আমি রূপার প্রশ্নের জবাব দিইনি। গভীর মনােযােগে খবরের কাগজ পড়ছি, এমন একটা ভঙ্গি করার চেষ্টা করছি।
‘কথা বলছ না কেন, আমাকে সেগুনবাগিচায় নামিয়ে দিতে পারবে? ‘পারব।
‘তাহলে চট করে প্যান্ট পরে নাও। লুঙ্গি পরে নিশ্চয়ই যাবে না। শেভ করাে। দুদিন ধরে শেভ করছ না।
আমি বাথরুমে ঢুকে গেলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে আঁৎকে উঠলাম। দু’দিন শেভ না করায় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। থুতনির কাছে চার পাঁচটা দাড়ি আবার শাদা। শাদা দাড়িগুলাের কল্যাণে চেহারায় প্রবীণ ভাব চলে এসেছে। শেভ করা মানে প্রবীণ ভাব বিসর্জন দেয়া, এটা কি ঠিক হবে? চেহারায় বুড়ােটে ভাব আমার ভালই লাগে। বুড়াে লােকগুলাে যখন চুলে কলপ দিয়ে, রঙচঙা শার্ট পরে তরুণ সাজতে চায় তখন অসহ্য লাগে। ইচ্ছা করে হাসতে হাসতে বলি, পঞ্চাশ ক্রশ করেছেন না? মৃত্যুর কিন্তু দেরি নেই, খুব বেশি হলে আর মাত্র দশ বছর। রঙচঙা জামা পরছেন, ভালো করছেন। শখ মিটিয়ে নেয়াই ভাল।
বাথরুম থেকে বের হয়ে পায়জামা–পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে একতলায় এসে শুনলাম, রূপা রিকশা নিয়ে চলে গেছে। সে যে একা যাচ্ছে, আমাকে সঙ্গে নেবার দরকার নেই, তা–ও বলে যায়নি। আমি দিব্যি সেজেগুজে নেমে এসেছি।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ
এরকম অবস্থায় নিজেকে খানিকটা বােকা বােকা লাগে। আমাকেও নিশ্চয়ই লাগছে। আমি বােকা ভাবটা চেহারা থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য সিগারেট ধরালাম। সিগারেট নিয়ে মুখের ভাবভঙ্গি অনেকখানি বদলে ফেলা যায়। মেয়েরা এই খবরটা
জানে না। জানলে পুরুষের তিনগুণ সিগারেট খেত।
সিগারেটে সবে তিনটা টান দিয়েছি, মুনিয়া এসে বলল, তােকে বাবা ডাকছেন।
এক্ষুণি যেতে বললেন। এক্ষুণি। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সিগারেট ফেলে দিলাম। এগিয়ে যাচ্ছি বাবার ঘরের দিকে, মুনিয়া তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তাের তাে খুবই বিশ্রী স্বভাব, জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরাে ফেলে চলে যাচ্ছিস! নিভিয়ে যাবি না? ঐদিন লাবণ্য পা পুড়ে ফেলেছে।
‘খালি পায় হাঁটাহাঁটি করে কেন ? ওকে না করতে পারিস না খালি পায়ে যেন হাঁটাহাঁটি না করে।
এই বলে আমি বাবার ঘরে ঢুকে গেলাম।
বাবা অবেলায় বিছানায় শুয়ে আছেন। বুকে ব্যথা সম্ভবত শুরু হয়েছে। চোখ মুখ দেখে কিছু অবশ্যি বােঝা যাচ্ছে না। শারীরিক যন্ত্রণা সহ্যের ক্ষমতা তাঁর অসাধারণ।
‘বাবা ডেকেছ ?” ‘হু, বৌমা কোথায় গেল?
ঠিক প্রত্যাশিত প্রশ্ন নয়। রূপা কোথায় গেছে তা নিয়ে বাবাকে উদ্বিগ্ন হওয়া মানায় না। মুনিয়া যদি বলত, ভাবী কোথায়? সেটা মানিয়ে যেত কিংবা মা যদি বলতেন, অসময়ে বৌমা কোথায় গেল তাও মানাত—কিন্তু বাবা জিজ্ঞেস করবেন
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ
আমি বললাম, সেগুনবাগিচার দিকে গেছে। ‘ঐখানে কি ? ‘জানি না।‘ ‘জিজ্ঞেস করিসনি ?” ‘না।” “আচ্ছা ঠিক আছে, যা।”
বাবার ঘর থেকে বের হয়ে এসে মনে হল সামান্য ভুল করা হয়েছে। আমার বলা উচিত ছিল, কি জন্যে জানতে চাচ্ছ? রূপাকে নিয়ে তুমি কি চিন্তিত ? রূপা এমন কিছু কি করেছে যার জন্যে চিন্তিত বােধ করছ?
সমস্যা হচ্ছে বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এমন যে প্রয়ােজনীয় কথা ছাড়া কোনো কথাই হয় না। সেই কথাবার্তাও সাধারণত খুব সংক্ষিপ্ত ধরনের। রূপা অবশ্যি হড়বড় করে তার সঙ্গে অনেক কথাবার্তা বলে। জেদী গলায় তর্ক করে। রূপার তর্ক করার ভঙ্গিটি খুব মজার, কিন্তু শুরুটা সে করে ভয়ঙ্করভাবে। তার ভঙ্গি দেখে মনে হয় প্রতিপক্ষকে সে ছিড়ে খুঁড়ে ফেলবে। প্রতিপক্ষ যখন পুরােপুরি ঘায়েল, তখন সে হঠাৎ গা এলিয়ে বলবে – অবশ্যি আপনার কথা ঠিক। প্রতিপক্ষ
তখন হতচকিত। পুরােপুরি আনন্দিতও হতে পারছে না, কারণ সে জানে তর্কে জিততে পারেনি, আবার দুঃখিতও হতে পারছে না।
আমি চায়ের খোঁজে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছি, বারান্দায় মা‘র সঙ্গে দেখা। মা বললেন, বৌমা কোথায় গেছে রে? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? তুমি তােমার বৌমাকে জিজ্ঞেস করলে না কেন?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ
‘সে তাে বলল সেগুনবাগিচায় গেছে।
‘তাহলে সেখানেই গেছে। আচ্ছা মা, ব্যাপারটা কি শুনি তাে?”
মা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, বউমা নাকি সিনেমা করছে। নায়িকার বােনের কি একটা চরিত্র।
‘বলল কে তােমাকে?” ‘পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ছবি ছাপা হয়েছে। তুই জানিস না কিছু?
‘জানি। তােমরা যা ভাবছ তা না। বিয়ের আগে ওরা কিছু বন্ধুবান্ধব মিলে শর্ট ফিল্ম বানানাে শুরু করেছিল। কাজ বন্ধ ছিল, এখন আবার শুরু হবার কথা।
‘বিয়ের পর আবার সিনেমা কি? বিয়ের আগে যা করেছে, করেছে। ‘বিয়ে করে তাে পাপ করেনি যে সব ছেড়ে দিতে হবে?”
‘পাপ–পুণ্যের কোনাে ব্যাপার না। তুই তাের বৌকে দিয়ে অভিনয় করাতে চাস, করাবি। এটা তাের ব্যাপার। পত্রিকায় যেসব লেখা ছাপা হয় – পড়তে ভালাে লাগে না। আত্মীয়স্বজনরা পড়ে। তারা মজা পায়। হাসাহাসি করে।
“কি লেখা হয়েছে ?
মা গম্ভীর গলায় বলল, মুনিয়ার কাছে কাগজটা আছে, পড়ে দেখ।
আমি মুনিয়ার কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে এলাম। নিজের ঘরে ঢুকে পাতা খুলে রীতিমত চমৎকৃত—পুরাে পাতা ভর্তি রূপার ছবি। লেখার শিরােনাম হচ্ছে তিনি নগ্ন হতে রাজি।
বেশ দীর্ঘ প্রতিবেদন, পুরাে তিন কলাম ছাপা হয়েছে। নিজস্ব প্রতিবেদক জানাচ্ছেন শর্ট ফিল্ম ‘সজনে ফুল’–এর নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ
ছবির তরুণ পরিচালক মুহাম্মদ জোবায়েদ এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন যে সামান্য কিছু প্যাচওয়ার্ক ছাড়া ছবির সব কাজ শেষ হয়েছে। জুন মাস নাগাদ ছবিটি সেন্সর বাের্ডের নিকট পাঠানাে হবে। ছবিতে একটি খােলামেলা দৃশ্য আছে যে কারণে সেন্সর বাের্ড ছবিটির ব্যাপারে আপত্তি তুলতে পারে বলেও তিনি আশঙ্কা করছেন। তিনি বলেন, জাতীয় সেন্সর বাের্ডে কিছু তথাকথিত নীতিবাগীশ লােক আছেন যারা পান থেকে চুন খসলেই “গেল, গেল” বলে হৈচৈ শুরু করেন। সহজ বাস্তবতাকে
স্বীকার করে নেবার মানসিকতা তাদের নেই। আমাদের ছবিতে কিছু খােলামেলা দৃশ্য আছে, যা গল্পের প্রয়ােজনে এসেছে এবং খুব শিল্পসম্মতভাবেই এসেছে। কোনো মুক্তবুদ্ধির মানুষই এই দৃশ্য নিয়ে আপত্তি তুলবেন না। মুহাম্মদ জোবায়েদ ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বর্তমান সেন্সর বাের্ডের সদস্যদের মধ্যে মুক্তবুদ্ধির ব্যাপারটা একেবারেই নেই। তাদের সবার দৃষ্টি একচক্ষু হরিণের মতাে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ
‘সজনে ফুল’ ছবির খােলামেলা দৃশ্য নিয়ে অভিনেত্রী রূপা চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে ছবিতে অভিনয় প্রসঙ্গে তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হলে রূপা চৌধুরী বলেন, নগ্ন হওয়াটাকে তিনি কিছু মনে করেন না। তিনি বলেন, “ঈশ্বর আমাদের এই পৃথিবীতে নগ্ন করেই পাঠিয়েছিলেন, এই সত্যটি মনে রাখলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এই প্রতিবেদক ঠাট্টাচ্ছলে রূপা চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি নগ্ন হয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে পারবেন? রূপা চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, আমি পারব তবে সেই দৃশ্য আপনারা সহ্য করতে পারবেন না।
পত্রিকায় রূপার যে ছবিটি ছাপা হয়েছে সেটি ভুদ্র ছবি। তবে প্রতিবেদন পড়বার পর ছবিটির দিকে তাকালেই পাঠকদের চোখে একটি নগ্ন মেয়ের ছবিই ভেসে উঠবে।