নীল অপরাজিতা-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ

মােফাজ্জল করিম সাহেব উচ্ছসিত হয়ে বললেন অসাধারণ, অসাধারণকবিতাটি বড় ফ্রেমে বাধানােচারদিকে লতা ফুল পাতা আঁকানিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্যে পুষ্পও গিয়েছিল। 

নীল অপরাজিতাফেরার পথে সে শওকত সাহেবের পাশে পাশে হাঁটতে লাগলপুষ্পের সঙ্গে এখন প্রায় দেখাই হচ্ছে নাকরিম সাহেব খবর দিয়েছেন পড়াশােনা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ছেসারাক্ষণ পড়ে আর বাকি সময়টা বাবুর সাথে দুষ্টামী ফাজলামী 

শওকত সাহেবের ধারণা তা নয়মেয়েটি যে কোন কারণেই হােক তাকে এড়িয়ে চলছেতিনি এমন কিছু কি করেছেন যাতে তাকে এড়িয়ে চলা উচিত? তিনি মনে করতে পারলেন নাএখন অবশ্যি বেশ সহজভাবে তাঁর পাশেপাশে হাঁটছেবাবু সঙ্গে নেইবাবু থাকলে সে নিশ্চয়ই বাবুর সঙ্গে আগেআগে হাঁটত এবং খানিকক্ষণ পর পর খিল খিল করে হাসত। 

বাবু নামের ছেলেটির সঙ্গে এই মেয়েটির এত ঘনিষ্টতা কি করে হয় তা তিনি 

ভেবে পাচ্ছেন নাএই ছেলের আশে পাশে কিছুক্ষণ থাকলেই তাে রাগে গা জ্বলে যাবার কথাএক দুপুর বেলায় ছেলে তাঁর ঘরে উপস্থিত হাতে একটা দড়ি। 

নীল অপরাজিতা-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ

স্যার কি ঘুমুচ্ছেন নাকি? 

দড়ির একটা ম্যাজিক দেখবেন ? নাম্যাজিক দেখতে ইচ্ছে করছে না। 

খুব ইন্টারেস্টিং ম্যাজিক স্যার দড়িটা কেটে তিন টুকরা করব তারপর জোড়া লাগায়ে দিব। 

তিনি হাল ছেড়ে তাকিয়ে রইলেনএই ছেলে তাঁকে ম্যাজিক না দেখিয়ে যাবে না। 

নেন স্যার দড়িটা মেপে দেখেনমাপতে হবে নাতুমি যা দেখাবে দেখাওউ মাপেনশেষে বলবেন অন্য দড়ি। 

তাকে দড়ি মাপতে হলবাবু বলল, এখন বিসমিল্লাহ বলে দড়িটা কাটেনকাটাকাটি যা করার তুমিই করআপনাকেই কাটতে হবে। 

তিনি দড়ি কেটে তিন টুকরা করলেনবাবু রুমাল দিয়ে কাটা টুকরাগুলি ঢেকে দিল এবং এক সময় আস্ত দড়ি বের করে আনল। 

কেমন স্যার আশ্চর্য না ? ‘া আশ্চর্যআসেন, আপনাকে শিখিয়ে দেই কি করে করা লাগেআমি শিখতে চাচ্ছি না। ‘শিখে রাখেনঅন্যদের দেখাবেনযে দেখবে সেই মজা পাবে। 

তাকে দড়ি কাটার ম্যাজিক শিখতে হল। 

এমন ছেলের সঙ্গ লাভের জন্য পুষ্প এত ব্যাকুল হবে কেন? পূষ্পকে কি তিনি এই কথাটা জিজ্ঞেস করবেন

পুষ্প তার পাশাপাশি হাঁটছেকরিম সাহেব, ওসি সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে করতে এগুচ্ছেনতারা অনেক সামনেইচ্ছা করলেই জিজ্ঞেস করা যায়ইচ্ছা করছে আবার করছেও না। 

পুষ্প বলল, আজকের নিমন্ত্রণটা আপনার কেমন লাগল

তিনি বললেন, ভাল। 

পুষ্প বলল, আমি সারাক্ষণ আপনাকে লক্ষ্য করছিলামআপনি অসম্ভব বিরক্ত হচ্ছিলেন অথচ হাসিমুখে বসেছিলেনআপনি তাে অভিনয়ও খু; ভাল জানেন। 

নীল অপরাজিতা-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ

ঠিকই ধরেছরকম কষ্ট কি আপনাকে প্রায়ই করতে হয় ? হ্যা হয়ওরা কিন্তু যা করেছে আপনাকে ভালবেসেই করেছেতাও জানিআপনি কি আমার উপর রাগ করে আছেন ? নারাগ করে থাকব কেন? রাগ করে থাকার মত তুমি কি কিছু করেছ?” 

পুষ্প তঁাকে বিস্মিত করে দিয়ে বলল, হ্যা করেছিকি করেছ? আপনার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকছি। 

তুমি দূরে দূরে থাকলেই আমি রাগ করব, এমন অদ্ভুত ধারণা তোমার কেন হল বলতাে? আমি একা থাকতেই পছন্দ করিতােমাদের বাড়ি ছেড়ে বজরায় এসে উঠলাম কি জন্যে? যাতে একা থাকা যায়বজরার মাঝি দুজনকেও বিদায় করে দিয়েছিরাতে অবশ্যি খানিকটা ভয় ভয় লাগে। 

আপনার লেখা কেমন হচ্ছে

ভাল হচ্ছে, খুব ভালএখানে বসে লেখার একটা প্রভাবও লক্ষ্য করছি লেখার ধরন একটু মনে হল পাল্টেছেপ্রকৃতির কথা স্বতস্ফূর্তভাবে চলে আসছে। 

পুষ্প বলল, সারাক্ষণ আপনার মাথায় লেখা ঘুরে তাই না? লেখা ছাড়া আপনি আর কিছু ভাবতে পারেন না। 

তিনি হেসে ফেলে বললেন, কবিতা শুনতে চাও? কবিতা?” 

হ্যা কবিতা, আমি আবৃত্তি ভাল করতে পারি নাআমার উচ্চারণও খারাপড়গণ্ডগােল করে ফেলিএবং তেও সমস্যা আছেতবে প্রচুর কবিতা আমার মুখস্তরেনুর সঙ্গে বাজি রেখে একবার সারারাত কবিতা মুখস্ত বলে গেছিবল কোন কবিতা শুনবে। 

নীল অপরাজিতা-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ

যা বলব তাই মুখস্ত বলতে পারবেন

অবশ্যই পারবআচ্ছা আষাঢ় মাস নিয়ে একটা বলুন। 

খুব সহজ বিষয় ধরলেবর্ষা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতুবর্ষা নিয়ে তার অসংখ্য কবিতা আছে – 

তিনি নীচু গলায় শুরু করলেন। 

আষাঢ় হতেছে শেষ, মিশায়ে মল্লার দেশ 

রচি ভরা বাদরেরসুরখুলিয়া প্রথম পাতা 

গীত গােবিন্দের গাথা গাহি মেঘে অম্বর মেদুরস্তব্ধ রাত্রি দ্বিপ্রহরে 

ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি পড়ে শুয়ে শুয়ে সুখ অনিদ্রায় রজনী শাঙন ঘন 

ঘন দেয়া গরজনসেই গান মনে পড়ে যায়শওকত সাহেব হঠাৎ কবিতা আবৃত্তি থামিয়ে দিলেন

তিনি একি করছেন? মেয়েটিকে অভিভূত করার চেষ্টা করছেন? সেই চেষ্টাও ছেলেমানুষী ধরনের চেষ্টাকোন মানে হয় নাএর কোন মানে হয় না। 

পুষ্প বলল, হঠাৎ থেমে গেলেন কেন? ইচ্ছা হচ্ছে নাআকাশে মেঘ নেই, বর্ষার কবিতা এই কারণেই ভাল লাগছে ” 

তিনি সিগারেট ধরিয়ে হন হন করে এগিয়ে গেলেনপুষ্প পেছনে পড়ে গেল। 

পরদিন গেলেন ময়নাতলা স্কুলে। 

জরাজীর্ণ স্কুলদেখেই কান্না পায়তিনি স্কুলে ঢোকামাত্র একদল রােগভােগা ছেলে মিলিটারীদের মত প্যারেড করতে করতে এলতাদের একজনদলপতি আছেসে এসে স্যালুট করে হ্যাণ্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলখুবই বিব্রতকর অবস্থা। 

নীল অপরাজিতা-পর্ব-(১৯)-হুমায়ূন আহমেদ

সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে মানপত্র পাঠ করলেন স্কুলের বাংলার শিক্ষক তারিনী বাবুহে মান্যবর, হে জগতের আলাে, হে বিদগ্ধ মহাজ্ঞানী, হে বাংলার হৃদয়, হে দেশমাতৃকার কৃতী সন্তান ... চলতেই লাগলচেয়ারে বসে দীর্ঘ সময় এই জিনিস 

শােনা কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়কিন্তু তিনি গলায় জুই ফুলের মালা নিয়ে চুপচাপ শুনছেনঅনুষ্ঠানে এক ছেলে কবিতা আবৃত্তি করল

 

Read more

নীল অপরাজিতা-পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *