নবনী পর্ব – ৩ হুমায়ূন আহমেদ

নবনী পর্ব – ৩

স্টেশন থেকে বর আনার জন্যে দুটা গাড়ি জোগাড় হয়েছে। ফুল দিয়ে সেই গাড়ি সাজানো হচ্ছে।ইরার বান্ধবীরা এসেছে। তারা বাসরঘর সাজাচ্ছে। কাউকে সেখানে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমার কোথাও বসার জায়গা নেই। বাবার পিঠের ব্যথা উঠেছে বলে তিনি তার ঘরে শুয়ে আছেন। আমাকে ডেকে পাঠালেন। কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন— তোর মামা এসে কি যে করবে ভাবতেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চুপি চুপি কাজ। সারতে বলেছে, এস দেখবে মচ্ছব বসে গেছে। কেউ কিছু বুঝতে চায় না। সব নির্বোধ। অন্তু না-কি ব্যান্ডপার্টি আনতে গেছে। শুনেছিস?

না।কেউ কারো কথা শুনছে না। সবাই নিজের মত কাজ করছে। এটা কি হিন্দুবাড়ির বিয়ে যে ব্যান্ডপার্টি লাগবে? তুমি ডেকে নিষেধ করে দাও।আমার নিষেধ কি কেউ শুনবে? কেউ শুনবে না। যার যা ইচ্ছা করছে। তোর বড় মামা আসার পর দেখবি গজব হয়ে যাবে। পুরোপুরি ইসলামিক কায়দায় আল্লাহু আকবর বলে আমাকে কোরবানী করে দেবে।

বড় মামা এসেছেন। ব্যান্ডপার্টিও একই সঙ্গে উপস্থিত হয়েছে। তারা এসেই তুমুল বাজনা শুরু করল। মামা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ কাণ্ডকারখানা দেখে বললেন, ঠিক আছে। বিয়েবাড়ি বিয়েবাড়ির মতাই হওয়া উচিত। চুপি চুপি বিয়ে দিলে ওরাও সন্দেহ করত। আল্লাহ যা করেন ভালর জন্যেই করেন। আল্লাহ ভরসা।

মামার এই কথাতেই বাবার পিঠের ব্যথা কমে গেল। তিনি ক্র্যাচে ভর দিয়ে নিজেই গেলেন ব্যান্ডপার্টি দেখতে। গম্ভীর গলায় বললেন, তোমরা সারাক্ষণ বাজনা বাজাবে না। বর আসার পর খানিকক্ষণ বাজাবে। ব্যস। তারপর কমপ্লিট স্টপ। মুসলমান বাড়ির বিয়ে, বাদ্য-বাজনা ভাল না। দেখি তোমাদের বাজনা কেমন একটু শুনি। স্যাম্পল শোনাও।

আমি আমার বাবাকে চিনি। বাচ্চারা যেমন ব্যান্ডপার্টি ঘিরে থাকে। তিনিও থাকবেন বাচ্চাদের সঙ্গে। তাঁর একমাত্র তফাৎ হবে তিনি কিছুক্ষণ পর পর বলবেন— ব্যান্ডপার্টি আনার বেকুবি ক্ষমার অযোগ্য। এই বাক্য বলা ছাড়া ব্যান্ডপার্টি ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাদের সঙ্গে তাঁর আর কোন তফাৎ খুঁজে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

শ্রাবণ মাসের ১৩ তারিখ রাত ১১টা দশ মিনিট আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই মুষলধারে বৃষ্টি নামল। মেয়েরা নেমে গোল বৃষ্টিতে কাদাখেলা খেলার জন্যে। উঠোন ভর্তি মেয়ে। এ তাকে কাদায় ফেলে দিচ্ছে, ও তাকে ফেলছে। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য।

বাবা এক ফাঁকে বিরক্ত গলায় ব্যান্ডপাটির লোকদের বললেন–আনন্দের একটা সময় যাচ্ছে কাদাখেলা হচ্ছে আর তোমরা চুপচাপ বসে আছ। এখর বাদ্য-বাজনা না বাজালে কখন বাজাবে? কেউ মারা যাবার পর? তোমাদের টাকা দিয়ে আনা হয়েছে কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমানোর জন্যে? যত সব ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার। বাজাও!

তুমুল বাদ্য শুরু হয়ে গেল। বাবা হৃষ্টচিত্তে কাদাখেলা দেখতে গেলেন তবে মুখ শুকনো করে বললেন, খবরদার আমার গায়ে কেউ কাদা ছিটাবে না। সব কিছুর বয়স আছে। আমার এখন কাদাখেলার বয়স না। তাছাড়া শরীর দুর্বল। পিঠে প্ৰচণ্ড ব্যথা।বাবাকে কেউ কান্দা মাখাতে গেল না। তবে তিনি যে মনেপ্ৰাণে এই জিনিসটি চাচ্ছেন তা আমরা সবাই বুঝলাম। আমি ইরাকে কানে কানে বললাম, কাউকে বল না বাবার গায়ে একটু কাদা মাখিয়ে দিক।

ইরা বলল, ছোটখালা এসে পড়বেন। তিনি খবর পেয়েছেন। খালা এলেই বাবাকে তিনি কাদায় চুবাবেন। তুমি নিশ্চিন্ত থােক।বড় মামা এসে আমাকে বললেন, খুকী তুই আমার সঙ্গে একটু আয়তো। তোর সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।বড় মামা আমাকে খুকী ডাকেন। আমি হচ্ছি। বড় খুকী। ইরা ছোট খুকী। তার নিজের চার মেয়ে। তাদেরও নাম বড় খুকী, মেজো খুকী, সেজো খুকী, ছোট খুকী।

নিরিবিলি কথা বলার কোন জায়গা নেই। মামা আমাকে ছাদে নিয়ে গেলেন। আমাদের কথা হল ছাদে উঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। ছাদে যাবার উপায় নেই। মুষল ধারে বর্ষণ হচ্ছে। সিঁড়ি অন্ধকার, তবে মামা টর্চ হাতে উঠে এসেছেন। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বললেন, বড় খুকী! তোকে কয়েকটা কথা বলা দরকার মা। বলুন।টৰ্চটা নিভিয়ে দেই। খামাখা ব্যাটারি খরচ। অন্ধকারে তোর আবার ভয় লাগবে না তো? ভয় লাগবে না।বড় মামা বাতি নিভিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। সম্ভবত কথা গুছিয়ে নিলেন।

মামা কিছু বলছেন না। টর্চ লাইটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। একবার জ্বালাচ্ছেন একবার নিভাচ্ছেন। তাঁর বোধহয় কাশিও হয়েছে। খুব কাশছেন। আমি বললাম, আপনার কি শরীর খারাপ মামা? হু। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। বোধহয় মাইগ্রেন পেইন শুরু হবে। টেনশান হলে এরকম হয়। বয়স হয়ে গেছে এখন টেনশান সহ্য হয় না। বয়সতো মা কম হল না।টেনশনের তো আর কিছু নেই মামা। বিয়ে হয়ে গেছে।হুঁ।জরুরি কি কথা যেন বলবেন?

তেমন জরুরি কিছু না। বিয়েশাদী ভাগ্যের ব্যাপার। আল্লাহ পাক যা ঠিক করে দেন। তাই হয়। জোড়া মিলানোই থাকে। আমরা খামাখাই দৌড়াদৌড়ি করি, হৈ চৈ করি। এর সঙ্গে বিয়ে ঠিক করি তার সঙ্গে ঠিক করি। নিতান্তই পণ্ডশ্রম করা হয়। যার যেখানে হবার সেখানেই হবে। তুই তোর বিয়ে নিয়ে মন খারাপ করিস না।আমি মন খারাপ করছি না মামা।

তোর আরো ভাল বিয়ে হতে পারত। হওয়া উচিত ছিল। সম্ভব হল না। চেষ্টা কম করি নাই।আমি হাসতে হাসতে বললাম, চেষ্টা করেও তো লাভ হত না। আপনিইতো বললেন, জোড়া আগেই মিলানো।মামা বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন। মনে হচ্ছে তিনি নিজের কথা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে জোড়া মিলানোর কথা বলছেন, তবে তাঁর বিশ্বাস অন্য।

বড় খুকী!

জ্বি মামা।

ছেলে দরিদ্র তবে ছেলে খারাপ না।আমি এসব নিয়ে ভাবছি না। তোমাদের যে আমি মুক্তি দিতে পারলাম এতেই আমি খুশি।আমি নিজে খাস দিলে আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করেছি। তুই সুখী হবি। সুখটাই বড় কথা। তবে সুখী হবার জেন্য চেষ্টা করতে হয়রে মা। খুব চেষ্টা চালাতে হয়।আমি চেষ্টা চালাব।

তুই বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোর উপর আমার ভরসা আছে। তোর বরও বুদ্ধিমান। তোদের অসুবিধা হবে না।মামা তুমি কি আমার সমস্যার কথা তাদের বলেছ? পরিষ্কার করে বলি নি। তবে ইঙ্গিত দিয়েছি।পরিষ্কার করে বল নি কেন? মামা আবার কাশতে লাগলেন। টর্চের আলো এদিক ওদিকে ফেলতে লাগলেন। আমি বললাম, মামা আমি কি বলব। উনাকে?

এখন বলাবলির দরকার নাই। তোদের দুজনের মধ্যে ভাব ভালবাসা হোক। তারপর বলবি। তাছাড়া দেখবি বলার দরকারও পরবে না। চল নিচে যাই। সাবধানে নামিস-সিঁড়ি পিছল। ধরা আমার হাত ধর।আমি মামার হাত ধরে সাবধানে নিচে নামছি। সিঁড়ির গোড়ায় ইরা দাঁড়িয়ে আছে। তার সুন্দর সাদা শাড়ি কাদায় মাখামাখি হয়েছে। ইরা বলল, আপা যে কজন বরযাত্রী এসেছে তাদের সবাইকে কাদায় চুবিয়ে দেয়া হয়েছে।

একজন দৌড়ে পালাতে গিয়েছিল সে নিজেই খাদে পড়ে গেছে। আমাদের কিছু করতে হয় নি। তার অবস্থাই সবচে করুণ। হি-হি-হি।বড় মামা বললেন, কাজটা ঠিক হচ্ছে না ছোট খুকী। এরা সম্মানিত মেহমান।সম্মানিত মেহমানদের অবস্থাটা একটু দেখে আসুন মামা। সম্মানিত মেহমানরা এখন মনের আনন্দেই কাদায় গড়াগড়ি করছেন। হিহিহি।

বাসরঘরে ঢুকতে ঢুকতে রাত দুটা বেজে গেল। এর মধ্যে কত সমস্যা যে হল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। বরযাত্রী একজনের মানিব্যাগ হারিয়ে গেল। ইরার এক বান্ধবীর কানের দুল খুলে পড়ে গেল। কলেজে পড়ে মেয়ে অথচ আকাশ ফাটিয়ে কান্না। এটা তার মার দুল। মা না-কি তাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলবে। আমার বড় মামার শুরু হল মাইগ্রেন পেইন। এই বিশেষ ধরনের মাথাব্যথা যে এমন পর্যায়ে যেতে পারে আমার ধারণা ছিল না।

বড় মামা মাথার যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করছেন, অন্তু প্ৰবল বেগে তাকে বাতাস করছে এই অবস্থায় আমি বাসর ঘরে ঢুকলাম। ইরার বান্ধবীরা খাট ভালমত সাজাতে পারে নি। কাগজের ফুল দিয়ে জবরজং কি বানিয়ে রেখেছে। মামা যে ভেলভেটের চাদর এনেছেন সেটা সাইজে ছোট হয়েছে। চারদিকে তোশক বের হয়ে আছে। চাদরে গোলাপ ফুল দিয়ে লিখেছে ভালবাসা। তাকালেই লজ্জা লাগে।

খাটের পাশে একটা একটা বেতের চেয়ার। রাখলই যখন দুটা বেতের চেয়ার রাখলেই পারত। একটা কেন রেখেছে? সেই বেতের চেয়ারে সে বসে। আছে। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়িয়ে আবার নিজেই লজ্জা পেল। ধাপ করে বসে পড়ল। ইরার সব বান্ধবীরা জানালার পাশে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছিল। ওরা হেসে উঠল খিলখিল করে। আমি খাটের উপর বসলাম।

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে আমি বসলাম সহজভাবেই। লজ্জায় অভিভূত হলাম না। তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও আমার লজ্জা লাগল না। আমি তাকলাম আগ্রহ নিয়ে। এই জীবন যার সঙ্গে কাটাব তাকে ভাল করে দেখতে ইচ্ছা করল। ইচ্ছাটা কি অন্যায়?

বিশেষত্বহীন চেহারার একজন মানুষ। মাথা খানিকটা নিচু করে বসে আছে। এরকম মানুষ পথে ঘাটে, ট্রেনে বাসে কত দেখি। আগ্রহ নিয়ে এদের দিকে কখনো কেউ তাকিয়ে থাকে না। যেহেতু কেউ তাকিয়ে থাকে না সেহেতু তারাও বেশ নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাটা তরমুজ কিনে সারামুখে রস মাখিয়ে খায়। রাস্তায় যেতে যেতে শব্দ করে নাক ঝাড়ে।

ঘরে আলো কম। ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় এরা একটা হারিকেন এবং একটা মোমবাতি দিয়ে গেছে। বাতাসে মোমবাতি যেভাবে কাঁপছে তাতে মনে হয় যে কোন মুহূর্তে নিভে যাবে। সে আমাকে দেখছে না। তার হয়তো লজ্জা লাগছে। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোমবাতির দিকে। এক সময় মোমবাতি নিভে গেল। সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মোমবাতি জ্বালালো।

যেন বাতি জ্বালিয়ে রাখাই তার প্রধান কাজ। ইরার বান্ধবীরা আবারও হাসছে খিলখিল করে। সে খুব লজ্জা পাচ্ছে। অসহায়ের মত তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমি হোসে ফেললাম। কেন হাসলাম নিজেই জানি না। আমি হাসি শাড়ির আঁচলে লুকানোর চেষ্টা করলাম না। মনে হয় সহজভাবে হেসে আমি মানুষটাকে অভয় দিতে চেষ্টা করলাম। সে অন্যদিকে তাকিয়ে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, তোমার মামার মাথাব্যথা কি খুব বেশি?

আমার সঙ্গে এই তার প্রথম কথা। আমি বললাম, হ্যাঁ বেশি।সে তৎক্ষণাৎ বলল, আমার এক বন্ধুর স্ত্রীরও মাইগ্রেন আছে। ওর নাম অহনা। অকুপাংচারে চিকিৎসা করিয়েছিল, এতে কমেছে।মানুষটা কথা বলে সহজ হবার চেষ্টা করছে। আমি তাকে সুযোগ করে দেবার জন্যেই বললাম, অকুপাংচার কি? যদিও আমি খুব ভাল করেই জানি অকুপাংচার কি।সে নড়েচড়ে বসল। খুব আগ্রহের সঙ্গে বলল, অকুপাংচার হল এক ধরনের চায়নীজ চিকিৎসা। সুচ ফুটিয়ে দেয়।

ব্যথা লাগে না?

লাগে, খুব অল্প।

তার কথা ফুরিয়ে গেল। সে এখন আবার তাকিয়ে আছে মোমবাতির দিকে। বোধহয় মনে-প্ৰাণে চাচ্ছে মোমবাতিটা নিভে যাক, তাহলে সে একটা কাজ পাবে, ছুটে গিয়ে মোমবাতি জ্বালাতে পারবে।আমার বলতে ইচ্ছা করছে—তুমি মোমবাতি নিয়ে এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তুমি আমার দিকে তাকাও। আমাকে এত লজ্জা পাবার কিছু নেই। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।

আসলেই মানুষটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। সে ইরার নায়ক শুভ্ৰ নয়। সে সাধারণ একজন মানুষ। অস্বস্তি, দ্বিধা এবং খানিকটা লজ্জা নিয়ে সে বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। কোন কথা পাচ্ছে না বলেই অকুপাংচার নিয়ে এসেছে। সেই বিষয়েও বেচারা বোধহয় কিছু জানে না। জানলে আরও কথা বলত।

সফিকেরও আমার সঙ্গে আসার কথা ছিল। সে হঠাৎ চলে গেল ব্যাঙ্কক।সফিক কে? যার কথা একটু আগে বললাম–অহনা। তার স্বামীর নাম সফিক। আমার ছেলেবেলার বন্ধু। আমি ওর অফিসেই কাজ করি। আমার বস।ও আচ্ছা।আমার বস শুধু না প্রতিষ্ঠানের মালিকও তবে আমার সঙ্গে ব্যবহার বন্ধুর মত। বিরাট বড়লোক। তার বাড়ি দেখলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। ছাদে সুইমিং পুল।খুব সুন্দর?

খুবই সুন্দর। মাঝে মাঝে জোছনা রাতে সুইমিং পুলের পাশে সে পার্টি দেয়। অপূর্ব লাগে।সে খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলছে। আমি লক্ষ্য করছি মানুষটার উপর আমার মায়া পড়ে যাচ্ছে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছে, তার কথা শুনতে ভাল লাগছে। শুরুতে তার চেহারা যতটা সাধারণ মনে হচ্ছিল এখন ততটা সাধারণ মনে হচ্ছে না। তার চোখ দুটা খুব সুন্দর লাগছে। মাথা ঝুকিয়ে কথা বলার ভঙ্গিও সুন্দর।

কেন এত অল্প সময়ে লোকটির উপর আমার মায়া পড়ল? এই মায়ার উৎস কি? এই ব্যাপারটা কি সব মেয়ের ক্ষেত্রেই ঘটে, না শুধু আমার বেলায় ঘটল? এই লোকটির সঙ্গে বিয়ে না হয়ে অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে হলে তার উপরও কি এত দ্রুত মায়া পড়ে যেত। তার চোেখও কি সুন্দর লাগত?

মোমবাতি আবার নিভে গেছে। সে উৎসাহের সঙ্গে আবার ছুটে গেছে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে তার মোমবাতি জ্বালানো দেখছি। দেয়াশলাইয়ের কাঠি বার বার নিভে যাচ্ছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের এখানে খুব বাতাস। তোমাদের বাড়িটা কি দক্ষিণমুখী? না।

তোমাদের এদিকে বোধহয় খুব বৃষ্টি হয়।হ্যাঁ খুব বৃষ্টি।যে ভাবে বৃষ্টি হচ্ছে, শিওর বন্যা হবে।দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। সে আমার দিকে তাকালো। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। কি আশ্চর্য! ছোটখালা। অতিথিপুর থেকে ছোটখালা চলে এসেছেন। তিনি খবরই পেলেন। কিভাবে, এলেনই বা কিভাবে?

ছোটখালার হাতে ট্রে। ট্রেতে দুকাপ চা। ছোটখালা হাসি মুখে বললেন–চা দেয়ার অজুহাতে জোর করে ঢুকে পড়লাম। ও নবনী, তোর বরের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দে।আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, উনি আমার ছোটখালা। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ।সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পা ছুঁয়ে সালাম করল।

ছোটখালা বললেন, ও নবনী, তোর বর যে আমাকে সালাম করল— আমি খালি হাতে এসেছি। যাই হোক, দেখি সকালে ব্যবস্থা করা যায় কি-না। তোরা দু জন দু মাথায় বসে আছিস কেন? বাবা, তুমি নবনীর পাশে গিয়ে বস। ছোটাছুটি করে মোমবাতি জ্বালাতে তোমাকে কে বলেছে? চা খেয়ে মোমবাতি হারিকেন দুটাই নিভিয়ে প্রাণভরে গল্প কর। মেয়েরা সব জানালায় ভিড় করে আছে। বাতি নিভিয়ে দিলে কিছু দেখা যাবে না। ওরা ভিড় কমাবে। বুঝতে পারছি?

 

Read more

নবনী পর্ব – ৪ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *