দিঘির জলে কার ছায়া গো পর্ব – ৪ হুমায়ূন আহমেদ

দিঘির জলে কার ছায়া গো পর্ব – ৪

টেনশনের ব্যাপার হচ্ছে, দৃশ্যটা আমার পছন্দ হচ্ছিল না। কাশি বান্ধবীর দৃষ্টি আকর্ষণ কেন করব? আমি তখন ডিরেক্টর সাহেবকে বললাম, কাশি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ না করে আমি যদি নিচু গলায় এক লাইন গান করি–আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে– তাহলে কেমন হয় স্যার?

আমি গান গাইতে পারি। ডিরেক্টর স্যার বললেন, খুবই ভালো হয়। ম্যাডাম নিলি বললেন, মোটেই ভালো হয় না। পুরো ব্যাপারটা সিনেমেটিক হয়। সস্তা বাংলা সিনেমা। দুজনের মধ্যে তর্ক বেধে গেল। এক পর্যায়ে ম্যাডাম কঠিন গলায় বললেন, আমি এই নাটকে কাজ করব না। আমি চলে যাচ্ছি, আপনি অনা কোনো নায়িকা খুঁজে বের করুন।উনি চলে গেলেন?

হ্যাঁ চলে গেলেন। আমার জন্যে পুরো ব্যাপারটা কেঁচে গেল। আগামীকাল শুটিং ছিল। শুটিং ক্যানসেল হয়ে গেছে।লীলা বলল, তুমি সমস্যা বাঁধিয়েছ, তোমার উচিত সমস্যা মেটানো।কীভাবে মেটাব? যে সমস্যা তৈরি করে সে জানে কীভাবে সমস্যা মিটাবে। এই অনেক কথা বলে ফেলেছি— আমার নিজেরই এখন ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট।বৃষ্টিতে ভিজবে না?

অবশ্যই ভিজব। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘুমাব। তুমি কখনো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘুমিয়েছ? না।একটা পাটি পেতে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে হবে। টাওয়েল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে হবে। মুখে বৃষ্টি পড়লে ঘুম আসবে না। মনে হবে মশা কামড়াচ্ছে।লীলা টেলিফোন রেখে দিল।রাতে বৃষ্টিতে ভিজে লীলার ভালো ঝামেলা হয়েছে। শেষরাতে জ্বর এসেছে। শুরু হয়েছে ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন। একটা শেষ হওয়া মাত্র আরেকটা।মাঝে মাঝে পানির পিপাসায় ঘুম ভাঙছে।

খাটের পাশের সাইড টেবিলে পানির বোতল থাকে। বোতলে পানি নেই। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল আনার প্রশ্নই আসে না। যতবার ঘুম ভেঙেছে ততবারই লীলা ক্লান্ত গলায় বলছে, কেউ কি আমাকে ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খাওয়াবে? বলার জন্যে বলা। ঘরে সে এবং তার বাবা ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণী নেই। শওকত সাহেবের ঘর সর্বক্ষিণে। তিনি দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমান। চিল্কার করে ডাকলেও তার কানে যাবে না। কে তার জন্যে পানি নিয়ে আসবে?

তবে জাগ্রত অবস্থায় পানি চাওয়ার একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে। স্বপ্নে তার জন্যে পানি আসছে। প্রতিবারই সাত-আট বছরের একটি বালক পানি নিয়ে আসছে। বিশাল সাইজের গ্লাসভর্তি পানি। সে পানি এনে বলছে, মা, পানি এনেছি। লীলা হাতে পানির গ্লাস নিচ্ছে, কিন্তু গ্লাসে মুখ দেবার আগেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। স্বপ্নের বাচ্চাটা তাকে মা ডাকছে কেন কে জানে? তার অবচেতন মন কি চাইছে তার বিয়ে হোক? একটা বাচ্চা হোক। বাচ্চা তাকে মা ডাকুক?

সকাল আটটা। লীলা চাদরের নিচে। সে বুঝতে পারছে না। তার কি ঘুম ভেঙেছে, না-কি স্বপ্ন দেখছে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দ কানে আসছে। কে চালাবে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার? কাজেই এটা স্বপ্ন। রান্নাঘর থেকে কল ছাড়ার শব্দ আসছে। কেউ থালাবাসন ধুচ্ছে। অবশ্যই স্বপ্ন। লীলা চেষ্টা করল জেগে ওঠার। আর তখন তার ঘরের দরজা কেউ একজন সামান্য ফাক করে বলল, আপা, গুড মর্নিং! বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে। সুশ্রী চেহারা। বড় বড় চোখ। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল। অ্যাপ্রন পরে আছে। লীলা বলল, কে?

ম্যাডাম, আমার নাম আসমা। আমি আপনাদের হাউসড়ে। আহসান স্যার আমাকে আর গনি মিয়াকে পাঠিয়েছে। আজ এই বাড়িতে উনার পার্টি আছে। আমরা গুছাচ্ছি। ম্যাডাম, চা-কফি কিছু খাবেন?

ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খাব।ম্যাডাম! আপনার কি শরীর খারাপ? মনে হয় জ্বর এসেছে।ম্যাডাম, আমি কি কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখব? দেখ।আসমা কপালে হাত দিয়ে বলল, অনেক জ্বর। ঘরে নিশ্চয় থার্মোমিটার আছে? বাবার কাছে আছে।ম্যাডাম, আমি পানি নিয়ে আসছি।লীলা শুয়ে পড়ল। তার চোখ বন্ধ।

জানালা দিয়ে রোদ এসে বিছানায় পড়েছে, সেই রোদের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চোখ কট কট করছে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দটা মাথায় লাগছে। আসমা পানি নিয়ে এসেছে। ট্রে-তে পানির গ্লাস, টিস্যুবক্স, এককাপ চা এবং একটা থার্মোমিটার। লীলা অবাক হয়ে দেখল, আসমা মেয়েটির কাজকর্ম অত্যন্ত গোছানো। সে লীলার হাতে পানির গ্লাস দিল। পানি খাওয়া শেষ হওয়ামাত্র তার হাতে দুটা টিস্যুপেপার দিল। কী জন্যে দিল লীলা বুঝতে পারল না। চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। পিরিচে দুটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট।

ম্যাডাম, প্যারাসিটামল খেয়ে চা খান। জ্বর সঙ্গে সঙ্গে কমবে। অনেকেই বলেন, খালি পেটে ওষুধ খাওয়া যায় না। কথাটা ঠিক না। অ্যাসপিরিন জাতীয় ট্যাবলেট খাওয়া যায় না। প্যারাসিটামল খাওয়া যায়। আগে থার্মোমিটারটা মুখে দিন, জ্বর দেখে দেই। টিপেপার দিয়ে থার্মোমিটারের মুখটা মুছে নিন।

হাতে টিস্যুপেপার দেবার রহস্য এখন ভেদ হলো। লীলা মুখে থার্মোমিটার দিয়ে বসে আছে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দ বন্ধ, এটা একটা স্বস্তির ব্যাপার। চেয়ার টানাটানির শব্দ হচ্ছে। এই শব্দ ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দের মতো অসহনীয় না।ম্যাডাম! আপনার জ্বর একশ দুই পয়েন্ট পাঁচ। আপনি শুয়ে থাকুন।

লীলা বাধ্য মেয়ের মতো শুয়ে পড়ল। আসমা বলল, আহসান স্যার আমাকে বলে দিয়েছেন আপনার ঘুম ভাঙামাত্রই যেন তার সঙ্গে আপনাকে টেলিফোনে যোগাযোগ করিয়ে দেই। ম্যাডাম দেব? না।ম্যাডাম, উনি বিশেষ করে বলে দিয়েছেন। এর মধ্যে দুবার টেলিফোন করেছেন। আপনার জ্বর স্যারকে আমি জানিয়েছি। সার খুবই চিন্তিত। স্যারকে ধরে দেই? শুধু হ্যালো বলুন। এতেই হবে।দাও।

আসমা অ্যাপ্রনের পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করল। নাম্বার টিপল এবং মোবাইল কানে দিয়ে বলল, স্যার, কথা বলুন। সে মোবাইল লীলার হাতে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দরজা ভেজিয়ে দিল।লীলা! জ্বর না-কি বাঁধিয়েছ? হ্যাঁ।নিশ্চয়ই তোমার অভ্যাস মতো কাল রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছ। ঠিক না? হ্যাঁ ঠিক।কতক্ষণ ভিজেছ? ঘড়ি দেখি নি, তবে অনেকক্ষণ ভিজেছি। বৃষ্টিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।আজকের পার্টি অফ করে দেই?

দিন।আমি কিন্তু আসব। রোগী দেখে যাব।কখন আসবেন? রাত আটটায়। তবে আমার ধারণা, তার আগেই তোমার জ্বর সেরে আঁবে। আসমা মেয়েটি তোমাকে সুস্থ করে তুলবে। এই মেয়ে খুব expert. আসমা মেয়েটি সম্পর্কে বলুন। পার্টি গোছানোর জন্যে পাঠিয়েছেন?

পার্টি গোছানোর জন্যে গনি মিয়াকে পাঠিয়েছি। আর আসমা হলো আমার দিক থেকে তোমাকে উপহার। সংসার ঘড়ির কাটার মতো সচল রাখতে ওর মতো একটি মেয়েই যথেষ্ট।তাকে পেয়েছেন কোথায়? সে দিনাজপুরের মেয়ে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ। কুয়েতে এক আমীরের বাড়িতে হাউসমেড় ছিল। নানান ঝামেলায় পড়ে দেশে ফিরে আসে। তার অতীত ইতিহাসের তো তোমার দরকার নেই। না-কি আছে?

দরকার নেই।তুমি রেস্ট নাও। জ্বর নিয়ে অতি প্রিয়জনদের সঙ্গেও কথা বলতে ভালো লাগে না। আর আমি অতি প্রিয়জনদের তালিকায় নেই।লীলা বলল, আমার অতি প্রিয়দের তালিকায় কে কে আছে বলে আপনার ধারণী?আহসান বলল, তোমার বাবা। মুহিব নামের যুবক, যে তোমাকে ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করেছে। তোমার ডাক্তার ছোটখালা সালেহা। ছাদে তোমার পোষা দুই ময়ূর এবং বাঁদরটা। বাঁদরটার নাম যেন কী? হড়হড়কু না?

জি, হড়হড়কু।এই অদ্ভুত নামটা কেন দিয়েছ? লীলা বলল, আপনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার হড়হড়কু বলুন, দেখবেন হড়হড়কু বলার সময় চেহারাটা বাঁদরের মতো হয়ে যায়। এইজন্যেই নাম রেখেছি হড়হড়কু।আহসান বলল, এক্ষুনি ব্যাপারটা টেস্ট করছি। লীলা, কথা শেষ করার আগে ছোট্ট আরেকটা কথা। ভিন্ন প্রসঙ্গ। বলি?

বলুন।আমি বিদেশ থেকে যখন আসি, তুমি আমার সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বলো। একটা পর্যায়ে এসে তুমি বলতে শুরু কর, তখন বিদেশে যাবার সময় হয়। বিদেশ থেকে ফিরে আসি, আবার শুরু কর আপনি।লীলা বলল, এবার যখন তুমি বলা শুরু করব তখন বিদেশ যাবেন না। তাহলেই তো হয়।আহসান বললেন, এটা মন্দ বলে নি। লীলা রাখি। দেখা হবে সন্ধ্যায়। দ্রুত সেরে উঠ।চেষ্টা করছি।থ্যাংক য়্যু

লীলা টেলিফোন রাখার পরপরই আসমা গামলাভর্তি পানি এবং তোয়ালে নিয়ে ঢুকেছে। লীলা বলল, কী? ম্যাডাম, আপনার গা স্পঞ্জ করে দেব।লাগবে না।আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন। আমি গা স্পঞ্জ করছি, দেখবেন কত ভালো লাগবে। ম্যাডাম, আমি আপনার সারা গা স্পঞ্জ করব। আপনি চোখ বন্ধ করে থাকুন। আমাকে লজ্জা করার কিছু নেই।আসমা গা স্পঞ্জ করছে। লীলা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার ভালো লাগছে। মনে হয় জ্বর কমতে শুরু করেছে।ম্যাডাম, ছাদে আপনার ময়র দুটা দেখে এসেছি। এদের স্বাস্থ্য বেশ ভালো। কিছুদিনের মধ্যেই পালকে রঙ ধরবে।তুমি জাননা কীভাবে?

আমি কুয়েতে যে শেখের বাড়িতে কাজ করতাম, উনার দশটা ময়ূর ছিল। দুটা ইমু পাখি ছিল। ময়ুরকে খাওয়ানোর জন্যে উনি তার প্রাইভেট প্লেনে করে হংকং থেকে সাপ আনাতেন।শেখের নাম কী? অনেক লম্বা নাম— আল হাসান ইবনে মোহম্মদ ইবন জাফর ইবনিল হোসায়ান। সবাই ডাকত শেখ হাসান।তাঁর চিড়িয়াখানায় আর কী ছিল?

নানান ধরনে পাখি ছিল। কোনো পশু ছিল না। তিনি পশু পছন্দ করতেন। অনেক জাতের ঈগল ছিল। একটা ঈগল ছিল তার পোষা। নাম সাব্বাই। তিনি ছাদে উঠে ঈগলটা ছেড়ে দিতেন। ঈগল সোজাসুজি আকাশে উঠে নিমিষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেত। আবার নেয়ে এসে তার হাতে বসত। ঈগলকে খাওয়ানোর জন্যে রোজ একটা করে দুম্বা জব হতো। উনার পাখি দেখাশোনার জন্যে চারজন লোক ছিল।তোমার দায়িত্ব কী ছিল?

ম্যাডাম, আমি, ফিলিপিনের তিন মেয়ে, শ্রীলঙ্কার একটা মেয়ে আর ইন্ডিয়ার একটা মেয়ে, আমরা ছিলাম হাউসমভ।এতজন? শেখের বাড়িটা ছিল প্রকাণ্ড। শোবার ঘর ছিল একুশটা। ম্যাডাম, বাথরুমে যান, হাতমুখ ধোন। আমি নাশতা আনিচ্ছি। আপনার জ্বর নামছে, গা ঘামছে।কী নাশতা খাব?

রুটি আর ভাজি। আমি একটা লিস্টি করে রেখেছি। লিস্টি মতো জিনিস আনিয়ে দিলে সকালের নাশতার সমস্যা হবে না।তোমার ঐ শেখ, উনি সকালে কী নাশতা খেতেন? প্যারিসের একটা রেস্টুরেন্টের সঙ্গে উনার কন্ট্রাক্ট ছিল। তারা নাশতার ব্যবস্থা করত। উনার এত টাকা যে খরচ করার পথ জানতেন না। ম্যাডাম, আপনার জ্বর এখন আরেকবার মাপব?

দরকার নেই। আমি বুঝতে পারছি জ্বর কমেছে।আসমা থার্মোমিটার হাতে নিয়ে বলল, জ্বর কতটা কমেছে জানা দরকার ম্যাডাম।তুমি আমাকে এখন থেকে আপা ডাকবে। ম্যাডাম ডাকবে না। বারবার ম্যাডাম ডাকছু। মনে হচ্ছে আমি সিনেমার নায়িকা। এক্ষুনি ডিরেক্টর সাহেব আমাকে শট দেবার জন্যে ডাকবেন। আমাকে লীলা আপা ভাকবে। যতবার লীলা শব্দটা শুনি আমার ভালো লাগে।আসমা বলল, আমি আপা ডাকব। লীলা আপা ডাকব না। আপনার নাম ধরে ডাকবেন আপনার প্রিয়জনরা।

লীলা বলল, থার্মোমিটার মুখে দিয়ে আমি এক মিনিট বসে থাকব, কথা বলতে পারব না। এই এক মিনিটে তুমি তোমার স্যার আহসান সাহেব সম্পর্কে যা জানো বলবে।আসমা বলল, পুরুষমানুষের মধ্যে মন্দভাব বেশি। মন্দ নাই এমন পুরুষ পাওয়া কঠিন। স্যারের মধ্যে মন্দ অংশ কম। আপা, আপনি এক সময় না এক সময় জানবেন এইজন্যে এখনই বলছি— কুয়েতের ঐ শেখ সৰু কয়জন মেয়েকে ব্যবহার করত। অনেক ঝামেলা করে আমি ফিরে আসি।

আহসান স্যার ফিরে আসার ব্যাপারে আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আমার মতো মেয়েদের পুরুষরা বেশ্যা বিবেচনা করে। তাদের সঙ্গে সেই আচরণ করে। আহসান স্যার কখনো এরকম করেন নি। তিনি সম্মানের সঙ্গেই আমার সঙ্গে কথা বলেন।আসমা থার্মোমিটার হাতে নিয়ে বলল, আপা, আপনার টেম্পারেচার এখন একশর সামান্য নিচে।

লীলা বলল, শেখের নামটা আরেকবার বলো তো! আসমা বলল, আল হাসান ইবনে মোহম্মদ ইবন জাফর ইবনিল হোসায়ান।মুহিব নিলি ম্যাডামের বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। দুজন দারোয়ান গেট পাহারা দিচ্ছে। আর একজন সম্ভবত কেয়ারটেকার জাতীয় কেউ। সে-ই মুহিবকে আটকেছে।আপনার নাম, কোথেকে এসেছেন সেই ঠিকানা এবং কেন এসেছেন সেটা লেখেন।মুহিব বলল, এত লেখাপড়া? জি এইটাই নিয়ম। নিলি ম্যাডাম এই নিয়ম করেছেন। তাকে অনেক উটকা লোক বিরক্ত করে তো এইজন্যে। আপনি করেন কী?

আমি কিছু করি না। আমিও একজন উটকো লোক।তাহলে দেখা হবে না। লেখালেখি করে লাভ নাই। চলে যান।এসেছি যখন চেষ্টা করে দেখি।বসেন ঐ চেয়ারে। দশটা বাজুক। দশটার পর ভেতরে খবর দেব। দশটার আগে ম্যাডামের কাছে খবর পাঠানো নিষেধ।মুহিব বলল, তিনতলা বাড়ির পুরোটাতেই কি ম্যাডাম থাকেন? জি।

মুহিব বলল, এমন কেউ কি আছে যাকে আপনারা গেটে আটকান না? সে সরাসরি চলে যেতে পারে। ফ্রি পাশ।এমন কেউ নাই। ম্যাডামের হাসবেন্ড যদি আসেন তাকেও খবর পাঠাতে হয়।ম্যাডাম বিবাহিত? জানতাম না তো।কেয়ারটেকার বলল, সম্পর্ক নাই। দুজন আলাদা থাকে। পুলা একটা আছে। স্যার তরে মাঝে মইদ্যে দেখতে আসে।মুহিব বলল, ছেলের নাম কী? পদ্ম।

পদ্ম তো মেয়েদের নাম।কথা ঠিক বলেছেন, তয় বড়লোকদের কারবার। মেয়ের নাম দেয় ছেলেরে। ছেলের নাম দেয় মেয়েরে।মুহিব বলল, ভাই, সিগারেট খাওয়া যাবে? না রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেয়ে আসতে হবে? খান সিগারেট।মুহিব একটা সিগারেট ধরালো। কেয়ারটেকারের দিকে প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনিও একটা খান। আসুন দুই ভাই মিলে ধোয়া ছাড়ি। আপনার নাম কী?

মকবুল।মকবুল ভাই, সিগারেট ধরান।মকবুল সিগারেট নিল। গম্ভীর গলায় বলল, আমার সাথে খাতির কইরা লাভ নাই। ম্যাডাম পারমিশন না দিলে No see. মুহিব বলল, আশেপাশে চায়ের দোকান আছে? চা খেয়ে সময় কাটাই, দশটার পরে একবার এসে খোঁজ নিব পারমিট পাওয়া গেল কি-না।বড় রাস্তার উল্টাদিকে একটা চায়ের দোকান আছে। চা ভালো বানায়।পারমিশন পাওয়া গেছে। পারমিশন পাওয়ায় মকবুলকে অসন্তুষ্ট বলে মনে হচ্ছে। সে বিরক্ত মুখে বলল, চলে যান। ফিরত যাবার সময় যে টাইমে ফিব্রত যাচ্ছেন সেই টাইম লিখে যাবেন।

কলিংবেলে হাত রাখার আগেই নিলি দরজা খুলল। কোনো একটা ম্যাগাজিনে (খুব সম্ভব তারকা সংবাদ) মুহিব পড়েছিল, মেকাপ ছাড়া নায়িকাদের চেহারা প্রায় পেতনির কাছাকাছি। নিলি মনে হয় তার মধ্যে পড়েন না। তাকে মেকাপ ছাড়া অনেক বেশি মিষ্টি লাগছে।নিলি বলল, মুহিব বসুন। আমার মন বলছিল আজকালের মধ্যে আপনি নাটকের বিষয়ে সুপারিশ করতে আসবেন। সুপারিশ করতে আসা দোষের কিছু না। জীবনের প্রথম নাটক প্রচারিত হোক সবাই চায়। আমি কিন্তু ঐ নাটকটা করব না।

মুহিব বলল, ম্যাডাম, আমি সুপারিশ করতে আসি নাই। আমার কপালে আছে সবকিছুতে আমি ফাইনাল পর্যন্ত যাব, তারপর ভজঘট হয়ে যাবে।তাই না-কি? জি। টুথপেস্টের একটা অ্যাড করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সব ফাইনাল। যেদিন শুটিং হবে সেদিন ডিরেক্টর বললেন আমাকে দিয়ে হবে না। আমার চোখে না-কি মায়া নাই।ডিরেক্টর সাহেবের নাম কী?

নাম মনে নাই।চোখে মায়া নেই বলে বিজ্ঞাপন বাতিল? জি।নিলি বলল, চোখের মায়াটা আসলে কী? মুহিব বলল, জানি না।নিলি বলল, ভালো করে তাকিয়ে দেখুন তো। আমার চোখে কি মায়া আছে? মুহিব কী বলবে বুঝতে পারছে না। লীলার মতো সহজ সম্পর্ক থাকলে বলতো, ম্যাডাম আপনার চোখে তেমন মায়া দেখছি না। কাঠিন্য দেখছি। বিজ্ঞাপনের ছবিতে কাজ করতে গেলে ডিরেক্টর সাহেব আপনাকেও বাদ দিয়ে দিতেন।

নিলি বলল, আমার চোখে মায়া নেই এই কথাটাই তো বলতে চাচ্ছেন। চক্ষুলজ্জায় বলতে পারছেন না। ঠিকই ধরেছেন। আমার দৃষ্টি কঠিন। যখন আমি আমার ছেলের দিকে তাকাই, তখন দৃষ্টি কোমল হয়। চোখে মায়া চলে আসে। চোখের মায়ার এই হচ্ছে রহস্য। চোখের মায়া গণবিষয় না। শুধুমাত্র প্রিয়জনদের জন্যে। আরো রহস্য আছে। জানতে চান? জানলে অভিনয়ে সুবিধা হবে।মুহিব বলল, বলুন।নিলি বলল, আপনি আপনার সামনের পেইন্টিংটার দিকে তাকান। কী দেখছেন?পাথরের ওপর পাখি বসে আছে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *