তালভঙ্গ-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

তালভঙ্গ-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একদল ভক্ত পৌঁছে দিল হোটেলের দরজা পর্যন্ত। রাত প্রায় একটা, তবু তারা যেতে চায় না, এখনও তারা গল্প করতে চায়। হোটেলের দারোয়ানটি লবির একটি সোফায় শুয়েছিল, সে ধড়মড় করে উঠে অবাক ভাবে চেয়ে রইল।

সবার সঙ্গে হেসে-হেসে কথা বলতে-বলতে প্রায় চোয়াল ব্যথা হয়ে যাচ্ছে দিবাকরের। পাশে মণিকা, তারও ঠোঁটে হাসি আঁকা। মণিকা কোনও কথা বলে না। সবাই ধরে নিয়েছে সে খুব লাজুক। একজন কেউ বলল, বউদি রাগ করছেন না তো? দাদাকে এতক্ষণ ধরে রেখেছি।

এরও কিছু উত্তর না দিয়ে মণিকা হাসিমুখে চেয়ে রইল।

দিবাকর জনপ্রিয়তা রক্ষা করতে জানে। সে যে শুধু নাম করা গায়ক তাই-ই নয়, তার ব্যবহারও অতি মিষ্টি! সকলের প্রতি সে সমান মনোযোগ দেয়। তার লম্বা চেহারা ভিড়ের মধ্যে অন্যদের মাথা ছাড়িয়ে থাকে। তার গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, গলায় একগাদা ফুলের মালা।

বেঙ্গলি ক্লাবের সেক্রেটারি বলল, ঠিক আছে, এবারে দাদাকে বিশ্রাম নিতে দাও। কাল সকালে তো দেখা হচ্ছেই।

একজন বলল, আহা, কাল সকালেই তো ওঁরা চলে যাচ্ছেন!

সেক্রেটারি বললেন, নটা চল্লিশে ট্রেন, তার আগে অন্তত দু-তিন ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে। কাল ছুটির দিন আছে—

একজন সুন্দরী মহিলা আদুরে গলায় বললেন, আমি কাল টেপ রেকর্ডার নিয়ে আসব। আমার জন্য কিন্তু কয়েকখানা গান তুলে দিতে হবে। কোনও কথা শুনছি না–।

দিবাকর কারুকেই প্রত্যাখ্যান করে না। সে এক দৃষ্টে মহিলাটির দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই! যে-কটা খুশি–।

সেক্রেটারিই উদ্যোগ নিয়ে খানিক বাদে সবাইকে বিদায় করলেন। দিবাকর হোটেলের গেট পর্যন্ত এসে আর-এক প্রস্ত অমায়িক হাসি উপহার দিল সবাইকে। মণিকা একই জায়গায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে।

একটু বাদে দিবাকর যখন ওপরে ওঠার সিঁড়িতে পা দিয়েছে, সেই সময় সেক্রেটারি আবার ফিরে এলেন প্রাইভেট কথা বলতে। কাছাকাছি আর কেউ নেই, তবু গলা ফিসফিস করে বললেন, আর একটা দিন থেকে যেতে পারবেন না? কানপুরের মিলনী ক্লাব আপনাকে খুব চাইছে। অবশ্য। ওদের রেটটা একটু কম করতে হবে। ওদের বাজেট কম। আমি মান্না দে-কে বলে দিয়েছিলুম, তিনিও ওদের কাছ থেকে কম নিয়েছিলেন। মান্নাদাকে আমি যা বলি–।

দিবাকর তাকাল মণিকার দিকে। মণিকা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে।

দিবাকর জিগ্যেস করলেন, কী, আর একটা দিন থাকা যাবে?

সেক্রেটারি বললেন, বউদি, আর কটা দিন থেকে যান না, অনেক সাইট সীয়িং করিয়ে আনব–।

মণিকা স্বামীর দিকে চোখ তুলে বলল, তোমার যা খুশি!

দিবাকর বলল, ঠিক আছে, রাত্তিরটা ভেবে দেখি। তারপর কাল সকালে যা হয় করা যাবে।

আমাদের আবার সামনের শনিবার একটা প্রোগ্রাম আছে দুর্গাপুরে।

—দিবাকরদা, আপনি লন্ডন যাচ্ছেন?

—কথা চলছে!

মণিকা সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল ওপরে।

চারতলায় ওপরে সবচেয়ে ভালো ঘরটি দেওয়া হয়েছে ওদের। সারা হোটেল নিস্তব্ধ, শহরের রাস্তাতেও এত রাতে কোনও শব্দ নেই।

মণিকার কাছেই চাবি। দরজা খুলে ভেতরের আলো জ্বেলে সে একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ঘরটা যেন বড় বেশি ফাঁকা লাগছে। এরকম অনেক হোটেলেই রাত কাটাতে হয়েছে, কিন্তু আগে কখনও কোনও ঘর এত ফাঁকা লাগেনি।

মণিকা জানলার কাছে এসে দাঁড়ল। রাস্তার ওপরেই একটা মসজিদ। তার ওপরে জ্যোৎস্নার আলো পড়েছে, মনে হয় যেন অন্য কোনও দেশের দৃশ্য।

দিবাকর এই সময় ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আরামের নিশ্বাস ছাড়ল, আঃ!

গলা থেকে একটার-পর-একটা মালা খুলে ফেলতে লাগল বেডসাইড টেবিলের ওপরে। তারপর সিল্কের পাঞ্জাবিটা খুলল। পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোটা সাদা খামটা নিয়ে বিছানার ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, টাকাগুলো তুলে রাখো।

মণিকা ফিরে তাকাল না।

দিবাকর একটা সিগারেট ধরিয়ে বাথরুমে গেল। তার মন আজ বেশ প্রফুল্ল। ফাংশান বেশ ভালো হয়েছে। একেবারে প্যাকড হল। চারখানা গান গাইবার কথা ছিল। শেষপর্যন্ত দর্শকদের অনুরোধে গাইতে হল এগারোটা।

বাথরুমে পাজামা ঝোলান ছিল। ধুতি খুলে পাজামা পরে দড়ি বাঁধতে-বাঁধতে বেরিয়ে এল দিবাকর। মণিকা তখনও বাইরে চেয়ে আছে জানলা দিয়ে।

দিবাকর তার পাশে এসে বলল, একটু হুইশকি খাই? নইলে রাত্রে ঘুম আসবে না।

দিবাকরের ইংরিজি উচ্চারণে কিছুটা বৈশিষ্ট্য আছে। স-এর জায়গায় প্রায়ই সে শব্যবহার করে। বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার খুলে ছোট হুইশকির বোতল বের করে সে খানিকটা কাঁচাই গলায় ঢালল। তারপর বলল, এখানকার অডিয়েন্স বেশ ভালো ছিল। কি বলো মণি?

মণিকা এবারেও কোনও জবাব দিল না।

এতক্ষণ বাদে মণিকার ওদাসীন্য লক্ষ্য করল দিবাকর। সে ঘরে ঢোকার পর মণিকা একটাও কথা বলেনি!

—কী ব্যাপার, তোমার কী হয়েছে?

—কিছু না তো!

—আমি হুইশকি খাচ্ছি বলে রাগ করছ? আজ যা একশাইটমেন্ট গেল।

—তবু এত রাত্রে ওসব না খেলেও পারতে! তোমার প্রেসার বেড়েছে!

—বেশি না। এই দু-ঢোক খাব। তুমি শাড়ি-টাড়ি ছাড়বে না?

–হুঁ।

কথা বলার সময় মণিকা একবারও মুখ ফেরায়নি। এখন তাকাল। চাঁদের ওপর দিয়ে দিব্যাঙ্গনাদের ওড়নার মতন পাতলা-পাতলা মেঘ ভেসে যাচ্ছে। দিবাকর চঞ্চল হয়ে আছে। যে মণিকার মুখ দেখছে না।

—মণি, তুমি আর-কটা দিন এখানে থেকে যেতে চাও?

—তোমার যা ইচ্ছে?

—এখানে অনেক কিছু দেখবার আছে? কানপুরে আর-একটা ফাংশান যদি হয়…তবে আমি রেট কমাব না। এই ব্যাটাদের সঙ্গে একটু হেসে কথা বললেই পয়সা কমাতে চাইবে। আমি ওদের কি বলব জানোনা? বলব, রেট-এর ব্যাপারে আমি কিছু জানি না ভাই, বউদির সঙ্গে কথা বলো। তুমি। ম্যানেজ করতে পারবে না?

—আমার সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই।

এবারে দিবাকর সত্যিই অবাক হল। মণিকার এরকম ব্যবহার তো সে কখনও দেখেনি। টাকাপয়সা সম্পর্কেও আগ্রহ দেখালে না? সাদা খামটা এখনও খাটের ওপরে পড়ে আছে।

কাছে গিয়ে মণিকার পিঠে হাত রেখে দিবাকর রীতিমতো ব্যাকুল ভাবে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী হয়েছে বলো তো মণি।

মণিকা এবারে মুখ ঘোরালো। তার দু-চোখে জল।

—কী হয়েছে, মণি? কী হয়েছে?

—আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

–কষ্ট হচ্ছে? কোথায়! পেট ব্যথা করছে? কখন থেকে শুরু হয়েছে? আগে বলোনি কেন?

মণিকা স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল স্বামীর দিকে। চোখের জল গড়িয়ে আসছে তার গাল বেয়ে!

—খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে? ওই লোকগুলো থাকতে-থাকতে বললে না কেন? ওরা কোনও ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে পারত। কোনও ট্যাবলেট নেই?

মণিকা বলল, আমার কষ্ট হচ্ছে তোমার জন্য!

—আমার জন্য?

—তোমাকে আজ কত লোক খাতির করছিল। কত সম্মান, হোটেল পর্যন্ত এগিয়ে দিল…

কথা শেষ করতে পারল না মণিকা, যেন আবার কান্না সামলাবার জন্যই সে ঘুরিয়ে নিল মুখ।

—সেইজন্য…তোমার কষ্ট?

এবারে স্বামীর চোখের ওপর সোজা চোখ রাখল মণিকা। আস্তে আস্তে বলল, আজ দু-জায়গায় তোমার সুর ভুল হয়েছে। চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে গানটার সময় যখন চড়ায় উঠলে একদম বেসুরো হয়ে গেল—

যেন কেউ সজোরে একটা থাপ্পড় কষিয়েছে দিবাকরকে। তার মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। সে অস্ফুট গলায় বলল, বেসুরো!

—তুমি বুঝতে পারোনি?

—আমি…মানে…তুমি বলছ কি মণি? আমি বেসুরো গাইব? এত লোকের সামনে?

—তুমি সত্যি বুঝতে পারোনি? নদীর জলে আলতা ছড়ানো-তে তোমার তাল কেটে গেল দুবার। তুমি সত্যি বুঝতে পারোনি?

—হ্যাঁ, ও জায়গাটায় একটু…এখানকার তবলচি অতি বাজে।

—ওই গানটাতে পাখোয়াজ ছিল। কীর্তনের সুর, তুমি আগে কতবার গেয়েছ।

—আমার তাল কেটে গেছে? তুমি বললেই হল? তাহলে শুধু-শুধু অডিয়েন্স এতবার গান গাইবার জন্য রিকোয়েস্ট জানাল।

—দু-তিনজন লোক ইস বলেছিল। আমি শুনেছি। কয়েকজন লোক উঠে চলে গেল।

–কয়েকজন লোক? অন্তত দু-হাজার লোক ছিল আজ, কিংবা তারও বেশি। তার মধ্যে কজন উঠে গেছে।

—সবাই তো গান বোঝে না। এমনিই শুনতে আসে। কয়েকজন মাত্র বোঝে।

—মফস্বলে ওরকম সব সময়ই কিছু লোক মাঝে-মাঝে উঠে যায়। বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে। ট্রেন ধরতে হবে, কিংবা কারখানার ডিউটি।

—তা হতে পারে।

—নিশ্চয়ই তাই।

—কিন্তু তুমি বোঝোনি? তোমার কানে তোমার গলা বেসুরো লাগেনি? তাল যখন কেটে গেল, অন্তরার সময় ধরতে পারছিলে না।

দিবাকর বড় এক চুমুক হুইস্কি টেনে নিল বোতল থেকে। তার চোখ দুটি সঙ্গে-সঙ্গে লাল হয়ে গেল। মাথার চুলের মধ্যে হাত দিয়ে সে কর্কশ গলায় বলল, আজ সবাই আমার এত প্রশংসা করে গেল, আর তুমি আমায় খোঁটা দিচ্ছ? তুমি আমার গানের ভুল ধরছ?

মণিকা প্রায় ছুটে এসে দিবাকরকে বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। বিবাহিত জীবনের ছাব্বিশ বছর পার হয়ে গেছে। ইদানীং আর স্বামীর বুকে মাথা রেখে এরকম কান্নার মতন কোনও ঘটনা ঘটে না।

দিবাকর রীতিমতো হকচকিয়ে গেছে। আজকাল বাইরে এসে প্রায়ই ঝগড়া হয়। এরকম নিঃশর্ত কান্না দেখতে সে অভ্যস্ত নয়।

রাগটা কমে গেল তার। স্ত্রীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে শান্ত গলায় বলল, এরকম

ছেলেমানুষী করছ কেন? কী হয়েছে সত্যি করে বলো তো।

একটু বাদে মণিকা মুখ তুলল। আঁচল দিয়ে মুখ মুছে শান্ত গলায় বলল, না, কিছু হয়নি। আমিই বেশি-বেশি চিন্তা করছি। শুয়ে পড়ো। আমি মশারি খুঁজে দিচ্ছি।

—আর-একটু বাদে।

—না, আর মদ খেয়ো না, লক্ষ্মীটি। শরীর খারাপ হবে। আজকাল মদ তোমার সহ্য হয় না।

শান্ত ছেলের মতন দিবাকর মদের বোতলটা রেখে দিল ড্রয়ারে। তারপর শুয়ে পড়ল বিছানায়।

মশারি গুঁজে দিয়ে মণিকা বাথরুমে গেল।

ফিরে এসে দেখল দিবাকর তখনও জেগে আছে। চোখ দুটি ওপরের দিকে স্থির।

মণিকা বলল, ঘুমিয়ে পড়ো এবার। কাল সকাল থেকেই তো আবার লোকজন আসবে। পাঁচ ছঘণ্টা না ঘুমোলে শরীর টিকবে কেন?

দিবাকর আস্তে-আস্তে বলল, আজ আমার গলাটা ভালো ছিল না। দু-এক জায়গায় সুর লাগেনি। আমি বুঝতে পারছিলুম।

—আজ না গাইলেই পারতে!

—এদের প্রোগ্রাম সব ফিকশড। গলা খারাপ বললে এরা শুনত? মফস্বলের পাবলিক কীরকম হয় তুমি জানো না?

—গত সপ্তাহে যাদবপুরের জলসাতেও…দুটো গানের পর আর কেউ কিছু গাইতে বলল না।

—ওখানে আরও অনেক আর্টিস্ট ছিল।

—এক বছর আগেও তোমার জন্যই টিকিট বিক্রি হত, অন্য আর্টিস্টদের বসিয়ে রেখে তোমায় দিয়ে দশটা-বারোটা গান গাওয়াত!

–কলকাতার অডিয়েন্স আজকাল খুব খারাপ হয়ে গেছে। ভালো গান-বাজনা কেউ শুনতেই চায়। সবাই তো হিন্দি…তবে এখানে লোকজন খুব ভালো ছিল।

—তোমার তাল কেটে গেল…আগে কোনওদিন তো এরকম হয়নি।

—একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলুম বোধহয়।

—তুমি বুঝতে পেরেছিলে তাহলে?

—হ্যাঁ। একটা তাল মিশ করতেই কীরকম নার্ভাস হয়ে গেলুম। এত দিন ধরে গাইছি, কক্ষনো এরকম হয়নি!

—সেই তখন থেকেই আমার কষ্ট হচ্ছিল! ওগো, আমার ভীষণ ভয় করছে!

—আরে যাঃ। এবারে ফিরে কয়েক দিন গলা সাধব। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে! ভয় কীসের! আমার কি অসুখ করেছে নাকি? এমন কিছু বুড়োও হয়নি!

—যখন তুমি খুব ভালো গাইতে, তখন তোমার তেমন নাম হয়নি। তোমার গলা যেন জলের মতন ছিল, আর তাল…তুমি যখন-তখন ছাড়তে আর ধরতে।

–বীরেশদা বলেছিল, আমার কাছে তাল আর লয় শিখতে হয়।

—এখন সবাই তোমার খাতির করছে কত, অথচ তুমি এখন ভুল গাইছো। তাহলে খাতির করছে কাকে? তোমাকে, না তোমার ভুল গানকে।

—তুমি বড় বাড়াবাড়ি করছ।

–কানপুরের ফাংশনের জন্য ওরা তোমায় রেট কমাতে বলল!

—সে ওরা লাই পেলেই ওরকম করে।

—সেক্রেটারি বুঝতে পেরেছে।

—যাঃ! ওই সেক্রেটারিটা একটা গোলা লোক। ও আবার সুর তাল বুঝবে কি? ওরা ফাংশান করে পয়সা পেটে!

—ওই সেক্রেটারি তবলা বাজায়। কে যেন বলছিল!

—সত্যি?

—হ্যাঁ। আমি শুনেছি। ও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে।

দিবাকর আর কোনও কথা বলল না। সে অভিমানের নিশ্বাস ফেলল একটা। তার বুকটা খালি খালি লাগছে। তেতো। ইচ্ছে করছে উঠে আর-একবার হুইস্কিতে চুমুক দিতে। কিন্তু উঠল না।

সে ভেবেছিল কেউ বুঝতে পারবে না। কিন্তু মণিকা বুঝেছে। মণিকাকে সে নিজে গান শিখিয়েছে একসময়। আর কজন সত্যিসত্যি ধরতে পেরেছে তার ভুল? সেক্রেটারি কানপুরে ফাংশনের রেট কমাতে বলল এই জন্যই?

সারারাত আর ঠিক মতন ঘুম এল না। মাঝে-মাঝে চোখ বুজে আসে তারপর একটা কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। কে কাঁদছে? দিবাকর উঁকি দিয়ে দেখে, না, মণিকা তো আর কাঁদছেনা। সে ঘুমিয়ে আছে।

তবু বারবার কান্নার শব্দে দিবাকরের তন্দ্রা ভেঙে যেতে লাগল।

ভোরের আলো ফুটতে-না-ফুটতেই দিবাকর মণিকাকে ধাক্কা দিয়ে ব্যস্তভাবে বলল, মণি, এই মণি, শিগগির তৈরি হয়ে নাও? আমাদের এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে।

মণিকা চোখ মুছতে-মুছতে বলল, বেরিয়ে পড়বে? কোথায় যাবে?

—কলকাতায়। পৌনে সাতটায় একটা ট্রেন আছে।

—সেই ট্রেনে…কিন্তু সবাই তো দেখা করতে আসবে বলেছে…

দিবাকর জানলার ধারে দাঁড়িয়ে গম্ভীর ভাবে বলল, যা বলছি তাই শোনো। আমি এক্ষুনি চলে যেতে চাই। বাজে লোকের ভিড় আমার সহ্য হয় না!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *