আমার কোনও বন্ধুও নেই। নেই কেন? কারও সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয় না।। হয় না কেন? আমি তাে জানি না কেন হয় না। মনে হয় আমাকে কেউ পছন্দ করে না। তােমাকে পছন্দ না করার তাে কোনও কারণ নেই।
তুমি নিজেই আমাকে পছন্দ কর না। অন্যদের দোষ দিয়ে কি হবে ? আমি তােমাকে পছন্দ করি না ?
কর না। তােমার এই ধারণা হল কেন?
আমি চুপ করে রইলাম। বাবাও চুপ করে গেলেন। মনে হচ্ছে তিনি খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন। অস্বস্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিস্ময়বােধ। অতি কাছের একজনকে নতুন করে আবিষ্কারের বিস্ময়।
রাত দশটার দিকে বাবার ঘরে গেলাম। ইচ্ছে করে খুব সেজেগুজে গেলাম। লাল পাড়ের হাল্কা সবুজ একটা শাড়ি পরলাম। কপালে টিপ দিলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চমকে গেলাম কি সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ির মেয়ে। কনের ছােট বােন।
বাবা আমার সাজগােজ দেখে আরও ভড়কে গেলেন । বিব্রত গলায় বললেন, মা বােস। তােমাকে তাে চেনা যাচ্ছে না
আমি বসতে বসতে বললাম, তােমার জরুরি কথা শুনতে এসেছি। বাবা বললেন, এত সেজেছ কেন? এমনি সাজলাম। মাঝে মাঝে আমার সাজতে ইচ্ছা করে। আমি আগে কখনও তােমাকে সাজতে দেখি নি। আমাকে কি সুন্দর লাগছে না বাবা? অবশ্যই সুন্দর লাগছে। কপালের টিপটা কি নিজেই এঁকেছ ?
আমি বললাম, বাবা তুমি নানান কথা বলে সময় নষ্ট করছ। কি বলবে সরাসরি বলে ফেল। অস্বস্তি বােধ করার কিছু নেই।
অস্বস্তি বােধ করার কথা আসছে কেন ?
তােমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তুমি অস্বস্তি বােধ করছ। তুমি বরং এক কাজ কর, দুই পেগ হুইস্কি খেয়ে নাও এতে তােমার ইনহিবিশন কাটবে। যা বলতে চাচ্ছ সরাসরি বলে ফেলতে পারবে।।
হুইস্কি খেলে ইনহিবিশন কাটে এই তথ্য জানলে কোত্থেকে?
গল্পের বই পড়ে। তােমার কাছ থেকে আমার গল্পের বই পড়ার অভ্যাস হয়েছে। আমিও দিন রাত বই পড়ি।।
এটা একটা ভাল অভ্যাস। বাবা তােমার কথাটা কি ?
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ দুম করে বললেন, তােমার ভেতর কিছু রহস্য আছে। রহস্যটা কি ?
আমি তােমার কথা বুঝতে পারছি না বাবা। তুমি কোন রহস্যের কথা বলছ ? সব মানুষের মধ্যেই তাে রহস্য আছে।
বাবা বললেন, সব মানুষের মধ্যে রহস্য আছে ঠিকই। তবে সেই সব রহস্য ব্যাখ্যা করা যায়। তােমার রহস্য ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। আমি সেটাই জানতে চাচ্ছি।
আমি এখনও তােমার কথা বুঝতে পারছি না।। বাবা উঠে দাঁড়ালেন। আলমারি খুলে হুইস্কির বােতল বের করলেন।
মিসির আলি সাহেব আপনাকে এতক্ষণ একটা কথা বলা হয় নি। লজ্জা লাগছিল বলেই বলতে পারিনি–আমার বাবা প্রচুর মদ্যপান করেন | এটা তাঁর অনেক দিনের অভ্যাস। আমার ধারণা মা যে মােটর অ্যাকসিডেন্টে মারা যান তার কারণ মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে বাবা অ্যাকসিডেন্ট করেন। আমি অবশ্যি এসব নিয়ে বাবাকে কখনও কোনও প্রশ্ন করিনি। আরেকটা কথা আপনাকে বলা হয়নি। -ছােট মা বাবার কাছ থেকে মদ্যপানের অভ্যাস করেছিলেন। এই অংশটি এতক্ষণ
গােপন রাখার জন্যে আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন।
বাবা বললেন, নিশি শােন। নিজের সম্পর্কে তােমার কি ধারণা? তুমি নিজে কি মনে কর তােমার চরিত্রে কোনও অস্বাভাবিকতা আছে?
তুমি নিশ্চিত যে তােমার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। আমি নিশ্চিত। তােমার আশেপাশে যারা থাকে তারা অস্বাভাবিক আচরণ করে কেন ?
আমি জানি না। তুমিও তাে আমার আশেপাশেই থাক– তুমি তাে অস্বাভাবিক আচরণ কর না।
তুমি আমার সঙ্গে তর্ক করছ কেন? তর্ক করছি না। তুমি প্রশ্ন করছ আমি তার জবাব দিচ্ছি। আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে তােমাকে দেখাতে চাই। বেশ তাে দেখাও।।
আগামী সপ্তাহে আমি মেরীল্যান্ডে যাচ্ছি। আমাদের সুপারসনিকের ওপর শর্ট ট্রেনিং হবে। তুমিও চল। সাইকিয়াট্রিস্ট তােমাকে দেখবে।
আচ্ছা।। মা ঠিক করে বল, তােমার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই?
তুমি তােমার ছােট মা’কে মাঝে মাঝে দেখতে পাও এটা কি সত্যি ? তােমার আন্টি আমাকে বলেছিল।
হ্যা সত্যি। তুমি শরিফা মেয়েটিকেও দেখতে পাও। আগে পেতাম এখন পাই না। তােমার কাছে কি মনে হয় না— এই ব্যাপারগুলি অস্বাভাবিক ?
কারণ শরিফাকে নীতু আন্টিও দেখেছেন। হা সে আমাকে বলেছে। শরিফাকে এখন আর তুমি দেখতে পাও না?
সে তার স্বামীর কাছে চলে গেছে। তবে আমি চাইলে সে আবার চলে আসবে।
বুঝিয়ে বল।
আমি স্বপ্নে যা দেখি তাই হয়। স্বপ্নে কি দেখতে চাই এটাও আমি ঠিক করতে পারি। কাজেই আমি যদি ভাবি স্বপ্নে দেখছি শরিফা চলে এসেছে তাহলে সে চলে
আসবে। এবং তখন তুমি চাইলে তুমিও তাকে দেখতে পাবে।
এ ব্যাপারটাও তােমার কাছে নরমাল মনে হয়? অস্বাভাবিক মনে হয় না?
, আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় না। আমার মনে হয় সব মানুষেরই ইচ্ছাপূরণ ধরনের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা আছে। কি করে সেই স্বপ্নটা দেখতে হয় তা
তারা জানে না বলে স্বপ্ন দেখতে পারে না।
নিশি ! জ্বি।
; কাজ কর। শরিফা মেয়েটিকে নিয়ে এসাে আমি তাকে দেখতে চাই।।
আচ্ছা। ক’দিন লাগবে তাকে আনতে? বেশি দিন লাগবে না। স্বপ্নটা দেখতে পেলেই সে চলে আসবে।
যত তাড়াতাড়ি পার তাকে নিয়ে এসাে কারণ মেরীল্যান্ড যাবার আগে আমি তাকে দেখতে চাই।
আচ্ছা। তােমার পড়াশােনা কেমন হচ্ছে? খুব ভাল হচ্ছে। গান শেখা কেমন হচ্ছে? গান শেখাও ভাল হচ্ছে।
তােমার গানের স্যারের সঙ্গে ক’দিন আগে কথা হল। তিনি তােমার গানের গলার খুব প্রশংসা করলেন। তােমার নাকি কিন্নর কণ্ঠ।
সব গানের স্যাররাই তাদের ছাত্রছাত্রীদের গানের গলা সম্পর্কে এ জাতীয় কথা বলে। আমার গানের গলা ভাল না।।
আমি তােমার গান একদিন শুনতে চাই। এখন গাইব? এখন গাইতে হবে না।। তােমার জরুরি কথা বলা কি শেষ হয়েছে বাবা?
আমি চলে যাব ? হ্যা যাও। শরিফা মেয়েটি এলে আমাকে খবর দিও।
আচ্ছা।
আমি আমার ঘরে এসে ঘড়ি দেখলাম, এগারােটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। আমি রাত সাড়ে এগারােটার সময় আবার বাবার ঘরে গেলাম। তিনি সম্ভবত ক্রমাগতই মদ্যপান করে যাচ্ছেন। তার চোখ খানিকটা লাল। মুখে বিবর্ণ ভাব। এমনিতে তিনি সিগারেট খান না—আজ খুব সিগারেট খাচ্ছেন। ঘর ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে আছে। বাবা আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, কি ব্যাপার মা?
আমার ঘরে এসাে। কেন ?
শরিফাকে দেখতে চেয়েছিলে শরিফা এসেছে। তুমি না ডাকতেই চলে এসেছে? আমি চুপ করে রইলাম। বাবা বললেন, শরিফা সত্যি এসেছে? হ্যা। কি করছে ? আমার খাটের নীচে বসে আছে।
বাবা হাসলেন। অবিশ্বাসী মানুষের হাসি। বাবা বললেন, তুমি কি তার সঙ্গে কথাও বল?
হা বলি। সে কি আমার সঙ্গে কথা বলবে ? জানি না। বলতেও পারে।
আমার ধারণা সে আমার সঙ্গে কথা বলবে না। আমি তাকে দেখতেও পাব । কারণ শরিফা নামের মেয়েটি খাটের নীচে বসে নেই। তােমার মাথার ভেতর একটা ঘর আছে, যে ঘর অবিকল তােমার শােবার ঘরের মত। সেই ঘরের খাটের নীচে সে বসে আছে। কাজেই তাকে দেখতে পাবার কোনও কারণ নেই। বুঝতে পারছ ?