নলিনী বাবু B.Sc. পর্ব – ১ হুমায়ূন আহমেদ

নলিনী বাবু B.Sc. পর্ব – ১

কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ

কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ।

সংসারোহয় মতিব বিচিত্রঃ।

কস্য ত্বং বা কুত আয়াতঃ।

তত্ত্বৎ চিন্তায় তদিদং ভ্রাতঃ ॥

কে তোমার স্ত্রী এবং কে তোমার পুত্র?

এই সংসারের ব্যাপার অতিশয় বিচিত্র।

তুমি কাহার এবং কোথা হইতেই বা আসিয়াছ,

হে ভ্রাতঃ! এই নিগূঢ় তত্ত্ব চিন্তা কর।

ভূমিকা

বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখতে আমার ভালো লাগে। সম্পর্কের গল্পের পাশাপাশি, সম্পর্কের বাইরের গল্প, ভূত-প্রেত, অশরীরী, ভিনগ্রহের মানুষ এইসব। আমাকে হাবিজাবি লেখক অবশ্যই বলা যেতে পারে।

নলিনী বাবু B.Sc.তে আমাদের অতি পরিচিত কাঠামোর মোড়কে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অদেখা ভুবনের গল্প বলতে চেয়েছি। সালভাদর দালি নিশি স্বপ্নকে ছবিতে নিয়ে এসেছেন, আমি চেষ্টা করেছি নিশি স্বপ্ন গদ্যে নিয়ে আসার। তবে এই রচনা অবশ্যই সুররিয়েলিস্টিক রচনা না। সুররিয়েলিস্টিক জগতের ছায়ায় রিয়েলিস্টিক রচনা।

আমি কি বলতে চেয়েছি তা কি বুঝাতে পেরেছি? মনে হয় না। যাই হোক, কি আর করা। চেষ্টা তো করেছি।

নলিনী বাবু B.Sc.র জগতে সবাইকে নিমন্ত্রণ।

হুমায়ূন আহমেদ

নুহাশ পল্লী, গাজীপুর

১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০

‘আমি নীলগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলের বিএসসি শিক্ষক’ বলেই ভদ্রলোক আমার পা ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়ালেন। আমি খপ করে তার হাত ধরলাম। বয়স্ক একজন মানুষ, মাথার সব চুল ধবধবে সাদা। তিনি আমার পা স্পর্শ করবেন কেন? পা ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটা এমনিতেই আমার অপছন্দ।

আমার নাম নলিনী ভট্টাচার্য।

আপনি বসুন। বিশেষ কোনো কাজে কি এসেছেন?

আজ্ঞে না। আমি লেখক দেখতে এসেছি।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, ভালো করে লেখক দেখুন। আমিও আপনাকে দেখি।

ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি। বেঁটেখাটো মানুষ। বড় বড় চোখ। চোখের মণিতে বিস্ময়বোধ। ব্রাহ্মণরা বেশিরভাগ সময় গৌরবর্ণের হন। ইনার গায়ের রঙ কালো। ভদ্রলোকের বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি পাঞ্জাবির সঙ্গে ধুতি পরেছেন। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় ধুতি ছেড়ে দিয়েছে। দুর্গাপূজার সময় কিছু ধুতি পরা মানুষ দেখা যায়। ধুতি নিয়ে তাদের খানিকটা সংকোচিত এবং বিব্রতও মনে হয়।

নলিনী ভট্টাচার্যের পোশাকের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি ধুতির সঙ্গে জুতা-মোজা পরেছেন। জুতা জোড়া বেশ ভারী এবং ধুতির সঙ্গে যাচ্ছে না।আপনি কি সবসময় জুতা পরেন? পরি।অস্বস্তি লাগে না? নলিনী বাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, অস্বস্তি লাগবে কেন? আমি বললাম, আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ। গরুর প্রতি ভক্তি আপনাদের মজ্জাগত। গরুকে দেবতার মতো দেখা হয়। দেবতার চামড়ায় বানানো জুতা পরতে অস্বস্তি লাগার কথা।নলিনী বাবু বিব্রত গলায় বললেন, আপনি এই কথা প্রথম বললেন। আমি এর আগে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি। বাকি জীবন আমি আর জুতা পরব না। আপনাকে, কথা দিচ্ছি।

ভাই আমি কথার কথা বলেছি। আপনি সত্য ভাষণ করেছেন।ভদ্রলোকের বিব্রত ভাব দেখে নিজেই লজ্জা পেলাম। মানুষকে বিব্রত করা আমার স্বভাবের মধ্যে নেই। তারপরও এ ধরনের কাজ আমি প্রায়ই করি। অপরিচিত মানুষ, যারা প্রথমবার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, তাদের সঙ্গেই বেশি করি মাসখানেক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র এসেছিল। সে কিছু কবিতা লিখেছে, আমাকে দেখাতে এসেছে। আমি বললাম, আমি গদ্য লেখক, কবিতা বুঝি না।

সে বিনয়ী গলায় বলল, না বুঝলেও পড়ে দেখুন।

আমি বললাম, তোমার নাম কী?

সে বলল, যূপকাষ্ঠ।

ছদ্মনাম?

জি স্যার।

ছদ্মনাম কেন?

কবি হিসেবে আসল নামটা যায় না।

আসল নাম কী?

আহম্মদ মিখাইল। ফেরেশতা মখাইল (আঃ) এর নামে নাম।আমি বললাম, যুপকাষ্ঠের চেয়ে আহম্মদ মিখাইল নাম অনেক সুন্দর। তারপরও ফেরেশতার নামের সঙ্গে মিলিয়ে মানুষের নাম হওয়া ঠিক না।কেন স্যার? মানব সম্প্রদায়ের অবস্থান ফেরেশতাদের অনেক উপরে। ফেরেশতাদের যে প্রধান তাকে বলা হয়েছিল মানুষকে কুর্নিশ করতে। জানো না? জানি স্যার।শোনো যূপকাষ্ঠ বাবু, তুমি বিদায় হও।ছেলেটা লজ্জা পেয়ে চলে যাওয়ার পর মনটা খুবই খারাপ হলো। এই ব্যবহারটা না করলেও হতো। কেন এ রকম করি?লেখক হিসেবে আমার মধ্যে কি অহঙ্কার দানা বাঁধতে শুরু করেছে? না-কি পুঁটি মাছ হয়ে যাচ্ছি? প্রকাণ্ড রুই মাছ গভীর পানিতে বাস করে। চলনে ধীরস্থির। পুঁটি মাছ গণ্ডুষ পানিতেও ফরফর করে। সংস্কৃত বলে ফরফরায়তে–

গণ্ডুষ জল মাত্রেন

সফরি ফরফরায়তে।

যা-ই হোক, নলিনী বাবুর কাছে ফিরে যাই। তিনি পকেট থেকে পানের ছোট্ট বাহারি কৌটা বের করে পান মুখে দিয়েছেন। জর্দার গন্ধ আসছে। আঙ্গুলের ডগায় চুন নিয়ে বসে আছেন। মনে হচ্ছে ভদ্রলোক পানবিলাসী। আমি বললাম, আপনার লেখক দেখা শেষ হয়েছে? তিনি জবাব দিলেন না। সুন্দর করে হাসলেন। আমি বললাম, আপনি আমার কয়টা বই পড়েছেন?

তিনি বললেন, একটা। আমি কোনো লেখকের একটার বেশি বই পড়ি। আপনার পড়েছি মিসির আলি। শরৎবাবুর চরিত্রহীন, যাযাবরের দৃষ্টিপাত। রবিবাবুর নৌকাডুবি পড়া শুরু করেছিলাম, একত্রিশ পৃষ্ঠা পড়ার পর বইটা চুরি হয়ে গেল। বাকিটা পড়া হয় নাই।আমি বললাম, সব লেখকের একটা করে বই পড়েন কেন? তিনি বললেন, হাঁড়ির ভাত সিদ্ধ হয়েছে কি না জানার জন্য সব ভাত টিপতে হয় না। একটা ভাত টিপলেই হয়।আমার ভাত কি সিদ্ধ হয়েছে?

নলিনী বাবু জবাব দিলেন না। তবে তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো আমার ভাত সিদ্ধ হয়নি। চক্ষুলজ্জায় বলতে পারছেন না। আমি বললাম, ভাই আমার একটু কাজ আছে। আপনি আরেক দিন আসুন, তখন কথা হবে।নলিনী বাবু বললেন, আপনি ভদ্রভাবে আমাকে বিদায় করতে চাচ্ছেন সেটা বুঝতে পারছি। একটা ছোট্ট রসিকতা করে চলে যাব। আগে না শুনে থাকলে মজা পাবেন। অঙ্কের ক্লাসে ছাত্রদের বিনোদন দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে রসিকতা করি। তারা হো হো করে হাসে। খুবই মজা লাগে। একটা বলব?

বলুন।এক লোক জীবনে প্রথম ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছে। সে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করল, বলটা নিয়ে ওরা কী করছে? পাশের জন বলল, গোল করার চেষ্টা করছে। সে বিস্মিত হয়ে বলল, বলটা তো গোলই আছে। আর কিভাবে গোল করবে? নলিনী বাবুগল্প শেষ করে বললেন, জোকটা বেশ হাসির, যে শুনে সেই হাসে কিন্তু আপনি হাসেননি। আগে শুনেছেন।আমি বললাম, আগে শুনিনি। বিরক্ত মানুষ হাসে না। মনে হয় আমি বিরক্ত।আমার উপর বিরক্ত?

আপনি ছাড়া তো আর কেউ নেই যে তার উপর বিরক্ত হব।মানুষ অনেক সময় নিজের উপরে বিরক্ত হয়।আমি নিজের উপর না, আপনার উপর বিরক্ত। এই সময় আমি লেখালেখি করি। আপনার কথায় ভাত হাঁড়িতে সিদ্ধ করি। ভাত সিদ্ধ করার কাজে বাধা পড়লে বিরক্ত হই।নলিনী বাবু বললেন, আপনার জন্য কিছু মাছ এনেছিলাম। ঘরে ঢুকাইনি। বারান্দায় রেখেছি। গৃহিনীকে মাছগুলো দিয়ে চলে যেতাম।আমি বললাম, স্ত্রীর সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আমি এখন একা বাস করছি।ছাড়াছাড়ি হবার কারণটা কি জানতে পারি?

আমি বিরক্ত গলায় বললাম, না।

এতবড় বাড়িতে একা থাকেন?

হ্যাঁ।

নিজের বাড়ি, নাকি ভাড়া?

ভাড়া (তখন উত্তরায় এক বাড়ি ভাড়া করে থাকি)।

ভাড়া কত দেন?

কুড়ি হাজার টাকা।

ইলেকট্রিসিটি, পানির বিল সব কি এর মধ্যে?

না, ইউটিলিটি আলাদা।

আপনার পাচক ছেলেটিকে ভাকুন তাকে মাছগুলো বুঝিয়ে দেই। পদ্মার দুটি ইলিশ আছে, মিঠাপানির গলদা চিংঙি আছে। টেংরা আছে। সবই আমি নিজে দেখেশুনে কিনেছি। কোনটা কিভাবে রাঁধতে হবে পাচককে বুঝিয়ে বলে দেই।আমি হতাশ গলায় বললাম, আমি এই বাড়িতে নতুন উঠেছি। আমার কোনো পাচক বা কাজের ছেলে এখনও জোগার হয়নি।আপনি খাওয়া-দাওয়া করেন কোথায়? একটা হোটেলের সঙ্গে ব্যবস্থা করা আছে, ওরা দুবেলা খাবার দিয়ে যায়।নলিনী বাবু বললেন, মাছগুলো ফ্রিজে রেখে যাই। তবে টাটকা খাওয়া আর ফ্রিজের বাসি খাওয়া আকাশ-পাতাল ফারাক হবে।

আমি বললাম, ফ্রিজ এ বাড়িতে নেই। ভাই কিছু মনে করবেন না। আপনার পেছনে আমি অনেক সময় নষ্ট করেছি। আর করব না। মাছগুলো নিয়ে আপনি চলে যান।নলিনী বাবু উঠে দাঁড়ালেন এবং আবার বসে পড়তে পড়তে বললেন, আপনার জন্য মাছ কিনেছি। আমি কীভাবে নিয়ে যাব? আপনার যে বইটা পড়েছি সেখানে লেখা ধোপখোলার বাজারের পদ্মার ইলিশ, মিঠাপানির গলদা চিংড়ি আর টেংরা মাছের কথা। আমি ধোপখোলার বাজার থেকেই মাছগুলো কিনেছি। আমি বিত্তবান কেউ না। সামান্য শিক্ষক। মাছ কিনতে আমার অর্থ ব্যয় হয়েছে। আপনি লেখক মানুষ। আপনার বোঝার কথা।

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করাটাই বোকামি হয়েছে। গেটে দারোয়ানকে দিয়ে বলে পাঠালেই হতো, আমি অসুস্থ, কারও সঙ্গে দেখা করছি না।নলিনী বাবু বললেন, আমি আপনাকে একটা ভালো প্রস্তাব দিচ্ছি। ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করুন। মাছ আমি বেঁধে দিয়ে যাই। আমি একজন ভালো পাচক। বিবাহ করিনি। নিজের রান্না নিজেকেই করতে হয়। গাইতে গাইতে যেমন গায়েন, বাঁধতে রাঁধতে রাঁধুনি।আমি বললাম, রান্না কিভাবে করবেন? মসলাপাতি কিছুই নেই। হাঁড়িপাতিলও নেই।নলিনী বাবু বললেন, যা যা প্রয়োজন আমি সবই সংগ্রহ করব। আপনি শুধু অনুমতি দিন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সামান্য আবদার।

আমি যতটুক বিরক্ত হওয়া সম্ভব ততটুকু বিরক্ত হয়েই লেখার টেবিলে বসলাম। রূপার পালংক নামে একটা উপন্যাসের শেষ কয়েকটি পাতা আজই শেষ করার কথা। প্রকাশককে সন্ধ্যাবেলায় আসতে বলেছি। এখন মনে হচ্ছে শেষ করতে পারব না। তারপরও লেখার টেবিলে কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম। তখন নলিনী বাবু উঁকি দিলেন।কোন চাল আপনার পছন্দ? নাজিরশাল আনব, নাকি মিনিকেট? আমি বললাম, যা ইচ্ছা আনুন, তবে টাকা দিচ্ছি নিয়ে যান। নিজের পকেট থেকে একটা পয়সাও খরচ করবেন না। গ্যারাজে গাড়ি আছে। গাড়ি নিয়ে যান। ড্রাইভারের নাম আলি হোসেন।আপনার গাড়ি আছে? হ্যাঁ আছে।বলেন কী? এত বিস্মিত হচ্ছেন কেন? ঢাকা শহরের চল্লিশ ভাগ মানুষের গাড়ি আছে।গাড়ি কত দিয়ে খরিদ করেছেন?

মনে নাই। ভাই এখন যান তো, আর বিরক্ত করবেন না।ঘড়ি দেখলাম। একটা বাজে। কখন বাজার আসবে, কখন রান্না হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি বাইপাসের রোগী। দুপুরে যথাসময়ে খাওয়া-দাওয়া করে আমাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে হয়। ব্যাধির কারণে জীবনে খানিকটা যান্ত্রিকতা চলে এসেছে। আজ মনে হয় সমস্ত রুটিন এলোমেলো হবে।আমি দেড়টা পর্যন্ত লেখালেখি করলাম। ঠিক দেড়টায় টিফিন ক্যারিয়ারে করে হোটেল থেকে খাবার চলে এলো। খেয়ে শোবার ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। সদর দরজা খোলা থাকল যাতে নলিনী বাবু ঘরে ঢুকতে পারেন।

দুপুরের ঘুম আমার কখনোই ভালো হয় না। আজ কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। এই জাতীয় ঘুমের একটা নাম আছে–মরণ ঘুম। অতলে তলিয়ে যাওয়া। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যা পার করে, ঝুম বৃষ্টির শব্দে। এবারের আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হয়নি বললেই চলে। আজ ঢাকা শহর ভাসিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। অনেক দিন পর বর্ষাযাপন করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্ষাযাপন একা করা যায় না। অতিপ্রিয় কাউকে পাশে লাগে। এই মুহূর্তে আমার অতিপ্রিয় কেউ নেই। অতি বিরক্তিকর মানুষ অবশ্যি এই মুহূর্তে একজন আছেন, নলিনী বাবু। রান্নাঘর থেকে তার খুটখাট শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মনে হয় রান্না শুরু হয়েছে। মশলা বাটার আওয়াজ আসছে। কি আশ্চর্য, ভদ্রলোক মশলা বাটছেন নাকি?

ঝুম বৃষ্টির সময় আমি অবধারিতভাবে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান শুনি। আজ তা সম্ভব হচ্ছে না। ঘরে গান শোনার যন্ত্রপাতি নেই। অভ্য পারিবারিক জীবন থেকে ছিটকে পড়েছি। এখনো গুছিয়ে উঠতে পারিনি। গুছাতে পারব বলেও মনে হচ্ছে না।ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। নলিনী বাবু একটা জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে ঢুকলেন। ঘরে মোমবাতি থাকার কথা না। মনে হয় তিনিই কিনে এনেছেন।নলিনী বাবু বললেন, বাজার করতে দেরি হয়েছে। পছন্দের জিনিস কিছুই পাইনি। ভালো শিলপাটা কেনার জন্য যেতে হয়েছে পুরান ঢাকায়। হার্ডওয়্যারের দোকানে যা পাওয়া যায় সবই বেলেপাথরের। তবে খুঁজে পেতে যেটা পেয়েছি, সেটা অসাধারণ। একশ বছর টেকার জিনিস।

আমি বললাম, আমরা কেউ থাকব না। শিলপাটা একশ বছর টিকে থাকবে, তাতে লাভ কি? আপনার পরের বংশধররা ব্যবহার করবে। প্যাকেটের মসলার সঙ্গে বাটা মসলার তফাৎটা শুধু তাদের ধরিয়ে দিতে হবে।মসলা কি আপনি বাটবেন? হুঁ।আপনার ফ্রেশ মাছ নষ্ট হয়ে যায়নি? আজ্ঞে না। মাছগুলো আপনার নিচতলার ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলার ফ্রিজে রেখে গিয়েছিলাম। বিনিময়ে তাকে একটি ইলিশ মাছ আর তিনটি গলদা চিংড়ি দিয়েছি।তিনি রেখেছেন? হ্যাঁ, রেখেছেন। খুশি হয়েই রেখেছেন। ফ্রেশ মাছের মর্যাদা গৃহিণীদের মতো কেউ বোঝে না। স্যার কি চা খাবেন? এক কাপ চা করে দেব?

দিন।রাত নয়টার মধ্যে খাওয়া তৈরি হয়ে যাবে। নটা পর্যন্ত কষ্ট করে ক্ষুধা সহ্য করতে হবে।ঠিক আছে। সহ্য করব।আপনি বদ্ধঘরে বসে না থেকে বারান্দার চেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখুন। আপনারা লেখক মানুষ, বৃষ্টি, ঝড় এসবই তো আপনাদের পছন্দ। শরবাবু আরাম কেদারায় শুয়ে বৃষ্টি দেখতেন। আপনার এই বাসায় কোনো আরাম কেদারা দেখলাম না। আমাদের নীলগঞ্জে হাকিম নামে খুব ভালো একজন কাঠমিস্ত্রি আছে। তাকে দিয়ে আমি আপনার জন্য একটা আরাম কেদারা বানিয়ে দেব। চা কি দুধ চা হবে, না লেবু চা? দুধ, লেবু সবই নিয়ে এসেছি। একটা জিনিস শুধু পাইনি, পোস্তদানা। পোস্তদানা দিয়ে গলদা চিংড়ি রান্নার শখ ছিল। দেখি পরের বার।

আমি দীর্ঘ নিশ্বাস চাপার চেষ্টা করলাম। এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে। নলিনী বাবু আবারও আসবেন।রাতে খেতে বসলাম। নলিনী বাবু আমার সামনে আসনপিড়ি হয়ে বসে পান চিবুতে লাগলেন। তিনি একাহারি। সকাল এগারোটার দিকে একবার খান। সারাদিন পান ছাড়া কিছু খান না। রাতে এক কাপ দুধ খেয়ে ঘুমুতে যান।দিনের পর দিন হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাচ্ছি। খাওয়া ব্যাপারটার ওপরই অভক্তি উঠে গিয়েছিল। অনেক দিন পর যা মুখে দিচ্ছি অমৃতের মতো লাগছে। নলিনী বাবু বললেন, পৃথিবীতে তিন ধরনের খাবার আছে—

রাজসিক

তামসিক

সাত্ত্বিক

রাজা-মহারাজারা যেসব খাবার খান সেটা রাজসিক। ভোগী মানুষের খাবার হলো তামসিক। মাংসপ্রধান খাবার, সঙ্গে অনুপান হিসেবে মদ্য। আপনি যে খাবার খাচ্ছেন তা হলো সাত্ত্বিক। শুদ্ধ খাবার। সাধু পুরুষরা খান।আমি যতদূর জানি সাত্ত্বিক খাবার হয় নিরামিষ। মাছ সেখানে থাকার কথা না।নলিনী বাবু জিভে কামড় দিয়ে বললেন, আপনার কথা ঠিক। আপনি লেখক মানুষ। আপনি তো জানবেনই! অপরাধ ক্ষমা করবেন।আমি বললাম, আপনি সব লেখকদের একটা করে বই পড়েছেন, বিভূতিভূষণের কোনো বই পড়েছেন?

দৃষ্টি প্রদীপ পড়েছি।উনার একটা উপন্যাসের নাম আদর্শ হিন্দু হোটেল। সেই হোটেলে তিনি একজন রন্ধনশিল্পীর গল্প বলেছেন। আপনার উচিত স্কুলের মেয়েদের অঙ্ক না শিখিয়ে একটা হোটেল দেয়া।নলিনী বাবু বললেন, আমি এক-দুইজনের জন্য রাঁধতে পারি। বেশি মানুষের জন্য পারি না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *