কোন কিছুতেই তার মন বসছে না। সাবেরের অসুখের এতটা যে বাড়াবাড়ি তা তিনি বুঝতেই পারেননি। ছেলের সঙ্গে ইদানীং তার যােগাযােগ নেই বললেই হয়। সাবের তাঁর ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে। এটা জানেন বলেই তিনি নিজেকে দূরে দূরে রাখেন।
তার মানে এটা না যে সাবের অসুস্থ হলেও তিনি জানবেন না। ডাক্তারের কথা শুনে তিনি বেশ বিচলিত বােধ করছেন। দুজন ডাক্তারই বললেন, ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিন।
তিনি বললেন, কেন? বেটার কেয়ার হবে। এইখানে কি বেটার কেয়ার হবে না বলতে চাচ্ছেন?
‘তা না। হবে নিশ্চয়ই তবে হাসপাতালে সব সময় হাতের কাছে ডাক্তার থাকবে।
‘প্রয়ােজন হলে এখানেও হাতের কাছে ডাক্তার রাখব। তাছাড়া আমার ছেলে নিজেও একজন ডাক্তার। রেকর্ড নম্বর পেয়ে এম.বি.বি.এস. পাশ করেছে।
‘কোন ইমার্জেন্সি হলে হাতের কাছে সবকিছু থাকবে। এই জন্যেই হাসপাতালের কথা বলা। অন্য কোন কারণ না।
‘ইমার্জেন্সি হবে এ রকম আশংকা কি করছেন? ‘হ্যা করছি। অবস্থা ভাল না।”
দুই দুয়ারী-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ
মতিন সাহেব ছেলেকে হাসপাতালে পাঠাননি। সার্বক্ষণিক সেবার জন্যে
একজন নার্স এনেছেন। ডাক্তার একজনও রাখতে চেয়েছিলেন, সাবের রাজি হয়নি। আগ্রহ এবং আনন্দের সঙ্গে বলেছে – ডাক্তার লাগবে কেন বাবা? আমি নিজেই তাে ডাক্তার। আগে সব ভুলে গিয়েছিলাম — এখন সব মনে পড়ছে। ফার্মাকোলজির বইটা হাতে নিয়ে যে কোন প্রশ্ন কর – আমি বলে দেব।
সাবেরের কথাবার্তা ঠিক সুস্থ মানুষের কথাবার্তা নয়। যে ছেলে বাবার ভয়ে অস্থির থাকতাে আজ সে বাবার সঙ্গে বন্ধুর মত গলায় কথা বলছে। স্বাভাবিক অবস্থায় এভাবে কথা বলা সম্ভব নয়।
‘বাবা, আমার সমস্যাটা কি ডাক্তাররা তােমাকে বলেছে – ?” ‘না।
‘আমাকেও বলেনি – তবে তারা সন্দেহ করছেন – চিকেন পক্স দূষিত হয়ে গ্যাংগ্রীনের মত হয়ে গেছে। তুমি কি আমার গা থেকে পচা গন্ধ পাচ্ছ?”
‘না।”
‘পচা গন্ধ পেলে বুঝতে হবে গ্যাংগ্রীন। গ্যাংগ্রীনের Causative Agents কি, বলব?
বলতে ইচ্ছে হলে বল। Clostrodium welchii, gram positive, anaerobic bacilli ... 1 আমি কিন্তু সব মুখস্থ বলে যাচ্ছি।
‘তাই তাে দেখছি।
একজন ভাল ডাক্তারের যে জিনিসটা সবচে বেশী দরকার তা হচ্ছে তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তি।
কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থেকে রেস্ট নেয়াটা বােধ হয় ভাল।
মতিন সাহেব ছেলের কাছ থেকে সরে এসে বারান্দায় বসেছেন। সাবেরের পাশে তার মা এবং নার্স মেয়েটি আছে। সুরমা অসম্ভব ভয় পেয়েছেন। নার্স মেয়েটিও ভয় পেয়েছে।
দুই দুয়ারী-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ
মিতু আবার এসে বলল, বাবা তােমার টেলিফোন। মতিন সাহেব বললেন, বল বাসায় নেই। ‘এক মিথ্যা দু‘বার বলা যায় না বাবা। মিস্টার আগস্ট বলেছেন। ‘তােমাকে যা বলতে বলেছি বল। ‘বড় আপা টেলিফোন করেছে – নিশা আপু।
মতিন সাহেব যন্ত্রের মত উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরলেন।
‘বাবা, কেমন আছ?
‘বাসার সবাই ভাল ?”
‘হ্যা।
“মিথ্যা কথা বলছ কেন বাবা ? সাবেরের তাে খুব অসুখ। ‘া ওর শরীরটা ভাল নেই।
এই খবর তােমরা আমাকে জানাওনি। ‘ভুল হয়ে গেছে।
‘এ রকম ভুল ইদানীং তােমাদের খুব ঘন ঘন হচ্ছে। তুমি একটা এ্যাকসিডেন্ট করেছিলে। একটা লােককে প্রায় মেরেই ফেলেছিলে — তাকে তুলে এনেছ। এখন সে আমাদের বাসাতেই আছে – এই খবরও দাওনি।
‘এটা তেমন কোন খবর না। ‘অবশ্যই বড় খবর। লােকটা অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে ...‘ ‘কোনই অদ্ভুত কাণ্ড করছে না। ‘মিতু বলল করছে, মন্টু মামাকে নাকি বটগাছ বানিয়ে দিয়েছে ... ‘মিতু কি বলছে – তাই বিশ্বাস করে বসে আছিস?‘ ‘মিতু তাে বাবা কখনাে মিথ্যা কথা বলে না।
‘বেশ, বাসায় এসে তাহলে তাের বটগাছ মন্টু মামাকে দেখে যা। বটগাছের নীচে বসে খানিকক্ষণ হাওয়া খেয়ে যা।
‘তুমি এমন রেগে রেগে কথা বলছ কেন বাবা?” ‘রাগ হচ্ছে বলেই রেগে রেগে কথা বলছি। ‘তুমি কি গাড়িটা পাঠাতে পারবে? ‘না। গাড়ি নিয়ে এষা সকালে বের হয়েছে, এখনও ফেরেনি।
দুই দুয়ারী-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ
মতিন সাহেব টেলিফোন রেখে আগের জায়গায় এসে বসলেন। বুঝতে পারছেন নিশার সঙ্গে কঠিন ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের ব্যবহার তিনি তার মেয়েদের সঙ্গে কখনাে করেন না। সকাল থেকেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। বেলা যতই বাড়ছে মেজাজ ততই খারাপ হচ্ছে। এখন দুপুর।
মিতু ঢুকলাে, বাবা আবার টেলিফোন। নিশা আপা ফোন করেছে। তুমি নাকি তাকে বকা দিয়েছ? সে কাদছে।
কাদুক।’
মিতু ফিরে গেল। নিশাকে বলল, বাবাকে বলেছিলাম তুমি কাঁদছ। বাবা বললেন – কাঁদুক।
সুরমা অফিসে হাজিরা দিতে গেছেন।
ব্যাংকের চাকরিতে হুট করে এ্যাবসেন্ট করা যায় না। এ.জি.এম–কে জানাতে হবে। আজকের দিন ছাড়াও আরাে দুদিন ছুটি নেবেন। তাঁর মাথায় যন্ত্রণা অন্যদিন সন্ধ্যার পর হয়, আজ শুরু হয়েছে দুপুর থেকে। সাবের তার ঘরে একা। নার্স মেয়েটি ঘরের বাইরে বারান্দায় চেয়ারে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে। মেয়েটি অসম্ভব রােগা – শ্যামলা চেহারা। সরল মুখ। চোখ দেখে মনে হয় কোন কারণে ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। বাইশ তেইশ বছর বয়স, রােগা বলেই বােধ হয় আরাে কম দেখা যায়। নার্স এর পেশায় মেয়েটি দু’বছর কাটিয়েছে – এর মধ্যেই রােগ এবং রােগী সম্পর্কে নির্বিকার ভাব চলে আসা উচিত ছিল, তা আসেনি।
মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াল। রুগীকে এন্টিবায়ােটিক খাওয়ানাের সময় হয়ে গেছে। রুগী এখন ঘুমুচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গিয়ে হলেও অষুধ খাওয়াতে হবে। এক মিনিট এদিক–ওদিক হতে দেয়া যাবে না।
সাবেরের গায়ে হাত দেয়া মাত্র সে চোখ মেলল। ‘স্যার, আপনার অষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে।
সাবের বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি আমাকে স্যার বলছেন কেন? আগেও বলব ভাবছিলাম। মনে থাকে না – আপনি নাম ধরে ডাকবেন। ভাল কথা – আপনার নাম কি?
‘হৈমন্তী। ‘বাহ, চমৎকার। হেমন্ত ঋতুতে জন্ম বলেই কি হৈমন্তী ?
Read more