আমারতাে বিশ্বাসই হয় না। ওসি সাহেবকে বলেছি একটা বড় বজরা নৌকা যদি দু এক দিনের জন্যে জোগাড় করতে পারেন।
‘উনাকে পেলে কোথায়?”
‘স্কুল ঘর ঝড়ে উড়ে গেছে শুনে দেখতে গেছেন। তখন বললাম। ওসি সাহেব উনার বিশেষ ভক্ত, লেখা পড়েছেন।
কুয়াতলা থেকে দোতলার ঘর দেখা যায়। শওকত সাহেবের ঘরের বাতি নেভানাে। সেই ঘরের দিকে পিতা এবং কন্যা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল।
শওকত সাহেব বারান্দায় বসেছিলেন।
আজো তাঁর খুব ভােরে ঘুম ভেঙ্গেছে। ঘুম ভেঙ্গেছে পাখির ডাকে। পাখির দল যে ভােরবেলা এত হৈ চৈ করে তিনি আগে কল্পনাও করেন নি। কবিরা পাখির ডাক নিয়ে এত মাতামাতি কেন করেন তিনি বুঝতে পারছেন না। তাঁর কাছে যন্ত্রণার মত মনে হচ্ছে। তবে রাত কেটে ভাের হবার দৃশ্য অসাধারণ। শুধু মাত্র এই দৃশ্য দেখার জন্যে রােজ ভােরবেলায় ওঠা যেতে পারে।
পুষ্প চা নিয়ে ঢুকল।
শওকত সাহেব বললেন, তুমি কি রােজই এত ভােরে ওঠ, না আমার জন্যে উঠতে হচ্ছে?
নীল অপরাজিতা-পর্ব-১৫-হুমায়ূন আহমেদ
পুষ্প এই কথার জবাব দিল না, হাসল। মেয়েটি বুদ্ধিমতী – হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল সে রােজ এত ভােরে ওঠে না। মেয়েটি তার বাবার বকবকানির স্বভাব পায় নি – এও এক দিক দিয়ে রক্ষা। দু’জনের কথা শুনতে হলে সর্বনাশ হয়ে যেত।
তােমার বাবা কি আছেন না স্কুলে চলে গেছেন? ‘স্কুলে গেছেন। আজ সকাল সকাল ফিরবেন। হাফস্কুল। ‘বস পুষ্প, চা খেতে খেতে তােমার সঙ্গে গল্পকরি।
বারান্দায় বসার কোন জায়গা নেই। একটি মাত্র চেয়ার সেখানে তিনি বসে। আছেন।
শওকত সাহেব বললেন, টেবিটায় বস। আর টেবিলে যদি বসতে অসুবিধা হয় তাহলে ভেতর থেকে চেয়ার নিয়ে এসাে। পুষ্প টেবিলেই বসল। তবে টেবিলটা একটু দূরে সরিয়ে নিল।
নীল অপরাজিতা-পর্ব-১৫-হুমায়ূন আহমেদ
‘এখন বল তুমি কেমন আছ?” ‘ভাল।” ‘দেখে খুব ভাল মনে হচ্ছে না। রাতে ঘুম হয়নি তাই না?”
পুস্প হ্যা সূচক মাথা নাড়ল। এই মানুষটার দৃষ্টি তীক্ষ। পুষ্প বলল, রাতে ঘুম হয়নি কি করে বুঝলেন?
‘চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম। রাতে ঘুম না হলে চোখের নীচ একটু কালচে হয়ে যায়। তােমার হয়েছে। তবে তুমি যদি এত ফর্শা না হতে তাহলে ধরতে পারতাম না। চা খুব ভাল হয়েছে।
‘আরেক কাপ দেই? ‘না। ভাল হয়েছে বলেই দ্বিতীয় কাপ খাব না। হয়ত দ্বিতীয়টা এত ভাল হবে । সেই মন্দ চা খেয়ে প্রথম কাপের আনন্দ মাটি হবে। আচ্ছা এখন বল, তুমি আমার কোন লেখা পড়েছ?”
‘একটা পড়েছি। ‘একটা? মােটে একটা ?”
“জ্বি। আপনি আসবেন যখন কথা হল তখন বাবা নেত্রকোনা থেকে আপনার একটা বই কিনে আনলেন।
‘কোন বইটা কিনলেন?
বাবা দোকানদারকে বললেন, উনার সবচে কমদামী বই যেটা সেটাই দেন। দোকানদার একটা চটি বই দিয়ে দিল – “প্রথম দিবস, দ্বিতীয় রজনী।”
নীল অপরাজিতা-পর্ব-১৫-হুমায়ূন আহমেদ
‘কমদামী বই হলেও এটা আমার ভাল লেখার মধ্যে একটা। এই বই নিয়ে সুন্দর একটা গল্প আছে – দাড়াও তােমাকে বলি। বৈশাখ মাসের এক তারিখে বই বের হবার কথা। প্রকাশকের দোকানে সকাল থেকে বসে আছি। তখনতাে আর আমার এত বই ছিল না –ঐটি হচ্ছে দ্বিতীয় বই। বই বেরুবে আমার আগ্রহ সীমাহীন। বাইরের বই দেয়ার কথা সে আসছে না।
দুপুরবেলা প্রকাশক বললেন, আপনি বাসায় চলে যান বই বের হলে আপনাকে বাসায় দিয়ে আসব। আমি রাজি হলাম না। এসেছি যখন বই নিয়েই যাব। বিকেল পর্যন্ত বসে রইলাম, বাইন্ডারের দেখা নেই। প্রকাশক বললেন, আপনি কাজ করুন বাইন্ডারের ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি – গিয়ে দেখুন কি ব্যাপার।
নীল অপরাজিতা-পর্ব-১৫-হুমায়ূন আহমেদ
বাইন্ডারকে আওলাদ হােসেন লেনে ধরলাম। সে সবে মাত্র লেই লাগাচ্ছে। আমার খুব মেজাজ খারাপ হল। বাইন্ডার বলল, কিছুক্ষণ বসেন একটা কাঁচা বই দিয়ে দেই।
সেই কিছুক্ষণ মানে চার ঘণ্টা। বাসায় ফিরলাম রাত নটার পর। বাসায় এসে দেখি – রেনুকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তার তখন নমাস চলছে। ডেলিভারী ডেটের এখনাে অনেক দেরী। ব্যথা উঠে গেছে আগেই। ছুটে গেলাম হাসপাতালে। স্বাতীর জন্ম হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় তাকে মার পাশে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আমার লজ্জার সীমা রইল না। আমার প্রথম বাচ্চা অথচ আমি পাশে নেই। আমার লজ্জা এবং দুঃখ স্বাতী ঠিকই বুঝল। আমার লজ্জা ঢাকার জন্যে বলল, কই দেখি তােমার বই। বাহ কি সুন্দর। বলেই শুধু মাত্র আমাকে খুশী করার জন্যে এই অবস্থায় বইটি পড়তে শুরু করল। আমার চোখে পানি এসে গেল।
পুষ্প বলল, আপনি এত সুন্দর করে গল্পটা বললেন যে আমার চোখেই পানি এসে গেছে।
নীল অপরাজিতা-পর্ব-১৫-হুমায়ূন আহমেদ
‘রেনু অনেক বড় ভুল করে। নানান ভাবে আমাকে কষ্ট দেয় কিন্তু ঐ রাতের ঘটনার কথা মনে হলেই ওর সব অপরাধ আমি ক্ষমা করে দেই।
‘যে মেয়ে ঐ রাতে এমন কান্ড করতে পারেন তিনি ভুল করতে পারেন না। ‘তাও অবশ্যি ঠিক। এখন তুমি বল, বইটা তােমার কেমন লাগল ?” পুষ্প চুপ করে রইল।। শওকত সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, বইটা কি তােমার ভাল লাগেনি? ‘জ্বি– না। ‘ভাল না লাগারতাে কথা না। তুমি কি পড়েছু ভাল মত?
‘কেন ভাল লাগল না বলতে পারবে? ‘পারব। ‘তাহলে বলতে শুনি। “আপনি কি আমার কথায় রাগ করছেন?
“না রাগ করছি না। আমার লেখার বিপক্ষে কঠিন কঠিন কথা আমি সব সময় শুনি। সাহিত্যের অধ্যাপকরা বলেন, পণ্ডিত ব্যক্তিরা বলেন, বিদগ্ধ জনেরা বলেন, তােমার মত অল্প বয়স্ক মেয়ে বলবে তা ঠিক ভাবি নি। বিশেষ করে যে আমার একটি মাত্র বই পড়েছে। এখন তুমি আমাকে বল, কেন ভাল লাগল না।
Read more