তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(১২) হুমায়ূন আহমেদ

অতি দ্রুত আন্টির শরীর খুব খারাপ করল। তিনি একেবারেই ঘুমুতে পারেন । গাদা গাদা ঘুমের ওষুধ খান— তারপরেও জেগে থাকেন। সারাক্ষণ নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলেন। অর্থহীন এলােমেলাে সব কথা। হঠাৎ হাসতে শুরু করেন সেই হাসি কিছুতেই থামে না। আবার যখন কাদতে থাকেন সেই কান্নাও চলতে থাকে। 

তন্দ্রাবিলাসবাবা যখন দেশে ফিরলেন তখন আন্টি পুরােপুরি উন্মাদ। কাউকেই চিনতে পারেন না। আমাকেও না। আন্টির চেহারাও খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মুখ শুকিয়ে মিসরের মমীদের মত হয়ে গেছে। দাঁত বের হয়ে এসেছে। সারা শরীরে বিকট গন্ধ। বাবা হতভম্ব হয়ে গেলেন। আন্টির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হল। চিকিৎসায় কোনও লাভ হল না। ক্রমে ক্রমে তাঁর পাগলামী বাড়তে থাকল। বাবাকে দেখলেই তিনি ক্ষেপে উঠতেন। একদিন সকালে পাউরুটি কাটার ছুরি নিয়ে তিনি বাবার ওপর ঝাপিয়ে পড়লেন ! ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারত। ভাগ্যক্রমে ঘটে নি–শুধু বাবার পিঠ কেটে রক্তারক্তি হয়ে গেল। 

আন্টিকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হল। আন্টির বাবা এসে তাকে নিয়ে 

গেলেন। সেখানে থেকে তিনি কিছুটা সুস্থ হলেন। তখন তাঁকে আবার আমাদের এখানে আনা হল। তিনি আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হল। 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(১২) হুমায়ূন আহমেদ

মাঝে মধ্যে আমি ওনাকে দেখতে যেতাম। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতেন না। কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকতেন। আন্টিদের বাড়ির কেউ চাইত না যে আমি যাই। 

আমি যাওয়া ছেড়ে দিলাম। 

শরিফার প্রসঙ্গে আসি। শরিফার হাত থেকে আমি খুব সহজে মুক্তি পেয়ে যাই। শরিফাকে আমি এক রাতে বলি—শরিফা তােমার কি উচিত না তােমার স্বামীর সঙ্গে গিয়ে থাকা ? 

শরিফা বলল, জাে উচিত। তুমি তার কাছে চলে যাও | হে কই থাকে জানি না আফা। আমি তাকে এনে দেব ? জ্বে আফা। 

আমি শরিফার স্বামীকে খবর পাঠালাম সে যেন এসে তার সাইকেল নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর যেন আসে। 

সে খুশি মনে সাইকেল নিতে এল। সাইকেলের সঙ্গে সে অন্য কিছুও নিয়ে গেল। মিসির আলি সাহেব—-আপমার জন্যে বিস্ময়কর খবর হল— মাসখানেক 

পরে আমি খবর নিয়ে জানতে পারি শরিফার স্বামীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তার আত্মীয় স্বজনরা তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিল। ভর্তি করাতে না পেরে শহরেই তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে। 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(১২) হুমায়ূন আহমেদ

তখন 

মিসির আলি সাহেব, 

এই সম্বােধন বার বার করতে আমার কুৎসিত লাগছে। নামের শেষে সাহেব আবার কি? নামের শেষে সাহেব লাগালেই মানুষটাকে অনেক দূরের মনে হয়। দূরের মানুষের কাছে কি এমন অন্তরঙ্গ চিঠি লেখা যায়? একবার ভেবেছিলাম ‘স্যার’ লিখি। তারপর মনে হল- স্যার তাে সাহেবের মতই দুরের ব্যাপার। মিসির আলি চাচা লিখব? না তাও সম্ভব না। মিসির আলি এমনই এক চরিত্র যাকে চাচা বা মামা ডাকা যায় না। গৃহী কোনও সম্বােধন তাঁকে মানায় না। দেখলেন আপনাকে আমি কত শ্রদ্ধা করি? না দেখেই কোনও মানুষকে এতটা শ্রদ্ধা করা কি ঠিক? থাকুক তত্ত্ব কথা— নিজের গল্পটা বলে শেষ করি। অনেকদূর তাে বলেছি – আপনি কি বুঝতে পারছেন যা বলছি সব সত্যি বলছি ? অর্থাৎ আমি যা সত্যি বলে বিশ্বাস করছি তাই বলছি। 

যতটুকু পড়েছেন সেখান থেকে কি বুঝতে পারছেন যে বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভাল না।। 

