আগস্ট বলল, আপনি কি কিছু বলতে চাচ্ছেন? বলতে চাইলে বলে ফেলুন। আর সুযােগ পাবেন না।
এষা নীচু গলায় বলল, আপনি কে আমি জানি না। জানতেও চাই না – হয়ত আপনি কেউ না, সাধারণ একজন মানুষ – কিংবা হয়ত বিশেষ ধরনের একজন মানুষ ... আপনি যেই হােন, আমি হাত জোর করে আপনার কাছে একটা অনুরােধ করব।
করুন। ‘ভাইয়ার মাথায় যে পাগলামীটা ঢুকেছে তা আপনি দূর করে দিন।
‘যাবার আগে আমি অবশ্যই তার সঙ্গে কথা বলব। তবে তাতে লাভ হবে কিনা জানি না। সে যা করেছে তা যদি পাগলামী না হয় তাহলে তা দূর করা তাে
অসম্ভব।
এষা শান্ত গলায় বলল, আমার একটি ব্যক্তিগত সমস্যাও আপনাকে বলতে চাই। বলতে ইচ্ছা করছে বলেই বলছি। আমার কোন লাভ হবে বলে বলছি না –
“বলুন। আমি খুব মন দিয়ে শুনছি।
এষা নরম গলায় বলল, একটা ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আমার ধারণা ছিল ছেলেটাকে আমি পাগলের মত ভালবাসি। এখন মনে হচ্ছে বাসি না। আবার মনে হচ্ছে বাসি। আপনি তাে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলেন
– আপনি কি এমন কিছু জানেন যা আমার মনের দ্বিধা দূর করতে পারবে?
আগস্ট শব্দ করে হাসল। এষা আহত গলায় বলল, হাসছেন কেন? ‘হাসছি – কারণ একটি মেয়ে প্রেমে পড়েছে কি পড়েনি তা জানা খুব সহজ। কোন মেয়ে যদি প্রেমে পড়ে তাহলে তার মধ্যে কিছু অলৌকিক ক্ষমতা চলে আসে। সেই মেয়ে যদি কোন কাচের পাত্রে হাত রাখে সেই পাত্র গঢ়ি নীল
বর্ণ ধারণ করে। আপনি একটি কাচের পাত্রে হাত দিয়ে দেখুন – পাত্রটি নীল হচ্ছে কিনা।
এষা চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল, শুধু শুধুই আপনার সঙ্গে কথা বললাম – আপনি উদি। এর বেশী কিছু না। আমার মনে হয় আপনাকে কোন একটা ঘরে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়েছিল। দরজা খুলে চলে এসেছেন।
দুই দুয়ারী-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ
“হতে পারে। বিচিত্র কিছু না।
সাবের ঝিম মেরে পড়ে ছিল।
রাত প্রায় তিনটা। সুরমা ছেলের পাশে শুয়ে আছেন। এতক্ষণ তিনি জেগেই ছিলেন, কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়েছেন। নার্স মেয়েটি বারন্দার চেয়ারে জেগে বসে আছে। মিস্টার আগস্টকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। রুগীর ঘরে ঢুকতে নিষেধ করতে যাচ্ছিল – কি ভেবে যেন করল না।
মিস্টার আগস্ট ঘরে ঢুকলাে। সাবেরের কপালে হাত রাখতেই সে চোখ মেলে বলল, আমি জেগে ছিলাম।
“তাই নাকি?” ‘জ্বি। জীবাণুদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। “কি কথা?
‘ওদের একটা কবিতা শুনালাম – আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে কি জানেন, ওরা কবিতা পছন্দ করে। তবে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিতে হয়। যেমন দরজা – দরজা ব্যাপারটা কি ওরা জানে না – মজার কথা না!
‘মজার কথা তাে বটেই। ‘আপনাকেও কবিতাটা শােনাই।
‘আমাকে শুনাবে কেন? আমি তাে আর জীবাণু না।”
সাবের হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই কবিতা শুরু করল –
দু‘হাতে দরজা খুলতেই দেখি তুমি
যে ব্যথা বুকের মাঝে গােপনে পুষেছি। এতােকাল ধরে, সারক্ষণ সাথী ছিল। [তােমার বিকল্পরূপে – শুধু এই ব্যথা] কি করে নামাই বলাে, তােমাকে দেখেই।
চারচোখ অপলক শুধু মেলে রাখা কারাে কোন কথা নেই, অথচ কখন। অবাক চোখের ভাষা অতিদ্রুত গতি কেড়ে নিল দুজনের প্রিয়–সম্ভাষণ
কেন যে এমন হলাে, কেন যে এমন।
মিস্টার আগস্ট বলল, জীবাণুরা আপনার এই কবিতা পছন্দ করেছে?
‘বি – ঐ যে বললাম, কয়েকটা জিনিস বুঝিয়ে দিতে হয়ছে। যেমন চার চোখে চেয়ে থাকা মানে কি, দরজা মানে কি, দু’হাত ব্যাপারটা কি? ওদের জগৎ আর আমাদের জগৎ তাে ভিন্ন।
দুই দুয়ারী-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ
তাতাে বটেই। ওরাও কি কবিতা লেখে?” ‘জিজ্ঞেস করিনি।
একবার জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন। ‘জি আচ্ছা।
‘আরেকটা কথা – আপনার মৃত্যু মানে তাে ওদেরও মৃত্যু। তা নিয়ে ওরা কি দুঃখিত না?”
‘না। ওদের জীবনটা ক্ষণস্থায়ী। স্ফুলিঙ্গের মত। উড়ে যাবে, নিভে যাবে। ওরা এই ব্যাপারটায় অভ্যস্ত।
‘আপনার সঙ্গে তাে ওদের এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়েছে – আপনার মৃত্যুতে তারা কি কষ্ট পাবে না?”
‘জিজ্ঞেস করি নি।
দেখুন না – জিজ্ঞেস করে।