তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২৩) হুমায়ূন আহমেদ

আগের বার 

টেবিল ল্যাম্প ছিল নানতুন কেনা হয়েছেআনিস চিঠিতে লিখেছিল, ঘরে ইলেকট্রিক তার ছিড়ে গেছে বলে ঘরে ফ্যান ঘুরছে না, বাতি জ্বলছে নানবনী দেখল ইলেকট্রিসিটি আছেমাথার ওপর দুর্বলভাবে ফ্যান ঘুরছে। 

তেঁতুল বনে জোছনা

রাত অনেক হয়েছেঘরের বারান্দায় নবনী বসে আছেবারান্দায় আলাে নেইখোলা জানালা থেকে কিছু আলাে এসে পড়েছে তার পায়েনবনীর কোলে একটা মােটা বাঁধানাে বইবই পড়ার মতাে আলাে নেইনিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে বই হাতে রাখা মাঝে মাঝে পাতা ওল্টানােচারদিক অসম্ভব নীরবরাত আটটার দিকে ঝিঝি ডাকছিলএরাও চুপ করে গেছেশহরের কোলাহল থেকে হঠাৎ ধরনের শব্দহীনতা মনের ওপর চাপ ফেলেনবনীর কিছু ভালাে লাগছে নাকিছুক্ষণ আগেও ক্ষিধে পাচ্ছিল, এখন সে ক্ষিধেও নেইমতি নামের মানুষটাকে বিদেয় করে দেয়া ঠিক হয় নিসে থাকলে তার সঙ্গে গল্প করা যেত

আনিস ফিরলেও খুব যে গল্প করা যাবে তা নাআনিস চুপচাপ ধরনের মানুষকথা বললে মন দিয়ে কথা শুনবেনিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কখনােই কিছু বলবে নাসে যে কৌতূহলশূন্য মানুষ তাও নাতার কৌতূহল আছে, কিন্তু কৌতূহলের কোনাে প্রকাশ নেইএর কোনাে মানে হয়? মানুষের ভেতর যা থাকবে তার প্রকাশও থাকা উচিতআবেগ থাকবে অথচ আবেগের প্রকাশ থাকবে না, এটা কেমন ব্যাপার

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২৩) হুমায়ূন আহমেদ

সুজাত মিয়া কয়েকবার এসে নবনীকে দেখে গেছেতাকে বলা হয়েছে সে যেন খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়েসে হ্যসূচক মাথা নেড়েছে কিন্তু খেতে বসে নিঘুরঘুর করছে। 

যে যেমন সে তার আশেপাশের মানুষগুলােও সে রকম জোগাড় করেসুজাত মিয়ার মুখে কোনাে কথা নেইপ্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে সে চেষ্টা করে হা না বলে জবাব দিয়ে দিতেমনে হচ্ছে তাকে কথা নাবলার ট্রেনিং দেয়া হায়েছে। 

রাস্তায় কাকে যেন দেখা যাচ্ছেটর্চের আলাে ফেলে এগুচ্ছেমানুষটার গায়ে চাদরচাদরে মাথাও ঢাকা আনিস ফিরছে কি? তার সাইকেল চুরি গেছেহেঁটে হেঁটেই ফেরার কথাএই গরমে সে মাথায় চাদর দিয়ে আছে কেন? শরীর খারাপ করেছে কি ? ডাক্তারদের শরীর খারাপ শুনতে খুব হাস্যকর লাগে, কিন্তু ডাক্তারদের শরীর খারাপ হয়ভালােমতােই হয়নবনী বুঝতে পারছে না, সে বারান্দায় বসে থাকবে নাকি আনিসকে চমকে দেবার জন্যে কিছু  

করবে ? বারান্দা থেকে নেমে উঠোনের কাঁঠাল গাছের আড়ালে চলে যাওয়া যায়তারপর হঠাৎ আনিসের সামনে ঝাপ দিয়ে পড়ে বিকট চিৎকার দেয়াএকঘেয়েমির জীবনকে ইন্টারেস্টিং করার জন্যে মাঝে মাঝে লবণ এবং গােলমরিচের গুঁড়াে ছিটিয়ে দিতে হয়বেঁচে থাকা ব্যাপারটার মধ্যেই একঘেয়েমি আছেযে মানুষটা সত্তর বছর বাঁচে তাকে এই দীর্ঘ সত্তর বছর ধরেই যথানিয়মে রাতে ঘুমুতে যেতে হয়স্যুর বছর প্রতিদিন তিনবেলা খেতে হয়ক্লান্তিকর একটা ব্যাপারনিম্নশ্রেণীর কীট পতঙ্গের বেঁচে থাকার মধ্যে কিছু বৈচিত্র্য আছেসামান্য পিঁপড়া এক সময় পাখা পেয়ে আকাশে ওড়েকুৎসিত দর্শন শুয়ােপােকা একদিন সুন্দর প্রজাপতি হয়মানুষের মধ্যে এরকম কিছু নেইমানুষ বদলায় না। 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২৩) হুমায়ূন আহমেদ

টর্চ হাতে লােকটা অনেক কাছে এসে গেছেসে আনিস না, মতিকোথেকে চাদর জোগাড় করে হন হন করে যাচ্ছেনবনী কোলের ওপর রাখা বইটার পাতা উল্টালতার সামান্য ভয় ভয় লাগছেচাদর গায়ে মানুষটাকে দেখে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও মনে হয়েছিলবিরাটনগরের ইমাম সাহেবসেই মানুষটাও ছিল মতির মতাে ছােটখাট । 

আনিস গিয়েছে মিঠাপুরে। 

বিরাটনগর থেকে মিঠাপুরের দূরত্ব সাত মাইলগ্রামের হিসাবে দুই ক্রোশের সামান্য বেশিবর্ষাকালে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালােইনজিনের নৌকা চলেসমস্যা হয় শীতের সময়শুকিয়ে যাওয়া বিলের ভেতর দিয়ে হাঁটা পথগ্রামের মানুষদের জন্যে হাটা কোনাে বড় ব্যাপার নাতারা মাইলের পর মাইল নির্বিকার ভঙ্গিতে হাঁটতে পারেআনিস পারে নাতার কষ্ট হয়পা ফুলে যায়সাইকেল চুরি যাওয়াতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছেসে অনেকবারই ভেবেছে এমন গভীর গ্রামে রােগী দেখতে যাবে নারােগীদের হাসপাতালে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবেহাসপাতালের ব্যাপারে এখনাে গ্রামের মানুষদের ভেতর প্রবল ভীতি কাজ করছেহাসপাতালে যাওয়া মানে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়াতাদের হিসেবে হাসপাতাল থেকে জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা শূন্য। 

ডাক্তার বাড়িতে নিয়ে আসার পেছনে আরেকটি মানসিকতা কাজ করেক্ষমতা প্রতিপত্তি জাহির করার মানসিকতাহে গ্রামবাসী তােমরা দেখ, পাস করা এমবিবিএস ডাক্তার বাড়িতে নিয়ে এসেছি। 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২৩) হুমায়ূন আহমেদ

আনিস যে রােগী দেখতে যাচ্ছে তার বয়স অল্পএগারাে বারাে বছরের কিশােরনাম কাদেরহঠাৎ তার শরীর ফুলে গেছেকথা বলতে পারছে না, কাউকে চিনতে পারছে নাঅন্য ডাক্তার তার চিকিৎসা করছিলেনচিকিৎসায় কোনাে ফল হয় নি বরং রােগীর অবস্থা আরাে খারাপ হয়েছেসেই ডাক্তার শেষ কথা বলে এসেছেনরােগী ঢাকায় নিতে হবেরােগীর আত্মীয়স্বজন রােগীকে ঢাকায় নিতে প্রস্তুতকিন্তু শেষ চিকিৎসা হিসেবে আনিসকে দেখাতে চায়অল্প বয়স্ক গম্ভীর ধরনের এই ডাক্তার সম্পর্কে নানান কথা শােনা যায়এই ডাক্তারের সাইকেলের ঘণ্টা নাকি আজরাইল সহ্য করতে পারে নাআজরাইলের কানে যন্ত্রণা হয়সে দূরে সরে যায়মরণাপন্ন রােগী বিছানায় উঠে বসে চিকন গলায় বলেকৈ মাছের সালুন দিয়া ভাত খামু। 

রােগীর বাড়ির কাছাকাছি পৌছার পর রােয়াইল বাজারের এমবিবিএস ডাক্তার সাইফুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আনিসের দেখা হলােসাইফুদ্দিন সাহেব মােটর সাইকেলে করে এসেছেনমােটর সাইকেলের কেরিয়ারে ডাক্তারি ব্যাগ নিয়ে তার এসিসটেন্ট বসাএসিসটেন্টের মুখও গম্ভীরতাকে রােগী দেখার জন্যে আনা হয়েছেতিনি আনিসকে দেখে ভুরু কুঁচকে ফেললেনমােটর সাইকেল দাঁড় রিয়ে আনিসকে হাতের ইশারায় এক পাশে নিয়ে গেলেনগােপন কিছু কথা বলবেনএইসব গােপন কথা রােগীর বাড়ির যে দুজন আনিসকে নিয়ে আসছে তাদের শোনানাে যাবে না। 

সাইফুদ্দিন সাহেব গলা নামিয়ে বললেনরােগী দেখার কিছু নাইশেষ অবস্থাডাক্তার শিলপাটায় বেটে শরীরে মাখিয়ে দিলেও কিছু হবে না। 

আনিস বলল, হয়েছে কী

পানি এসে শরীর ফুলে গেছেশ্বাসনালিও ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছেরাতটা টিকবে নাভিজিটের টাকা নিয়ে দ্রুত চলে আসবেনঅঞ্চলটা খারাপডাক্তারের উপস্থিতিতে রােগী মারা গেলে খবর আছে। 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২৩) হুমায়ূন আহমেদ

আনিস চুপ করে রইলসাইফুদ্দিন সাহেব গলা আরাে নামিয়ে এনে বললেনভিজিটের টাকা নিয়ে এরা ঝামেলা করে নাইদুইশ টাকা ভিজিট চেয়েছিলাম দিয়েছেমােটর সাইকেলের তেলের খরচ দিয়েছেআর আমার এসিসটেন্টকে দিয়েছে কুড়ি টাকাএদের পয়সাকড়ি আছে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *