জোছনা ও জননীর গল্প পর্ব – ৩৫ হুমায়ূন আহমেদ

জোছনা ও জননীর গল্প পর্ব – ৩৫

শেষবার বড় অংকের টাকা নেয়া হয় মিলিটারিকে ঘুস দিয়ে রিলিজ করে নিয়ে আসার জন্যে। তবে আগেই বলা হয় সম্ভাবনা মাত্র ত্ৰিশ পারসেন্ট। ভাগ্য ভালো থাকলে রিলিজ হয়ে যাবে। ভাগ্য খারাপ হলে পুরো টাকা নষ্ট হবে। এখন আপনি দেখেন চান্স নিবেন কি না। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন। আমি বলব, চান্স না নিতে। এরা আজকাল রিলিজ করে দেবে এই বলে টাকা খায় কিন্তু কাজ করে না। বিরাট হারামি জাতি।

এই কথা বলার পরেও সব পার্টি টাকা দেয়। সম্ভাবনা যত কমই হোক, একটা চেষ্টা তো করা হলো।কলিমউল্লাহকে গুছিয়ে কথা বলা ছাড়া আর কিছুই করতে হয় না। ঘরে বসে রোজগার। কলিমউল্লাহর মাঝে মাঝে মনে হয়, যুদ্ধের সময় হলো বুদ্ধি পরীক্ষার সময়। বুদ্ধি থাকলে যুদ্ধের সময় করে খেতে পারবে, বুদ্ধি না থাকলে শেষ। নিজের বুদ্ধিতে কলিমউল্লাহ নিজেই মাঝে-মাঝে চমৎকৃত হয়।

জোহর সাহেবের সঙ্গে কলিমউল্লাহর যোগাযোগ আছে। তবে জোহর সাহেব এখন আগের চেয়ে অনেক ব্যস্ত। সব সময়ই তার ঘরে লোকজন থাকে। বেশির ভাগ দিন কথাবার্তাই হয় না। কলিমউল্লাহর ধারণা যে প্রয়োজনে প্রথম তাকে ডাকা হয়েছিল, সেই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলেই তার আলাদা ডাক পড়ে না।

প্রয়োজনটা কী ছিল তা এখনো কলিমউল্লাহর কাছে পরিষ্কার না। প্রয়োজন শেষ হলে তাকে পুরোপুরি বিদেয় করে দেয়ার কথা। তাও এরা করছে না। শত ব্যস্ততার মধ্যেও জোহর সাহেব তার দিকে তাকিয়ে পরিচিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন। এইটাই কম কী! জোহর সাহেব অতি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ক্ষমতাধর মানুষের চোখের ইশারারও দাম আছে।

জোহর সাহেবের শরীর-স্বাস্থ্য মনে হয় খুবই খারাপ হয়েছে। চাদর আগেই গায়ে দিয়ে রাখতেন, এখন চাদরের নিচে ফুল হাতা সুয়েটার পরেন। দুর্দান্ত গরমে একজন মানুষ ফুলহাতা সুয়েটার এবং চাদর গায়ে দিয়ে থাকে কীভাবে – সেও এক রহস্য। তিনি সারাক্ষণই কাশেন।। যক্ষ্মারোগীর কাশির মতো খুসখুসে কাশি। ব্যাটাকে যক্ষ্মায় ধরেছে কি-না কে জানে!

কলিমউল্লাহ যখন ধরেই নিয়েছিল জোহর সাহেব তাকে আর ডাকবেন না, আলাদা করে কথাবার্তা বলবেন না, তখন ডাক পড়ল। সেদিন ঘরে লোকজন নেই। জোহর সাহেব একা। তাঁর পুরনো ভাঙ্গতে চেয়ারে পা তুলে বসে আছেন। খুসখুসে কাশি কাশছেন।

কেমন আছ কবি?

বিনয়ে গলে যাবার মতো ভঙ্গি করে কলিমউল্লাহ বলল, স্যার আপনার দোয়া।

টাকা-পয়সা ভালো কামাচ্ছেন তো?

কলিমউল্লাহ খানিকটা হকচাকিয়ে গেল। সে টাকা-পয়সা কামাচ্ছে–এই তথ্য জোহর সাহেবের জানার কথা না। ব্যাটা মনে হয় আন্দাজে ঢ়িল ছুঁড়েছে। এরা আন্দাজে ঢিল ছোড়ার বিষয়ে ওস্তাদ।জোহর সাহেব কাশতে কাশতে বললেন, টাকা-পয়সা যা কামানোর দ্রুত কামিয়ে নিন। সুযোগ বেশি দিন নাও থাকতে পারে।কলিমউল্লাহ প্ৰসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, স্যারের শরীর কি খারাপ? হ্যাঁ, খারাপ। আমার নিজের ধারণা লাংস ক্যান্সার। ডাক্তার এই কারণেই দেখাচ্ছি না। আপনার শরীর ভালো তো? জি জনাব, আমি ভালো।মোবারক হোসেন সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করেছেন?

এইবার কলিমউল্লাহ সত্যি সত্যি চমকাল। এই খবর কোনোক্রমেই জোহর সাহেবের জানার কথা না। ব্যাটা জানে কীভাবে? কলিমউল্লাহ নিজের বিস্ময় গোপন করতে করতে বলল, জি স্যার। অসহায় পরিবার। মনটা এত খারাপ হয়ে গেল। মাথার উপরে দেখাশোনার কেউ নাই–এই ভেবে এত বড় দায়িত্ব নিলাম। আপনার কথাও তখন মনে পড়ল।

আমার কথা মনে পড়ল কেন?

আপনি বলেছিলেন পরিবারটির জন্যে আপনি কিছু করতে চান?

কলিমউল্লাহ।

জি স্যার।

তুমি অনেক বুদ্ধিমান, কিন্তু তোমার চেয়ে আমার বুদ্ধি অনেক বেশি। কেউ যখন আমাকে খুশি করার জন্যে কিছু বলে, আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলি। আমার তখন ভালো লাগে না।

আমি ভুল করে থাকলে মাফ করে দেবেন স্যার।

আলবদর বাহিনী তৈরি হচ্ছে শুনেছ?

জি-না স্যার।

আমি চাই তুমি আলবদরে ঢুকে যাও। সেখানে কিছু বুদ্ধিমান মানুষ দরকার।

আপনি যা বলবেন, তাই হবে স্যার।

কোরআন শরীফ পড়েছ?

কলিমউল্লাহ বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বলল, মুসলমানের ছেলে কোরআন শরীফ পড়ব না, কী বলেন স্যার!

জোহর সাহেব কাশি থামিয়ে শান্ত গলায় বললেন, আল্লাহপাক কোরআন শরীফে বলেছেন–মানুষকে আমি সর্বোত্তম রূপে তৈরি করি। সে যখন পরিবর্তিত হয়, তখন তাকে সর্বনিম্ন স্তরে নিয়ে যাই।কলিমউল্লাহ বলল, বাহ সুন্দর আয়াত! জোহর সাহেব কলিমউল্লাহর দিকে ঝুকে এসে বললেন, তুমি ছিলে কবি। একজন কবি হলো মানুষের সর্বোত্তম রূপ। তুমি যখন পরিবর্তিত হবে, তখন কতটা পরিবর্তিত হও–সেটা আমার দেখার ইচ্ছা।স্যার কি আমার উপর কোনো কারণে রাগ করেছেন?

না, রাগ করি নি। একজন কবি কি কখনো আরেকজন কবির উপর রাগ করতে পারে? ভালো কথা, কোরআন শরীফে কবিদের প্রসঙ্গে একটা আয়াত আছে, সেটা কি তুমি জানো?

জি-না স্যার।

পরেরবার আয়াতটা জেনে আসবে। তখন এই আয়াত নিয়ে আমরা

আলোচনা করব।

জি আচ্ছা স্যার।

জোহর সাহেবের ঘর থেকে বের হয়ে কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, তোর দিন ঘনায়ে এসেছে। দিন ঘনায়ে আসলে মানুষ ধর্ম কপচায়, তুইও ধর্ম কপচাচ্ছিস।

মনে মনে এ ধরনের কঠিন কথা বললেও সে পরদিন আলবদরে ঢুকে গেল।

কলিমউল্লাহর বাবুর্চি বাচ্চু মিয়া ভোল পাল্টে বিহারি হয়ে গেছে। বিহারি হবার জন্যে তাকে খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় নি–মাথার চুল ছোট ছোট করে কাটতে হয়েছে, একটা সানগ্লাস কিনতে হয়েছে, গলায় বাঁধার জন্যে বাহারি রুমাল। প্যান্টের পকেটে রাখার জন্যে মুখ বন্ধ চাকু।

প্রতিদিনই ঢাকা শহরে সে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুরতে বের হয়। তখন মুখ ভর্তি থাকে পান, হাতে সিগারেট। তার গা থেকে ভুরতুর করে আন্তরের গন্ধ বের হয়।

লোকজন তার দিকে ভীত চোখে তাকায়। বাচ্চু মিয়ার বড় ভালো লাগে। যে-কোনো পান-সিগারেটের দোকানের সামনে সে যখন দাড়াম, দোকানি তটস্থ হয়ে পড়ে। কীভাবে খাতির করবে বুঝতে পারে না। বাচ্চু মিয়া পানের পিক ফেলে ঢেকুরের মতো শব্দ করে (ঢেকুরের শব্দ করাটা সে সম্প্রতি আয়ত্ত করেছে। এই শব্দেও লোকজন চমকায়। চমকানি দেখেও তার বড় ভালো লাগে।) এবং পিক করে পানের পিক ফেলে। বিহারিদের পানের পিক ফেলা বাঙালিদের মতো নয়। তারা আয়োজন কয়ে পিক ফেলে। এই কায়দাও এখন সে জানে। দোকানি যখন আতঙ্কে অস্থির হয়ে যায়, তখন সে বলে, তুমি সাচ্চা পাকিস্তান? (গলা গম্ভীর।)

দোকানি ক্রমাগত হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তে থাকে। তখন বাচ্চু মিয়া দ্বিতীয় দফায় পানের পিক ফেলে বলে, সিগ্রেট নিকালো। (গলা আগের চেয়েও গম্ভীর।)

দোকানি তৎক্ষণাৎ এক প্যাকেট সিগারেট (বেশিরভাগ সময় ক্যাপস্টান, এক একটা শলার দাম দশ পয়সা, সহজ ব্যাপার না) বের করে এগিয়ে দেয়।

পান খিলাও। জর্দা ডবল। চুনা কম।

দোকানি অতি দ্রুত পান বানাতে বসে। পান বানাতে শুরু করে। ভয়ে যখন তার হাত কাঁপতে শুরু করে, তখন বাচুর মায়া হয়। সে নিচু গলায় বলে, ভাইজান, এত ডরাইতেছেন কী জন্যে? আমি বিহারি না, বাঙালি। বিহারির ভাব ধরছি।

দোকানির ভয় তাতেও কাটে না। তার চোখে তখন সন্দেহ। নতুন কোনো ফাঁদ নিশ্চয়ই।

ডর খাইয়েন না ভাইজান। আল্লাহর কসম আমি বাঙালি। বাচ্চু মিয়া নাম। খালি যে বাঙালি এইটাও ঠিক না, আমি মুক্তি। (এখন গলার স্বর চাপা।)

দোকানির চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

বাচ্চু মিয়া ফিসফিস করে বলে, দিনে বিহারি সাইজা ঘুরি। মিলিটারির খোঁজ-খবর নেই। রাইতে বুম বুম বোমা। রাইতে আমরার বোমার আওয়াজ পান না?

পাই।

কাইল রাইতে পাইছিলেন? ইয়াদ কইরা দেখেন।

জি।

কয়বার পাইছেন বলেন দেখি? তিনবার। সইন্ধ্যা রাইতে দুইবার। এগারোটার সময় একবার। রাইত এগারোটার অপারেশনে আমি ছিলাম। সইন্ধ্যা রাইতে ছিলাম না। এগারোটার অপারেশনে মিলিটারি মারা পড়েছে তিনটা।

এই পর্যায়ে দোকানির বিশ্বাস ফিরে আসে। তার চোখ-মুখ থেকে ভয় কেটে যায়। মুখ হাসি হাসি হয়ে যায়। সে আনন্দিত গলায় বলে, ভাই, চা খাইবেন?

আপনার দোকানে চায়ের ব্যবস্থা কই?

ব্যবস্থা নাই, আনায়ে দেই।

আচ্ছা আনান। তার আগে সিগ্রেটের দামটা নেন। আমরা মুক্তি। জোরজবরদস্তি কইরা জিনিস নেওয়া আমরার নিষেধ আছে।

দোকানি প্রায় চেচিয়ে বলে, কী সর্বনাশ। আপনের কাছ থাইক্যা সিগারেটের দাম নিমু? আমি কি বেজন্মা?

মুক্তি সেজে গল্প করতে বাচ্চু মিয়ার ভালো লাগে। তখন নিজেকে মুক্তিই মনে হয়।

ভাইসব, আপনাদের অপারেশন চলতেছে কেমন?

রাইতে বোমা শুনেন না?

অবশ্যই শুনি। মাঝে মধ্যে দিনেও শুনি।

রাইত-দিন বইল্যা এখন আমরার কিছু নাই। সব সময় শুনবেন। আমরার দলের লোকজন আরো আসতেছে। প্ৰতিদিনই আসে।

আলহামদুলিল্লাহ।

মিলিটারির পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে গেছে। বুঝতেছেন না?

অবশ্যই বুঝতেছি।

চরমপত্র শুনেন?

আরে কী বলেন? এইটা না শুনলে চলে? চরমপত্র আর ঢাকা শহরে বোমার শব্দ–এই দুইটা না শুনলে আমার আর আমার পরিবারের ঘুম হয় না।

যতই দিন যাচ্ছে বাচ্চু মিয়ার সাহস ততই বাড়ছে। এখন সে মাঝে-মধ্যে মিলিটারির কোনো দল দেখলে এগিয়ে যায়। মিলিটারিরাও বিহারি দেখলে মনে ভরসা পায়। বাচ্চু মিয়া, তাদের দিকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে–ভাই হালত কিয়া? মিলিটারিদের সঙ্গে তার ভালোই কথাবার্তা হয়।

পানের পিক ফেলতে ফেলতে সে গম্ভীর গলায় বলে, সব মুক্তি ফিনিস করডো। বাঙালি খতম করো। সব খতম।

তার উর্দু ঠিক হয় না। তাতে সমস্যা নেই। বিহারিরাও ভালো উর্দু বলতে পারে না। বিহারিদের চেনার উপায় হলো–বাংলা উর্দুর মিকচার ভাষা। এই ভাষা বাচ্চু মিয়া জানে।

সন্ধ্যার আগে আগে বাচু ঘরে ফিরে আসে। চাল-ডালের খিচুড়ি বসিয়ে দেয়। রান্না ভালো হবে না খারাপ হবে–এটা নিয়ে চিন্তা করার কিছু নাই। সে একা মানুষ। কাঁচা চাল-ডাল চিবায়ে খেলেও কারো কিছু বলার নেই। একা থাকার এই মজা। সে কলিমউল্লাহর বাসাতেই আছে। মাঝে-মাঝে লোকটাকে নিয়ে তার চিন্তা হয়। দশ টাকা হাত খরচ দিয়ে মানুষটা যে গেল, আর তার খোঁজ নেই। মারা যায় নি তো? আজকাল মরে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না। ঘর থেকে বের হলে মৃত্যু, ঘরে বসে থাকলেও মৃত্যু। ঢাকা শহরে আজরাইলের কোনো বিশ্রাম নাই।

বাচ্চু মিয়া খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রেডিও কানের কাছে নিয়ে শুয়ে পড়ে। স্বাধীন বাংলা বেতারের কোনো কিছুই যেন বাদ না পড়ে। বিশেষ করে চরমপত্র। চরমপত্র যখন হয় তখন বাচু চরমপত্রের লোকটার মতো গলা করে বলে, দে দে গাববুইরা মাইর দে।

চরমপত্ৰ শোনার সময় তার মনে হয়, ইস যদি সত্যি মুক্তি হতে পারতাম তাহলে গাবুইরা মাইর দিতাম। মিলিটারি বুঝত মাইর কী জিনিস। বাঙালি কী জিনিস!

এক শুক্রবারে দরজার কড়া নড়ছে। কড়া নড়ার ভঙ্গি ভালো না। খারাপ কিছু না তো? কোনো বাঙালি এখন এত জোরে কড়া নাড়ে না। বাঙালি কড়া নাড়ে ভয়ে ভয়ে। লালমুখা মিলিটারি?

শুয়োরের বাচ্চারা এখন বাড়ি বাড়ি তালাশ শুরু করেছে। জোয়ান ছেলে সব ধরে নিয়ে যায়। এরা ফিরত আসে না। জোয়ান হওয়ার এই এক বিপদ হয়েছে। বড় পীর গাউসুল আযমের নাম নিয়ে বাক্ষু মিয়া দরজা খুলল। দরজা খুলে হতভম্ব! কলিউমউল্লাহ দাঁড়িয়ে আছেন। দাড়ি, মাথায় টুপি, ইন্ত্রি করা পাঞ্জাবি।

কলিমউল্লাহ বলল, কিরে তুই এখনো আছিস? পালায়ে যাস নাই?

বাচ্চু মিয়া কদমবুসি করতে কবতে বলল, আমি যামু কই? আপনে খরচ বরচ কিছুই দিয়া যান নাই। খায়া না খায়া আছি। আপনি ছিলেন কই?

কলিমউল্লাহ তীক্ষ্ণ চোখে ঘর-দুয়ার দেখতে দেখতে বলল, জিনিসপত্র বিক্রি করেছিস না-কি? খালি খালি লাগছে।

হিসাব মিলাইয়া দেখেন।

চা বানা। চা খাই। ভালো কথা, তুই কি আমার বিছানায় শুয়ে ঘুমাস নাকি? বিছানা দেখে তো সে রকমই লাগে।

বাচ্চু মিয়া জবাব না দিয়ে চা বানাতে গেল। ঘটনা সত্যি।

সে আগে মেঝেতে ঘুমাতো। এখন স্যারের বিছানাতেই ঘুমায়। যুদ্ধের বাজারে সব সমান। আম কাঠ সেগুন কাঠের একই দর। সে কেন বিছানায় ঘুমাবে না?

কলিমউল্লাহ চায়ে চুমুক দিয়ে কিছুটা শান্ত হলো। বাচ্চু মিয়া যে ঘর বাড়ি ফেলে পালিয়ে যায় নি–এটা বড় ব্যাপার। চুরি অবশ্যই করেছে। টুকটাক চুরি তো করবেই।

স্যার, আপনে ছিলেন কই?

কলিমউল্লাহ বলল, বিয়ে করলাম। এই নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।

বাচ্চু মিয়া অবাক হয়ে বলল, বিবাহ করেছেন?

হুঁ।

ভাবিসাব কই?

আছে। অন্য একটা বাড়িতে তুলেছি।

উনার নাম কী?

নাম দিয়ে তুই কী করবি? ফাজিলের মতো কথা।

উনার সাথে পরিচয় হবে না?

তুই এত বড় তালেবর যে পরিচয় করায়ে দিতে হবে? তুই এই বাড়িতে যে রকম আছিস, সে রকম থাকিবি। বাড়ি পাহারা দিবি। বুঝেছিস?

বুঝলাম।

আমি মাঝে-মধ্যে এসে দেখে যাব। খরচ দিয়া যাব। জিনিস বিক্রি বন্ধ।

বাচ্চু মিয়া নিজের জন্যেও চা বানিয়ে এনেছে। বেয়াদবি যেন না হয়। সে জন্যে অন্যদিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। স্যার বিবাহ করেছেন শুনে ভালো লাগছে। যে বাড়িতে মেয়েছেলে নাই, সে বাড়িতে কাজ করে মজা নাই।

স্যার, দেশ স্বাধীন হইব কবে?

স্বাধীন তো হয়েই আছে। নতুন করে কী হবে? উল্টা পাল্টা কথা বন্ধ।

জি, আচ্ছা বন্ধ।

তুই চাকর, চাকরের মতো থাকিবি। তোর কাজ ভাত রান্দা, বুঝেছিস?

জি, বুঝলাম। তয় এখন অবশ্য ভাত রান্দনের সময় পাই না। কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে হয়।

কলিমউল্লাহ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কী কাজকর্ম?

বাচ্চু মিয়া উদাস গলায্য বলল, মুক্তি হয়েছি স্যার।

কী হয়েছিস?

মুক্তি।

কলিমউল্লাহ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। স্যারের অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটা বাচ্চু মিয়ার বড় ভালো লাগছে। এখন সে আর ভাত রান্দা চাকর না। সে মুক্তি! মুক্তি কোনো সহজ জিনিস না।

তুই মুক্তি হয়েছিস?

জি। দিনে ঘুমাই, রাইতে অপারেশন। আইজ রাইতেও অপারেশন আছে। দোয়া রাইখেন। চা কি আরেক কাপ খাইবেন? বানাই?

কলিমউল্লাহ হ্যাঁ না কিছু বলল না। বাচ্চু মিয়া চা বানাতে গেল। তার বড় ভালো লাগছে যে স্যার তার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেছে। যুদ্ধের বাজার বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। যুদ্ধের বাজারে মিথ্যা কথাকে সব সময় সত্যি মনে হয়। এইটাই হলো যুদ্ধের বাজারের মজা।

চায়ের কাপ কলিমউল্লাহর হাতে দিতে দিতে বাচ্চু মিয়া বলল, স্যার, একটু দোয়া রাইখেন আইজি আমরার বিরাট অপারেশন আছে। জীবন নিয়া ফিরতে পারব কি-না। আল্লাহ মান্বুদ জানে। মনে হয় না।

অপারেশন কোথায়?

এইটা বলা নিষেধ আছে।

বাচ্চু মিয়া!

জি স্যার।

আমার সঙ্গে ফাজলামি না করলে ভালো হয়। কয়েকদিনের জন্যে বাইরে ছিলাম, এর মধ্যে তুই মুক্তি হয়ে গেছিস?

বাচ্চু মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ধরছেন ঠিক। তয় স্যার মুক্তিতে ঢুকতেছি। কথাবার্তা চলতেছে।

চুপ!

জি আচ্ছা চুপ করলাম। স্যার গোসল করবেন? পানি গরম করি?

না।

গায়ে তেল ডলে দেই? আরাম পাবেন। তেল ডলার পরে গোসলে মজা আছে। দিব?

কলিমউল্লাহ উদার গলায় বলল, দে।

আরামে কলিমউল্লাহর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, বাচ্চু মিয়ার শরীর ম্যাসাজেব এই গুণটি তুচ্ছ করার মতো না। মাঝে-মাঝে এই বাড়িতে এসে গা ম্যাসাজ করালে খারাপ হবে না। ম্যাসাজে রক্ত চলাচল ভালো হয়। শরীর ঠিক থাকে। শরীর ঠিক থাকা মানেই মেজাজ ঠিক থাকা।

বাচ্চু মিয়া!

জি স্যার।

এত ভালো ম্যাসাজ তুই শিখেছিস কার কাছে?

আমার ওস্তাদ মনু মিয়া বাবুর্চির শইল ডালতে ডালতে শিখছি।

তোর কাজ যুদ্ধও না, রান্দাও না। তোর কাজ শইল ডলা। বুঝেছিস?

জি স্যার।

যুদ্ধ বিষয়ে একটা পাঞ্জাবি শের শুনবি? জোহর সাহেবের কাছ থেকে শুনে নোট করে রেখেছিলাম। শেরাটা হলো

সুলেহ, কীতিয়ান ফাতেহ যি বাতাবে

কমর জং তি মূল না কাসেয়ে নি

এর অর্থ হলো, যদি শান্তি বিজয় আনে, তাহলে যুদ্ধ করো না। কবিতাটা সুন্দর না?

কলিমউল্লাহ স্যারের ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে বাচু বলল, যুদ্ধ ছাড়া আমরার গতি নাই। বিনা যুদ্ধে পাঞ্জাবি যাবে না। খাবিস জাত।

চুপ থাক।

জি আচ্ছা।

বাঙালি যুদ্ধ করার জাত না। বুঝেছিস?

জি বুঝেছি। তয় মনে একটা বিরাট শখ ছিল যুদ্ধ করব। একটা পাঞ্জাবি মারতে পারলেও জীবন সার্থক হইত।

আর কথা না চুপ।।

জি আইচ্ছা।

ম্যাসাজ অতি আরামের হচ্ছে। কলিমউল্লাহ ঘুমিয়ে পড়েছে। এই সুযোগে বাচ্চু মিয়া তার মনের কথা বলে যাচ্ছে— স্যার, ধরেন যুদ্ধ করা যদি কপালে নাও থাকে, একটা অপারেশন যদি খালি দেখতে পারতাম! একদিকে গুলি করতাছে মুক্তি আরেক দিকে পাকিস্তান। পাকিস্তান মইরা সাফ, এরা আমরার মুক্তির বালটাও ছিঁড়তে পারল না। এমন একটা দৃশ্য যদি দেখতে পারতাম— দেখি আল্লা কী করে। কপালে থাকলে দেখব। আপনে কী বলেন স্যার? আপনে কি ঘুমে?

কলিমউল্লাহ পুরোপুরি ঘুমে— এই বিষয়ে নিশ্চিত হবার পরেই বাচ্চু মিয়া তার পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট সরিয়ে ফেলল। যুদ্ধের বাজারে চুরি দোষের মধ্যে পড়ে না।পরম করুণাময় মানুষের সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করেন বলেই হয়তো বাচ্চু মিয়ার ইচ্ছাও পূর্ণ করলেন।

সে চোখের সামনে মুক্তিদের একটা বড় অপারেশন দেখার সুযোগ পেল। সে বাংলা মোটরের কাছে বিহারি সেজে কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ, কালো পোশাকের মিলিটারি এবং সেনাবাহিনীর একজন সেকেন্ড লেফটেনেন্টের সঙ্গে গল্প করছিল। এমন সময় দেখল একটা কালো রঙের টয়োটা গাড়ি তাদের কাছে এসে হঠাৎ যেন ব্রেক করে থামল।

মুহুর্তেই গাড়ির জানালা থেকে প্রবল গুলি বর্ষণ হতে লাগল। একটি গ্রেনেড উড়ে এলো গাড়ির ভেতর থেকে।গাড়ি যেমন উড়ে এসেছিল ঠিক তেমনিভাবে উড়ে চলে গেল। বাচ্চু মিয়া মারা গেল চোখের সামনে ঢাকা শহরের গেরিলাদের ভয়াবহ একটি আক্রমণ দেখে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে খুব কম মানুষের মনই আনন্দে অভিভূত থাকে। তারটা ছিল।

কোলকাতায় পার্ক সার্কাসের একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের নাম কোহীনূর ম্যানশন। কোহীনূর ম্যানশনের মাঝারি ধরনের ফ্ল্যাটে বাংলাদেশের প্রবাদ পুরুষ মাওলানা ভাসানী বাস করেন। তাঁর সঙ্গী মুজাফফর-ন্যাপের এক সময়ের কমী জনাব সাইফুল ইসলাম। সাইফুল ইসলামের দায়িত্ব বিভিন্ন জায়গায় মাওলানা ভাসানীর বিবৃতি পাঠানো, রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে লেখা চিঠি কপি করা। চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা করা।

মাওলানা সেখানে খানিকটা নির্বাসিত জীবন-যাপন করছেন; স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলধারা থেকে আলাদা। সংগ্ৰামময় দীর্ঘ জীবন পার করে এখন একটু যেন ক্লান্ত।

তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে নিজের হাতে একটি চিঠি লিখেছেন। তার বক্তব্য–

আমার প্রথম পুত্রের মৃত্যু হয় ধুবড়ির গ্রামে। তাই আমার

বৃদ্ধ স্ত্রীর আশা শেষ দাফন ধুবড়ির কোনো গ্রামে হয়।…*

চিঠিতেও বিষাদের সুর। যেন তিনি দূরাগত ঘণ্টা ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন।

মাওলানা ভাসানী তার ফ্ল্যাটের বসার ঘরে বসে আছেন। তার পরনে সেলাইবিহীন লুঙ্গি, গায়ে ধবধবে সাদা ফতুয়া। ডান হাতে তসবির ছড়া। তিনি তসবি টানছেন। তাঁর দৃষ্টি স্থির। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। প্রধানমন্ত্রী মাওলানার পা স্পর্শ করে সালাম করলেন। বিনীত, গলায় বললেন, হুজুর কেমন আছেন?

মাওলানা বললেন, ভালো আছি মনের সুখে মাছি মারতেছি। এদিকে অনেক মাছি।

আপনার খাওয়া দাওয়ার কোনো অসুবিধা কি হচ্ছে?

মাওলানা তসবি টানা বন্ধ করে বললেন, খাওয়া দাওয়ার সুবিধা অসুবিধার কথা বাদ দেও। কোনো কাজের কথা থাকলে বলো।

হুজুর, আমি নানান অসুবিধায় আছি।

কেউ সুবিধায় নাই। তবে তোমার অসুবিধা বুঝতে পারি। বাতাস বড় গাছে লাগে। ছোট গাছে লাগে না। তুমি এখন বড় গাছ।

বড় গাছ হওয়ার বাসনা কোনো দিন আমার ছিল না।

হ্যাঁ, এই কথাটা সত্য বলেছ।

আপনার কাছে পরামর্শের জন্যে এসেছি।

শোনো তাজউদ্দিন, আমি পরামর্শের মুদির দোকান খুলি নাই। দোয়া যদি চাও বলো দোয়া দিতে পারি।

আমি আপনার কাছে পরামর্শ চাই।

কোন বিষয়ে?

তাজউদ্দিন চুপ করে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ মওলানার হাতের তসবি দ্রুত ঘুরল। একসময় তসবির ঘূর্ণন বন্ধ হলো। তিনি শান্ত গলায় বললেন, নিজের বুদ্ধিতে চলবা–এইটাই আমার পরামর্শ। যুদ্ধের বাজারে ভেজাল বুদ্ধির বিকিকিনি হয়। বুদ্ধি কিনতে গেলে ভেজাল বুদ্ধি পাইবা। এই আমারে দেখ, সারাজীবন নিজের বুদ্ধিতে চলেছি। ভালো কথা, তোমার কি ক্ষুধা হয়েছে? কিছু খাবা?

তাজউদ্দিন না-সূচক মাথা নাড়লেন। মাওলানা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বয়স হয়ে গেছে। শরীরে শক্তি নাই। মনে শক্তি আছে শরীরে নাই। শরীরে শক্তি থাকলে তোমারে বলতাম, আমারে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার বানায়া আমার নিজ গ্রামে পাঠায়ে দেও।অনেক বড় যুদ্ধ অস্ত্র ছাড়া করা যায়।

শেষে কিন্তু অস্ত্ৰ লাগে। খবরের কাগজে দেখলাম, ফ্রান্সের আঁদ্রে মালরো এই বয়সেও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থেকে সরাসরি যুদ্ধ করতে চান। খবরটা পড়ে এত ভালো লেগেছে সঙ্গে সঙ্গে চোখে পানি এসেছে। আমি খাস দিলে উনার জন্যে দোয়া করেছি। আমি উনাকে ধন্যবাদ জানায়ে একটা পত্ৰ দিব। তুমি পাঠাবার ব্যবস্থা করো।জি করব। আমার প্রতি আপনার আর কোনো আদেশ কি আছে? একটা আদেশ আছে। আদেশ বলো, অনুরোধ বলো, নির্দেশ বলো একটা আছে।বলুন কী আদেশ?

আমাকে স্বাধীন বাংলাদেশের ধুবড়ি গ্রামে পাঠাবার ব্যবস্থা করো। আমার সময় শেষ হয়ে আসছে। আমি আমার নিজ গ্রামে মরতে চাই।মাওলানা চোখ বন্ধ করলেন। আবারো তসবি ঘুরতে লাগল। প্রধানমন্ত্রী উঠার ভঙ্গি করতেই মাওলানা ইশারায় তাঁকে বসতে বললেন। মাওলানা চোখ মেলে শান্ত গলায় বললেন, মাথা কাছে আনো, তোমার জন্যে একটু দোয়া করে দেই। ভালো কথা, আমার এখান থেকে কিছু মুখে না দিয়া যাবে না। চালভাজা খাবে? চাল ভাজতে বলি। তেল-মরিচ দিয়ে চালভাজা খাও। বাংলাদেশী খাদ্য।

প্রধানমন্ত্রী মাথা এগিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। মাওলানা তাঁর মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছেন।

সূত্র : স্বাধীনতা ভাসানী ভারত, সাইফুল ইসলাম

ত্রিপুরার বাংলাদেশ হাসপাতাল থেকে পাঠানো

মায়ের কাছে লেখা জনৈক মুক্তিযোদ্ধার চিঠি

৭৮৬

পাক জনাবেষু আম্মাজান,

পত্রে আমার শতকোটি ছালাম জানিবেন। দাদিজান এবং দাদাজানের কদম মোবারকেও আমার শতকোটি ছালাম। বাড়ির অন্য সকলের জন্যে শ্রেণীমতো ছালাম ও দোয়া।

পর সমাচার এই যে, আমি ভালো আছি। আপনারা আমার যে মৃত্যুসংবাদ শুনিয়াছেন ইহা সত্য নহে। আমার দুই পায়ে মর্টারের শেল লাগিয়াছিল। যথাযথ চিকিৎসা হইয়াছে। এখন আমি হাসপাতালে আছি, সুস্থ হইয়া উঠিতেছি, ইনশাআল্লাহ। অনেক বিশিষ্ট মানুষ আমাকে দেখিতে আসিয়াছে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আমার নাম উঠিয়াছে। ইহা বিরাট সুসংবাদ। দেশ স্বাধীন হইলে আমি সারাজীবন সরকার হইতে ভাতা পাইব।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *