তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৮) হুমায়ূন আহমেদ

আমি না হয় অপেক্ষা করিআচ্ছা দে দেখিনাশতা করেই ফেলি

তিথির নীল তোয়ালেজাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন তাঁর মেয়ে অনেক খাবারের আয়ােজন করেছেপরােটা, ভুনা গােশত, পাউরুটি, মাখন, ডিম, একটা বাটিতে চিড়া ভাজা, অন্য একটা বাটিতে মুড়িজাফর সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, পরােটা তুই ভেজেছিস 

কি? ভাল হয়েছেখুব ভাল হয়েছে। 

তিথি লজ্জিত গলায় বলল, পরােটা আমি ভাজি নি বাবাপাশের ফ্ল্যাটের অরুনার মা, উনাকে বলেছিলামউনি বানিয়ে পাঠিয়েছেন। 

গােশতওঁ উনি রান্না করেছেন?গােশত আমি রান্না করেছিভাল হয়নি বাবা?” 

ভাল হয়েছেখুব ভাল হয়েছে অনেক পদ করেছিসঠিকমত নাশতা করলে দুপুরে আজ আর খেতে হবে না” 

তিথির লজ্জা লাগছেএতগুলি পদ টেবিলে সাজানাে বাবা নিশ্চয়ই মনে মনে হাসছেনতাছাড়া সে খানিকটা সাজগােজও করেছেবাবার চোখে পড়ার কথাতেমন আহামরি কিছু না চোখে কাজল দিয়েছেনতুন ভাজ ভাঙ্গা একটা শাড়ি পরেছে। 

তিথিজ্বি বাবাতাের কি পাসপাের্ট আছে?” 

নাপাসপাের্ট সাইজ ছবি আছে

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৮)

নাতাহলে তুই এক কাজ করনিউমার্কেটে গিয়ে পাসপাের্টের জন্যে ছবি তােলএরা ঘন্টা খানিকের মধ্যে ছবি দিয়ে দেয়ছবি নিয়ে তুই দুপুর বারটার মধ্যে আমার অফিসে চলে আসবিতারপর তােকে নিয়ে আমি পাসপাের্ট অফিসে যাবদু দিনের মধ্যে পাসপাের্ট বের করতে হবে‘ 

তিথি অস্পষ্ট গলায় বলল, কেন

আমি চাই তােরা দুজন যেন এক সঙ্গে যেতে পারিসসেটাই ভাল হবেতাের কোন আপত্তি আছে?” 

তিথি লজ্জিত গলায় বলল, নাগুডআপত্তি থাকাটা কোন কাজের কথা নাআজ সিলেটে যাচ্ছি মনে আছে 

মনে আছে। 

জিনিস পত্র গুছিয়ে নেতাের মাকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসতে হবেকাল সকালে পৌছব বিকেলের ট্রেনে সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে আসব। 

মা আসতে রাজি হবেতাে?” 

অবশ্যই রাজি হবেমেয়ের বিয়ে মা আসবে নাকি বলিস তুইঝগড়া আপাতত মুলতুবী থাকবিয়ে নিয়ে হয়ে যাক তারপর আবার নতুন উদ্যমে শুরু করা যাবে। 

জাফর সাহেব চলে গেছেনতিথি অপেক্ষা করছেমারুফের আসার নাম নেইআসতে না পারলে একটা টেলিফোন তো করবেতাও করছে নাতিথির খিধে লেগেছে কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছা করছে নাএতক্ষণ পর্যন্ত না খেয়ে বসে থাকার জন্যেই বােধহয় মাথা ধরেছেহালকা ধরণের মাথা ব্যথা যা এক সময় সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। 

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৮)

তিথি খালি পেটে চা খেলসকাল থেকে এই পর্যন্ত চার কাপ চা খাওয়া হয়েছেসে ঠিক করে ফেলল মারুফ না আসা পর্যন্ত সে কিছুই খাবে নাসে যদি আজ রাত এগারােটায় আসে তিথি রাত এগারােটা পর্যন্ত না খেয়ে অপেক্ষা করবে। 

মারুফের সবচে বড় সমস্যা হল সে বেশীর ভাগ সময়ই কথা দিয়ে কথা রাখে তার জন্যে সে মন খারাপ করে না বা দুঃখিতও হয় নাযেন কথা দিয়ে কথা না রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যাপার নাস্বাভাবিক ব্যাপার।  তিথি ঘড়ি দেখে ঠিক এগারােটা বাজার দশমিনিট আগে ঘর তালা দিয়ে বের হলনিউমার্কেট যেতে লাগবে দশ মিনিটছবি তুলে এক ঘন্টা ঘােরাফেরা করবেবারােটায় ছবি ডেলিভারী নিয়ে বেবীটেক্সী করে বাবার কাছে চলে যাবেসেখান থেকে পাসপাের্ট অফিস। 

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৮)

জাফর সাহেব অফিসে এসে দেখেন তঁার ঘর খােলাঘরে তিথির বড় মামা বিরক্ত মুখে বসে আছেনশুধু বসে আছেন বললে ভুল হবে পাইপ টানছেনপাইপের ধােয়ায় ঘর অন্ধকারএয়ার কুলার বসানাে ঘরে দরজা জানালা বন্ধ থাকেধােয়া ঘর থেকে বেরুতে পারে না। 

তিথির বড় মামা সাইদুর রহমান আর্মি শর্টকোর্সে মিলিটারীতে ছিলেনদশ বছর চাকরির পর লেফটেন্যান্ট কর্ণেল হয়ে রিটায়ার করেছেনবর্তমানে ব্যবসা করেনসারাক্ষণই বলেন, ব্যবসার অবস্থা ভয়াবহকিন্তু তিনি ভয়াবহ অবস্থায় আছেন বলে মনে হয় নাধানমন্ডিতে আশি লক্ষ টাকায় দশ কাঠা জমি কিনেছেনসেখানে পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ি হবেপ্রতি তলায় দুটা করে ফ্ল্যাটএকেকটি বিক্রি হবে চল্লিশ লক্ষ টাকায়এর মধ্যে ৬টি বিক্রি হয়ে গেছেউত্তরার কাছে উত্তরখান নামের জায়গায় বিঘার মত জমি কিনেছেন

সেখানে বাগানবাড়ি হচ্ছেবাংলাে প্যাটার্নের বাড়িসামনে ঝিল, ঝিলে নৌকাবলতে গেলে হুলুস্থুল ব্যাপারযে এমন হুলুস্থূল ব্যাপার শুরু করে তার মুখে সারাক্ষণ বিজনেসের অবস্থা ভয়াবহ এই কথা শুনতে ভাল লাগে নাজাফর সাহেবের অসহ্য লাগেতিনি রিটায়ার্ড লেফটন্যান্ট কর্ণেল সাইদুর রহমানকে দু চোখে দেখতে পারেন নামাস খানিক আগে সাইদুর রহমানের ছােটমেয়ে পিঙ্গলার জন্মদিন উপলক্ষ্যে রিভার ক্রুজ হলজাহাজে করে পাগলা থেকে চাঁদপুরে যাওয়া এবং ফিরে আসারিভার ক্রুজে সবাই গিয়েছে তিনি যাননিশরীর খারাপের অজুহাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৮)

 সাইদুর রহমান জাফর সাহেবকে দেখে মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেনজাফর সাহেব বললেন, খবর সব ভাল

সাইদুর রহমানের প্রু কুঁচকে গেলতিনি পাইপে নতুন করে তামাক ভরতে লাগলেনজাফর সাহেব বললেন, কতক্ষণ হল এসেছেন

 অনেকক্ষণআমি এসেছি আটটা চল্লিশে এখন বাজে নটা পঞ্চাশতুমি কি সবসময়ই অফিসে এমন দেরী করে আস?” 

অপমান সূচক প্রশ্নজাতীয় প্রশ্নের জবাব দেয়াও এক ধরনের অপমানজাফর সাহেব বললেন, চা দিতে বলব চা খাবেন

চা খেতে পারি| বেয়ারাকে চায়ের কথা বলে জাফর সাহেব নিজের চেয়ারে বসলেনতিনি খানিকটা চিন্তিতলেফটেন্যান্ট কর্ণেল সাহেব ঠিক কি উদ্দেশ্য এসেছেন বােঝা যাচ্ছে না। 

সাইদুর রহমান পাইপে লম্বাটান দিয়ে বললেন, আমি তােমার বাসাতেই যেতামশেষ পর্যন্ত অফিসে আসলামকিছু ট্যাকনিক্যাল কথাবার্তা আছে যা অফিসে বলা যায় না। 

কি ট্যাকনিক্যাল কথা ?” 

আমি অনেকদিন থেকেই ভাবছি তােমার সঙ্গে একটা ফুল ডিসকাশান হওয়া উচিততােমার কি বলার আছে আমি শুনতে চাইএক তরফ কথা শুনলে তাে হবে না।  এক তরফা কি কথা শুনেছেন? আমি বুঝতে পারছি না

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৮)

চা আসুকতারপর বলি‘ 

সাইদুর রহমান চোখ বন্ধ করে পাইপ টানছেনজাফর সাহেবের ইচ্ছা করছে তঁার বেয়ারাকে ডেকে বলেন, এই হামবাগটাকে ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দাওবের করে দেবার পর যে চেয়ারে হামবাগটা বসেছে সেটা ডেটল পানিতে ধুয়ে দাওমনে যা ভাবা যায় অধিকাংশ সময়ই তার উল্টোটা করতে হয়জাফর সাহেব বেয়ারাকে তাড়াতাড়ি চা আনতে বললেনসাইদুর রহমান বললেন, তােমার ঘরের দরজায় কি লালবাতি জ্বালানাের সিস্টেম আছে? সিস্টেম থাকলে লালবাতী জ্বালিয়ে দাও আমি চাইনা আমার কথাবার্তায় ইনটারাপসান হােক। 

আপনার এমন কি কথা যে লালবাতি জ্বালিয়ে বলতে হবে?” 

সাইদুর রহমান আবার ভ্রু কুঁচকে ফেললেনচা এসে গেছেতিনি এক চুমুক খেয়ে বললেন, চা তো ভাল বানিয়েছেযাবার সময় আরেক কাপ খেতে হবেমনে করিয়ে দিও তাে| মনে করিয়ে দেবএখন বলুন কি ব্যাপার? লালবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছি ঘরে কেউ ঢুকবে না। 

সাইদুর রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, শায়লা আমাকে কমপ্লেইন করেছে তুমি নাকি তাকে মারধর করব্যাপারটা কিআপনাকে বলেছে

না বললে তাে জানতে পারতাম নাআমার কাছে ওহী নাজেল হয় নিআমি শায়লার কথা শুনে স্তম্ভিতযার মেয়ে এম. . পাশ করেছে তাকে মারধাের করতে সাহস লাগেতােমার সাহস আছে বােঝা যাচ্ছেYou are a courageous man

আপনি কি আমাকে শাস্তি দিতে এসেছেন? | নাশাস্তির প্রশ্ন আসে নাতবে শায়লা তােমাকে শাস্তি দিতে চায়সে ঠিক করেছে তােমার সঙ্গে আর বাস করবে নাএই কথাটাই তােমাকে বলতে এসেছি। 

বলুন শুনছি। 

যা চাচ্ছে তা হল সে তার মেয়েদের নিয়ে থাকবে তুমি আলাদা কোথাও থাকবেবাড়ি ভাড়া করে থাকতে পারকিংবা কোন হােটেলে ঘর নিয়ে থাকতে পারএবং আমার কাছে মনে হয় এটা দুজনের জন্যেই মঙ্গলজনক হবেসমস্যার ভদ্র সমাধান হবে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *