লােকটি জড়সড় হয়ে বসে আছে। মিসির আলি লক্ষ্য করলেন, তার চোখের নিচে কালি পড়েছে। তার মানে রাতে ঘুমাতে পারছে না। এ রকম হওয়ার কথা নয়। মিসির আলি চিন্তিত মুখে ভেতরে ঢুকলেন। তার ফিরে আসতে অনেক সময় লাগল।
এখন বলেন, ব্যাপারটা কী?
আনিস ইতস্তত করে বলল, ভূতপ্রেত বলে সত্যি কিছু আছে?” ‘এই কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?‘
আনিস মুখ কালাে করে বলল, “অনেক রকম কাণ্ডকারখানা হচ্ছে। আমি কনফিউজড হয়ে গেছি।
অর্থাৎ এখন ভূতপ্রেত বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন? আনিস চুপ করে রইল। ‘এর কারণটা বলেন, শুনি।
নানারকম শব্দ হয় ঘরে। “তাই নাকি? আপনি নিজে শােনেন?” ‘জ্বি, শুনি। গন্ধও পাই, ফুলের গন্ধ। আপনি পান, না আপনার স্ত্রী পান?‘ রানু প্রথম পায়, তারপর আমি পাই।‘
মিসির আলি চুরুট ধরালেন। আনিস বলল, “গত রাতে ঘরের মধ্যে কেউ যেন নূপুর পায়ে হাঁটছিল।
‘এই নূপুরের শব্দ প্রথম কে শােনে? আপনার স্ত্রী? ‘জ্বি।
তারপর আপনাকে বলার পর আপনি শুনতে পান।‘ ‘জ্বি।
‘আনিস সাহেব, এটাকে বলা হয় ইনডিউসড অডিটরি হেলুসিনেশন। আপনার মন দুর্বল। আপনার স্ত্রী যখন বলেন শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, তখন আপনিও তা শুনতে থাকেন। ব্যাপারটি আপনার মনােজগতে । আসলে কোনাে শব্দ হচ্ছে।
আনিস দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, আপনি যদি একবার আসেন আমাদের বাসায়, আপনি নিজেও শুনবেন।
না ভাই, আমি শুনব না। আমি খুব শক্ত ধরনের মানুষ। খুবই যুক্তিবাদী লােক আমি।‘
‘আপনি আসেন–না এক বার । “ঠিক আছে, যাব।‘
কবে আসবেন? আজ আসতে পারবেন?‘ ‘আমি কাল–পরশুর মধ্যে একবার যাব।‘
আমাদের বাড়িঅলার খুব সুন্দর ফুলের বাগান আছে। প্রচুর গােলাপও আছে। বিকেলের দিকে গেলে সেটাও দেখতে পারবেন।
মিসির আলি কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বড় ফুলের বাগান?”
‘জি।‘
আনিস সাহেব, এমন কি হতে পারে না, বাতাসে নিচের বাগান থেকে ফুলের সৌরভ ভেসে আসে? সেই সৌরভকে আপনি একটি আধ্যাত্মিক রূপ দেন। হতে পারে? | ‘পারে, কিন্তু শব্দটা?”
‘কোনাে একটা ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। মস্তিষ্ক খুব অদ্ভুত জিনিস, আনিস সাহেব। সে আপনাকে এমন সব জিনিস দেখাতে বা শােনাতে পারে, যার আসলে কোনাে অস্তিত্ব নেই। আপনি কি উঠছেন?”
‘জ্বি।
“আচ্ছা ঠিক আছে, যান। আমার নিজেরও মাথা ধরেছে। দুটো পেরাসিটামল খেয়েছি, লাভ হচ্ছে না। জ্বরও আসছে বলে মনে হয়। শরীরটা গেছে। বেশি দিন বাঁচব না।‘
পত্রিকা খুলে নীলু অবাক হলাে। সেই বিজ্ঞাপনটি আবার ছাপা হয়েছে। কথাগুলাে এক। জিপিও বক্স নাম্বারও ৭৩। শিরােনমটিও আগের মতাে কেউ কি আসবেন?‘ এর মানে কী? নীলুর ধারণা ছিল, এই বিজ্ঞাপনটি আর কোনাে দিন ছাপা হবে না। এর প্রয়ােজন ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে না। নীলুর ইচ্ছা হলাে দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাঁদার। সে মুখ কালাে করে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারান্দায় তার জন্যে একটা বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছিল। মিসির আলি সাহেব দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন, এখানে কি আনিস সাহেব থাকেন?”
‘স্যার আপনি? আমাকে চিনতে পেরেছেন?” ‘ও ইয়ে, তুমি। আমার ছাত্রী? কোন ইয়ার?” থার্ডইয়ার স্যার। নীলু আমার নাম। নীলুফার।‘ “ও আচ্ছা। নীলুফার—তােমাদের তেতলায় আনিস সাহেব থাকেন নাকি? “জ্বি।
তার কাছে এসেছি। উঠবার রাস্তা কোন দিকে?‘ নীলু তাকে সঙ্গে করে তিনতলায় নিয়ে গেল। ‘ফেরবার পথে আমাদের বাসা হয়ে যাবেন স্যার। যেতেই হবে। ‘আচ্ছা, দেখি।‘ ‘দেখাদেখি না স্যার, আপনি আসবেন।‘
আনিস ঘরে ছিল না। রানু তাঁকে নিয়ে বসাল। সে খুবই অবাক হয়েছে। মিসির আলি বললেন, “খুব অবাক হয়েছেন মনে হচ্ছে?
‘আপনি–আপনি করে বলছেন কেন?
ও আচ্ছা, তুমি–তুমি করে বলতাম, তাই না? ঠিক আছে। এখন বল, আমাকে দেখে অবাক হয়েছ?‘
হ্যা।‘
‘খুব অবাক হয়েছ?” ‘জ্বি। আপনি আসবেন ভাবতেই পারি নি।
মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘তুমি তাে শুনেছি সব কিছু আগে বলে দিতে পার, এটি তাে পারার কথা ছিল।
রানু থেমে–থেমে বলল, আপনি লােকটি বেশ অদ্ভুত! “তাই নাকি?”
হ্যা। আপনার যুক্তিও খুব ভালাে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। ‘বিশ্বাস করলেই পার। আনিস সাহেব কখন আসবেন?”
এসে পড়বে। ‘আমাকে একটু চা খাওয়াও। আর শােন, তােমাদের একটা কাজের ছেলে। আছে নাকি? ওকে পাঠাও তাে আমার কাছে।
“ওকে কী জন্যে?”
কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব।‘
মিসির আলি : কি নাম? জিতু : জিতু মিয়া। মিসির আলি : দেশ কোথায়? জিতু : টাঙ্গাইল।
মিসির আলি : শুনলাম দুই–এক দিন আগে তুমি নাকি রাতের বেলা কি একটা দেখে ভয় পেয়েছ? জিতু : জ্বি, পাইছি। মিসির আলি : কী দেখেছ? জিতু : পাকের ঘরে এক জন মেয়েমানুষ। হাঁটাচলা করতাছে। মিসির আলি : সুন্দরী? জিতু : জ্বি, খুব সুন্দর! মিসির আলি : রান্নাঘরে তাে বাতি জ্বালানাে ছিল? জিতু : জ্বি–না।। মিসির আলি : অন্ধকারে তুমি মানুষ কীভাবে দেখলে? জিতু : নিচুপ। মিসির আলি : আমার মনে হয় জিনিসটা তুমি স্বপ্নে দেখেছ। জিতু : নিশ্রুপ। মিসির আলি : আচ্ছা জিতু মিয়া, তুমি যাও। শােন, এক প্যাকেট সিগারেট
নিয়ে এস আমার জন্যে। ক্যাপস্টান। নাও, টাকাটা নাও। | জিতু মিয়া চলে গেল। রানু ছােট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ইউনিভার্সিটির সব মাস্টাররাই কি আপনার মতাে বুদ্ধিমান?”
না। আমার নিজের বুদ্ধি একটু বেশি। আচ্ছা, এখন যে খুটখাট শব্দ শােনা যাচ্ছে, এই শব্দটার কথাই কি আনিস সাহেব আমাকে বলেন?”
রানু জবাব দিল না। মিসির আলি কান পেতে শুনলেন।
শব্দটা তাে বেশ স্পষ্ট। রান্নাঘর থেকে আসছে না?”
‘এই শব্দটার কথাই আনিস সাহেব বলেন, তাই না?‘ ‘বােধহয়। আপনি রান্নাঘর দেখবেন? আপনি যাওয়ামাত্রই শব্দ থেমে যাবে।
শব্দটা বেশির ভাগই রান্নাঘরে হয়? “জ্বি।‘
‘ইদুর–মরা কিছু বিষ ছড়িয়ে দিও, আর শব্দ হবে না। ওটা ইঁদুরের শব্দ। রান্নাঘরে খাবারের লােভে ঘােরাঘুরি করে। সে জন্যেই শব্দটা বেশি হয় রান্নাঘরে । বুঝলে?”
যুক্তিটা পছন্দ হচ্ছে না মনে হয়।‘ যুক্তি ভালােই। আরেক কাপ চা খাবেন? নাহ্, এখন উঠব। আনিস সাহেব মনে হয় আজ আর আসবেন না। না, আপনি আরেকটু বসুন। আপনাকে একটা গল্প বলব।‘ আজ আর না, রানু। মাথা ধরেছে।‘ ‘মাথা ধরলেও আপনাকে শুনতে হবে। বসুন, আমি চা আনছি। প্যারাসিটামল খাবেন?‘
“ঠিক আছে।
চা আনবার আগেই আনিস এসে পড়ল। তার অফিসে নাকি কী–একটা ঝামেলা হয়েছে। দশ হাজার টাকার একটা চেকের হিসেবে গণ্ডগােল। চেকটা। ইস্যু হয়েছে আনিসের অফিস থেকে। আনিসের চোখে–মুখে ক্লান্তি। মিসির আলি বললেন, আপনি বিশ্রামটিাম করেন। আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না। আমি রানুর কাছ থেকে একটা গল্প শুনব।‘
কী গল্প? জানি না কী গল্প । ভয়ের কিছু হবে।‘ রানু বলল, না, ভয়ের না। তুমি গােসলটোসল সেরে এসে চা খাও।
‘আমি গল্পটা শুনতে পারব না?”
নাহ্। সব গল্প সবার জন্যে না।‘
আনিসের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল । সে কিছু বলল না। বাথরুমে ঢুকে পড়ল। রানু তার গল্প শুরু করল খুব শান্ত গলায়। মিসির আলি তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে লাগলেন।
রানুর দ্বিতীয় গল্প।
আমার তখন মাত্র বিয়ে হয়েছে। সপ্তাহখানেকও হয় নি। সেই সময় এক কাণ্ড হলাে।