বাবা আমাকে পছন্দ করেন না। 

কেন করেন না, আমি জানি না। আমি কখনও জিজ্ঞেস করি নি। কিন্তু বুঝতে পেরেছি। পছন্দ করেন না মানে এই না যে তিনি সারাক্ষণ ধমকাধমকি করেন। এইসব কিছুই না। মাঝে মাঝে গল্প করেন। লেজার ডিস্কে ভাল ছবি আনলে হঠাৎ বলেন, মা এসাে ছবি দেখি। জন্মদিনে খুব দামী গিফট দেন। যতবারই বাইরে যান আমার জন্যে কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। তারপরেও আমি বুঝতে পারি বাবা আমাকে তেমন পছন্দ করেন না। মেয়েরা এইসব ব্যাপার খুব সহজে ধরতে পারে। কে তাকে পছন্দ করছে কে করছে না— এই পর্যবেক্ষণ শক্তি মেয়েদের সহজাত। এই বিদ্যা তাকে কখনও শিখতে হয় না। সে জন্মসূত্রে নিয়ে আসে। ঐ যে কবিতা 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(১২) হুমায়ূন আহমেদ

“এ বিদ্যা শিখে না নারী আসে আপনাতে” 

আন্টি অসুস্থ হয়ে যাবার পর বাবা যেন কেমন কেমন চোখে আমাকে দেখতে লাগলেন । যেন আমিই আন্টিকে অসুস্থ করেছি। আমি যেন ভয়ংকর কোনও মেয়ে আমার সংস্পর্শে যে আসবে সেই মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে।। 

বাবার দুশ্চিন্তার কারণও আছে। ছােট মা অসুস্থ হবার পর আমার ঘরেই বেশির ভাগ সময় থাকতেন। তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আমার বিছানাতে শুয়ে মারা যান। যে রাতে তিনি মারা যান সে রাতে অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প করেন। আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর তিনি ঘুমের ওষুধ খান— একটা চিঠি লেখেন। তারপর আমার সঙ্গে ঘুমুতে আসেন। আমি ভােরবেলা জেগে উঠে দেখি তিনি কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন চোখ আধা খােলা। চোখের সাদা অংশ চকচক করছে। মুখ খানিকটা

হিম হয়ে আছে। আমার তখন খুব কম বয়স। তারপরেও আমি বুঝলাম তিনি মারা গেছেন। আমি ভয় পেলাম না। চিৎকার দিলাম না। শান্ত ভঙ্গিতেই বিছানা থেকে নামলাম। দরজা ভেতর থেকে ছিটকিনি দেয়া। আমি চেয়ারে দাঁড়িয়ে ছিটকিনি খুলে বাবার ঘরে গিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাবাকে বললাম, ছােট মা মারা গেছেন। 

বাবা তখন কফি খাচ্ছিলেন। তিনি খুব ভাের বেলা ওঠেন। নিজেই কফি বানিয়ে খান। তিনি মনে হল আমার কথা বুঝতে পারলেন না, কাপ নামিয়ে রেখে বললেন- মা কি বললে? 

আমি আবারও বললাম, ছােট মা মারা গেছেন। বাবা দ্বিতীয় শব্দ উচ্চারণ করলেন না। 

আমার ঘরে এসে ঢুকলেন। এক পলক ছােট মাকে দেখলেন। 

তাঁর কপালে হাত রাখলেন। তারপর রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(১২) হুমায়ূন আহমেদ

ছােট মা’র পর শরিফা মারা গেল। সেও থাকত আমার ঘরে। সেও কি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ? আমরা যদি ধরে নেই কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেনি তাহলে বুঝতে হবে শরিফা নিজেই ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে। যে মেয়ে পরদিন স্বামীর কাছে যাবে সে এই কান্ড কখন করবে ? মানসিক ভাবে অসুস্থ হলেই করবে। শরিফাও তাহলে অসুস্থ ছিল। 

আন্টির অসুস্থতা তাে চোখের সামনে ঘটল। আমার ঘরেই তার শুরু। কাজেই বাবা যদি ভেবে থাকেন প্রতিটি অসুস্থতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে তাহলে বাবাকে খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। 

এক রাতে, খাবার টেবিলে তিনি বললেন—নিশা, তােমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। আমি বললাম, বল। 

বাবা বললেন, খাবার টেবিলে বলতে চাচ্ছি না, খাওয়া শেষ করে আমার ঘরে আস। দু’জন কথা বলি। 

আমি বললাম, আচ্ছা। তােমার বয়স এখন কত? আমি বললাম, অক্টোবরে পনেরাে হবে।। 

তাহলে তাে তুমি অনেক বড় মেয়ে। তােমার বয়স পনেরাে হতে যাচ্ছে তা বুঝতে পারি নি। 

আমি হাসলাম। বাবা বললেন, তুমি যে খুব সুন্দর হয়েছ তা কি তুমি জান? 

না

কেউ তােমাকে বলে নি ? তােমার বন্ধু বান্ধবরা ?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *