দেবী উপন্যাস -পর্ব-(২০)-হুমায়ুন আহমেদ

লােকটি জড়সড় হয়ে বসে আছেমিসির আলি লক্ষ্য করলেন, তার চোখের নিচে কালি পড়েছেতার মানে রাতে ঘুমাতে পারছে না। রকম হওয়ার কথা নয়মিসির আলি চিন্তিত মুখে ভেতরে ঢুকলেনতার ফিরে আসতে অনেক সময় লাগলদেবী

এখন বলেন, ব্যাপারটা কী

আনিস ইতস্তত করে বলল, ভূতপ্রেত বলে সত্যি কিছু আছে?এই কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?‘ 

আনিস মুখ কালাে করে বলল, অনেক রকম কাণ্ডকারখানা হচ্ছেআমি কনফিউজড হয়ে গেছি। 

অর্থাৎ এখন ভূতপ্রেত বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন? আনিস চুপ করে রইলএর কারণটা বলেন, শুনি। 

নানারকম শব্দ হয় ঘরেতাই নাকি? আপনি নিজে শােনেন?জ্বি, শুনিগন্ধও পাই, ফুলের গন্ধআপনি পান, না আপনার স্ত্রী পান?রানু প্রথম পায়, তারপর আমি পাই‘ 

মিসির আলি চুরুট ধরালেনআনিস বলল, গত রাতে ঘরের মধ্যে কেউ যেন নূপুর পায়ে হাঁটছিল। 

এই নূপুরের শব্দ প্রথম কে শােনে? আপনার স্ত্রী? জ্বি। 

তারপর আপনাকে বলার পর আপনি শুনতে পানজ্বি। 

আনিস সাহেব, এটাকে বলা হয় ইনডিউসড অডিটরি হেলুসিনেশনআপনার মন দুর্বলআপনার স্ত্রী যখন বলেন শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, তখন আপনিও তা শুনতে থাকেনব্যাপারটি আপনার মনােজগতে আসলে কোনাে শব্দ হচ্ছে। 

আনিস দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, আপনি যদি একবার আসেন আমাদের বাসায়, আপনি নিজেও শুনবেন। 

না ভাই, আমি শুনব নাআমি খুব শক্ত ধরনের মানুষখুবই যুক্তিবাদী লােক আমি‘ 

আপনি আসেননা এক বার ঠিক আছে, যাব‘ 

কবে আসবেন? আজ আসতে পারবেন?আমি কালপরশুর মধ্যে একবার যাব‘ 

আমাদের বাড়িঅলার খুব সুন্দর ফুলের বাগান আছেপ্রচুর গােলাপও আছেবিকেলের দিকে গেলে সেটাও দেখতে পারবেন। 

মিসির আলি কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, বড় ফুলের বাগান?” 

জি‘ 

আনিস সাহেব, এমন কি হতে পারে না, বাতাসে নিচের বাগান থেকে ফুলের সৌরভ ভেসে আসে? সেই সৌরভকে আপনি একটি আধ্যাত্মিক রূপ দেনহতে পারে? | পারে, কিন্তু শব্দটা?”

 কোনাে একটা ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছেমস্তিষ্ক খুব অদ্ভুত জিনিস, আনিস সাহেবসে আপনাকে এমন সব জিনিস দেখাতে বা শােনাতে পারে, যার আসলে কোনাে অস্তিত্ব নেইআপনি কি উঠছেন?” 

জ্বি। 

আচ্ছা ঠিক আছে, যানআমার নিজেরও মাথা ধরেছেদুটো পেরাসিটামল খেয়েছি, লাভ হচ্ছে নাজ্বরও আসছে বলে মনে হয়শরীরটা গেছেবেশি দিন বাঁচব না‘ 

পত্রিকা খুলে নীলু অবাক হলােসেই বিজ্ঞাপনটি আবার ছাপা হয়েছেকথাগুলাে একজিপিও বক্স নাম্বারও ৭৩শিরােনমটিও আগের মতাে কেউ কি আসবেন?এর মানে কী? নীলুর ধারণা ছিল, এই বিজ্ঞাপনটি আর কোনাে দিন ছাপা হবে নাএর প্রয়ােজন ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে নানীলুর ইচ্ছা হলাে দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাঁদারসে মুখ কালাে করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালবারান্দায় তার জন্যে একটা বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছিলমিসির আলি সাহেব দাঁড়িয়েতিনি বললেন, এখানে কি আনিস সাহেব থাকেন?” 

স্যার আপনি? আমাকে চিনতে পেরেছেন?ইয়ে, তুমিআমার ছাত্রী? কোন ইয়ার?থার্ডইয়ার স্যারনীলু আমার নামনীলুফারআচ্ছানীলুফারতােমাদের তেতলায় আনিস সাহেব থাকেন নাকি? জ্বি। 

তার কাছে এসেছিউঠবার রাস্তা কোন দিকে?নীলু তাকে সঙ্গে করে তিনতলায় নিয়ে গেলফেরবার পথে আমাদের বাসা হয়ে যাবেন স্যারযেতেই হবেআচ্ছা, দেখিদেখাদেখি না স্যার, আপনি আসবেন‘ 

আনিস ঘরে ছিল নারানু তাঁকে নিয়ে বসালসে খুবই অবাক হয়েছেমিসির আলি বললেন, খুব অবাক হয়েছেন মনে হচ্ছে

আপনিআপনি করে বলছেন কেন

আচ্ছা, তুমিতুমি করে বলতাম, তাই না? ঠিক আছেএখন বল, আমাকে দেখে অবাক হয়েছ?‘ 

হ্যা‘ 

খুব অবাক হয়েছ?জ্বিআপনি আসবেন ভাবতেই পারি নি। 

মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে হাসিমুখে বললেন, তুমি তাে শুনেছি সব কিছু আগে বলে দিতে পার, এটি তাে পারার কথা ছিল। 

রানু থেমেথেমে বলল, আপনি লােকটি বেশ অদ্ভুত! তাই নাকি?” 

হ্যাআপনার যুক্তিও খুব ভালাে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়বিশ্বাস করলেই পারআনিস সাহেব কখন আসবেন?” 

এসে পড়বেআমাকে একটু চা খাওয়াওআর শােন, তােমাদের একটা কাজের ছেলেআছে নাকি? ওকে পাঠাও তাে আমার কাছে। 

ওকে কী জন্যে?” 

কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব‘ 

মিসির আলি : কি নাম? জিতু : জিতু মিয়ামিসির আলি : দেশ কোথায়? জিতু : টাঙ্গাইল। 

মিসির আলি : শুনলাম দুইএক দিন আগে তুমি নাকি রাতের বেলা কি একটা দেখে ভয় পেয়েছ? জিতু : জ্বি, পাইছিমিসির আলি : কী দেখেছ? জিতু : পাকের ঘরে এক জন মেয়েমানুষহাঁটাচলা করতাছেমিসির আলি : সুন্দরী? জিতু : জ্বি, খুব সুন্দর! মিসির আলি : রান্নাঘরে তাে বাতি জ্বালানাে ছিল? জিতু : জ্বিনামিসির আলি : অন্ধকারে তুমি মানুষ কীভাবে দেখলে? জিতু : নিচুপমিসির আলি : আমার মনে হয় জিনিসটা তুমি স্বপ্নে দেখেছজিতু : নিশ্রুপমিসির আলি : আচ্ছা জিতু মিয়া, তুমি যাওশােন, এক প্যাকেট সিগারেট 

নিয়ে এস আমার জন্যেক্যাপস্টাননাও, টাকাটা নাও| জিতু মিয়া চলে গেলরানু ছােট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ইউনিভার্সিটির সব মাস্টাররাই কি আপনার মতাে বুদ্ধিমান?” 

নাআমার নিজের বুদ্ধি একটু বেশিআচ্ছা, এখন যে খুটখাট শব্দ শােনা যাচ্ছে, এই শব্দটার কথাই কি আনিস সাহেব আমাকে বলেন?” 

রানু জবাব দিল নামিসির আলি কান পেতে শুনলেন। 

শব্দটা তাে বেশ স্পষ্টরান্নাঘর থেকে আসছে না?” 

এই শব্দটার কথাই আনিস সাহেব বলেন, তাই না?বােধহয়আপনি রান্নাঘর দেখবেন? আপনি যাওয়ামাত্রই শব্দ থেমে যাবে। 

শব্দটা বেশির ভাগই রান্নাঘরে হয়? জ্বি‘ 

ইদুরমরা কিছু বিষ ছড়িয়ে দিও, আর শব্দ হবে নাওটা ইঁদুরের শব্দরান্নাঘরে খাবারের লােভে ঘােরাঘুরি করেসে জন্যেই শব্দটা বেশি হয় রান্নাঘরে বুঝলে?” 

যুক্তিটা পছন্দ হচ্ছে না মনে হয়যুক্তি ভালােইআরেক কাপ চা খাবেন? নাহ্, এখন উঠবআনিস সাহেব মনে হয় আজ আর আসবেন নানা, আপনি আরেকটু বসুনআপনাকে একটা গল্প বলবআজ আর না, রানুমাথা ধরেছে‘মাথা ধরলেও আপনাকে শুনতে হবেবসুন, আমি চা আনছিপ্যারাসিটামল খাবেন?‘ 

ঠিক আছে। 

চা আনবার আগেই আনিস এসে পড়লতার অফিসে নাকি কীএকটা ঝামেলা হয়েছেদশ হাজার টাকার একটা চেকের হিসেবে গণ্ডগােলচেকটাইস্যু হয়েছে আনিসের অফিস থেকেআনিসের চোখেমুখে ক্লান্তিমিসির আলি বললেন, আপনি বিশ্রামটিাম করেনআমার জন্যে ব্যস্ত হবেন নাআমি রানুর কাছ থেকে একটা গল্প শুনব‘ 

কী গল্প? জানি না কী গল্প ভয়ের কিছু হবেরানু বলল, না, ভয়ের নাতুমি গােসলটোসল সেরে এসে চা খাও। 

আমি গল্পটা শুনতে পারব না?” 

নাহ্সব গল্প সবার জন্যে না‘ 

আনিসের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল সে কিছু বলল নাবাথরুমে ঢুকে পড়লরানু তার গল্প শুরু করল খুব শান্ত গলায়মিসির আলি তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে লাগলেন। 

রানুর দ্বিতীয় গল্প। 

আমার তখন মাত্র বিয়ে হয়েছেসপ্তাহখানেকও হয় নিসেই সময় এক কাণ্ড হলাে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *