দেবী উপন্যাস -পর্ব-(২১)-হুমায়ুন আহমেদ

আমার বিয়ে হয়েছিল শ্রাবণ মাসের তারিখেঘটনাটা ঘটল শ্রাবণ মাসের চোদ্দ তারিখসকালবেলা আমার এক মামাশ্বশুর এসে ওকে নিয়ে গেলেন মাছ মারতেনৌকায় করে মাছ মারা হবে। নৌকা বড় গাঙ দিয়ে যাবে সােনাপােতার বিলেদেবী

বঁড়শি ফেললেই সেখানে বড়বড় বােয়াল মাছ পাওয়া যায়বর্ষাকালে বােয়ালের কোনাে স্বাদ নেই জানেন তাে? কিন্তু সােনাপােতার বােয়ালে বর্ষাকালেই নাকি সবচেয়ে বেশি তেল হয়। 

দুপুরের পর থেকেই হঠাৎ করে খুব দিনখারাপ হলােবিকেল থেকে বাতাস বইতে লাগল আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম ওরা আর ফেরে নাসন্ধ্যার পর থেকে শুরু হলাে প্রচণ্ড ঝড়বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। 

আমাদের বাড়িটা হচ্ছে কাঠেরকাঠের দোতলা আমি একাএকা দোতলায় উঠে গেলামদোতলার কোণার দিকের একটা ঘরে আজেবাজে জিনিস রাখা হয়স্টোররুমের মতােকেউ সেখানে যায়টায় না আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাদতে শুরু করলামতখন হঠাৎ একটি মেয়ের কথা শুনতে পেলাম মেয়েটি খুব নিচুস্বরে বললসােনাপােতার বিলে ওদের নৌকা ডুবে গেছেকিছুক্ষণ আগেই ডুবেছেএটা শােনার পর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। 

মিসির আলি বললেন, এইটুকুই গল্প? ‘া গল্পের কোনাে বিশেষত্ব লক্ষ্য করলাম না। 

বিশেষত্ব হচ্ছে, সেদিন সন্ধ্যায় ওদের সত্যিসত্যি নৌকাডুবি হয়েছিলএর কোনাে ব্যাখ্যা আছে আপনার কাছে

আছেঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, কাজেই তােমার মনে ছিল অমঙ্গলের আশঙ্কাঅবচেতন মনে ছিল নৌকাডুবির কথাঅবচেতন মনই কথা বলেছে তােমার সঙ্গেমানুষের মন খুব বিচিত্র রানুআমি উঠলাম। 

মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেনরানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, একতলার নীলু নামের যে মেয়েটি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে, সে আপনার জন্যে বারান্দায় অপেক্ষা করছেযাবার সময় ওর সঙ্গে আপনার দেখা হবে। 

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, তাতে কি

রানু বলল, নীলু এই মুহূর্তে কী ভাবছে তা আমি বলতে পারবওকে জিজ্ঞেস করলেই দেখবেন আমি ঠিকই বলেছিআমি অনেক কিছুই বলতে পারি‘ 

নীলু কী ভাবছে?নীলু ভাবছে এক জন অত্যন্ত সুপুরুষ যুবকের কথাসেটা তাে স্বাভাবিকএক জন অবিবাহিত যুবতী এক জন সুপুরুষ যুবকের কথাই ভাবেএটা বলার জন্যে কোনাে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দরকার হয় না, রানু। 

মিসির আলি নেমে গেলেননীলু সত্যিসত্যি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলসে খুব অনুরােধ করল যাতে স্যার এক কাপ চা খেয়ে যান, কিন্তু মিসির আলি বসলেন 

তার প্রচণ্ড মাথা ধরেছেপ্যারাসিটামল কাজ করছে নাসারা জীবন তিনি এত অষুধ খেয়েছেন যে অষুধ তার ওপর এখন আর কাজ করে নাখুব খারাপ লক্ষণ। 

নীলুর বাবা বারান্দায় বসেছিলেননীলুকে বেরুতে দেখে তিনি ডাকলেন, নীলু, কোথায় যাচ্ছ মা?‘ 

একটু বাইরে যাচ্ছিকিন্তু এইটুকু বলতেই নীলুর গলা কেঁপে গেলগাল লাল হলােতিনি তা লক্ষ্য করলেন বিস্মিত গলায় বললেন, বাইরে কোথায়?নীলু জবাব দিল না। 

কখন ফিরবে মা?আটটা বাজার আগেই ফিরবগাড়ি নিয়ে যাওগাড়ি লাগবে নাতােমার কিছু লাগবে বাবা, চা বানিয়ে দিয়ে যাব?” 

না, চা লাগবে না। একটু সকালসকাল ফিরিস মাশরীরটা ভালাে নাসকালসকালই ফিরব‘ 

বিকেলের আলাে নরম হয়ে এসেছেসব কিছু দেখতে অন্য রকম লাগল নীলুর চোখেনিউ মার্কেটের পরিচিত ঘরগুলােও যেন অচেনাযেন ওদের এক ধরনের রহস্যময়তা ঘিরে আছে। 

কেমন আছ নীলু?” 

নীলু তৎক্ষণাৎ তাকাতে পারল নাতার লজ্জা করতে লাগল তার ভয় ছিল আজ হয়তাে সে আসবে নাপ্রিয়জনদের দেখা তাে এত সহজে পাওয়া যায় না। 

আজ তুমি দেরি করে এসেছপাঁচ মিনিট দেরিতােমার তার জন্যে শাস্তি হওয়া দরকার‘ 

কী শাস্তি? সেটা আমরা চা খেতেখেতে ঠিক করবখুব চায়ের পিপাসা হয়েছেকোথায় চা খাবেন?” 

এখানে কোথাওআর শােন নীলু, চা খেতেখেতে তােমাকে আমি একটা কথা বলতে চাইখুব জরুরি কথা‘ 

এখন বলুনহাঁটতেহাঁটতে বলুন। 

নাহ্এই কথা হাঁটতেহাঁটতে বলা যায় নাবলতে হয় মুখােমুখি বসেচোখের দিকে তাকিয়ে‘ 

নীলুর কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমলনিঃশ্বাস ভারি হয়ে এলসে কোনােমতে বলল, ঠিক আছে, চলুন কোথাও বসি। 

কি বলতে চাই তা কি বুঝতে পারছ?” 

নাহবুঝতে পারছ, নীলুমেয়েরা এইসব জিনিস খুব ভালাে বুঝতে পারে‘ 

নীলুর গা কাপতে লাগলঅন্য এক ধরনের আনন্দ হচ্ছেঅন্য এক ধরনের সুখমনে হচ্ছে পৃথিবীতে এখন আর কেউ নেইচারিদিকে সীমাহীন শূন্যতাশুধু তারা দুই জন হাঁটছেহেঁটেই চলেছে কেমন যেন এক ধরনের কষ্টও হচ্ছে বুকের মধ্যে। 

ওরা একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলচায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে?নাখাও না! কিছু খাও‘ 

সে বয়কে ডেকে কী যেন বলল নীলু শুনতে পেল নাকোনাে কিছুতেই তার মন বসছে নাসব তার কাছে অস্পষ্ট লাগছেকি নীলু, কিছু বলচুপ করে আছ কেন?” 

কী বলব? যা ইচ্ছা বলনীলু ইতস্তত করে বলল, আপনি বিজ্ঞাপনটা আবার দিয়েছেন কেন?

সে হাসল শব্দ করে দেখেছ বিজ্ঞাপনটা?” 

হা।’ মনখারাপ হয়েছে? নীলু কিছু বলল নাবল, মনখারাপ হয়েছে? হা। 

সে আবার শব্দ করে হাসলতার পর ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, আমি পত্রিকার অফিসে টাকা দিয়ে রেখেছিলামকথা ছিল প্রতি মাসে দুই বার করে ছাপবেতােমার সঙ্গে দেখা হবার পর তার আর প্রয়ােজন ছিল না, কিন্তু সেটা বলা হয় নিআগামী কাল বন্ধ করে দেবএখন খুশি তাে?‘ 

নীলু জবাব দিল না। 

বল, এখন তুমি খুশি? এইভাবে চুপ করে থাকলে হবে না, কথা বলতে হবে। বল, তুমি খুশি

সে আরেক দফা চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট ধরালখানিকক্ষণ দুই জনেই কোনাে কথা বলল নাবাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছেপৃথিবী বড় সুন্দর গ্রহএতে বেঁচে থাকতে সুখ আছে । 

নীলু। 

তােমাকে যে কথাটি আমি বলতে চাচ্ছিলাম সেটি বলি

বলুন‘ 

দেখ নীলু, সারা জীবন পাশাপাশি থেকেও এক সময় একজন অন্যজনকে চিনতে পারে নাআবার এমনও হয়, এক পলকের দেখায় একে অন্যকে চিনে ফেলেঠিক না?‘ 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *