নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব-১৩)

যাই। সিগারেটটা শেষ করে নিই। পরী কী করছে জান? লীনাপান্না, তার দু বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মাঝে মাঝে অবিকল গরুর মতাে গলায় চিৎকার করে কাঁদছে। 

‘দুলাভাই, আপনি পরীর কাছে যান। ‘যাই। আনিস, তুমি হ্যাপিনেস সম্পর্কে জানতে চাইছিলে-– 

 

নির্বাসনপরে বলবেন। এখন পরীর কাছে যান। ‘া, তাই যাই।’ 

হােসেন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আনিস দেখল, তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাসলেন। 

হৈচৈ শুনে বড়চাচা নিচে নেমে গিয়েছিলেন। 

ততক্ষণে পান্নাকে পানি থেকে তােলা হয়েছে এবং পান্নার চার পাশে একটি জটলার সৃষ্টি হয়েছে। সব ক’টি বাচ্চা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। বােচাচা কয়েক বার জানতে চেষ্টা করলেন কী হয়েছে। কিন্তু সবাই হৈচৈ করছে, কেউ কিছু বলছে না। তিনি ভিড়ের মধ্যে উকি দিয়ে দেখলেন পরী তার দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছে। পরীর গা ভেজা, তার মাথায় কচুরিপানার ছােট ছােট পাতা লেগে রয়েছে। বড়চাচা ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। গলা উঁচিয়ে বললেন, “কী হয়েছে রে পরী? 

 ‘পান্না পানিতে ডুবে গিয়েছিল। আভা কোনােমতে তুলেছে। পরী ঘনঘন চোখ মুছতে লাগল। 

বড়ােচাচা বললেন, ‘তুলেই তাে ফেলেছে, তবু কাঁদছিস!” 

নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ

বড়ােচাচা হাসতে লাগলেন। পরীর কাণ্ড দেখে বেশ মজা লাগছে তাঁরতিনি এক বার ভাবলেন জিজ্ঞেস করেন, পরী নিজেই যে ছােটবেলায় পুকুরে ডুবে মরতে বসেছিল, সেটি কি তার মনে আছে? কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। নিঃশব্দে নিজের ঘরে চলে গেলেন। তাঁকে এখন খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছে। 

তেইশ বছর আগে একবার পরী ডুবতে বসেছিল। তাকে সেদিন টেনে তুলেছিল পরীর বড়ােচাচী। তেইশ বছর পর শ্রাবার এক জন পরীর মেয়েকে টেনে তুলল। বাহ! বেশ মজার ব্যাপার তাে! কিন্তু পরীর কি সেই শৈশবের কথা মনে আছে? অনেক বড়াে বড়াে ঘটনা মানুষ চট করে ভুলে যায়। আবার অর্থহীন সামান্য অনেক অকিঞ্চিৎকর ব্যাপার মানুষের অন্তরে দাগ কেটে বসে যায়। | বড়চাচার এগার বছরের বিবাহিত জীবনে কত বড়াে বড়াে ঘটনাই তাে ঘটেছে। কিন্তু সেসব ছবি বড় ঝাপসা। কষ্ট করে দেখতে হয়, ঠিক ঠিক মনে পড়তে চায় না। শিরীন মরবার সময় তাঁকে যেন কী সব বলেছিল। সেসব কেমন আবছাভাবে মনে আসে। এমন কি শিরীনের চেহারাও ঠিকঠিক মনে পড়ে না। কিন্তু একটি ছােট্ট ঘটনা, একটি অতি সামান্য ব্যাপার, আজও কী পরিষ্কার ভাবে মনে আছে তাঁর। 

নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ

 সেদিন ভীষণ গরম পড়েছ। দুপুরে একটু ঘুমিয়েছিলেন। ঘেমে একেবারে নেয়ে গেছেন। ঘুম যখন ভাঙল, তখন বেলা পড়ে গেছে। 

তিনি বারান্দার ইজিচেয়ারে এসে বসেছেন। একটি কাক কোথেকে এসে কা 

কা শুরু করেছে। তিনি হাত নেড়ে কাক তাড়িয়ে দিলেন, সেটি আবার উড়ে , আর ঠিক তখনি শুনলেন ঘরে ভেতর থেকে শিরীন খুব মৃদু স্বরে সুর করে বল.. রসুন বুনেছি, রসুন বুনেছি।’ | কত দিন হয়ে গেল, তবু তাঁর মনে হয় যেন সেদিনের ঘটনা। কাকটির তাকানর ভঙ্গিটিও তাঁর মনে আছে। এ রকম হয় কেন মানুষের? বড়াে বিচিত্র মন আমাদের। 

বড়ােচাচা দুপুরের খাবার খেতে আনিসের ঘরে চলে গেলেন। আনিস অসুস্থ হয়ে এখানে পড়ে আছে প্রায় এগার মাস। এই এগার মাসের প্রতি দুপুরে তিনি আনিসের সঙ্গে খেতে বসেছেন। খাওয়ার ঘন্টাখানিক সময় তিনি আনিসের ঘরে কাটান। এটাসেটা নিয়ে হালকা গল্প গুজব করেন। আজ ঘরে ঢুকে দেখলেন খাবার দিয়ে গিয়েছে এবং আনিস গোগ্রাসে খাচ্ছে। সে চাচাকে দেখে লজ্জিত হয়ে বলল, ‘বড়াে খিদে পেয়েছে চাচা। 

খিদে পেলে খাবি। আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে নাকি রে গাধা ‘আপনি হাত ধুয়ে আসুন। ‘তাের শরীর কেমন বল?” ‘ভালাে।’ ‘ব্যথা হয় নি, না?” 

সকালের দিকে অল্প হয়েছিল, এখন নেই। 

বড়ােচাচা খেতে বসে আনিসের দিকে বারবার তাকাতে লাগলেন। আনিসের চেহারায় তার বাবার চেহারার আদল আছে। খুব পুরুষালি গড়ন। তবে মেয়েদের মতাে ছােট্ট কফিকাটা চিবুক। এইটুকুতেই তার চেহারায় অনেকখানি ছেলেমানুষী এসে গেছে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *