আগের বার
টেবিল ল্যাম্প ছিল না। নতুন কেনা হয়েছে। আনিস চিঠিতে লিখেছিল, ঘরে ইলেকট্রিক তার ছিড়ে গেছে বলে ঘরে ফ্যান ঘুরছে না, বাতি জ্বলছে না। নবনী দেখল ইলেকট্রিসিটি আছে। মাথার ওপর দুর্বলভাবে ফ্যান ঘুরছে।
রাত অনেক হয়েছে। ঘরের বারান্দায় নবনী বসে আছে। বারান্দায় আলাে নেই। খোলা জানালা থেকে কিছু আলাে এসে পড়েছে তার পায়ে। নবনীর কোলে একটা মােটা বাঁধানাে বই। বই পড়ার মতাে আলাে নেই। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে বই হাতে রাখা । মাঝে মাঝে পাতা ওল্টানাে। চারদিক অসম্ভব নীরব। রাত আটটার দিকে ঝিঝি ডাকছিল। এরাও চুপ করে গেছে। শহরের কোলাহল থেকে হঠাৎ এ ধরনের শব্দহীনতা মনের ওপর চাপ ফেলে। নবনীর কিছু ভালাে লাগছে না। কিছুক্ষণ আগেও ক্ষিধে পাচ্ছিল, এখন সে ক্ষিধেও নেই। মতি নামের মানুষটাকে বিদেয় করে দেয়া ঠিক হয় নি। সে থাকলে তার সঙ্গে গল্প করা যেত।
আনিস ফিরলেও খুব যে গল্প করা যাবে তা না। আনিস চুপচাপ ধরনের মানুষ। কথা বললে মন দিয়ে কথা শুনবে। নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কখনােই কিছু বলবে না। সে যে কৌতূহলশূন্য মানুষ তাও না। তার কৌতূহল আছে, কিন্তু কৌতূহলের কোনাে প্রকাশ নেই। এর কোনাে মানে হয়? মানুষের ভেতর যা থাকবে তার প্রকাশও থাকা উচিত। আবেগ থাকবে অথচ আবেগের প্রকাশ থাকবে না, এটা কেমন ব্যাপার ?
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২৩) হুমায়ূন আহমেদ
সুজাত মিয়া কয়েকবার এসে নবনীকে দেখে গেছে। তাকে বলা হয়েছে সে যেন খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ে। সে হ্য–সূচক মাথা নেড়েছে কিন্তু খেতে বসে নি– ঘুরঘুর করছে।
যে যেমন সে তার আশেপাশের মানুষগুলােও সে রকম জোগাড় করে। সুজাত মিয়ার মুখে কোনাে কথা নেই। প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে সে চেষ্টা করে হা না বলে জবাব দিয়ে দিতে। মনে হচ্ছে তাকে কথা না–বলার ট্রেনিং দেয়া হায়েছে।
রাস্তায় কাকে যেন দেখা যাচ্ছে। টর্চের আলাে ফেলে এগুচ্ছে। মানুষটার গায়ে চাদর। চাদরে মাথাও ঢাকা । আনিস ফিরছে কি? তার সাইকেল চুরি গেছে। হেঁটে হেঁটেই ফেরার কথা। এই গরমে সে মাথায় চাদর দিয়ে আছে কেন? শরীর খারাপ করেছে কি ? ডাক্তারদের শরীর খারাপ শুনতে খুব হাস্যকর লাগে, কিন্তু ডাক্তারদের শরীর খারাপ হয়— ভালােমতােই হয়। নবনী বুঝতে পারছে না, সে বারান্দায় বসে থাকবে না–কি আনিসকে চমকে দেবার জন্যে কিছু
করবে ? বারান্দা থেকে নেমে উঠোনের কাঁঠাল গাছের আড়ালে চলে যাওয়া যায়। তারপর হঠাৎ আনিসের সামনে ঝাপ দিয়ে পড়ে বিকট চিৎকার দেয়া। একঘেয়েমির জীবনকে ইন্টারেস্টিং করার জন্যে মাঝে মাঝে লবণ এবং গােলমরিচের গুঁড়াে ছিটিয়ে দিতে হয়। বেঁচে থাকা ব্যাপারটার মধ্যেই একঘেয়েমি আছে। যে মানুষটা সত্তর বছর বাঁচে তাকে এই দীর্ঘ সত্তর বছর ধরেই যথানিয়মে রাতে ঘুমুতে যেতে হয়। স্যুর বছর প্রতিদিন তিনবেলা খেতে হয়। ক্লান্তিকর একটা ব্যাপার। নিম্নশ্রেণীর কীট পতঙ্গের বেঁচে থাকার মধ্যে কিছু বৈচিত্র্য আছে। সামান্য পিঁপড়া এক সময় পাখা পেয়ে আকাশে ওড়ে। কুৎসিত দর্শন শুয়ােপােকা একদিন সুন্দর প্রজাপতি হয়। মানুষের মধ্যে এরকম কিছু নেই– মানুষ বদলায় না।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২৩) হুমায়ূন আহমেদ
টর্চ হাতে লােকটা অনেক কাছে এসে গেছে। সে আনিস না, মতি। কোথেকে চাদর জোগাড় করে হন হন করে যাচ্ছে। নবনী কোলের ওপর রাখা বইটার পাতা উল্টাল। তার সামান্য ভয় ভয় লাগছে। চাদর গায়ে মানুষটাকে দেখে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও মনে হয়েছিল–– বিরাটনগরের ইমাম সাহেব। সেই মানুষটাও ছিল মতির মতাে ছােটখাট ।
আনিস গিয়েছে মিঠাপুরে।
বিরাটনগর থেকে মিঠাপুরের দূরত্ব সাত মাইল। গ্রামের হিসাবে দুই ক্রোশের সামান্য বেশি। বর্ষাকালে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালাে। ইনজিনের নৌকা চলে। সমস্যা হয় শীতের সময়। শুকিয়ে যাওয়া বিলের ভেতর দিয়ে হাঁটা পথ। গ্রামের মানুষদের জন্যে হাটা কোনাে বড় ব্যাপার না। তারা মাইলের পর মাইল নির্বিকার ভঙ্গিতে হাঁটতে পারে। আনিস পারে না। তার কষ্ট হয়। পা ফুলে যায়। সাইকেল চুরি যাওয়াতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। সে অনেকবারই ভেবেছে এমন গভীর গ্রামে রােগী দেখতে যাবে না। রােগীদের হাসপাতালে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। হাসপাতালের ব্যাপারে এখনাে গ্রামের মানুষদের ভেতর প্রবল ভীতি কাজ করছে। হাসপাতালে যাওয়া মানে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়া। তাদের হিসেবে হাসপাতাল থেকে জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা শূন্য।
ডাক্তার বাড়িতে নিয়ে আসার পেছনে আরেকটি মানসিকতা কাজ করে। ক্ষমতা প্রতিপত্তি জাহির করার মানসিকতা।– হে গ্রামবাসী তােমরা দেখ, পাস করা এমবিবিএস ডাক্তার বাড়িতে নিয়ে এসেছি।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২৩) হুমায়ূন আহমেদ
আনিস যে রােগী দেখতে যাচ্ছে তার বয়স অল্প— এগারাে বারাে বছরের কিশাের। নাম কাদের। হঠাৎ তার শরীর ফুলে গেছে। কথা বলতে পারছে না, কাউকে চিনতে পারছে না। অন্য ডাক্তার তার চিকিৎসা করছিলেন। চিকিৎসায় কোনাে ফল হয় নি বরং রােগীর অবস্থা আরাে খারাপ হয়েছে। সেই ডাক্তার শেষ কথা বলে এসেছেন— রােগী ঢাকায় নিতে হবে। রােগীর আত্মীয়স্বজন রােগীকে ঢাকায় নিতে প্রস্তুত। কিন্তু শেষ চিকিৎসা হিসেবে আনিসকে দেখাতে চায়। অল্প বয়স্ক গম্ভীর ধরনের এই ডাক্তার সম্পর্কে নানান কথা শােনা যায়। এই ডাক্তারের সাইকেলের ঘণ্টা না–কি আজরাইল সহ্য করতে পারে না। আজরাইলের কানে যন্ত্রণা হয়। সে দূরে সরে যায়। মরণাপন্ন রােগী বিছানায় উঠে বসে চিকন গলায় বলে— কৈ মাছের সালুন দিয়া ভাত খামু।
রােগীর বাড়ির কাছাকাছি পৌছার পর রােয়াইল বাজারের এমবিবিএস ডাক্তার সাইফুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আনিসের দেখা হলাে। সাইফুদ্দিন সাহেব মােটর সাইকেলে করে এসেছেন। মােটর সাইকেলের কেরিয়ারে ডাক্তারি ব্যাগ নিয়ে তার এসিসটেন্ট বসা। এসিসটেন্টের মুখও গম্ভীর। তাকে রােগী দেখার জন্যে আনা হয়েছে। তিনি আনিসকে দেখে ভুরু কুঁচকে ফেললেন। মােটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে আনিসকে হাতের ইশারায় এক পাশে নিয়ে গেলেন। গােপন কিছু কথা বলবেন— এইসব গােপন কথা রােগীর বাড়ির যে দুজন আনিসকে নিয়ে আসছে তাদের শোনানাে যাবে না।
সাইফুদ্দিন সাহেব গলা নামিয়ে বললেন— রােগী দেখার কিছু নাই। শেষ অবস্থা। ডাক্তার শিলপাটায় বেটে শরীরে মাখিয়ে দিলেও কিছু হবে না।
আনিস বলল, হয়েছে কী ?
পানি এসে শরীর ফুলে গেছে। শ্বাসনালিও ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। রাতটা টিকবে না। ভিজিটের টাকা নিয়ে দ্রুত চলে আসবেন। অঞ্চলটা খারাপ। ডাক্তারের উপস্থিতিতে রােগী মারা গেলে খবর আছে।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২৩) হুমায়ূন আহমেদ
আনিস চুপ করে রইল। সাইফুদ্দিন সাহেব গলা আরাে নামিয়ে এনে বললেন— ভিজিটের টাকা নিয়ে এরা ঝামেলা করে নাই। দুইশ টাকা ভিজিট চেয়েছিলাম দিয়েছে। মােটর সাইকেলের তেলের খরচ দিয়েছে। আর আমার এসিসটেন্টকে দিয়েছে কুড়ি টাকা। এদের পয়সাকড়ি আছে।