্যে আলাদা ঘর দেয়া হয়েছে। সে সেখানে থাকে না। একা তার ভয় লাগে। বাড়ির সামনে ছোট্ট লনের মতো আছে। লনে দেশী ফুলের গাছ। বাড়ির এক পাশে হাসনাহেনার ঝাড়। বাড়ির পেছনে বেশ অনেকখানি জায়গা। সেখানে দুটা বড় কামরাঙ্গা গাছ আছে। একটা গাছের গুড়ি শ্বেতপাথরে বাঁধানো।

কলিমউল্লাহ রোজ কিছু সময় এখানে কাটায়। তার হাতে তখন কাগজ-কলম থাকে। কামরাঙ্গা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে গাছের চিড়ল চিড়ল পাতা দেখতে তার ভালো লাগে। নতুন কবিতা নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। জীবন এত আনন্দময় কেন–এই নিয়ে ভাবতেও ভালো লাগে। ভালো লাগার ষোল কলা পূর্ণ হতো, যদি নতুন কোনো কবিতা লেখা হতো। বিয়ের পর থেকে তার মাথায় কবিতা আসছে না। একটাও না। একদিন শুধু একটা লাইন এসেছিল–

কামনায় রাঙ্গা ছিল কামরাঙ্গা ফল

এইখানেই সমাপ্তি। দ্বিতীয় লাইনটা আসে নি। প্রথম লাইনটাও মাথা থেকে যায় নি। কলিমউল্লাহ এখন নিশ্চিত–প্রথম লাইনটা মাথা থেকে না তাড়ালে নতুন কিছু আসবে না। তার এখন প্রধান চেষ্টা মাথা থেকে প্রথম লাইন সরানো। ব্যাপারটা খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। গ্রামোফোনের প্যাঁচকাটা রেকর্ডের মতো একটা লাইনই শুধু মাথায় ঘুরপাক খায়। কবি হওয়ার যন্ত্রণা আছে। সাধারণ মানুষ এই যন্ত্রণা থেকে অবশ্যই মুক্ত।

নতুন বাড়ি কলিমউল্লাহর স্ত্রীর খুবই পছন্দ। মাসুমা জিজ্ঞেস করেছে, এই বাড়ি আসলে কার? কলিমউল্লাহ বলেছে, তোমার।মাসুম বলেছে, আমার হবে কীভাবে? বাড়ি যদি আমার হতো তাহলে বাড়ির নাম হতো মাসুম কুটির। বাড়ির নাম তো হেনা কুটির।কলিমউল্লাহ হাই তুলতে তুলতে বলেছে, বাড়ির নতুন নামের শ্বেতপাথর যখন বসবে তখন টের পাবে। অর্ডার দেয়া হয়েছে। সাদা পাথরে কালো অক্ষরে বাড়ির নাম লেখা হবে। এতদিনে হয়ে যেত, কারিগর নেই বলে হচ্ছে না।

কী নাম? মাসুম কুটির?

না। বাড়ির নাম রেখেছি মেঘবালিকা।

মেঘবালিকাটা কে?

তুমি। মেঘবালিকা কবিতা তোমাকে নিয়ে লিখেছি, ভুলে গেছ? এত ভুলোমনা হলে সংসার চলবে? সত্যি করে বলো তো বাড়িটা কার?

এক হিন্দু উকিলের বাড়ি ছিল। ইন্ডিয়ায় পালায়ে গেছে। আমি বন্দোবস্ত নিয়েছি।

কীভাবে বন্দোবস্ত নিয়েছ?

আছে, আমার কানেকশন আছে।

দেশ স্বাধীন হলে তো এই বাড়ি তোমার থাকবে না।

কলিমউল্লাহ বিরক্ত হয়ে বলল, দেশ স্বাধীন হবে তোমাকে কে বলেছে?

মাসুমা অবাক হয়ে বলল, দেশ স্বাধীন হবে না?

কোনোদিন না। পটকা ফুটিয়ে দেশ স্বাধীন করতে লাগবে খুব কম করে হলেও একশ পঞ্চাশ বছর। বাঙালি জাতি কী রকম জানো? বাঙালি জাতি হলো স্বফুলিঙ্গ জাতি। যে-কোনো বিষয়ে উৎসাহে ফুলিঙ্গের মতো ঝলমল করে। সেই উৎসাহ ধাপ করে নিভে যায়। ফুলিঙ্গ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা জানো?

না।

রবীন্দ্ৰনাথ লিখেছেন

ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল

ক্ষণকালের ছন্দ

উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল,

সেই তারই আনন্দ।

মাসুমা মুগ্ধ গলায় বলল, এত কবিতা তুমি জানো, আশ্চর্য। মাসুমা যতই তার স্বামীকে দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। প্রায়ই তার মনে হয়, একটা মানুষ একই সঙ্গে এত জ্ঞানী এবং এত ভালো হয় কীভাবে? ভাগ্যিস দেশে একটা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলেই তো এমন একজন অসাধারণ মানুষের সঙ্গে হুট করে তার বিয়ে হয়ে গেল। যুদ্ধ যদি না হতো আর বাবা যদি তাদের সঙ্গে থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই তার বিয়ের জন্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার খোঁজা হতো। কবি খোঁজা হতো না।

মাসুমা এখন তার স্বামীর প্রতিটি কথা মনে-প্ৰাণে শুধু যে বিশ্বাস করে তাই না— কথাগুলি অন্যদের শোনানোর দায়িত্বও অনুভব করে। মরিয়ম এখন তার মেঝ বোনকে ডাকে হিজ মাস্টার্স ভয়েস। মাসুমা এতে রাগ করে না। সে আনন্দই পায়।রাতের খাবার পর কলিমউল্লাহ সবাইকে নিয়ে টিভিতে খবর দেখে। খবর দেখার পর দেশের অবস্থা নিয়ে গল্পগুজব করে। এই সময়টা মাসুমার খুব ভালো কাটে। গল্প বলার সময়ই তার মনে হয়–একটা মানুষ এত সুন্দর করে কথা বলে কীভাবো! আর কত তার আদব-কায়দা! স্ত্রী সামনে থাকার পরেও সে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কথা বলে না।

কথা বলে তার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে। কী মিষ্টি করেই না সে মা ডাকে! সব মানুষ তাদের শাশুড়িকে আম্মা ডাকে। শুধু এই মানুষটা ডাকে মা। মাসুমার মনে হয়, শুধুমাত্র একজন কবির পক্ষেই তার শাশুড়িকে এত মিষ্টি করে মা ডাকা সম্ভব।মা মন দিয়ে শোনেন। আমাদের জাতিগত সমস্যা হচ্ছে, আমরা কোনো কথা মন দিয়ে শুনি না। কান দিয়ে শুনি। আমরা অতীত নিয়ে হৈচৈ করি।–ভবিষ্যতে কী আসছে সেটা নিয়ে ভাবি না।

ঘটনার এ্যানালাইসিস করতে পারি না। আমি আজ একটা এ্যানালাইসিস দেব। দেখেন আপনার কেমন লাগে।মুক্তিযুদ্ধের নামে যে পটকা ফাটাফাটি হচ্ছে তার পেছনের প্রধান মানুষ কে? শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি কোথায়? জেলে। তার কপালে কী আছে? ফাঁসির দড়ি। কাজেই শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গে এইখানেই শেষ। ফুল স্ট্রপ। কমা সেমিকোলন না, একেবারে ফুলস্টপ।

বাকি থাকল। কারা? আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। তারা কী করছেন? একে একে দল ছেড়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন। আজো একজন করেছেন। চট্টগ্রামের এমপি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। কিছুক্ষণ আগেই নিউজে দেখলেন। দেখলেন না? গত সপ্তাহে বগুড়ার দুই আওয়ামী এমপি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিল। এরা কেউ বেকুব না। এরা বাতাস বোঝে। কখন কোন দলে যেতে হবে জানে।

যারা প্ৰথম ধাক্কায় ইন্ডিয়ায় চলে গেছে তারা পড়েছে বেকায়দায়। ইচ্ছা! থাকলেও ইয়াহিয়ার সঙ্গে যোগ দিতে পারছে না। তারা আছে সুযোগের অপেক্ষায়। ফিরে এলো বলে।তারা যে আশা করছে ইন্ডিয়া বাংলাদেশের জন্যে যুদ্ধ করবে, সেই আশার গুড়ে বালি শুধু না, আশার গুড়ে গু। মা, একটা খারাপ কথা বলে ফেলেছি, বেয়াদবি মাপ করবেন। ইন্দিরা গান্ধী সাগু খাওয়া মেয়ে না। সে নামত জানা মেয়ে। ইন্ডিয়া পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেই লাদাখ দিয়ে শত শত চাইনিজ সৈন্য ইন্ডিয়ার ভেতরে ঢুকে পড়বে।

এক টানে তারা চলে আসবে মেঘালয় পর্যন্ত। ইন্দিরার অবস্থা তখন কী হবে? ইন্দিরাকে বলতে হবে–ভিক্ষা চাই না, তোমার কুত্তাটারে একটু সামলাও। এইখানেই শেষ না, থাবা মেরে বসে আছে আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিম ধরে আছেন। তবে বিপ্লাম ধরা অবস্থাতেও সিগন্যাল পাঠিয়ে দিয়েছেন ইন্ডিয়ার কাছে। সিগন্যালটা হলোইন্দিরা, তুমি অনেকদিন আমাদের চির শত্রু রাশিয়ার সঙ্গে ঘষাঘষি করেছ। আমি চুপ করে দেখেছি। আর দেখব না।

আমেরিকা কী বুঝেন তো মা? আমেরিকা হলো বাঘের বাবা টাগ। বাঘ লাফ দিয়ে ঘাড়ে পড়ে। টাগ লাফ দেয় না। লেজ দিয়ে একটা বাড়ি দেয়। এক বাড়িতেই কাজ শেষ।মরিয়ম ভয়ে ভয়ে বলল, যারা মুক্তিযুদ্ধ করছে তাদের কী হবে? কলিমউল্লাহ মরিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, আপা, সত্য জবাবটা আপনাকে দিতে খারাপ লাগছে। কারণ ভাইসাহেব মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। ঝড়-বৃষ্টি, প্যাক-কাদায় কী করতেছেন তিনিই জানেন। তারপরেও সত্যটা বলি।

এদের মোহভঙ্গ হবে। অনেকের ইতিমধ্যে হয়েও গেছে। এরা অস্ত্ৰপাতি ফেলে নিজের নিজের ঘরে ফেরার চেষ্টা করবে। যারা আগে রেগুলার আর্মিতে ছিল, তাদের কোর্টমার্শাল হবে। যারা রেগুলার আর্মির না, তাদের কী হবে বলতে পারছি না। শাস্তি হতে পারে, আবার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাও হতে পারে।আজকের মতো আলোচনা শেষ। মা যান। ঘুমাতে যান। আপনার ঘুম কম হচ্ছে। আপনার ঘুম দরকার। চিন্তা করবেন না। চিন্তায় ভাত নাই। কর্মে ভাত।

কৰ্মে ভাত কথাটা এখন কলিমউল্লাহর জন্যে প্রযোজ্য। সে প্রচুর কাজ করছে। সেনাবাহিনীকে ছোটখাটো জিনিস সাপ্লাই দিচ্ছে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব জিনিস। একবার সাপ্লাই দিল এক টন নারিকেল তেল। এক টন নারিকেল তেলের তাদের প্রয়োজনটা কী কে জানে! ট্যাংকের চাক্কায় কী দেবে! জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যায়। কলিমউল্লাহ জিজ্ঞেস করে না। বাড়তি কৌতূহল দেখানোর দরকার কি?

তার সাপ্লাই দেয়া নিয়ে কথা। মিলিটারি সাপ্লাই মানে পয়সা। নগদ পয়সা।মিলিটারি সাপ্লাই ছাড়াও সম্পূর্ণ নতুন এক জায়গা থেকে ভালো টাকা আসছে। টাকাটা অন্যায়ভাবে আসছে তা ঠিক, তবে যুদ্ধের বাজারে ন্যায় অন্যায় দুই যমজ ভাই। বোঝার উপায় নাই কোন ভাই ন্যায়, কোন ভাই অন্যায়। দুজনই দেখতে একরকম।

টাকা বানানোর নতুন কায়দাটা হলো বন্দিশিবির থেকে খবর বের করা। আত্মীয়স্বজনরা খবরের জন্যে আধাপাগল হয়ে থাকে। টাকা খরচ করতে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। গয়না, বাড়ি-ঘর বিক্রি করে হলেও টাকার জোগাড় করবে, শুধু একটা খবর দরকার। বেঁচে আছে না। মারা গেছে।খবর সাপ্লাইয়ের ব্যবসা অনেকেই করছে। ঘরে বসে উপার্জন। কোনো রিস্ক নেই। অনেক বিহারি যেখানে করছে, সেখানে তার এই ব্যবসা করতে ক্ষতি কী?

বরং লাভ আছে। টাকাটা বিহারিদের হাতে না গিয়ে বাঙালির হাতে থাকিল।এই ব্যবসায় তার এক বিহারি পার্টনার অবশ্যি আছে। মজনু শেখ। টাকার অর্ধেক ভাগ তাকে দিতে হয়। পুরো টাকাটা সে রাখতে পারে না। ব্যবসাটা একা করতে পারলে হতো। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বিহারি লোক ছাড়া বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য করা যায় না। বাঙালিরা এখন বিহারি বিশ্বাস করে না। শুধু এই একটি ক্ষেত্রে বিহারির কথা তারা বিশ্বাস করে।

ব্যবসাটা এইভাবে হয়–একজন এলো তার ভাইকে মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে। সে বেঁচে আছে না বন্দিীশিবিরে আছে জেনে দিবে। তার কাছে খবর পাঠাতে হবে। মুক্তির ব্যবস্থা করা যায় কি-না দেখতে হবে।কলিমউল্লাহ প্রথমে খুব সূক্ষ্মভাৱে পার্টির টাকা-পয়সা কেমন আছে বােঝার চেষ্টা করে। পার্টি দুর্বল হলে এক ব্যবস্থা, সবল হলে অন্য ব্যবস্থা। মাঝামাঝি অর্থনৈতিক অবস্থার পার্টির সঙ্গে প্রথমদিন কলিমউল্লাহর নিম্নোক্ত কথাবার্তা হয়–আপনার ভাইকে কবে ধরে নিয়ে গেছে?

সোমবার।তারিখটা বলেন, শুধু বার বললে তো হবে না।আঠারো তারিখ।ভাইয়ের নাম, বয়স বিস্তারিত একটা কাগজে লেখে আমাকে দেন। ছবি এনেছেন? জি-না।কী আশ্চর্য কথা, একটা ছবি সঙ্গে করে আনবেন না! এখন নিয়া আসি। সিঙ্গেল ছবি বোধহয় নাই, গ্রুপ ছবি আছে।

গ্রুপ ছবি থেকে কী বোঝা যাবে বলেন। সিঙ্গেল ছবি জোগাড় করার ব্যবস্থা করেন। তবে আজকে না। আজ আমার কাজ আছে। আগামীকাল এই সময়ে আসেন।জি আচ্ছা। খবর কি পাওয়া যাবে? সেটা তো ভাই বলতে পারব না। অবস্থা বুঝেন না? আমি চেষ্টা করব সেটা বলতে পারি।টাকা-পয়সা কত দেব?

আরে রাখেন টাকা-পয়সা, আগে খোঁজটা পাই কি-না দেখি। আগামীকাল ছবি নিয়ে আসেন, আর ভাইকে যদি কোনো খবর পাঠাতে চান, সেটা চিঠির মতো করে দেন। সেই চিঠিতে খবরদার আপনার ভাইয়ের নাম উল্লেখ করবেন। না। নিজেদের নামও লিখবেন না। চিঠি ধরা পড়লে বিরাট সমস্যা হয়।ভাই সাহেব, কিছু টাকা দিয়ে যাই?

আপনার মনে হয় টাকা বেশি হয়ে গেছে। এখন বাড়িতে যান। আল্লাহখোদার নাম নেন। টাকা খরচের সুযোগ পাবেন।পার্টি খুবই খুশি হয়ে বাড়ি যায়। এক ধরনের ভরসাও পায় যে, এরা ধান্দাবাজ না।

পরের দুই সপ্তাহ পাটিকে শুধু খেলানো। প্রথমবার বলা যে বেঁচে আছে। তবে পুরো নিশ্চিত না।তারপরের বার বেঁচে আছে এই ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত। তবে মিলিটারি খুবই অত্যাচার করছে। মার বন্ধ করার জন্যে টাকা।তারপরের বার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, একবেলা শুধু একটা শুকনা রুটি দিচ্ছে। টাকা খরচ করলে হয়তো রেশনের খাওয়া পাবে, তবে নিশ্চিত।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *