লােকটি নীচু গলায় বলল, বিড়াল মিউ মিউ করে যে কথাগুলি বলে তা যদি মানুষ বুঝতাে তাহলে তাকে কোনদিন ফেলে দিয়ে আসতাে না। বিড়াল কি বলে?
‘বিড়াল কাঁদতে কাঁদতে বলে, তুমি আমাকে অনেক দূরে ফেলে দিয়ে এসেছিলে। আশ্রয় এবং খাদ্যের সন্ধানে আমি অন্য কোথাও যেতে পারতাম। তা যাইনি। তােমার কাছেই ফিরে এসেছি। অনেক কষ্টে ফিরেছি। কেন জান? তােমার প্রতি ভালবাসার জন্যে। এই ভালবাসা পশুর ভালবাসা হলেও ভালবাসা। এর অমর্যাদা করাে না। তুমি আমাকে গ্রহণ কর।
‘আপনাকে এসব কে বলেছে? ‘কেউ বলেনি। আমি অনুমান করেছি।
‘ভাই এই দেখেন আমার চোখে পানি এসে গেছে। আমি আবার হাইলি ইমােশনাল লােক। অল্পতেই আমার চোখে পানি এসে যায়। টিভির বাংলা সিনেমা যতবার দেখি ততবার কাঁদি। সবাই হাসাহাসি করে। সিনেমা দেখা ছেড়ে দিলাম এই কারণে।
‘মানুষ হয়ে জন্মানাের অনেক যন্ত্রণা।
‘কারেক্ট কথা বলেছেন ভাই। এর চেয়ে গাছ হয়ে জন্মানাে ভাল ছিল। মাঝে মাঝে গাছ হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। হাসবেন না ভাই সত্যি বলছি।”
‘গছি হওয়া তাে খুব সহজ। ‘খুব সহজ? কি বলছেন আপনি?”
‘া খুব সহজ। গভীর বনের মাঝামাঝি একটা ফাঁকা জায়গায় দু‘হাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। গায়ে কোন কাপড় থাকবে না। মাথায় রােদ পড়বে, বৃষ্টি পড়বে, রাতে চাঁদের আলাে পড়বে। আস্তে আস্তে শরীরটা গাছের মত হয়ে যেতে থাকবে। প্রথম দিকে ক্ষুধা–তৃষ্ণা হবে। আস্তে আস্তে কমে যাবে। রােদে পুড়ে গায়ের চামড়া শক্ত হতে থাকবে। পায়ের তলা দিয়ে শিকড় বেরুবে।
‘সত্যি বলছেন নাকি ভাই? ‘হ্যা সত্যি । ‘কতদিন লাগে? ‘কারাে জন্যে খুব অল্পদিন লাগে। আবার কারাে জন্যে দীর্ঘ সময় লাগে। ‘আমার কতদিন লাগবে বলে মনে হয় ? ‘বুঝতে পারছি না। আপনার ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভর করছে। ‘ট্রাই করে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।
‘দেখুন না।
পুরােপুরি নগ্ন না হয়ে যদি একটা আণ্ডার ওয়্যার থাকে তাতে অসুবিধা
না। তবে পুরােপুরি নগ্ন হতেই অসুবিধা কি? কেউ তাে দেখছে না।
‘সেটাও সত্যি। আচ্ছা ভাই আপনি অনেস্টলি বলুন তাে – আমি কি দেখব চেষ্টা করে?” | দেখুন। অন্তত একদিন এবং একরাত দেখুন। যদি দেখছেন পারছেন না, বাসায় চলে আসবেন।
মন্টুর ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। সে নিজের ভেতর অন্য এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছে। সে গাঢ় স্বরে বলল, ব্রাদার একটা কথা।
. বলুন।
‘আপনি এক কাজ করুন। গাড়ি নিয়ে চলে যান। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবেন আমি থেকে গেছি। কি জন্যে সেটা বলবেন না। ওরা হাসাহাসি করতে পারে।”
“জি আচ্ছা বলব না। লােকটা বাসায় ফিরল বিকেল পাঁচটায়।
সে সরাসরি বাসায় আসেনি। গাড়ি নিয়ে সারা শহর ঘুরেছে। ড্রাইভার বিরক্ত হলেও কিছু বলে নি।
মতিন সাহেব বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন – তিনি লােকটাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে বিস্মিত হলেন। লােকটি বলল, ফিরতে খানিকটা দেরী করলাম। গাড়ি নিয়ে খুব ঘুরেছি। আশাকরি কিছু মনে করবেন না।
‘মন্টু? মন্টু কোথায়? ‘উনি মৌচাকে থেকে গেলেন। আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। | মতিন সাহেব কি বলবেন ভেবে পেলেন না। লােকটি গুন গুন করতে করতে নিজের ঘরের দিকে এগুচ্ছে –
সকাতরে ঐ কাদিছে সকলে শােন শােন পিতা
কহ কানে কানে শােনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা। সুরমাকে নিয়ে আজ চোখের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। মতিন সাহেব কোন উৎসাহ বােধ করছেন না। তার ভেতর এক ধরনের অস্বস্তি বােধ হচ্ছে। তার মন বলছে লােকটিকে তাড়িয়ে দিতে হবে। অতি দ্রুত তাড়িয়ে দিতে হবে।
দু’টি খাট পাশাপাশি। হরিপ্রসন্ন বাবু এক খাটে – অন্য খাটে মিস্টার আগস্ট। রাত প্রায় দশটা বাজে। কাজের মেয়ে ঘরেই রাতের খাবার দিয়ে গিয়েছিল। খাওয়া শেষ হয়েছে। হরিবাবু কিছুই প্রায় খেতে পারেননি। সন্ধ্যা থেকেই তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এখন বেশ বেড়েছে। তার মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস ঠিকই। নিতে পারছেন — ফেলতে পারছেন না। ফুসফুসে বাতাস ক্রমেই জমা হচ্ছে।
মিস্টার আগস্ট বলল, ভাই আপনার শরীরটা কি খারাপ?
হরিবাবু হঁ–সূচক মাথা নাড়লেন। ‘নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?”
‘লুডু খেলবেন? মিতুর লুডু সেটটা আমার কাছে আছে। হরিবাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, লুডু ?
‘া লুডু। সাপ লুডু। এই খেলায় এক ধরনের উত্তেজনা আছে। উত্তেজনার কারণে – শারিরীক কষ্ট অনেকটা কমে যাবে। খেলবেন?”
‘খেলে দেখুন না। ভাল না লাগলে বন্ধ করে দেবেন।
হরিবাবু অবাক হয়ে দেখলেন লােকটা লুডু বাের্ড মেলে ধরেছে। পাগল নাকি লােকটা? তিনি শুনেছেন লােকটা গাড়ির ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল।
স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। মাথাও যে খারাপ হয়ে গেছে সে কথা তাকে কেউ বলে নি।
‘তাই খেলবেন? নিন আপনি প্রথম দান দিন। সাপ লুডুর নিয়ম জানেন তাে – – এক না উঠলে ঘুটি ঘর থেকে বেরুবে না।।
Read more