পদ্মার পলিদ্বীপ – উপন্যাস – আবু ইসহাক
উৎসর্গ – বড় ভাই মোহাম্মদ ইসমাইল-এর স্মৃতির উদ্দেশে
পদ্মার পলিদ্বীপ সম্পর্কে দেশি-বিদেশী অভিমত
…একখানা উচ্চাঙ্গের উপন্যাস। ইহার অনেক জায়গা একাধিকবার পড়িয়াছি। বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব ছাড়িয়াই দিলাম।…এত ব্যাপক, বিস্তৃত, জটিল অথচ সুসংহত এবং স্বচ্ছন্দ কাহিনী কমই পড়িয়াছি।…এই উপন্যাসে নানা কাহিনীর সুষম সমাবেশ হইয়াছে, পদ্মার বিধ্বংসী লীলার যথাযথ বর্ণনা আছে,…। এই বর্ণনা প্রত্যক্ষ, পুঙ্খানুপুঙ্খ অথচ সংযত, অশ্লীল কাহিনীতে কোথাও শ্লীলতার অভাব দেখা যায় না। জরিনা-ফজলের যৌনমিলনের যে চিত্র আঁকা হইয়াছে তাহার মধ্যে জরিনাই অগ্রণী। তাহার ধর্মবোধ তীক্ষ্ণ। সে জানে সামাজিক রীতি ও ধর্মীয় নীতির দিক দিয়া সে পাপিষ্ঠা, কিন্তু মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় বলা যাইতে পারে, পর্বত গৃহ ছাড়ি বাহিরায় যবে নদী সিন্দুর উদ্দেশে, কার সাধ্য রোধে তার গতি। ব্যভিচারের এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ, অথচ সংযত বর্ণনা আর কোথাও পড়িয়াছি বলিয়া মনে হয় না।
ইতিহাস মানুষের কাহিনী বলে, যে কাহিনী ঘটিয়া গিয়া স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। সাহিত্য জীবন্ত, তাহার প্রধান গুণ উধ্বমুখী অভীপ্সা এবং তাহার প্রাণ আইডিয়া। চরের প্রজারা জমিদার ও তাহার সাঙ্গোপাঙ্গোদের দ্বারা অপমানিত হয়। হেকমত সমস্ত জীবন মহাজনের ঋণ শোধ করিতেই চুরি করিয়া বেড়ায়। ফজল ছেলেমানুষ, কিন্তু জমিদারের নায়েব যে তাহার পিতাকে যথেষ্ট মর্যাদা দেয় নাই তাহার যথাযোগ্য প্রত্যুত্তর সে দিয়াছে। রূপজান কিছুতেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে পীরসাহেবের বিবি হইতে চায় নাই। জরিনা ধর্মভীরু। কিন্তু যে শাস্ত্র তাহার হৃদয়ের অন্তরতম সত্যকে উপলব্ধি করে নাই তাহাকে সে মানে নাই আর আদর্শবাদী বিপ্লবী এই উপন্যাসকে নূতন আলোকে উদ্ভাসিত করিয়াছে।
ড. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ইংরেজী বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।
১৯ জুন, ১৯৯১ তারিখে আবু ইসহাককে লিখিত তাঁর পত্রের কিছু অংশ।
সম্পূর্ণ পত্রটি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র-এর মাসিক মুখপত্র ‘বই’ নভেম্বর, ১৯৯১-এ প্রকাশিত।
.
…পদ্মার পলিদ্বীপ প্রতিভার সৃষ্টি। …এই উপন্যাসের জরিনার মত চরিত্র এক শরচ্চন্দ্র আঁকিতে পারিতেন। একাধিক বার পড়ার পরও আমি এই চরিত্রটির রহস্য অনুধাবন করার চেষ্টা করি। বারংবার প্রশ্ন জাগে–যদি হেকমত জীবিতাবস্থায় ফিরিয়া আসিত তাহা হইলে এই ধীর স্থির অবিচলিত রমণী কি উত্তর দিত।
আবু ইসহাক-এর নিকট ২৮ জুলাই, ১৯৯১ তারিখে ড. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত-এর লিখিত পত্র থেকে উদ্ধৃতি।
.
তাঁর প্রথম উপন্যাসের মতো এটাও পল্লীজীবন ভিত্তিক, এখানেও জীবনবোধ তীক্ষ্ণ, বাস্তব জীবনের পরিবেশন অকৃত্রিম ও সত্যনিষ্ঠ। তবে সূর্য-দীঘল বাড়ী–র চাইতে বর্তমান উপন্যাসের পরিমণ্ডল বৃহত্তর, জীবন সগ্রামের চিত্র এখানে আরো দ্বন্দ্বমুখর ও তীব্র নাটকীয়তা তা অধিকতর উজ্জ্বল। এবং কাহিনীর পটভূমি-পরিবেশও ভিন্নতর।…উপন্যাসটিতে লেখক একই সঙ্গে গভীরতা ও বিস্তার এনে একে এপিকধর্মী করার প্রয়াস পেয়েছেন।
দীর্ঘদিন পরে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশিত হলেও আবু ইসহাক ‘পদ্মার পলিদ্বীপ উপহার দিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর পূর্বখ্যাতিকে শুধু অমলিন রাখেননি, আমার বিবেচনায় তাকে আরো সম্প্রসারিত করেছেন।
অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : বেতার বাংলা, ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭.
.
আবু ইসহাকের এই উপন্যাসটিও সাহিত্য-রসাস্বাদক। প্রতিটি ব্যক্তির কাছে চ্যালেনজ রাখার সাহস রাখে। টানাপোড়েন সমাজ-জীবনের জলজ্যান্ত নিখুঁত ছবিতে উপন্যাসটি ভরিয়ে তোলায় লেখক আরেকবার প্রমাণ করলেন নিছক কাহিনী নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পারিপার্শ্বিক সমাজব্যবস্থা, জীবনসগ্রাম, প্রেম, যা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে ভাবায়, প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, কাদায়, সেগুলোই সাহিত্যের আসল মূলধন। এই মূলধনকে সাহিত্য করে তোলায় আবু ইসহাকের ক্ষমতা অপরিসীম। তাই এই রচনা সমাজের রসকষহীন প্রিনটেড ডকুমেন্ট হয়ে ওঠেনি।
… একথা স্বীকার করতেই হয়, আবু ইসহাক পাঠককে টেনে রাখার জাদু জানেন। গ্রাম্য সেন্টিমেন্টের সঙ্গে ত্রিকোণ প্রেম, ত্রিকোণ প্রেমের সঙ্গে বাস্তব বোধ, বাস্তব বোধের সঙ্গে গ্রাম্য রাজনীতি সব মিলিয়ে একটি আদর্শ উপন্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চতুরঙ্গ : কলকাতা : এপ্রিল, ১৯৮৭.
.
প্রাণবন্ত, যথাযথ আঞ্চলিক ভাষার বলিষ্ঠ ব্যবহার উপন্যাসকে খুবই আকর্ষণীয় করেছে; বলাবাহুল্য, পড়তে শুরু করলেই বই শেষ না করে থাকা সম্ভব নয়’–কথাটা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। একই কারণে বইয়ের প্রতিটি চরিত্রই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে।…জরিনার চরিত্রটি নায়ক ফজল ও নায়িকা রূপজানের চরিত্রের চাইতেও বেশি জীবন্ত মনে হয়েছে। যেন টলস্টয়ের বিখ্যাত নায়িকা আনা কারেনিনার গ্রাম-বাংলার চর অঞ্চলের অতি চেনা সংস্করণ।
দীপঙ্কর : মাসিক সাহিত্য পত্রিকা, ঢাকা : বৈশাখ, ১৩৯৪.
.
কিন্তু এই মিলনান্ত নাটকীয়তার সঙ্গে মিশেছে একটা বলিষ্ঠ আধুনিক চেতনা। এটাও এ উপন্যাসের একটা বৈশিষ্ট্য বটে, এ কালের আধুনিকতার সেই মেরুদণ্ডহীন শিল্পাদর্শ থেকে যা ভিন্ন। বিবাহ, তালাক ইত্যাদিকে ঘিরে ধর্মীয়-সামাজিক সংস্কার মনের অন্ধকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করে, এই গল্পের নায়ক সেটিকে পদ্মার জলে ভাসিয়ে দিয়েছে।
দৈনিক বাংলা : ঢাকা :১১ আষাঢ়, ১৩৯৪.
.
…’পদ্মার পলিদ্বীপ’ ব্যতিক্রমী চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, ভাষা বাকভঙ্গী নিয়ে এক অনবদ্য সৃষ্টি। সূর্য-দীঘল বাড়ীতে যে আবু ইসহাক অপরিমেয় অভিজ্ঞতায় সমতলের সাধারণ মানুষের জীবন-সগ্রামের নিবিড় কাহিনী তুলে ধরেছিলেন; পদ্মার পলিদ্বীপে তিনি হয়েছেন আরো বেশি জীবনঘনিষ্ঠ, চরের সংগ্রামী মানুষের ব্যথা বেদনায়, ক্রোধ-মমতায় আরো বেশি নিবিষ্ট। তাই ‘পদ্মার পলিদ্বীপে’ জীবন ধরা দিয়েছে কোন তন্ত্র কিংবা দর্শন নির্ভর করে নয়। এই উপন্যাসে চিত্রিত জীবন-সগ্রামে নদীনালা-নির্ভর বাংলাদেশের এক উপেক্ষিত অথচ বৃহত্তর পরিধির আকাশ-বাতাস, ঘাস-জমিন, মাছ-ফসল, প্রকৃতি আবহাওয়া যেন কথা কয়ে গেছে একান্ত নির্লিপ্তভাবে।….
দৈনিক ইত্তেফাক : ঢাকা : ২৯ অক্টোবর, ১৯৮৭.
.
‘পদ্মার পলিদ্বীপ’-এ চিত্রিত হয়েছে পদ্মার চরাঞ্চলের জীবন, এই জীবনের সঙ্গে আবু ইসহাক ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত।…তিনি একটি জটিল জীবনের চিত্র এঁকেছেন, এই জটিলতা সূর্য-দীঘল বাড়ীতে নেই ।…আবু ইসহাক পল্লীজীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জানেন। পদ্মার পলিদ্বীপে পল্লীজীবনের একটা বিশেষ দিক, চরাঞ্চলের সংঘাতময় জীবনের কথা নিয়ে লিখেছেন। এই বিশেষ দিকটির সঙ্গে তিনি উত্তমরূপে পরিচিত। বিশেষ আঞ্চলিক ভাষার জগৎকে তিনি জানেন এবং তার অনেক চিত্র দিয়েছেন।
উত্তরাধিকার : বাংলা একাডেমীর সাহিত্য-পত্রিকা, অকটোবর-ডিসেম্বর, ১৯৮৭.
.
সবশেষে ঔপন্যাসিক যে ভাবেই শেষ করুন না কেন ফজল-জরিনার মানবিক সম্পর্ককে সত্যিকারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং সামাজিকতা, ধর্মীয় অন্ধতা, বিবেকের উত্তেজনা সবকিছুকে ছাপিয়ে কিভাবে দুটি কাক্ষিত হৃদয় পরস্পর কাছাকাছি নিবিড় আলিঙ্গনে যায় তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। পটভূমি গ্রাম কিন্তু বিশ্লেষণটা আধুনিক এখানেই আবু ইসহাকের শিল্পের সার্থকতা।
দৈনিক বাংলা : ঢাকা : ৩ জুন, ১৯৯৪.
.
… Though the total context and plot of Ishaq’s second novel Padmar Palidwip is a different one, here the indomitable human spirit is also present as a theme as experienced in the first novel. The vast canvas encompassing the whole populace of the story’s locality, their thoughts and feelings, love and hatred, their invincible zeal and their defeat, gives the book and epic disposition.
০১.
পুর্বের আকাশ ফরসা হয়ে এসেছে। টুকরো টুকরো মেঘের ওপর লাল হলুদের পোচ। দপদপ করে জ্বলছে শুকতারা। ঐদিকে তাকিয়ে ফজল বলে, ধলপহর দিছেরে নূরু, পোয়াত্যা তারা ওঠেছে। আরো জলদি করণ লাগব।
দুজনেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সূর্য ওঠার আগেই কাঁকড়ামারির মুখে পৌঁছতে হবে তাদের। আলো দেখার সাথে সাথে মাছ তাদের রাতের আস্তানা ঢালু কিনারা ছেড়ে সরে যাবে গভীর পানিতে।
নদীর ঢালে জাল দিয়ে মাছ ধরছে চাচা। দশ বছরের ভাইপো ডুলা নিয়ে ফিরছে তার পিছু পিছু। চাচা জাল ঝেড়ে মাছ ফেলে। ভাইপো কুড়িয়ে নিয়ে রাখে ডুলার ভেতর। চিংড়ি আর বেলে মাছই বেশির ভাগ।
ফজল আবার জালটাকে গোছগাছ করে তার একাংশ কনুইর ওপর চড়ায়। বাকিটা দু’ভাগ করে দু’হাতের মুঠোয় তুলে নেয়। তারপর পানির দিকে এগিয়ে গিয়ে ঝাঁকি মেলে ছুঁড়ে দেয় নদীর পানিতে। দূরে গিয়ে অনেকটা জায়গার ওপর ওটা ঝপ করে ছড়িয়ে পড়ে।
ঝাঁকি জাল। কড়া পাক দেয়া সরু সুতোয় তৈরি। পানিতে ভিজে ভিজে সুতো পচে না যায় সেজন্য লাগানো হয়েছে গাবের কষ। কষ খেয়ে খেয়ে ওটা কালো মিশমিশে হয়েছে। জালের নিচের দিকে পুরোটা ঘের জুড়ে রয়েছে ‘ঘাইল’–মাছ ঘায়েল করার ফাঁদ। ঘাইলগুলোর সাথে লাগান হয়েছে লোহার কাঠি।
এ লোহার কাঠির কাজ অনেক। কাঠির ভারে ভারী হয় বলেই জালটাকে দূরে ছুঁড়ে মারা সম্ভব হয়। আর ওটা তাড়াতাড়ি পানির তলায় গিয়ে মাটির ওপর চেপে বসতে পারে। জাল টেনে তুলবার সময় আবার কাঠির ভারের জন্য ফাঁদগুলো মাটির ওপর দিয়ে ঘষড়াতে ঘষড়াতে গুটিয়ে আসে। গুটিয়ে আসে চারদিক থেকে মুখ ব্যাদান করে। জালের তলায় আটকে পড়া মাছ পালাবার পথ পায় না।
জালটা স্রোতের টানে কিছুটা ভাটিতে গিয়ে মাটির ওপর পড়েছে। ফজল তার কবজিতে বাঁধা রাশি ধরে ওটা আস্তে আস্তে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে টেনে তোলে। যেন কোনো জলরাক্ষসীর উপড়ে তোলা একমাথা চুল।
জালের মধ্যে ছড়ছড় আওয়াজ। চকচকে সাদা মাছগুলো অন্ধকারেও চেনা যায়। কয়েকটা টাটকিনি। নূরু খুশি হয়ে ওঠে।
ফজল মাছগুলো জাল থেকে ঝেড়ে ফেলে। নূরু চটপট হাত চালিয়ে ডুলায় তোলে শুনে শুনে, এক-দুই-তিন। বড় একটা টাটকিনি তার হাত থেকে পিছলে লাফ দিয়ে গিয়ে পানিতে পড়ে। ওটা ধরবার ব্যর্থ চেষ্টায় ওর কাপড় ভিজে যায়। কাদা মেখে যায় শরীরে।
জাল ফেলতে ফেলতে তারা উজানের দিকে এগিয়ে যায়। রাত তিন প্রহরের সময় তারা। মাছ ধরতে এসেছে। ডুলাটা মাছে ভরে গিয়েছিল একবার। ফজল সেগুলো গামছায় বেঁধে নিয়েছে। ডুলাটা আবারও ভরভর হয়েছে। ওটা বয়ে নিতে নূরুর কষ্ট হচ্ছে খুব।
পশু-পাখির ঘুম ভেঙেছে। জেগে উঠেছে কাজের মানুষেরা। গস্তি নৌকার হালে গুঁড়ি মারার শব্দ আসছে কেড়োত-কোড়োত। ঝপ্পত্ঝপ্ দাঁড় ফেলছে মাঝিরা। অনুকূল বাতাস পেয়ে নৌকায় পাল তুলে দিয়েছে কেউ বা রাত্রির জন্য কোনো নিরাপদ ঘোঁজায় তারা পাড়া গেড়ে ছিল। বিশ্রামের পর আবার শুরু হয়েছে যাত্রা। অন্ধকার মিলিয়ে যেতে না যেতে অনেক পানি ভাঙতে হবে তাদের।
আলো আর আঁধারের বোঝাঁপড়া শেষ হয়ে এসেছে। আঁচল টেনে আঁধার ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে। চরের লটা আর কাশবন মাথা বের করেছে। স্পষ্ট হয়ে উঠছে ঘোলাটে পানি।
আশ্বিন মাস। পদ্মা এখন বিগতযৌবনা। তার ভরা যৌবনের তেজ আর দুরন্তপনা থেমেছে। দুর্দম কাটালের কলকলানি আর নেই। পাড়ের দেয়ালে নিয়ন্ত্রিত তার গতি শ্রান্ত শিথিল স্রোত কুলুকুলু ধ্বনি তুলে বয়ে যাচ্ছে এখন।
দুদু, অ দুদু!
কি রে?
শিগগির আহো। ঐখানে একটা বড় মাছে ডাফ দিছে।
দুও বোকা! ডাফ দিয়া ও কি আর অইখানে আছে!
ফজল তবুও জাল ফেলে। পায় দুটো বড় বেলে মাছ। বেশ মোটাসোটা। সে নিজেই এ দুটো ডুলায় তুলে দেয়। নূরুর ছোট হাতের মুঠোয় এ দুটোকে সামাল দেয়া সম্ভব নয়।
ফজল চারদিকে চোখ বুলায়। তরতর করে উজিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা। মাঝনদীতে চেরা চিচিঙ্গের মতো লম্বা জেলে নৌকা মৃদু ঢেউয়ের দোলায় দুলছে এদিক ওদিক। জগতবেড় জাল ফেলে রাতভর প্রহর গুনছিল জেলেরা। রাতের অন্ধকার মিলিয়ে যাওয়ার আগেই জাল টানতে শুরু করেছে তারা।
পুব আকাশে সোনালি সূর্য উঁকি দিয়েছে। কালো রেখার মতো দিগন্তে গাছের সারির আভাস ফুটে উঠেছে।
ফজল এগিয়ে গেছে কিছু দূর। চটপট পা চালিয়ে নূরু ধরে ফেলে চাচাকে। সে সামনের দিকে তাকায়। কাঁকড়ামারির মুখ এখনো দেখা যায় না। তাদের ডিঙিটা কাঁকড়ামারির খাড়িতে লটাখেতের আড়ালে বেঁধে রেখে এসেছে তারা। সামনের বাঁকটা পার হলেই সেই খাড়ির মুখ দেখা যাবে। নদীর এ সরু প্রশাখাঁটি উত্তর-পশ্চিম থেকে চরের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে নদীর দক্ষিণ শাখায় গিয়ে মিশেছে।
ও-ও-ও-দুদু, দুদু…!
কিরে কি…কি?
ফজল জালের মাছ ঝেড়ে রেখে কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিল। নূরুর ভীত কণ্ঠের ডাক শুনে ছুটে আসে সে।
মাছ কুড়াবার সময় নূরুর ডান হাতে একটা কাঁকড়া লেগেছে। দুই দাঁড়া দিয়ে চেঙ্গি দিয়েছে ওর বুড়ো আর কড়ে আঙুলে।
ফজল দাঁড়া দুটো ছিঁড়ে ফেলে কাঁকড়াটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পাড়ের দিকে। দাঁড়া দুটো খসে পড়ে আঙুল থেকে।
ইস্, রক্ত ছুটছে রে! তুই নায় যা গিয়া নূরু। লটা চাবাইয়া ঘায়ে রস লাগাইয়া গো। আমি এডুক শেষ কইর্যা আইতে আছি।
নূরু ডুলাটা রেখে রওনা হয়। ওর লুঙ্গি থেকে পানি ঝরছে। পানিতে ভিজে শিটে মেরে গেছে পা দুটো। ভোরের বাতাসে শীত-শীত করছে, খাড়া হয়ে উঠেছে শরীরের রোম। হাঁটতে হাঁটতে সে কাঁকড়ামারির মুখে চলে যায়। লটাখেতের ভেতর দিয়ে পানি ভেঙে নৌকায় গিয়ে ওঠে।
দূরে স্টিমারের সিটি শোনা যায়। চাটগাঁ মেল বহর এসে ভিড়ল।
নূরু একটা লটা ভেঙে দাঁতের তলায় ফেলে। চিবিয়ে রস দেয় ঘায়ে। রসটা মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। সে লটা চিবিয়ে চিবিয়ে রস চুষতে শুরু করে দেয়।
জালের খেপ শেষ করেছে ফজল। দূর থেকে সে দেখতে পায়, নূরুলটা চিবোচ্ছে। তার হাসি পায়। সে ডেকে বলতে যাচ্ছিল, কিরে নূরু, গ্যাণ্ডারি পালি কই? কিন্তু বলতে পারে না সে। লটা চিবোতে দেখে হাসি পায় বটে, আবার একই সঙ্গে মায়াও লাগে। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে ওর। ভোর হয়েছে। ভোরের নাশতা চিড়ে-মুড়ি নিয়ে এতক্ষণে বসে গেছে সব বাড়ির ছেলে-মেয়েরা।
ফজল নৌকার দিকে আসছে। শব্দ পেয়ে নূরু চট করে লটাটা ফেলে দেয় পানিতে। চাচা দেখে ফেলেনি তো!
মুখ থেকে লটার রস নিয়ে সে ঘায়ে লাগাতে থাকে। চাচাকে বোঝাতে চায়, ঘায়ে রস লাগাবার জন্যই সে লটা চিবুচ্ছিল।
ফজলের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। হাসি গোপন করার জন্য সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, এই নূরু, আরো পাঁচটা ছাডা ইচা পাইছি রে! মুগুরের মতন মোট্টা এক-একটা।
ফজল নৌকায় ওঠে। ডুলার আর গামছায় বাঁধা মাছগুলো সে ঢেলে দেয় নৌকার উওরায়।
বেলে বা অন্য কোনো মাছ দেখে নয়, বড় বড় গলদা চিংড়ি দেখে খুশি হয় নূরু। সে একটা একটা করে গুনতে শুরু করে।
গলদা চিংড়ি আঠারোটা, বেলে মাছ ছোট-বড় মিলিয়ে তিন কুড়ি চারটা আর কিছু টাটকিনি আর গুড়োগাড়া মাছ।
নাও ছাইড়্যা দে নূরু। এইবার দাউন কয়ডা উড়াইয়া ফালাই
দু’জনেই বৈঠা হাতে নেয়। নূরু পাছায়, ফজল গলুইয়ে। কিছুদূর উজিয়ে তারা দাউন বড়শি তুলতে শুরু করে। লম্বা ডোরের সাথে খাটো খাটো ডোরে পরপর বাঁধা অনেকগুলো বড়শি। টোপ গেঁথে তিন জায়গায় পাতা হয়েছে এ বড়শি।
ফজল একটা একটা করে দাউন তিনটে তুলে নেয়। প্রথমটায় বেঁধেছে একটা শিলন। আর একটা ছোট পাঙাশ মাছ। দ্বিতীয়টা একদম খালি। তৃতীয়টায় বেঁধেছে বড় একটা পাঙাশ মাছ। তেলতেলে মাছটা চকচক করছে ভোরের রোদে।
ফজল বলে, মাছটা খুব বুড়ারে। তেল অইছে খুব। এইডার পেডির মাছ যে গালে দিব, বুঝব মাছ কয় কারে! মাইনষে কি আর খামাখা কয়–পক্ষীর গুড়া আর মাছের বুড়া, খায় রাজা আঁটকুড়া।
মাছ ধরা শেষ হয়েছে। এবার বেচবার পালা। নূরুকে বলতে হয় না। সে নৌকার মাথা ঘুরিয়ে দেয় নিকারির টেকের দিকে। ভাটির টানে ছুটছে নৌকা। নূরু হালটা চেপে ধরে বসে থাকে মাথিতে। ফজল তার হাতের বৈঠা রেখে মাছগুলো বাছতে শুরু করে। আকার অনুযায়ী সে হালি ঠিক করে রাখে। গোটা দশেক টাটকিনি আর ছ’টা গলদা চিংড়ি বাদে সবগুলোই বেচে দিতে হবে। বড় পাঙাশ মাছটা নিজেদের জন্য রাখবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তা হলে বাকিগুলোয় আর কটা পয়সাই আসবে। সের চারেক ওজনের পাঙাশ মাছটায় কমসে কম বারো গণ্ডা পয়সা পাওয়া যাবে। ঘরে চাল নেই। তেল-নুন আরো অনেক কিছুই কিনতে হবে। শুধু মাছ খেয়ে তো আর পেট ভরবে না। মাছটার দামে কেনা যাবে দশসের চাল– সংসারের চারদিনের খোরাক।
গত তিন বছর ধরেই টানাটানি চলছে সংসারে। ডিঙ্গাখোলা আর লক্ষ্মীচর ভেঙে যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে এ দুর্দিন। এই দুই চরে অনেক জমি ছিল তাদের। বছরের খোরাক রেখে অন্তত পাঁচশ টাকার ধান বেচতে পারত তারা। প্রতি বছর পাট আর লটা ঘাসে আসত কম করে হলেও হাজার টাকা। পদ্মার অজগরস্রোত গিলে খেয়েছে, উদরে টেনে নিয়েছে সব জমি। গুণগার নমকান্দি থেকে শুরু হয়েছিল ভাঙা। তারপর বিদগাঁও কোনা কেটে, দিঘলির আধাটা গিলে, কাউনিয়াকান্দা, ডিঙ্গাখোলা, লক্ষ্মীচর আর মূলভাওরকে বুকে টেনে চররাজাবাড়ির পাশ কেটে উন্মাদিনী পদ্মা গা দোলাতে দোলাতে চলে গেছে পুব দিকে। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এঁকেবেঁকে চলেছে ডানে আর বাঁয়ে।
চরের বসত আজ আছে, কাল নেই। নদীর খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করে চরের আয়ু। তার খুশিতে চর জাগে। তারই খেয়ালে ভেঙে যায় আবার। এ যেন পানি আর মাটির চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ, দশ, বিশ বছরের মেয়াদে বুকের ওপর ঠাই দেয় পানি। মেয়াদ ফুরালেই আবার ভেঙেচুরে নিজের জঠরে টেনে নেয়। চরবাসীরা তাই স্থায়ী হয়ে বসতে পারে না কোনো দিন। তাদের বাপ-দাদার ভিটে বলতে কিছু নেই। বাপ-দাদার কবরে চেরাগ জ্বালবার প্রয়োজন হয় না তাদের কোনো দিন। ফজলের বাবা এরফান মাতব্বর প্রায়ই একটা কথা বলে থাকে, চরের বাড়ি মাটির হাঁড়ি, আয়ু তার দিন চারি।
এরফান মাতব্বরের বাড়ি ছিল লক্ষ্মীচরে। এগারো বছর কেটেছিল সেখানে। এ এগারো বছরের আয়ু নিয়েই জেগেছিল চরটা। মেয়াদের শেষে পদ্মা গ্রাস করেছে। এই নিয়ে কতবার যে লক্ষ্মীচর জেগেছে আর ভেঙেছে তার হিসেব রাখেনি এরফান মাতব্বর। সে ঘর-দোর ভেঙে, পরিবার-পরিজন, গরু-বাছুর নিয়ে ভাটিকান্দি গিয়ে ওঠে। দুটো করে টিনের চালা মাটির ওপর কোনাকুনি দাঁড় করিয়ে খুঁটিহীন কয়েকটা দোচালা তৈরি হয় মামাতো ভাইয়ের বাড়ির পাশে। মাতব্বরের সংসার এভাবে ‘পাতনা দিয়ে ছিল বছর খানেক। তারপর ঐ চরেই জায়গা কিনে বছর দুয়েক হলো সে আবার বাড়ি করেছে।
ফজল আগে শখ করে মাছ ধরতে যেত। মাছ ধরাটা ছিল তখন নেশার মতো। এখন অনেকটা পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ উপজীবিকার আশ্রয় না নিয়ে উপায় ছিল না। সংসারে খাবার লোক অনেক। সে তুলনায় এখন জমির পরিমাণ সামান্য। চরদিঘলিতে মাত্র কয়েক নল জমি আছে তাতে যে ধান হয় তাতে টেনেটুনে বছরের চারমাস চলে। বাকি আটমাসের পেটের দায় ছাড়াও খাজনা রয়েছে। চর থাকুক আর না থাকুক জমিদারের নায়েবরা খাজনার টাকা গুনবেই। নয়তো তাদের কোনো দাবিই থাকবে না যদি আবার কখনো চর জেগে ওঠে সে এলাকায়।
ফজল লুকিয়ে-চুরিয়ে মাছ বেচে। গেরস্তের ছেলের পক্ষে মাছ-বেচা নিন্দার ব্যাপার। আত্মীয়-কুটুম্বরা জানতে পারলে ছি-ছি করবে। হাসাহাসি করবে গাঁয়ের লোক। দুষ্ট লোকের মুখে মুখে হয়তো একদিন মালো বা নিকারি খেতাব চালু হয়ে যাবে।
দিনের পর দিন অভাব অনটনের ভেতর দিয়ে সংসার চলছিল। মাছ বেচার কথা কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবেনি ফজল। শখ করে একদিন সে লেদ বড়শি নিয়ে নদীতে গিয়েছিল। বড়শিতে উঠেছিল একটা মস্ত বড় আড় মাছ। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল নিকারি-নৌকা। মাছ দেখে ডাক দেয় মাছের ব্যাপারি, ও ভাই মাছটা বেচুবানি?
ফজল কৌতুক বোধ করে। মজা করবার জন্য উত্তর দেয় সে, হ বেচুম। কত দিবা?
তুমি কত চাও?
এক টাকা।
এক টা–কা! মাছখানের লগে নাওখান দিবা তো?
উঁহু, বৈডাখান দিমু।
বোঝলাম, বেচনের মত নাই তোমার। বেচতে চাও তো উচিত দাম কইয়্যা দ্যাও।
তুমিই কও।
আটআনা দিমু।
আট আনা!
পয়সার অঙ্কটা মধুর লাগে ফজলের কানে। লোভ হয় তার। পয়সার অভাবে তিনদিন ধরে একটা বিড়ির মুখ দেখেনি সে।
সে এদিক ওদিক তাকায়। না, ধারে কাছে কেউ নেই। নিকারি-নৌকাটা ভাটিয়ে গিয়েছিল কিছুদূর। ফজল ডাক দেয়, ও ভাই, আইও লইয়া যাও।
নিকারি নৌকায় মাছটা তুলে দিয়ে আট আনা গুনে নেয় ফজল। তার মাছ বেচার বউনি হয় এভাবে।
সেদিন কয়েকটা ছোট ছোট শিলন, ট্যাংরা মাছও পেয়েছিল ফজল। সেগুলো নিয়ে যখন সে বাড়ি আসে তখন মা চেঁচিয়ে ওঠে, মাছ খাইলেই দিন যাইব আঁ? এতদিন বীজ-ধান ভাইন্যা খাওয়াইছি। দেহি আইজ খাওয়ন আহে কইতন।
মাছগুলোকে ধপাত্ করে মাটিতে ফেলে ফজল ডিঙিতে উঠেছিল আবার ডিঙি ছুটিয়ে হাশাইলের বাজার থেকে মাছ-বেচা পয়সায় কিনে এনেছিল ছয় সের চাল।
তারপর থেকে মাছ বেচা পয়সায় সংসারের আংশিক খরচ চলছে। ফজলের বাবা-মা প্রথম দিকে আপত্তির ঝড় তুলেছিল। অভাবের তাড়নায় সে ঝড় এখন শান্ত হয়ে গেছে।
মাছের গোনা-বাছা শেষ করে ফজল। মাছের গায়ের লালায় তার হাত দুটো চটচট করে। হাত ধুয়ে সে গামছায় মোছে। তারপর গলুইয়ে গিয়ে মাথির চরাট সরিয়ে বের করে বিড়ি আর ম্যাচবাতি।
অত কিনার চাপাইয়া ধরছস ক্যান্ নূরু? সামনে ফিরা আওড়। আরো মাঝ দিয়া যা।
নুরুকে সাবধান করে দেয় ফজল। কিনার ঘেষে কিছুদুর গেলেই আবর্ত। সেখানে স্রোত বইছে উল্টোদিকে। ওখানে গিয়ে পড়লে নৌকা সামলানো সম্ভব হবে না ছোট ছেলেটির পক্ষে। এক ঝটকায় তাদের নৌকা বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যাবে অনেক দূর।
নূরু নৌকা সরিয়ে নিয়ে যায় কিনারা থেকে দূরে। মাঝের দিকে সোতের টান বেশি তরতর করে এগিয়ে যায় নৌকা।
ফজল এবার বিড়ি ধরিয়ে মাথিতে চেপে বসে। সে বিড়িতে লম্বা টান দেয় আর মুখ ভরে ধোয়া ছাড়ে।
দূরে নদীর মাঝে সাদা সাদা দেখা যায়, কি ওগুলো?
ফজল চেয়ে থাকে। তার চোখে পলক পড়ে না। ঐখানেই বা ওর আশেপাশে কোথাও ছিল তাদের খুনের চর।
নূরুকে সরিয়ে বৈঠা হাতে নেয় ফজল। জোর টানে সে নৌকা ছোটায় পুব-উত্তর কোণের দিকে।
কিছুদূর গেলেই সাদা বস্তুগুলো স্পষ্ট দেখা যায়।
কি আশ্চর্য! নদীর মাঝে হেঁটে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো বক।
ফজল বৈঠা হাতে দাঁড়িয়ে যায়। কিছু দেখবার জন্য সে উত্তর দিকে তাকায়। হ্যাঁ ঐ তো, ঐ-তো বানরির জোড়া তালগাছ!
উল্লসিত হয়ে ওঠে ফজল। বলে, চর জাগছেরে নূরু, চর জাগছে!
কই, কই?
ঐ দ্যাখ, ঐ যে ঐ।
বকগুলো আঙুল দিয়ে দেখায় ফজল।
আনন্দে লাফিয়ে ওঠে নূরু। সে দেখতে পায় হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছে বকগুলো। মাছ ধরার জন্য গলা বাড়িয়ে আছে। লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মারছে মাঝে মাঝে।
এইডা কি আমাগ চর, দুদু?
হরে হ। আমাগ খুনের চর। ঐ দ্যাখ, ঐযে দ্যাখা যায় বানরির জোড়া তালগাছ। ছোডকালে আমরা যখন ঐ চরে যাইতাম তখন সোজা উত্তরমুখি চাইলে দ্যাখা যাইত আসুলির ঐ উঁচা তালগাছ দুইডা।
ফজল বকগুলোর দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, নূরু, তুই বৈঠা আতেল। টান দে জোরে, বকগুলোরে দেখাইয়া দেই।
ক্যান্ দুদু?
এখনো কেও টের পায় নাই। বক দেখলেই মাইনষে টের পাইয়া যাইব, চর জাগছে।
চাচা-ভাইপো বৈঠা টেনে এগিয়ে যায়। কিছুদূর গেলেই বৈঠা ঠেকে মাটির সাথে।
আর আউগান যাইবনারে নূরু, চড়ায় ঠেইক্যা যাইব নাও। মাডিতে নাও কামড় দিয়া ধরলে মুশকিল আছে। তখন দুইজনের জোরে ঠেইল্যা নামান যাইব না।
বৈঠাটানা বন্ধ করে দুজনেই। বকগুলো এখনো বেশ দূরে। ফজল পানির ওপর বৈঠার বাড়ি মারে ঠপাস-ঠপাস। কিন্তু বকগুলো একটুও নড়ে না। ওরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, এত দূরের শত্রুকে ভয় করবার কিছু নেই।
ফজল আরো কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যায় নৌকা। কিন্তু কিভাবে তাড়াবে বক? মারবার মতো একটা কিছু পেলে কাজ হত।
হঠাৎ ফজলের নজর পড়ে বেলে মাছগুলোর ওপর। সে ডওরা থেকে একটা বেলে মাছ নিয়ে জোরে বকগুলোর দিকে ছুঁড়ে মারে। বকগুলো এবার উড়াল দেয়। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই আবার নেমে পড়ে চরে।
বকগুলোতো বড় বজ্জাতরে। এইখানে মাছ খাইয়া জুত পাইয়া গেছে। অত সহজে যাইব না।
দুদু, পানিতো এটটুখানিক, আমি নাইম্যা গিয়ে দেখাইয়া দিয়া আহি?
নারে, তুই পারবি না। কাফালের মইদ্যে পইড়া যাবি।
ফুঁত্-ফুঁত্।
স্টিমারের ফুঁ শুনে ফজল ও নূরু তাকায়। চাটগাঁ মেল আসছে। সামনে নৌকা পড়েছে। বোধ হয়। তাই ফুঁত্-ফুঁত্ শব্দ করল দু’বার।
ফজল বলে, খাডো চুঙ্গার জাহাজ। শুয়োরের মতোন ‘গ’ দিয়া আইতে আছেরে! শিগগির টান দে নূরু। নাওডা সরাইয়া লইয়া যাই। চড়ার উপর ঢেউয়ে আছাড় মারব।
নৌকা নিয়ে সরে যায় তারা। তাদের অনেক দূর দিয়ে নতুন চরেরও উত্তর পাশ দিয়ে স্টিমার চলে যায়। তার চলার পথের আন্দোলিত পানি ঢেউ হয়ে ছুটে আসছে। ফজল ঢেউ বরাবর লম্বিয়ে দেয় নৌকা, শক্ত হাতে হাল ধরে। নূরুকে বলে, তুই বৈডা থুইয়া দে নূরু। শক্ত কইর্যা পাডাতন ধইর্যা থাক। উজান জাহাজে ঢেউ উঠব খুব।
ডলে-মুচড়ে উঁচু হয়ে ঢেউ আসছে। বিপদ বুঝে বকগুলো এবার উড়াল দেয়।
দ্যাখ দ্যাখ নূরু। ঐ দ্যাখ, বকগুলো উড়াল দিছে।
বকগুলোর অবস্থা দেখে নূরুর হাসি পায়। সে বলে, এইবার। এইবার যাও ক্যান্? ঢেউয়ের মইদ্যে ডুবাইয়া ডুবাইয়া মাছ খাও এইবার।
বকগুলো ওপরে উঠে দু-একবার এলোমেলো চক্কর দেয়। নিচে ঢেউয়ের তাণ্ডব দেখে নামবার আশা ছেড়ে দেয় ওরা। তারপর ঝাক বেঁধে পশ্চিম দিকে উড়ে চলে যায়।
ঢেউয়ের বাড়িতে ওঠানামা করছে নৌকার দুই মাথি। এক মাথিতে ফজল, অন্য মাথির ঠিক নিচেই পাটাতন ধরে বসে আছে নূরু। ফজল বলে, নূরু, সী-সঅ, সী-সঅ, কিরে ডর লাগছে নি? সী-সঅ, সী-সঅ।
ঢেউ থামলে নূরু বলে, সী-সঅ কি দুদু?
সী-সঅ একটা খেইল। বাচ্চারা খেলে। নারাণপুর চৌধুরী বাড়ি খাজনা দিতে গেছিলাম। সেইখানে দেইখ্যা আইছি।
একটু থেমে সে আবার বলে, আইজ আর নিকারির টেঁকে যাইমু নারে।
ক্যান?
ক্যান্ আবার! বাড়িতে খবর দিতে অইব না! মাছ বেচতে গেলে দেরি অইয়া যাইব অনেক। তুই বৈডা নে শিগগির। টান দে।
দু’জনের বৈঠার টান, তার ওপর অনুকূল স্রোত। নৌকা ছুটছে তীরের মতো।
ফজল নলতার খাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় নৌকা। নতুন চর দখলের এলোমেলা ভাবনায় আচ্ছন্ন তার মন।
খাঁড়ির পুবপাড়ে ঢোনের মধ্যে বাঁধা একটা নৌকা। ওটার ওপর চোখ পড়তেই ফজলের চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে যায়। নৌকাটা তার চেনা।
নূরু সামনের দিকে চেয়ে বৈঠা টেনে যাচ্ছে। ফজল একবার দেখে নেয় তাকে। তারপর সে চরাটের ওপর নিঃশব্দে দাঁড়ায়, তাকায় পুবদিকে।
কিছুদূরে কলাগাছে ঘেরা একটা বাড়ি। কলাগাছের ফাঁক দিয়ে বাড়ির উঠানের একাংশ দেখা যায়। আর দেখা যায় একখানা লাল শাড়ি হাওয়ায় দুলছে।
ফজলের বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে। সে বসে পড়ে। নূরুকে বলে, মোল্লাবাড়ি চিন্যা যাইতে পারবি নূরু?
হ্যাঁ, নূরু ঘাড় কাত করে।
কোনমুখি ক দেখি?
নূরু দাঁড়ায়। পুবদিকে তাকিয়ে বলে, ও-ই তো দ্যাখা যায়।
ঠিক আছে। কয়েকটা মাছ দিয়া আয় গিয়া। এতগুলো মাছ আমরা খাইয়া ছাড়াইতে পারমু না।
ফজল পুবপাড়ে নৌকা ভিড়ায়। উওরায় রাখা মাছগুলো হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে সে জিজ্ঞেস করে, কোনডা দিমুরে নূরু? ইচা, না পাঙাশ?
বড় পাঙাশটা দ্যাও।
আইচ্ছা, পাঙাশ মাছটাই লইয়া যা। আর তোর নানাজানরে আমাগ বাড়ি জলদি কইর্যা আইতে কইস। জরুরি কাম আছে। আমার কথা কইলে কিন্তু আইব না। তোর দাদাজানের কথা কইস।
আইচ্ছা।
নূরু চরাটের নিচে দলা-মুচড়ি করে রাখা জামাটা পরে নেয়।
ফজল একখণ্ড রশি মাছটার কানকোর ভেতর ঢোকায়। মুখ দিয়ে সেটা বের করে এনে দু’মাথায় গিঠ দিয়ে ঝুলনা বাঁধে।
মাছটা হাতে ঝুলিয়ে পাড়ে নেমে যায় নূরু। ফজল নৌকা ছেড়ে দেয়। বৈঠায় টান দিতে দিতে সে ডেকে বলে, শোন্ নূরু, চর জাগছে–এই কথা কই না কারোরে, খবদ্দার! তোর নানার লগে আইয়া পড়িস। ইস্কুলে যাইতে অইব কিন্তু।
আইচ্ছা।
বড় মাছ। হাতে বুঝিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে নূরুর। সে হাতটা উঁচু করে নিয়েছে। তবুও মাছের লেজের দিকটা মাটির ওপর দিয়ে ঘষড়াতে ঘষড়াতে যাচ্ছে।
.
বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়ায় ফজল। শব্দ পেয়ে ছোট বোন আমিনা ছুটে আসে।
নূরু কই, মিয়াভাই?
ও মোল্লাবাড়ি গেছে। তুই মাছগুলোরে ডুলার মইদ্যে ভইরা লইয়া আয়।
ফজল লাফ দিয়ে নৌকা থেকে নামে। থালা-বাসন নিয়ে বরুবিবি ঘাটের দিকে আসছিল। ফজল জিজ্ঞেস করে, বাজান কই, মা?
ঘরে হুইয়া রইছে। শরীলডা ভালো না।
ঘরের দরজায় পা দিয়ে ফজল ডাকে, বাজান।
কিরে? শুয়ে শুয়ে সাড়া দেয় এরফান মাতব্বর।
চর জাগছে।
চর জাগছে!
হ, আমাগ খুনের চর।
খুনের চর!
এরফান মাতব্বর বিছানা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে। কার কাছে হুনলি?
হুনি নাই। দেইখ্যা আইছি। এক ঝক বক বইছিল চরে।
খুনের চর ক্যামনে বুঝলি?
উত্তরমুখি চাইয়া দ্যাখলাম, বানরির জোড়া তালগাছ।
এরফান মাতব্বর চৌকি থেকে নেমে বেরিয়ে আসে। কিছুদিন থেকেই ভালো যাচ্ছিল না তার শরীর। মাঝে মাঝে জ্বর হয়। আজও ভোর বেলায় শীত-শীত করছিল। কাঁপুনি শুরু হয়েছিল শরীরে। জ্বর আসার পূর্বলক্ষণ। তাই সে বিছানায় বসে বসে কোনো রকমে ফজলের নামাজ পড়েই আবার শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু এ মুহূর্তে খবর শুনে শীত আর কাঁপুনি কোথায় পালিয়ে গেছে! বার্ধক্যে নুয়ে পড়া শরীরটা সোজা হয়ে উঠেছে। পাকা জ্বর নিচে বড় বড় হয়ে উঠেছে ঘোলাটে চোখদুটো। মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে শিথিল হাত।
ফজু, শিগগির মানুষজনরে খবর দে। দ্যাখ, জমিরদ্দি, লালুর বাপ, রুস্তম, আহাদালী, মেহের মুনশি কে কুনখানে আছে। মান্দ্রায় আর শিলপারনে কারুরে পাডাইয়া দে। কদম শিকারি, ধলাই সরদার, জাবেদ লশকর আর রমিজ মিরধারে খবর দে। নাশতা খাইছস?
না, পরে খাইমু।
আইচ্ছা, পরেই খাইস। তুই বাইর অইয়া পড়। ঢোলে বাড়ি দিসনা কিন্তু। চর জাগনের কথা কানে কানে কইয়া আহিস। দুফরের মইদ্যে বেবাক মানুষ আজির অওয়ন চাই। যার যার আতিয়ার যে লগে লইয়া আহে।
ফজল রওনা হয়।
ফজু, হোন। ভাওর ঘরের বাঁশ-খুঁড়া নাও ভইরা লইয়া আইতে কইস যার যার।
একটু দম নিয়ে হাঁক দেয় মাতব্বর, নূরু…নুরু কইরে? তামুক ভইর্যা আন।
নূরুরে মোল্লাবাড়ি পাডাইছি। মোল্লার পো-রে আইতে খবর কইয়া আইব। ফজল বলে।
আইচ্ছা যা তুই, আর দেরি করিস না।
মাতব্বর মনে মনে বলে, মোল্লা কি আর আইব? মাইয়া আটকাইছে। চোরামদ্দি এহন কোন মোখ লইয়া আইব আমার বাড়ি।
ফজল চলে গেলে বিড়বিড় করে বলতে থাকে মাতব্বর, আইব না ক্যান্? আইব– আইব। চর জাগনের কথা হুনলে শোশাইয়া আইব, হুহ । না আইয়া যাইব কই? কলকাডি বেবাক এই বান্দার আতে। দেহি, এইবার আমার পুতের বউ ক্যামনে আটকাইয়া রাহে।
মাতব্বর ঘরে যায়। আফার থেকে ঢাল-কাতরা, লাঠি-শড়কি নামিয়ে উঠানে নিয়ে আসে।
থালা-বাসন মেজে ঘাট থেকে ফিরে আসে বরুবিবি। স্বামীকে হাতিয়ার নাড়াচাড়া করতে দেখে সে অবাক হয়। কিছুক্ষণ আগেই যে মানুষটিকে সে শুয়ে শুয়ে কাঁপতে দেখে গেছে, সে মানুষটিই কিনা এখন বাইরে বসে ঢাল-কাতরা-শড়কি নাড়াচাড়া করছে। সে বলে, এই দেইখ্যা গেলাম ওনারে বিছানে। কোনসুম আবার এগুলা লইয়া বইছে? ওনারে কি পাগলে পাইল নি?
হ, পাগলেই পাইছে। তুমি হোন নাই, ফজু কয় নাই কিছু?
কই, না তো!
আরে, আমাগ চর জাগছে।
চর জাগছে! কোন চর?
খুনের চর!
খুনের চর?
বরুবিবির বুকের ভেতর কে যেন চেঁকির পাড় দিতে শুরু করেছে। তার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। কোনো রকমে রান্নাঘরে গিয়ে সে বসে পড়ে। তার মনের আবেগ, তার বুকের ঝড় বিলাপ হয়ে বেরোয়, ও আমার রশুরে, বাজান। কত বচ্ছর না যে পার অইয়া গে-ল, রশু-রে-আ-মা-র। তোরে না-যে ভোলতে না-যে পা-রি, মানিকরে-আ-মা-র।
দশ বছরের পুরাতন শোক। সংসারের পলিমাটিতে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। সে মাটি এখন কাঁপতে শুরু করেছে। মাতব্বরের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তার দুচোখের কোলে পানি জমে। ঝাঁপসা দৃষ্টি মেলে সে চেয়ে থাকে হাতিয়ারগুলোর দিকে।
.
০২.
খুনের চর।
দশ বছর আগে একবার জেগেছিল এ চর। তখন নাম ছিল লটাবনিয়া। এ চরের দখল নিয়ে মারামারি হয়েছিল দুই দলে। দুই দলের দুই প্রধান ছিল এরফান মাতব্বর আর চেরাগ আলী সরদার। দুই দলের পাঁচজন খুন হয়েছিল। এরফান মাতব্বরের দলের দু’জন আর চেরাগ আলীর দলের তিনজন। এরপর থেকেই লোকের মুখে মুখে লটাবনিয়ার নাম হয়ে যায় খুনের চর।
এরফান মাতব্বরের বড় ছেলে রশিদ চরের এ মারামারিতে খুন হয়েছিল।
বাইশ বছরের জোয়ান রশিদ। গায়ে-পায়ে বেড়ে উঠেছিল খোদাই ষাড়ের মতো। মাত্র বিশজন লোক নিয়ে সে চেরাগ সরদারের শ’খানেক লোকের মোকাবেলা করেছিল।
সেদিন ছিল হাটবার। চরের পাহারায় যারা ছিল তাদের অনেকেই সেদিন দিঘিরপাড় গিয়েছিল হাট-সওদা করতে। সত্তরটা ভাওর ঘরের অর্ধেকের বেশি ছিল সেদিন ঝাঁপবন্ধ। একটানা দুমাস ধরে পাহারা দিতে দিতে তাদের মধ্যে একটা অবহেলার ভাব এসে গিয়েছিল। তাদের কাছে ফুরিয়ে এসেছিল পাহারা দেয়ার প্রয়োজন। বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই ভেবে কেউ কেউ আবার ভাওর ঘরে বউ ছেলে-মেয়ে এনে ঘর-সংসারও পেতে বসেছিল। চেরাগ সরদার যে এমনি একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তারা।
দুপুর তখন গড়িয়ে গেছে। ভাওর ঘরের ছায়ায় বসে ইলশা জাল বুনছিল রশিদ। আর পাশে বসে গল্প করছিল তার দোস্ত রফি। হঠাৎ তাদের নজর পড়ে নদীর দিকে।
ষোলটা নৌকা বোঝাই লোক এ চরের দিকে আসছে।
তারা দুজনেই লাফ দিয়ে দাঁড়ায়, রশিদ গলার সবটুকু জোর দিয়ে হাঁক দেয়, আইছে রে-এ-এ, আইছে, শিগগির বাইর-অ-আউগ গা…আউগ গা-আ-আ-আ…
রফিও গলা ফাটিয়ে হাঁক দেয়, তোরা কইরে—? আউগ্ গা–শিগগির আউগগা।
এদিকে-ওদিকে যারা ছিল তারা যার যার ভাওর ঘর থেকে বেরোয়। চারদিকে চিৎকার আর শোরগোল।
রশিদ আর রফি গুলেল বাঁশ আর লুঙ্গির টোপর ভরে মাটির গুলি নিয়ে নদীর দিকে দৌড় দেয়। তাদের পেছনে আসে বাকি আর সবাই। কারো হাতে ঢাল-কাতরা, কারো হাতে শুধু শড়কি, কারো হাতে লম্বা লাঠি।
রশিদ আর রফি গুলির পর গুলি মারে নৌকার লোকদের ওপর। কিন্তু তারা বেতের ঢাল দিয়ে ফিরিয়ে দেয় সে গুলি। দুই বন্ধু বুঝতে পারে, এভাবে ওদের ঠেকানো যাবে না। তারা দৌড়ে গিয়ে ভাওর ঘর থেকে নিজেদের ঢাল-শড়কি নিয়ে আসে।
নৌকাগুলোর দশটা কিনারায় এসে ঠেকে। বাকি ছয়টা বড় নৌকা। ভাটা-পানিতে এগোতে না পেরে সেগুলো মাথা ঘোরায় পাশের চলপানির দিকে।
আধ-হাঁটু পানিতে নামে চেরাগ সরদারের লোকজন। ঢাল-কাতরা, লাঠি-শড়কি নিয়ে তারা মার-মার করতে করতে এগিয়ে আসে।
চরের কাইজ্যায় একদল চায় অন্য দলকে হটিয়ে তাড়িয়ে দিতে। বেকায়দায় না পড়লে খুন-খারাবির মধ্যে কেউ যেতে চায় না। খুন-জখম হলেই থানা-পুলিসের হাঙ্গামা আছে, মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলা আছে, জেল-হাজতের ভয় আছে।
চেরাগ সরদারও তাই খুনাখুনি এড়াবার জন্য হাটের দিনটি বেছে নিয়েছিল। সে ভেবেছিল, তাদের এত লোকজন ও মারমার হামাহামি শুনে এরফান মাতব্বরের গুটিকয়েক লোক চর ছেড়ে ভেগে যাবে। তখন সহজেই দখল করা যাবে চর।
কিন্তু অত সহজে চারটা দখল করা যায়নি।
রশিদ তার লোকজন নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। চেরাগ সরদারের দল ডাঙায় উঠতে না উঠতেই শুরু হয়ে যায় মারামারি।
দলের একজনকে খুন হতে দেখেই রশিদ খেপে যায়। মারমার ডাক দিয়ে এগিয়ে যায় সে। তার শড়কির ঘায়ে একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে তিরতিরে পানির মধ্যে।
প্রথম দশটা নৌকা থেকে দলটি নেমেছিল, রশিদ ও তার দল তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যায়। আরো একটা লাশ ফেলে তাদের অনেকেই পিছু হটে নৌকার দিকে। কিন্তু আরো ছ’খানা নৌকায় করে যারা এসেছিল তারা অন্য দিক দিয়ে নেমে এসে রশিদ ও তার লোকদের ঘিরে ফেলে। আর সকলের মতো নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে রশিদও বাঁচতে পারত। সাঁতার দিয়ে নাগরারচরে গিয়ে উঠতে পারত। কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়ায়। আরো একজনের জান নিয়ে নিজের জান দেয় সে।
তারপর থানা-পুলিস, তদন্ত-তল্লাশ, ধর-পাকড়, হাজত। আদালতে দুই দলের বিরুদ্ধেই মামলা ওঠে খুন আর হাঙ্গামার। এক মামলায় আসামি চেরাগ সরদার ও তার দলের বিশজন; অন্য মামলায় এরফান মাতব্বরের দলের তেরো জন।
আসামিরা সবাই দিশেহারা। তারা বুঝতে পারে, ফাঁসির দড়ি না হোক, ঘানির জোয়াল ঝুলে আছে সবারই ঘাড়ের ওপর।
এখন কি করা যায়?
চেরাগ সরদার নিজেই এক মামলার আসামি। তাই প্রথমে সে-ই আপোসের প্রস্তাব পাঠায় এরফান মাতব্বরের কাছে।
আপোসের কথা শুনেই রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে মাতব্বরের। তার জানের টুকরো ছেলেকে যারা খুন করেছে, তাদের সাথে আপোস!
প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল এলাকার দফাদার সামেদ আলী। মাতব্বরের দলেরও জনকয়েক এসেছিল তার পিছু পিছু।
ক্রোধে মাতব্বরের মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ পর্যন্ত কোনো কথা বেরোয় না। শেষে নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তেজিত স্বরে সে বলে, না, কিছুতেই না। ওর সাথে কোনো আপোস নাই। ওরে জেলের ভাত না খাওয়াইয়া ছাড়মু না–ছাড়মু না, কইয়া দিলাম। তুমি যাও, কও গিয়া তারে।
মাতব্বরের দলের আহাদালী বলে, হে অইলে জেলের ভাত তো আমাগ কপালেও লেখা আছে, মাতব্বরের পো।
তার কথায় সায় দিয়ে জমিরদ্দি বলে, মিটমাট কইর্যা ফালানডাই ভালো। কেবুল ওগই জেলের ভাত খাইয়াতে পারতাম তয় এক কথা আছিল। ওগ সাথ সাথ যে আমাগও জেলে যাইতে অইব।
মাতব্বর এ কথা ভাবেনি তা নয়। কিন্তু আপোসের কথা ভাবলেই তার প্রতিশোধকামী মনে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। ক্রোধে ফুলে ওঠে সারা শরীর। তার কাছে আপোস মানেই পরাজয়, মৃত ছেলের স্মৃতির অবমাননা।
শেষ পর্যন্ত দলের লোকজনের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না এরফান মাতব্বর। চেরাগ সরদার আর চরের দাবি করবে না, এই শর্তে আপোস করতে রাজি হয় সে। এ সিদ্ধান্ত নিতে দশ দিন লেগেছিল তার।
কিন্তু আপোস করলেই তো আর চুকে গেল না সব। মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায়? খুনের মামলা। এ তো ছেলেখেলা নয় যে, চায় মন খেলোম, না চায় মন চলোম।
দফাদার সে বুদ্ধিও দেয়, তার লেইগ্যা চিন্তা নাই। আদালতে উল্ট-পাল্ডা, আবোল তাবোল সাক্ষী দিলেই মামলা ঢিশমিশ অইয়া যাইব। কোন সওয়ালের পিডে কি জওয়াব দিতে অইব তা উকিলরাই ঠিক কইর্যা দিব।
শেষে সে রকম ব্যবস্থাই হয়েছিল। দুই বিবাদী পক্ষের দুই উকিল মিলে সাক্ষীদের ভালো করে শিখিয়ে পড়িয়ে দেন। সরকার পক্ষের উকিলের প্রশ্নের জবাবে সাক্ষীরা সেই শেখানো বুলি ছেড়ে দেয়। একজনের জবানবন্দির সাথে আর একজনেরটার মিল হয় না। ঘটনা চোখে দেখেছে এমন সাক্ষীরাও বিনা দ্বিধায়, কোনো রকম লজ্জা-শরমের ধার না ধেরে বলে যায়, তারা নিজের চোখে দেখেনি, অমুকের কাছে শুনেছে। সাক্ষীদের কয়েকজনকে বিরুদ্ধাচারী ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কোনো ভাবেই সরকারবাদি মামলা টেকে না। যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে দুটো খুনের মামলার আসামিরাই খালাস পেয়ে যায়।
খুনাখুনির পরই চারটাকে ক্রোক করে সাময়িকভাবে সরকারি দখলে রাখার হুকুম দিয়েছিল আদালত। ভবিষ্যতে যাতে আবার শান্তিভঙ্গ না হয় সে জন্যই থানার পুলিস এ ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ করেছিল। পরে যে পক্ষ মামলায় জিতবে, সে-ই হবে চরের মালিক।
আপোসের শর্ত অনুসারে চেরাগ সরদার আর চরের দাবি করেনি। তাই আদালতের রায়ে এরফান মাতব্বরই চরটা ফিরে পায় আবার।
খবর পেয়ে আটিগাঁর পাঞ্জু বয়াতি বখশিশের লোভে এরফান মাতব্বরের বাড়ি গিয়ে হাজির হয়। দোতারা বাজিয়ে সে নিজের বাধা পুরাতন একটা গান জুড়ে দেয়–
লাঠির জোরে মাটিরে ভাই
লাঠির জোরে মাটি,
লাঠালাঠি কাটাকাটি,
আদালতে হাঁটাহাঁটি,
এই না হলে চরের মাটি
হয় কবে খাঁটি…রে।
পাঞ্জু বয়াতির এ গান এখন চরবাসীদের কাছে আপ্ত বাক্যের মর্যাদা লাভ করেছে। তাদের মুখে মুখে ফেরে এ গান। তাদের অভিজ্ঞতার থেকেও তারা বুঝতে পেরেছে, নতুন চর জাগলে এসব ঘটনা ঘটবেই। লটাবনিয়ার বেলায়ও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। লাঠালাঠি হলো, কাটাকাটি হলো। আদালতে হাঁটাহাঁটিও হলো প্রায় দু’বছর। তারপর ফিরে এল শান্তি। খাঁটি হলো চরের মাটি।
এরফান মাতব্বর তার বর্গাদার ও কোলশরিকদের মধ্যে চরের জমি ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয়। চরের বুকে গড়ে ওঠে নতুন বসতি। শুরু হয় নতুন জীবন।
কিন্তু এত কাণ্ডের পর খাঁটি হলো যে মাটি, তা আর মাত্র তিনটি বছর পার হতে না হতেই ফাঁকি হয়ে গেল। পদ্মার জঠরে বিলীন হয়ে গেল খুনের চর।
সেই খুনের চর আবার জেগেছে।
এরফান মাতব্বর গামছায় চোখ মোছে। বরুবিবির বিলাপ থেমেছে কিন্তু হায়-মাতম থামেনি। থেকে থেকে তার বক্ষপঞ্জর ভেদ করে হাহাকার উঠছে–আহ্ বাজান, আহ সোনা-মানিক!
এরফান মাতব্বর উঠে দাঁড়ায়। রান্নাঘরের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে নিজে নিজেই বলে, আর কাইন্দা কি করমু! কান্দলেই যদি পুত পাইতাম তয় চউখের পানি দিয়া দুইন্যাই ভাসাইয়া দিতাম।
তারপর রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে সে বলে, অ্যাদে ফজুর মা, আর কাইন্দ না। আল্লার বেসাত আল্লায় লইয়া গেছে। কাইন্দা আর কি রকমু। ওডো এইবার। মানুষজন আইয়া পড়ল বুইল্যা। তুমি চাইলে-ডাইলে বড় ডেগটার এক ডেগ চড়াইয়া দ্যাও শিগগির।
বরু বিবি কাঁদতে কাঁদতে বলে, কাইজ্যা করতে ওনরাই যে যায়। আমার ফজুরে চরের ধারেকাছেও যাইতে দিমু না।
আইচ্ছা না দ্যাও, না দিবা। অখন যা কইলাম তার আয়োজন কর। আমি মাডি খুইদ্যা চুলা বানাইয়া দিতে আছি উডানে।
বরুবিবির বুকের ঝড় থামতে অনেক সময় লাগে। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সে মসলা বাটে, চুলো ধরায়। তারপর চাল-ডাল ধুয়ে এনে খিচুড়ি বসিয়ে দেয় এক ডেগ। চুলোর মধ্যে শুকনো লটা খুঁজতে খুঁজতে তার কেবলই দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
.
০৩.
মান্দ্রা আর শিলপারনে ‘খবরিয়া’ পাঠিয়ে আশপাশের লোকজনকে খবর দিয়ে ফজল বাড়ি ফিরে আসে। এসেই সে নূরুর খোঁজ করে।
তার মনটা চাতকের মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে রয়েছে। নূরু ফিরে এলে শোনা যাবে মোল্লাবাড়ির খবরাখবর। ওকে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কথার জাল পাতলে রূপজানের কথাও কিছু বের করা যাবে।
স্কুলের বেলা হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও তার ফেরবার নাম নেই। সে আন্দাজ করে, নূরু ঠিক রূপজানের পাল্লায় পড়েছে। আদর দিয়ে দিয়ে সে ছেলেটার মাথা খেয়ে ফেলবে।
এজন্য রূপজানের ওপর কিন্তু রাগ হয় না ফজলের। বরং প্রসন্নই হয় তার মন। বাপ মার স্নেহ বঞ্চিত ছেলেটাকে সে নিজেও বড় কম আদর করে না। পড়াশুনার জন্য মাঝে মাঝে সে একটু তয়-তম্বি করে। ব্যস, ঐ পর্যন্তই। ওর দাদা-দাদির জন্য ওর গায়ে একটা ফুলের টোকা দেয়ার যো নেই।
নূরুর বয়স যখন পাঁচমাস তখন তার বাবা রশিদ চরের কাইজ্যায় খুন হয়। কোলের শিশু নিয়ে বিধবা হাজেরা তিন বছর ছিল মাতব্বর বাড়ি। দু’মাস-তিন মাস পরে সে বাপের বাড়ি মুলতগঞ্জে বেড়াতে যেত। দশ-বারো দিন পার হতে না হতেই এরফান মাতব্বর নিজে গিয়ে তাকে নিয়ে আসত আবার। বলত, নাতিডা চউখের কাছে না থাকলে ভালো ঠেকে না।
এমনি একবার বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল হাজেরা। তার বাবা শরাফত দেওয়ান। জোর করে আবার তার নিকে দিয়ে দেয়। মেয়ের কোনো রকম আপত্তিই সে শোনেনি। নূরুর কি হবে ভেবে সে অনেক কেঁদেছিল। কাঁদতে কাঁদতে ফুলিয়ে ফেলেছিল চোখ-মুখ। স্বামীর বাড়ি গিয়েও তার চোখের পানি শুকোয়নি। অবস্থা দেখে পরের দিনই তার স্বামী জালাল মিরধা দেওয়ানবাড়ি থেকে নূরুকে নিয়ে যায়। তাকে হাতুয়া পোলা হিসেবে রাখতে রাজি হয় সে।
এ নিকেতে এরফান মাতব্বরকে দাওয়াত দেয়া দূরে থাক, একটু যোগ-জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি শরাফত দেওয়ান। সম্বন্ধের যোগাড়যন্ত্র সবই খুব গোপনে সেরেছিলো সে। তার ভয় ছিল, খবরটা কোনো রকমে মাতব্বরের কানে গেলে সে হয়তো গোলমাল বাঁধাবে।
তিন দিন পর এরফান মাতব্বরের কাছে খবর পৌঁছে। শুনেই সে রাগে ফেটে পড়ে।
অনেক আরজু নিয়ে দেশ-কুলের এ মেয়েকে ছেলের বউ করে ঘরে নিয়েছিল মাতব্বর। আসুলির ভাল মাইনষের সাথে একটা প্যাঁচ দেয়ার জন্য সে পানির মতো টাকা খরচ করেছিল। মেয়ের বাপকে রাজি করাবার জন্য তিনশ একটাকা শাচক দিতে হয়েছিল। মেয়েকে সোনা দিতে হয়েছিল পাঁচ ভরি।
হাজেরার নিকে দিয়েছে, মাতব্বরের রাগ সেজন্য নয়। ছেলের মৃত্যুর পরই সে বুঝতে পেরেছিল, এ মেয়ের ওপর তার আর কোনো দাবি নেই। কাঁচা বয়সের এ মেয়েকে বেশি দিন ঘরে রাখা যাবে না, আর রাখা উচিতও নয়। তবু তিন-তিনটে বছর শ্বশুরবাড়ির মাটি কামড়ে পড়েছিল হাজেরা। দুধের শিশুকে সাড়ে তিন বছরেরটি করেছে। তার কাছে এর বেশি আর কি আশা করা যায়?
কিন্তু রাগ হয়েছিল তার অন্য কারণে। শরাফত দেওয়ান তার মেয়ের নিকে দিয়েছে। দিক, তাকে যোগ-জিজ্ঞাসা করেনি, না করুক। কিন্তু তার নাতিকে তার হাতে সোপর্দ করে দিয়ে যায়নি কেন সে? সে কি মনে করেছে মাতব্বরকে?
রাগের চোটে তার মনের স্থৈর্য লোপ পায়। বিড়বিড় করে সে বলে, আসুলির হুনা ভাল মানুষ। হালার লাশুর পাইলে দুইডা কানডলা দিয়া জিগাইতাম, কোন আক্কেলে ও আমার নাতিরে আউত্যা বানাইয়া মাইনষের বাড়ি পাড়াইছে।
একবার সে ভাবে, যাবে নাকি লাঠিয়াল-লশকর নিয়ে মির বাড়ি? পয়লা মুখের কথা, কাজ না হলে লাঠির গুতা। তার বিশ্বাস, লাঠির গুতা না পড়লে নাতিকে বের করে আনা যাবে না। কিন্তু ফৌজদারির ভয়ে শেষ পর্যন্ত সে নিরস্ত হয়।
ফজলের বয়স তখন সতেরো বছর। সে এক বাড়িতে জায়গীর থেকে নড়িয়া হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ত। মাতব্বর তাকে গোপনে খবর পাঠায়, ভুলিয়ে-ভালিয়ে, চুরি করে বা যেভাবেই হোক নূরুকে যেন সে বাড়ি নিয়ে আসে।
মুলতগঞ্জ ও নড়িয়া পাশাপাশি গ্রাম। ফজল সুযোগ খুঁজতে থাকে। হাজেরা বাপের বাড়ি নাইয়র এলে সে একদিন দেওয়ানবাড়ি বেড়াতে যায়। নূরুকে জামা কিনে দেয়ার নাম করে মুলতগঞ্জের হাটে নিয়ে যায় সে। সেখান থেকে নৌকা করে দে পাড়ি! নূরুকে বুকের সাথে জাপটে ধরে সে বাড়ি গিয়ে হাজির হয়।
সেদিন থেকেই সে দাদার আবদার, দাদির আহ্লাদ আর চাচার আদর পেয়ে বড় হয়ে উঠছে। বাপ-মার অভাব কোনোদিন বুঝতে পারেনি। সে এতখানি বড় হয়েছে, এখন পর্যন্ত দাদির আঁচল ধরে না শুলে তার ঘুম হয় না। দাদার পাতে না খেলে পেট ভরে না। আর চাচার সাথে হুড়োকুস্তি না করলে হজম হয় না পেটে ভাত।
ফজল ঘরের ছাঁচতলা গিয়ে পুবদিকে তাকায়। না, নূরুর টিকিটিও দেখা যায় না।
সে তামাক মাখতে বসে যায়। এত লোকের কল্কে সাজাতে অল্প-স্বল্প তামাকে হবে না। সে দেশী তামাকের মোড়া মুগুরের ওপর রেখে কুচিকুচি করে কাটে। তলক হওয়ার জন্য কিছু মতিহারি তামাক মিশিয়ে নেয় তার সাথে। শেষে মিঠাম করার জন্য রাব মিশিয়ে হাতের দাবনা দিয়ে ডলাই-মলাই করে।
লোকজন মাতব্বর বাড়ি এসে জমায়েত হতে হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। প্রত্যেকেই ভাওর ঘরের জন্য বাঁশ-খোটা, দড়াদড়ি যে যা পেরেছে নৌকা ভরে নিয়ে এসেছে। নিজ নিজ হাতিয়ারও নিয়ে এসেছে সবাই।
ধারে-কাছের কিছু লোক আগেই এসেছিল। এরফান মাতব্বর তাদের বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। দুজন গেছে চুলার ধারে তাদের চাচিকে সাহায্য করতে। তিন-চারজন জং ধরা শড়কি আর কাতরা ঘষতে লেগে গেছে পাথরের ওপর। একজন বালিগচার ওপর কোপা। দা আর কাটারিতে ধার দিচ্ছে।
কয়েকজন গেছে কাশ আর চুইন্যা ঘাস কাটতে। ভাওর ঘর তুলতে দরকার হবে এসব ঘাস-পাতার। এগুলোর গোড়ার দিকটা দিয়ে হবে বেড়া আর আগার দিকটা দিয়ে ছাউনি। খুঁটির বাঁশে টান পড়বে। তাই কয়েকজন চলে গেছে নদীর উত্তর পাড়। বানরি ও হাশাইল গ্রাম থেকে বাঁশ কিনে তারা সোজা গিয়ে চরে উঠবে।
লোক এসেছে একশরও বেশি। এত লোকের জন্য থালা-বাসন যোগাড় করা সোজা কথা নয়। ফজল কলাপাতা কাটতে লেগে যায়। কঞ্চির মাথায় কাস্তে বেঁধে সে কলাগাছের আগা থেকে ডাউগ্গা কাটে। তারপর এক একটাকে খণ্ড করে চার-পাঁচটা।
খেতের আল ধরে নূরু আসছে। ধানগাছের মাথার ওপর দিয়ে ওর মাথা দেখা যায়।
ওকে দেখেই ফজলের পাতা কাটা বন্ধ হয়ে যায়। তার বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে।
ইস, আবার টেরি কাটছে মিয়াসাব। নূরুর দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ফজল।
কাছে এলে সে আবার লক্ষ্য করে, শুধু পরিপাটি করে চুলই আঁচড়ায়নি নূরু, তেলে চকচক করছে চুল। চোখে সুরমাও লাগিয়েছে আবার। গায়ের জামা আর লুঙ্গিটাও তত বেশ পরিষ্কার মনে হচ্ছে। তার বুঝতে বাকি থাকে না, এসব কাজে কার হাত লেগেছে।
বাড়ির কাছে আসতেই ফজল ডাক দেয়, এই নূরু, এই দিগে আয়।
কাছে এলে সে কপট রাগ দেখায়, কিরে তোরে না বারহায় বারহায় কইয়া দিছিলাম জদি কইর্যা আইয়া পড়িস। ইস্কুলে যাইতে অইব।
চাচি আইতে দিল না যে।
ফজলের অনুমান ঠিকই হয়েছে। সে আবার জিজ্ঞেস করে, আইতে দিল না ক্যান্?
চাচি কয়, এদ্দিন পরে আইছস, না খাইয়া যাবি কই?
ও তুমি প্যাট তাজা কইর্যা আইছ?
না খাইয়া আইতে দিল না যে! আবার কইছিল, আইজ থাইক্যা কাইল যাইস।
ইস্ আদরের আর সীমা নাই। কি খাওয়াইলরে?
বেহানে গিয়া খাইছি কাউনের জাউ আর আন্তেশা পিডা। দুফরে পাঙাশ মাছ ভাজা, পাঙাশ মাছের সালুন, ডাইল। হেষে দুধ আর ক্যালা।
ক্যালা কস ক্যারে? ইস্কুলে পড়স, কলা কইতে পারস না? মুচকি হেসে আবার বলে সে, কলা কইতে পারে না, জাদু আমার ট্যাড়া সিঁথি কাটছে, হুঁহ!
নূরু লজ্জা পেয়ে হাতের এক ঝটকায় চুলগুলো এলোথেলো করে দিয়ে বলে, আমি বুঝি কাটছি, চাচি আঁচড়াইয়া দিছে।
ফজল নূরুকে হাত ধরে পরম স্নেহে কাছে টেনে নেয়। আঙুলের মাথা দিয়ে বিস্রস্ত চুল দু’দিকে সরিয়ে সিঁথিটা ঠিক করতে করতে বলে, তোর চোখে সুরমা লাগাইয়া দিছে কে রে?
চাচি।
লুঙ্গি আর জামাডাও বুঝি তোর চাচি ধুইয়া দিছে?
হ।
তোর চাচি কিছু জিগায় নাই?
হ জিগাইছে, তোর দাদা কেমুন আছে? তোর দাদি কেমুন আছে?
আর কারো কথা জিগায় নাই?
হ জিগাইছে, তোর চাচা কেমুন আছে?
তুই কি কইছস? কইছি বেবাক ভালো আছে।
আর কি কইছে?
আর কইছে তোগ লাল গাইডা বিয়াইছে নি?
আর …?
নূরু তার পকেট থেকে একটা ছোট মোড়ক বের করে। কাগজের মোড়কটা ফজলের হাতে দিয়ে সে বলে, চাচি কইছে, এইডার মইদ্যে একখান তাবিজ আছে। পীরসাবের
তাবিজ।
হ তোমারে এইডা মাজায় বাইন্দা রাখতে কইছে।
ক্যান?
চাচি কইছে, বালা-মসিবত আইতে পারব না। আর অজু না কইর্যা এইডা খুলতে মানা করছে চাচি।
ক্যান, খুললে কি অইব?
খুললে বোলে চউখ কানা অইয়া যাইব।
ফজল মনে মনে হাসে। রূপজানের চাল ধরে ফেলে সে। নূরু যাতে খুলে না দেখে, সে-জন্যই সে চোখ কানা হওয়ার ভয় দেখিয়েছে।
ফজল মোড়কটা পকেটে পুরে বলে, আইচ্ছা যা তুই।
নূরু কিছুদূর যেতেই ফজল ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিরে তোর নানাজান আইল না?
হে বাড়িতে নাই, গরু কিনতে মুনশিরহাট গেছে।
নূরু চোখের আড়াল হতেই ফজল কলাগাছের ঝাড়ের মধ্যে গিয়ে ঢোকে। পকেট থেকে বের করে মোড়কটা। সুতা দিয়ে ওটাকে আচ্ছামতো পেঁচিয়ে দিয়েছে রূপজান। সুতার প্যাঁচ খুলে সে মোড়কটার ভেতরে পায় একটা সাদা রুমাল আর ভাঁজ করা একটা কাগজ। রুমালটার এক কোণে এমব্রয়ডারি করা ফুল ও পাতা। তার নিচে সুচের ফোর দিয়ে লেখা, ভুলনা আমায়।
ফজল রুমালটা গালের সাথে চেপে ধরে। তারপর ওটাকে পকেটে রেখে সে ভাঁজ করা কাগজটা খুলে পড়ে।
প্রাণাধিক,
হাজার হাজার বহুত বহুত সেলাম পর সমাচার এই যে আমার শত কোটি ভালবাসা নিও। অনেক দিন গুজারিয়া গেল তোমারে দেখি না। তোমারে একটু চউখের দেখা দেখনের লেইগ্যা পরানটা খালি ছটফট করে। তুমি এত নিষ্ঠুর। একবার আসিয়া আমার খবরও নিলা না। বাজান তোমার উপরে রাগ হয় নাই। সে রাগ হইছে মিয়াজির উপরে। সে আমার গয়না বেচিয়া খাইছে। সেই জন্যই বাজান রাগ হইছে। কিন্তু আমি গয়না চাই না। তুমিই আমার গয়না, তুমিই আমার গলার হার। তুমিই আমার পরানের পরান। যদি তোমার পরানের মধ্যে আমারে জায়গা দিয়া থাক তবে একবার আসিয়া চউখের দেখা দিয়া যাইও। তোমার লেইগ্যা পথের দিগে চাহিয়া থাকিব।
নূরুর কাছে শোনলাম, খুনের চর জাগছে। তোমার আল্লার কিরা, চরের কাইজ্যায় যাইও না। ইতি।
অভিগানী
রূপজান
ফজল কাগজটা উল্টে দেখে, সেখানে একটা পাখি আঁকা। তার নিচে লেখা রয়েছে, যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে।
তারও নিচে লেখা আছে একটা পরিচিত গানের কয়েকটা লাইন–
যদি আমার পাখারে থাকত,
কে আমারে ধরিয়া রাখত,
উইড়া যাইতাম পরান বন্ধুর দ্যাশেরে ॥
ফজল চিঠিটা আবার প্রথম থেকে পড়তে শুরু করে।
ফজু কই রে? অ ফজু…
জ্বী আইতে আছি। পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে ফজল তাড়াতাড়ি চিঠিটা পকেটে পোরে। সে আরো কিছু কলাপাতা কেটে বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলছে এরফান মাতব্বর।
খিচুড়ি রান্না শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।
মাতব্বর বলে, এই হানে খাওনের হেঙ্গামা করলে দেরি অইয়া যাইব। এক কাম করো, খিচুড়ির ডেগটা নায় উড়াইয়া লও। নাও চলতে চলতে যার যার নায়ের মইদ্যে বইয়া খাইয়া লইও।
রমিজ মিরধা বলে, হ এইডাই ভালো। খাইতে খাইতে যদি দিন কাবার অইয়া যায় তয় কোনো কাম অইব না।
লোকজন খিচুড়ির ডেগটা ধরাধরি করে মাতব্বরের ছই-বিহীন ঘাসি নৌকায় তোলে। কলাপাতাগুলো লোক অনুসারে প্রত্যেক নৌকায় ভাগ করে দেয় ফজল। বাঁশ-খোঁটা, লাঠি শড়কি, ঢাল-কাতরা আগেই নৌকায় উঠে গেছে। এবার লোকজনও যার যার নৌকায় উঠে যায়।
নূরু এসে ফজলকে ডাকে, ও দুদু, দাদি তোমারে বোলায়।
ফজল উঠানে গিয়ে দেখে, তার বাবা আর মা ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে।
মাতব্বর বলে, জুয়ান পোলা দশজনের লগে যাইব না, এইডা কেমুন কথা! মাইনষে হুনলে কইব কি? বাঘের ঘরে মেকুর পয়দা অইছে।
কইলে কউক। আমার পোলা আমি যাইতে দিমু না।
যাইতে দিবা না, তয় কি মুরগির মতন খাঁচায় বাইন্দা রাখতে চাও?
মাইনষের কি আকাল পড়ছে নি? দুইডা না, তিনডা না, একটা পোলা আমার। ও না গেলে কি অইব?
কি অইব, তুমি যোবা না। আমার দিন তো ফুরাইয়া আইল, আমি চউখ বুজলে ও-ই অইব মাতব্বর। আপদে-বিপদে মাইনষের আগে আগে চলতে না হিগলে মাতবরি-সরদারি করব কেমন কইর্যা?
থাউক, আমার পোলার মাতবরি-হরদারি করণ লাগব না।
ফজল এগিয়ে গিয়ে মা-কে বাধা দেয়, তুমি চুপ অওতো মা। কি শুরু করছ?
তারপর সে তার পিতার দিকে চেয়ে বলে, বাজান, বেবাক জিনিস নায়ে উইট্যা গেছে। আপনে ওঠলেই এখন রওনা দিতে পারি।
বরুবিবি এবার ফজলকে বলে, অ ফজু, বাজানরে তুই যাইস না।
ক্যান যাইমু না?
ক্যান্ যাইমু না, হায় হায়রে আবার উল্ডা জিগায় ক্যান্ যাইমু না। তয় যা-যা তোরা বাপে পুতে দুইজনে মিল্যা আমার কল্ডাডা কাইট্যা থুইয়া হেষে যা।
মাতব্বর কাছে এসে ধীরভাবে বলে, ও ফজুর মা, হোন। আমরা তো কাইজ্যা করতে যাইতে আছি না। এইবার আর কাইজ্যা অইব না। চেরাগ আলী ঐ বচ্ছর যেই চুবানি খাইছে, এই বচ্ছর আর চরের ধারে কাছে আইতে সাহস করব না।
তয় ফজুরে নেওনের কাম কি?
ও না গেলে মানুষ-জনেরে খাওয়াইব কে? আর হোন, কাইজ্যা লাগলে ওরে কাইজ্যার কাছে যাইতে দিমু না। তুমি আর ভাবনা কইর্য না। চলরে ফজু, আর দেরি করণ যায় না।
বাপের পেছনে পেছনে ছেলে রওনা হয়। নূরু বরুবিবির কাছেই দাঁড়ানো ছিল। তাম্শা দেখবার জন্য সে-ও নৌকাঘাটার দিকে রওনা হয়। বরুবিবি খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। তারপর তাকে কোলের মধ্যে নিয়ে সে বিলাপ করতে শুরু করে দেয়, ও আমার রশুরে, বাজান তোরে না যে ভোলতে না যে-পা-আ-আ-রি, সোনার চান ঘরে থুইয়া কেমনে চইল্যা গে-এ-এ-লি, বাজানরে-এ-এ-এ, আ-মা–র।
এরফান মাতব্বর নৌকায় উঠেই তাড়া দেয়, আর দেরি কইর্য না। এইবার আল্লার নাম লইয়া রওনা দ্যাও।
লোকজন যার যার নৌকা খুলে রওনা হয়। মেহের মুনশি হাঁক দেয়, আল্লা-রসুল বলো ভাইরে ম-মী-ঈ-ঈ-ন…
আল্লা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুনশির কথার শেষ ধরে বাকি সবাই জাক্কইর দেয়।
মাতব্বরের ঘাসি নৌকার আগে-পিছে তেইশখানা নৌকা চলছে। কোনোটায় চারজন, কোনোটায় বা পাঁচজন করে তোক। কিছুদূর গিয়েই ফজল খিচুড়ি পরিবেশন করতে লেগে যায়। সে ইরি হাতে ডেগের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। চলতে চলতে এক একটা ডিঙি এসে নৌকার সাথে ভিড়ে। ফজল লম্বা হাতলওয়ালা কাঠের ইযারি দিয়ে ডেগ থেকে খিচুড়ি তুলে কলাপাতার ওপর ঢেলে দেয়।
এরফান মাতব্বর লোকজনদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলে, যার যার প্যাট ভইরা খাইও মিয়ারা। রাইতে কিন্তু খাওয়ার যোগাড় করণ যাইব না।
এরফান মাতব্বর সকলের ওপর দিয়ে গাছ-মাতব্বর। তার সাথে ঘাসি নৌকায় বসে আলাপ-আলোচনা করছে পুলকি-মাতব্বর রমিজ মিরধা, জাবেদ লশকর, মেহের মুনশি আর কদম শিকারি। পুলকি অর্থাৎ সদ্য উদ্গত গাছের শাখার মতোই তারা কচি মাতব্বর। তাদের চারপাশে বসেছে সাত-আটজন কোলশরিক।
তারা পরামর্শ করে ঠিক করে, চরের উত্তর দিকটা পাহারা দেয়ার জন্য জাবেদ লশকর ও তার লোকজন ভাওর ঘর তুলবে। এভাবে দক্ষিণদিকে কদম শিকারি, পশ্চিমদিকে রমিজ মিরধা আর পুবদিকে মেহের মুনশি তাদের লোকজন নিয়ে পাহারা দেবে। যদি কেউ চর দখল করতে আসে তবে পুবদিক দিয়ে আসার সম্ভাবনাই বেশি। তাই এরফান মাতব্বর ও তার আত্মীয়-স্বজন পুবদিকটায় ভাওর ঘর তুলবার মনস্থ করে।
সবগুলো ডিঙির লোকজন খাওয়া শেষ করেছে। এবার মাতব্বর ঘাসি নৌকার সবার সাথে খেতে বসে। খেতে খেতে সবাই তারিফ করে খিচুড়ির। রমিজ মিরধা বলে, চাচির আতের খিচুড়ি যে খাইছে, হে আর ভেলতে পারব না কোনোদিন।
রান্নার প্রশংসা শুনে মাতব্বর খুশি হয়। কিন্তু সবার অজান্তে সে একটা দীর্ঘশ্বাসও ছাড়ে। আর মনে মনে ভাবে, এ তারিফ যার প্রাপ্য সে আর মাতব্বর বাড়ি নেই এখন।
আসুলির ভাল মাইনষের ঘরের মেয়ে ক’টা বছরের জন্য এসে মাতব্বর বাড়ির রান্নার ধরনটাই বদলে দিয়ে গেছে। হাজেরা এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর বরুবিবি তার হাতেই রসুইঘরের ভার ছেড়ে দিয়েছিল। হাজেরা বাপের বাড়ি নাইয়র গেলে মুশকিল বেঁধে যেত। স্ত্রীর হাতের রান্না খেয়ে মাতব্বর মুখ বিকৃত করে বলত, নাগো, ভাল্ মাইনষের মাইয়ার রান্দা খাইতে খাইতে জিব্বাডাও ভাল মানুষ অইয়া গেছে। তোমাগ আতের ফ্যাজাগোজা আর ভাল লাগে না।
নিরুপায় হয়ে বরুবিবিকে শেষে পুতের বউর কাছে রান্না শিখতে হয়েছিল।
এরফান মাতব্বর তার লোকজন নিয়ে যখন নতুন চরে পৌঁছে, তখন রোদের তেজ কমে গেছে।
মাতব্বর সবাইকে নির্দেশ দেয়, যার যার জাগায় ডিঙ্গা লইয়া চইল্যা যাও। আমরা ‘আল্লাহু আকবর’ কইলে তোমরা ঐলগে আওয়াজ দিও। এই রহম তিনবার আওয়াজ দেওনের পর ‘বিছমিল্লা’ বুইল্যা বাঁশগাড়ি করবা।
একটু থেমে সে আবার বলে, তোমরা হুঁশিয়ার অইয়া থাইক্য। রাইতে পালা কইর্যা পাহারা দিও এক একজন।
লোকজন নিজ নিজ নির্ধারিত স্থানে ডিঙি নিয়ে চলে যায়।
আছরের নামাজ পড়ে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মাতব্বর। তারপর লোকজন নিয়ে নৌকা থেকে নামে। বাঁশের খোটা হাতে এক একজন হাঁটু পানি ভেঙে মাতব্বরের নির্দেশ মতো দূরে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।
ফজলকে ডেকে মাতব্বর বলে, অ ফজু, এইবার আল্লাহু আকবর আওয়াজ দে।
ফজল গলার সবটুকু জোর দিয়ে হাঁক দেয়, আল্লাহু আকবর।
চরের চারদিক থেকে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আওয়াজ ওঠে, আল্লাহু আকবর।
তিনবার তকবির ধ্বনির পর একসাথে অনেকগুলো বাঁশ গেড়ে বসে চরের চারদিকে। দখলের নিশান হয়ে সেগুলো দাঁড়িয়ে থাকে পলিমাটির বুকে।
.
০৪.
উত্তরে মূলভাওড়, দক্ষিণে হোগলাচর, পুবে মিত্রের চর আর পশ্চিমে ডাইনগাঁও–এই চৌহদ্দির মধ্যে ছোট বড় অনেকগুলো চর। চারদিকে জলবেষ্টিত পলিদ্বীপ। এগুলোর উত্তর আর দক্ষিণদিক দিয়ে দ্বীপবতী পদ্মার দুটি প্রধান স্রোত পুব দিকে বয়ে চলেছে। উত্তর দিকের স্রোত থেকে অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা বেরিয়ে চরগুলোকে ছোট বড় গোল দিঘল নানা আকারে কেটে-হেঁটে মিশেছে গিয়ে দক্ষিণদিকের স্রোতের সঙ্গে।
চরগুলোর বয়স দুবছরও হয়নি। এগুলো জেগেছে আর জঙ্গুরুল্লার কপাল ফিরেছে। প্রায় সবগুলো চরই দখল করে নিয়েছে সে। আর এ চরের দৌলতে নানাদিক দিয়ে তার কাছে টাকা আসতে শুরু করেছে। কোলশরিকদের কাছ থেকে বাৎসরিক খাজনার টাকা আসে। বর্গা জমির ধান-বেচা টাকা আসে। আসে ঘাস-বেচা টাকা।
কোলশরিক আর কৃষাণ-কামলারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, ট্যাহারা মানুষ চিনে। ওরা বোঝে, কোন মাইনষের ঘরে গেলে চিৎ অইয়া অনেকদিন জিরাইতে পারব।
হ, ঠিক কথাই কইছ। আমরা তো আর ট্যাহা-পয়সারে এক মুহূর্তুক জিরানের ফরসত দেই না। আইতে না আইতেই খেদাইয়া দেই।
টাকারা জঙ্গুরুল্লাকে চিনেছে মাত্র অল্প কয়েক বছর আগে। ভালো করে চিনেছে ধরতে গেলে চরগুলো দখলে আসার পর। আজকাল টাকা-পয়সা নাড়াচাড়া করার সময় বিগত জীবনের কথা প্রায়ই মনে পড়ে তার। জঙ্গুরুল্লার বয়স পয়তাল্লিশ পার হয়েছে। গত পাঁচটা বছর বাদ দিয়ে বাকি চল্লিশটা বছর কি দুঃখ কষ্টই না গেছে তার। জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়টাই কেটেছে অভাব-অনটনের মধ্যে। পেটের ভেতর জ্বলেছে খিদের আগুন। অথচ তার শরীরের ঘামও কখনো শুকোয়নি।
সাত বছর বয়সের সময় তার মা মারা যায়। বাপ গরিবুল্লা আবার শাদি করে। জঙ্গুর সত্মা ছিল আর সব সত্মাদের মতোই। বাপও কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। অতটুকু বয়সেই সে বুঝতে পেরেছিল–গাঁয়ের লোক শুধু শুধুই বলে না, মা মরলে বাপ অয় তালুই।
ঘোপচরে গরিবুল্লার সামান্য কিছু জমি ছিল। সেই জমি চাষ করে আর কামলা খেটে কোনো রকমে সে সংসার চালাত। জঙ্গুর বয়স দশ বছর হতে না হতেই সে তাকে হোগলাচরের এক চাষী গেরস্তের বাড়ি কাজে লাগিয়ে দেয়। সেখানে পাঁচ-ছবছর পেটে-ভাতে রাখালি করে সে। তারপর দুটাকা মাইনেয় ঐ চরেরই আর এক বড় গেরস্তের বাড়ি হাল চাষের কাজ জুটে যায়।
বছর চারেক পরে তার বাপ মারা যায়। সত্য তার ছবছরের মেয়েকে নিয়ে নিকে বসে অন্য জায়গায়। জঙ্গু ঘোপচরে ফিরে আসে। গাঁয়ের দশজনের চেষ্টায় তার বিয়েটাও হয়ে যায়। অল্পদিনের মধ্যেই। গরিব চাষীর মেয়ে আসমানি। গোবরের খুঁটে দেয়া থেকে শুরু করে ধান ভানা, চাল ঝাড়া, মুড়ি ভাজা, ঘর লেপা, কাঁথা সেলাই, দুধ দোয়া ইত্যাদি যাবতীয় কাজে তার হাত চলে। আর অভাব-অনটনের সময় দু-এক বেলা উপোস দিতেও কাতর হয় না সে। কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে গুছিয়ে নেয় সে গরিবের সংসার।
জঙ্গুরুল্লা বাপের লাঙ্গল-গরু নিয়ে চাষ-বাস শুরু করে। মাঝে মাঝে কামলা খাটে অন্যের জমিতে। সারাদিন সে কি খাটুনি! পুরো পাঁচটা দিন কামলা খেটে পাওয়া যেত। একটিমাত্র টাকা। টাকাটা নিয়ে সে মুলতগঞ্জের হাটে যেত। দশ আনায় কিনত সাত সের চাল আর বাকি ছ’আনার ডাল-তেল-নুন-মরিচ ও আরো অনেক কিছু।
এ সময়ের একটা ঘটনার কথা মনে পড়লেই তার কপাল কুঁচকে ওঠে। চোখদুটো ক্রুর দৃষ্টি মেলে তাকায় নিজের পা দুখানার দিকে। দুপাটি দাঁত চেপে ধরে নিচের ঠোঁট।
ঘোপচরের মাতব্বর ছিল সোহরাব মোড়ল। তার ছেলের বিয়ের বরযাত্রী হয়ে জঙ্গুরুল্লা দক্ষিণপাড়ের কলুকাঠি গিয়েছিল। আসুলির ভা, মানুষ। মেহমানদের জন্য সাদা ধবধবে ফরাস বিছিয়েছিল বৈঠকখানায়। সেই ফরাসের ওপর জঙ্গুরুল্লা তার থেবড়া পায়ের কয়েক জোড়া ছাপ ফেলেছিল। তা দেখে চোখ টেপাটিপি করে হেসেছিল কনেপক্ষের লোকেরা। তাদের অবজ্ঞার হাসি বরপক্ষের লোকদের চোখ এড়ায়নি। রাগে সোহরাব মোড়লের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল। কোনো রকমে সে সামলে নেয় নিজেকে।
কিন্তু বাড়ি ফেরার পথেই সে পাকড়াও করে জঙ্গুরুল্লাকে জুতা খুলে মারতে যায়। আর সবাই না ঠেকালে হয়তো জুতার বাড়ি দু-একটা পড়ত জঙ্গুরুল্লার পিঠে।
সোহরাব মোড়ল রাগে গজগজ করে, শয়তান, ওর কি এট্টু আক্কেল-পছন্দ নাই? ও আধোয় পায়ে ক্যামনে গিয়া ওঠল অমন ফরাসে। দেশ-কুলের তারা আমাগ কি খামাখা নিন্দে? খামাখা কয় চরুয়া ভূত?
দুলার ফুফা হাতেম খালাসি বলে, এমুন গিধড় লইয়া ভর্দ লোকের বাড়িতে গেলে কইব কি ছাইড়া দিব? আমাগ উচিত আছিল বাছা বাছা মানুষ যাওনের।
ঠিক কথাই কইছ, এইবারতন তাই করতে অইব।
আইচ্ছা, ওর ঘাড়ের উপরে দুইটা চটকানা দিয়া জিগাও দেহি, ওর চরণ দুইখান পানিতে চুবাইলে কি ক্ষয় অইয়া যাইত?
বরযাত্রীদের একজন বলে, কারবারডা অইছে কি, হোনেন মোড়লের পো। জুতাতে বাপ-বয়সে পায়ে দেয় নাই কোনো দিন। নতুন রফটের জুতা পায়ে দিয়া ফোস্কা পড়ছে। নায়েরতন নাইম্যা খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে কিছুদূর আইছিল। হেরপর খুইল্যা আতে লয়। বিয়াবাড়ির কাছে গিয়া ঘাসের মইদ্যে পাও দুইখান ঘইষ্যা রাত্বরি জুতার মইদ্যে ঢুকাইছিল।
ছিঃ-ছিঃ-ছিঃ! জাইতনাশা কুত্তা! ওর লেইগ্যা পানির কি আকাল পড়ছিল? কই গেল পা-না-ধোয়া শয়তানডা?
একটা হাসির হল্লা বরযাত্রীদের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সবাই খোঁজ করে জঙ্গুরুল্লার, কইরে পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা? কই? কই গেল পা-না-ধোয়া গিধড়?
জঙ্গুরুল্লাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি সেখানে। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সে পেছন থেকে সরে পড়েছিল।
কিন্তু সরে পড়লে কি হবে? দশজনের মুখে উচ্চারিত সেদিনকার সেই পা-না-ধোয়া বিশেষণটা তার নামের আগে এঁটে বসে গেছে। নামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিরাজ করছে সেদিন থেকে। নামের সঙ্গে এ বিশেষণটা যোগ না করলে তাকে চেনাই যায় না আর।
পা-না-ধোয়া বললে প্রথম দিকে খেপে যেত জঙ্গুরুল্লা। মারমুখী হয়ে উঠত। কিন্তু তার ফল হতো উল্টো। সে যত বেশি চটত তত বেশি করে চটাত পাড়া-প্রতিবেশীরা। শেষে নিরুপায় হয়ে নিজের কর্মফল হিসেবেই এটাকে মেনে নিতে সে বাধ্য হয়।
চার বছর পর ঘোপচর নদীতে ভেঙে যায়। জঙ্গুরুল্লা চণ্ডীপুর মামুর বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ কাজে সে কাজে সাতঘাটের পানি খেয়ে সে যখন জীবিকার আর কোনো পথ পায় না তখন ঘড়িশার কাছারির নায়েবের কথা মনে পড়ে তার।
চণ্ডীপুর আসার মাস কয়েক পরের কথা। ঘড়িশার কাছারির নায়েব শশীভূষণ দাস স্টিমার ধরবার জন্য নৌকা করে সুরেশ্বর স্টেশনে গিয়েছিলেন। খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে তিনি প্রাতঃকৃত্যের জন্য নদীর পাড়ে কাশঝোঁপের আড়ালে গিয়ে বসেছিলেন। ঐ সময়ে জঙ্গুরুল্লা ঝকিজাল নিয়ে ওখানে মাছ ধরছিল। জালটা গোছগাছ করে সে কনুইর ওপর চড়িয়েছে এমন সময় শুনতে পায় চিৎকার। জালটা ঐ অবস্থায় নিয়েই সে পেছনে ফিরে দেখে একটা পাতিশিয়াল এ্যাকখ্যাক করে একটা লোককে কামড়াবার চেষ্টা করছে। লোকটা চিৎকার করছে, পিছু হটছে আর লোটা দিয়ে ওটাকে ঠেকাবার চেষ্টা করছে। জঙ্গুরুল্লা দৌড়ে গিয়ে জাল দিয়ে খেপ মারে পাতিশিয়ালের ওপর। পাতিশিয়াল জালে জড়িয়ে যায়। লোকটার হাত থেকে লোটা নিয়ে সে ওটার মাথার ওপর মারে দমাদম। ব্যস, ওতেই ওর জীবনলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়।
ডাক-চিৎকার শুনে বহু লোক জমা হয়েছিল সেখানে। তাদের কাছে জানা যায়–আগের দিন ঐ এলাকার পাঁচ জনকে পাগলা শিয়ালে কামড়িয়েছে। সবাই বুঝতে পারে–ওটাই সেই পাগলা শিয়াল।
জঙ্গুরুল্লার বুদ্ধি ও সাহসের প্রশংসা করে সকলেই। নায়েব তাকে দশ টাকা বখশিশ দিয়ে বলেন, যদি কখনো দরকার পড়ে, আমার ঘড়িশার কাছারিতে যেও।
দুঃসময়ে নায়েবের কথা মনে পড়তেই সে চলে গিয়েছিল ঘড়িশার কাছারিতে। নায়েব তাকে পেয়াদার চাকরিতে বহাল করে নেন। মাসিক বেতন তিন টাকা। বেতন যাই হোক, এ চাকরির উপরিটাই আসল। আবার উপরির ওপরে আছে ক্ষমতা যাকে জঙ্গুরুল্লা বলে ‘পাওর’। এ কাজে ঢুকেই জঙ্গুরুল্লা প্রথম প্রভুত্বের স্বাদ পায়। সাড়ে তিন হাত বাঁশের লাঠি হাতে সে যখন মহালে যেত তখন তার দাপটে থরথরিয়ে কাপত প্রজারা। নায়েবের হুকুমে সে বকেয়া খাজনার জন্য প্রজাদের ডেকে নিয়ে যেত কাছারিতে। দরকার হলে ধরেও নিত। কখনো তাদের হাত-পা বেঁধে চিৎ করে রোদে শুইয়ে রাখত, কখনো কানমলা বাঁশডলা দিয়ে ছেড়ে দিত।
একবার এক প্রজাকে ধরতে গিয়েছিল জঙ্গুরুল্লা। লোকটা অনেক কাকুতি-মিনতি করে শেষ সম্বল আট আনা এনে দেয় তার হাতে। কিন্তু কিছুতেই জঙ্গুরুল্লার মন গলে না। শেষে লোকটা তার পা জড়িয়ে ধরে।
চমকে ওঠে জঙ্গুরুল্লা। অনেকক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সে। শেষে বলে, যা তোরে ছাইড়া দিলাম। পাট বেইচ্যা খাজনার টাকা দিয়া আহিস কাছারিতে।
তারপরেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। প্রত্যেকবারই মাপ করে দেয়ার সময় তার অন্তরে আকুল কামনা জেগেছে, সোহরাব মোড়লরে একবার পায়ে ধরাইতে পারতাম এই রহম!
শুধু কামনা করেই ক্ষান্ত হয়নি জঙ্গুরুল্লা। সোহরাব মোড়লকে বাগে পাওয়ার চেষ্টাও অনেক করেছে সে। তার চেষ্টা হয়তো একদিন সফল হতো, পূর্ণ হতো অন্তরের অভিলাষ। কিন্তু পাঁচটা বছর–যার বছর দুয়েক গেছে ওত-ঘাত শিখতে–পার হতে না হতেই তার পেয়াদাগিরি চলে যায়। প্রজাদের ওপর তার জুলুমবাজির খবর জমিদারের কানে পৌঁছে। তিনি জঙ্গরুল্লাকে বরখাস্ত করার জন্য পরোয়ানা পাঠান নায়েবের কাছে। জমিদারের পরোয়ানা। না মেনে উপায় কি? নায়েব জঙ্গুরুল্লাকে বরখাস্ত করেন বটে, তবে কৃতজ্ঞতার প্রতিদান হিসেবে নতুনচর বালিগাঁয়ে তাকে কিছু জমি দেন।
জঙ্গুরুল্লা বালিগাঁয়ে গিয়ে ঘর বাঁধে। লাঙ্গল-গরু কিনে আবার শুরু করে চাষ বাস। আগের মতো হাবা-গোবা সে নয় আর। একেবারে আলাদা মানুষ হয়ে ফিরে এসেছে সে। আগে ধমক খেলে যার মূৰ্ছা যাওয়ার উপক্রম হতো, সে এখন পানির ছিটে খেলে লগির গুঁতো দিতে পারে।
জমিদারের কাছারিতে কাজ করে নানা দিক দিয়ে তার পরিবর্তন ঘটেছে। সে দশজনের সাথে চলতে ফিরতে কথাবার্তা বলতে শিখেছে। জমা-জমি সংক্রান্ত ফন্দি-ফিকির, প্যাঁচগোছও শিখেছে অনেক। তাছাড়া বেড়েছে তার কূটবুদ্ধি ও মনের জোর। যদিও প্রথম দিকে গায়ের বিচার-আচারে তাকে কেউ পুছত না, তবুও সে যেত এবং সুবিধে মতো দু-চার কথা বলতো। এভাবে গায়ের সাদাসিধে লোকদের ভেতর সে তার প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই সে গাঁয়ের অন্যতম মাতব্বর বলে গণ্য হয়।
তারপর আসে ১৩৪৬ সাল–জঙ্গুরুল্লার ভাগ্যোদয়ের বছর। বর্ষার শেষে আশ্বিন মাসে মাঝ-নদীতে একটার পর একটা চর পিঠ ভাসাতে শুরু করে। পদ্মার প্রধান স্রোত দু’ভাগ হয়ে সরে যায় উত্তরে আর দক্ষিণে। জঙ্গুরুল্লা বালিগাঁয়ের লোকজন নিয়ে কয়েকটা চরই দখল করে নেয়। তারপর কুণ্ডু আর মিত্র জমিদারদের কাছারি থেকে বন্দোবস্ত এনে বসিয়ে দেয় কোলশরিক। তাদের কাছ থেকে মোটা হারে সেলামি নিয়ে সে তার অবস্থা ফিরিয়ে ফেলে।
চরগুলো দখল করার পর জঙ্গুরুল্লা চরপাঙাশিয়ায় নতুন বাড়ি করে। উত্তর, পুব আর পশ্চিম ভিটিতে চৌচালা ঘর ওঠে। দক্ষিণ ভিটিতে ওঠে আটচালা কাছারি ঘর। নতুন ঢেউটিনের চালা আর পাতটিনের বেড়া নিয়ে ঘরগুলো দিনের রোদে চোখ ঝলসায়। রাত্রে চাঁদের আলোয় বা চলন্ত স্টিমারের সার্চলাইটের আলোয় ঝলমল করে।
ঘরগুলো তুলতে অনেক টাকা খরচ হয়েছিল জঙ্গুরুল্লার। সে নিজের পরিবার-পরিজনের। কাছে প্রায়ই বলে, গাঙ অইল পাগলা রাকস। কখন কোন চরের উপরে থাবা মারে, কে কইতে পারে? এইডা যদি চর না অইত, তয় আল্লার নাম লইয়া দালানই উডাইতাম।
যত বড় পয়সাওয়ালাই হোক, পদ্মার চরে দালান-কোঠা তৈরি করতে কেউ সাহস করে না। দালান মানেই পোড়া মাটির ঘর। মাটির ওপর যতক্ষণ খাড়া থাকে ততক্ষণই এ মাটির ঘরের দাম। ভেঙে ফেললে মাটির আর কী দাম? তাই চরের লোক টিনের ঘরই পছন্দ করে। চর-ভাঙা শুরু হলে টিনের চালা, টিনের বেড়া খুলে, খাম-খুঁটি তুলে নিয়ে অন্য চরে গিয়ে ঠাই নেয়া যায়।
বিভিন্ন চরে জঙ্গুরুল্লার অনেক জমি আছে। কোলশরিকদের মধ্যে জমির বিলি-ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজের জন্য বাছাবাছা জমিগুলো রেখেছে সে। নিজে বা তার ছেলেরা আর হাল চাষ করে না এখন। বর্গাদার দিয়ে চাষ করিয়ে আধাভাগে অনেক ধান পাওয়া যায়। সে ধানে বছরের খোরাক হয়েও বাড়তি যা বাঁচে তা বিক্রি করে কম সে-কম হাজার দুয়েক টাকা ঘরে। আসে। নিজেরা হাল-চাষ না করলেও জমা-জমি দেখা-শোনা করা দরকার, বর্গাদারদের থেকে ভাগের ভাগ ঠিকমতো আদায় করা দরকার। এ চর থেকে দূরের চরগুলোর দেখাশোনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই সে কিছুদিন আগে কুমিরডাঙ্গা আর বগাদিয়ায় আরো দুখানা বাড়ি করেছে। কুমিরডাঙ্গায় গেছে প্রথমা স্ত্রী আসমানি বিবি তার সেজো ছেলে জহিরকে নিয়ে। ঘরজামাই গফুর আর মেয়ে খায়রুনও গেছে তাদের সাথে। বড় ছেলে জাফর বগাদিয়ায় গিয়ে সংসার পেতেছে। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী শরিফন আর মেজো ছেলে ও ছেলে বউ রয়েছে বড় বাড়িতে। জঙ্গুরুল্লা বেশির ভাগ সময় ও বাড়িতেই থাকে। মাঝে মাঝে নিজের পানসি নিয়ে চলে যায় কুমিরডাঙ্গা, না হয় বগাদিয়া।
টাকার জোর, মাটির জোর আর লাঠির জোর–এ তিনটার জোরে জোরোয়ার জঙ্গুরুল্লা। এখন সর্মানের জোর হলেই তার দিলের আরজু মেটে। সম্মানের নাগাল পেতে হলে বিদ্যার জোরও দরকার–সে বুঝতে পারে। বড় তিন ছেলেতো তারই মতো চোখ থাকতে অন্ধ। তারা ‘ক’ লিখতে কলম ভাঙে। তাই সে ছোট ছেলে দুটিকে স্কুলে পাঠিয়েছে। তারা হোস্টেলে থেকে মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুলে পড়ে।
মান-সম্মান বাড়াবার জন্য জঙ্গুরুল্লা টাকা খরচ করতেও কম করছে না। গত বছর সে মৌলানা তানবীর হাসান ফুলপুরীকে বাড়িতে এনে মস্ত বড় এক জেয়াফতের আয়োজন করেছিল। সে জেয়াফতে গরুই জবাই হয়েছিল আঠারোটা। দাওয়াতি-বে-দাওয়াতি মিলে অন্তত তিন হাজার লোক হয়েছিল। সে জনসমাবেশে মৌলানা সাহেব তাকে চৌধুরী পদবিতে অভিষিক্ত করে যান। সেদিন থেকেই সে চৌধুরী হয়েছে। নতুন দলিলপত্রে এই নামই চালু হচ্ছে আজকাল। চরপাঙাশিয়ার নামও বদলে হয়েছে চৌধুরীর চর। কিন্তু এত কিছু করেও তার নামের আগের সে পা-না-ধোয়া খেতাবটা ঘুচল না। তার তাবে আছে যে সমস্ত কোলশরিক আর বর্গাদার, তারাই শুধু ভয়ে ভয়ে তার চৌধুরী পদবির স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু তা-ও সামনা-সামনি কথা বলার সময়। তার অগোচরে আশপাশের লোকের মতো এখানে তারা পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লাই বলে।
কিছুদিন আগে তার সেজো ছেলে জহিরের বিয়ের সম্বন্ধের জন্য সে ঘটক পাঠিয়েছিল উত্তরপাড়ের ভাটপাড়া গ্রামের কাজিবাড়ি। শামসের কাজি প্রস্তাব শুনে ‘ধত ধ্যত’ করে হকিয়ে দেন ঘটককে। বলেন, চদরি নাম ফুডাইলে কি অইব! সাত পুরুষেও ওর বংশের পায়ের ময়লা যাইব না।
এ সবই জঙ্গুরুল্লার কানে যায়। রাগের চোটে সে দাঁতে দাঁত ঘষে। নিন্দিত পা দুটোকে মেঝের ওপর ঠুকতে থাকে বারবার। তার ইচ্ছে হয়, পা দুটো দিয়ে সে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সবকিছু, পদানত করে চারদিকের সব মাটি আর মানুষ। এমনি করেই এক রকমের দিগ্বিজয়ের আকাক্ষা জন্ম নেয় তার মনে। তাই আজকাল আশেপাশে কোনো নতুন চর জাগলেই লাঠির জোরে সে তা দখল করে নেয়। জমির সত্যিকার মালিকেরা উপায়ান্তর না দেখে হাতজোড় করে এসে তার কাছে দাঁড়ায়। দয়া হলে কিছু জমি দিয়ে সে তাদের কোলশরিক করে রাখে।
চরদিঘলির উত্তরে বড় একটা চর জেগেছে–খবর পায় জঙ্গুরুল্লা। চরটা তার এলাকা থেকে অনেক দূরে, আর কারা নাকি ওটা দখল করে বসেছে। এসব অসুবিধের কথা ভেবেও দমে না সে। নানা প্রতিকূল অবস্থার ভেতর পরপর অনেকগুলো চর দখল করে তার হিম্মত বেড়ে গেছে। তাই কোনো রকম অসুবিধাই সে আর অসুবিধা বলে মনে করে না। চর আর চরের দখলকারদের বিস্তারিত খবর আনবার জন্য সে তার মেজো ছেলে হরমুজকে দু’জন কোলশরিকের সাথে নতুন চরের দিকে পাঠিয়েছিল। তারা ফিরে এসে খবর দেয়–চরটার নাম খুনের চর, দখল করেছে এরফান মাতব্বর, ভাঙর ঘর উঠেছে ঊনষাটটা।
সেদিনই জঙ্গুরুল্লা তার বিশ্বস্ত লোকজন ডাকে যুক্তি-পরামর্শের জন্য। তার কথার শুরুতেই শোনা যায় অনুযোগের সুর, কি মিয়ারা, এত বড় একটা চর জাগল, তার খবর আগে যোগাড় করতে পার নাই?
কোলশরিক মজিদ খালাসি বলে, ঐ দিগেত আমাগ চলাচল নাই হুজুর।
ক্যান্?
আমরা হাট-বাজার করতে যাই দিঘিরপাড় আর হাশাইল। হাশাইলের পশ্চিমে আমায় যাওয়া পড়ে না।
যাওয়া পড়ে না তো বোঝলাম। কিন্তুক এদিকে যে গিট্টু লাইগ্যা গেছে।
গিট্টু! কিয়ের গিট্টু? দবির গোরাপি বলে।
হোনলাম, এরফান মাতব্বর চরডা দখল কইরা ফালাইছে।
হ, আগের বার আট-দশ বচ্ছর আগে যহন ঐ চর পয়স্তি অইছিল তহন এরফান মাতব্বরই ওইডা দখল করছিল।
হ, তার বড় পোলা ঐ বারের কাইজ্যায় খুন অইছিল। মজিদ খালাসি বলে।
প্রতিপক্ষ খুবই শক্তিশালী, সেটাই ভাবনার কথা। জঙ্গুরুল্লার কথা-বার্তায় কিন্তু ভাবনার বিশেষ কোনো আভাস পাওয়া যায় না।
সে স্বাভাবিক ভাবেই বলে, খবরডা আগে পাইলে বিনা হ্যাঁঙ্গামে কাম ফতে অইয়া যাইত। যাক গিয়া, তার লেইগ্যা তোমরা চিন্তা কইর্য না। চর জাগনের কথাডা যখন কানে আইছে তখন একটা উল্লাগুল্লা না দিয়া ছাইড়্যা দিমু!
কিন্তু হুজুর, রেকট-পরচায় ঐ চরতো এরফান মাতব্বরের নামে আছে। মজিদ খালাসি বলে।
আরে রাইখ্যা দ্যাও তোমার রেকট-পরচা। চরের মালিকানা আবার রেকট-পরচা দিয়া সাব্যস্ত অয় কবে? এইখানে অইল, লাডি যার মাডি তার।
তবুও কিছু একটা….।
সবুর করো, তারও ব্যবস্থা করতে আছি। ঐ তৌজিমহলের এগারো পয়সার মালিক বিশুগায়ের জমিদার রায়চৌধুরীরা। আমি কাইলই বিশুগাঁও যাইমু। রায়চৌধুরীগ নায়েবরে কিছু টাকা দিলেই সে আমাগ বিরুদ্ধে আদালতে নালিশ করব।
নালিশ করব!
হ, কয়েক বচ্ছরের বকেয়া খাজনার লেইগ্যা নালিশ করব। আমরাও তখন খাজনা দিয়া চেক নিমু। তারপর এরফান মাতব্বরও যেমুন রাইয়ত, আমরাও তেমুন।
কি কইলেন হুজুর, বোঝতে পারলাম না। মজিদ খালাসি বলে।
থাউক আর বেশি বুঝাবুঝির দরকার নাই। যদি জমিন পাইতে চাও, তবে যার যার দলের মানুষ ঠিক রাইখ্য। ডাক দিলেই যেন পাওয়া যায়। কারো কাছে কিন্তু ভাইঙ্গা কইও না, কোন চর দখল করতে যাইতে লাগব। এরফান মাতব্বরের দল খবর পাইলে কিন্তু হুঁশিয়ার অইয়া যাইব।
কবে নাগাদ যাইতে চান হুজুর? দবির গোরাপি জিজ্ঞেস করে।
তা এত ত্বরাত্বরির কি দরকার? আগে নালিশ অউক, খাজনার চেক-পত্র নেই, আর ওরাও ধান-পান লাগাইয়া ঠিকঠাক করুক। এমুন বন্দোবস্ত করতে আছি, দ্যাখবা মিয়ারা, তোমরা ঐ চরে গিয়া তৈয়ার ফসল ঘরে উডাইতে পারবা।
লোকজন খুশি মনে যার যার বাড়ি চলে যায়।
০৫-০৮. আশ্বিন মাসের শেষ পক্ষ
আশ্বিন মাসের শেষ পক্ষ। চরটার কোনো কোনো অংশ ভাটার সময় জেগে ওঠে। জোয়ারের সময় সবটাই ডুবে যায় আবার। এ পানির মধ্যে বাঁশের খুঁটি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি ঝুপড়ি। টুঙ্গির মতো অস্থায়ী ঐ ঝুপড়িগুলোরই নাম ভাওর ঘর। মাতব্বরের জন্য উঠেছে তিনখানা ভাওর ঘর। চরের চারপাশ ঘিরে ভাওর ঘরগুলো পাহারা দিচ্ছে, চোখ রাখছে চারদিকে।
জোয়ারের সময় ঝুপড়ির মধ্যে এক বিঘত, আধা বিঘত পানি হয়। পানির সমতলের হাতখানেক ওপরে বাঁশের মাচান বেঁধে নেয়া হয়েছে। যারা মাচান বাঁধতে পারেনি, তারা অন্য চর থেকে নৌকা বোঝাই করে নিয়ে এসেছে লটাঘাস। পানির মধ্যে সে ঘাসের স্থূপ সাজিয়ে উঁচু করে নিয়েছে। এরই ওপর হয়েছে শোয়া-থাকার ব্যবস্থা। শরীরের ভারে পিষ্ট হয়ে ঘাস যখন দেবে যায় তখন পানি উঁকি দেয়। তাই কয়েকদিন পর পরেই আরো ঘাস বিছিয়ে উঁচু করে নিতে হয়।
প্রথম কয়েকদিন এরফান মাতব্বরের বাড়ি থেকে সবার জন্য খিচুড়ি এসেছিল। এক গেরস্তের পক্ষে এত লোকের খাবার যোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই শরিকরা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিয়েছে। যাদের বাড়ি ধারেকাছে, তাদের খাবার আসে বাড়ি থেকে। বাকি সবাই ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে ভাওর ঘরেই রান্নার ব্যবস্থা করেছে। আলগা চুলোয় একবেলা বেঁধে তারা দুবেলা খায়। নিতান্ত সাদাসিধে খাওয়া। কোনো দিন জাউ আর পোড়া মরিচ, কোনো দিন ভাত আর জালে বা বড়শিতে ধরা মাছভাজা। আর বেশির ভাগ সময়েই ডালে-চালে খিচুড়ি।
চরের বাগ-বাটোয়ারা এখনো হয়নি। হবে পুরোটা চর জেগে উঠলে। কারণ তখনই জানা যাবে কোন দিকের জমি সরেস আর কোন দিকেরটা নিরেস। তবে এর মধ্যেই এরফান মাতব্বর চরটার মোটামুটি মাপ নিয়ে রেখেছে। পুব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য দুহাজার ষাট হাত। আর উত্তর-দক্ষিণে প্রস্ত আটশ চল্লিশ হাত। উত্তর-পূর্ব কোণের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে একটা ঘোঁজা। সেখানে আঁঠাই পানি। মাতব্বর মনে মনে ঠিক করে রেখেছে–কিভাবে ভাগ করা হবে জমি। চরটাকে মাঝ বরাবর লম্বালম্বি দুভাগ করতে হবে। তারপর টুকরো করতে হবে আটহাতি নল দিয়ে মেপে। এভাবে উত্তর অংশে ঘোঁজা বাদ দিয়ে দুই শত পয়তাল্লিশ আর দক্ষিণ অংশে দুই শ সাতান্ন–মোট পাঁচ শ দুই নল জমি পাওয়া যাবে। এক নল প্রস্থ এক ফালি জমির দৈর্ঘ্য চরের মাঝখান থেকে নদীর পানি পর্যন্ত চার শ বিশ হাতের কাছাকাছি। মোট শরিকের সংখ্যা ছাপ্পান্ন। প্রত্যেককে আট নল করে দিয়ে বেঁচে যাবে চুয়ান্ন নল। নিজের জন্য তিরিশ নল রেখে বাকিটা ভাগ করে দিতে হবে পুলকি-মাতব্বরদের মধ্যে।
ভাগ-বাটোয়ারা না হলেও কোলশরিকরা যার যার ভাওর ঘরের লপ্তে সুবিধামতো বোরো ধানের রোয়া লাগাতে শুরু করেছে।
.
চর দখল হয়েছে। এবার খাজনা-পাতি দিয়ে পরিষ্কার হওয়া দরকার। দুবছরের খাজনা বাকি, নদী-শিকস্তি জমির খাজনা কম। কিন্তু জমিদার-কাছারির নায়েব ওসবের ধার ধারে না। সে পুরো খাজনাই আদায় করে। কখনো দয়া হলে মাপ করে দেয় কিছু টাকা। কিন্তু চেক কাটে সব সময় শিকস্তি জমির। বাড়তি টাকাটা যায় নায়েবের পকেটে। এজন্য মাতব্বর কিছু মনেও করে না। সে ভাবে–নায়েব খুশি থাকুক। সে খুশি থাকলে কোনো ঝড়-ঝাঁপটা আসতে পারবে না।
এখন জমি পয়স্তি হয়েছে। চেক কাটাতে হবে পয়স্তি জমির। তাই এক পয়সাও মাপ পাওয়া যাবে না। তাছাড়া নায়েবকে খুশি করার জন্য সেলামিও দিতে হবে মোটা টাকা।
এরফান মাতব্বর তার পুলকি-মাতব্বরদের ডেকে আলোচনায় বসে। বৈঠকে ঠিক হয়–এখন নলপিছু দশটাকা করে খাজনা বাবদ আদায় করা হবে কোলশরিকদের কাছ থেকে। পরে ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গেলে নলপ্রতি তিরিশ টাকা সেলামি দিতে হবে এরফান মাতব্বরকে। জমির আসল মালিক সে-ই।
প্রায় সকলের কাছ থেকে টাকা আদায় হয়। বারো জন টাকা দিতে পারে না। তারা এত গরিব যে একবেলা দুমুঠো ভাত জোটানো মুশকিল হয় তাদের।
মাতব্বর কয়েকদিন তাগাদা দিয়ে বিরক্ত হয়ে যায়। শেষে একদিন তাদের ডেকে সাফ কথা বলে দেয়, যদি জমি খাইতে চাও, টাকা যোগাড় করো। আরো দুইদিন সময় দিলাম।
দিলে আমি অন্য মানুষ বোলাইয়া জমি দিয়া দিমু। জমির লেইগ্যা কত মানুষ ফ্যা-ফ্যা কইর্যা আমার পিছে পিছে ঘোরতে আছে।
নিরুপায় হয়ে আহাদালী, জমিরদ্দি ও আরো কয়েকজন ফজলকে গিয়ে ধরে।
জমিরুদ্দি বলে, কোনো রহমেই আমরা ট্যাহা যোগাড় করতে পারলাম না। কেউ কর্জও দিতে চায় না। আপনে যদি মাতব্বরের পো-রে কইয়্যা দ্যান।
উঁহু, আমার কথা শোনব না বাজান। জানো তো, কত বছর ধইর্যা খাজনা চালাইতে আছি আমরা?
আহাদালী বলে, তিন মাসের সময় চাই, খালি তিন মাস। তিন মাস পরেই বা দিবা কইতন? তা যোগাড় কইরা দিমু, যেইভাবে পারি। ধান লাগাইছি, দেহি—
ধানতো প্যাটেই দিতে অইব। ওতে কি আর টাকা আইব?
আইব। প্যাডেরে না দিয়া বেইচ্যা ট্যাহা যোগাড় করমু।
ফজলের চোখে-মুখে অবিশ্বাসের হাসি! সে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। কি যেন চিন্তা করে।
টাকাপয়সার টানাটানি চলছে এরফান মাতব্বরের সংসারেও। এ চরে আসার পরই ফজল পয়সা আমদানির একটা সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেছে। এতদিন কথাটা সে কাউকে বলেনি আজ এদের দুর্দশা দেখে সে আর থাকতে পারে না। বলে, একটা কাজ যদি করতে পারো তবে টাকার যোগাড় অয়। পারবা করতে?
পারমু না ক্যান, পারমু। কি কাম? জমিরুদ্দি বলে।
জোয়ারের সময় চরের উপরে মাছ কেমন ডাফলা-ডাফলি করে, দ্যাখছ?
হ দেখছি। একজন কোলশরিক বলে।
যদি বানা বানাইতে পার তবে এই মাছ বেড় দিয়া ধরা যায়।
বেড়ওয়ালা মালোগ মতন? আহাদালী জিজ্ঞেস করে।
হ।
মাছ ধইর্যা হেষে–?
শেষে আবার কি?
ফজল এমন করে হাসে যার অর্থ বুঝতে কষ্ট হয় না কারো।
জমিরদ্দি বলে, ও, আপনে মাছ বেচনের কথা কইতে আছেন!
তাতে দোষ কি?
দোষ না! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! তোবা তোবা তোবা! মাইনষে হোনলে কইব কি?
কি কইব?
জাউল্যা কইব। ছাই দিব মোখে।
কোলশরিকদের একজন বলে, মাছ বেচলে পোলা-মাইয়ার বিয়া দেওয়ন কষ্ট আছে।
আরে ধ্যাত! হালাল রুজি খাইবা, চুরি-ডাকাতি তো করবা না।
কিন্তু জাইত গেলে যে আর জাইত পাওয়া যাইব না।
প্যাটে ভাত জোটে না, তার আবার জাত। যাও জাত ধুইয়া পানি খাও গিয়া। আমার কাছে আইছ ক্যান্? আমি তোমায় জন্যই কইলাম। নইলে আমার ঠ্যাকাডা পড়ছে কি? ফজল রেগে ওঠে।
আহাদালী বলে, রাগ করেন ক্যান? মাইনষে তো আর দ্যাখব না প্যাডে ভাত আছে, নাই। তাগ টিটকারির চোডে—
যে টিটকারি দিব তার গলায় গামছা লাগাইয়া কইও, চাউল দে খাইয়া বাঁচি। টাকা দে জমিদারের খাজনা দেই।
একটু থেমে আবার বলে ফজল, কামলা খাইলে যদি জাত না যায়, ধান-পাট বেচলে যদি জাত না যায়, তবে মাছ বেচলে জাত যাইব ক্যান, অ্যাঁ?
জমিরদ্দি বলে, আপনেত কইতে আছেন। আপনে পারবেন মাছ বেচতে?
ফজল মনে মনে হাসে। মুখে বলে, হ পারুম। তোমরা মনে করছ, তোমাগ কুয়ার মধ্যে নামাইয়া দিয়া, আমি উপরে বইস্যা আতে তালি দিমু। উঁহু, আমিও আছি তোমাগ লগে।
জমিরদ্দি : আপনেও আছেন!
আহাদালী : অ্যাঁ, আপনেও থাকবেন আমাগ লগে!
ফজল : হ-হ-হ, আমিও থাকমু।
আহাদালী : মাতবরের পো জানে এই কথা?
ফজল : এখনো জানে না। তারে জানান লাগব।
আহাদালী : উনি কি রাজি অইব?
ফজল : তারে রাজি করানের ভার আমার উপর।
জমিরদ্দি : উনি যদি রাজি অয়, আর আপনে যদি আমাগ লগে থাকেন, তয় আর ডরাই কারে! কি কও তোমরা?
সকলে : হ, তাইলে আর ডর কি?
ফজল : আমি এখনি বাড়ি যাইতেছি। জমিরদ্দি আর আহাদালী চলো আমার সাথে।
.
এরফান মাতব্বর বিষম ভাবনায় পড়ে যায়। আর সবার মতো তারও সেই একই ভয়। ফজল মাছ বিক্রি করে লুকিয়ে-চুরিয়ে। কাজটা একা করে বলে কেউ জানবার সুযোগ পায় না। কিন্তু যেখানে দশজন নিয়ে কারবার, সেখানে ব্যাপারটা গোপন রাখা কোনো রকমেই সম্ভব নয়।
মাতব্বর বলে, নারে, পরের দিনই মুলুকের মানুষ জাইন্যা ফালাইব।
জানুক, তাতে কী আসে যায়। ফজল বলে।
কী আসে যায়! তখন মাইনষেরে মোখ দেখান যাইব? মাতব্বরের কণ্ঠে রাগ ও বিরক্তি।
একজন তো না যে মুখ দ্যাখাইতে শরম লাগব। বইতে পড়ছি–দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। যখন এতজনে একসাথে কাজটা করতে চাই তখন আর লজ্জা-শরম কিসের? এত মাইনষের বদনাম করতে মুখ বেদনা অইয়া যাইব না মাইনষের!
অনেক ভেবে-চিন্তে মাতব্বর শেষে নিমরাজি হয়। ফজল আশ্বাস দেয়–রোজ ভোর রাত্রে মাছ নিয়ে তারা চলে যাবে তারপাশা। সেখানে কেউ তাদের চিনবে না। কেউ জানতে পারবে না মাছ বেচার কথা।
.
দশজন যোগ দিয়েছে ফজলের সাথে। দুজন কেটে পড়েছে। তারা বলে দিয়েছে–না খেয়ে শুকিয়ে মরবে তবু তারা ইজ্জতনাশা কাজ করতে পারবে না।
নৌকা নিয়ে পরের দিনই ফজল হাটে যায়। সাথে যায় দলের কয়েকজন। তারা মাকলা আর তল্লা বাঁশ কেনে গোটা চল্লিশেক। আর কেনে সাত সের নারকেলের কাতা।
কাতা আর বাশগুলো ভাগ করে নেয় সবাই। প্রত্যেককে চারহাত খাড়াই আর পাঁচহাত লম্বাই ছ’খানা করে বানা তৈরি করতে হবে।
মাত্র দুদিন সময় দিয়েছিল ফজল। কিন্তু কাজ অনেক। বাঁশগুলোকে খণ্ড করা, খণ্ডগুলোকে ফেড়ে চটা বের করা, চটাগুলো চেঁচেছুলে এক মাথা চোকা করা, শেষে একটার পর একটা কাতা দিয়ে বোনা। এত ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার তৈরি হয় বানা আর তার জন্য লেগে যায় পুরো চারটে দিন।
বানা তৈরি করতেই যা ঝঞ্ঝাট। ও দিয়ে মাছ ধরা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। ভরা জোয়ারের পর ভাটার টান লাগার কিছুক্ষণ আগে বানা পুঁতে বেড় দিতে হয়। ধনুকের আকারে সে বানা ঘিরে থাকে অনেক জায়গা। ভাটার সময় পানি নেমে যায় আর মাছ আটকা পড়ে বেড়ের ভেতর। আড়, বোয়াল, বেলে, বাটা, ট্যাংরা, টাটকিনি, পাবদা, চিংড়ি ইত্যাদি ছোট-বড় নানা রকমের মাছ। রাত্রের বেড়ে দু-চারটে রুই-কাতলা-মৃগেল-বাউসও পাওয়া যায়। পানির মাছ ডাঙায় পড়ে লাফালাফি ছটকাছটকি করে।
ফজল আর তার সঙ্গীরা হৈ-হুঁল্লোড় করে হাত দিয়ে ধরে সে মাছ। অনেক সময় পানি নেমে যাওয়ার অপেক্ষাও করে না তারা। অল্প পানির মধ্যে গোলাগুলি করে, আছাড় পাছাড় খেয়ে মাছ ধরায় আনন্দ বেশি, উত্তেজনা, বেশি। এজন্য অবশ্য মাঝে মাঝে বাতাশি, বজুরি আর ট্যাংরা মাছের কাঁটার জ্বলুনি সইতে হয়, চিংড়ি আর কাঁকড়ার চেঙ্গি খেয়ে ঝরাতে হয় দু-চার ফোঁটা রক্ত।
একবার দিনের বেলা প্রকাণ্ড এক রুই মাছ আটকা পড়েছিল বেড়ে। এত বড় মাছ দিনের বেলা তো দূরের কথা, রাত্রেও কদাচিৎ আসে অগভীর পানিতে। বোধহয় শুশুকের তাড়া খেয়ে কিনারায় এসেছিল মাছটা। ভাটার সময় বেড়ে বাধা পেয়েই ওপর দিয়ে লাফ মেরেছিল। লাফটা কায়দা মতো দিতে পারলে বানা ডিঙ্গিয়ে বেরিয়ে যেতে পারত। আরেকবার লাফ দেয়ার আগেই ফজল সবাইকে নিয়ে ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর সে যে কি পাছড়া পাছড়ি! পানির জীবকে পানির ভেতর কাবু করা কি এতই সোজা! ধস্তাধস্তির সময় মাছের গুঁতো খেয়ে কয়েকজনের শরীরে জায়গায় জায়গায় কালশিরা পড়ে গিয়েছিল।
পঁচিশ সের ওজন ছিল মাছটার। বেচার সময় মাপা হয়েছিল। দাম পাওয়া গিয়েছিল আট টাকা।
রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টায় জোয়ার-ভাটা খেলে দু’বার। এ দু’বারই শুধু বানা পুঁতে বেড় দিয়ে মাছ ধরা যায়। দিনের জোয়ারে খুব বেশি সুবিধে হয় না। সুবিধে হয় রাত্রের জোয়ারে।
দিনে বেড় দিয়ে যে মাছ পাওয়া যায় তার কিছুটা খাবার জন্য ফজল ও তার সাথীরা ভাগ করে নেয়। মাঝে মাঝে চরের আর শরিকদেরও দেয়া হয় কিছু কিছু। বাকিটা বড় বড় চাই-এর মধ্যে ভরে পানির ভেতর জিইয়ে রাখে। রাত্রে ধরা মাছের সাথে সেগুলো নিয়ে তারা ভোর রাত্রে চলে যায় তারপাশা।
চিংড়ি আর বড় মাছ কেনে মাছের চালানদাররা। তারা কাঠের বাক্সে ভরে বরফ দিয়ে সে মাছ চালান দেয় কলকাতায়। এদের কাছ থেকে ভালো দাম পাওয়া যায়। ছোট মাছগুলো সস্তায় বেচে দিতে হয় নিকারি-কৈবর্তের কাছে।
মাছ বিক্রি করে তারা ভোর আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে ফিরে আসে। জমিরদ্দিন সরু ডিঙি সাত বৈঠার টানে ছুটে চলে বাইচের নৌকার মতো। উজান ঠেলে মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা পৌঁছে যায় তারপাশা। সেখান থেকে ভাটি পানিতে ফিরে আসতে আধঘণ্টাও লাগে না। রোজ পনেরো-বিশ টাকা আসে মাছ বেচে। এভাবে আরো পনেরোটা দিন চালাতে পারলে যোগাড় হয়ে যাবে দশ জনের খাজনার টাকা।
টাকার গন্ধে অনেকেরই লোভ জাগে, ভিড়তে চায় দলে। কিন্তু ফজল তাদের পাত্তা দেয় না। যে দুজন মান-ইজ্জত নিয়ে সরে-পড়েছিল, তারা এসে যোগ দিতে চায়।
ফজল রেগে ওঠে। তাদের মুখের ওপর বলে দেয়, ওঃ, এখন জুইতের নাও বাইতে আইছ। তোমরা। উঁহু, তোমরা তোমাগ জাত-মান লইয়া থাক গিয়া। আমাগ দলে জায়গা নাই।
কিন্তু ফজলের রাগ মাটি হয়ে যায় দুদিনেই। সে তাদের ডেকে বলে, যদি আসতে চাও তবে আর সবাইর মতন বানা তৈরি করো।
.
০৬.
দিঘিরপাড় কাছারির নায়েব সীতানাথ ভৌমিককে দেখে ভদ্র বলেই মনে হয়েছিল ফজলের। কিন্তু তার কথা-বার্তার ধরন দেখে সে বুঝতে পারে, লোকটা ভদ্র শুধু কাপড়-চোপড়ে। সে তার পিতার সাথে তুমি-তুমি করে কথা বলছে, যদিও বয়সে সে তার চেয়ে কম করে হলেও পনেরো বছরের ছোট।
ফজলের রাগ ধরে যায়। রাগটাকে কোনো রকমে বাগ মানিয়ে সে ধীরভাবে বলে নায়েব মশাই, আপনাদের বয়স ষাট পার হইয়া গেছে না?
নায়েবের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। প্রশ্নকারীকে দেখে নিয়ে সে এরফান মাতব্বরকে বলে, ছেলেটা তোমার না মাতবর?
হ বাবু।
বলিহারি ছোঁড়ার আন্দাজ। ফজলের দিকে কটমট করে তাকিয়ে তারপর বলে, আমার বয়স দিয়ে তোর দরকার কিরে অ্যাঁ।
না, এমনিই জিজ্ঞাস করলাম। বাজানের বয়স পঞ্চান্ন। তার সাথে যখন তুমি তুমি’ কইর্যা কথা কইতে আছেন, তখন আন্দাজ করলাম আপনের বয়স ষাট পার হইয়া গেছে।
এরফান মাতব্বর ধমকে ওঠে, অ্যাই ফজু, শতয়তা–ন, চো-প।
ধমক তো নয়, যেন একটা বাঘ গর্জে উঠেছে। নায়েবের কলজে পর্যন্ত কেঁপে ওঠে সে ধমক শুনে। মাতব্বরের গম্ভীর মুখ আর ক্রোধরক্তিম চোখের দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করে সে।
মুখ-চোখের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে এনে মাতব্বর অনুনয়ের সুরে বলে, নায়েব বাবু, রাগ কইরেন না। পোলাডার বুদ্ধি-বিবেচনা এহনো পাকে নাই। কার লগে ক্যামনে কথা কইতে অয়, এহনো হিগে নাই। আপনে ওরে মাপ কইরা দ্যান। অ্যাই ফজু? বাবুর কাছে মাপ চা। মাতব্বর পেছন দিকে মুখ ঘোরায়।
ফজল নেই।
মাতব্বর উঠে দরজা পর্যন্ত গিয়ে দেখে ফজল অনেক দূর চলে গেছে, হেঁটে যাচ্ছে হনহন করে।
ফিরে এসে সে বলে, বাড়িতে গিয়া লই। ওরে আচ্ছা মতন মালামত করমু। আপনে রাগ অইয়েন না।
ছেলেটাকে লেখাপড়া শেখান হয়েছে বোধহয়? নায়েব বলে। আগের মতো তুমি উচ্চারণ করতে আর উৎসাহ পায়না তার মুখ।
হ, এই কেলাস নাইন পর্যন্ত পড়ছে। সংসারের কাজ-কামের লেইগ্যা আর পড়াইতে পারলাম না।
যতটুকু পড়েছে তার জন্য অনেক ভোগান্তি আছে। শেখের ছেলে একটু লেখাপড়া শিখলেই জাত-গোত্রের কথা ভুলে যায়। মনে করে নওয়াব সিরাজদ্দৌলা হয়ে গেছে। ছেলেটা কাজ-কর্ম কিছু করে, না খালি আলফেট কেটে ঘুরে বেড়ায়?
না কাম-কাজ করে। আমি তো বুড়া অইয়া গেছি সংসারের বেবাক কাম এহন ও-ই করে।
করলেই ভালো। দেখি, পুরান চেক-দাখিলা কি আছে।
এরফান মাতব্বরের হাত থেকে খাজনার পুরানো চেক নিয়ে সে কাছারির খাতাপত্র দেখে। দু’বছরের খাজনা বাকি।
নায়েব বলে, জমিতো ভগবানের ইচ্ছায়, গঙ্গার কৃপায় পয়স্তি হয়েছে। সেলামি দিতে হবে এবার।
তা দিমু।
দিমু তো বুঝলাম, কিন্তু কবে?
আইজই দিমু। আপনে খাজনার চেক কাডেন। একসাথে দিতে আছি।
উঁহু আগে সেলামির টাকা, তারপর খাজনা।
এরফান মাতব্বর এক হাজার টাকা নায়েবের হাতে তুলে দেয়।
কত?
পুরা হাজার টাকাই দিলাম।
উঁহু। আরো এক হাজার লাগবে।
এরফান মাতব্বর হাতজোড় করে বলে, আর দাবি কইরেন না, বাবু। চরডা লায়েক অউক। তখন আপনেরে খুশি করমু।
কিন্তু খুশি করার সময়ই তো এখন। কই, আর কি আছে দেখি?
আর দুই সনের খাজনার টাকা আনছি।
কই দেখি।
নায়েব হাত পেতে আরো চারশ’ টাকা নিয়ে মাতব্বরের কাছ থেকে। বাংলা ১৩৪৭ সালের চেক কেটে মাতব্বরের হাতে দেয়।
এক সনের চেক দিলেন নি বাবু?
হ্যাঁ, গত সনের চেক দিলাম। এই সনের খাজনা পরে দিলেই চলবে।
মাতব্বর কাছারি থেকে বেরোয়। তার মনে আফসোস–এক থেকে অনেকগুলো টাকা। নেমে গেল। জমিদারের সেলামি দিতেই গেল বারো শ টাকা। মাতব্বর জানে–জমিদারের না, নায়েবের কাম। সেলামির টাকা সবটাই উঠবে নায়েবের সিন্দুকে। সে মনে মনে বলে, যত কাড়ি সুতা, সব নেয় বামনের পৈতা।
মাতব্বর নৌকাঘাটে আসে। নৌকায় কেউ নেই। হাঁক দেয়, কই গেলিরে তোরা?
মেরামতের জন্য ডাঙার ওপর কাত করে রাখা ঢুশা নৌকার আবডালে ছায়ায় বসে ষোলঘুটি খেলছিল ‘বাইছা’ দু’জন। ডাক শুনে তারা গামছা ঝাড়তে ঝাড়তে ছুটে আসে। দু’জনই কোলশরিক। নৌকা বাইতে তাদের নিয়ে এসেছে মাতব্বর।
ফজল কইরে? সে নায় আহে নাই?
আইছিল। সে আমাগ লগে যাইব না। পরে যাইব।
পরে যাইব! ক্যান?
হে কইছে, আইজ দিঘিরপাড় খেলা আছে। তারিখের খেলা। হেই খেলা দেইখ্যা যাইব।
কিয়ের খেলা?
কপাটি খেলা।
তারিখ দিছে কারা?
তারিখ দিছে। মাঝেরচরের আক্কেল হালদার আসুলিগ লগে। গেল হাটবার চর আর আসুলিগ মইদ্যে জিদাজিদি অইছে।
তারিখ তো দিছে। পারব আসুলিগ লগে?
পারব না ক্যান্। আক্কেল হালদার দক্ষিণপাড় গেছে। পালং আর ভোজেশ্বর তন বড় বড় খেলোয়াড় লইয়া আইব।
তোরা আল্লার নাম লইয়া নাও ছাড়। ফজু থাউক পইড়া। খেলা দ্যাখলেই প্যাড ভরব। জোরে বৈডা চালা। বাড়িতে গিয়া যে আছরের নামাজ পড়তে পারি।
উজান পানি। স্রোত ভেঙে ছলচ্ছল আওয়াজ তুলে নৌকা চলছে দুলতে দুলতে।
নৌকায় ছই নেই। মাতব্বর ছাতা মাথায় দিয়ে বসে। তার মনে নানা ভাবনা-চিন্তার জটলা লেগেই থাকে সব সময়। আজ আবার সেখানে যোগ দিয়েছে আর এক ভাবনা।
ভাবনা হয়েছে ফজলের আজকের ব্যবহারে। নায়েব না হয় বেতমিজের মতো তুমি তুমি করে কথা বলছিল। সে জন্য ওভাবে ঠেস দিয়ে কথা বলার কী দরকার ছিল ওর? সে হলো নায়েব। জমির মালিক যে জমিদার, তার নায়েব। এদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তোয়াজ-তাজিমের সাথে। কটু কথা বললেও গায়ে মাখতে হয় না তা। এদের সাথে আড়ি দিয়ে, মেজাজ দেখিয়ে কি চরে বসত করা যায়? একটু নারাজ হলেই এরা এদের মেহেরবানির ঝাপি তুলে দেবে অন্যের হাতে। দিনকে বানিয়ে ফেলবে রাত। তার বয়স উমরেই সে কত দেখেছে–আসল হকদারকে ভোজবাজি দেখিয়ে কেমন করে এরা নতুন চরের আলমদারি দেয় অন্য লোককে। তারপর আর কি! চরের দখল নিয়ে বেঁধে যায় মারামারি খুনাখুনি। মামলা-মোকদ্দমার অতল গহ্বরে নেমে যায় বেশুমার টাকা। এভাবে সে নিজেও বড় কম ভোগেনি।
মাতব্বর বুঝতে পারে, এরকম মেজাজ নিয়ে ফজল কোনো দিনই চরে বসত করতে পারবে না। তাই তাকে নসিহত করার কথা চিন্তা করে সে। কিন্তু ছেলেকে নসিহত করার মতো মনের জোর নেই তার।
অভাবের সময়ে সে পুতের বউর গয়না বন্ধক দিয়েছে। সে ছুতোয় ছেলের শ্বশুর আরশেদ মোল্লা তার মেয়ে আটকে রেখেছে। বউ আনবার জন্য দুবার লোক পাঠিয়েছিল মাতব্বর। মোল্লা বলে পাঠিয়েছে, মাইয়ার শরীলের গয়না পুরা না লইয়া যেন আর মাইয়া নেওনের কথা মোখ দিয়া কয় না।
তারপর সাত মাস পার হয়ে গেছে, ছেলে আর বউর দেখাসাক্ষাৎ একদম বন্ধ। যদিও এর জন্য বেয়াইকেই দায়ী করে, তবুও নিজের দোষটাও মাতব্বর অস্বীকার করে না। তার মনেও ঢুকেছে কেমন একটা সঙ্কোচ যার ফলে সে ছেলেকে আগের মতো কড়া কথায় ভর্ৎসনা করতে পারে না আজকাল।
মনের পর্দায় আরশেদ মোল্লার ছায়া পড়তেই তার রাগ ফণা বিস্তার করে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে সে মনে মনে বলে, সোনাদানা আমি দিছিলাম। আমিই বন্দক দিছি। আল্লায় দিন দিলে আবার আমিই ছাড়াইয়া আনমু। তুই ত আধা পয়সার গয়নাও দেস নাই। তুই ক্যান্ মাইয়া আটকাবি? মাইয়া আকটাইয়া করবি কি তুই?
তার মনের অনুচ্চারিত প্রশ্ন থামে। যেন উত্তর চায় প্রতিপক্ষের। তারপর আবার তার ক্ষুব্ধ মন চেঁচিয়ে ওঠে, মাইয়া আটকাইয়া ঘরে খাম্বা দিবি? দে খাম্বা। দেহি কদ্দিন ঘরে রাখতে পারস মাইয়াডা। আমি আবার আমার পোলারে বিয়া করাই।
বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়ে। মাতব্বরের মনের ঝগড়াও থামে তখনকার মতো।
রাত্রে খেতে বসে সে স্ত্রী-কে বলে, হোন ফজুর মা, আরশেদ মোল্লারে এমুন একটা ঠাসা দিমু–
ক্যান?
ক্যান্ আবার! মাইয়া আটকানের মজা দেহাইয়া দিমু। ওর মাইয়া আননেরও দরকার নাই, ছাড়নেরও দরকার নাই। ওর মাইয়া ওর বাড়িতেই পচুক, বুড়ি অউক। ফজুরে আবার আমি বিয়া করাইমু।
যা করে যে চিন্তা-ভাবনা কইর্যা করে।
এর মইধ্যে চিন্তা-ভাবনার কি আছে?
চিন্তা-ভাবনার কিছু নাই? অইবার সারদা আইনের বচ্ছর ‘ওঠ ছ্যামড়া তোর বিয়া’ কইয়া ফজুরে বিয়া করাইল। কয়ডা বচ্ছর পরেই আবার ভাইঙ্গা দিল বিয়া। এতে আল্লা বেজার অয় না?
অতীতের ভুলের কথা তুলতেই চুপ হয়ে যায় মাতব্বর।
অনেকক্ষণ পর সে বলে, আমার দোষ দিলে কি অইব। আসলে তোমার পোলাডারই বউর ভাগ্য নাই।
.
০৭.
হা-ডু-ডু খেলার প্রতিযোগিতা। খেলার ভেতর দিয়ে চর আসুলির শক্তি পরীক্ষা হবে আজ।
সামান্য কথার খোঁচা থেকে এ আড়াআড়ির সৃষ্টি হয়েছে। দিঘিরপাড়ের গুড়ের আড়তদার হাতেম শিকদার তার পাশের ধানের আড়তদার আক্কেল হালদারকে সেদিন কথায় কথায় বলেছিল, আরে দ্যাখা আছে। তোমাগ চরে আবার খেলোয়াড় আছেনি! আছে সব–
কি কইলা! খেলোয়াড় নাই!
নাই-ইতো। তোমরা পার ঢাল-কাতরা লইয়া খুনাখুনি করতে।
আমরা খুনাখুনি করতেও পারি, খেলতেও পারি।
পার আমার ইয়ে। আমাগ মাকুহাটির ফরমানের খেলা দ্যাখছ? ও একবার ‘কপাইট’ কইয়া ডু’ দিলে তোমায় খেলোয়াড়রা ছ্যাড়া খাইয়া ভাইগ্যা যাইব।
‘আর ছাড়ান দ্যাও। ওই রহম খেলোয়াড় গণ্ডা গণ্ডা আছে আমাগ চরে।
আছে! তবে খেইল্যা দ্যাহাও না একদিন।
হ দ্যাহাইমু।
কবে? তারিখ দ্যাও।
তুমি দ্যাও তারিখ।
পরশু মঙ্গলবার।
না, তার পরের দিন বুধবার।
আজ সেই খেলার তারিখ বুধবার।
খেলার মাঠ লোকে লোকারণ্য। জেদাজেদির খেলা। দর্শকের ভিড় তো হবেই। দুই অঞ্চলের উগ্র সমর্থকদের মনে উত্তেজনার বারুদ। শান্তিরক্ষার জন্য সশস্ত্র পুলিস এসে হাজির হয়েছে।
বড় ময়দানের মাঝখানে দাগকাটা খেলার কোট। ষোল হাত দীর্ঘ আর দশ হাত প্রস্থ কোটটিকে মাঝখানে দাগ কেটে সমান দু’ভাগ করা হয়েছে দুই দলের জন্য। কোটের চারপাশে বাঁশের খোটা পুঁতে তার সাথে মোটা রশির ঘের বাঁধা হয়েছে। সে ঘেরের বাইরে সারি সারি লোক বসে গেছে। তাদের পেছনে গায়ে গায়ে মেশামিশি হয়ে দাঁড়িয়েছে বেশির ভাগ দর্শক।
বিকেল চারটায় খেলা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু চরের দল এখনো আসেনি। আসুলির খেলোয়াড়রা অনেক আগেই এসে গেছে। বিক্রমপুরের দুর্ধর্ষ খেলোয়াড় সব। বজ্রযোগিনীর বাদল, মাকুআটির ওসমান আর ফরমান দুই ভাই, কামারখাড়ার ভজহরি, কলমার আল্লাস, সোনারং-এর কালীপদ আর পাঁচগাঁর শাসমু এসেছে। হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরে তারা কোটের এক অংশে তৈরি হয়ে বসে আছে।
দর্শকরা অধৈর্য হয়ে ওঠে। অধৈর্য হয়ে ওঠেন স্বয়ং রেফারিও। তার মুখের বাঁশির আওয়াজে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। কিছুক্ষণ পরে পরেই তিনি তাঁর হাতঘড়ি দেখছেন আর জোড়া ফুঁ দিচ্ছেন বাঁশিতে।
অতি উৎসাহী ছেলে-ছোকরার দল নৌকাঘাটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চরের দিক থেকে লোক বোঝাই কোনো নৌকা দেখলেই তারা হৈ-হৈ করে ওঠে, ঐ যে–ঐ ঐ আইতে আছে! তারপর ছড়া আবৃত্তি করতে থাকে সমস্বরে–
হেঁই কপাটি তুলা ধোন,
মশা করে ভোন্ ভোন্।
মাছির কপালে ফোঁটা,
মইষ মারি গোটা গোটা।
কোলাহল শুনে দর্শকরা একটু আশান্বিত হয়। কিন্তু নৌকা কাছে এলে দেখা যায়– খেলোয়াড়দের কেউ আসেনি। এসেছে তাদের নৈরাশ্যের কয়েকজন ভাগীদার শুধু।
আসুলির লোকেরা ভুড় দিতে শুরু করে। তারা বলে, চরুয়ারা আইব না। ওরা ডরাইয়া গেছে।
চরাঞ্চল থেকেও বহু লোক খেলা দেখতে এসেছে। আসুলির লোকদের ঠেস-টিটকারি শুনে তাদের মুখ কালো হয়ে যায়। কচ্ছপের মতো সুবিধে থাকলে হয়তো তারা তাদের মাথা লুকিয়ে ফেলত লজ্জায়।
এক পক্ষ যখন আসেনি তখন অন্য পক্ষ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করবে। সেই জয় ঘোষণা করতে হবে রেফারিকে। তিনি বাঁশি বাজান, হাত নেড়ে প্রতিপক্ষের খালি কোটে ‘ডু’ দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন আসুলির দলকে।
হঠাৎ ভিড় ঠেলে খালি মাঠে নামে একজন লোক। লোকটিকে সবাই চেনে। সাতকচরের সোলেমান। সে এক কালের নামকরা খেলোয়াড়। এখন বয়স হয়েছে। মাথার কাঁচা-পাকা চুল দেখেই বোঝা যায়, বয়স তার চল্লিশ পার হয়ে গেছে। সাত-আট বছরের মধ্যে তাকে কোথাও খেলায় নামতে দেখা যায়নি।
রেফারির দিকে এগিয়ে সোলেমান বলে, নগেন বাবু, চরের খেলোয়াড়রা আহে নাই। কিন্তু আমরা আছি চরের মানুষ। আমরা খেলুম বিনা খেলায় আসুলিগ জিত্যা যাইতে দিমু না।
রেফারি বলেন, কিন্তু তোমাদের আক্কেল হালদার কোথায়? খেলার তারিখ দিয়ে এমন–
হুনছি, সে খেলোয়াড় আনতে গেছে দক্ষিণপাড়। মানুষটা এহনো আইল না ক্যান্ কে জানে?
দর্শকদের ভেতর থেকে একজন বলে, আইব কি, ডরের চোডে পথ ভুইল্যা গেছে।
রেফারি সোলেমানকে বলেন, তবে নেমে পড়। কোথায় তোমার খেলোয়াড়রা?
এই আনতে আছি। দশটা মিনিট সময় দ্যান।
সোলেমান চারদিকের দর্শকদের ওপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে হাঁক দেয়, কে আছস রে তোরা? চরের ইজ্জত না যাইতে শিগগির আয়।
ভিড়ের মাঝ থেকে ফজল ও আরো তিনজন এসে যোগ দেয় সোলেমানের সাথে।
খেলা হবে না ভেবে দর্শকরা মনমরা হয়ে গিয়েছিল। এবার তারা আনন্দে কোলাহল করে ওঠে, হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায়, উৎসাহ দেয় চরের খেলোয়াড়দের।
এখনো দু’জন খেলোয়াড়ের অভাব। সোলেমান ও ফজল দর্শকদের মধ্যে পরিচিত লোক খুঁজে বেড়ায়।
ফজলের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় একটি ছেলের। রূপজানের মুখের আভাস আনন্দ জাগায় তার মনে।
দশ বছরের ছেলেটি তার শ্যালক। সে রশির বেড়া ঘেঁষে বসে আছে। দুলাভাই মাঠে নামার পর থেকেই সে তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বারবার হাত নাড়ছিল।
হাসি বিনিময় করে ফজল তার কাছে এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে, এই দেলু কার সাথে আসছ?
কাদিরভাইর সাথে। আরো কত মানুষ আইছে!
ফজল গায়ের জামা খুলে দেলোয়ারের হাতে দিয়ে তার কানে কানে বলে, এইডার মধ্যে টাকা আছে সাবধানে রাইখ্য।
আচ্ছা। জানেন দুলাভাই, কাদিরভাই কিন্তু খুব ভালো খেলে।
তাই নাকি?
হ, খুব লেংড়ি দিতে পারে।
তাই নাকি! কই সে?
দেলোয়ার পেছন দিকে তাকায়। কাদিরকে খুঁজে পেয়ে সে বলে, ওই যে দুলাভাই।
ফজলের চোখে চোখ পড়তেই তার চাচাতো শ্যালক কাদির হেসে ওঠে।
ফজল তাকে ডাকে, তাড়াতাড়ি নামো। সময় নাই।
কাদির হাত নেড়ে খেলতে অসম্মতি জানায়। কিন্তু দর্শকরা তাকে ঠেলে মাঠে নামিয়ে দেয়।
অন্য দিক থেকে সোলেমানও একজনকে জোর করে মাঠে নামায়।
খেলার পোশাক নেই কারো। এভাবে খেলায় নামতে হবে কে জানত? খুঁজে-পেতে একটা প্যান্টও যোগাড় করতে পারে না কেউ। কি আর করা! খেলোয়াড়রা সবাই লুঙ্গিতে কাছা মেরে নেয়।
সোলেমান তার খেলোয়াড়দের কোটের এক কোণে জড় করে নিচু গলায় পরামর্শ দেয়, দ্যাখো, তোমরা ওগ বড় বড় খেলোয়াড় দেইখ্যা ঘাবড়াইয়া যাইও না। খালি ঠ্যাকা দিয়া যাইবা। কোনো উপায়ে ড্র’ রাখতে পারলেই আইজ ইজ্জত বাঁচে। তোমরা ধীরে-সুস্থিরে খেলবা। ওরা চেতলেও চেতবা না। আবার সুযোগ পাইলেও ছাড়বা না। ঐ যে বাদল ফরমান। দাঁতাল শুয়রের মতন শক্তি ওগ গায়। ওরা কিন্তু গোতলাইয়া লইব। কায়দা মতন না পাইলে ওগ ধরবা না। আর ঐ যে কালীপদ–ব্যাডা কুলুপের ওস্তাদ। ডু দেওয়ার সময় হুঁশিয়ার। ভজার পায়ে কিন্তু সাংঘাতিক জোর। ও পাও আউগাইয়া দিব, লেংড়িও দিব। কিন্তু কেও ধরবা না। ধরলেই কিন্তু ঘোড়ার মতন ছিটা লাথি মাইর্যা যাইব গা। শামসু ঢুশ দিয়া ধরে। আর ঐ যে আলাস–ওরে বেড় দিলেই লাফা মাইর্যা চইল্যা যাইব।
রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে তৈরি হওয়ার জন্য তাড়া দেন।
সোলেমান রেফারিকে দুটো আঙুল দেখায়। আরো দুমিনিট সময়ের প্রার্থনা।
সে আবার শুরু করে, তোমাগ মইদ্যে কুলুপ জানে কে?
আমি জানি। ফজল বলে।
ঠিক আছে, তুমি ডান কিনারে থাকবা। আর আমি থাকমু বাঁ কিনারে।
আচ্ছা, তবে আমার পাশে থাকব লখাই। ও কুলুপ দেওনের ভান করব, তা অইলে যে ডু দিতে আইব, তার নজর থাকব লখাইর উপরে। তখন পাশের তন কুলুপ দিমু আমি?
হ দিও। কিন্তু যখন তখন কুলুপ দিও না। তুমিতো ডু দিতেও পারবা?
হ পারমু।
আর কার কি গুণ আছে কও দেহি শিগগির।
নিজের মুখে নিজের গুণ জাহির করতে লজ্জা পায় সবাই।
ফজল বলে, এই যে কাদির, ও পারে লেংড়ি দিতে।
বেশ বেশ! সাবধানে ডু দিবা। কালীপদর দিগে কিন্তু ঠ্যাং বাড়াইও না।
আর ঐ যে কোরবান। ও পারে হাতে কুলুপ দিতে।
উঁহু। ওরা যেমুন জুয়ান, হাতে কুলুপ দিয়া জুত করতে পারবা না। ঠিক আছে, তুমি হাতে কুলুপ দেওনের ভান করবা আর আমি তখন সুবিধা পাইলে কুলুপ দিমু বাইয়া পায়ে।
মধু আর তালেবের তেমন কোনো বিশেষ গুণ নেই। তারা মাঝে মাঝে ডু’ দেবে আর বিপক্ষের খেলোয়াড় ধরার সময় সাহায্য করবে।
সোলেমান আরো বলে, যে পয়লা ধরবা, হে যদি বোঝ ধরা ঠিক অইছে, তয় ‘ধর’ কইয়া আওয়াজ দিবা। তখন আর সবাই ঝাপাইয়া পড়ব। যাও আর সময় নাই। যার যার জায়গা লও গিয়া।
খেলা শুরু হয়।
রেফারির বাঁশির নির্দেশ পেয়ে আসুলির দলের বাদল প্রথমে ‘ডু’ দেয়, ডিগিড্ডিগিড্ডি গিড্ডিগি–
তার উত্তরে সোলেমান ডু’ দেয়, কপাইচ-কপাইচ—কপাইচ–
আলকাস : ট্যাগাট্টাগাট্টাগা–
ফজল : ড্যাগাড্ড্যাগাড্ড্যাগাড্ড্যাগা—
ফরমান : কপাইট–কপাইট–কপাইট–
উত্তেজনাহীন ‘ডু’-এর মহড়া চলে কিছুক্ষণ। তারপরই আসুলির দল মেতে ওঠে। বাদল, ফরমান আর আল্লাসের ‘ডু’-এর দাপটে বিব্রত বোধ করে চরের দল।
ছোট্ট সীমিত কোটের মধ্যে সাতজন খেলোয়াড়ের দাঁড়াবার জায়গা। এর মধ্যে থেকেই বিপক্ষের আক্রমণের মোকাবেলা করতে হবে। চরের দল তাড়া খেয়ে শেষ সীমারেখার কাছে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করে।
ফরমান ‘ডু’ দিয়ে এগিয়ে যায়, মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে থাবা মারে। কোরবান লোভ সামলাতে পারে না। সে ফরমানের হাতে কুলুপ দিয়ে বসে। কিন্তু তার হাতের ঝটকা টানে কোরবান উপুড় হয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয়।
দলের একজন কমে গেল। সোলেমান ‘ডু’ দেয়। সময় কাটাবার জন্য মধ্য রেখার কাছ দিয়েই ঘুরে ঘুরে সে ‘কপাইচ–কপাইচ’ করে। সময় বেশি নিচ্ছে দেখে রেফারির সন্দেহ হয়, দম চুরি করছে বোধ হয় সোলেমান। তাইতো! তিনি বাঁশিতে ফুঁ দেন। কিন্তু কেউ ছুঁয়ে মারবার আগেই সোলেমান লাফিয়ে ভেগে আসে।
ভজহরি ‘ডু’ দিতে এগিয়ে আসে। ফজলের দিকে ডান পা এগিয়ে দেয় সে। চোখে তার অবজ্ঞার হাসি। ভাবটা এই–সাহস থাকলে ধরো না দেখি, কত মুরোদ। ফজল লখাইকে কনুইর গুঁতো মেরে ইশারা করতেই সে কুলুপ দেয়ার ভান করে। ভজহরি লেংড়ি দেয় লখাইকে। অমনি ফজল ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মাজার ওপর। জাপটে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, ধর।
সাথে সাথে আর তিনজনে ধরে রেখে দেয় ভজহরিকে।
সোলেমান ফজলকে বাহবা দেয় আবার চুপিচুপি সাবধানও করে, ওইভাবে ঝাপাইয়া পইড় না। বুকে চোট লাগতে পারে।
ভজহরি মরে যাওয়ায় কোরবান তাজা হয়েছে। ফজল ‘ডু’ দেয়। সোলেমানের মতো সে-ও সময় ধ্বংস করে।
‘ট্যাগাট্টাগা’ করতে করতে আসে আল্লাস। সে বাঁ দিকের খেলোয়াড়দের সোজা তাড়িয়ে নিয়ে চলে। সোলেমান আর কোরবানের ‘জল্লা’ যাওয়ার মতো অবস্থা। ফজল দৌড়ে যায় আল্লাসকে ধরতে। কিন্তু সে সোলেমানকে ছুঁয়ে, লাফ মেরে ফজলকে ডিঙিয়ে পালিয়ে যায়।
আসুলির সমর্থকরা আনন্দে হাততালি দেয়।
দলের দুই প্রধান খেলোয়াড় মারা গেছে। এবার আর উপায় নেই।
কাদির ‘ডু’ দেয়ার জন্য মধ্যরেখার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সতেরো বছরের নব যুবক। সুপারি গাছের মতো ওর দৈর্ঘ্য আছে, প্রস্থ নেই। হাত-পা কাঠিকাঠি, যেন তালপাতার সেপাই। ওকে দেখে আসুলির খেলোয়াড়রা অবহেলার হাসি হাসে, হাতে তুড়ি মেরে ঠাট্টা করে। তাদের ঠাট্টার জবাবে সে ‘ডু’ দেয়–
‘হেঁই কপাটি কয় বাড়ি?
সাবু খাইছ কয় বাট্টি?’
রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দেন। হাত নেড়ে বলেন, এরকম ছড়া কেটে ‘ডু’ দেয়া চলবে না। আবার ‘ডু’ দাও।
কাদির ‘ডিগডিগ’ করতে করতে এগিয়ে যায়।
কালিপদ আর ওসমান মাটির ওপর থাবড়া মেরে ওকে ভয় দেখায়। কিন্তু ও ঘাবড়ায় না। ওর ‘ডু’ চলতে থাকে।
হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে কালীপদর পায়ে লেংড়ি মেরে সে চলে আসে।
চারদিক থেকে হাততালি পড়ে। কেউ কেউ বলে, পচা শামুকেও পা কাটে।
সোলেমান আনন্দের আতিশয্যে কাদিরকে কাঁধের ওপর নিয়ে নাচতে থাকে। কালীপদ মারা পড়ায় বেঁচে ওঠে সোলেমান ও ফজল। আবার পুরো হয় চরের দল।
কিন্তু একটু পরেই ফরমানের আক্রমণে মারা যায় কাদির আর মধু। তারও কিছুক্ষণ পরে তালেব ‘ডু’ দিতে গিয়ে ধরা পড়ে।
বিরতির বাঁশি বাজে। খেলার অর্ধেক সময় শেষ হলো। আসুলির দলের সবাই তাজা। চরের দলে বেঁচে আছে চারজন।
দশ মিনিট বিশ্রামের পর আবার খেলা শুরু হয়।
সোলেমান ‘ডু’ দিয়ে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে যায়। একটু এগিয়ে ওসমানের ওপর থাবা মারতেই শামসু ঢুস দিয়ে ধরবার জন্য ছুটে আসে। সোলেমান চক্কর মেরে শামসুকে ঘূর্ণা খাইয়ে চলে আসে।
আক্লাস ‘ডু’ দিয়ে সোলেমান ও তার পাশের খেলোয়াড়দের দাবড়ে নিয়ে যায়। লাফ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করাই তার উদ্দেশ্য। ফজল তাকে বেড় দেয়। আল্লাস লাফ দিতেই সে সটান খাড়া হয়ে যায়, দু’হাত বাড়িয়ে আলাসের ডান হাঁটুর কাছে জাপটে ধরে। আলাস ফজলের কাঁধের ওপর ঝুলতে থাকে। তার মাথা নিচের দিকে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে হাতদুটো তার মাটি ধরবার জন্য আকুলি-বিকুল করছে।
‘ডু’-এর আদান-প্রদান চলে কিছুক্ষণ। চরের খেলোয়াড়রা সব ধীর-স্থির। তারা ‘ডু’ দিয়েও বেশি দূর এগোয় না, ধরবার জন্যও বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে না। শামসু আর আল্লাস তাজা না হওয়া পর্যন্ত আসুলির দলও বেশি মাতে না। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর মধু ও লখাইকে মেরে তারা দল পুরো করে। কিন্তু সময় আর বেশি নেই। এ পর্যন্ত তারা এক পাট্টিও বানাতে পারেনি। কয়েকটা অখ্যাত অজ্ঞাত পুচকে খেলোয়াড় তাদের এভাবে ঠেকিয়ে রাখবে, এর চেয়ে লজ্জার ব্যাপার আর কি হতে পারে?
তারা বাদল আর ফরমানকে গোয়ার্তুমি করার জন্য ছেড়ে দেয়। মাতামাতি করে ‘ডু’ দিয়ে চেষ্টা করতে দোষ কি? ধরা পড়লে পড়ুক। আর বেঁচে আসতে পারলে তো কথাই নেই।
বাদল আর ফরমান খ্যাপার মতো ‘ডু’ দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে চরের দলকে।
সোলেমান সাবধান করে দেয় সবাইকে, অ্যাকদিগে দাবড় লাগাইলে অন্য দিগ থিকা আউগ্গাইয়া আসবা। কিন্তু ধরবা না, খবদ্দার। করুক না ওরা গোলাগুলি যত পারে!
সোলেমানের উদ্দেশ্য সময় নষ্ট করা। সময় কাবার করে কোনো রকমে ‘ডু’ রাখতে পারলেই চরের ইজ্জত বজায় থাকে। কিন্তু বাদল আর ফরমান ‘ডু’ দিয়ে শেষ সীমারেখার কাছে দাবড়িয়ে নিয়ে যায় তাদের। সীমারেখার বাইরে গেলেই জল্লা যেতে হবে। এ অবস্থায় সোলেমানের হুঁশিয়ারি ভেস্তে যায়। ঠিক থাকতে পারে না সোলেমান নিজেও। না-মরদের মতো জল্লা গিয়ে মরার চেয়ে ধরে মরা অনেক ভালো।
কিন্তু ধরতে গিয়েই শুরু হয় মড়ক। কোরবান আর তালেব ধরেছিল বাদলকে। কিন্তু সে দু’জনকেই হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যায়। তারপর ফরমানকে ধরতে গিয়ে মারা যায় সোলেমান। আর বাদলের দাবড় খেয়ে কাদির জল্লা যায়। টিকে থাকে শুধু ফজল।
উত্তেজনা টগবগ করছে দর্শকদের ভেতর। এবার আসুলির ভাগ্যে নিশ্চিত জয়লাভ।
মিনিট দুয়েক সময় আছে আর। ফজল ডু’ দেয়। কিন্তু তাকে ধরবার আগ্রহ দেখায় না কেউ। সে দম শেষ করে ফিরে আসে।
বাদল ‘ডু’ দেয়, এগিয়ে যায় লম্বা হাত বাড়িয়ে। ফজল সরতে থাকে কোণের দিকে, ধরবার ভান করে। কিন্তু বাদল ওসব গ্রাহ্যের মধ্যেই নেয় না। আর নেবেই বা কেন? দিঘে পাশে কোনোটায়ই ফজল তার সমকক্ষ নয়। ফজল মাথা নুইয়ে কুলুপ দেয়ার ভান করে। আর সেই সময় তার মাথায় থাবা মারবার জন্য বাদল একটু বেশিই এগিয়ে যায়। অমনি ফজল তড়িৎগতিতে এগিয়ে গিয়ে বাদলের মাজায় ধরে ফেলে। বাদল কোস্তাকুস্তি করে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু ততক্ষণে ফজল তাকে শূন্যে তুলে ফেলেছে।
চারদিকে হৈচৈ কলরোল। হাততালির চোটে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়।
লখাই তাজা হয়ে ডু’ দিতে যায়। তার ডু’ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রেফারি খেলার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
চরের জনতা বেড়া গলিয়ে ছুটে আসে মাঠে। হৈ-হুঁল্লোড় করে তারা তাদের খেলোয়াড়দের ঘিরে ধরে। এক একজন খেলোয়াড়কে চার-পাঁচজনে মিলে মাথার ওপর তুলে নেয়।
আক্কেল হালদারের ছোট ভাই তোয়াক্কেল হালদার এতক্ষণ দর্শকদের ভিড়ের মাঝে চুপটি মেরে ছিল। সে এসে বলে, খেলোয়াড়গ নিয়া চলো বাজারে। আইজ তারা আমাগ ইজ্জত বাঁচাইছে। তাগ এট্টু মিষ্টিমুখ করাইয়া দেই।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। খেলোয়াড়দের নিয়ে জলধর ময়রার দোকানে ঢোকে তোয়াক্কেল। ফজল আর কাদিরের জামা বগলে নিয়ে দেলোয়ার জনতার পেছনে পেছনে আসছিল। সে ও ঢুকে পড়ে দোকানে। ফজল তাকে আদর করে পাশে বসায়। বাইরে দাঁড়িয়ে জটলা করে বিশ-পঁচিশ জন হুজুগমত্ত ছেলে-ছোকরা।
ময়রাকে তোয়ালে বলে, তোমার দোকানডা আইজ কিন্যা ফালাইমু আলইকর।
তা কিন্যা ফলাওনা। আমারে শুদ্ধা কিন্যা ফালাও।
হ কিনমু। এহন কও দেহি, কত ট্যাহার মিষ্টি আছে তোমার দোকানে।
ময়রা হেসে বলে, কত আর অইব! দ্যাও তিরিশ ট্যাহা।
তোয়াক্কেল তিনটা দশ টাকার নোট ময়রার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, নেও তিরিশ ট্যাহাই দিলাম। তুমি দিতে শুরু কর। আমাগ প্যাড ভরাইয়া বাইরের তাগও দিবা। দিয়া ফুরাইয়া ফালাইবা বেবাক।
মিষ্টি খাওয়া শেষ করে রওনা হয় সবাই।
কাদির আগে আগে চলছে। তার পেছনে চলছে ফজল দেলোয়ারের হাত ধরে।
দেলোয়ার নিচু গলায় বলে, দুলাভাই আপনেরে বহুত দিন বিচ্রাইছি।
ক্যান?
বু আপনেরে যাইতে কইছে। হাশাইলের হাটে, দিঘিরপাড় হাটে কত বিচরাইছি আপনেরে!
হাটে আসি নাই বহুদিন। নতুন চর লইয়া বড় ঝামেলার মইদ্যে আছি। চল, আজই ইমু তোমাগ বাড়ি।
যাইবেন! ঠিক! দেলোয়ার খুশি হয়ে ওঠে।
হ যাই। তোমাগ নায় জায়গা অইব তো?
হ্যাঁ।
ফজল একটু চিন্তা করে কাদিরকে ডাকে, ও কাদির।
জ্বি।
এত তাড়াতাড়ি যাইতে আছ ক্যান্? তোমায় বাড়ি যাইমু দেইখ্যা বুঝি পলাইতে আছ?
না-না, কি যে কন! লজ্জা পেয়ে বলে কাদির। চলেন না যাই। আপনে তো আমায় বাড়ির পথ ভুইল্যাই গেছেন।
তবে চলো দেখি, কাপুড়িয়া দোকানে।
কাপড় কিনবেন নি?
হ।
নিতাই কাপড়ের দোকানে গিয়ে ফজল শ্যালকদের পছন্দমতো এক জোড়া নকশিপাড় শাড়ি কেনে। তার পরিধানের লুঙ্গিটা মাটিকাদা মেখে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। এটা পরে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। তাই নিজের জন্যও সে কেনে একটা মাদ্রাজি লুঙ্গি। তারপর গগন ময়রার দোকান থেকে এক পাতিল মিষ্টি কিনে তারা নৌকায় উঠে রওনা হয়।
.
০৮.
মোল্লাবাড়ির একমাত্র জামাই ফজল। শ্বশুরবাড়ির আদর-আপ্যায়নের মাত্রাটা তাই একটু বেশিই জুটত তার ভাগ্যে। তার আগমনে উৎসব শুরু হয়ে যেত মোল্লাবাড়ি। শ্বশুর-শাশুড়ি ব্যস্ত হয়ে উঠত–মুরগি জবাই করোরে, গুঁড়ি কোটরে, পিঠা বানাওরে! সে যে কত পদের পিঠা। কখনো বানাত পাটিসাপটা, বুলবুলি, ভাপা, কখনো বানাত ধুপি, চন্দ্রপুলি, চিতই, কখনো বা পাকোয়ান, শিরবিরন, বিবিখানা। চালের গুঁড়ি কুটে পিঠা বানাতে বানাতে রাতদুপুর হয়ে যেত। সে পিঠা তৈরির আসর আনন্দমুখর হয়ে উঠত গীত-গানে, কেচ্ছা-শোলকে।
সাত-আট মাস আগেও একবার শ্বশুরবাড়ি এসেছিল ফজল। সেবারও উৎসব লেগে গিয়েছিল মোল্লাবাড়ি। জামাইয়ের আদর-যত্নের কোনো রকম ত্রুটিই হতে দেয়নি শ্বশুর-শাশুড়ি। ফজল দু’দিন ছিল সেখানে। শালা-শালীরা তাকে ঘিরে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ছিল দুদিন। ঠাট্টা-মশকরা, হাসি-হুল্লোড়ে তারা ভরে দিয়েছিল তার মন-প্রাণ।
আজও এ বাড়িতে পা দেয়ার পর শালা-শালীরা ছুটে এসেছিল। এসেছিল কলরব করতে করতে, দুলাভাই আইছে, দুলাভাই আইছে!
শালা-শালীরা হৈ-চৈ করতে করতে তাকে ভেতরবাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। বেঁকি বেড়ার কাছে পৌঁছতেই শোনা যায় শ্বশুরের গলা, অ্যাই দেলা, অতিথরে কাছারি ঘরে নিয়া বইতে দে।
অন্দর থেকে ছেলে-মেয়েদের লক্ষ্য করে ধমক ছাড়ে সে আবার, অ্যাই পোলাপান, কিয়ের এত চিল্লাচিল্লি? বান্দরের খেইল আইছে, আঁ? যা, ঘরে যা শিগগির।
ধমক খেয়ে সুড়সুড় করে চলে গিয়েছিল সবাই। তারপর আর একজনও আসেনি তার কাছে। যে দেলোয়ার এত আগ্রহভরে তাকে নিয়ে এল, তার মুখের হাসিও মিলিয়ে যায়। ফজল বুঝতে পারে, তার এ বাড়িতে আসায় খুশি হয়নি শ্বশুর। কিন্তু কেন? তার বাবা রূপজানের গয়না বন্ধক দিয়েছে সে জন্য? রূপজান তো চিঠিতে লিখেছিল, শ্বশুরের রাগ তার ওপরে নয়। কেন সে লিখেছিল এমন কথা? আর তাকে আসতেই বা লিখেছিল কেন এত মিনতি করে? কেন দেলোয়ারকে পাঠিয়েছিল হাটে-বাজারে তাকে খুঁজতে?
রূপজানকে দেখার জন্য ব্যাকুল বাসনা রয়েছে তারও মনে। রূপজানের আকুল আহ্বান না পেলে তার সে বাসনা পথ খুঁজে পেত না। আসত না সে এ বাড়ি। দেলোয়ার হারিকেন জ্বালিয়ে রেখে যায় কাছারি ঘরে। রূপজান কোন ঘরে কি করছে জানতে ইচ্ছে হয়েছিল ফজলের। কিন্তু জিজ্ঞেস করা আর হয়ে ওঠে না। সে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে।
মোরগের ক্ব-ক্ব চিৎকার শোনা যায়। খোপ থেকে মোরগ টেনে বার করছে কেউ।
মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বিদ্যুৎ চমকের মতো আনন্দ খেলে যায় ফজলের মনে। সে ভাবে, মোরগ জবাই করার আয়োজন হচ্ছে যখন তখন তার অনাদর হবে না নিশ্চয়।
অন্দরে শ্বশুরের গলা শোনা যায় আবার, মোরগ ধরছে ক্যাডারে?
কেউ উত্তর দিল কিনা শোনা গেল না।
শ্বশুর আবার বলে, রাইতের বেলা ঘুমের মোরগ লইয়া টানাটানি শুরু করছে কাঁ? আল্লা রাইত দিছে ঘুমানের লেইগ্যা। ঘুমের পশু-পক্ষীরে কষ্ট দিলে আল্লার গজব পড়ে।
মোরগের ক্ব-ক্ব আর শোনা যায় না। খোপের মোরগ খোপেই চলে গেছে, বুঝতে পারে ফজল।
আবার মেঘ জমে তার মনে। বাড়ি চলে যাওয়ার কথা ভাবে সে। কিন্তু এত রাত্রে নৌকা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সে অবাঞ্ছিত মুসাফিরের মতো একা বসে থাকে কাছারি ঘরে।
এর আগে যতবার সে এ বাড়িতে এসেছে প্রত্যেক বারই শ্বশুর-শাশুড়ি হাসিমুখে এগিয়ে এসেছে। সেও তাজিমের সাথে তাদের কদমবুসি করেছে। তাকে ভেতরবাড়ি নিয়ে গিয়ে তারা জিজ্ঞেস করেছে সকলের কুশল-বার্তা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছে জমাজমি আর ফসলাদির খবরাখবর। আজ তাদের আলাঝিলাও দেখতে পায়নি সে। তাই কদমবুসি করার সুযোগও হয়নি। দেলোয়ার হারিকেন দিয়ে সেই যে গেছে আর একবারও আসেনি তার কাছে। সে এলে তাকে সাথে করে সে অন্দরে গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির কদমবুসি করে আসতে পারত।
ঢুকুর-ঢুক্ আওয়াজ আসছে পেঁকির। ধান ভানার শব্দ। দ্রুততালের মৃদু শব্দ হলে বোঝা যেত পিঠের জন্য চালের গুঁড়ি কোটা হচ্ছে। পেঁকিটা যে রকম বিলম্বিত তালে ওঠা-নামা করছে তা থেকে সহজেই বুঝতে পারে ফজল, চেঁকিতে পাড় দিচ্ছে শুধু একজন। রূপজান নয় তো!
ফজল উঠে অন্দরমুখী দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। তার চোখ দুটো খুঁজে বেড়ায় একটি মুখ। কিন্তু কোনো ঘরের খিড়কি-জানালা দিয়েই সে মুখ দেখা যায় না। ঢেঁকিঘরে কোনো খিড়কি নেই। সেখানে আছে কিনা কে জানে? পশ্চিমভিটি ঘরের বারান্দায় শুধু দেলোয়ারকে দেখা যায়। সে স্কুলের পড়া তৈরি করছে বোধ হয়।
নিঃশব্দ পায়ে ফজল সেদিকে এগিয়ে যায়। জানালার পাশে গিয়ে নিচু গলায় ডাকে, দেলু।
জ্বী।
তোমার বু’ আছে এই ঘরে?
না।
ঢেঁকিঘরে আছে?
উঁহু, সে পাকের ঘরে, মা-র লগে রানতে লাগছে।
মিয়াজি কোন ঘরে?
উত্তরের ঘরে।
আমারে নিয়া চলো দেখি, মিয়াজিরে সেলাম কইর্যা আসি।
দেলোয়ারের পেছনে পেছনে উত্তরভিটি ঘরে ঢোকে ফজল।
আরশেদ মোল্লা বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছিল। শব্দ পেয়ে সে মাথা তুলে তাকায়।
আস্লামু আলাইকুম। ফজলের সশ্রদ্ধ সালাম।
আরশেদ মোল্লা সালামের জবাব দেয় না।
কদমবুসি করার জন্য ফজল তার পায়ের দিকে এগিয়ে যেতেই সে পা গুটিয়ে বসে পড়ে। হাত নেড়ে বলে, উঁহু উঁহু দরকার নাই। এই পাও ধরলে লাভ অইব না। যাও নিকারি-কৈবর্তের পায়ে ধর গিয়া। দুইডা পয়সা উৎপন্ন অইব।
ধক করে ওঠে ফজলের বুক। তার মুখ কালো হয়ে যায়। সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় সেখানে। কাছারি ঘরে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে চৌকির ওপর।
এতক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে কুয়াশা। তার মাছ বেচার কথা জেনে ফেলেছে শ্বশুর। আর এ জন্যই এ বাড়িতে উল্টো হাওয়া বইছে আজ।
আর একদও এ বাড়িতে থাকা চলে না। ফজল বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে। নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালে হয় তো ধরতে পারবে কোনো নৌকা।
.
কাছারি ঘর থেকে বেরিয়ে কিছু দূর গিয়েই সে থমকে দাঁড়ায়। তার কুঁকড়ে-যাওয়া মন হঠাৎ চিড়বিড়িয়ে ওঠে–এভাবে চুপিচুপি চোরের মতো কেন যাবে সে? এটা তো মরদের কাজ নয়। সে কি চুরি-ছ্যাচড়ামি করেছে, না ডাকাতি বাটপাড়ি করেছে। সে করছে হালাল রুজি। এতে শ্বশুরের রাগ হওয়ার কি আছে? তার রাগের মাখা তামুক কে খেতে চায়? শুধু একজন রাগ না হলেই হয়। সে যদি বাধ্য থাকে তবে কারো তোয়াক্কা সে করে না। আজই–এই রাতেই রূপজানের সাথে বোঝাঁপড়া করবে সে।
সে কাছারি ঘরে ফিরে এসে দেখে দেলোয়ার খাবার আনতে শুরু করেছে।
আগে ভেতর বাড়িতেই তার খাবার দেয়া হতো। সামনে বসে পরিবেশন করত শাশুড়ি, নয় তো রূপজান। আজকের অবস্থা বিবেচনা করে এ ব্যবস্থায় আশ্চর্য হয় না সে।
তার খিদে নেই তেমন। বেশি মিষ্টি খেয়ে তার মুখটা কেমন বাই-বাইতা করে। পেটের ভেতরেও কেমন বেতাল ভাব। ঝাল তরকারি দিয়ে দুটো ভাত খেলে হয়তো সে ভাবটা কেটে যেত। কিন্তু এ বাড়ির তেতো আবহাওয়ায় তার খাবার ইচ্ছে একেবারেই মরে গেছে। তবুও সে খেতে বসে। কিছু না খেলে আবহাওয়াটা হয়তো আরো তেতো, আরো বিষাক্ত হয়ে উঠবে।
কৃষক পরিবারের নিত্যকার খাবার ডাল, ভাত, মাছের সালুন। কোনো বিশেষ পদ তৈরি হয়নি জামাইয়ের জন্য। ফজল নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুটো মুখে দিয়ে খাওয়া শেষ করে।
দেলোয়ার মিষ্টিও নিয়ে আসে। তারই আনা মিষ্টি। ফজল বলে, মিষ্টি এত খাইছি আইজ! প্যাডের মইদ্যে মিষ্টির চর পইড়া গেছে। ওগুলা লইয়া যাও।
মিষ্টি খেয়ে দেলোয়ারেরও একই অবস্থা। তাই আর সাধাসাধি না করে সে মিষ্টির থালা নিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরেই সে কথা-বালিশ এনে ধপাৎ করে ফেলে চৌকির ওপর।
শব্দটার প্রতিশব্দ হয় ফজলের বুকের ভেতর।
দেলোয়ার বিছানা পেতে দিয়ে চলে যায়। ফজল কাঁথা আর বালিশটার দিকে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে।
আগে শ্বশুরবাড়ি এলে তার শোয়ার ব্যবস্থা হতো অন্দরের কোনো নিরালা ঘরে। সেখানে। থাকত পাশাপাশি দুটো বালিশ। দোসরহীন বালিশটা যেন মুখ লুকিয়ে কাঁদছে আজ।
ফজল বসে বসে বিড়ি টানে। তার নাক আর মুখ দিয়ে গলগলিয়ে ধোঁয়া বেরোয়। তার বুকের ভেতর জ্বলছে যে ক্ষোভের আগুন, এ যেন তারই ধোয়া।
সে উঠে পায়চারি করে এদিক-ওদিক। ঢেঁকিঘর থেকে এখনও ধানভানার শব্দ আসছে।
হারিকেনের আলো যথাসম্ভব কমিয়ে দিয়ে অন্দরমুখি দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় ফজল। উত্তর ও পশ্চিমভিটি ঘরে বাতি জ্বলছে।
কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে দুটো বাতিই নিবে গেল। তাকে উপহাস করে যেন মুখ লুকাল অন্ধকারে।
ফজল দরজা দুটোয় খিল লাগিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। হাত বাড়িয়ে হারিকেনটা নিবিয়ে দেয়।
একটা সম্ভাবনা হঠাৎ উঁকি দেয় তার মনে। সে উঠে পড়ে। অন্ধকার ঘর অন্ধের মতো । হাতড়াতে হাতড়াতে গিয়ে সে অন্দরমুখি দরজাটার খিল খুলে রেখে আসে।
সম্ভাবনাটা তার অন্তরের উমে রূপান্তরিত হয় নিশ্চিত বিশ্বাসে। আর সে বিশ্বাসের ওপর ভর দিয়েই চলে তার প্রতীক্ষা।
কিন্তু আসছে না কেন রূপজান? এখনো কি সবাই ঘুমোয়নি? ভারাভানুনি এখনো ধান ভানছে পেঁকি ঘরে। বোধহয় তার জন্যই আসতে পারছে না।
ঢেঁকিটা যেন কিছু বলছে। কি বলছে? ফজল শুনতে পায়–ওটা বলছে, আসি গো আসি, আসি গো আসি।
রাত অনেক হয়েছে। টেকির শব্দ আর শোনা যায় না। ফজল অধীর প্রতীক্ষায় এ-পাশ ও-পাশ করে।
এখনও দেরি করছে কেন রূপজান? ঘুমিয়ে পড়েনি তো?
উঁহু কিছুতেই না। মনে মনে বলে সে। চউখের দেখা দেখনের লেইগ্যা পরান যার ছটফট করে, তার চউখে কি ঘুম আইতে পারে?
তার মনে হয়, রূপজান জেগেই আছে, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না বেরুবার।
সে বিছানা ছেড়ে খালি পায়ে ঘর থেকে বেরোয়। পা টিপে টিপে পশ্চিম ভিটি ঘরের দক্ষিণ পাশের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে হয়তো এ ঘরেই শুয়ে আছে রূপজান।
আধ-ভেজানো জানালার ফাঁক দিয়ে সে তাকায় ভেতর। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে সব একাকার। তার দৃষ্টি হারিয়ে যায় সে অন্ধকারে। সে মৃদু শিস দেয় বারকয়েক। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
ফজলের মনে হয় রূপজান এ ঘরে নেই। থাকলে জেগেই থাকত সে। এ অন্ধকারেও তার নড়াচড়ার আভাস পাওয়া যেত। আর হয়তো পাওয়া যেত রেশমি চুড়ির মিষ্টি রিনিঠিনি আওয়াজ।
উত্তরভিটি ঘরেই তাহলে শুয়েছে রূপজান। কিন্তু সে ঘরের বারান্দায় থাকে শ্বশুর। সে-দিকে যেতে তাই সাহস হয় না তার। নিরাশ মনে কাছারি ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য সে পা বাড়ায়। এমন সময় শোনা যায় হালকা আওয়াজটুক-টুক-টুক। কাঠ বা অন্য কিছুর ওপর টোকা দেয়ার শব্দ।
আনন্দ-শিহরণে কেঁপে ওঠে তার সমস্ত শরীর। সে তাড়াতাড়ি টিনের বেড়ায় আঙুলের টোকা দেয় তিনবার। কোনো সাড়া না পেয়ে সে আবার টোকা দেয়। কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। কিন্তু প্রত্যাশিত ঠকঠক আওয়াজ আর শোনা যায় না।
তার মনে সন্দেহ জাগে–এ কি রূপজানের সঙ্কেত? না আর কিছু শব্দ? টিকটিকির শিকার ধরে আছাড় মারার শব্দ নয়তো?
জানালাটা আরো একটু ফাঁক করার জন্য সে একটা পাট ভেতরের দিকে ঠেলে দেয় আর অমনি ক্রুদ্ধ আওয়াজ শোনা যায়, কোঁ-ওঁ-ওঁ।
সে লাফ দিয়ে পিছিয়ে যায় ভয়ে। তার এক পায়ে কাঁটা ফুটে যায় কয়েকটা। কাঁটাযুক্ত শুকনো ডালটা সে টান দিয়ে খুলে ফেলে। একটা কাঁটা বোধহয় ভেঙে রয়েই গেল।
আচমকা ভয়ে পিছিয়ে গেলেও সাথে সাথেই ফজল বুঝতে পেরেছিল, ক্রুদ্ধ আওয়াজটা একটা উমে-বসা মুরগির। সে আবার জানালার কাছে ফিরে যায়। দৃষ্টি ফেলে ঘরের ভেতর। এবারেও কিছুই ধরা দেয় না চোখে।
তাকে চমকে দিয়ে আবার সেই আওয়াজ হয়–ঠুকঠুকঠুক। কিন্তু সেই সাথে শোনা যায় চিঁও চিঁও ডাক। ডিম ফুটে মুরগির বাচ্চা বেরুচ্ছে।
ঠুক-ঠুক শব্দটা কিসের এতক্ষণে ধরতে পেরেছে ফজল। হতাশায় ভারাক্রান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে সে ফিরে যায় কাছারি ঘরে। কলসিতে রাখা অজুর পানি দিয়ে পা ধুয়ে সে শুয়ে পড়ে।
কাঁটাটা বড় যন্ত্রণা দিচ্ছে পায়ে। বরই কাঁটা বোধ হয়। তাই এত ব্যথা করছে। এটা খুলতে না পারলে ঘুম আসবে না আজ। ফজল উঠে হারিকেন ধরায়। কিন্তু কি দিয়ে খুলবে কাটা? নখ দিয়ে সরু করা ম্যাচবাতির কাঠি দিয়ে সে খোঁচায় চামড়ার ওপর। কিন্তু চার পঁচটা কাঠি ধ্বংস করেও কাঁটার নাগাল পাওয়া যায় না।
কিসের সামান্য একটু শব্দ শুনে মাথা তোলে ফজল। একটা পাটশলা পুবদিকের জানালা দিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। বাঁ হাতে পাটশলাটা ধরে সে জানালার দিকে তাকায়। একটা হাত আবছায়ার মতো সরে গেল।
ফজলের মনের বীণায় আনন্দের সুর বেজে ওঠে। আর সেই সুরের সাথে নেচে ওঠে তার দেহের সমস্ত অণু-পরমাণু।
মনের উল্লাস গোপন করে সে হাসিমাখা মুখে চেয়ে থাকে জানালার দিকে। অনুচ্ছ স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলে, এত রাইতে আর রংটং করণ লাগব না। আসনের ইচ্ছা থাকলে আইসা পড় শিগগির। দেরি করলে কিন্তু কপাটে খিল লাগাইয়া থুইমু।
জানালা থেকে দরজার দিকে চোখ ফেরাবার সময় তার নজর পড়ে হাতের পাটশলার দিকে। ওটার আগায় একটা সাদা বেলোয়ারি পুঁতি। পুঁতিটা ধরতেই পাটশলাটার ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসে একটা খোঁপার বেলকুঁড়ি কাঁটা।
আনন্দের সুর ছাপিয়ে হঠাৎ বেজে ওঠে করুণ সুর। তার মনের গহনে সমাহিত একটা পুরাতন স্মৃতি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ঠিক এমনি একটা খোঁপার কাঁটা দিয়ে তার পায়ের কাঁটা তুলে দিয়েছিল জরিনা।
সারদা আইনের বছর। বাংলা ১৩৩৬ সাল। সবার মুখে এক কথা–আইন পাশ হয়ে গেলে ছেলে-মেয়ের বিয়ে-শাদি দেয়া মুশকিল হবে। তাই বিয়ের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল দেশে। সদ্যোভূমিষ্ঠ অনেক ছেলে-মেয়েরও বিয়ে হয়েছিল সে সময়। দুই পেটের অজাতশিশুর বিয়ের ঘটকালির নজিরও নাকি আছে প্রচুর। সেই সময়ে ফজলের সাথে বিয়ে হয়েছিল জরিনার। ফজলের বয়স তখন এগারো আর জরিনার দশ। পাঁচ বছর যেতে না যেতেই জরিনা হাতে-পায়ে বেড়ে উঠল। তার সারাদেহে নেমে এল যৌবনের ঢল। আর ফজলের তখন গোঁফের রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। তারপর একদিন। ফজল তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র কয়েকদিন বাকি। রাত জেগে পড়া তৈরি করছিল সে। জরিনা ঐ সময়ে ঢুকে পড়েছিল তার পড়ার ঘরে। তার খোঁপা থেকে বেলকুঁড়ি খুলে সে ফজলের পায়ের কাঁটা তুলে দিয়েছিল। কাঁটা তোলার সময় তার পা-টা ছিল জরিনার কোলের ওপর। আর ঐ অবস্থায় তাদের দেখে ফেলেছিল ফজলের বাবা।
গুরুতর ভাবনায় পড়ে যায় এরফান মাতব্বর। তার মনে হয় সেয়ানা বউটা নষ্ট করে ফেলবে তার আবাত্তি ছেলেটাকে। ছিবড়ে বানিয়ে ফেলবে। আর ওকে দূর না করলে ছেলের পড়াশুনা একেবারেই হবে না। ছেলে বই সামলাবে, না বউ সামলাবে?
কয়েকদিনের মধ্যে একটা ব্যবস্থা করে ফেলে এরফান মাতব্বর। জরিনাকে আবার বিয়ে দিতে যে খরচ লাগবে সে বাবদ কিছু টাকা সে জরিনার ভাইয়ের হতে গুঁজে দেয়। তারপর একদিন ফজলকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে খেজুরগাছ-কাটা চকচকে ধারালো দা হাতে নিয়ে মাতব্বর গর্জে ওঠে, অ্যাদে ফউজ্যা, ছ্যান দেখছস? তালাক দে, কইয়া ফ্যাল–তিন তালাক বায়েন। তেড়েংবেড়েং করলে তিরখণ্ড কইর্যা ফালাইমু।
নিতান্ত নিরুপায় ফজল উচ্চারণ করতে বাধ্য হয়েছিল, তিন তালাক বায়েন।
সেদিনই রাগে দুঃখে ফজল বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। নিরুদ্দেশ হয়ে ছিল তিন মাস। সেই থেকে তার লেখা-পড়ারও ইতি ঘটেছিল।
স্মৃতিটাকে নির্মম শক্তিতে দাবিয়ে দেয় ফজল। আজকের এ আনন্দঘন মুহূর্তে একে কোনো রকম প্রশ্রয় দিতে রাজি নয় তার মন। মৃত অতীত মনের গহ্বরে চাপা পড়ে থাক। পড়ে থাক গহন অন্ধকারে।
খোঁপার কাঁটাটা দিয়ে ফজল পায়ের কাঁটাটা তুলে ফেলে। আর ওটা তুলবার সময় ছলছল করে তার চোখ দুটো।
খোঁপার কাঁটাটা দিয়ে পালালো কোথায় রূপজান? সে নিশ্চয় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে আলো জ্বলছে, তাই বোধ হয় সে আসতে লজ্জা পাচ্ছে।
ফজল হারিকেনটা নিবিয়ে দেয়। ঘুমের ভান করে সে পড়ে থাকে বিছানায় আর মাঝে মাঝে বালিশে চিবুক রেখে দৃষ্টি ফেলে অন্ধকারে অদৃশ্য ভেজানো দরজার ওপর।
সময় এগিয়ে চলছে। চলছে ফজলের মনের ওপর দিয়ে আশা-নিরাশার মই টেনে। বারবার মাথা তুলতে গিয়ে তার ঘাড়ে ব্যথা ধরে গেছে। ক্লান্ত হয়েছে চোখ দুটো।
ফজল অস্থির হয়ে ওঠে। চঞ্চল হয় রক্তস্রোত শিরা-উপশিরায়। নিজেকে সে আর বিছানায় ধরে রাখতে পারে না। সে উঠে বসে। মনে মনে ভাবে–রূপজান তো এমনিতেই লজ্জাবতী লতা। এতদিনের অসাক্ষাতে লজ্জার মাত্রাটা হয়তো আরো বেড়ে গেছে। তাকে দেখলে লজ্জায় দৌড় মারবে নাতো সে? নাহ, তাকে কোনো মতেই পালাবার সুযোগ দেয়া যায় না। সে বাইরমুখি দরজার খিল নিঃশব্দে খুলে নিশ্রুপে বেরিয়ে যায়। কাছারি ঘরের পশ্চিম পাশ দিয়ে গিয়ে বেঁকিবেড়ার আড়াল থেকে সে উঁকি মারে। নাহ! রূপজানের আলাঝিলাও দেখা যায় না উঠানে। তবে কি সে কাছারি ঘরের পুবপাশে আছে? পুবদিকের জানালা দিয়েই তো সে পাটশলাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ফজল উঠান পার হয়ে ঢেঁকিঘরের উত্তরপাশ ঘুরে পুবপাশ দিয়ে আলগোছে পা ফেলে এগিয়ে যায়।
একটু দূরেই কাছারি ঘরের পুব পাশে ঘন অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তির আভাস পাওয়া যায়।
হ্যাঁ, ঐ তো রূপজান বসে রয়েছে। তাকে দেখে পালিয়ে যাবে নাতো আবার! এত চোখপলানি খেলা ভালো লাগে না তার।
ফজল পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়। কিন্তু রূপজান নড়ছে না তো একটুও! নড়লে আন্দোলিত হতো কালো অন্ধকার। বোধ হয় কাছারি ঘরের দিকে চোখ তার। তাকে ঘর থেকে বেরুতে দেখেনি তো? দেখলে সে এরকম নিশ্ৰুপ বসে থাকত না। উঠে দাঁড়াত অন্তত।
ফজল নিঃশব্দে এগিয়ে যায়, পেছন থেকে বেঁধে ফেলে তাকে দুই বাহুর আবেষ্টনীতে।
মূর্তিটি গা মোচড়ামুচড়ি করে। দুহাত দিয়ে ছাড়াবার চেষ্টা করে নিজেকে।
আরে এমুন করতেছ ক্যান্?
ফজল তাকে পাজাকোলা করে নেয়। চুমোয় চুমোয় ভরে দেয় তার ঠোঁট, দুটি গাল। নিজেকে মুক্ত করবার চেষ্টা করছে না আর সে এখন।
ফজল তাকে কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। নিবিড় করে বুকে টেনে নিতে নিতে ফিসফিস করে সে বলে, বাপের বাড়ির ভাতে রস নাই? কেমুন হুগাইয়া গ্যাছ মনে অইতাছে!
এই কি! কাঁপতে আছ ক্যান্ তুমি? কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে ফজল।
প্রেমিকের বুকের সাথে আরো নিবিড় হয়ে মিশে যায় প্রেমিকা। নবম হাত দিয়ে গলা জাপটে ধরে তার। কিন্তু তবুও তার কাঁপুনি থামে না, কথা বেরোয় না মুখ দিয়ে।
ফজল তার গালে চুমো এঁকে দিয়ে বলে, কথা কওনা ক্যান, আঁ? তোমারে কি ডরে ধরছে? কিসের ডর আঁ? এত রাইতে আর কেও জাগব না। আর জাগলেই বা কি। আমি কি অন্য মাইনষের বউ লইয়া হুইয়া রইছি?
একটু থেমে আবার সে বলে, আইজ ভারি কষ্ট দিছ। খোঁপার কাঁটাডা দিয়া আবার পলাইয়া রইছিলা ক্যান, আঁগো? কি, মুখ বুইজ্যা রইছ যে! একবারও তো জিগাইলা না, কেমুন আছি?
এবারও কোনো জবাব পায় না ফজল। বুকের সাথে এক হয়ে মিশে যেতে চাইছে যেন তার প্রিয়া। তার গলায় মুখে সে চুমো দিচ্ছে বারবার।
ফজলের চঞ্চল রক্ত আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে। সারা দেহে জাগে পুলক-শিহরণ । তার ডান হাত কাপড়ের জঞ্জাল সরিয়ে অবতরণ করে প্রিয়ার দেহভূমিতে।
কিন্তু এরকম লাগছে কেন? এ কোন চরে নেমেছে সে? তাকে কি কানাভুলায় পেয়েছে? পথ ভুলিয়ে নিয়ে এসেছে অন্য চরে?
সন্দেহ জাগতেই হাতের পাঁচটি খুদে অনুচর একজোট হয়ে জরিপ করতে লেগে যার চরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত।
তাইতো! এ চরটা তো তার পরিচিতি নয়! এর আকার-আয়তন চড়াই-উত্রাই, হালট ঢালট, খাজ-ভাঁজ তার অচেনা।
ফজল এবার স্পষ্ট বুঝতে পারে এ রূপজান নয়। সে বলে ওঠে, কে? কে তুমি?
কোন জবাব পাওয়া যায় না। তার মুখের ভাষা যখন মুক, তখন তার দেহের ভাষা মুখর। হয়ে উঠেছে। তার অঙ্গে অঙ্গে সার্বজৈবিক ভাষার কলরব।
ফজলের ব্যস্ত হাতটি বালিশের তলা থেকে ম্যাচবাতি বের করে। সে কাঠি খুলে ধরাতে যাবে অমনি একটা হাতের ঝটকা খেয়ে তার হাত থেকে ম্যাচবাতিটা ছিটকে পড়ে যায়। কাঠিগুলো শব্দ করে ছড়িয়ে যায় মেঝের ওপর। তার হতভম্ব হাতটি অন্য একটি হাতের আমন্ত্রণে ফিরে যায় কিছুক্ষণ আগের পরিত্যক্ত জায়গায়।
দুটি কবোষ্ণ ঠোঁট ফজলের ঠোঁটে গালে সাদর স্পর্শ বুলায় বার-বার। তার সারা দেহে সঞ্চারিত হয় বাসনা-বিদ্যুৎ। রক্তে জাগে পরম পিপাসা।
শয্যাসঙ্গিনী তাকে অনাবৃত বুকের ওপর টেনে নেয়। ফজল বাধা দেয় না বরং এগিয়ে দেয় নিজেকে। সে ভুলে যায় ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়। ভুলে যায় নিজের নাম পরিচয়। এ মুহূর্তে তার কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই। এখন সে শুধু একটি পুরুষ। তার দেহ অতিথি হয়েছে যে দেহের, তা শুধুই একটি রমণীর। তারও কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই। এ মুহূর্তে পরিচয়ের কোনো প্রয়োজনও বোধ করে না তারা। দুটি নর-নারী। আদিম রক্তবাহী দুটি দেহ। রক্ত-মাংসের অমোঘ দাবির কাছে তারা পরাজয় মানে। এক দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সাথী খুঁজে পায় অন্য দেহে। তারা মগ্ন হয় উচ্ছল আলাপনে, এক হয়ে দোলে তরঙ্গের দোলায়।
কালো রাত্রি তখন চোখ বুজে প্রহর গুনছে।
ফজল লুঙ্গিটা খুঁজে নিয়ে কোমরে জড়ায়। শুয়ে থাকে বিছানার এক পাশে। কি রকম একটা অশুচিতায় ছেয়ে গেছে তার আপাদমস্তক। পাপ-চিন্তায় বিব্রত তার মন।
সে সন্তর্পণে চৌকি থেকে নামে। নিঃশব্দে মেঝে হাতড়িয়ে বেড়ায় অন্ধকারে। কিছুক্ষণ খোঁজার পর ম্যাচবাক্সটা পাওয়া যায়। পাওয়া যায় একটা কাঠিও। সে শিয়রের কাছে এগিয়ে গিয়ে কাঠিটা ধরায়।
চিৎ অবস্থায় শায়িত তিমির-সঙ্গিনী হকচকিয়ে ওঠে। সে মুখ ঢেকে ফেলে এক হাতের দাবনায়। অন্য হাতে আঁচল টেনে বুক ঢাকে, ঠিকঠাক করে বেশবাস।
এক হাতে জ্বলন্ত কাঠিটা ধরে ফজল অন্য হাত দিয়ে তার মুখের ওপর থেকে জোর করে হাতটা সরিয়ে দেয়।
কে! কে!! জরিনা! জরু! জরু!!
পলাতক অতীত ফিরে আসে। সাত বছরের বিচ্ছেদ-প্রাচীর ডিঙিয়ে সে অতীত আশ্রয় খোঁজে বর্তমানের বুকে। ফজল নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সে জ্বলন্ত কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বিছানায় উঠে সে নিবিড় করে জরিনাকে বুকে টেনে নেয়। সে বুকের ভেতর তোলপাড় করছে আবেগ ও বেদনার বাম্প।
পুঞ্জীভূত বেদনা গুমরে মরছে জরিনারও বুকের ভেতর। সেই বুকের দ্রুত ওঠা-নামা অনুভব করতে পারে ফজল। রুদ্ধ কান্না বক্ষপঞ্জর ভেদ করে বুঝি বেরিয়ে আসতে চাইছে।
সে পরম স্নেহে জরিনার পিঠে, মাথায় হাত বুলায়। বেদনার্ত কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, জরিনা–জরু–জরু, তুমি এই বাড়িতে কবে আইছ? ক্যান আইছ?
জরিনা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। তার চোখের পানিতে ফজলের কাঁধ ভিজে যায়।
ফজল শঙ্কিত হয়। এখনই হয় তো গলা ছেড়ে কেঁদে উঠবে জরিনা। সে শাড়ির এক অংশ টেনে নিয়ে তার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, জরিনা, লক্ষ্মীসোনা কাইন্দ না। চলো তোমারে আউগ্যাইয়া দিয়া আসি।
জরিনা আরো নিবিড় করে ফজলের গলা জড়িয়ে ধরে। তার ফোঁপানির শব্দ আরো স্পষ্টতর হয়।
জরু, জরু, অবুঝের মতো কইর্য না। কেও টের পাইলে কেলেঙ্কারি অইয়া যাইব।
ফজল তাকে টেনে তোলে। বাহুবেষ্টনীতে বেঁধে, মাথায় মুখে সস্নেহে হাত বুলাতে বুলাতে তাকে সে সামনের দরজায় নিয়ে যায়। তারপর দরজা খুলে একরকম জোর করেই তাকে বের করে দেয় সে।
জরিনা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ফজল দাঁড়িয়ে থাকে খোলা দরজার মুখে। তার এক হাতে ছিল স্নেহ-প্রীতির স্নিগ্ধ পরশ। আর অন্য হাতে? অন্য হাতে ছিল নিরেট নিষ্ঠুরতা। সে নিষ্ঠুরতা এখন শত হাতে তার বুকে আঘাত হানছে। আঘাতে আঘাতে বেদনার বাম্প গলে দরদর ধারায় তার দুগাল বেয়ে পড়তে থাকে।
নিকষ কালো অন্ধকার। জরিনা পা টিপে টিপে ফিরে আসে চেঁকিঘরে। বলতে গেলে গেরস্তের চেঁকিঘরই তার আশ্রয় আজকাল। চেঁকিই তার অন্নদাতা।
মেঝেতে মাদুর একটা বিছানোই ছিল। সে গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আসে না। সে চোখের পাতা বন্ধ করে। আর সাথে সাথেই সক্রিয় হয়ে ওঠে তার মনের চোখ। সে চোখের পাতা নেই। সে চোখ বন্ধ করা যায় না। সে চোখের সামনে ভেসে ওঠে অতীতের দৃশ্যপট। পটের নিশ্চল ছবিগুলো আবার চলতে শুরু করে একের পর এক।
একটি মেয়ে। বয়স তার দশ হবে কি হবে না। তাকে ঘিরে বসে গীত গাইছে বোন বেয়ান-ভাবির দল, এমন সোন্দর বইনডি আমার পরে লইয়া যায়।
নতুন বাক্স ভরে আসে নতুন শাড়ি-সেমিজ, সোনা-রূপার নতুন গয়না। চাচি-ফুফু খালারাও আসে। তাকে তারা সাজায় মনের মতো করে। আসে সাক্ষী-উকিল। তারা কবুল আদায় করে, শরবত দেয়।
পরের দিন ভোর বেলা। পালকি আসে উঠানে। মেয়েটিকে কোলের ওপর নিয়ে বসে আছে তার দাদি। কারা সব বলে, যাও, কোলে কইরা লইয়া যাও দেহি কেমনতরো জুয়ান। যাও, নিজের জিনিস, শরম কি?
কৌতূহলী মেয়েটি টান দিয়ে সরিয়ে ফেলে বিরক্তিকর লম্বা ঘোমটাটা। একটা ছেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ছেলেটি তারই বয়সী বা তার চেয়ে বড়জোর বছর খানেকের বড় হবে। রেশমি আচকান তার পরনে। মাথায় ঝলমলে জরির টুপি।
দাদির কোল থেকে তাকে তুলবার চেষ্টা করে ছেলেটি। মেয়েটি তাকে হাতের ঝটকায় সরিয়ে দেয়।
হো-হো-করে হেসে ওঠে উঠানভর্তি লোকজন।
আবার আসে ছেলেটি। আবার তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সে। দাদি তার কানে কানে বলে, যাও সোনাবইন। আল্লার নাম লইয়া পালকিতে গিয়া ওড।
পালকিতে! এতক্ষণ কও নাই ক্যান্। বারে কি মজা!
মেয়েটি দাদির কোল থেকে ঝটকা মেরে বেরিয়ে এক দৌড়ে গিয়ে ওঠে পালকিতে। হাসি আর হাততালির হট্টগোল ওঠে চারদিক থেকে।
ছেলেটি পালকিতে ওঠে। বসে মেয়েটির মুখোমুখি হয়ে। পালকি চলে। সুর করে সারি গাইতে গাইতে চলছে বেহারারা–
আল্লা-হা ব-লো
জোরে–হে চ-লো,
বিয়া খাইয়া বল অইছে
জোরে–হে চ-লো,
ইনাম মিলব দশ টাকা
হুঁশে–হে চ-লো,
সামনে আছে কলই খেত
কোনা-হা কা-টো।
পায়ের তলে মান্দার কাঁটা
দেইখ্যা হাঁ-টো।
বিয়েটা যে কী ব্যাপার, স্পষ্ট কোনো ধারণাই ছিল না জরিনার। বিয়ের দিনের ঘটনা নিয়ে কতজনে কত ঠাট্টা করত তাকে।
আর স্বামী কাকে বলে তা-ও কি সে জানত তখন! একটা ছবি মনে ভাসতেই হাসি পায় তার।
ঈদের দিন। ফজল আসে তাদের বাড়িতে। আসে ঠিক নয়। নতুন বাচ্চা জামাইকে সাথে করে নিয়ে আসে তার বাবা। পাশাপাশি খেতে বসে সে ও ফজল। পরিবেশন করে তার মা। ফজলের পাতের দিকে আড়চোখে চেয়ে গাল ফুলিয়ে উঠে পড়ে জরিনা। বলে, আর এক বাড়ির এক ছ্যামড়া আইছে। তারেই কেবুল বেশি বেশি দিতে আছে।
জরিনার মা চোখ রাঙায়, এই জরিনা, চুপ।
চুপ করমু ক্যান্? ওরে আমার রাঙা মোরগার কল্লাডা দিছ, রান দিছ। আর আমারে দিছ দুইডা আড়ডি।
এই মাইয়া! ছি! ছি! চোখ রাঙায় তার মা।
ফজল নিজের থালা থেকে রানটা তুলে দেয় জরিনার থালায়।
জরিনা আবার ফুঁসে ওঠে, ইস! আর একজনের পাতের জুডা খাইতে বুঝিন আক্ কইর্যা রইছি আমি।
বাতে শয্যাগত বুড়ি দাদি পাশের ঘর থেকে টিপ্পনি কাটে, বিয়ার দিনতো আ কইর্যা আছিলি। আধা গেলাশ শরবত হেঁচার মতন এক চুমুকে গিল্যা ফালাইছিলি! নিজের পুরুষের জুডা খাইতে ঘিন্না কিলো আঁ?
পরে দাদি তাকে ডেকে নিয়ে পাশে বসিয়ে অনেক কথা বলেছিল, অনেক উপদেশ দিয়েছিল। কি যে সব বলেছিল তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি তখন। তারপরেও তারা দু’জন একসাথে খেলেছে চোখপলানি, নলডুবি, ঝগড়া করেছে, মারামারি করেছে। তাদের কাণ্ড দেখে হেসেছে বাড়ির লোকজন, আত্মীয়-প্রতিবেশী।
ফজল ও জরিনা বেড়ে ওঠে। সেই সাথে বেড়ে ওঠে তাদের লজ্জা আর সঙ্কোচ। শেষ হয় একসাথে খেলাধূলা। ফজলকে দেখলেই জরিনার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে সলাজ হাসি। সে দৌড়ে পালায়। ফজলের হাস্যোজ্জ্বল চোখ দুটো পিছু ধাওয়া করে তার।
কিন্তু লজ্জা ও সঙ্কোচ যত বাড়তে থাকে তত বাড়তে থাকে একজনের প্রতি আর একজনের আকর্ষণ।
পনেরোয় পা দিয়ে জরিনা গায়ে-গতরে বেড়ে ওঠে লকলকিয়ে। জরিনার শ্বশুর এরফান মাতব্বর চিন্তিত হয়। কারণ মেয়ের অনুপাতে ছেলে বড় হয়নি। আর ফজল তখন স্কুলে পড়ে। এ সময়ে বউয়ের আঁচলের বাও যদি ছেলের গায়ে লাগে একবার, তবে কি আর উপায় আছে? লেখাপড়া একেবারে শিকেয় উঠে যাবে।
জরিনার বাবা-মা তখন মারা গেছে। তার ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে এরফান মাতব্বর। ঠিক হয়–ফজল ম্যাট্রিক পাশ না করা পর্যন্ত জরিনা ভাইয়ের বাড়িতে থাকবে। সেখানে ফজলও যেতে পারবে না। শুধু উৎসব-পরবে তারা দু-একদিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি যাওয়া-আসা করতে পারবে। ফজল দিঘিরপাড় স্কুলে পড়ত। তার স্কুলে যাওয়ার পথে পড়ত শ্বশুরবাড়ি। তাকে সে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো আট মাইল দূরের নড়িয়া হাই স্কুলে। তার জন্য জায়গিরও ঠিক হলো সেখানের এক বাড়িতে।
কিছু ফুল যখন পাপড়ি মেলে তখন মধুকর টের পায়। দীর্ঘ পথের বাধা-বিঘ্ন তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। তুচ্ছ মনে হয় কাটার ভয়।
জরিনা পাশ ফিরে শোয়। স্মৃতি-কোঠার দরজা খুলে যায় আবার। দুপুর বেলা। দাওয়ায় বসে একটি তরুণী ফুল-সুপারি কাটছে। হঠাৎ শোনা যায় হট্টিটির ডাক–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট, টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট।
বাড়ির পেছনে লটাবন নদীর কিনারা পর্যন্ত বিস্তৃত। ডাকটা আসছে সেদিক থেকে। সে ছাঁচতলা গিয়ে দাঁড়ায়। আবার শোনা যায়–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট। এ ডাকের অর্থ জানে একমাত্র সে-ই। সে বোঝে–একটা হট্টিটি ডাকোছে তার হডিটিনীকে।
সে উঠানে আসে। ভাবি সরষে ঝাড়ছে। ওজন করছে ভাই। সরষে বেচতে হাটে যাবে সে। তাদের চোখের সামনে থেকে জরিনা একটা ভরা বদনা তুলে নেয়। ইচ্ছে করেই একটু পানি ফেলে দেয় ছলাৎ করে। তারপর ছাঁচতলা দিয়ে সে চলে যায় লটাবনে।
অনেকক্ষণ পরে সে ফিরে আসে। আঁচলের তলায় লুকিয়ে নিয়ে আসে ঝকঝকে নতুন এক ডজন বেলকুঁড়ি কাঁটা।
জরিনা তার খোঁপায় হাত দেয়। সেই খোঁপার কাঁটার চার-পাঁচটা এখনও টিকে আছে। টিকে আছে এক রাতের এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে।
ঘটনা নয়, দুর্ঘটনা। আর তার জন্য দায়ী তার দুঃসাহস।
ফজল পরীক্ষায় পড়া নিয়ে ব্যস্ত। সে সময়ে তার পড়ার ঘরে ঢুকেছিল সে। অতো রাত্রে শ্বশুর যে আবার দেখে ফেলবে, কে জানত? কিন্তু কি অন্যায় দেখেছিল সে? কাঁটা তুলতে দেখেছিল ফজলের পা থেকে। এই টুকুইতো!
জরিনা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে। তার মুদিত চোখের পাতা বেঁধে রাখতে পারে না অশ্রুর প্লাবন।
অনেক আলোর আশীর্বাদ নিয়ে, শিশিরের স্নেহ নিয়ে বেড়ে উঠেছিল একটি লতা। তাতে ফুটেছিল ফুল যার বুকে ছিল আশার পরাগ, পাপড়ি-পাতায় রঙিন স্বপ্ন। ঐ রাতের দুর্ঘটনায় উৎপাটিত হলো সে লতা। তারপর যে মাটিতে পুঁতে দেয়া হলো তার শিকড়, তাতে না আছে সার না আছে রস।
হেকমতের চেহারা চোখে ভাসতেই তার সমস্ত সত্তা বিতৃষ্ণায় ভরে যায়। ঘৃণায় কুঁচকে যায় সারা শরীর। হেকমত চোর। সে সিঁদ কেটে চুরি করে। বিয়ের মাস খানেক পরেই চুরির মালসহ ধরা পড়ে সে। তার জেল হয় তিনবছর। খালাস হয়ে আসার কিছু দিন পরেই আবার তার খোঁজ পড়ে। তারপর থেকেই সে ফেরার। চৌকিদার-দফাদারের চোখ এড়িয়ে সে কৃচিৎ কখনো আসে। একদিনের বেশি থাকে না। কিন্তু তার আসা না আসা সমান কথা জরিনার কাছে। শীতের মেঘের কাছে কে প্রত্যাশা করে বৃষ্টি?
বৃষ্টি নেই, ছায়া নেই এমনি এক মরুভূমি যেন জরিনার জীবন। উদগ্র পিপাসা বুকে নিয়ে ছটফট করছিল সে বছরের পর বছর। আজ মরুর আকাশে হঠাৎ মেঘ দেখে আকুলি-বিকুলি করছিল তার চাতক-মন। সে আর ধরে রাখতে পারেনি নিজেকে। এ মেঘ যে তার পরিচিত।
জীবনে একমাত্র ফজলের সাথেই হয়েছিল তার অন্তরঙ্গ পরিচয়। সে-ই তার জীবনের প্রথম পুরুষ। বিকাশোম্মুখ সে পুরুষটি এখন পূর্ণবিকশিত। সে লাভ করেছে পূর্ণ যৌবন। যেমন হয়েছে সে দেখতে সুন্দর, তেমনি হয়েছে বলিষ্ঠ। তার অঙ্গে প্রত্যঙ্গে শক্তির সজীবতা। আজকের সান্নিধ্যের অপূর্বতায় তা স্পষ্ট অনুভূত। এর কাছে হেকমত কি? সে একটা অপদার্থ পুরুষ। তার যৌবন নেই, আছে শুধু যৌবনের পায়তারা যা শুধু হাস্যকর নয়, অসহ্য। তার কোমরে লুঙ্গির প্যাঁচে গোঁজা থাকে একটা সোডার পুটলি সব সময়। পিত্তশূলের ব্যথা উঠলেই এক খাবলা মুখে দিয়ে সে মরার মতো পড়ে থাকে বিছানায়।
জরিনা চোখ মেলে। ফিকে জোছনায় জমাট অন্ধকার তরল হয়েছে কিছুটা। বিছানায় পড়ে থাকতে আর ভালো লাগে না তার। সে উঠে টেকির ওপর গিয়ে বসে কাতলা হেলান দিয়ে।
এতক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেক পানি ঝরিয়েছে তার চোখ। এখন কিছুটা শান্ত হয়ে সে অনুভব করতে পারে, তার অন্তরের বেদনার সাথে মিশে আছে আজকের সফল অভিসারের আনন্দ। তখনই তার সারা দেহ-মনে নতুন করে সঞ্চারিত হয় তৃপ্তির অনুভূতি। সুখের আবেশে চেঁকির কাতলা দুটোকে সে জড়িয়ে ধরে দুহাতে। এই মুহূর্তে সব কিছুই তার কাছে আপন মনে হয়। এই নিঝঝুম রাত্রিকেও মনে হয় একান্ত আপন।
মনের আঁধারে বাসনার চামচিকেটা আবার পাখা মেলতে চায়। তাকে আর আটকে রাখতে পারছে না জরিনা। সে ঝপ সরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়।
কৃষ্ণা নবমীর চাঁদ পূর্বদিগন্ত ছাড়িয়ে উঠে গেছে অনেকদূর। ক্ষয়িষ্ণু প্রতিবেশীর আগমনে সচকিত হয়ে উঠেছে আকাশের লক্ষ কোটি তারা। হয়তো বা বিদ্রুপের হাসি হাসছে। ঝিরঝিরিয়ে বইছে শরতের স্নিগ্ধ বাতাস। যেন ঘুমন্ত পৃথিবীর নিশ্বাস-প্রশ্বাস।
মোহময়ী এ রাত। এমন লজ্জাহারিণী আশ্রয়দায়িনী রাতটা পলে পলে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এমন প্রীতিময়ী রাত তার জীবনে আর আসবে না কোনো দিন। এ রাতের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান।
জরিনা সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে উঠানের দিকে পা বাড়ায়। এ রাতের একটি মুহূর্তকণাও সে বিফলে যেতে দেবে না।
উঠানে পা দিয়েই তার দৃষ্টি হঠাৎ থমকে যায়। একটা ছায়ামূর্তি–নারীমূর্তি ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে কাছারি ঘরের দিকে। ভেজানো দরজা ঠেলে মূর্তিটা ঢুকে পড়ে ঘরে। তার খিল এঁটে দেয়ার অস্পষ্ট শব্দ বিকট আঘাত হানে জরিনার বুকে। তার আহত আশা আক্রোশে কাঁপে, ফণা বিস্তার করে।
সে টেকিঘরের বেড়া ধরে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর একপা-দু’পা করে এগিয়ে যায় কাছারি ঘরের দিকে। পশ্চিম পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পুব দিকের জানালা দিয়ে চাঁদের ক্ষীণ আলোর রেশ এসে পড়ছে ঘরের ভেতর। ঘরের ঘন অন্ধকার তাতে হালকা হয়েছে কিছুটা।
জরিনা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় নিশূপে। ফিকে অন্ধকার ভেদ করে দৃষ্টি চলে তার । স্পষ্ট দেখা যায় না কিছুই শুধু রেখাচিত্র, ছায়া-অভিনয়। অস্পষ্ট ছবিগুলো তার কল্পনার তুলিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার শিরা-উপশিরায় দ্রুত আনাগোনা করে একটা উষ্ণ প্রবাহ। রোমাঞ্চিত হয় তার সারা অঙ্গ। তার চোখ নেমে আসে আপনা থেকেই।
জরিনা ঢেঁকিঘরে ফিরে আসে। তার বুকের মধ্যে অশান্ত চামচিকের পাখা ঝাঁপটানি। কিছুতেই ওটা থামছে না। সে রান্নাঘরে গিয়ে ঢকঢক করে পানি খায়। পানি দিয়ে যেন ভিজিয়ে দিতে চায় চামচিকের অস্থির ডানা দুটো। কিন্তু থামাতে পারছেনা।
সে বিছানায় শুয়ে ছটফট করে। আবার উঠে গিয়ে মাথায় পানি দেয়। সারা দেহে অসহ্য দাবদাহ। এ দাহ কিসে শান্ত হবে?
অনেকক্ষণ কেটে গেছে। রাত আর বেশি নেই। নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ায় জরিনা । এগিয়ে চলে যন্ত্রচালিতের মতো। কাছারি ঘরে গিয়ে বসে চৌকির পাশে।
ফজল বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। অন্ধকারের আবরণে ঢাকা তার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে জরিনা। হাত বুলায় তার কপালে, মাথায়। ঘুমের ঘোরে ফজল হাত বাড়ায় তার দিকে। হাতটা তুলে নেয় জরিনা। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে ফজল ডাকে, রূপজান, রূপজান।
জরিনা তার মাথা রাখে ফজলের বুকে। হঠাৎ ফজলের ঘুম ভেঙে যায়।
আমার রূপজান!
জরিনা সাড়া দেয় না। ফজল ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। অনুচ্চ স্বরে বলে, ও তুমি! আবার আইছ! তুমি নিজে তে জাহান্নামে যাইবাই, আমারেও নিয়া ছাড়বা।
একটু থেমে আবার বলে, জরিনা, তুমি অন্যের বউ। তোমার গায়ে আমার আঙুলের একটু ছোঁয়া লাগলেও পাপ অইব।
জরিনা তার পায়ে মাথা কুটতে থাকে। ফজল পা সরিয়ে নেয়। সে উঠে দাঁড়ায়, জরিনাকে টেনে তোলে। বলে, জরিনা যাও। আর কোনো দিন আইও না। তুমি আর আমার কেউ না।
কেউ না! অস্ফুট কথা জরিনার আর্তনাদের মতো শোনায়। সে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
জরিনা চলে গেছে। সে আর কেউ নয় ফজলের। তবুও এমন হাহাকার করে উঠছে কেন, ব্যথায় ভরে উঠছে কেন তার বুকের ভেতরটা?
এ হাহাকার, এ ব্যথা কখন থামবে, কিসে থামবে?
ফজল ভাবে, রূপজান কাছে থাকলে এ হাহাকার উঠবে না আর। দূর হবে মনের সব দুঃখ-ব্যথা।
ভোর হতে না হতেই ফজল কাদিরকে ডেকে আনে পাশের বাড়ি থেকে। বলে, তোমার বু’রে লইয়া যাইতে চাই। মিয়াজিরে গিয়া কও।
দুদু কি রাজি অইব?
রাজি অইব না ক্যান্? তোমার বু’তো আমার লগে যাওনের লেইগ্যা তৈয়ার।
কাদির বাড়ির ভেতর যায়। ফিরে আসে অল্পক্ষণ পরেই। আরশেদ মোল্লা যা বলেছে, কাদির এসে কোনো রকম ঢাকা-চাপা না দিয়ে তাই বলে, দুদু কয়, মাইয়ার গয়নাগুলা তো বেইচ্যা খাইছে বেবাক। আবার শুরু করছে মাছ-বেচা। এই জাউল্যা বাড়ি আমার মাইয়া দিমু না।
দিব না কি করব? মাইয়াখান সিন্দুকে ভইরা রাখব? তোমার দুদুরে কইও, একদিন এই জাউল্যা ভাগাইয়া লইয়া যাইব ভদ্রলোকের মাইয়ার। তখন ইজ্জত লইয়া টান পড়ব, কইয়া রাখলাম আমি। এখন চলাম। তোমার ডিঙি দিয়া আমারে দাত্রার চরে নামাইয়া দিয়া আসো।
দেরি করেন দুলাভাই, নাশতা খাইয়া–
উঁহু। তুমি জলদি ডিঙি লইয়া ঘাটে আসো।
০৯-১২. ফজল বাড়ি যায় না
ফজল বাড়ি যায় না। বাড়ি গেলেই তার বাবা হয়তো জেরা শুরু করবে, রাত্রে কোথায় আছিলি? কাইল নায়েবের লগে অমুন কইর্যা কথা কইতে গেলি ক্যান্?
সোজা খুনের চর চলে যায় ফজল। তাকে দেখে পুলকি-মাতব্বর আর কোলশরিকেরা কোলাহল করে ওঠে। যার যার ভাওর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তারা। রমিজ মিরধা বলে,
কাইল আসুলিগ একখান খেইল দ্যাহাইয়া আইছ হোনলাম?
জাবেদ লশকর : এই মিয়া মাতবরের পো না খেললে কাইল চরের ইজ্জত থাকত না।
ধলাই সরদার : হোলাম আসুলিগ কোন বড় খেলুরে তুমি এমুন চিবি দিছিলা, চিবির চোডে হের জিব্বাডা বোলে সোয়া আত বাইর অইয়া গেছিল?
ফজল : আরে না মিয়া। এমন কথা কার কাছে শোনলেন?
ধলাই সরদার : যারা খেইল দ্যাখতে গেছিল তাগ কাছেই হুনছি।
গতদিনের হা-ডু-ডু খেলার আলোচনায় মেতে উঠে সবাই। তাদের মুখে ফজল আর সোলেমানের খেলার তারিফ।
সবাই চলে গেলে ফজল নিজেদের ভাওর ঘরে গিয়ে ঘরের ঝপ খোলে। তাদের গাবুর একাব্বর তার অনুপস্থিতিতে বেড়ের মাছ ধরে অন্যান্যদের সাথে তারপাশা গেছে মাছ বেচতে।
মাচানের ওপর হোগলা বিছানো রয়েছে। একপাশে রয়েছে ভাঁজকরা একটা কাঁথা। রাত্রে বারবার তাড়া খেয়েছে যে ঘুম, তা এসে বিছানাটার কোথাও লুকিয়ে রয়েছে যেন। তার অদৃশ্য হাতের আলতো পরশ অনুভব করে ফজল। তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। সে কাথার তলা থেকে বালিশ টেনে নেয়। তারপর বিছানার ওপর ঢেলে দেয় সে তার ঘুমকাতর শরীরটাকে। কিন্তু বালিশের ওপর মাথা রাখতেই হঠাৎ চমকে ওঠে সে। লাফিয়ে ওঠে তড়াক করে।
হায়, হায়, হায়! কি সর্বনাশের মাথার বাড়ি! এখন উপায়? ফিরে যাবে নাকি সে শ্বশুরবাড়ি?
কিন্তু এখন গিয়ে কোনো লাভ নেই, ফজল ভাবে। এতক্ষণে কাছারি ঘরের বিছানাটা তোলা হয়ে গেছে। বালিশের তলায় রাখা খোঁপার কাঁটাটা নিশ্চয় পেয়ে গেছে রূপজান। কি কেলেঙ্কারিটা ঘটে গেল তার ভুলের জন্য।
রূপজান কি কিছু বুঝতে পারবে? বুঝতে না পারার কোনোই হেতু নেই। একটা মাত্র কাঁটা। কয়েকটা হলেও রূপজানকে ফাঁকি দেয়া যেত। সে নিজেই ভেবে আশ্বস্ত হতে, কাঁটাগুলো তারই জন্য এনে রেখেছিল ফজল। দিতে ভুলে গেছে। এখন ওই কাঁটা বালিশের নিচে রাখার যে কোনো কৈফিয়তই নেই। তাছাড়া কাঁটাটা যার খোঁপার, সে ঐ বাড়িতেই রাত্রে ছিল। তার খোঁপায় নিশ্চয় রয়েছে ওটার মতো আরো কাঁটা।
ফজলের শিরা-উপশিরায় ঠাণ্ডা স্রোত ওঠা-নামা করছে।
খোঁপার কাঁটাটা সম্ভবত তারই পয়সায় কেনা। জরিনাকে এ রকম এক ডজন কাঁটা দিয়েছিল সে।
নিজের পয়সার কেনা কাঁটাটা এমন নিমকহারামি করল! দুশমনি করল! নাহ্, প্রাণহীন এ কাঁটাটার আর কী দোষ? দুশমনি করেছে জরিনা, সেই জাহান্নামের লাকড়িটা।
ফজল ভাবে, এ ঠিক পাপের শাস্তি। পাপ খাতির করে না পাপের বাপকেও। সে কবিরা গুনা করেছে। তার জন্য এখন কড়ায়-গণ্ডায় সুদে-আসলে জরিমানা দিতে হবে।
জরিনার জন্য ফজলের মনের কোটরে বাসা বেঁধেছিল অনেক স্নেহ-মতো, অনেক। সহানুভূতি। কিন্তু এ মুহূর্তে রাগ ও বিতৃষ্ণার ঘূর্ণিঝড় উড়িয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে সে সব কোমল অনুভূতি। জরিনাকে সে মনে মনে গাল দেয়, বেহায়া ঢেনি মাগিডাই তো তারে ঠেইল্যা নামাইছে পাপের আঠাই দরিয়ায়। এখন কত যে চুবানি খাইতে অইব তার শুমার নাই।
ফজল তার মনশ্চক্ষে দেখতে পায়–রূপজান ঝাঁটা মেরে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে জরিনাকে।
জরিনার জন্য আবার কেমন করে ওঠে ফজলের মন। তাড়া-খাওয়া মমতা আর সহানুভূতি মনের আশ্রয়ে ফিরে আসার জন্য পথ খোঁজে।
ফজল রূপকথার বইয়ে পড়েছিল রাজপুত্র আর রাজকন্যার পেছনে ধাওয়া করছে এক দৈত্য। তার গতিরোধ করার জন্য রাজকন্যা ছুঁড়ে ফেলে দেয় তার মাথার চিরুনি। সেই চিরুনি থেকে সৃষ্টি হয় কাঁটার এক দুর্ভেদ্য জঙ্গল। জরিনার খোঁপার কাঁটটাও বুঝি তার শ্বশুরবাড়ির চারদিকে সৃষ্টি করছে দুর্ভেদ্য কাঁটার বেড়া। সে বেড়া ভেদ করে সে কি রূপজানের কাছে যেতে পারবে আর?
ফজু কইরে?
ফজলের চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে যায়। পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে সে ঝুপড়ি থেকে বেরোয়। তার পিতার সাথে রয়েছে মেহের মুনশি, ধলাই সরদার আর জমিরদ্দি।
হোন্ ফজু, কোলশরিকগ খবর দিছি। এহনই আইয়া পড়ব। তুই ঘরের আড়ালে ছায়ার মইদ্যে হোগলা বিছাইয়া দে। বৈডক আছে আইজ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মাতব্বরের দলের লোকজন এসে হাজির হয় বৈঠকে।
এরফান মাতব্বর বলে, হোন মিয়ারা, আল্লার ফজলে কাম পাকা-পোক্ত অইয়া গেছে। জমিদারের সেলামি দিয়া খাজনাপাতি দিয়া পরিষ্কার অইয়া আইছি। এহন এমুন কোনো ব্যাডা নাই যে চরের তিরিসীমানায় আউগগায়।
আহাদালী বলে, কত ট্যাহা খাজনা দিলেন, মাতবরচাচা?
দেদার টাকা ঢাছিরে বাপু। তোমার মতো মাইনষে গইন্যা শুমার করতে পারব না। এহন কও দেহি তোমরা, ক্যামনে ভাগ করতে চাও জমি?
জমির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আলোচনা চলে অনেকক্ষণ। অবশেষে মাতব্বরের প্রস্তাবই মেনে নেয় সকলে। চরটাকে মাঝ বরাবর লম্বালম্বি দু’টুকরো করে আটহাতি নল দিয়ে মেপে ভাগ করতে হবে। চরের মাঝখান থেকে নদীর পানি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে এক এক জনের জমি। অবস্থানের দিক দিয়ে সকলের জমিই এক ধরনের হবে। তাই উৎকর্ষের দিক দিয়েও জমিতে জমিতে বড় বেশি পার্থক্য থাকবে না।
ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আলোচনা শেষ হলে এরফান মাতব্বর বলে, আমি তো ফতুর অইয়া গেছি সেলামি আর খাজনা দিয়া। এইবার আমার সেলামির যোগাড় করো।
নল পিছে কত কইর্যা সেলামি নিবেন মাতব্বরের পো? ধলাই সরদার জিজ্ঞেস করে।
আর সব মাতবররা যেই রহম নেয়।
রুস্তম বলে, আর সব মাতবররা তো ডাকাইত। তাগ মতন ধরলে আমরা গরিব মানুষ বাচমু ক্যামনে?
কদম শিকারি সায় দিয়ে বলে, মাতবরভাই, এট্টু কমাইয়া ধরেন।
তাইলে তোমরাই কও, কত কইর্যা দিবা।
রমিজ মিরধা বলে, নল পিছে বিশ ট্যাহা করেন।
বিশ টাকা! তোমাগ খায়েশ খানতো কম না! গত ছয় বচ্ছর খাজনা চালাইছি এই নাই চরের। তহন একটা আধা-পয়সা দিয়াও তো কেও সাহায্য করো নাই। এহন কোন আক্কেলে এমুন আবদার করো তোমরা?
উপরে আল্লা আর নিচে আপনে আমাগ বাপের সমান। আপনের কাছে আবদার করমু তো কার কাছে করমু?
তোমরা বিবেচনা কইর্যা কইও। চাইরশ বিশ আত দিঘল এক এক নল জমি। এক নলে কততুক জমি অয় ইসাব করছনি মেহের?
হ, করছি। এই ধরেন সাড়ে দশ কাঠার মতন। কানির ইসাবে অয় দুই গণ্ডার কিছু বেশি। একরের ইসাবে সাড়ে সতেরো শতাংশ। মেহের মুনশি বলে।
এহন তোমরাই কও। সাড়ে দশ কাঠা জমির লেইগ্যা তিরিশ টাকাও দিবা না কেমুন কথা?
জমিরদ্দি : দিতাম মাতবরের পো। কিন্তুক চরের জমি, আইজ আছে কাইল নাই।
ধলাই সরদার : হ, হ, গাঙ্গে ভাঙ্গনের ডর না থাকলে তিরিশ ক্যান্, একশ ট্যাহাই দিতাম।
এরফান মাতব্বর : অইচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা পঁচিশ টাকা কইর্যা দিও। সবাই রাজি?
সবাই রাজি হয়।
মাতব্বর আবার বলে, হোন মিয়ারা, যারা আগে সেলামির টাকা দিতে পারব, তাগ ইচ্ছামতো, পছন্দমতো জমি দিয়া দিমু।
ভালো সরেস জমি পাওয়ার আশায় সে-দিনই সেলামির টাকা নিয়ে এরফান মাতব্বরের বাড়ি হাজির হয় অনেকে। একদিনেই আদায় হয় সাত হাজার টাকা।
বহুদিন পরে এক সাথে অনেকগুলো টাকা হাতে পেয়ে মাতব্বরের মন খুশিতে ভরে ওঠে। তার বয়সের বোঝা হালকা মনে হয়। ভাটাধরা রক্তে অনুভূত হয় জোয়ারের পূর্বাভাস।
টাকা অনেকগুলো। কিন্তু টাকার কাজও রয়েছে অনেক। প্রথমেই ঋণ সালিশি বোর্ডের মীমাংসা অনুযায়ী দুই মহাজনের দেনার কিস্তি শোধ করতে হবে। তারপর যেতে হবে জণ্ড পোদ্দারের দোকানে। পুতের বউর বন্ধক-দেয়া গয়নাগুলো ছাড়িয়ে আনতে হবে। ফজুর মা’র দু’গাছা গয়নাও বন্ধক পড়ে আছে আজ দু’বছর। বাড়ির সবার জন্য কাপড়চোপড় কিনতে হবে। ঘাসি নৌকাটা মেরামত করা দরকার। পানসি গড়াতে হবে একটা। মাতব্বরির মান মর্যাদা বজায় রাখতে হলে পানসি একটা রাখতেই হয়। আগেও একটা পানসি ছিল মাতব্বরের। চর ভাঙার পর অভাবের সময় সেটা বেঁচে ফেলতে হয়েছিল।
পরের দিন। এরফান মাতব্বর হাশাইল বাজারে যায়। জগু পোদ্দারের দোকানে গিয়ে ছাড়িয়ে নেয় বন্ধক-দেয়া সবগুলো গয়না। পুতের বউর গলার হার, কানের মাকড়ি, হাতের চুড়ি আর অনন্ত। ফজুর মা’র গলার দানাকবচ আর কানের করণফুল। এগুলো বন্ধক দিয়ে পাঁচশ টাকা নিয়েছিল সে। এখন সুদে আসলে দিতে হলো আটশ টাকা।
সুদ যে কেমন করে ব্যাঙের বাচ্চার মতো পয়দা হতে থাকে বুঝে উঠতে পারে না মাতব্বর। সে মনে মনে বলে, ব্যাডা পোদারের পুত কি দিয়া যে কি ইসাব করল, বোঝতেই পারলাম না। ফজলরে সঙ্গে আনা উচিত আছিল। ও ইসাবপত্র বোঝে ভালো।
কাপড়চোপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা শেষ করে এরফান মাতব্বর নৌকায় গিয়ে ওঠে। তাদের গাবুর একাব্বর নৌকা ছেড়ে দেয়।
মাতব্বর বলে, সোজা নলতা মোল্লাবাড়ি চইল্যা যা। আইজ বউ না লইয়া বাড়িত যাইমু না।
ভাটি পানি। তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। গয়নার পুটলিটার ওপর হাত বুলাতে বুলাতে এরফান মাতব্বর মনে মনে বলে, আইজ দ্যাহাইয়া দিমু আরশেদ মোল্লারে। ও বিশ্বেস করে নাই আমার কথা। মনে করছে ওর মাইয়ার গয়না আর ছাড়াইতে পারমু না। আইজ দশটা চউখ উধার কইর্যা আইন্যা দেখবি, যেই গয়না বন্দুক দিছিলাম, তা বেবাক ছাড়াইয়া আনছি। দেহি, এইবার তুই আমার পুতের বউ কোন ছুতায় আটকাইয়া রাখস।
আরশেদ মোল্লা নিজের ও গরুর গা ধোয়ার জন্য নদীতে নেমেছিল। দুটো বলদ ও একটা গাইকে গলাপানিতে দাঁড় করিয়ে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে সে ওদের গা ঘষামাজা করছিল। হঠাৎ একটা উদলা নৌকার ওপর তার চোখ পড়ে। নৌকাটা তার বাড়ির দিকে আসছে আর ওতে বসে আছে এরফান মাতব্বর।
আরশেদ মোল্লা তাড়াতড়ি একটা ডুব দিয়ে আধা নাওয়া গরুগুলোকে খেদিয়ে নিয়ে যায় বাড়ির দিকে।
ভেজা কাপড়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মোল্লা তার স্ত্রীকে ডাকে, কইগো রূপির মা, আমার লুঙ্গি আর নিমাডা দ্যাও দেহি জলদি।
এত জলদি কিয়ের লেইগ্যা? মাইর করতে যাইব নি?
আগো চুপ করো। রূপজান কই?
নাইতে গেছে।
হোন, এরফান মাতব্বর আইতে আছে।
কুড়ুম আইতে আছে ভালো কথা। পুরান কুড়ুমের কাছে যাইতে আবার সাজান-গোছন লাগবনি?
দুত্তোরি যা! বিরক্ত হয়ে মোল্লা ভিজা কাপড়েই ঘরে যায়। লুঙ্গি বদলে নিমাটা গায়ে চড়িয়ে সে বেরিয়ে আছে। স্ত্রীকে বলে, হোন, মাতবর আমার কথা জিগাইলে কইও, দিঘিরপাড় হাটে গেছে।
ক্যান্? কুড়ুমের ডরে উনি পলাইতে আছে নি?
পলাইতে আছি তোমারে কে কইল? হোন, আমার মনে অয় মাতবর আইতে আছে তোমার মাইয়া নিতে। আমি থাকলেই তক্কাতক্কি অইব। জোরাজুরি করব মাইয়া নেওনের লেইগ্যা। আমি বাড়ি না থাকলে আর জোরাজুরি করতে পারব না। তুমি কইও, উনি বাড়ি নাই। খালি বাড়িরতন মাইয়া দেই ক্যামনে?
কই গেলেন বেয়াইসাব? এরফান মাতব্বরের গলা।
আরশেদ মোল্লা খাটো গলায় বলে, ঐ যে আইয়া পড়ছে! আমি গেলাম।
আরশোদ মোল্লা বাড়ির পেছন দিক দিয়ে সটকে পড়ে।
বেয়াইসাব কই? আবার হাঁক দেয় এরফান মাতব্বর। আরে–আরে–আরে! গরুতে ক্যালার ড্যামগুলা খাইয়া ফালাইল। কই গেলেন মোল্লাসাব?
এরফান মাতব্বর তার হাতের লাঠি উঁচিয়ে হেঁই হাঁট-হাট করে গরুগুলোকে তাড়া দেয়।
রূপজানের মা সোনাভান ওরফে সোনাইবিবি মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে আসে গরু বাঁধবার জন্য।
আসলামালেকুম বেয়ানসাব। কেমন আছেন?
আল্লায় ভালোই রাখছে।
মোল্লাসব কই?
উনি হাট করতে গেছে দিঘিরপাড়।
হাট করতে গেছে! তয় এই মাত্র গরু নাওয়াইতে দ্যাখলাম কারে?
হ উনিই। ঐ পুবের বাড়ির তারা হাটে যাইতে আছিল। তাই ত্বরাত্বরি গিয়া ওঠছে তাগো নায়। গরু বান্ধনেরও অবসর পায় নাই।
সোনাইবিবি গরু বাঁধবার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু গরুর শিং নাড়া দেখে সে ভয়ে পিছিয়ে আসে। তার মাথার ঘোমটা পড়ে যায়, নাকের দোলায়মান সোনার চাঁদবালিটা চিকমিকিয়ে ওঠে।
মাতব্বর বলে, আপনে পারবেন না। আমি আমার গাবুররে ডাক দিতে আছি। ওরে একাব্বর, এই দিগে আয়। গরুগুলারে গোয়ালে বাইন্দা রাখ।
মাতব্বর বেঠকখানায় গিয়ে চৌকির ওপর বসে। তার প্রশ্ন এড়িয়ে অন্দরে চলে যেতে পারেনা সোনাইবিবি। সে অন্দরমুখি দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে মাতব্বরের সাথে কথা বলছে।
বউমা কই, বেয়ান সাব? নাইতে গেছে।
আইজ বউমারে নিতে আইছি। একটা মাত্র পুতের বউ আমার। বউ বাড়িতে না থাকায় বাড়ি-ঘর আমার আন্দার অইয়া রইছে।
আপনেরা আমাগ মাইয়ার মোখৃখান যে আন্দার কইর্যা থুইছেন হেই কথাতো কন্ না। মাইয়ার গয়নাগুলারে বেবাক–
গয়নার কথা কেন? এই দ্যাহেন, বেবাক গয়না ছাড়াইয়া আনছি।
গয়নার পুটলিটা উঁচু করে দেখায় মাতব্বর। তারপর আবার বলে, বউমারে ডাক দ্যান। তার গয়না তার আতে বুঝাইয়া দিমু আইজ।
কিছুক্ষণ পর রূপজান আসে। শ্বশুরের কদমবুসি করে সে দাঁড়ায় তার কাছে।
মাতব্বর বলে, তোমার এই বুড়া পোলার উপরে রাগ অইয়া রইছ মা? এই দ্যাহো। মাতব্বর। গয়নার পুটলি খোলে। এই নেও মা, তোমার গলার হার। নেও, গলায় দ্যাও। শরম কিয়ের?
হারটা গলায় পরে রূপজান।
আর এই ধরো কানের মাড়িজোড়া। কানে দ্যাও মা, কানে দ্যাও। তুমি তো জানো মা, কেমুন বিপাকে পইড়া গেছিলাম। তা না অইলে কি আমার মা-র গয়না বন্দুক দেই আমি? কানে দিছ মা? হ্যাঁ এইতো এহন কেমুন সোন্দর দেহা যায় আমার মা-লক্ষ্মীরে।
একজোড়া অনন্ত ও ছয়গাছা চুড়িসহ পুটলিটা রূপজানের দিকে এগিয়ে দিয়ে মাতব্বর আবার বলে, এই নেও মা। কিছু থুইয়া আহি নাই। বেবাক ছাড়াইয়া আনছি। আর দ্যাহো, কেমুন চকমক-ঝকমক করতে আছে। সবগুলারে পালিশ করাইয়া আনছি।
রূপজানের গয়না পরা হলে মাতব্বর বলে, এইতো এহন আমার মা-র মোখখান হাসি খুশি দ্যাহা যায়। আর এই নেও শাড়ি। দ্যাহো কী সোন্দর গুলবদন শাড়ি। যাও মা শাড়ি পিন্দা তোমার মা-র কদমবুসি করো গিয়া। আর জলদি কইর্যা তৈয়ার অইয়া নেও।
সোনাইবিবি দরজার আবডালে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলে, কর্তা বাড়িতে নাই। খালি বাড়িরতন মাইয়া দেই ক্যামনে?
কর্তা নাই, কর্তানি তো আছে। যান বেয়ানসাব, বউমারে সাজাইয়া-গোজাইয়া দ্যান।
উনি বাড়ি না আইলে তো মাইয়া দিতে পারমু না।
উনি কোন সুম আইব, তার তো কোনো ঠিক নাই!
হ, হাটে গেছে, আইতে দেরি অইব। আপনে আর একদিন আইয়েন।
আর একদিন আর আইতে পারমু না। আইজই বউ লইয়া বাড়িত যাওন চাই। এইখানে এই পাড়া গাইড়া বইলাম আমি। যান, খাওনের যোগাড় করেন। পালের বড় মোরগাড়া জবাই করেন গিয়া।
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যা। কিন্তু এখনো বাড়ি ফিরে এল না আরশেদ মোল্লা। চৌকির ওপর শুয়ে বসে বিরক্তি ধরে গেছে এরফান মাতব্বরের। অস্বস্তিতে ছটফট করে সে। এর মধ্যে রূপজান তামাক সাজিয়ে দিয়ে গেছে বার কয়েক। প্রত্যেক বারই তাকে জিজ্ঞেস করেছে মাতব্বর, কি মা, তোমার বাজান আইছে?
অধৈর্য হয়ে ওঠে রূপজানও। সে বার বার ছাঁচতলায় গিয়ে নদীর দিকে তাকায়। কিন্তু তার বাজানকে দেখা যায় না কোনো নৌকায়। তার ব্যাকুলতার কাছে হার মানে লজ্জা সঙ্কোচ। সে মা-কে বলে, মা, বাজান এহনো আহেনা ক্যান?
উনির আহন দিয়া তোর কাম কি?
দ্যাহো না, মিয়াজি যাওনের লেইগ্যা কেমুন উতলা অইয়া গেছে।
তোর মিয়াজি উতলা অইছে, না তুই উতলা অইছস?
লজ্জায় মাথা নত করে রূপজান। মেয়ের দিকে চেয়ে মায়ের মন ব্যথায় ভরে ওঠে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে।
রূপজানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সে বলে, আমি আর কী করতে পারি, মা। তোর বাপ বেবুঝ, গোঁয়ার। আমার কোনো কথা কানে লয় না।
যেই গয়নার লেইগ্যা আমারে আটকাইছে, হেই গয়না তো বেবাকই দিছে আবার। বাজান বাড়িত থাকলে যাইতে মানা করত না। তুমি মিয়াজিরে কও আমারে লইয়া যাইতে।
কোন্ ডাকাইত্যা কথা কস, মা। উনির হুকুম ছাড়া তোরে যদি এহন যাইতে দেই, তয় কি আমারে আস্ত রাখব! কাইট্যা কুচিকুচি কইর্যা গাঙে ভাসাইয়া দিব না!
যদি যাইতে না দ্যাও, তয় গয়নাগুলা রাখবা কোন মোখে? এগুলা ফিরাইয়া দেই?
ফিরাইয়া দিবি ক্যান্? উনি বাড়িত আহুক। ওনারে বুঝাইয়া-সুজাইয়া তোরে পাড়াইয়া দিমু একদিন।
এরফান মাতব্বর মাগরেবের নামাজ পড়েও অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু আরশেদ মোল্লার আসার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না তার। মনের এ সন্দেহ তার আরো দৃঢ় হয়। সে বুঝতে পারে, আরশেদ মোল্লা তাকে দেখে পালিয়েছে। সুতরাং সে যতক্ষণ এ বাড়িতে আছে ততক্ষণ মোল্লা কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না।
মাতব্বর এশার নামাজ পড়ে বাড়ি রওনা হয়। যাওয়ার সময় বেয়ানকে বলে যায়, গয়নার লেইগ্যা মাইয়া আটকাইছিল। সবগুলো গয়না বুঝাইয়া দিছি। এইবার ভালমাইনষের মতন আমার পুতের বউরে যে আমার বাড়ি দিয়া আহে।
.
১০.
কার্তিক গেল, অগ্রহায়ণও প্রায় শেষ হয়ে এল। কিন্তু রূপজানকে দিয়ে গেল না আরশেদ মোল্লা। লোকটার মতলব খারাপ বলে মনে হচ্ছে এরফান মাতব্বরের। মোল্লার চেহারা মনে। ভাসতেই তার রক্ত টগবগ করে ওঠে, ‘জাক্কইর’ দিয়ে ওঠে সারা শরীরের রোম। তার ইচ্ছে হয়–মোল্লাকে শড়কি দিয়ে গেঁথে কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে।
রাগ হয় তার নিজের ওপরেও। কেন সে আহাম্মকের মতো এতগুলো গয়না তুলে দিয়ে এল মোল্লার মেয়েকে? যে মোল্লা ফেরেববাজি করে নিজের নাবালক ভাইপোর দুই কানি জমি আত্মসাৎ করতে পারে, জমির লোভী সেই মোল্লা যখন নতুন চরের জমির জন্য তার কাছে এল না, তখনই সে বুঝতে পেরেছিল, লোকটার মনে খন্নাস’ভর করছে। এতটা বুঝেও কেন বোকামি করল সে! কেন দিয়ে এল গয়নাগুলো! ওগুলো থাকলে ও দিয়েই আবার সে ফজলের বিয়ে দিতে পারত।
হুঁকো টানতে টানতে উঠানে বেরোয় এরফান মাতব্বর। সেখানে বরুবিবি রোদে দেয়া ধান ঘাটছিল পা চালিয়ে।
মাতব্বর বলে, হোন ফজুর মা, এত টাকার গয়না খামাখা দিয়া আইলাম। আমার মনে অয় গয়নাগুলা অজম করনের তালে আছে মোল্লা।
আমারও মনে অয় গয়নাগুলো মাইরা দিব।
কিন্তু অজম করতে দিমু না। আইজ মানুষজন খবর দিতে আছি।
ক্যান, মানুষজন দিয়া কি অইব?
কি অইব আবার! এত চর দখল করলাম এই জিন্দিগিতে, আর এহন নিজের পুতের বউ দখলে আনতে পারুম না!
ওনার কি মাথা খারাপ অইল নি? কাইজ্যা-ফ্যাসাদ কইর্যা বউ ছিনাইয়া আনলে মাতবর বাড়ির ইজ্জত থাকব? মাইনষে–
কি করতে কও তয়? পাজির লগে পাইজ্যামি না করলে দুইন্যায় বাঁইচ্যা থাকন যায় না।
আবার মোল্লাবাড়ি গিয়া দেহুক না একবার।
উঁহু! আমি আর যাইতে পারমু না। তোমার পোলারেই পাড়াইয়া দ্যাও।
ও গেলে তো দিবইনা।
হে অইলে ঐ মাইয়ার আশা ছাইড়া দ্যাও। গেছে গয়না যাইক। তুমি মাইয়া বিচরাও। ফজুরে আবার আমি বিয়া করাইমু।
কিন্তুক ফজুরে রাজি করান যাইব না।
ক্যান্ যাইব না? এমুন খুবসুরত আর ঢাক-চেহারার মাইয়া যোগাড় করমু, মোল্লার মাইয়ার তন তিন ডফল সোন্দর।
উঁহু। কত জায়গায় কত মাইয়া দ্যাখলাম। আমার রূপজানের মতন এমুন রূপে-গুণে কামে-কাইজে লক্ষ্মী মাইয়া আর পাওয়া যাইব না।
মাইয়াডা তো লক্ষ্মী, কিন্তু বাপখান কেমুন? ওর মতো অলক্ষ্মী, পাজির পা-ঝাড়া আছে দুইন্যার মাঝে? ওর মাইয়া লক্ষ্মী অইলেই কি, আর না অইলেই কি! তুমি জিগাও তোমার পোলারে।
উঁহু, ও রাজি অইব না কিছুতেই।
ক্যামনে বোঝলা তুমি?
আমি মা, আমি কি আর বুঝি না?
তয় এমুন না-মরদের মতন চুপচাপ রইছে ক্যান্ তোমার পোলা? যায় না ক্যান্ হউর বাড়ি? আলগোছে ভাগাইয়া লইয়া আইলেই তো পারে।
এই বুদ্ধিলাই ভালো। চুপে-চাপে কাম অইয়া গেলে কেও টের পাইব না।
হ তোমার পোলারে এই পরামিশই দ্যাও। নেহাত যদি বউ স্ব-ইচ্ছায় না আইতে চায়, তয় জোর কইর্যা লইয়া আইব। তা না পারলে গয়নাগুলা যে কাইড়া লইয়া আহে।
ফজলও এ রকমই ফন্দি এটেছিল। দ্বিধা-লজ্জার চাপে তা ছিল তার মনে মনেই এত দিন। বাপ-মায়ের প্ররোচনা ঝেটিয়ে দেয় তার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। সে তার মামাতো ভাই হাশমতের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করে, তার শ্বশুর যেদিন দূরে কোথাও যাবে, রাত্রে বাড়ি ফিরবে না, সেদিন সে চলে যাবে শ্বশুর বাড়ি। রাত্রে সে থাকবে সেখানে। রাত দুপুরের পর নৌকা নিয়ে সেই বাড়ির ঘাটে হাজির হবে হাশমত।
দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে। কিন্তু সুযোগ আর আসে না। ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত ফজল মিস্ত্রিদের কাজ দেখাশুনা করে। নতুন চরে পানসি তৈরি হচ্ছে তাদের। রাতের বেলাও ভাওর ঘর ছেড়ে সে কোথাও যায় না। বসে থাকে খবরের আশায়। গোপন খবরের জন্য সে তার চাচাতো শালা কাদিরকে লাগিয়েছে।
চুপচাপ বসে থাকলেই ফজলের মনে হানা দেয় জরিনার খোঁপার কাঁটাটা। রূপজান নিশ্চয় পেয়েছে কাঁটাটা। তার বুঝতে বাকি নেই কিছু।
বুঝুক, বুইঝ্যা জ্বইল্যা পুইড়া মরুক। ও-ই তো এর লেইগ্যা দায়ী। ঐ দিন রাইতে দেরি করল ক্যান্ ও? ফজলের মনে ক্ষুব্ধ গর্জন।
কিন্তু তবুও তার মনের দ্বিধা দূর হয় না। সে কেমন করে গিয়ে দাঁড়াবে রূপজানের সামনে? কাঁটাটার কথা জিজ্ঞেস করলে কি বলবে সে?
নাহ্, মিছে কথা ছাড়া উপায় নেই, ফজল ভাবে। এমন কিছু বানিয়ে রাখতে হবে যাতে জিজ্ঞেস করলেই ঝেড়ে দেয়া যায়।
কিন্তু রূপজানের সাথে দেখা করার সুযোগই যে পাওয়া যাচ্ছে না।
সুযোগের নাগাল পাওয়ার আগেই একদিন বাড়ি থেকে নূরু এসে বলে, দুদু, পা-না ধোয়া জঙ্গুরুল্লা হুছি চর দখলের আয়োজন করতে আছে!
কার কাছে শুলি?
আইজ ইস্কুলতন আইতে লাগছি, একজন মাইয়ালোকে আমারে ডাক দিয়া নিয়া চুপে চুপে কইছে এই কথা।
মাইয়া লোক! কে চিনস না?
উঁহু। হে কইছে, আইজই তোর চাচার কাছে খবরডা দিস।
মাইয়া লোকটা দ্যাখতে কেমন?
শ্যামলা রঙ। নীলা রঙের শাড়ি পরনে।
মোডা না চিকন?
বেশি চিকন না। মোডাও না।
বয়স কত অইব? বুড়ি, না জুয়ান?
বুড়ি না। চাচির মতই বয়স অইব।
ফজল চিনতে পারে না কে সে মেয়েলোকটি। কিন্তু সে যে-ই হোক, নিশ্চয়ই কোনো শুভাকাক্ষী আপন জন। তার খবরটা বেঠিক বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। জঙ্গুরুল্লা দাঙ্গাবাজ। তার তবে অনেক কোলশরিক, লাঠিয়াল-লশকর। ডাইনগাঁয়ের পুব দিকে অনেক কয়টা চর দখল করেছে সে। ফজল চিন্তিত হয়।
নূরু ও চার-পাঁচজন পুলকি-মাতব্বরকে সাথে করে ফজল বাড়ি যায়।
এরফান মাতব্বর শুনে বিশ্বাস করতে চায় না। সে বলে, নিজের এলাকা ছাইড়া জঙ্গুরুল্লা এত দূরে আইব কি মরতে?।
মেহের মুনশি বলে, কওন যায় না চাচাজান। জঙ্গুরুল্লার দলে অনেক মানুষজন।
হ ব্যাডা ট্যাহার কুমির। সমর্থন করে বলে জাবেদ লশকর। মাইনষে কয়, জঙ্গুরুল্লা পাল্লা-পাথর দিয়া ট্যাহা মাপে। গইন্যা বোলে শুমার করতে পারে না।
হে অইলে তো তৈয়ার থাকতে অয়, এরফান মাতব্বর বলে। চাকইর্যা ভাড়া করণ লাগব, না, তোমরাই ঠেকা দিতে পারবা?
ফজল : আমরাই পারুম।
মেহের মুনশি : এক কাম করলে অয়। আমাগ জমিরদ্দির মাইয়া বিয়া দিছে জঙ্গুরুল্লার কোলশরিক মজিদ খালাসির পোলার কাছে। জমিরদ্দিরে পাড়াইয়া দেই খালাসি বাড়ি। মাইয়ার কাছতন খবর লইয়া আইব গিয়া।
যুক্তিটা পছন্দ হয় সকলের। সেদিনই জমিরদ্দিকে বেয়াই বাড়ি পাঠিয়ে এরফান মাতব্বর চলে যায় খুনের চর। রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেয়ার জন্য সে তার লোকদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে। এক এক দল পালা অনুসারে নদীর কিনারা দিয়ে ঘুরে ঘুরে পাহারা দেবে। মাতব্বর নিজেও আস্তানা গাড়ে ভাওর ঘরে।
.
চর দখলের কিছুদিন পরেই বোরো ধানের রোয়া লাগানো হয়েছিল নদীর কিনারার কোনো কোনো জমিতে। নতুন মাটিতে ফসলের জোর দেয়া যায় খুব। কিছুদিন আগে আরো কিছু জমিতে লাগানো হয়েছে বোরা ধানের রোয়া। সেগুলোও সতেজ হয়ে উঠছে।
রোদ পোহাতে পোহাতে চরটার চারদিকে চোখ বোলায় এরফান মাতব্বর। সবুজের সমারোহ তার চোখ জুড়িয়ে দেয়। নতুন চর বলেই মনে হয় না তার কাছে। চর জাগার সাথে সাথে এমন ফসল ফলানো সম্ভব হয় না সব সময়। অপেক্ষা করতে হয় দু-এক বছর।
জমিরদ্দি খবর নিয়ে ফিরে আসে।
খবরটা সত্যি। বিশুগাঁওয়ের জমিদার রায়চৌধুরীরা এ তৌজির এগারো পয়সার মালিক। তাদের কাছ থেকে বন্দোবস্ত এনেছে জঙ্গুরুল্লা, তার লোকজন তৈরি হচ্ছে। জন পঞ্চাশেক চাকরিয়াও নাকি এনেছে সখিপুরার চর থেকে।
খবর শুনে মুখ শুকিয়ে যায় উপস্থিত পুলকি-মাতব্বর আর কোলশরিকদের। তাদের উদ্বেগভরা মুখের দিকে তাকিয়ে মাতব্বর বলে, জমিতে ফসল দেইখ্যা চর দখলের লোভ অইছে। আহে যে চরের কাছে। আমারে চিনে না। আমি যখন থিকা মাতবর তখন জঙ্গুরুল্লার নাম-নিশানাও আছিল না।
রুস্তম বলে, হ, পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা এহন চদরী নাম ফুডাইছে।
হ, মাইনষে যেমুন কয়–বাপ-বয়সে ঘোড়া না, লেজেতে লাগাম। তোমরা ঘাবড়াইও না। ওর চর দখলের খায়েশ মিডাইয়া দিমু।
কিন্তু মুখে যত সাহসের কথাই বলুক, মাতব্বর মনে মনে শঙ্কিত হয়। মহাভাবনায় পড়ে সে। তার দলের বেশির ভাগ লোকই আনাড়ি। তারা লাঠিও ঘোরাতে পারে না ঠিকমত । ঘোরানোর চোটে যদি বো-বো আওয়াজই না ওঠে, তাকে কি লাঠি ঘোরানো বলে? মাত্র দশ বারোজন শড়কি চালাতে পারে, বেতের ঢাল দিয়ে নিজেদের বাঁচাবার কৌশল জানে। কিন্তু পেশাদার চাকরিয়াদের সামনে তারা ধরতে গেলে কুকুরের মোকাবেলায় মেকুর।
মাতব্বর বলে, মেহের মুনশি চইল্যা যাও ট্যাংরামারি। ঐ জাগার আলেফ সরদার। আমার পুরান চাকইর্যা। বিশ-পঁচিশজন শাগরেদ লইয়া যেন তোমার লগেই আইয়া পড়ে। আর কদম চইল্যা যাও জাজিরার চর। গদু পালোয়নের পোলা মেঘু ওর বাপের মতোই মর্দ অইছে। ওরে আর ওর দলের পনেরো-বিশজন শড়কিদার লইয়া আইয়া পড়বা জলদি।
একটু থেমে মাতব্বর আবার বলে, আমাগ হাংগাল-বাংগালগুলারে লইয়া কি করি? এইগুলার আতে শড়কি দিতে ভস্সা পাই না। ওরা শড়কি আতে পাইলে বিপক্ষের মাইষের বুকের মইদ্যে হান্দাইয়া দিব। এই গুলার আতে দিতে অইব লাডি। কিন্তুক একজনও ঠিকমত লাডি চালাইতে পারে না।
হ, ঠিকই কইছেন। একজনও ভালো কইর্যা লাডি চালাইতে হিগে নাই। বলে রমিজ মির।
ফজল, এক কাম কর। তুই লোনসিং চইল্যা যা। তুই না কইছিলি লোনসিংয়ের কে খুব ভালো লাডি খেইল শিখছে?
হ, তুরফান। ফজল বলে। আমার লগে নড়িয়া ইস্কুলে পড়তো। পুলিন দাসের এক শাগরেদের কাছে সে লাঠি খেলা শিখছে।
পুলিন দাস আবার কে? আহাদালী জিজ্ঞেস করে।
পুলিনবিহারী দাস। বাড়ি লোনসিং। স্বদেশী আন্দোলনের বড় নেতা। এখন বোধ করি জেলে আছে।
আমরা হুনছি, সে এত জোরে বোঁ-বোঁ কইর্যা লাডি ঘুরাইতে পারত, বন্দুকের ছা তার লাডির বাড়ি খাইয়া ছিট্যাভিট্যা যাইত, তার শরীলে লাগতে পারত না। মাতব্বর বলে। ফজল গিয়া তুরফানরে লইয়া আয়। আমাগ হাংগাল-বাংগালগুলারে কয়ডা দিন লাডি খেলার তালিম দিয়া যাইব।
আমি আইজই যাইতে আছি।
হ, তোমরা কিছু মোখে দিয়া এহনই বাইর অইয়া পড়। যাইতে-আইতে পথে দেরি কইর্য না কিন্তুক।
দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে তিনটা উড়োজাহাজ আসছে। বিকট আওয়াজ তুলে ওগুলো মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় উত্তর-পূর্ব কোণের দিকে।
এরফান মাতব্বর শুনেছে, সারা দুনিয়া জুড়ে তুমুল লড়াই শুরু হয়ে গেছে। সে জিজ্ঞেস করে, কোন মুলুকে যাইতে আছে এগুলা, জানোনি?
মনে অয় আসাম মুলুকে যাইতে আছে। বলে জাবেদ লশকর।
উড়োজাহাজগুলো দূর-দিগন্তে মিলিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মাতব্বর তবুও চেয়ে আছে সেদিকে। ওগুলোর আওয়াজ যেন বাসা বেঁধেছে তার বুকের ভেতর। যেন লড়াইয়ের কাড়া নাকাড়া বেজে চলেছে সেখানে।
মাতব্বর শক্ত করে ধরে তার হাতের লাঠিটা। তার শিথিল বাহুর পেশি কঠিন হয়ে ওঠে। স্পষ্ট হয়ে ওঠে কোঁচকানো মুখের রেখাগুলো। ঘোলাটে চোখ দুটো ঝলকে ওঠে আক্রোশে।
.
১১.
ফজল পরের দিনই তুরফানকে নিয়ে আসে। এসেই তুরফান পুলকি-মাতব্বর আর কোলশরিকদের জোয়ান তরুণ ছেলেগুলোকে লাঠি খেলার সবক দিয়ে শুরু করেছে। ফজল নিজেও নিচ্ছে খেলার তালিম।
আলেফ সরদার এসেছে তার তিরিশজন সারগেদ নিয়ে। মেঘু পালোয়ান নিয়ে এসেছে ঊনিশজন। মাতব্বরের দলের আশিজনও হাজির। যার যার হাতিয়ার–ঢাল-কাতরা, লাঠি শড়কি, গুলেল-গুলি সব তৈরি।
দূর থেকে কেমনে গগম্ আওয়াজ শোনা যায়, যেমন শোনা যায় হাটের হট্টগোল। সত্যি যেন হাট বসে গেছে খুনের চরে।
চাকরিয়াদের সাথে নিয়ে পালা অনুসারে পাহারা দিচ্ছে কোলশরিকেরা। যাদের অবসর তারা বয়স ও প্রকৃতি-প্রবণতা অনুসারে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আড্ডা দেয়। একদল মাটিতে দাগ কেটে ষোলগুটি খেলে তো আর একদল কেচ্ছা-শোলকের আসর জমিয়ে তোলে। কোনো ভাওর ঘরে বসে যায় পুঁথি-পাঠের মজলিস। সুর করে পড়ে গাজী-কালু আর সোনাভানের পুঁথি। যেখানে পানসি নৌকা তৈরি হচ্ছে, সেখানকার আসর সবচেয়ে বেশি জমজমাট। বুড়ো আকু মিস্ত্রি টান দিয়েছে গানে–
ও-ও জীর্ণ কাষ্ঠের একখান তরী,
তার উপরে এক সওয়ারি,
পাড়ি ধরছে অকুল দরিয়ায় ॥
ওরে উওরায় পানি টুবুটুবু,
তাইতে তরী ডুবুডুবু
এখন ঢেউ উঠিলে হইব অনুপায় ॥
আছরের নামাজের সময় হয়নি তখনও। এরফান মাতব্বর ভাওর ঘরে বসে কোরানশরিফ পড়ছিল। গানের আওয়াজ কানে আসতেই তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়, বিরক্তি ধরে। গানের আওয়াজ যাতে কানে না আসে সেজন্য গলার স্বর উঁচু পর্দায় চড়িয়ে কোরান তেলাওয়াতে মন দেয় সে। কিন্তু পাক কোরানের পাতা ছেড়ে তার মনমাঝি এক সময়ে চড়ে বসে জীর্ণ কাষ্ঠের তরীতে।
ও-ও জীর্ণ কাষ্ঠের একখান তরী,
তার উপরে এক সওয়ারি,
পাড়ি ধরছে অকুল দরিয়ায় ॥
ওরে কালা মেঘে আসমান ছাওয়া
খাড়াঝিলিক করে ধাওয়া
এখন তুফান ছাড়লে হবে কি উপায়?
ওরে ও মন-মাঝি–
সাবধানে ধরিও হাল,
কৌশলে বান্ধিও পাল,
উজান গাঙে পাড়ি পাওয়া দায় ॥
গান শেষ হলে এরফান মাতব্বরের সংবিৎ ফিরে আসে। নিজেকে সে তিরস্কার করে বারবার। কোরান-মজিদের পাক কালামের ওপর কেন সে তার মনকে নিবিষ্ট রাখতে পারেনি। আল্লার কালাম সে অশেষ ভক্তি নিয়ে পড়ে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না বলে কি তার মন উড়াল দেবে ঐ গানের কথা আর সুরের পেছনে পেছনে!
মাতব্বর আলোয়ানের কয়েক প্যাঁচে ঢেকে নেয় তার মাথা আর কান দুটো। তারপর আবার শুরু করে কোরানশরিফ তেলাওয়াত।
আছরের নামাজ পড়ে মাতব্বর আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। শীতে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার সারা শরীর।
আবার শোনা যায় গান। দোতারা বাজিয়ে এবার গাইছে বোধহয় পাঞ্জু বয়াতি।
দয়ালরে তোর দয়ার অন্ত নাই,
এই আসমান জমিন
আর সাগর গহিন।
সবখানে তার পরমান পাই ॥
মাতব্বরের মন গানের পাখায় ভর দিয়ে আবার উড়ে চলে। তাকেও টানে গানের আসরের দিকে। সে ঝুপড়ি থেকে বেরোয়। একপা-দু’পা করে এগিয়ে যায় ধীরে ধীরে। তাকে দেখে সচকিত হয়ে ওঠে সবাই। বন্ধ হয়ে যায় গান। মাতব্বরের ইচ্ছে হয় চেঁচিয়ে বলে, ওরে গানে ক্ষ্যান্ত দিলি ক্যান্? চলুক, চলতে দে।
মাতব্বর নিজেকে সামলে নেয়। সে সকলের মুরব্বি মাতব্বর। তার উচিত নয় এদের সাথে হৈ-হুঁল্লোড় করার। এছাড়া একবার যদি এরা প্রশ্রয় পেয়ে যায় তবে গান-বাজনায় মেতে যাবে সবাই। আর ওদিক দিয়ে বিনা বাধায় জঙ্গুরুল্লা দখল করে নেবে চর।
মাতব্বর ডাকে আকু মিস্ত্রিকে, কিও মিস্ত্রি, আর কদ্দিন লাগাইবা?
এই ধরেন কুড়ি-বাইশ দিন।
অনেক দিন লাগাইতে আছ। জলদি করো। এর পর আবার ছই লাগাইতে অইব।
একটু থেমে সে ডাক দেয়, ফজল কইরে?
জ্বী। ভিড় থেকে বেরিয়ে আসে ফজল।
তোর লাডির খেইল কেমুন চলতে আছে?
খুব ভালো চলতে আছে।
উন্নতি অইছে কিছু? না খালি খালি–
না অনেক উন্নতি অইছে।
আরো ভালো কইর্যা শিখতে অইব। আর হোন, তুই, হাশমত, লালু, ফেলু, বক্কর, টিটু, একাব্বর শড়কি চালানও শিখ্যা রাখ। আর কে কে শিখতে চায়?
আমি, আমি, বলে আরো দশ-বারোজন এগিয়ে আসে।
মাতব্বর বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ সাবাস! তোমরা আলেফ সরদার আর মেঘু পালোয়ানের শাগরেদ অইয়া যাও। শড়কি চালান শিখ। খামাখা সময় নষ্ট কইর না। কি ভাই আলেফ সরদার, কই মেঘু, পারবা না আমাগ এই হাংগাল-বাংগালগোরে এট্টু লায়েক বানাইতো?
পারমু না ক্যান্, মেঘু পালোয়ান বলে।
মেঘু রাজি অইয়া গেল নি ও? হাসতে হাসতে বলে আলেফ সরদার। এই জমিনওলাগো এই বিদ্যা হিগাইলে হেষে আমাগ ভাত জুটব না কিন্তু কইয়া দিলাম। কি কন মাতবর-ভাই?
আরে না-না। ভাত দেওনের মালিক আল্লা। আমরা চাইলেও কি আর তোমাগ ভাত মারতে পারমু?
তা ঠিক কইছেন। লইয়া আহেন মণ্ডা-মিডাই। মোখ মিষ্টি কইর্যা তয় না পয়লা সবক দিমু।
পরের দিন মিষ্টিমুখ করে আলেফ সরদার আর মেঘ পালোয়ান নতুন নতুন সাগরেদদের শড়কি চালনা শেখাতে আরম্ভ করে। এরফান মাতব্বর নিজে দাঁড়িয়ে দেখে। সেও এক কালে ভালো শড়কি চালাতে পারত।
এরফান মাতব্বর নতুন সাগরেদদের উপদেশ দেয়, মাইনষে কইতেই কয়, বাঙ্গালের মাইর, দুনিয়ার বাইর। তোমরা হেই রকম বাঙ্গাল। তোমরা কাবু পাইলে এক্কেবারে মাইরা ফালাইবা, আবার বেকাদায় পড়লে নিজেরা মরবা। এর লেইগ্যা তোমাগ তালিম দিতাছি। চরের কাইজ্যা কিন্তু রাজা-বাদশাগ লড়াই না যে যারে পাইলাম তারে খুন করলাম। চরের কাইজ্যা অইল বিপক্ষরে খেদানের লেইগ্যা। তাই নিজেরে বাঁচাইতে শিখ একদম পয়লা। তারপর শড়কি দিয়া খোঁচা দিতে শিখ। খোঁচা কিন্তু বুকে মাথায় দিবা না। খোঁচা দিবা আতে, পায়ে। খোঁচা খাইয়া যে লাঠি-শড়কি ফালাইয়া ভাইগ্যা যায়।
রোজ ভোর বেলা তিন-চার ঘণ্টা চলে শড়কি চালনা শিক্ষা। আর বিকেল বেলা আলেফ সরদারও মেঘু পালোয়ান তাদের দল নিয়ে লাঠি-শড়কি খেলার প্রতিযোগিতায় নামে। কখনও জঙ্গুরুল্লার দল সেজে একদল আক্রমণ করে, অন্য দল এরফান মাতব্বরের পক্ষ নিয়ে তাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে এগিয়ে যায়। মহড়ার সময় ন্যাকড়া দিয়ে বেঁধে দেয়া হয় শড়কির ফলা।
চাকরিয়ারা মাথাপিছু এক টাকা হিসেবে রোজানা পায়। তাদের সরদার দু’জন পায় দু’টাকা করে। এর ওপর আবার মাগনা খোরাক দুবেলা। কম করে খেলেও আধা সের চালের ভাত খায় এক-এক জনে এক-এক বেলা।
চাকরিয়া এসেছে আজ বিশ দিন। এ ক’দিনে দেড় হাজার টাকার ওপর খরচ হয়ে গেছে এরফান মাতব্বরের। আরো কতদিন রাখতে হবে চাকরিয়াদের কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে। কিন্তু এই হারে খরচ হলে কিছুদিনের মধ্যেই সে ফতুর হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে যা আদায় হয়েছিল সেলামি বাবদ। কোলশরিকদের কাছ থেকেও কিছু আদায় করা যাবে না এখন, আর তা উচিতও নয়। সেলামির টাকাই বহু কষ্টে যোগাড় করেছিল তারা। সে ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি অনেকে।
এই জমিদার আর জমিদারের নায়েবরাই যত নষ্টের গোড়া। মনে মনে গর্জে ওঠে এরফান মাতব্বর। যে এগারো পয়সার মালিকানা দেখায় রায়চৌধুরীরা, সেই জাগাতো আরো অনেক দক্ষিণে, এখনো পানির তলে। ছয়-সাত বচ্ছর আগে ঐখানে চর আছিল্।
নিজেগ জাগার নাম-নিশান নাই, এখন আমার চরের বন্দোবস্ত দিছে জঙ্গুরুল্লারে। জমিদার আর ওর নায়েবের পেডের ঝুলি বাইর করন দরকার। যত কাইজ্যা-ফ্যাসাদের মূলে এই জানোয়ারের পয়দারা।
মনের আক্রোশ মনেই চাপা দিয়ে এরফান মাতব্বর জঙ্গুরুল্লার হামলা প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে, কিন্তু এ পর্যন্ত একবারও হানা দেয়ার চেষ্টা করেনি বিপক্ষ দল। দিন দশেক আগে একবার, দিন দুই আগে আরো একবার রাত দুপুরে হৈ-চৈ করে উঠেছিল পাহারারত চাকরিয়ারা, ঐ আইতে আছে, আউগ্গারে, আউগ্গা…আউগ্গা…
মারমার করে এগিয়ে গিয়েছিল দলের সবাই। ফজল নদীর কিনারায় গিয়ে পাহারাওলাদের কাছে শোনে–অনেকগুলো নৌকা এদিকে আসছিল। এদিকের হাঁক-ডাক কুদা-কুদি শুনে ভেগে গেছে।
ফজল টর্চের আলো ফেলে।
চাকরিয়াদের একজন বলে, এহন কি আর দেহা যাইব? এতক্ষণে চইল্যা গেছে কোন মুলুকে!
মাতব্বর পুরানো ঘাগু। সে জানে, এ সব কিছু নয়। চাকরিয়াদের চাকরি বজায় রাখার ফন্দি আর কি। কিন্তু জেনেও সে বলে না এ কথা কাউকে। বললে শেষে হয়তো যেদিন সত্যি সত্যি বাঘ আসবে সেদিন রাখালকে বাঁচাবার জন্য আর এগিয়ে আসবে না কেউ।
হুড়মুড় করে চলে যাচ্ছে টাকা। প্রায় শ’খানেক টাকা খরচ হয় রোজ। দিন যত যাচ্ছে, তহবিলের টাকাও কমে আসছে তত। আর এ ভাবে খরচ করা উচিত নয়, ভাবে এরফান মাতব্বর। আলেফ সরদার ও মেঘু পালোয়ানের সাথে পরামর্শ করে সে দুই দল থেকে বেছে মাত্র দশজন রেখে বাকি সবাইকে বিদেয় করে দেয়। আলেফ ও মেঘুর ‘রোজানা’ দুটাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয় তিন টাকা।
.
১২.
পান্সি তৈরি শেষ হয়েছে। ওটায় গাবও লাগানো হয়েছে তিন পোচ। এখন পানিতে ভাসিয়ে এতে পাটাতন বসাতে হবে, ছই লাগাতে হবে।
বুধবার জোহরের নামাজ পড়ে নৌকা ভাসানো হবে। শুভ দিন-ক্ষণ ঠিক করে রেখেছে এরফান মাতব্বর। কিন্তু বুধবার আসার তিন দিন আগেই তার জ্বর হয়। বাড়ি গিয়ে সে বিছানা নেয়।
শুভ দিন-ক্ষণ যখন ধার্য করা হয়েছে তখন ঐ দিন ঐ ক্ষণেই নৌকা ভাসানো হবে– ফজলকে খবর পাঠায় এরফান মাতব্বর। গাবুর একাব্বর খবরের সাথে নিয়ে আসে তিনটে ধামা ভরে খই আর সের কয়েক বাতাসা।
পাহারারত কয়েকজন ছাড়া আর সবাই জমায়েত হয়েছে নৌকা ঠেলবার জন্য।
নৌকার বুকের সামনে মাটিতে পাতালি করে রাখা হয়েছে চারখণ্ড কলাগাছ। একবার কলাগাছের ওপর চড়িয়ে দিতে পারলে নৌকাটা সহজেই গড়িয়ে নেয়া যাবে নদীর দিকে। গায়ে গায়ে মেশামেশি হয়ে নৌকা ধরেছে অনেকে। সবার ধরবার মতো জায়গা নেই। ফজল মাথার ওপর রুমাল নেড়ে হাঁক দেয়, জো-র আ…ছে…এ…এ…?
সকলে : আ….ছে…এ..এ…।
ফজল : এই জোর থাকতে যে জোর না দিব তার জোর নিব ট্যাংরা মাছে…এ..এ… হেঁইও…
সকলে : হেঁইও।
ফজল : মারুক ঠেলা।
সকলে : হেইয়ো।
ফজল : মারুক ঠেলা।
সকলে : হেঁইও…ও…ও…
ফজল : অ্যাই কলাগাছ ফ্যাল সামনে…এ…এ… মোরো ঠেলারে… এ…এ…।
সকলে : হেঁইও, নামছে, নামছে নামছেরে– হেঁইও।
নৌকা নেমে গেছে নদীতে। ফজল ও আরো কয়েকজন বসেছে নৌকায়। পাঁচখানা বৈঠা এগিয়ে দেয় একাব্বর।
সকলে চিলিবিলি করে খই আর বাতাসা ভরে নিজ নিজ গামছায়। একটা ধামায় করে কিছু খই-বাতাসা তুলে দেয়া হয় পানসিতে।
ফজল হাল ধরেছে। চারজন টানছে বৈঠা। নতুন পানসি তরতর করে চলছে পানি কেটে। কিনারায় দাঁড়িয়ে খই-বাতাসা খাচ্ছে সবাই, আর চেয়ে দেখছে নতুন নৌকার চলন দোলন। গড়নে কোনো খুঁত আছে কিনা তাও দেখছে মনোযোগ দিয়ে।
ও মিয়ারা?
ডাক শুনে বাঁ দিকে মাথা ঘোরায় সবাই। উত্তর দিক থেকে উধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে একজন অপরিচিত লোক।
কি কও মিয়া? দৌড়াইতেছ ক্যান? একজন জিজ্ঞেস করে।
দারোগা-পুলিস আইতাছে। লোকটি বলে। অ্যাঁ দারোগা-পুলিস! কই?
ভীত ও বিস্মিত প্রশ্ন সকলের। কারোটা উচ্চারিত হয়, কারোটা ভয়ে লুকিয়ে থাকে মুখের গহ্বরে।
ঐ চাইয়া দ্যাহো।
সবাই উত্তর দিকে তাকায়। সত্যি থানার নৌকা। আরো দুটি নৌকা আসছে ওটার পেছনে পেছনে।
লোকটিকে ছুটে আসতে দেখেই পাড়ের দিকে পানসি ঘুরিয়েছিল ফজল। তাড়াতাড়ি বৈঠা মেরে ফিরে আসে সে। নৌকার থেকে লাফ দিয়ে নেমেই জিজ্ঞেস করে, কি ও, কি কি?
দারোগা-পুলিস আইতাছে, ঐ দ্যাহো চাইয়া।
একই সঙ্গে অনেকগুলো সন্ত্রস্ত কণ্ঠের কোলাহলে শঙ্কিত হয় ফজল। সে থানার নৌকার দিকে চেয়ে অপরিচিত লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, কিয়ের লেইগ্যা আইতে আছে?
কাইল বোলে ডাকাতি অইছে কোনখানে?
হ অইছে এই চরের পশ্চিম দিগে।
গত রাত্রে এশার নামাজের পর ফজল ও তার মাছ ধরার সঙ্গীরা বেড়ের মাছ ধরতে গিয়েছিল। চাকরিয়াদের খাওয়াবার জন্যই শুধু পৌষ মাসের হাড়-কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে মাছ ধরতে যেতে হয় আজকাল। ভাটার সময় তিরতিরে পানির মধ্যে আছাড়-পাছাড় খেয়ে মাছ ধরছিল তারা। এমন সময় শোনা যায় ডাক-চিৎকার, আমারে মাইর্যা ফালাইছে রে। ডাকাইত–ডাকাইত। পরে জানা যায় পুব্যের চরের এক গেরস্ত পাট বিক্রি করে লৌহজং থেকে বাড়ি ফিরছিল নৌকায়। একদল ডাকাত তাকে মারধর করে তার পাট-বেচা পাঁচশ’ টাকা নিয়ে গেছে।
অপরিচিত লোকটি বলে, ঐ ডাকাতির আসামি ধরতে আইতে আছে।
আসামি! আসামির খোঁজ পাইছে? ফজল জিজ্ঞেস করে।
হ আপনের নামও আছে। আর কদম শিকারি কার নাম? আরো চৌদ্দ-পনেরো জন।
ফজল শুদ্ধ, বিমূঢ়। চোখে তার শূন্য দৃষ্টি।
মেহের মুনশি লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কে ভাই? কই হোন্ছ এই কথা?
আরে মিয়া আমার বাড়ি বাশগাও। ফজল মিয়া তো চিনে না। ওনার বাপ চিনে। তার লগে আমার বাপের গলায় গলায় খাতির আছিল। আইজ চুরির ইজাহার দিতে গেছিলাম থানায়। ফজল মিয়ারে আসামি দেওনের কথা হুইন্যা চিল-সত্বর আইছি দারোগার নাওরে পিছনে ফালাইয়া।
সংবিৎ ফিরে পেতেই ফজল দেখে তার লোকজন এমন কি চাকরিয়ারা পর্যন্ত ভেগে যাচ্ছে। কেউ ভাওর ঘরের দিকে ছুটছে। কেউ ছুটছে কিনারায় বাধা ডিঙিগুলোর দিকে।
রমিজ মিরধা বলে, কি মিয়া খাড়াইয়া রইছ কাঁ? ঐ দ্যাহো আইয়া পড়ল। সে এক রকম ঠেলে নিয়ে চলে ফজলকে।শিগগির নায় ওড।
ভাওর ঘর থেকে হাতিয়ার, বিছানাপত্র নিয়ে দৌড়ে আসে চাকরিয়াদের কেউ কেউ। ফজলের আগেই তারা নতুন পানসিটায় চড়ে বসে।
ফজল বলে, তোমরা ক্যান পলাইতেছ? তোমায় তো ধরতে আসে না।
তোমরা যেমুন পলাইতে শুরু করছ, মনে অয় তোমরাই ডাকাতি করছ। মেহের মুনশি বলে।
আমরা ডাকাতি করছি, কয় কোন হুমুন্দির পুত। আঁঝি মেরে ওঠে আলেফ সরদার।
এই চাকরা, মোখ সামলাইয়া কথা কইস।
দ্যাখ, মোখ দিয়া না, এই শড়কি দিয়া কইমু। আলেফ শড়কি উঁচু করে।
ফজল ধমকি দেয়, এইডা কি শুরু করলেন আপনেরা।
আরে আইয়া পড়ল! শিগগির ওড নায়। রমিজ মিরধা তাড়া দেয়।
ফজল : কেও বাকি নাইতো?
জাবেদ লশকর : আরে না–না। ঐ চাইয়া দ্যাহ্, জমিরদ্দির নায় ওঠছে দশ-বারোজন আর ঐ যে ধলাইর নাও।
মেঘু পালোয়ান : মিয়ারা তোমরা পুলিসের লগে দোস্তালি কর। আমরা নাও ছাইড়া দিলাম।
ফজল ও বাকি আর সবাই পানসিতে ওঠে। পাঁচ বৈঠার টানে ছুটে চলে পানসি।
দূরে মান্দ্রার খড়ির মুখে জড় হয় সব ক’টা নৌকা। গুনতি করে দেখা যায় সবাই পালাতে পেরেছে।
লালুর বাপ বলে, পুলিস আইজ একটা ঠক খাইব। একটা পোনাও পাইব না করে।
একাব্বর ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিল। পুলিসের কথা শুনেই নৌকার ডওরার মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে আল্লা-আল্লা করছিল সে। এতক্ষণে তার প্রাণে পানি আসে। সে বলে, নাওডা আরো দূরে লইয়া যাও। পুলিস বন্দুক ছাইড়া দিব।
হো-হো হেসে ওঠে সবাই।
ফজল বলে, ব্যাডা কেমন নিমকহারাম। আমরা ভালোরে বুইল্যা আউগাইয়া গেলাম। আর আমাগ দিল আসামি!
মেঘু পালোয়ান : ঐ যে মাইনষে কয় না, উপকাইরারে বাঘে খায়।
মেহের মুনশি : আমার মনে অয় কেও পরামিশ দিয়া আমাগ নাম লাগাইয়া দিছে। না অইলে ঐ অচিনা ব্যায় নাম পাইল কই?
আলেফ সরদার : দুশমনের কি আকাল আছে? তোমায় চরের কাছে ডাকাতি অইছে, তাই সন্দ করছে, তোমরা ছাড়া আর কে করব এই কাম।
ফজল : আমাগ না অয় সন্দ করছে, আমরা পালাইছি। কিন্তু আপনেরা ক্যান্ পলাইছেন চর খালি থুইয়া?
আলেফ : মিয়া, তোমার একগাছ চুলও পাকে নাই। তাই বোঝতে পার না। দারোগা যহন জিগাইত–ও মিয়া তোমার বাড়ি কই? তহন কি মিছা কথা কইতে পারতাম? ট্যাংরামারির কথা হুইন্যা এক্কেরে তক্ষণ তক্ষণ মাজায় দড়ি লাগাইত। কইত এত দূর তন কি করতে আইছ এইখানে? তোমরাই ডাকাতি করছ।
নৌকার সবাই সায় দেয় তার কথায়। ফজলকেও মেনে নিতে হয় তার যুক্তি।
শীতকালের বেলা তাড়াতাড়ি পালায় শীতের তাড়া খেয়ে। দারোগা-পুলিস চর থেকে চলে যায়। তাদের নৌকা দৃষ্টির আড়াল হতেই মান্দ্রার খাড়ি থেকে বেরোয় সবকটি নৌকা।
মেহের মুনশি বলে, আস্তে আস্তে চালাও। আন্ধার অউক।
চইল্যাতত গেছে। আবার আস্তে আস্তে ক্যান? মেঘু পালোয়ান বলে। দুফরের খাওনডা মাইর গেছে। জলদি চালাও।
হ জলদি চালাও। আলেফ সরদার বলে। প্যাটার মইদ্যে শোল মাছের পোনা কিলবিলাইতে আছে।
তবু ধীরে ধীরে চলছে নৌকা। চরের কাছে পৌঁছতে সন্ধ্যা উতরে যায়।
এই ক্যাডারে? আর আউগ্গাইস্ না, খবরদার!
খাইছেরে! সব্বনাশতো অইয়া গেছে!
হায় আল্লা, জঙ্গুরুল্লা চর দখল কইর্যা ফালাইছে।
ফজল ও তার লোকজন হতভম্ভ। তাদের নৌকা থেমে গেছে। পানিতে টুপটাপ পড়ছে কিছু। গুলেল বাঁশের গুলি বুঝতে পারে তারা। দু-একটি গুলি তাদের গায়েও এসে লেগেছে।
আকস্মিকতার ঘোর কাটিয়ে ফজল হাঁক দেয়, কারারে তোরা? ভাইগ্যা যা ভালো থাকতে। নইলে জবাই কইর্যা ফালাইমু।
আইয়া দ্যাখ কে কারে জবাই করে।
তারপর দুই দলে চলতে থাকে অশ্রাব্য গালাগাল।
ফজল ও মেহের মুনশি জিজ্ঞেস করে আলেফ ও মেঘুকে, কি মিয়ারা, পারবানি লড়তে?
লড়তে পারমু না ক্যান্। কিন্তুক এই রাইতের আন্ধারে কে দুশমন কে আপন চিনা যাইব না। আউলাপাতালি লড়াই করতে গিয়া খামাখা জান খোয়াইতে অইব।
একজন লাঠিয়াল : আমার ঢাল-শড়কি আনতে পারি নাই।
মেঘু : অনেকের কাছেই আতিয়ার নাই। আতিয়ার থুইয়া পলাইছে আহাম্মকরা।
জাবেদ লশকর : তয়তো ওগো মজাই। আমাগ শড়কি দিয়াই আমাগ পেডের ঝুলি বাইর করতে পারব।
প্রত্যেকেই কাঁথা-বালিশ, ঢাল-কাতরা, লাঠি-শড়কি, মাছ ধরার সরঞ্জাম ইত্যাদি কিছু না কিছু হারিয়ে হায়-আফসোস করতে থাকে।
মেহের মুনশি বলে, জঙ্গুরুল্লাতো জবর ফেরেববাজ। দ্যাখছনি ক্যামনে ডাকাতি মামলা দিয়া আমাগ ছাপ্পরছাড়া কইর্যা দিল!
হায় হায়রে! এত কষ্ট কইরা ধান রুইছি। লালুর বাপ বলে।
মেঘু পালোয়ান : জঙ্গুরুল্লা কি মরদের মতো কাম করছে নি? হিম্মত থাকলে আইত সামনাসামনি।
জাবেদ : আহ্-হারে কতগুলা জমির ধান। এত কষ্ট কইর্যা–
আলেফ : আর হায়-হুঁতাশ কইর্যা কি অইব? চলো, মাতবরের কাছে যাই। দেহি উনি কি করতে বুদ্ধি দ্যা।
রমিজ মিরধা: কাইল রাইত পোয়াইলে আহন লাগব। কাইল যদি ওগ তাড়াইতে না পারো তয় ধানের আশা মাডি দিয়া থোও।
ফজল : দেহি, বাজান কি করতে কয়।
নতুন পানসি এরফান মাতব্বরের বাড়ির দিকে রওনা হয়। তার পেছনে সারি বেঁধে চলে ছোট-বড় বাইশখানা ডিঙি।