দিঘির জলে কার ছায়া গো পর্ব – ৫ হুমায়ূন আহমেদ

দিঘির জলে কার ছায়া গো পর্ব – ৫

নিলি বলল, মানুষের চোখের দৃষ্টি হচ্ছে Convergent, দুই চোখের দৃষ্টি একবিন্দুতে মিলে। যদি ইচ্ছা করে মিলতে না দেয়া হয়, তাহলেই চোখে মায়া চলে আসে। আপনি এখন পেইন্টিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকুন, তবে ছবি দেখবেন না। ডান চোখে দেখার চেষ্টা করেন পেইন্টিং-এর ডান ফ্রেম। বাঁ চোখে বা ফ্রেম। একটু চেষ্টা করলেই হয়ে যাবে। এই তো হয়েছে। এবং আপনার চোখে মায়া চলে এসেছে।মুহিব বলল, চোখে মায়া আনার ব্যাপারটা কি কেউ আপনাকে শিখিয়েছে?

নিলি বলল, না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেই বের করেছি। ভালো কথা, আপনার বাসায় কি বড় আয়না আছে? পুরো শরীর দেখা যায় এমন আয়না? না।বড় একটা আয়না কিনবেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলবেন।লাভ কী? অভিনয় ভালো হবে। এক্সপ্রেশন ভালো হবে। শব্দ করে হাসবেন। এতে মুখের চামড়ায় ফ্লেক্সিবিলিটি আসবে। আপনাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু টিপস দিয়ে দিলাম। কারণ জানতে চান? চাই।

আপনি খুব ভালো একটা দিনে এসেছেন। আজ আমার বাবুর জন্মদিন। দুবছর আগে এইদিনে সকাল দশটা চল্লিশ মিনিটে বাবু জন্মেছিল। ডাক্তার যখন আমার কোলে বাবুকে দিল আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ডাক্তার সাহেব, এই পদ্মফুল কি আমার? সেই থেকে ছেলের নাম পদ্ম! নিলির চোখে পানি এসে গেছে। সে কোনোরকম অস্বস্তি বোধ না করে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল। মুহিব বলল, আপনার পদ্মকে কি একটু দেখতে পারি?

নিলি বলল, না। পদ্মার বাবা তাকে নিয়ে গেছেন। পদ্মার কাস্টডি নিয়ে মামলা চলছিল। মামলায় সে জিতেছে। সাত বছর বয়স পর্যন্ত সব মায়েরা বাচ্চাকে রাখার অধিকার পায়। আমি পাই নি। কারণ তার বাবা কোর্টে প্রমাণ করতে পেরেছেন। আমি চরিত্রহীনা নারী। আমার বাড়িতে রোজা রাতে দুষ্ট লোকের আড্ডা হয় মদ্যপান করা হয়।

অভিনয়ের নাম করে আমি দিনের পর দিন বিভিন্ন শুটিংস্পটে রাত কাটাই। আমার ছেলে কাজের মেয়েদের কাছে একা একা থাকে। বাবুর যে মূল আয়া সজিরন কোর্টে তাই বলেছে। বাবুর বাবা সজিরনকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছেন। পঞ্চাশ হাজার টাকা ওদের কাছে অনেক বড় ব্যাপার।মুহিব বলল, সজিরন কি এখন বাড়িতে পল্লীর দেখাশোনা করে?

ঠিকই ধরেছেন। আপনার বুদ্ধি ভালো। আপনি অভিনয় ভালো করবেন। বেকুবরা অভিনয় করতে পারে না। চা খাবেন? মুহিব বলল, না। আমি চা খেয়ে এসেছি। রাস্তার মোড়ে একটা চায়ের দোকান আছে, ভালো চা বানায়। সেখান থেকে পরপর তিনকপি চা খেয়েছি। চা এরকম যে এক কাপ খেলে আরেক কাপ খেতে ইচ্ছা হয়।নিলি বলল, আফিং টাফিং নিশ্চয় মেশায়া চা এমন কোনো নেশার জিনিস যে পরপর তিন কাপ খেতে ইচ্ছা করবে।

একদিন খেয়ে দেখতে হবে।মুহিব বলল একটা ফ্লাস্ক দিন। ফ্লাস্কে করে নিয়ে আসি।নিলি বলল, চা আনতে হবে না। আচ্ছা শুনুন, সন্ধ্যাবেলা একটা কাজকরে দিতে পারবেন? মুহিব বলল, পারব।নিলি বলল, কী কাজ না জেনেই বললেন পারব? মুহিব বলল আমার ধারণী পদ্মার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাকে আপনি উপহার। পাঠাবেন। সেই উপহার নিয়ে যেতে হবে আমাকে।নিলি বলল, ঠিক ধরেছেন। ফ্লাস্ক দিচ্ছি। চা নিয়ে আসুন।চুহিব বলল, গিফট কি কেনা হয়েছে?

নিলি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। বড় একটা গাড়ি কিনেছি। ব্যাটারি অপারেটেড প্যাডেলে চাপ দিলেই গাড়ি চলবে। পদ্মর বয়স দুবছর–প্যাডেলে চাপ দেয়ার বিষয়টা সে বুঝতে পারবে কিনা জানি না। আমার ধারণা বুঝবে। ওর অনেক বুদ্ধি। ওর বুদ্ধির একটা গল্প শুনবেন?

গুনব।নিলি বলল, না থাক।নিলির চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখ মুছছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, মুহিবের চোখে পানি এসে গেছে। সে অন্যদিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে। সে চাচ্ছে চোখের পানি যেন চোখেই শুকিয়ে যায়। সে চোখের পাতা ফেলছে না।মুহিব! জি ম্যাডাম। You are a good soul, আমি যে নাটকটা করব না বলেছিলাম সেটা করব। আপনার জীবনের প্রথম অভিনয় নষ্ট হতে দেব না।ম্যাডাম, অভিনয় নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। হলে হবে। না হলে হবে না।নিলি হাসতে হাসতে বলল, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি হিমু হবার চেষ্টা করছেন। আপনার কি রূপা বলে কেউ আছে?

মুহিব বলল, আছে। তার নাম লীলা।বাহ কী সুন্দর নাম! লীলার একটা পোষা বদর আছে। বাঁদরটার নাম সুন্দর–হড়হড়কু।সুন্দর কোথায়? অদ্ভুত নাম। এই নাম কেন? লীলার ধারণা এই নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মুখ খানিকটা বাঁদরের মতো হয়। ওর দুটা পোষা ময়ুর আছে। একটার নাম চিত্রা আরেকটার নাম মিত্রা।নিলা বলল, আপনার বান্ধবীকে দেখার ইচ্ছা করছে। আপনাদের প্রথম দেখা কীভাবে হয়? নর্দমাতে দেখা। লীলা এই নিয়ে চারলাইনের একটা ইংরেজি কবিতাও লিখেছে, শোনাব? অবশ্যই শোনাবেন।মুহিব বলল,

We were in the drain

I looked at him and saw his pain

with weariness and fault

I cave the dirty stain.

লীলার জ্বর নেই তবে চেহারায় জুরের ছায়া পড়ে আছে। তাকে ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ লাগছে। তার ইচ্ছা করছে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে। লবণ-বাতির রহস্য আলো ছাড়া ঘরে আর কোনো আলো থাকবে না। লবণ-বাতি লীলার ছোট মামা স্পেন থেকে পাঠিয়েছেন। খনিজ লবণের একটা টুকরার ভেতর বাল্ব জ্বলে। বাল্বের আলো লবণের দেয়াল ভেদ করে আসার সময় অদ্ভুত লাল হয়ে যায়। লীলা এই লালের নাম দিয়েছে লবণ-লাল। এই লাল রঙ নিয়ে সে অনেকদিন থেকে একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছে। প্রথম লাইনটা মাথায় এসেছে— When the salt red glows in the dark radiating sorrow…। দ্বিতীয় লাইন আসছে না।

লীলা বসার ঘরে সোফায় বসে আছে। তার সামনে আদার রস দেয়া এক কাপ গ্রিন টি। সে মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। তার সামনে আহসান বসে আছে। তার গায়ে হালকা মেরুন রঙের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির রঙের সঙ্গে লবণ-আলোর মিল আছে। দ্রলোককে সুন্দর লাগছে। আহসান নিচু গলায় কথা বলে যাচ্ছে। লীলা আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে তার প্রতিটি কথা সে মন দিয়ে শুনছে। আসলে তা-না। লীলার মাথায় লবণ-আলো কবিতার দ্বিতীয় লাইন ঘুরছে। দুটা মাত্র শব্দ মাথায় এসেছে Radiating sorrow…। আর আসছে না।

আহসান বলল, লীলা, তুমি কি ডেভিড ব্রেইনের নাম শুনেছ? লীলা বলল, না। উনি কি কবি? আহসান বলল, ম্যাজিকের কবি। street magician, অসাধারণ সব ম্যাজিক দেখান।তার কথী এল কেন? আমি নিউইয়র্কে তার একটা ম্যাজিক দেখেছি। Levitation Magic. লেভিটেশন ম্যাজিক মানে?

লেভিটেশন মানে শূন্যে ভাসা। উনি নিউইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তায় সবার সামনে শূন্যে ভেসেছেন। রাস্তা থেকে ছয় ইঞ্চি ওপরে উঠে দুই মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড ছিলেন।লীলা বলল, দুই মিনিট শূন্যে ভেসে লাভ কী? মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে দুই মিনিটের জন্যে অগ্রাহ্য করে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছেন, এইটাই লাভ। লীলা, তুমি মনে হয় মন দিয়ে আমার কথা শুনছ। আবার জ্বর আসছে না-কি?

দেখি হাতটা বাড়াও তো, জ্বর দেখি।লীলা হাত বাড়াল। আহসান লীলার হাত ধরল। লীলা মনে মনে গুনছে one thousand one, ore thousand two one thousand three… আহসান কতটা সময় হাত ধরে থাকে সেটা জানার জন্যেই one thousand one, two… বলা। একবার one thousand one বলতে এক সেকেন্ড লাগে।লীলার হিসেবে এগারো সেকেন্ড পর আহসান হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, মনে হচ্ছে জ্বর আসছে।লীলা বলল, আসুক। ঝড় আসছে আসুক।ঝড় বলছ কেন?

লীলা বলল, জ্বর হলো শরীরের ঝড়। এই কারণেই ঝড় বলছি। ম্যাজিক সম্বন্ধে কী বলছিলেন বলুন। ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোক দুই মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড শূন্যে ঝুলে রইলেন।আহসান বলল, তুমি মনে হয় ridicule করছ। সবার সামনে কোনো যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়া শূন্যে ভেসে থাকী কঠিন কাজ। যে দেখে তার মধ্যে এক ধরনের অলৌকিক অনুভূতি হয়। তুমি দেখবে? লীলা বলল, আমি কীভাবে দেখব? ব্লেইন সাহেবকে আমি কোথায় পাব? আহসান বলল, আমি দেখাব।লীলা বলল, আপনি দেখবেন মানে? আপনি ম্যাজিক জানেন না-কি?

ম্যাজিক জানি না, তবে দেশের বাইরে যখন যাই দুই একটা ইজি আইটেম ম্যাজিক শপ থেকে কিনে নিয়ে আসি।শূন্যে ভাসা ইজি আইটেম? কৌশলটা খুবই সহজ। Optical illusion তৈরি করা। শূন্যে ভাসার ডেভিড ব্লেইনের এই ভার্সানটার কৌশল জানতে তিনশ ডুলার খরচ করতে হয়েছে। তোমাকে দেখাব?

দেখান।আহসান উঠে দাঁড়াল। ঘরের শেষমাথায় চলে গেল। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে একটু নিচু হলো, তারপর লীলাকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যি শূন্যে ছয় ইঞ্চি ওপরে উঠে গেল। লীলা বলল, Oh God! আহসান শূন্য থেকে নামতে নামতে বলল, আনন্দ পেয়েছ? লীলা বলল, অবশ্যই আনন্দ পেয়েছি।কৌশলটা শিখিয়ে দেব?

লীলা বলল, না। কৌশল কেন শেখাবেন? কৌশল শিখলে তো রহস্যই নষ্ট। তবে আপনি মুহিবকে দেখাতে পারেন। মাঝে মাঝে সে শূন্যে ভেসে আমাকে দেখাবে। আমি মজা পাব।আহসান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আচ্ছা তাকে শিখিয়ে দেব।লীলা বলল, এখন একটা কাজ করুন, আপনার শূন্যে ভাসার খেলা বাবাকে দেখিয়ে আসুন। বেচারা একা একা ঘরে বসে আছে।

আহসান বললেন, তুমি চল। তিনজন মিলে গল্প করি।লীলা বলল, আমার জ্বর আসছে। জ্বর আসার সময় বাবার বক্তৃতা অসহ্য লাগে। আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। ডিনারের সময় আমাকে ডেকে পাঠাবেন। আপনার সঙ্গে ডিনার করব।লীলা উঠে দাঁড়াল। তাকে দ্রুত বিছানায় শুয়ে পড়তে হবে। কবিতার দ্বিতীয় লাইনটা মনে হয় চলে এসেছে।আহসানকে পেয়ে শওকত সাহেব আনন্দিত।

তিনি নতুন একটা বই পড়ছেন। বইয়ে বিবর্তনবাদের জনক Darwin সাহেবকে ধরাশায়ী করা হয়েছে। বিষয়টায় তিনি বিপুল আনন্দ পেয়েছেন। তার পূর্বপুরুষ বানর এটা তিনি নিতেই পারতেন না। এখন সমস্যার সমাধান হয়েছে। তিনি আহসানের দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, তুমি ডারউইনবাদে বিশ্বাস কর? আহসান বলল, জি চাচা করি।তোমার বিশ্বাস তুমি এখন যে-কোনো একটা ভালো ডাস্টবিন দেখে ফেলে দিয়ে আসতে পার?

আহসান বলল, জি আচ্ছা।পুরো বিষয়টা না শুনেই জি আচ্ছা বলবে না। আগে পুরো বিষয়টা শোন।আহসান হতাশভঙ্গিতে পুরো বিষয়টা শোনার জন্যে প্রস্তুত হলো। সহজে এই বিরক্তিকর মনুষটার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।শওকত সাহেব বললেন, তোমাদের ডারউইনের থিওরি বলে পাখি এসেছে সরীসৃপ থেকে। তুমি এখন একটা সাপ এবং ময়ূর পাশাপাশি রাখ। চিন্তা কর যে ময়ুরের পূর্বপুরুষ সাপ। যে সাপ এখন ময়ূরের প্রিয় খাদ্য। বলো তোমার কিছু বলার আছে?

এই মুহূর্তে কিছু বলার নেই চাচা।মনে মনে দশের ওপরে ৯৫০টা শূন্য বসাও। এই বিশাল প্রায় অসীম সংখ্যা দিয়ে এককে ভাগ কর। কী পাবে জানো? শূন্য। এটা হলো অ্যাটমে অ্যাটমে ধাক্কাধাক্কি করে DNA অনু তৈরির সম্ভাবনা। মিলার নামে কোনো সাইন্টিস্টের নাম শুনেছ? ছাগলটাইপ সাইনটিস্ট।চাচা, শুনি নি।ঐ ছাগলটা ১৯৫০ সনে একটা এক্সপেরিমেন্ট করে অন্য ছাগল সাইন্টিস্টদের মধ্যে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। ছাগলটা করেছে কী, ল্যাবরেটরিতে আদি পৃথিবীর আবহাওয়া তৈরি করে ঘনঘন ইলেকট্রিক কারেন্ট পাস করেছে।

কিছু প্রোটিন অনু তৈরি করে বলেছে— এইভাবেই পৃথিবীতে প্রাণের শুরু। প্রাণ সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার কোনো ভূমিকা নেই। এখন সেই ছাগল মিলারকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে হাসাহাসি। Life ম্যাগাজিনে কী লেখা হয়েছিল পড়ে শোনাই।চাচা, আরেকদিন শুনি। জটিল কিছু শোনার জন্যে আমি এই মুহূর্তে মানসিকভাবে তৈরি না।শওকত সাহেব বললেন, জটিল কিছু বলছি না। জলবৎ তরলং। মন দিয়ে শোন। আল্ডারলাইন করে রেখেছি।শওকত সাহেব পড়তে শুরু করলেন। আহসান হতাশ চোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল।

Geologist now think that the premordial atmosphere consisted mainly of carbon dioxide and Nitrogen gases that are less reactive than those used in the 1953 Mitler experiment…

পদ্মর জন্মদিন অনুষ্ঠানে মুহিব উপস্থিত হয়েছে। তার হাতে গিফট র্যাপ দিয়ে মোড়ানো বিশাল বাক্স দেখে দারোয়োন কিছু জিজ্ঞেস করল না। দারোয়ান বলল, ছাদে চলে যান। ছাদে প্যান্ডেল খাটিয়ে উৎসব।

ছাদে উঠে মুহিব পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। বিশাল প্যান্ডেল। প্যান্ডেলের এক মাথায় স্টেজ করা হয়েছে। বিচিত্র পোশাক পরা একজন ডিসকো জকি ভয়ঙ্কর ধরনের বাজনা বাজাচ্ছেন। সেই বাজনার সঙ্গে ছেলেমেয়েরা যার যেমন ইচ্ছা নেচে যাচ্ছে। পাশেই বার তৈরি করা হয়েছে। নানান সাইজ এবং নানান ধরনের বোতল টেবিলে ঝলমল করছে। দুজন বারটেন্ডার ড্রিংক্স দিচ্ছে। বারের ওপর বড় বড় করে লেখা–

Dont over do it. মুহিব উপহারের বাক্স নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। এখানে কারো হাতেই উপহারের কোনো প্যাকেট দেখা যাচ্ছে না। হলুদ ব্লেজার পরা অতি সুদর্শন এক ভদ্রলোক এসে মুহিবের সামনে দাঁড়ালেন। বিনয়ী গলায় বললেন, আপনার পরিচয় জানতে পারি?

মুহিব বলল, আমি পদ্মর জন্যে একটা উপহার নিয়ে এসেছি। পদ্মর মা পাঠিয়েছেন।ভদ্রলোক ইশারা করে কাকে যেন ডাকলেন। তাকে বললেন, জলিল, উনার কাছ থেকে গিফট নিয়ে যাও।মুহিব বলল, নিলি ম্যাডাম বলে দিয়েছেন আমি যেন নিজের হাতে তাকে গিফটটা দেই।ভদ্রলোক বললেন, জলিল, উনাকে পদ্মর কাছে নিয়ে যাও। আর ভাই, আপনি গিফট দিয়ে ছাদে চলে আসবেন। পার্টি এনজয় করবেন। আপনার নাম?

মুহিব।মুহিব সাহেব, পরে আপনার সঙ্গে দেখা হবে।ঘরভর্তি উপহারের মাঝখানে একটা দুবছরের বাচ্চা লাল শার্ট লাল প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে উপহার দেখছে। কোনো একটা বাক্সে হাত দেয়া মাত্র বৃদ্ধা এক মহিলা ধমক দিচ্ছে, হাত দিবা না কইলাম।মুহিবের মনে হলো এই মহিলাই সজিরন। পদ্মর আয়া।মুহিব বলল, পদ্ম! কাছে আস, তোমার মা তোমার জন্যে কী পাঠিয়েছেন দেখ।পদ্ম পরিষ্কার গলায় বলল, আমার মা পাঠিয়েছে?

মুহিব বলল, হ্যাঁ।নিলি মা পাঠিয়েছে? হ্যাঁ।বলেছে—বাবুকে আদর? হ্যাঁ বলেছেন। এসো আমরা উপহার খুলি।পদ্ম ছুটে এল। বৃদ্ধা খ্যাখ্যান গলায় বলল, বাক্স এখন খোলা স্যারের নিষেধ আছে। পরে খোলা হবে। একপাশে থুইয়া দেন। সময় বুইঝা খোলা হইব।মুহিব বলল, তোমার নাম সজিরন না? জে।

মুহিব বলল, বাঘের ওপরে আছে টাগ। তোমার স্যারের ওপরে আছে নিলি ম্যাডাম। তুমি মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছ, এই খবর আমরা জানি। হাইকোর্টে আপিল করা হয়েছে। যদি প্রমাণ হয় তুমি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছ, তোমার চার বছরের জেল হবে। জেলে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে যাও। পান খাওয়ার অভ্যাস আছে দেখতে পাচ্ছি। অভ্যাস ছাড়ার চেষ্টা কর। জেলে পান পাবে না। সমস্যা হবে।মুহিব প্যাকেট খুলছে। পদ্ম ছোট ছোট হাতে তাকে সাহায্য করছে। এবং টুক টুক করে কথা বলছে।গোলাপ ফুল আমাকে গোঁতা দিয়েছে।মুহিব বলল, কাটা লেগেছে হাতে?

হুঁ। এইখানে।পদ্ম হাত বাড়িয়ে বলল, উম্মা দাও।উম্মা ব্যাপারটা কী মুহিব বুঝতে পারছে না।সজিরন বলল, হাতে চুমা দিতে বলতাছে।মুহিব সজিরনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই বেটি খবরদার, আমার সাথে কথা বলবি না। বদের হাডিড। ইয়া নফসি ইয়া নফসি করতে থাক। তোর কপালে দুঃখ আছে।

সজিরন বলল, আমি স্যারের বগলে যাইতেছি। আপনি কী বলছেন সব বুলব।মুহিব বলল, যা তাড়াতাড়ি যা।সজিরন ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র মুহিব পদ্মকে গাড়িতে বসিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এখানে বেশিক্ষণ থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।মুহিব বাড়িতে ফিরল রাত নটায়। বাড়িতে ঢুকতে পারল না।

বাড়ির সামনে ভিড়। লোকজন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। পুলিশের একটা জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাড়ি ঘিরেও ভিড়। মুহিবের চোখের সামনে তার বাবা আলাউদ্দিনকে পুলিশের গাড়িতে তুলল। আলাউদ্দিনের হাতে হাতকড়া। কোমরে দড়ি। তিনি বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পড়লেন। মুহিব পুলিশের গাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছে। ভিড় ঠেলে কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। সে বাবা বলে চিৎকার দিতে যাচ্ছে, তার আগেই গাড়ি ছেড়ে দিল।তিনটা খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় আলাউদ্দিনের ছবি ছাপা হয়েছে। তাদের সংবাদ শিরোনাম–

প্রধান শিক্ষক কর্তৃক

ছাত্রী ধর্ষিত।

কোচিং সেন্টারে প্রধান শিক্ষক

কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণের চেষ্টা।

শিক্ষক হাজিতে।

কন্যাসম ছাত্রী

শিক্ষকের যৌন লালসার শিকার।

ধর্ষণের চেষ্টাকালে শিক্ষক ধৃত।

মুহিব হাজতে তার বাবার সামনে বসে আছে। সে তার বাবার দিকে তাকাতে পারছে না। অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আলাউদ্দিন সিগারেট খান না। তার হাতে সিগারেট। ভুস ভুস করে ধোয়া ছাড়ছেন। তার চোখ রক্তবর্ণ। চুল উসকোখুসকো। একটা চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। মুহিব বলল, মারধোর করেছে না-কি বাবা?

আলাউদ্দিন বললেন, হুঁ। ওসি সাহেবকে টাকা খাওয়াতে হবে। টাকা খাওয়ালে মারধোর হবে না। চেকবই আনতে বলেছিলাম, এনেছিস? হুঁ।ব্যাংকে এক লাখ বিশ হাজার টাকা আছে। চেক লিখে দেই। পুরাটাই তুলবি। ওসি সাহেবকে দিবি দশ হাজার। হাতেপায়ে ধরে বলবি, এর বেশি দেওয়ার সামর্থ্য নাই। পায়ে ধরতে পারবি না? পারব।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *