আপনার কাছে নাম গােপন করেছিলাম বলে দুঃখিত। আমার নাম শরিফুল হক। আচ্ছা জনাব, যাই।
ডাকনাম ডালিম। আমাকে ডালিম নামেই বেশির ভাগ চেনে। আপনি তাহলে ডালিম কুমার ?
যুবক জবাব দিলেন না। রাধানাথ কোনাে কারণ ছাড়াই খানিকটা অস্থির বােধ করলেন। যুবক কি তার নিজের অস্থিরতা খানিকটা তাঁকে দিয়েছে। এই সম্ভাবনা আছে। মানুষ চুম্বকের মতাে। একটি চুম্বক যেমন পাশের চুম্বককে প্রভাবিত করে, মানুষও করে।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। শুক্রবার। ভােরবেলা বাংলাদেশ বেতার থেকে ডালিমের কণ্ঠ শােনা গিয়েছিল। এই যুবক আনন্দের সঙ্গে ঘােষণা করেছিল, আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী মুজিব সরকারকে এক সেনাঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করা হয়েছে। সারা দেশে মার্শাল ল’ জারি করা হলাে।
এই প্রসঙ্গ আপাতত থাক। যথাসময়ে বলা হবে। দুঃখদিনের গাথা একসঙ্গে বলতে নেই। ধীরে ধীরে বলতে হয়।
রাত আটটা।
শফিক অবন্তির পড়ার ঘরে বসে আছে। তাকে চা দেওয়া হয়েছে, সে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। অবন্তি এখনাে আসে নি। তার দাদা সরফরাজ খান একটা বই হাতে বেতের চেয়ারে বসে আছেন। শফিক কখনাে তাকে অবন্তির পড়ার ঘরে দেখে নি।
দেয়াল(পর্ব-৪)- হুমায়ূন আহমেদ
সরফরাজ বললেন, মাস্টার, তােমার ছাত্রীর পড়াশােনা কেমন চলছে? শফিক বলল, ভালাে।
সরফরাজ বললেন, গৃহশিক্ষক বিষয়টাই আমার অপছন্দ। আইন করে গৃহশিক্ষকতা উঠিয়ে দেওয়া প্রয়ােজন বলে আমি মনে করি। কেন জানাে?
জি-না।
ছাত্রছাত্রীরা গৃহশিক্ষকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। নিজেরা কিছু বুঝতে চায় না। কষ্ট করতে চায় না। আমার কথায় যুক্তি আছে না?
জি আছে।
সরফরাজ বললেন, নৈতিকতার বিষয়ও আছে। ছাত্রীরা প্রেম শেখে গৃহশিক্ষকের কাছে। তােমাকে কিছু বলছি না। তুমি আবার কিছু মনে কোরাে না। আমি ইন-জেনারেল বলছি। গৃহশিক্ষক ও ছাত্রীর প্রেম কোথায় শুরু হয় জানাে ?
শফিক অস্বস্তির সঙ্গে বলল, না।।
শুরু হয় টেবিলের তলায় পায়ে পায়ে ঠোকাঠুকি থেকে। তারপর বই লেনদেন। বইয়ের পাতার ভেতরে চিঠি।
সরফরাজ হয়তাে আরও কিছু বলতেন, তার আগেই অবন্তি ঢুকল। সে অবাক হয়ে বলল, দাদাজান, তুমি এখানে কেন ?
সরফরাজ বললেন, আমি এখানে থাকতে পারব না।
তুমি থাকবে তােমার ঘরে। মাস্টার তােকে কীভাবে পড়ায় দেখি। একেকজনের পড়ানাের টেকনিক একেক রকম। শফিকের টেকনিকটা কী জানা দরকার ।
অবন্তি বলল, কোনাে দরকার নেই। তা ছাড়া আজ আমি পড়ব না। স্যারের সঙ্গে গল্প করব।
গল্প করবি? সবদিন পড়তে ভালাে লাগে না। তখন গল্প করতে হয়।
সরফরাজ বললেন, কী গল্প করবি আমিও শুনি। শ্রোতা যত ভালাে হয় গল্প তত জমে।
অবন্তি বলল, দাদাজান, আমি একেকজনের সঙ্গে একেক ধরনের গল্প করি। তুমি ওঠো তাে।
সরফরাজ উঠে দাঁড়ালেন। অবন্তি বলল, যাওয়ার সময় দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যাবে এবং অবশ্যই বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে না।
সরফরাজ বিড়বিড় করে কিছু বললেন, পরিষ্কার বােঝা গেল না । অবন্তি শফিকের সামনে বসতে বসতে বলল, দাদাজানের স্বভাব মাছির মতাে। খুব বিরক্ত করতে পারেন।
দেয়াল(পর্ব-৪)- হুমায়ূন আহমেদ
শফিক জবাব দিল না। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় সে ব্ৰিত বােধ করছে। সে তার দুই পা যথাসম্ভব ভেতরের দিকে টেনে বসেছে। মনে করার চেষ্টা করছে—কখনাে কি অবন্তির পায়ের সঙ্গে তার পা লেগেছে ?
অবন্তি কালাে রঙের চামড়ার ব্যাগ নিয়ে বসেছে। সে ব্যাগ খুলে পারফিউমের শিশি টেবিলে সাজাচ্ছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শফিক। অবন্তি বলল, স্যার, এখানে মােলটা শিশি আছে। আপনি প্রতিটি পারফিউমের গন্ধ শুকবেন, তারপর বলবেন সবচেয়ে সুন্দর গন্ধ কোনটা, সবচেয়ে কম ভালাে গন্ধ কোনটার।
শফিক বলল, আচ্ছা ঠিক আছে।
অবন্তি বলল, আমার মােলতম জন্মদিন উপলক্ষে আমার মা ষােলটা পারফিউম পাঠিয়েছেন। তিনি জানতে চেয়েছেন কোনটার গন্ধ আমার সবচেয়ে ভালাে লাগল।
শফিক বলল, উনি নিশ্চয়ই জানতে চান নি আমার কোনটা ভালাে লাগল ।
অবন্তি বলল, উনি জানতে চান নি, কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি। আচ্ছা স্যার, আপনি কি জার্মান ভাষা জানেন ?
শফিক বলল, বাংলা ভাষাই ঠিকমতাে জানি না, জার্মান কীভাবে জানব ? কেন বলাে তাে ? | অবন্তি বলল, আমি একটা লেখা লিখেছি। আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। আমি এই লেখাটা আমার মাকে পড়াতে চাই। মা স্প্যানিশ ও জার্মান ছাড়া অন্য কোনাে ভাষা জানেন না। তিনি যখন আমাকে চিঠি লেখেন তখন সেই চিঠি কাউকে দিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে দেন। অবশ্য মূল চিঠি সবসময় সঙ্গে থাকে।
দেয়াল(পর্ব-৪)- হুমায়ূন আহমেদ
শফিক বলল, আমার পরিচিত একজন আছেন, নাম রাধানাথ। তিনি পৃথিবীর অনেক ভাষা জানেন। বিরাট পণ্ডিত মানুষ। তবে জার্মান ভাষা জানেন কি না আমার জানা নেই। আমি খোজ নেব।
অবন্তি বলল, চুপ করে বসে থাকবেন না স্যার, গন্ধ পরীক্ষা শুরু করুন। ভালাে কথা, আপনি কি বাসি পােলাও খান ? আমার জন্মদিনে একগাদা খাবার রান্না করা হয়েছে। শুধু একজন গেস্ট এসেছে, আর কেউ আসে নি। আপনাকে কি টিফিন ক্যারিয়ারে করে কিছু খাবার দিয়ে দেব ?
শফিক বলল, দাও। একটা পেন্সিল দিতে পারবে? পারব। পেন্সিল দিয়ে কী করবেন ? শফিক ইতস্তত করে বলল, তােমার একটা ছবি আঁকব। পেন্সিল পােট্রট।
আপনি পােট্রট করতে পারেন? পারি। কোথেকে শিখেছেন ? নিজে নিজেই শিখেছি। কিছু বিদ্যা আছে মানুষের ভেতর থাকে। সে নিজেও তা জানে না।
অবন্তি আগ্রহ নিয়ে পেন্সিলের সন্ধানে গেল।
শফিক কাদেরের চায়ের দোকানে বসা। টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার নিয়ে শফিক চায়ের দোকানে এসেছে। দুজনেই আগ্রহ করে নিঃশব্দে খাচ্ছে।
কালাপাহাড়কেও খাবার দেওয়া হয়েছে। সে পােলাও খাচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে আরামে মাংসের হাড় চিবাচ্ছে। কাদের বলল, ভাইজান, আপনি আজিব মানুষ।
শফিক বলল, আজিব কেন ?
খানা নিয়া আমার এইখানে চইলা আসলেন! আমি আপনের কে বলেন ? কেউ না। ভাইজান, এত আরাম কইরা অনেকদিন খানা খাই না। আমি আপনেরে দেশের বাড়িতে নিয়া যাব। গ্রামের নাম তালতলি, কেন্দুয়া থানা। আমার স্ত্রী বেগুন দিয়া টেংরা মাছের একটা সালুন রান্ধে। এমন স্বাদের সালুন বেহেশতেও নাই। আপনেরে খাওয়াব। আমার সাথে দেশের বাড়িতে যাবেন না ?
শফিক বলল, যাব।
কাদের বলল, আপনের সঙ্গে আমি ভাই পাতাইলাম । আইজ থাইকা আপনে আমার ছােটভাই। আমি খুবই গরিব মানুষ। ভাইয়ে-ভাইয়ে আবার ধনী-গরিব কী ? ঠিক না ছােটভাই ?
শফিক হাসল ।
সরফরাজ খান একদৃষ্টিতে তার হাতের কাগজের দিকে তাকিয়ে আছেন। কাগজে পেন্সিলে এক পরী আঁকা হয়েছে। পরীর নাম অবন্তি । পেন্সিলে আঁকা একটা ছবি এত সুন্দর হয়! তাও সম্ভব ? অবন্তিকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! দুষ্টুমি করে সে নিচের ঠোট সামান্য বাঁকা করে রেখেছে। তাও বােঝা যাচ্ছে। | যে মাস্টার এত সুন্দর ছবি আঁকে সে শয়তানের ঘনিষ্ঠ স্বজন ছাড়া কিছু না। ছবি আঁকা বিদ্যা দিয়ে সে নিশ্চয়ই মেয়েদের ভুলায়, এটা বােঝাই যাচ্ছে।
মেয়েদের স্বভাবই হচ্ছে হালকা জিনিস নিয়ে মাতামাতি করা। যে ছবি ক্যামেরায় তােলা যায় সেই ছবি পেন্সিলে আঁকার কিছু নেই। বদের হাড়ি।
সরফরাজ খান সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন—মাস্টারের চাকরি শেষ। পত্রপাঠ বিদায় । ছবিটাও নষ্ট করে ফেলতে হবে ।