প্রায়ই ব্রেইন শর্ট সার্কিট হয়ে যায়।
রূপা গল্পগুচ্ছ নিয়ে এল। হৈমন্তী গল্প বার করা হল। আমি রূপার মুখের দিকে তাকিয়ে গড়গড় করে বলে যেতে লাগলাম – “কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না।
তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিবাহের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনাে রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে। কিন্তু পণের টাকার অপেক্ষিক গুরুত্ব এখনাে কিঞ্চিৎ উপরে। আছে, সেই জন্যেই তাড়া। ...”
রূপা বলল, থামুন। আপনি ভুল করেছেন ‘এখনাে তাহার এই দু’টা শব্দ বাদ পড়েছে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনাে তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেই জন্যেই তাড়া।
আমি চুপ করে গেলাম। রূপা বলল, থামলেন কেন? আমি বললাম, আজ আর ইচ্ছা করছে না। আরেকদিন।
রূপাদের বাড়ি থেকে বের হয়েই সফিক বলল, কি, আমার কথা ঠিক হয়েছে? দেখেছিস এমন রূপবতী মেয়ে ?
আমি বললাম, না, দেখিনি। ‘মেয়েটার চোখ নীল, তা লক্ষ করেছিস?”
‘চোখ নীল কেন বল তাে? ‘আমি কি করে বলব?”
‘রূপার মা হচ্ছেন লেবানীজ মেয়ে। মেয়ে তার মা‘র রূপ পেয়েছে। চোখ এই কারণেই নীল ড্রয়িং রুমে যে সব ছবি দেখেছিস, সবই ওর মার আঁকা।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
রূপার সঙ্গে পরিচয়ের এই হচ্ছে শুরু। রূপার চাচার সঙ্গে কথা হয়েছে। ভদ্রলােক রােবট জাতীয়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, কিছুক্ষণ পর খুব দ্রুত
খানিকক্ষণ চোখ পিটপিট করেন, তারপর আবার তাকিয়ে থাকেন। কথাবার্তা বলেন , বললেও এক অক্ষরে সীমাবদ্ধ থাকে। রূপা যখন বলল, চাচা, ইনার নাম রঞ্জু।
রােবট চাচা বললেন, হু।। “উনি হলেন সফিক সাহেবের বন্ধু। সফিক সাহেবকে তাে তুমি চেন, চেন না??
“ঠিক আছে চাচা, তুমি এখন যাও। এরা দু‘জন এসেছে ভি সি আরে একটা ছবি দেখতে — এ্যামেডিউস।
আমি বললাম, এই যে আমরা প্রায়ই আসি আপনার চাচা বিরক্ত হন না?
‘অবশ্যই হন। তবে বিরক্ত হলেও কিছু বলেন না, কারণ আমাকে তার বাড়িতে রাখার জন্য তিনি মাসে দশ হাজার করে ঢাকা পান এবং বাবা তাকে বলে দিয়েছেন — আমাকে যেন আমার মত চলতে দেয়া হয়। চাচার ভয়ঙ্কর মানসিক কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তিনি আমাকে আমার মত চলতে দিচ্ছেন। মােট কবার গিয়েছি রূপাদের বাড়িতে? অনেকবার। তবে কখনো একা যাইনি। সব সময় সফিক সঙ্গে ছিল। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রতিবারই রূপা বলেছে – দেখি আপনার স্মৃতিশক্তি কেমন, হৈমন্তী গল্পটা আবার বলুন তাে। আমি মিলিয়ে দেখি। একটা না একটা ভুল আপনি প্রতিবারই করেছেন। যেদিন কোনাে ভুল করবেন না সেদিন আপনার জন্যে পুরস্কার আছে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
‘কি পুরস্কার?” | ‘তা বলব না। তবে খুব ভাল পুরস্কার। যা আপনি কখনাে কল্পনাও করেন নি।
লাম একা । অমিকে একা দেখে রূপা অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিল।
‘কি ব্যাপার, একা যে! বন্ধু কোথায় ?
আমি বললাম, ব্যক্তিগত প্রয়ােজনে এসেছি, কাজেই একা। | রূপা আগের চেয়েও বিস্মিত হয়ে বলল, কি প্রয়ােজন?
‘হৈমন্তী গল্পটা ভুল ছাড়া আপনাকে শােনাব । “ও আচ্ছা। ‘গল্পগুচ্ছ নিয়ে আসুন।
‘গল্পগুচ্ছ আনতে হবে না। আজ যে আপনি ভুল করবেন না তা আপনার চোখ–মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। আপনাকে একটা চমৎকার পুরস্কার দেব বলেছিলাম। তা দিতে আমি প্রস্তুত আছি। পুরস্কারটা কি আপনি কি আন্দাজ
করতে পারেন?
‘না, আমি আন্দাজ করার চেষ্টাও করিনি। কারণ আপনি বলেছিলেন পুরস্কারটা কি তা আমি কল্পনাও করতে পারব না।
রূপা বলল, কিছু কল্পনাতাে তারপরেও করেছেন। করেননি?
সত্যি বলছেন? ‘হ্যা, সত্যি বলছি।
‘বসুন চা খাই আগে, তারপর কথা হবে। আমি যে একটা সিনেমা করছি তা কি আপনি জানেন?
জানি – সফিক বলেছে। সজনে ফুল। “আজ সেই ছবির কিছু কাজ হবে বুড়িগঙ্গা নদীতে। বিকেল তিনটা থেকে শিফট। আপনি কি যাবেন?”
না কেন ? ‘অনেক লােকজন সেখানে থাকবে। এত লােকজন আমার ভাল লাগে না।
“কি জন্যে লােকজনদের ভিড় আপনার ভাল লাগে না? লােকগুলিকে আপনার কি বােকা মনে হয়, না বেশি বুদ্ধিমান মনে হয়?
“বােকা মনে হয়।
রূপা হেসে ফেলল। নিজেই চা নিয়ে এল। টী পট থেকে চা ঢালতে ঢালতে বলল, আপনাকে যেমন বলেছি – “এমন সুন্দর একটা উপহার দেব যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।” সে রকম কথা আমি অন্য পুরুষ মানুষদেরও বলেছি। এটা বললে পুরুষদের মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তন দেখতে আমার ভাল লাগে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
‘কাউকে কি পুরস্কার দিয়েছেন?
‘না। বাজি এমন বিষয়ে ধরি যা পূরণ করা সম্ভব না। মুতালেব নামে আমার একজন বন্ধু আছে, তাকে একটা অঙ্কের ধাধা দিয়েছি। সে এক বছর ধরে সেই ধাধার জবাব বের করার চেষ্টা করছে – বিশেষ পুরস্কারের আশায়, যে পুরস্কারটা কি তা সে জানে না।
‘বের করতে পারেনি?”
কোনদিন পারবেও না। এই ধাধাটার কোনো উত্তর নেই। তবে আপনি পারবেন। আপনার চোখমুখ দেখেই মনে হচ্ছে আপনি তৈরি হয়ে এসেছেন। তবে আজ হাতে একেবারেই সময় নেই। কোনাে একদিন আপনাকে খবর দেব। বাসায়
কি আপনার টেলিফোন আছে? থাকলে নাম্বারটা রেখে যান।
তারপর একদিন অদ্ভুত এক ব্যাপার হল। দুপুরে ঘুমিয়ে আছি – মুনিয়া এসে ডেকে তুলল, টেলিফোন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ঘুমুচ্ছি বলতে পারলি না?
দিনে তো তুই কখনাে ঘুমাস না। কাজেই ভাবলাম বােধহয় মটকা মেরে পড়ে আছিস।
কে টেলিফোন করেছে?
নাম জিজ্ঞেস করিনি, তবে গলার স্বর অসম্ভব মিষ্টি। আমি এরকম মিষ্টি গলার স্বর এর আগে শুনিনি।
আমি টেলিফোন ধরতেই ওপাশ থেকে রূপা বলল, আপনার কি ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি আছে? শাদা পাঞ্জাবি ?
“কেন?” ‘আছে কিনা বলুন।
আছে। ‘পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে চলে আসতে পারবেন? ‘পারব, কিন্তু ব্যাপারটা কি?
আপনাকে বিয়ে করতে হবে।‘ ‘বিয়ে করতে হবে মানে?
‘অসহায় একজন তরুণীকে উদ্ধার করতে হবে।
কিছু গুণ্ডাপাণ্ডা ধবনের ছেলে জোর করে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টায় আছে। তাদের একজন মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায়।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কি বলছেন আপনি, এই যুগে এটা কি সম্ভব? ‘এই যুগেই সম্ভব। অন্য যু। হলে সম্ভব ছিল না। ‘পুলিশে খবর দিতে বলুন।