আমার বিয়ে হয়েছিল শ্রাবণ মাসের ছ’ তারিখে। ঘটনাটা ঘটল শ্রাবণ মাসের চোদ্দ তারিখ। সকালবেলা আমার এক মামাশ্বশুর এসে ওকে নিয়ে গেলেন মাছ মারতে। নৌকায় করে মাছ মারা হবে। নৌকা বড় গাঙ দিয়ে যাবে সােনাপােতার বিলে।
বঁড়শি ফেললেই সেখানে বড়–বড় বােয়াল মাছ পাওয়া যায়। বর্ষাকালে বােয়ালের কোনাে স্বাদ নেই জানেন তাে? কিন্তু সােনাপােতার বােয়ালে বর্ষাকালেই নাকি সবচেয়ে বেশি তেল হয়।
দুপুরের পর থেকেই হঠাৎ করে খুব দিন–খারাপ হলাে। বিকেল থেকে বাতাস বইতে লাগল । আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম । ওরা আর ফেরে না। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হলাে প্রচণ্ড ঝড়। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল।
আমাদের বাড়িটা হচ্ছে কাঠের। কাঠের দোতলা । আমি একা–একা দোতলায় উঠে গেলাম। দোতলার কোণার দিকের একটা ঘরে আজেবাজে জিনিস রাখা হয়। স্টোররুমের মতাে। কেউ সেখানে যায়টায় না । আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাদতে শুরু করলাম। তখন হঠাৎ একটি মেয়ের কথা শুনতে পেলাম । মেয়েটি খুব নিচুস্বরে বলল—সােনাপােতার বিলে ওদের নৌকা ডুবে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই ডুবেছে। এটা শােনার পর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।
মিসির আলি বললেন, ‘এইটুকুই গল্প? ‘া ।‘ ‘গল্পের কোনাে বিশেষত্ব লক্ষ্য করলাম না।
‘বিশেষত্ব হচ্ছে, সেদিন সন্ধ্যায় ওদের সত্যি–সত্যি নৌকাডুবি হয়েছিল। এর কোনাে ব্যাখ্যা আছে আপনার কাছে?
‘আছে। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, কাজেই তােমার মনে ছিল অমঙ্গলের আশঙ্কা। অবচেতন মনে ছিল নৌকাডুবির কথা। অবচেতন মনই কথা বলেছে তােমার সঙ্গে। মানুষের মন খুব বিচিত্র রানু। আমি উঠলাম।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘একতলার নীলু নামের যে মেয়েটি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে, সে আপনার জন্যে বারান্দায় অপেক্ষা করছে। যাবার সময় ওর সঙ্গে আপনার দেখা হবে।
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, তাতে কি?
রানু বলল, নীলু এই মুহূর্তে কী ভাবছে তা আমি বলতে পারব। ওকে জিজ্ঞেস করলেই দেখবেন আমি ঠিকই বলেছি। আমি অনেক কিছুই বলতে পারি।‘
নীলু কী ভাবছে?‘ নীলু ভাবছে এক জন অত্যন্ত সুপুরুষ যুবকের কথা।‘ ‘সেটা তাে স্বাভাবিক। এক জন অবিবাহিত যুবতী এক জন সুপুরুষ যুবকের কথাই ভাবে। এটা বলার জন্যে কোনাে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দরকার হয় না, রানু।
মিসির আলি নেমে গেলেন। নীলু সত্যি–সত্যি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। সে খুব অনুরােধ করল যাতে স্যার এক কাপ চা খেয়ে যান, কিন্তু মিসির আলি বসলেন
তার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। প্যারাসিটামল কাজ করছে না। সারা জীবন তিনি এত অষুধ খেয়েছেন যে অষুধ তার ওপর এখন আর কাজ করে না। খুব খারাপ লক্ষণ।
নীলুর বাবা বারান্দায় বসেছিলেন। নীলুকে বেরুতে দেখে তিনি ডাকলেন, নীলু, কোথায় যাচ্ছ মা?‘
একটু বাইরে যাচ্ছি।‘ কিন্তু এইটুকু বলতেই নীলুর গলা কেঁপে গেল। গাল লাল হলাে। তিনি তা লক্ষ্য করলেন । বিস্মিত গলায় বললেন, বাইরে কোথায়?‘ নীলু জবাব দিল না।
কখন ফিরবে মা?‘ ‘আটটা বাজার আগেই ফিরব। “গাড়ি নিয়ে যাও।‘ ‘গাড়ি লাগবে না। তােমার কিছু লাগবে বাবা, চা বানিয়ে দিয়ে যাব?”
না, চা লাগবে না। একটু সকাল–সকাল ফিরিস মা। শরীরটা ভালাে না।‘ সকাল–সকালই ফিরব।‘
বিকেলের আলাে নরম হয়ে এসেছে। সব কিছু দেখতে অন্য রকম লাগল নীলুর চোখে। নিউ মার্কেটের পরিচিত ঘরগুলােও যেন অচেনা। যেন ওদের এক ধরনের রহস্যময়তা ঘিরে আছে।
‘কেমন আছ নীলু?”
নীলু তৎক্ষণাৎ তাকাতে পারল না। তার লজ্জা করতে লাগল । তার ভয় ছিল আজ হয়তাে সে আসবে না। প্রিয়জনদের দেখা তাে এত সহজে পাওয়া যায় না।
‘আজ তুমি দেরি করে এসেছ। পাঁচ মিনিট দেরি। তােমার তার জন্যে শাস্তি হওয়া দরকার।‘
কী শাস্তি? ‘সেটা আমরা চা খেতে–খেতে ঠিক করব। খুব চায়ের পিপাসা হয়েছে। ‘কোথায় চা খাবেন?”
‘এখানে কোথাও। আর শােন নীলু, চা খেতে–খেতে তােমাকে আমি একটা কথা বলতে চাই। খুব জরুরি কথা।‘
‘এখন বলুন। হাঁটতে–হাঁটতে বলুন।
নাহ্। এই কথা হাঁটতে–হাঁটতে বলা যায় না। বলতে হয় মুখােমুখি বসে। চোখের দিকে তাকিয়ে।‘
নীলুর কপালে বিন্দু–বিন্দু ঘাম জমল। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। সে কোনােমতে বলল, “ঠিক আছে, চলুন কোথাও বসি।
“কি বলতে চাই তা কি বুঝতে পারছ?”
নাহ। বুঝতে পারছ, নীলু। মেয়েরা এইসব জিনিস খুব ভালাে বুঝতে পারে।‘
নীলুর গা কাপতে লাগল। অন্য এক ধরনের আনন্দ হচ্ছে। অন্য এক ধরনের সুখ। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এখন আর কেউ নেই। চারিদিকে সীমাহীন শূন্যতা। শুধু তারা দুই জন হাঁটছে। হেঁটেই চলেছে । কেমন যেন এক ধরনের কষ্টও হচ্ছে বুকের মধ্যে।
ওরা একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে?” না। ‘খাও না! কিছু খাও।‘
সে বয়কে ডেকে কী যেন বলল । নীলু শুনতে পেল না। কোনাে কিছুতেই তার মন বসছে না। সব তার কাছে অস্পষ্ট লাগছে। “কি নীলু, কিছু বল। চুপ করে আছ কেন?”
কী বলব? যা ইচ্ছা বল।‘ নীলু ইতস্তত করে বলল, আপনি ঐ বিজ্ঞাপনটা আবার দিয়েছেন কেন?”
সে হাসল শব্দ করে । “দেখেছ বিজ্ঞাপনটা?”
হা।’ মন–খারাপ হয়েছে? নীলু কিছু বলল না। বল, মন–খারাপ হয়েছে? হা।
সে আবার শব্দ করে হাসল। তার পর ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, “আমি পত্রিকার অফিসে টাকা দিয়ে রেখেছিলাম। কথা ছিল প্রতি মাসে দুই বার করে ছাপবে। তােমার সঙ্গে দেখা হবার পর তার আর প্রয়ােজন ছিল না, কিন্তু সেটা বলা হয় নি। আগামী কাল বন্ধ করে দেব। এখন খুশি তাে?‘
নীলু জবাব দিল না।।
বল, এখন তুমি খুশি? এইভাবে চুপ করে থাকলে হবে না, কথা বলতে হবে। বল, তুমি খুশি?
সে আরেক দফা চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। খানিকক্ষণ দুই জনেই কোনাে কথা বলল না। বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পৃথিবী বড় সুন্দর গ্রহ। এতে বেঁচে থাকতে সুখ আছে ।
নীলু।
“তােমাকে যে কথাটি আমি বলতে চাচ্ছিলাম সেটি বলি?
বলুন।‘
“দেখ নীলু, সারা জীবন পাশাপাশি থেকেও এক সময় একজন অন্যজনকে চিনতে পারে না। আবার এমনও হয়, এক পলকের দেখায় একে অন্যকে চিনে ফেলে। ঠিক না?‘