ভদ্রলােক আমার সম্পর্কে খোঁজখবর করার জন্যে মধুপুর গিয়েছিলেন, কী খোজ পেলেন জানতে ইচ্ছা করছে।
মধুপুরের খবর পেলে কীভাবে? স্বপ্নে?‘ না, স্বপ্নটপ্ল না। অনুফা চিঠি দিয়েছে। কবে চিঠি পেয়েছ?” “গতকাল।
আনিস চুপ করে গেল। রানু তার নিজের চিঠিপত্রের কথা আনিসকে কখনাে
বলে না। বিয়ের পর রানু তার আত্মীয়স্বজনের যত চিঠিপত্র পেয়েছে তার কোনােটি সে আনিসকে পড়তে দেয় নি। এ নিয়ে আনিসের গােপন ক্ষোভ আছে ।
‘কি, আমাকে নিয়ে যাবে? ‘আমি আগে গিয়ে দেখি দ্রলােকের অবস্থা কেমন।
মিসির আলিকে পাওয়া গেল না। বাড়িতে তার এক ছােট ভাই ছিল, সে বলল, ভাইয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অবস্থা বেশি ভালাে না। বিলরুবিন নাইন পয়েন্ট ফাইভ। লিভার খুবই ড্যামেজড় ।
মিসির আলি হাসপাতালে এসেছেন একগাদা বই নিয়ে। তার ধারণা ছিল বই পড়ে সময়টা খুব খারাপ কাটবে না, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সে রকম হয় নি। ডাক্তাররা বই পড়তে নিষেধ করেন নি, কিন্তু দেখা গেল বই পড়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই মাথার ভেতর ভোতা এক ধরনের যন্ত্রণা হয়। যন্ত্রণা নিয়ে বই পড়ার কোনাে মানে হয় না। তবু তিনি মৃত্যু–বিষয়ক একটি বই পড়ে ফেললেন এবং মৃত্যু ব্যাপারটিতে যথেষ্ট উৎসাহ বােধ করতে লাগলেন। তার স্বভাবই হচ্ছে কোনাে বিষয় একবার মনে ধরে গেলে সে বিষয় সম্পর্কে চূড়ান্ত পড়াশােনা করতে চেষ্টা করেন।
মৃত্যু সাবজেক্টটি তার পছন্দ হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারছেন না। বইপত্র নেই। ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে কিছু থাকার কথা, কিন্তু আনাবেন কাকে দিয়ে? তাকে কেউ দেখতে আসছে না। তিনি এমন কোনাে জনপ্রিয় ব্যক্তি নন যে তার অসুস্থতার খবরে মানুষের ঢল নামবে। তা ছাড়া অসুখের খবর তিনি কাউকে জানান নি। হাসপাতালে ভর্তি হবার ইচ্ছাও ছিল না, কিন্তু ঘরে দেখাশােনার লােক নেই। কাজের মেয়েটি তিনি মধুপুর থাকাকালীন বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ভেগে গেছে। এমন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়া উপায় কী?
বিকালবেলা তার কাছে কেউ আসে না। সবারই আত্মীয়স্বজন আসে দেখতে, তার কাছে কেউ আসে না। এই সময়টা তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন এবং এখনাে মানুষের সঙ্গ পাবার জন্যে তার মন কাঁদে দেখে নিজের কাছেই লজ্জিত বােধ করেন।
আজ সারা দিন মিসির আলির খুব খারাপ কেটেছে। তাঁর রুমমেট ছাব্বিশ বছরের ছেলেটি সকাল নটায় বিনা নােটিসে মারা গেছে। মৃত্যু যে এত দ্রুত
মানুষকে ছুঁয়ে দিতে পারে তা তার ধারণাতেও ছিল না। ছেলেটা ভােরবেলায় নাশতা চেয়েছে, তার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথাবার্তাও বলেছে। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, “আজ কেমন আছ?
‘আজ বেশ ভালাে। ‘লিভার ব্যথা করছে না?” নাহ্, তবে তলপেটের দিকে একটা চাপা ব্যথা আছে।‘ ‘খুব বেশি? ‘না, খুব বেশি না। আপনি এটা কী বই পড়ছেন?”
‘এটা একটা সায়েন্স ফিকশন—“ফ্রাইডে দি থার্টিন্থ”। বেশ ভালাে বই। তুমি পড়বে?
“জ্বি–না। ইংরেজি বই আমার ভালাে লাগে না। বাংলা উপন্যাস পড়ি।।
‘কার লেখা ভালাে লাগে? এ দেশের–মানে বাংলায়, কার লেখা তােমার পছন্দ?
‘নিমাই ভট্টাচার্য।
তাই নাকি?” ছেলেটি আর জবাব না দিয়ে কারাতে থাকে। সকাল সাড়ে আটটায় বলল, এক জন ডাক্তার পাওয়া যায় কি না দেখবেন?‘ তিনি অনেকক্ষণ বােম টিপলেন, কেউ এল না। শেষ পর্যন্ত নিজেই গেলেন ডিউটি রুমে। ফিরে এসে দেখেন ছেলেটি মরে পড়ে আছে।
মৃত্যুর সময় পাশে কেউ থাকবে না, এর চেয়ে ভয়াবহ বােধহয় আর কিছু নেই। শেষ বিদায় নেবার সময় অন্তত কোনাে–একজন মানুষকে বলে যাওয়া দরকার। নিঃসঙ্গ ঘর থেকে একা-একা চলে যাওয়া যায় না। যাওয়া উচিত নয়। এটা হৃদয়হীন ব্যাপার।
এত দিন যে ছেলেটি ছিল, এখন আর সে নেই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তার সমস্ত চিহ্ন এ ঘর থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বিছানায় নতুন বালিশ ও চাদর। দিয়ে গেছে হয়তাে সন্ধ্যার মধ্যে কোনাে নতুন পেশেন্ট এসে পড়বে।
মিসির আলি সমস্ত দিন কিছু খেতে পারলেন না। বিকেলের দিকে তার গায়ে বেশ টেম্পারেচার হলাে। প্রথম বারের মতাে মনে হলাে একজন–কেউ তাঁকে দেখতে এলে খারাপ লাগবে না। ভালােই লাগবে। কেউ না এলে এক জন রােগী হলেও আসুক, একা–একা এই কেবিনে রাত কাটানাে যাবে না। ঠিক এই সময়। ইতস্তত ভঙ্গিতে রানু এসে ঢুকল।
‘আপনি ভালাে আছেন?”
না, ভালাে না। তুমি কোথেকে? বাসা থেকে। ইস! আপনার এ কী অবস্থা!‘ ‘অবস্থা খারাপ ঠিকই। আনিস সাহেব কোথায়? ‘ও আসে নি, আমি একাই এলাম । ওর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছি।‘ ‘বস তুমি। ঐ চেয়ারটায় বস। ফ্লাস্কে চা আছে। খেতে চাইলে খেতে পার। “উঁহু, চা–টা খাব না। আপনার কাছে একটা খবর জানতে এসেছি।‘ ‘কোন খবরটি?
মধুপুরে গিয়ে আপনি কী জানলেন?” ‘তেমন কিছু জানতে পারি নি।
তবু যা জেনেছেন তা–ই বলুন। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে। অনুফা। লিখেছে, আপনি নাকি হাজার–হাজার মানুষকে নানা রকম প্রশ্ন করেছেন।
মিসির আলি হাসলেন। হাসলে হবে না, আমাকে বলতে হবে।‘
‘প্রথম যে জিনিসটি জানলাম—সেটি হচ্ছে, তুমি অনেকগুলাে ভুল তথ্য দিয়েছ।‘
‘আমি কোনাে তথ্য দিই নি।
‘তুমি নিজে হয়তাে জান না সেগুলাে ভুল। যেমন পায়জামা খােলার ব্যাপারটি—এ রকম কোনাে কিছু ঘটে নি।
রানু চোখ লাল করে বলল, ‘ঘটেছে।‘
না রানু, ঘটে নি। এটা তােমার কল্পনা। তা ছাড়া তুমি উলঙ্গ একটি ডেড বডির কথা বলেছ—সেটাও ঠিক না।
‘কিন্তু আমি জানি, এগুলাে ঠিক।‘
না রানু। এইসব তুমি নিজে ভেবেছ এবং আমার ধারণা এ জাতীয় স্বপ্ন তুমি মাঝে–মাঝে দেখ। দেখ না?”
কী রকম স্বপ্নের কথা বলছেন? মিসির আলি কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন। স্পষ্ট গলায় বললেন, তুমি প্রায়ই স্বপ্ন দেখ না—এক জন নগ্ন মানুষ তােমার কাপড় খােলার চেষ্টা করছে?
রানু উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে থাকল। ‘বল রানু। জবাব দাও।‘
হা, দেখি।‘ কখনাে কি ভেবে দেখেছ এ রকম স্বপ্ন কেন দেখ?
ভাবি নি।
আমি ভেবেছি এবং কারণটাও খুঁজে বের করেছি। আজ সেটা বলতে চাই , অন্য এক দিন বলব।‘
না, আপনি আমাকে আজই বলেন।
‘মিসির আলি ফ্লাস্ক থেকে চা ঢাললেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘চা খেতে–খেতে শােন। চায়ে ক্যাফিন আছে।