মােফাজ্জল করিম সাহেব উচ্ছসিত হয়ে বললেন – অসাধারণ, অসাধারণ। কবিতাটি বড় ফ্রেমে বাধানাে। চারদিকে লতা ফুল পাতা আঁকা। নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্যে পুষ্পও গিয়েছিল।
ফেরার পথে সে শওকত সাহেবের পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। পুষ্পের সঙ্গে এখন প্রায় দেখাই হচ্ছে না। করিম সাহেব খবর দিয়েছেন – পড়াশােনা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। সারাক্ষণ পড়ে আর বাকি সময়টা বাবুর সাথে দুষ্টামী ফাজলামী
শওকত সাহেবের ধারণা তা নয়। মেয়েটি যে কোন কারণেই হােক তাকে এড়িয়ে চলছে। তিনি এমন কিছু কি করেছেন যাতে তাকে এড়িয়ে চলা উচিত? তিনি মনে করতে পারলেন না। এখন অবশ্যি বেশ সহজভাবে তাঁর পাশে–পাশে হাঁটছে। বাবু সঙ্গে নেই। বাবু থাকলে সে নিশ্চয়ই বাবুর সঙ্গে আগে–আগে হাঁটত এবং খানিকক্ষণ পর পর খিল খিল করে হাসত।
বাবু নামের ছেলেটির সঙ্গে এই মেয়েটির এত ঘনিষ্টতা কি করে হয় তা তিনি
ভেবে পাচ্ছেন না। এই ছেলের আশে পাশে কিছুক্ষণ থাকলেই তাে রাগে গা জ্বলে যাবার কথা। এক দুপুর বেলায় ঐ ছেলে তাঁর ঘরে উপস্থিত – হাতে একটা দড়ি।
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ
‘স্যার কি ঘুমুচ্ছেন নাকি?
‘দড়ির একটা ম্যাজিক দেখবেন ? ‘না। ম্যাজিক দেখতে ইচ্ছে করছে না।
‘খুব ইন্টারেস্টিং ম্যাজিক স্যার – দড়িটা কেটে তিন টুকরা করব তারপর জোড়া লাগায়ে দিব।
তিনি হাল ছেড়ে তাকিয়ে রইলেন। এই ছেলে তাঁকে ম্যাজিক না দেখিয়ে যাবে না।
‘নেন স্যার দড়িটা মেপে দেখেন। ‘মাপতে হবে না। তুমি যা দেখাবে দেখাও। ‘উ মাপেন। শেষে বলবেন অন্য দড়ি।
তাকে দড়ি মাপতে হল। বাবু বলল, এখন বিসমিল্লাহ বলে দড়িটা কাটেন। ‘কাটাকাটি যা করার তুমিই কর। ‘উ আপনাকেই কাটতে হবে।
তিনি দড়ি কেটে তিন টুকরা করলেন। বাবু রুমাল দিয়ে কাটা টুকরাগুলি ঢেকে দিল এবং এক সময় আস্ত দড়ি বের করে আনল।
‘কেমন স্যার আশ্চর্য না ? ‘া আশ্চর্য।। ‘আসেন, আপনাকে শিখিয়ে দেই কি করে করা লাগে। ‘আমি শিখতে চাচ্ছি না। ‘শিখে রাখেন। অন্যদের দেখাবেন। যে দেখবে সেই মজা পাবে।
তাকে দড়ি কাটার ম্যাজিক শিখতে হল।
এমন ছেলের সঙ্গ লাভের জন্য পুষ্প এত ব্যাকুল হবে কেন? পূষ্পকে কি তিনি এই কথাটা জিজ্ঞেস করবেন?
পুষ্প তার পাশাপাশি হাঁটছে। করিম সাহেব, ওসি সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে করতে এগুচ্ছেন। তারা অনেক সামনে। ইচ্ছা করলেই জিজ্ঞেস করা যায়। ইচ্ছা করছে আবার করছেও না।
পুষ্প বলল, আজকের নিমন্ত্রণটা আপনার কেমন লাগল?
তিনি বললেন, ভাল।
পুষ্প বলল, আমি সারাক্ষণ আপনাকে লক্ষ্য করছিলাম। আপনি অসম্ভব বিরক্ত হচ্ছিলেন অথচ হাসিমুখে বসেছিলেন। আপনি তাে অভিনয়ও খু; ভাল জানেন।
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ
“ঠিকই ধরেছ। ‘এ রকম কষ্ট কি আপনাকে প্রায়ই করতে হয় ? ‘হ্যা হয়। ‘ওরা কিন্তু যা করেছে আপনাকে ভালবেসেই করেছে। ‘তাও জানি। ‘আপনি কি আমার উপর রাগ করে আছেন ? ‘না। রাগ করে থাকব কেন? রাগ করে থাকার মত তুমি কি কিছু করেছ?”
পুষ্প তঁাকে বিস্মিত করে দিয়ে বলল, হ্যা করেছি। “কি করেছ? ‘আপনার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকছি।
‘তুমি দূরে দূরে থাকলেই আমি রাগ করব, এমন অদ্ভুত ধারণা তোমার কেন হল বলতাে? আমি একা থাকতেই পছন্দ করি। তােমাদের বাড়ি ছেড়ে বজরায় এসে উঠলাম কি জন্যে? যাতে একা থাকা যায়। বজরার মাঝি দু‘জনকেও বিদায় করে দিয়েছি। রাতে অবশ্যি খানিকটা ভয় ভয় লাগে।
‘আপনার লেখা কেমন হচ্ছে?
‘ভাল হচ্ছে, খুব ভাল। এখানে বসে লেখার একটা প্রভাবও লক্ষ্য করছি – লেখার ধরন একটু মনে হল পাল্টেছে। প্রকৃতির কথা স্বতস্ফূর্তভাবে চলে আসছে।
পুষ্প বলল, সারাক্ষণ আপনার মাথায় লেখা ঘুরে তাই না? লেখা ছাড়া আপনি আর কিছু ভাবতে পারেন না।
তিনি হেসে ফেলে বললেন, কবিতা শুনতে চাও? ‘কবিতা?”
‘হ্যা কবিতা, আমি আবৃত্তি ভাল করতে পারি না। আমার উচ্চারণও খারাপ। ‘র’ ‘ড়‘ এ গণ্ডগােল করে ফেলি। দ’ এবং ধ’ তেও সমস্যা আছে। তবে প্রচুর কবিতা আমার মুখস্ত। রেনুর সঙ্গে বাজি রেখে একবার সারারাত কবিতা মুখস্ত বলে গেছি। বল কোন কবিতা শুনবে।
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ
‘যা বলব তাই মুখস্ত বলতে পারবেন?
‘অবশ্যই পারব। ‘আচ্ছা আষাঢ় মাস নিয়ে একটা বলুন।
‘খুব সহজ বিষয় ধরলে। বর্ষা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতু। বর্ষা নিয়ে তার অসংখ্য কবিতা আছে –
তিনি নীচু গলায় শুরু করলেন।
আষাঢ় হতেছে শেষ, মিশায়ে মল্লার দেশ
রচি “ভরা বাদরের” সুর। খুলিয়া প্রথম পাতা
গীত গােবিন্দের গাথা গাহি “মেঘে অম্বর মেদুর।” স্তব্ধ রাত্রি দ্বিপ্রহরে
ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি পড়ে শুয়ে শুয়ে সুখ অনিদ্রায় “রজনী শাঙন ঘন
ঘন দেয়া গরজন” সেই গান মনে পড়ে যায়। শওকত সাহেব হঠাৎ কবিতা আবৃত্তি থামিয়ে দিলেন।
তিনি একি করছেন? মেয়েটিকে অভিভূত করার চেষ্টা করছেন? সেই চেষ্টাও ছেলেমানুষী ধরনের চেষ্টা। কোন মানে হয় না। এর কোন মানে হয় না।
পুষ্প বলল, হঠাৎ থেমে গেলেন কেন? ‘ইচ্ছা হচ্ছে না। আকাশে মেঘ নেই, বর্ষার কবিতা এই কারণেই ভাল লাগছে ।”
তিনি সিগারেট ধরিয়ে হন হন করে এগিয়ে গেলেন। পুষ্প পেছনে পড়ে গেল।
পরদিন গেলেন ময়নাতলা স্কুলে।
জরাজীর্ণ স্কুল। দেখেই কান্না পায়। তিনি স্কুলে ঢোকামাত্র একদল রােগভােগা ছেলে মিলিটারীদের মত প্যারেড করতে করতে এল। তাদের একজন। দলপতি আছে। সে এসে স্যালুট করে হ্যাণ্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। খুবই বিব্রতকর অবস্থা।
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ
সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে মানপত্র পাঠ করলেন স্কুলের বাংলার শিক্ষক তারিনী বাবু। হে মান্যবর, হে জগতের আলাে, হে বিদগ্ধ মহাজ্ঞানী, হে বাংলার হৃদয়, হে দেশমাতৃকার কৃতী সন্তান ... চলতেই লাগল। চেয়ারে বসে দীর্ঘ সময় এই জিনিস
শােনা কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি গলায় জুই ফুলের মালা নিয়ে চুপচাপ শুনছেন। অনুষ্ঠানে এক ছেলে কবিতা আবৃত্তি করল।
Read more