নিষাদ পর্ব – ৪ হুমায়ূন আহমেদ

নিষাদ পর্ব – ৪

পাটি বিছিয়ে খাওয়ার আয়োজন। উচ্ছে ভাজা, চিংড়ি মাছ, ডাল এবং একটা শক্তি। কিশোরী মেয়েটি খাবার তুলে তুলে দিচ্ছে। মেয়েটির মুখ গোলাকার, নাক ঈষৎ চাপা। তবু ভারি মিষ্টি লাগছে মেয়েটিকে মেয়েটির কথাবার্তায় কোনো আড়ষ্টতা নেই, যেন মুনিরকে সে অনেক দিন থেকে চেনে। মেয়েটি মিষ্টি রিনরিনে গলায় কথা বলছে এবং খুব কৌতূহলী চোখে মুনিরকে দেখছে।

বাবা প্রায়ই বাসায় এসে বলেন, আপনি নাকি বাবার হিসাব মিলিয়ে দিয়েছেন। প্রতি বৃহস্পতিবার অফিসে যাবার সময় বলেন–ছেলেটিকে দাওয়াত করব। আপনাকে বোধহয় আর বলেন না। নাকি বলেন, আপনি আসেন না? মুনিরের কেন জানি লজ্জা করছে। চোদ্দ-পনের বছরের বাচ্চা একটি মেয়ে, তবু কেন মুনির সহজ হতে পারছে না।

ভাই, আপনার কি একটিই মেয়ে?……..হ্যাঁ, বিনুর বড় একটা ভাই ছিল। জন্মের পরপর মারা গেছে।আপনার মেয়ে কী পড়ে? বিনু হেসে ফেলে বলল, আপনি বাবাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমাকে জিজ্ঞেস করুন। আপনি এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? কী পড় তুমি? আইএ পড়ি।নিজাম সাহেব বললেন, আর পড়াশোনা হবে না। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এ দেশে বিয়ের পর মেয়েদের পড়াশোনা হয় না।

বিনু আবার হেসে ফেললঃ হাসিমুখে বলল, যে-সব প্রশ্ন বাবাকে করা দরকার, সে-সব প্রশ্ন আপনি করছেন আমাকে! আর যে-সব প্রশ্ন আমাকে করা দরকার, সেসব করছেন বাবাকে। আপনি মানুষ এত অদ্ভুত কেন? তুমি কিছু মনে করো না।না, কিছু মনে করছি না।

আপনার কি গরম লাগছে? গরম লাগবে কেন? গরম লাগছে না।ঘামছেন কেন?….বিনুর প্রশ্নের সঙ্গে-সঙ্গেই ব্যাপারটা ঘটল। চোখের সামনের জগৎ হঠাৎ কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। শব্দ অস্পষ্ট। ঘোলাটে আলোর তীব্রতা দ্রুত কমছে—-কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। মুনির তুলিয়ে যাচ্ছে শব্দহীন আলোহীন এক জগতে! শরীরের কোনো ইন্দ্ৰিয় কাজ করছে না। এই অবস্থা কতক্ষণ ছিল মুনিরের মনে নেই। ঘোর কাটল। কিছু-কিছু আলো সে দেখতে পাচ্ছে। দুএকটা শব্দ কানে আসছে। মুনির ক্লান্ত গলায় বলল, পানি খাব।

এইমাত্র না পানি খেলে! আবার পানি কেন? সত্যি খেতে চাও?…..মুনির স্পষ্ট করে তাকাল। সে একটা অচেনা বাড়ির অচেনা বারান্দায় বসে আছে। তার সামনে বিনু তার গায়ে ঘরোয়া ভঙ্গিতে পরা হালকা নীল রঙের একটা সুতির শাড়ি। বারান্দায় একটা পাটি পাতা। বিনু বসেছে পাটিতে। সে একটা চেয়ারে বসে আছে। রাত। বারান্দায় চাঁদের আলো আছে।এই, সত্যি সত্যি পানি চাও? চাই।

বিনু উঠে গেল। এই বাড়ি কার? এই মেয়েটির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, জায়গাটা কোথায়? সে কিছুই জানে না। বছরখানিক আগে প্রথম যা হয়েছিল, এও কি তাই? তার কি দুটো জীবন? এই দুটো জীবন কি পাশাপাশি চলছে? নাও, পানি নাও! মুনির যন্ত্রের মতো হাত বাড়াল। ঠাণ্ডা কনকনে পানি।ও কি, গ্লাস হাতে বসে আছ কেন? এটা কোন জায়গা? এ আবার কি রকম কথা? কোন জায়গা মানে? এমনি বললাম।চল, শুয়ে পড়ি।

আর কতক্ষণ বারান্দায় বসে থাকবে?…….মুনির যন্ত্রের মতোই একটা ঘরে ঢুকল। এটাই বোধহয় শোবার ঘর। বেশ বড়লোকের বাড়ি মনে হচ্ছে। সুন্দর করে সাজান। দেয়ালে তিন-চার বছরের একটা ফুটফুটে শিশুর ছবি। মেয়েটি বলল, শোন, চট করে ঘুমিয়ে পড়বে না। বাবার চিঠির জবাব দিয়ে তারপর ঘুমুবো। আমার তো মনে হয় তুমি তাঁর চিঠি পড় নি এখনো। নাকি পড়েছ? না।পড়ে শোনাব? শোনাও।

মেয়েটি ড্রয়ার খুলে চিঠি বের করল-গলার স্বর বুড়ো মানুষের মতো করে পড়তে শুরু করল-টুনু, তুমি দীর্ঘদিন যাবত আমার পত্রের জবাব দিতেছ না। ইহার কারণ বুঝিতে আমি অক্ষম। এক জুন বৃদ্ধ মানুষের পত্রের জবাব দেওয়া সাধারণ ভদ্রতা। চাকরি এবং সংসার নিয়া তুমি ব্যস্ত আমি জানি। দুনিয়ার সকলেই ব্যস্ত। কেহ বর্সিয়া নাই। তোমার মা বাতে আক্রান্ত। আয়ুৰ্বেদীয় চিকিৎসা চলিতেছে। তবে আমার ইচ্ছা তাহাকে ঢাকায় আনিয়া কোনো বড় ডাক্তারকে দিয়া দেখান।

ঢাকায় বাত রোগের জন্য নামী ডাক্তারদের সন্ধান লইও।……..বৌমাকে আদর ও স্নেহমুম্বন দিবে। তাহাকে অতি শীঘ্রই পৃথক পত্ৰ দিব। ইতি চিঠি পড়া শেষ করে মেয়েটি বলল, দেখলে, তোমার ওপর কি রকম রাগ করেছেন? একটা চিঠি লিখতে কতক্ষণ লাগে বল তো? কাগজ-কলম এনে দিই।

মুনির সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দেয়ালে টাঙন ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কার ছবি?…….মেয়েটি দীর্ঘ সময় মুনিরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ ছলছল করছে। এই শিশুটি সম্ভবত তাদেরই। এবং খুব সম্ভব শিশুটি বেঁচে নেই। তার জন্যে মুনিরের কোনো দুঃখ বোধ হচ্ছে না। কারণ এই শিশুটিকে সে চেনে না। অতীতের কিছুই তার মনে পড়ছে না। সে দেখছে শুধু বর্তমান। এবং অদ্ভুত কোনো বর্তমান। এই বর্তমানের কোনো ব্যাখ্যা নেই। আবার বলল, ছবিটা কার? মেয়েটি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, তোমার কী হয়েছে।

ছবি কার জিজ্ঞেস করছি কেন? তুমি জান না ছবি কার?….বলতে-বলতে মেয়েটি ফুঁপিয়ে উঠল। মুনিরের ঘোর কেটে গেল। সে আগের জায়গাতেই আছে। ভাত-মাছ খাচ্ছে বিনু মেয়েট পাতে এক চামচ ডাল দিল। নিজাম সাহেব বললেন, দৈ আছে। টক দৈ। ডালের সঙ্গে মিশিয়ে খাও। ভালো লাগবে! বিনু বলল, দৈ কিন্তু বাবা নেই। বেড়াল মুখ দিয়েছিল, ফেলে দিয়েছি। ইস, আপনার বোধহয় খাওয়ায় খুব কষ্ট হল।না, কষ্ট হয় নি।এমন দিনে বাবা আপনাকে নিয়ে এসেছে যে, কোনো বাজার নেই। একটা যে টিম ভেজে দেব সে উপায়ও নেই।

ঘরে ডিমও ছিল না।আমার কিচ্ছু লাগবে না।আরেকদিন কিন্তু আপনি আসবেন। আসবেন তো?…….হ্যাঁ, আসব।খবর দিয়ে আসবেন! আচ্ছা, খবর দিয়ে আসব।আপনি কি পান খান? না।মুনির বারান্দায় হাত ধুতে গেল। বিনু সঙ্গে করে পানি নিয়ে এসেছে। এখন আর বৃষ্টি নেই। মেঘ কাটতে শুরু করেছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চাঁদ উঠবে।

শ্রাবণ মাসের চাঁদ অপূর্ব হয়, কে জানে আজ কেমন হবে?….মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, কি ব্যাপার, আজ খালি হাতে যে! আমার সিগারেট কোথায়? মুনির লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। মিসির আলি বললেন, আজকালের মধ্যে না এলে আমি নিজেই উপস্থিত হতাম তোমার ওখানে।আমি কোথায় থাকি তা তো আপনি জানেন না।আগে জানতাম না। এখন জানি। শার্লক হোমসের মতো বুদ্ধি খাটিয়ে বের করেছি।

শুনতে চাও?……..প্রথমে খোঁজ করলাম ইষ্টার্ন মার্কেস্টাইলে। দেখা গেল এই নামে কোনো অফিস নেই। তুমি ভুল ইনফরমেশন দিয়েছিলে।ভুল দিইনি। আগে এই নাম ছিল। এখন নাম বদলেছে।যখন দেখলাম অফিস থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না, তখন পাড়ার ছোটছোট পান-বিড়ির দোকানগুলোতে খোঁজ করতে লাগলাম। কারণ তুমি সিগারেট খাও! এইসব দোকানগুলোতে তোমাকে একাধিকবার যেতে হবে।

সিগারেট খাই, কী করে বুঝলেন? আপনার সামনে তো কখনো খাই নি।তোমার পকেটে দেশলাই দেখেছি। তাছাড়া যে সিগারেট খায়, সে-ই সাধারণত অন্যকে সিগারেট উপহার দেবার কথা ভাবে।দোকান থেকেই আমার খোঁজ পেলেন? হ্যাঁ। মুনির, তুমি চা খাবে? হ্যাঁ, খাব।কী তুমি কথায়-কথায় স্যার বল, আজ এখন পর্যন্ত একবারও বল নি।

কারণটা স্যার, আমি চা খাব। মিসির আলি উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। তার মনে হল, ছেলেটি বেশ রসিক। এবং সে সহজ হতে শুরু করেছে। যত সহজ হবে, ততই তাঁর জন্যে ভালো। প্রচুর তথ্য তাঁর দরকার তথ্য ছাড়া এগুবার কোনো পথ নেই। তিনি নিজে কোনো তথ্য সংগ্ৰহ করতে পারছেন না। ছেলেটির উপরই তাঁকে নির্ভর করতে হবে! আজ আমাকে কিছু বলবে মনে হচ্ছে? জ্বি, বলব।বাতি নেভাতে হবে? না।

মুনির খুব সহজ ভঙ্গিতে নিজাম সাহেবের বাড়ির ঘটনার কথা বলল। কেমন করে হঠাৎ পট পরিবর্তন হল, সে-সময় তার অনুভূতি কী ছিল, সবই সুন্দর করে গুছিয়ে বলল। শিশুটির দেয়ালে টাঙন ছবিটির কথা, তার পানি চাইবার কথা-কিছুই বাদ দিল না! মিসির আলি একটি প্রশ্নও করলেন না।

সমস্ত বৰ্ণনাটা শুনলেন চোখ বন্ধ করে। এক বাইেরও তাকালেন না।তোমার বলা শেষ হয়েছে? জ্বি।তোমার বর্ণনা থেকেই মনে হচ্ছিল, বিনু মেয়েটি তোমাকে অভিভূত করেছে। রূপবতী কিশোরী মেয়ে। তার সহজ সরল ব্যবহার, তার যত্ন-এইসব তোমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই না? জ্বি।

তুমি প্রবলভাবে মেয়েটিকে কামনা করেছ। সেই সঙ্গে তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছ। এই প্রচও কামনা বা প্রবল আকর্ষণের কারণে তোমার মধ্যে বিভ্রম সৃষ্টি হয়েছে। যার জন্যে মেয়েটিকে তুমি দেখেছ তোমার স্ত্রী হিসেবে। পুরোটাই তোমার কল্পনা। ডে-ড্রীমিং। এক ধরনের ইচ্ছেপূরণ স্বপ্ন।হতে পারে।আগের বার তুমি একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলে। এবার কিছু আন নি? না।

আবার যদি কখনো এ-রকম হয়, একটা জিনিস মনে রাখবে।–কিছু একটা হাতে নেবে। খবরের কাগজ হলে খুব ভালো হয়।খবরের কাগজ দিয়ে কী করবেন? খবরের কাগজে একটা তারিখ থাকে। এই তারিখটা দেখব। তুমি তোমার অন্য একটা জীবনের কথা বলছি। মনে হচ্ছে দুটো জীবন পাশাপাশি চলছে।

সেই জীবনের সময় এবং এই জীবনের সময়ও কি পাশাপাশি?……….তার মানে আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন? না, করছি না। আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও করতে পারছি না। কিছু একটা দাঁড় করাতে হলে আমার প্রচুর তথ্য দরকার। সেইসব তথ্য আমার হ্রাতে নেই। তবে তুমি যে-গল্প বলছি, তার কাছাকাছি গল্প বিভিন্ন উপকথায় চালু আছে।

তাই নাকি?……..হ্যাঁ। একটা শুধু তোমাকে বলি! এক লোক পুকুরে গোসল করতে নেমেছে। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত, গোসল শেষ করে বাসায় গিয়ে খাবে। পানিতে ডুব দিয়ে যেই উঠল ওম্নি সে দেখে, সব কিছু কেমন অন্য রকম লাগছে। সব অচেনা। সে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল। সে নিজেও বদলে গেছে। সে এখন আর পুরুষ নয়।

রূপবতী এক যুবতী। সে কাঁপতে কাঁপতে পানি ছেড়ে উঠে এল। এক সওদাগর তখন তাকে দেখতে পেয়ে সঙ্গে নিয়ে গেল। সওদাগরের সঙ্গে তার বিয়ে হল। চারটি ছেলেমেয়ে হল! তারপর একদিন দুপুরে সে সবাইকে নিয়ে গোসল করতে এসেছে। পানিতে ডুব দিয়ে ওঠামাত্র দেখল, সে তার পরিচিত জগতে উঠে এসেছে। আবার সে পুরুষ! সে দ্রুত তার বাড়িতে গেল।

স্ত্রী ভাত বেড়ে অপেক্ষা করছে। লোকটির মন গভীর বিষাদে আচ্ছান্ন। বারবার চারটি পুত্ৰ-কন্যার কথা তার মনে পড়ছে। ওরা কোথায় আছে, কী করছে, কে জানে? হয়তো হয়ে মাকে খুঁজছে।মুনির বলল, এটা তো উপকথা, সত্যি নয়।তা ঠিক। তবে সব গল্পের পেছনেই এক ধরনের সত্যি ব্যাপার থাকে। এর পেছনেও কিছু-না-কিছু থাকতে পারে। আমি এইজাতীয় সব গল্প জোগাড় করছি। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডজাতীয় যত বই পাচ্ছি পড়ছি।

মুনির ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। মিসির আলি বললেন, তুমি তোমার স্ত্রী ধ্ৰুফে-মেয়েটিকে দেখেছ, তার বয়স কি ফ্রক-পরা মেয়েটির চেয়ে বেশি মনে হ্যাঁ, হচ্ছিল।তোমার শোবার ঘরে জানালায় পর্দা ছিল? হ্যাঁ, ছিল।পর্দার রঙ মনে আছে।জ্বি-না।তাহলে ব্যাপারটা স্বপ্ন হবারই সম্ভাবনা। কারণ, শুধু স্বপ্নদূশ্যগুলোই হয় সাদাকালো।আমি কিন্তু দেখেছি, ঐ মেয়েটির পরনে নীল রঙের শাড়ি।

নিজাম সাহেবের মেয়েটির পরনে নিশ্চয়ই কিছু ছিল। যে-কারণে তুমি ভাবছ তোমার স্বপ্নে দেখা স্ত্রীর গায়ের শাড়িটি নীল।মুনির চুপ করে রইল। মিসির আলি বললেন, নিজাম সাহেবের মেয়েটির গায়ে কী ছিল? ফ্রক বা কামিজজাতীয় কিছু।তার রঙ কী ছিল? নীল।মিসির আলি অল্প হাসলেন। পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমার এই নিয়ে দু বার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। দুবারই তুমি ছিলে ক্লান্ত, বিরক্ত, হতাশ।

তাই না?……..জ্বি।এখন থেকে মাঝে-মাঝে চেষ্টা করে দেখবে, নিজ থেকে ঐ জগতে যেতে পার কি না। যখন এক-একা থাকবে তখন চেষ্টা করবে। ঐ জগতে যেতে চাইবে। ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করবে! জ্বি আচ্ছা।কোনো এক জন ভালো নিউরোলজিস্টকে দিয়েও তোমার ব্রেইন ওয়েডগুলো পরীক্ষা করাতে চাই। আমি প্রফেসর আসগর নামে এক নিউরোলজিষ্টের সঙ্গে কথাও বলে রেখেছি।

তুমি কি কাল বিকেল পাঁচটায় একবার আমার কাছে আসতে পারবে?…পারব। কিন্তু স্যার, নিউরোলজিষ্ট তো অনেক টাকা নেবে! সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।মিসির আলির সে-রাতে ভালো ঘুম হল না। ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখে রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে গেল। বাকিরাতটা জেগে কাটাতে হল। স্বপ্নৰ্দশ্য নিয়েও প্রচুর চিন্তা করলেন। অবদমিত কামনাই স্বপ্নে উপস্থিত হয়।। ব্যাখ্যা সহজ এবং চমৎকার, কিন্তু তবু কোথাও যেন একটা ফাঁকি আছে।

কিছু-একটা বাকি থেকে যায়। সেই কিছুর রহস্য কি কোনো দিন ভেদ হবে?…..আচ্ছা, পশু-পাখি। এরাও কি স্বপ্ন দেখে? অবদমিত কামনা কি তাদের নেই? পশুদের স্বপ্ন কেমন হয়? স্বপ্ন দেখার সময় মানুষের চোখের পাতা কাঁপতে থাকে—বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় তাকে বলে Rapid eye movement (REM), ঐ জাতীয় কম্পন তিনি একটি ঘুমন্ত কুকুরের চোখের পাতায় দেখেছিলেন। সেই কুকুরটি কি তখন স্বপ্ন দেখছিল? জানার কোনো উপায় নেই।

মিসির আলির খানিকটা মন খারাপ হল। এক দিন না এক দিন। এইসব রহস্যের সমাধান হবে, কিন্তু তিনি জেনে যেতে পারবেন না। মানুষ স্বল্পায়ু প্রাণী—এটাও একটা গভীর বেদনার ব্যাপার। এত বুদ্ধি নিয়ে সৌরজগতে যে-প্ৰাণীটি এসেছে, তার কর্মকাল সীমাবদ্ধ।

তিনি বাতি নিভিয়ে ঘুমের চেষ্টা করছেন-লাভ হচ্ছে না। বিচিত্র সব চিন্তা মাথায় আসছে। একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল নেই। আবার মিল আছেও। অদৃশ্য যে সুতোয় মিলগুলো গাঁথা, সে-সুতোটির নাম অনন্ত মহাকাল–The eternity.নিউরোলজিস্ট প্রফেসর আসগর বিশালদেহী মানুষ।

গোলগোল মুখ। মাথাভর্তি টাক–তীক্ষ্ণ চোখ। শিশুরা ভয় পেয়ে যাবার মতো চেহারা, কিন্তু মানুষটি হাসিখুশি। কারণে অকারণে রোগীকে ধমক দেয়ার বাজে অভ্যাসটি এখনো অর্জন করেন নি।ভদ্রলোক অনেক ঝামেলা করলেন। প্রথম বারের স্ক্যানিং ভালো হয় নি, দ্বিতীয় বার করলেন। কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলেন না। চোখে পড়ার মতো কোনো অস্বাভাবিকতা ব্রেইন ওয়েভে নেই। তিনি হেসে বললেন, আপনি এক জন খুবই সুস্থ মানুষ।

শুধু শুধু আমার কাছে এসেছেন। আপনার অসুবিধা কী?……..কোনো অসুবিধা নেই। মাঝে মাঝে আজেবাজে স্বপ্ন দেখি, এই অসুবিধা।আজেবাজে স্বপ্ন তো সবাই দেখে। আমিও দেখি। একবার কী দেখলাম জানেন? বাংলা একাডেমিতে গ্ৰন্থমেলা হচ্ছে, আমি শুধু একটা আণ্ডারওয়্যার পরে সেই গ্ৰন্থমেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। হা হা হা।মুনির হেসে ফেলল।

মিসির আলি বললেন, বাংলাদেশে ক্যাট স্কেনের কোনো ব্যবস্থা আছে? আমি এই ছেলের ব্রেইনের একটা ক্যাট স্কেন করাতে চাই! শুধু-শুধু ক্যাট স্কেন কেন করাবেন?…পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে চাই যে, ওর মস্তিকে কোনো সমস্যা নেই।বাংলাদেশে ক্যাট স্কেনার নেই। মাদ্রাজে নিয়ে যেতে পারেন। সেখানে আছে।ডাক্তারের চেষার থেকে বের হয়ে মিসির আলি বললেন, তোমার নিশ্চয়ই পাসপোর্ট নেই।জ্বি-না।কাল সকাল দশটার দিকে এসো, পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে একটা দরখাস্ত করে দিই।

পাগল হয়েছেন নাকি স্যার? আমি পাগল হব কেন? পাগল হচ্ছে তুমি। তা পুরোপুরি হবার আগেই একটা ব্যবস্থা করা দরকার।অনেক টাকার ব্যাপার স্যার।তা তো বটেই। আমার কাছেও এত টাকা নেই। একটা ব্যবস্থা করতে হবে।। পাসপোর্টটা তো করা থাকুক। চা খাবে নাকি? এস, চা খাওয়া যাক।দু জল চা খেল নিঃশব্দে। চায়ের দোকানে রেডিও বাজছে। মিসির আলি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে রেডিও শুনছেন। তাঁর চোখ ছায়াচ্ছন্ন। গানের বিষাদ তাঁকে স্পর্শ করেছে।

যখন মইরা যাইবারে হাছন………..মাটি হৈব বাসা।……………কোথায় রইবো লক্ষণ ছিরি,…………………রঙ্গের রামপাশা।………..মুনির অবাক হয়ে লক্ষ করল, মিসির আলির চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এই মানুষটির প্রতি গভীর মমতা ও ভালবাসায় মুনিরের হৃদয় আর্দ্র হল। পৃথিবীতে ভালোমানুষের সংখ্যা কম। কিন্তু এই অল্প কজনের হৃদয় এত বিশাল, যে, সমস্ত মন্দ মানুষ তাঁরা তাঁদের হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন।

মিসির আলি রুমাল বের করে চোখ মুছে অপ্রস্তুতের হাসি হাসলেন। থেমেথেমে বললেন, মানুষের মন বড় বিচিত্র। এই গান আগে কতবার শুনেছি, কখনো এরকম হয় নি। আজ হঠাৎ চোখে পানিটানি এসে এক কাণ্ড। চল, ওঠা যাক।মুনির বলল, একটু বসুন স্যার, আপনাকে একটা কথা বলি।বল।

ঐদিন আপনি আমাকে ধলেছিলেন চেষ্টা করতে, নিজে-নিজে ঐ জগতে যেতে পারি কি না।চেষ্টা করেছিলে?জ্বি। আমি যেতে পারি। ইচ্ছে করলেই পারি।বল কী? হ্যাঁ স্যার। গত তিন দিনে আমি চার বার গিয়েছি। যাওয়াটা খুবই সহজ।মিসির আলি চুপ করে রইলেন। মুনির বলল, আমি আপনার জন্যে দুটো জিনিস ওখান থেকে নিয়ে এসেছি।

দুটো ছবি …বল কী তুমি! দেখি! মুনির একটা খাম এগিয়ে দিলা মৃদু গলায় বলল, বাসায় গিয়ে দেখবেন স্যার। প্লীজ।মিসির আলি কৌতূহল সামলাতে পারলেন না। ছবি দুটো দেখলেন। একটি বিয়ের ছবি-বর এবং কনে পাশাপাশি বসে আছে। তাদের ঘিরে আছে আত্মীয়স্বজন। বর মুনির। কনে নিশ্চয়ই বিনু নামের মেয়েটি।

অন্যটি স্বামী-স্ত্রীর ছবি। ওদের কোলে ফুটফুটে একটি শিশু। ছবির উলটো পিঠে লেখা — আমাদের টগরমণি। বয়স এক বছর।মুনির বলল, এ আমাদের ছেলে। চার বছর বয়সে মারা যায়। নিউমোনিয়া হয়েছিল। ডাক্তাররা উলটাপাল্টা চিকিৎসা করেছেন।বলতে-বলতে মুনিরের গলা আর্দ্র হয়ে গেল। আলি দীর্ঘ সময় মুনিরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কোনো খবরের কাগজ আনি নি?………জ্বি-না স্যার। কিছু আনার কথা তখন মনে থাকে না। ছবিগুলো কেমন করে চলে এসেছে, আমি জানি না। ছবিগুলো হাতে নিয়ে দেখছিলাম, হঠাৎ ঘোর কেটে গেল।–দেখি আমি আমার ঘরে বসে আছি। আমার হাতে দুটো ছবি।চল, রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটি।চলুন।তারা দু জন উদ্দেশ্যহীন ভঙ্গিতে সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত হেঁটে বেড়াল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। মিসির আলির মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। একসময় তিনি বললেন, তুমি কি এর পরেও নিজাম সাহেবের বাসায় গিয়েছিলে? জ্বি-না স্যার।

চল, আজ যাওয়া যাক।কেন?……….এমনি যাব। দেখব। কথা বলব। ভয় নেই, ছবির কথা কিছু বলব না।আমার স্যার যেতে ইচ্ছে করছে না।বেশ, তুমি না গেলো। কীভাবে যেতে হয় আমাকে বল। আমি একাই যাব।স্যার, আমি চাই না ঐ মেয়েটি ছবি সম্পর্কে কিছু জানুক।ও কিচ্ছুই জানবে না।মুনির খুব অনিচ্ছার সঙ্গে ঠিকানা বলল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে খুব অস্বস্তি বোধ করছে।

স্যার, যাই?………আচ্ছা, দেখা হবে।মুনির ঘর থেকে বের হয়েও বেশ কিছু সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল, যেন চলে যাবার ব্যাপারটায় তার মন ঠিক সায় দিচ্ছে না, আবার না-যাওয়াটাও মনঃপূত নয়।মিসির আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন-মনে-মনে বললেন, অদ্ভুত মানবজীবন। মানুষকে আমৃত্যু দ্বিধা এবং দ্বন্দ্বের মধ্যে বাস করতে হয়।

 

নিষাদ পর্ব – ৫ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *