‘স্যার দেখলাম, ফুপু খুব সুন্দর ঝকমকা শাড়ি পরা। কপালে টিপ। গা ভর্তি গয়না। গয়নার ভেতর লাল, নীল, সবুজ কত রকম পাথর। পান খেয়ে ফুপুর ঠোট টকটকে লাল। ফুপু বললেন, ওরে নুরু, দেখ, কি সুন্দর সুন্দর গয়না আমার গায়।
আমি বললাম, ফুপু, আপনি মনে হয় খুব সুখে আছেন ?
ফুপু বললেন, হারে বােকা, খুব সুখে আছি। স্বামী–সন্তান সব সঙ্গে আছে। তবে ছেলেটা বড় দুষ্টুমি করে। সারাদিন আছে খেলার মধ্যে। একে নিয়ে আমি চিন্তায় অস্থির। শাসনও করতে পারি না। শাসন করতে গেলেই তাের ফুপা ছুটে এসে বলে – কর কি, কর কি! আর আমার মেয়েও হয়েছে ভাই–সােহাগী। তার ভাইকে কিছু বললেই তার মুখ ভার। বড় যন্ত্রণায় আছি রে নুরু { বলেই ফুপু আনন্দে হাসতে লাগলেন। আমি বললাম, আপনার আনন্দ দেখে ভাল লাগছে ফুপু।
ফুপু বললেন, তুই গরীব মানুষ, তােকে বিষয়–সম্পত্তি দিয়ে এসেছিলাম। লুই তাে স্কুল করে বসে আছিস।
আমি বললাম, আপনার কি এটা পছন্দ না ফুপু?
ফুপু বললেন, অবশ্যই পছন্দ। তবে তুই আমার নাম দিয়েছিস, এটাতে খুব লজ্জায় পড়েছি। নামটা বদলে দে।
জ্বি আচ্ছা, দেব।
‘লক্ষৌ টাইপটা কি?”
‘দু ধরনের টাইপে কোরান শরীফ ছাপা হয় – একটা কোলকাতা টাইপ একটা লক্ষে টাইপ। তিথি তুমি কি একটু ধরবে আমার সিগারেট নিভে গেছে ধরিয়ে নেই। তিথি রিসিভার ধরে আছে। মারুফ সিগারেট ধরাতে ধরাতে এতক্ষণ কি বলল তা গুছিয়ে নিল। কোরান শরীফের ব্যাপারটা সে হঠাৎ করে নিয়ে এসেছে। বড় ধরনের মিথ্যা বলার এক পর্যায়ে কোরান শরীফ নিয়ে এলে সুবিধা হয়। যারা মিথ্যাটা শুনছে তারা নিশ্চিত হয় এটা মিথ্যা না। কোন মুসলমান ছেলে সংস্কারের কারণেই হােক বা অন্য যে কোন কারণেই হােক কোরান শরীফ জড়িয়ে মিথ্যা বলে না।
হ্যালাে তিথি ।
শুনলেতো আমার ঘটনা? ‘শুনলাম। আই এ্যাম সরি।
তুমি কেন সরি হবে। সরি হলাম আমি। আমার যে কি খারাপ লাগছিল তােমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না।
‘আমি বুঝতে পারছি। ‘না তুমি বুঝতে পারছ না। যাই হােক এখন তােমার খবর বল। ‘আমার বলার মত কোন খবর নেই। আমি কিছুক্ষণ পর সিলেট রওনা হচ্ছি।‘ ‘কোথায় রওনা হচ্ছ?” ‘সিলেট ?” ‘কেন ?”
‘মা’কে নিয়ে আসতে যাচ্ছি। বিয়ের ব্যাপারটা মা’কে বলতে হবে না? বাবাকে রাজি করিয়েছি। মা’কে রাজি করাতে হবে। মজার ব্যাপার কি জান। সিলেট যাচ্ছি
আমি একা।
একা মানে?”
‘একা মানে একা। অল বাই মাইসেলফ। বাবা আর আমি আমাদের দু‘জনের যাবার কথা ছিল। এখন ঠিক হয়েছে বাবা যাবেন না। আমি একা যাব। একটা স্লিপিং বার্থ রিজার্ভ করা আছে।
তিথি !‘ “বল।
“আমি কি যেতে পারি তােমার সঙ্গে? প্রথমত একা একা তুমি রাতের ট্রেনে যাবে ভাবতেই আমার খারাপ লাগছে। দ্বিতীয়ত সারারাত গল্প করতে করতে যাওয়ার আলাদা আনন্দ আছে।‘
‘সারারাত গল্প করার আনন্দতাে অনেক পাবে।‘ | ‘তা পাব, তবে সেটা হবে বিয়ের পরে। বিয়ের আগে সারারাত গল্প করার আনন্দ অন্য রকম।
‘তুমি জানলে কি ভাবে?”
‘অনুমান করছি। কল্পনায় বুঝতে পারছি। প্রকৃতি আমাকে কল্পনা করার অসাধারণ ক্ষমতা দিয়েছেন। তােমার ট্রেন ক‘টায়?”
‘রাতে সাড়ে দশটায়।। ‘আমি ঠিক দশটার সময় কমলাপুর রেল স্টেশনে উপস্থিত থাকব। ‘আরে না না। অসম্ভব।
‘শােন তিথি, নেপােলীয়ান যখন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আল্পস পর্বতমালার সামনে এসে দাড়ালেন এবং ঠিক করলেন তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে পর্বতমালা অতিক্রম করবেন তখন তাঁর সেনাপতিরা বলল, এটা অসম্ভব। তার উত্তরে তিনি বললেন, অসম্ভব হচ্ছে এমন একটি শব্দ যা শুধু বােকাদের অভিধানেই পাওয়া যায়।
নেপােলীয়ানের পক্ষে যে কথা বলা সম্ভব তা–কি তােমার পক্ষে বলা সম্ভব? তুমিতাে নেপােলীয়ান না।” ।
‘কে বলল আমি নেপােলীয়ান না। আমি অবশ্যই নেপােলীয়ান। আমি ঠিক দশটায় ট্রেনে চেপে বসব। সারারাত গল্প করব। তুমি মনে করে ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা নেবে।
‘মারুফ শােন, দয়া করে এই কাজটা করবেন।। প্লীজ। প্লীজ। ‘স্টেশনে দেখা হবে।
মারুফ টেলিফোন নামিয়ে রাখল। আজ তার মনটা খুব ভাল। আজিজ সাহেবের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। নীলা পাথর কেনার টাকা। বিয়েতে কাজে লাগবে। পরে সুন্দর কোন গল্প বলে আজিজ সাহেবকে ঠাণ্ডা করলেই হবে।
জাফর সাহেব মেয়েকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছেন। তিথি অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে যদি মারুফের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। বাবাকে তাহলে সে কি বলবে? বাবাই বা কি মনে করবেন? তিথি ভয়ে ভয়ে চারদিক দেখছে – মারুফকে দেখা যাচ্ছে না। এত মানুষের মাঝে চট করে দেখা পাওয়াও মুশকিল। কোথাও নিশ্চয়ই আছে। দু নম্বর প্ল্যাটফরম থেকে ট্রেন ছাড়বে। সে নিশ্চয়ই দু নম্বর প্ল্যাটফরমে ঘোরাঘুরি করছে। তিথিকে দেখতে পেয়ে হাসি মুখে এগিয়ে আসবে। তখন তিথি তার বাবাকে কি বলবে?
দু নম্বর প্ল্যাটফরমেও মারুফকে দেখা গেল না। তবু তিথির অস্বস্তি দূর হল না। যে কোন মুহুর্তে সে উদয় হতে পারে। জাফর সাহেব যখন মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন তখনই শুধু তিথি খানিকটা স্বস্তি বোধ করল। মারুফ এখন এসে উপস্থিত হলে তেমন অসুবিধা হবে না। নুরুজ্জামানকে সামলানাে যাবে। সরল ধরনের মানুষ, এদের কে যা বলা হয় তাই তারা বিশ্বাস করে। সে সাড়ে ন‘টায় বাসায় ফিরেছে তাকে বলা হয়েছে সিলেট যেতে হবে, সে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ গুছিয়ে প্রস্তুত। একবার জিজ্ঞেসও করে নি – কেন যেতে হবে? ক‘দিন থাকতে হবে ? হলুদ রঙের একটা কোট তার গায়ে। কোর্টের বােতামগুলি মেরুন রঙের।
কোন সুস্থ মাথার মানুষ এ রকম একটা কেটি গায়ে দিতে পারে? সে আবার সুযােগ পেলেই তিথিকে কোট সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছে। | ‘রাস্তার সাইডে বিক্রি করছিল। হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখেছে। একটা দুইটা না শত শত কোট। আমি শুধু শুধু জিজ্ঞেস করলাম – দাম কত? বলল দু‘শ টাকা। আমি চলে আসছি, দোকানদার বলল, চলে যাচ্ছেন কেন, একটা দাম বলেন তারপর চলে যান। যদি দরে বনে দিয়ে দিব। না বলে নাই। আমি বললাম, পঞ্চাশ টাকা। কেনার ইচ্ছা নাই এই জন্য বললাম, পঞ্চাশ। আগে একবার স্যান্ডেল কিনে ঠক খেয়েছিলাম। তাই বুদ্ধি করে এমন কম দাম বললাম। সে সাথে সাথে পলিথিনের
ব্যাগের ভেতর ঢুকায়ে কোট দিয়ে দিল। পরলাম এমন বিপদে না কিনেও পারি না। নিজের মুখে দাম বলেছি। জিনিসটা কেমন হয়েছে ?
‘ভাল। “ঠিক বলেছেন – ভাল। খুব গরম। গরমের চোটে ঘাম ছুটেছে।