রূপার গলার স্বর বদলে যাচ্ছে। চোখের তারায় অন্য এক ধরনের আলাে। সে আজ বিশেষ কিছু বলবে। সেই বিশেষ কথাগুলি শােনার জন্যে আমি অপেক্ষা। করছি। রূপী চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ঠোট মুছল, তারপর আগের চেয়েও নিচু গলায় বলল, প্রতিবাদ আমি নিজেও করতে পারতাম। ভণ্ডামী, ভান এইসব আমার ভাল লাগে না।
যেখানে এইসব দেখেছি কঠিন গলায় প্রতিবাদ করেছি। তােমার মা‘র কথার কোন প্রতিবাদ করতে পারলাম না, কারণ তিনি যা বলেছেন সত্যি বলেছেন। এক বিন্দু মিথ্যা নয়।
পাখি আমার একলা পাখি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ
‘তাতে কিছু যায় আসে না। ‘সবটা শােন তারপর বল, “তাতে কিছু যায় আসে না। আমার মা আর্ট স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। অহংকারী জেদী একটি মেয়ে। অসম্ভব রূপবতী। আমি বলেছি না মা’র কিছু কিছু জিনিস আমি পেয়েছি। রূপ হচ্ছে তার একটা। কিন্তু মা ছিলেন দরিদ্র। তাদের পুরাে পরিবারটাই দরিদ্র। দু‘বেলা খাবার সামর্থও এই পরিবারের ছিল না।
এমন একটা পরিবারে রূপবতী মেয়ে হয়ে জন্মানাের হাজারো সমস্যা। মা আর্ট স্কুলের পড়ার খরচ চালাতে পারেন না। অনাহারের কষ্টও এক সময় অসহ্য বােধ হল। এক সময় দেখা গেল ছুটির দিনে নাইট ক্লাবগুলিতে তিনি নাচতে শুরু করেছেন। বাড়তি কিছু টাকা আসছে।
আমি বললাম, থাক এসব। | রূপা বলল, থাকবে কেন? আমি তাে বলতে লজ্জা পাচ্ছি না। তুমি শুনতে লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমার মা প্রতিটি ঘটনা আমাকে বলেছেন। যখন বলেছেন তখন আমার বয়স খুব অল্প।
পাখি আমার একলা পাখি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ
তিনি বলতে লজ্জা পান নি, আমিও মার কথা শুনে লজ্জা পাইনি। তুমি কেন পাবে? মা বলতেন – শরীর এবং মন আলাদা আলাদা। শরীর অশুচি হলেই মন অশুচি হয় না। এটা হয়ত তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই বলতেন।
| ‘মা ভয়ংকর জীবন বেছে নিয়েছিলেন। আমার বাবা তাঁকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। বিয়ে করেন। দেশে নিয়ে আসেন। মা‘র সমস্ত দুঃখ, সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। কেমন লাগছে তােমার গল্পটা ?” ভাল?” ‘শুধু ভাল ? এটা কি চমৎকার একটা গল্প না ?” ‘হ্যা চমৎকার গল্প।
‘এই চমৎকার গল্পের একটা ভয়ংকর অংশ আছে। সেই অংশটা এখন আমি তােমাকে বলব।
‘বাবা যখন আমার মাকে বিয়ে করেন তখন আমার মা অন্তঃসত্তা। আমার মা ঠিক জানেন না – আমার বাবা কে। এইসব কিছুই আমি তােমাকে বলিনি। এখন। বললাম, কারণ পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। আমার চাচার বাবার সম্পত্তির জন্যে মামলা মােকদ্দমা করবেন। একজন অবৈধ কন্যা বিপুল সম্পত্তি পাবে তা তাে হয় না।
পাখি আমার একলা পাখি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ
বাবার শরীর অসুস্থ। তিনি যে দীর্ঘদিন বাইরে থাকেন চিকিৎসার জন্যে থাকেন। সম্পত্তি নিয়ে কথাবার্তা বলার সময় এসে গেছে। আমি চুপ করে আছি। দেখছি রূপাকে। মানুষ কি করে এত সুন্দর হয়!
রূপা বলল, আমি এখন যে কথাগুলি বললাম তা কি তুমি তােমার বাবা, মা, ভাইবােন – এদের বলতে পারবে?
‘আমার ধারণা হয়েছিল পারবে। আমি এমন একজনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম যে সবকিছু তুচ্ছ করে আমাকে গ্রহণ করতে পারবে। আমার চারপাশে অনেকেই ছিল। তিনজনের একটা তালিকা তৈরি করেছিলাম। তুমি ছিলে দু’ নম্বরে।
এক নম্বরে কে ছিল?” ‘সফিক ছিল এক নম্বরে।
পাখি আমার একলা পাখি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ
রূপা হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি ঘুমুব। আমাকে একটু জায়গা দাও তাে। সে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত জেগে তার পাশে বসে রইলাম। সে গভীর ঘুমে অচেতন। ঘুমের মধ্যেই
হাসছে, স্বপ্ন দেখছে হয়ত।
সন্ধ্যা মিলাবার পর বেরুলাম। মুনিয়ার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে হবে। সেখান থেকে একবার যাব সফিকের কাছে। তারপর? তারপর কি আমি জানি না। একটা সাইকেল থাকলে ভাল হত। সাইকেলে করে সারা শহর চক্কর দেয়া যেত।