‘পারছি – কিন্তু আমি যা বলছি তা সত্য। জীবাণুরা যে কোন ভাবেই হােক আমার সঙ্গে কম্যুনিকেট করতে পারছে। তােমাদের ব্যাপারটা আমি বােঝাতে পারছি না, কারণ কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার গ্রহণ করার মত মানসিক প্রস্তুতি তােমাদের নেই।
‘তুমি তাে আমাদেরই একজন। তােমার ভেতর সেই মানসিক প্রস্তুতি কি করে হয়ে গেল?”
‘মিস্টার আগস্ট আমাকে সাহায্য করেছেন। মতিন সাহেব থমথমে গলায় বললেন, সে তােমাকে জীবাণুর সঙ্গে কথা বলা শিখিয়েছে?”
‘তা – না, ব্যাপারটা কি হয়েছে আমি তােমাকে বলি – মানুষের অসুখ কি করে হয় ঐ ব্যাপারটা মিস্টার আগস্ট জানতেন না। আমি একদিন তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, পুরাে ব্যাপারটা হয় জীবাণুঘটিত নয় ভাইরাসঘটিত। তখন তিনি খুব আগ্রহ করে জানতে চাইলেন – আচ্ছা ঐ জীবাণুদের সঙ্গে যােগাযােগ করা যায় ?
ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারলে খুব সুবিধা হত। তারপর থেকে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি ...।
‘তুমি তাহলে প্রথম ব্যক্তি যে জীবাণুদের সঙ্গে কথা বলল?”
এর আগেও হয়ত কেউ কেউ করেছে – এটা তেমন কঠিন কিছু না।
এর আগে কেউ যদি করে থাকে তাহলে এতদিনে আমরা কি তা জানতে পারতাম না?
দুই দুয়ারী-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
‘না। যাদের এই সৌভাগ্য হয়েছে তারা ভেবেছে এটা এক ধরনের স্বপ্ন। এক ধরনের ভ্রান্তি। তারা নিজেরাও ঠিক বিশ্বাস করেনি, কাজেই কাউকে বলেনি।
‘তােমার ধারণা এটা স্বপ্ন বা ভ্রান্তি নয়?” ‘আমার তাই ধারণা।
‘তােমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে সাবের। তােমার ব্রেইন এখন নন ফাংশানিং।
সাবের চোখ বন্ধ করে ফেলল। দীর্ঘ সময় কথা বলার কারণে সে ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছে। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হল। মতিন সাহেব সুরমার দিকে তাকালেন। সুরমা তার ছেলের মাথার কাছে মূর্তির মত বসে আছেন। তাঁর পেছনে খাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিশা। সে পুরােপুরি হতভম্ব হয়ে গেছে। মতিন সাহেব মিস্টার আগস্টের খোঁজে বের হলেন। আগস্ট ফিরে এসেছে এবং কাঁঠাল গাছের নিচে বসে আছে এই খবর তিনি পেয়েছেন।
মতিন সাহেবকে দেখে আগস্ট উঠে দাঁড়াল। মতিন সাহেব তীব্র গলায় বললেন, আপনি কে ঠিক করে বলুন তাে?
আগস্ট শান্ত গলায় বলল, আমি কে তা আমি জানি না। জানলে অবশ্যই বলতাম।
‘আপনি জানেন না আপনি কে?
‘জ্বি না। এবং মজার ব্যাপার কি জানেন – আপনি নিজেও জানেন না আপনি কে? এই পৃথিবীর কোন মানুষ জানে না সে কে? সে কোথা থেকে এসেছে
– সে কোথায় যাবে।
দুই দুয়ারী-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
‘আপনি আমার পরিবারে যে ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করেছেন তা কি আপনি জানেন ?”
‘পুরােপুরি না জানলেও আঁচ করতে পারছি।
‘কাল সকালে সূর্য ওঠার পর এই বাড়িতে আমি আপনাকে দেখতে চাই না। আমি কি বলছি বুঝতে পারছেন?
‘পারছি। আপনি চাইলে আমি এখনাে চলে যেতে পারি! ‘এত রাতে কোথায় যাবেন ?
হাঁটতে শুরু করব, তারপর আপনার মত একজন কেউ আমাকে পাবে , .. তাঁর বাসায় কিছুদিন থাকব। তারপর ..
‘আপনার জীবন কি এই ভাবেই কাটছে?”
‘আমি জানি না। সত্যি জানি না – জানলে আপনাকে জানাতাম। কাঁঠাল গাছের নিচে বসে আমি প্রায়ই ভাবি – আমি কে? পুরানাে স্মৃতি বলে আমার কিছু নেই। আমি বাস করি বর্তমানে।। | মতিন সাহেব কঠিন গলায় বললেন, আপনি আমাকে কনফিউজ করার চেষ্টা করবেন না, আমি মন্টু না যে আপনার কথা শুনে গাছ হবার জন্য মাঠে দাঁড়িয়ে থাকব বা জীবাণুদের সঙ্গে বাক্যালাপ শুরু করব ...
‘আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন।
মতিন সাহেব শান্ত গলায় বললেন, আপনি কি দয়া করে আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন? ওকে বুঝাবেন যে জীবাণুদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা যায় না। সে যা করছে তা নেহায়েত পাগলামী …‘
‘পাগলামী তাে না–ও হতে পারে।
দুই দুয়ারী-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
তার মানে ? হয়ত সে সত্যি ওদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা আয়ত্ত করেছে।
মতিন সাহেব রাগে কাঁপছেন। তীব্র রাগে তিনি কয়েক মুহূর্ত চোখে অন্ধকার দেখলেন – একবার ইচ্ছে হল পাগলটার উপর ঝাপিয়ে পড়েন। নিজেকে সামলালেন। বাগান থেকে ঘরের দিকে রওনা হলেন। ক্লান্তিতে পা ভেঙ্গে আসছে।
মিতু এসে আগস্টকে বলল, আপনাকে খেতে ডাকছে।
আগস্ট উঠে দাঁড়াল। মিতু বলল, ডাইনিং ঘরে খাবার দিয়েছে।
আগস্ট কিছু বলল না। কাজের মেয়ে তার খাবার ঘরে দিয়ে যায়। আজ প্রথম ডাইনিং ঘরে ডাক পড়ল। শেষ খাবার বলেই বােধ হয়। আগস্ট ভেবেছিল ডাইনিং হলে অনেকেই থাকবে। দেখা গেল শুধু সে আর মিতু। এষা খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। এষার চোখ মুখ কঠিন হয়ে আছে। সে খাবারদাবার টেবিলে রাখছে যন্ত্রের মত।
আগস্ট বলল, আমি কাল ভােরে চলে যাচ্ছি। আপনাদের অনেক বিরক্ত করলাম – কিছু মনে করবেন না।
এষা উত্তর দিল না। মিতু বলল, আর আসবেন না? আগস্ট ভাত মাখতে মাখতে বলল, ভবিষ্যতের কথা তাে আমি বলতে পারি না। আসতেও পারি। হয়ত
কুড়ি, পঁচিশ বা ত্রিশ বছর পর আবার দেখা হবে।
মিতু বলল, তখন কি আপনি আমাকে চিনতে পারবেন?
‘চিনতে না পারারই কথা। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চেহারা পাল্টে যায়। তবে তুমি তােমার নাম যদি বল – আমি চিনতে পারব। মানুষের চেহারা পাল্টালেও নাম পাল্টায় না।‘
খাওয়া এগুচ্ছে নিঃশব্দে। মিতু টেবিল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এষা আগস্টের মুখােমুখি বসল। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। চুপ করে গেল। শুধু তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে।