কেউ অবশ্যি এল না। দেখতে–দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। চিঠিরও কোনাে উত্তর নেই। লােকটি হয়তাে চিঠি পায় নি। ডাকবিভাগের কল্যাণে আজকাল তো বেশির ভাগ চিঠিই প্রাপকের হাতে পৌঁছায় না। এতে ক্ষতি যেমন হয়, লাভও তেমনি হয়। কিংবা হয়তাে এমন হয়েছে, ঐ লােক অসংখ্য চিঠি পেয়ে। পছন্দমতাে চিঠিগুলাের উত্তর দিয়েছে। নীলুর তিন লাইনের চিঠি তার পছন্দ হয় নি। সে হয়তাে লম্বা–লম্বা চমৎকার সব চিঠি পেয়েছে। ইনিয়ে–বিনিয়ে অনেক কিছু লেখা সব চিঠিতে।
দশ দিনের মাথায় নীলুর কাছে চিঠি এসে পড়ল । খুবই দামী একটা খামে চমৎকার প্যাডের কাগজে চিঠি। গােটা–গােটা হাতের লেখা । কালির রঙ ঘন কালাে। মাখন–রাঙা সে কাগজে লেখাগুলাে মুক্তার মতাে ফুটে আছে। এত সুন্দর হাতের লেখাও মানুষের হয়! চিঠিটি খুবই সংক্ষিপ্ত ।
কল্যাণীয়াসু তােমার চমৎকার চিঠি গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। একজন ব্যথিত মানুষের আবেদনে তুমি সাড়া দিয়েছ—তােমাকে ধন্যবাদ । খুব সামান্য একটি উপহার পাঠালাম। প্লীজ, নাও।
আহমেদ সাবেত উপহারটি সামান্য নয়। অত্যন্ত দামী একটি পিওর পারফিউমের শিশি ।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ
নীলু ভেবে পেল না, এই লােকটি কি সবাইকে এ রকম একটি উপহার পাঠিয়েছে? যারাই চিঠির জবাব দিয়েছে তারাই পেয়েছে? কিন্তু তাও কি সম্ভব? নাকি নীলু একাই চিঠির জবাব দিয়েছে? নীলুর বড় লজ্জা করতে লাগল। সে পারফিউমের শিশিটি লুকিয়ে রাখল এবং খুব চেষ্টা করতে লাগল সমস্ত ব্যাপার ভুলে যেতে। সে চিঠিটি কুচিকুচি করে ছিড়ে ফেলে দিল জানালা দিয়ে। কেন এমন একটা বাজে ঝামেলায় জড়াল?
কিন্তু দিন সাতেক পর নীলু আবার একটি চিঠি লিখল। একটি বেশ দীর্ঘ চিঠি । সেখানে শেষের দিকে লেখা—আপনি কে, কী করেন—কিছুই তাে জানান নি। আপনার বিজ্ঞাপনটিও দেখছি না। তার মানে কি এই যে আপনার নিঃসঙ্গতা এখন দূর হয়েছে? নীলু বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করল চিঠির জবাবের জন্যে, কিন্তু কোনাে জবাব এল না। কেন জানি নীলুর বেশ মন–খারাপ হল। আরেকটি চিঠি লেখার ইচ্ছা হতে লাগল, কিন্তু তাও কি হয়? একা–একা সে শুধু চিঠি লিখবে? তার এত কী গরজ পড়েছে?
দুপুর–রাতে আনিসের ঘুম ভেঙে গেল। হাত বাড়াল অভ্যেসমতাে। পাশে কেউ নেই। আনিস ডাকল, রানু, রানু। কোনাে সাড়া নেই। বাথরুম থেকে একটানা পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। বাথরুমে নাকি? আনিস উকি দিল বাথরুমে কেউ নেই। কোথায় গেল! আনিস গলা উঁচিয়ে ডাকল, রানু। বসার ঘর থেকে ক্ষীণ হাসির শব্দ এল । বসার ঘর অন্ধকার। রানু কি সেখানে একা–একা বসে আছে নাকি?
আনিস বসার ঘরে ঢুকে বাতি জ্বেলেই সঙ্গে–সঙ্গে বাতি নিভিয়ে ফেলল। রানু বসার ঘরে ছােট টেবিলে চুপচাপ বসে আছে। তার গায়ে কোনাে কাপড় নেই।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ
এই রানু।
কী হয়েছে? তােমার কাপড় কোথায়? ‘খুলে ফেলেছি। বড় গরম লাগছে।‘ আনিস এসে রানুর হাত ধরল। হিমশীতল হাত। একটু–একটু যেন কাঁপছে। ‘এস রানু, ঘুমুতে যাই। ‘আমার ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও।
কাল আমরা একজন ডাক্তারের কাছে যাব, কেমন? ‘কেন?‘ ‘তােমার শরীর ভালাে না রানু।। ‘আমার শরীর ভালােই আছে।
না, তুমি খুব অসুস্থ। এস আমার সঙ্গে। কাপড় পরে ঘুমুতে এস।‘
রানু কোনাে আপত্তি করল না। সঙ্গে–সঙ্গেই উঠে এল । কাপড় পরল এবং বাধ্য মেয়ের মতাে বিছানায় শুয়ে প্রায় সঙ্গে–সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। জেগে রইল আনিস। রানুর শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে। আগে তাে এ রকম কখনাে হয় নি। মিসির আলি–টালি নয়, বড় কোনাে ডাক্তারকে দেখানাে দরকার।
খুটখুট করে শব্দ হচ্ছে রান্নাঘরে। ইদুরের উপদ্রব। তবু কেন জানি শব্দটা অন্য রকম মনে হচ্ছে। যেন কেউ হাঁটছে রান্নাঘরে। থপথপ শব্দও হলাে কয়েক বার। আনিস বলল, “কে?‘ রান্নাঘরের শব্দটা হঠাৎ থেমে গেল। আনিস বলল, ‘কে? কে? মনের ভুল নাকি? আনিস যেন স্পষ্ট শুনল, রান্নাঘর থেকে কেউ–এক জন বলল, “আমি।‘ স্পষ্ট এবং তীক্ষ্ণ আওয়াজ। মেয়েলি স্বর। নাকি রানুই বলছে ঘুমের ঘােরে? এটাই হয়েছে। রানুরই গলা।
আনিস হাত বাড়িয়ে রানুকে কাছে টানল। রানু বলল, ‘হাতটা সরিয়ে নাও,
গরম লাগছে। তার মানে কি রানু জেগেছিল এতক্ষণ?
‘তুমি জেগেছিলে?” ‘া।‘ ‘আমি যখন বললাম কে কে, তখন কি তুমি বলেছ, আমি? রানু চুপ করে রইল। আনিস বলল, বল, বলেছ এ রকম কিছু? ‘হা, বলেছি।‘
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ
‘কিন্তু তুমি জবাব দিলে কেন? তােমাকে তাে কিছু জিজ্ঞেস করি নি। আমি জানতে চাচ্ছিলাম রান্নাঘরে কেউ আছে কি না।‘
রানু ফিসফিস করে বলল, আমি তাে রান্নাঘরেই ছিলাম। আমি রান্নাঘর থেকেই জবাব দিয়েছি।‘ আনিস চুপ করে গেল। বিছানায় উঠে বসে পরপর দুটি সিগারেট শেষ করল। বাথরুমে গিয়ে বাতি জ্বালিয়ে রেখে এল। রান্নাঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে এল। থাকুক, সারা রাত বাতি জ্বালানাে থাকুক। ‘রানু।
কাল তুমি আমার সঙ্গে একজন ডাক্তারের কাছে যাবে, কেমন? “ঠিক আছে, যাব।‘ ডাক্তার সাহেব যা–যা জানতে চান, সব বলবে। রানু জবাব দিল না। মনে হলাে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। শান্ত নির্বিঘ্ন ঘুম কিন্তু রান্নাঘরে আবার শব্দ হচ্ছে। আনিসের মনে হলাে সে স্পষ্ট চুড়ির টুনটুন শব্দ শুনছে। কাঁচের চুড়ির আওয়াজ। আনিস কয়েক বার ডাকল, কে, কে ওখানে? কেউ কোনাে জবাব দিল না। বাথরুম থেকে একটানা জল পড়ার শব্দ আসছে।
বাড়িঅলাকে বলতে হবে কল ঠিক করে দিতে। এক জন কাজের মানুষ রাখতে হবে। পুরুষমানুষ নয়, মেয়েমানুষ—যে রাত–দিন থাকবে। আত্মীয়স্বজন কাউকে এনে রাখলে ভালাে হত। কিন্তু আনিসের তেমন কোনাে আত্মীয়স্বজন নেই, যারা এখানে এসে থাকবে। আনিসের ঘুম এল শেষরাতের দিকে।
মিসির সাহেবের সঙ্গে তারা প্রায় দুই ঘণ্টা সময় কাটাল। রানু খুব সহজ–স্বাভাবিক আচরণ করল। এর প্রধান কৃতিত্ব সম্ভবত মিসির সাহেবের। তিনি খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে কথাবার্তা বললেন। এক পর্যায়ে রানু বলল, আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন, আমি আপনার মেয়ের বয়সী।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ
‘মেয়ের বয়সী হলে কী, আমার তাে মেয়ে নেই। বিয়েই করি নি। রানু কিছু–একটা বলতে গিয়েও বলল না। ভদ্রলােক সেটি লক্ষ্য করলেন । ‘তুমি কিছু বলতে চাচ্ছিলে?”
‘কিছু বলতে চাইলে বলতে পার।‘ ‘না, আমি কিছু বলব না।‘
মিসির সাহেব চায়ের ব্যবস্থা করলেন। চা খেতে–খেতে নিতান্তই সহজ ভঙ্গিতে বললেন, ‘আনিস সাহেব বলেছিলেন, তুমি যা স্বপ্নে দেখ তা–ই সত্যি যা স্বপ্নে দেখ তা–ই হয়?” শুধু স্বপ্ন না, যা আমার মনে আসে তা–ই হয়।‘ ‘বল কী!‘
আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না, না? ‘বিশ্বাস হবে না কেন? পৃথিবীতে অনেক অদ্ভুত ব্যাপার আছে। পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত।‘
বলতে–বলতে মিসির আলি ড্রয়ার খুলে চৌকা ধরনের চারটি কার্ড বের করলেন। হাসিমুখে বললেন, “রানু, এই কার্ডগুলিতে ডিজাইন আঁকা আছে। আমি একেকটি টেবিলের ওপর রাখব, ডিজাইনগুলি থাকবে নিচে।