চতুর্থ খণ্ড
০১. চতুরে চতুরে
কলিকাতার উত্তরাংশে কোনও দ্বিতল গৃহের একটি প্রকোষ্ঠে বসিয়া খগেন্দ্রনাথ ওরফে সোণার হরিণ, অতি নিবিষ্টচিত্তে একখানি পত্র পাঠ করিতেছিল। তাহার সম্মুখে টেবিলের উপর ডাকের আর একখানি খোলা খাম পড়িয়া আছে। প্রথম পত্রখানি পড়িয়া, দ্বিতীয়খানি খগেন্দ্র তুলিয়া লইল। এখানি, প্রথমখানির মত বহুপৃষ্ঠাব্যাপী নহে–ক্ষুদ্র, নিম্নলিখিত কয়েক ছত্রে শেষ হইয়াছিল–
বাশুলিপাড়া
৫ই জ্যৈষ্ঠ
প্রিয় খগেনবাবু,
আপনার পত্র পাইলাম। আমি যেরূপ সন্দেহ করিয়াছিলাম, আপনিও সেরূপ করিয়াছেন দেখিয়া সুখী হইলাম। আমাকে যে সকল সংবাদ আপনি জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, তাহা এ পর্যন্ত কিছুই আমি সংগ্রহ করিতে পারি নাই। কল্য দেওয়ানজি কলিকাতা যাত্রা করিবেন, সেখানে ৫/৭ দিন থাকিবেন। তাঁহার ঠিকানা ৬৫নং মানিকতলা ষ্ট্রীট। যদি পারেন, তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আপনার যাহা জ্ঞাতব্য জানিয়া লইবেন। আপনি লিখিয়াছেন আরও কিছুদিন আমার এখানে থাকা আবশ্যক। কিন্তু আজকাল বউরাণী আমার প্রতি তেমন আর প্রসন্ন নহেন। তাঁহারসহচর জুটিয়াছে, সহচরী এখন নিপ্রয়োজন। আপনি দেওয়ানজিকে বলিয়া দেখিবেন। আজ তবে আসি।
আপনার অনুগত
কনক
পত্রখানি পাঠ করিয়া খগেন্দ্র দেওয়ালের ঘড়ির পানে চাহিল–দেখিল বেলা তিনটা বাজিয়াছে। ভাবিল–যাই, এখন গেলে নিশ্চয়ই দেখা পাইব। বিলম্বে হয়ত তিনি বাহির হইয়া যাইবেন।
খগেন্দ্র তখন উঠিয়া, আলমারি খুলিয়া কয়েকটা জামা বাহির করিয়া পরীক্ষা করিতে লাগিল। দেখিল, একটার বুকের কাছটায় একটু ছেঁড়া আছে। কয়েকখানি ধুতি বাহির করিল–যেখানি সৰ্ব্বাপেক্ষা পুরাতন দিস্তাপড়া, সেইখানি রাখিয়া আলমারি বন্ধ করিয়া দিল।
সেই ধুতিখানি পরিয়া, ছেঁড়া জামাটি গায়ে দিয়া, একখানি আধময়লা রেশমী চাদর কাঁধের উপর ফেলিয়া খগেন্দ্র সিঁড়ি দিয়া নামিল। বাহির হইবার পূর্বে হস্তের ছাতাটির প্রতি চাহিয়া দেখে, সেটি উত্তম কাপড়ের ছাউনিযুক্ত–বাটে রূপা লাগানো আছে। ভৃত্য ক্ষুদিরামকে সেইখানে দেখিয়া বলিল–তোর ছাতা আছে?
আজ্ঞে হুজুর।
নিয়ে আয়।
ক্ষুদিরাম ছুটিয়া গিয়া নিজের ছাতাটি আনিয়া দিল। খগেন দেখিল সেটি পুরাতন এবং অল্পমূল্যের বটে–পছন্দ হইল। নিজের ছাতাটি ক্ষুদিরামের হাতে দিয়া বলিল–উপরে রেখে আয়, তোরটা আমি নিয়ে চলোম।
ক্ষুদিরাম প্রভুর মুখপানে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। সহসা দেখিল, বাবুর গায়ের জামাটিও ছেঁড়া। তাই সে আরও বিস্মিত হইল। ব্যাপারটা কি, অনুমান করিবার চেষ্টা করিতেছে, এমন সময় খগেন বলিল–যা না–হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? –বলিয়া খগেন বাহির হইয়া গেল।
ক্ষুদিরাম উপরে গিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া ভাবিল। সে এতদিন এখানে চাকরি করিতেছে–এরূপ বেশে ত বাবুকে কখনও বাহির যাইতে দেখে নাই! ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ তাহার মনে পড়িল তাহাদের গ্রামের শিবদাস মোকও একবার এইরূপ করিয়াছিল। শিবদাসের দোকানের বিলক্ষণ চতি–তাহার কাঁচাগোল্লার বড়ই সুখ্যাতি–আশেপাশের পাঁচখানা গ্রামের লোক তাহার দোকানের বাধা খরিদ্দার। টাকার মত সালসা আর নাই–সেই সান্সার প্রভাবে শিবদাসের চেহারাখানিও দিব্য মোটাসোটা গোলগাল তৈলচিক্কণ। এমন সময় হঠাৎ একদিন তাহার উপর ইনকাম। ট্যাক্সের এক নোটিস আসিয়া উপস্থিত। শিবদাস বড় চতুর লোক। বিলক্ষণ বুঝিল, এ। চেহারা দেখিলে হাকিম শুনিবে না, তাই সে গোটা দুইদিন অস্নাত ও অভুক্ত অবস্থায়। কাটাইয়া, ছিন্ন মলিন বস্ত্র পরিয়া সদরে যাত্রা করে। ইনকাম ট্যাক্স হাকিমের সম্মুখে। দাঁড়াইয়া এরূপ কাতর ক্রন্দন করিতে থাকে যে, তিনি তাহার ট্যাক্স একেবারে মাফ করিয়া দেন। এই ঘটনা স্মরণ হওয়াতে ক্ষুদিরাম অকূলে কূল পাইল। বিজ্ঞভাবে ঘাড়টি নাড়িয়া বলিল–বুঝেছি। বাবু ইনকাম টেকসো হাকিমের কাছে দরবার করতে যাচ্ছেন।
এদিকে খগেন্দ্র বড় রাস্তায় পৌঁছিয়া দেখিল, ধর্মতলার দিকে একখানি ট্রামগাড়ী যাইতেছে। পকেটে পয়সা ছিল, তথাপি ট্রামে উঠিল না। সেই রৌদ্রে, ছাতাটি মাথায় দিয়া পদব্রজে চলিল।
যথাসময়ে খগেন্দ্র ৬৫নং মাণিকতলায় পৌঁছিল। একজন উড়িয়া খানসামাকে দেখিতে পাইয়া বলিল, ওহে, এ বাড়ী কার?
খানসামা বলিল, সুবোধবাবুর।
দেখ, রঘুনাথ মজুমদার মহাশয় এখানে থাকেন কি?
রঘুনাথ মজুমদার? কে তিনি?
বাশুলিপাড়ায় থাকেন।
তখন খানসামা বলিল, ওঃ–বাশুলিপাড়ার দাওয়ানজি?
হ্যাঁ—হ্যাঁ
এসেছেন বটে।
তাকে একবার খবর দিতে পার?
কেন?
কায আছে।
আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
এই কলকাতা থেকেই।
কি বলব?
বোলো যে খগেনবাবু এসেছেন, আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান।
যদি জিজ্ঞাসা করেন খগেনবাবু কে?
বোলো খগেনবাবু উকিল।
এই উকিল কথাটি শুনিয়া খানসামার মনে একটু সম্ভ্রম উপস্থিত হইল। বলিল–আপনি উকিল!
খগেন ঈসৎ হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ–কিন্তু আমি না হয়ে তুমি উকিল হলেই ভাল হত। যে রকম জেরাটা করছ!
খানসামা এ রসিকতাটুকু বুঝিতে পারিল না। বলিল–আচ্ছা, আপনি বৈঠকখানায় বসুন–আমি দাওয়ানজিকে খবর দিচ্ছি।
খগেন বৈঠকখানায় প্রবেশ করিয়া টেবিলের নিকট একটি চেয়ারে বসিল। ভিত্তিগুলি সুন্দর সুন্দর চিত্রে সজ্জিত–মধ্যস্থলে একখানি বৃহৎ তৈলচিত্র আছে। মেঝেটি শতরঞ্জ মোড়া। টেবিলের অন্যদিকে জাজিমে মোড়া একখানি তক্তপোষ রহিয়াছে, স্থানে স্থানে কয়েকটি তাকিয়া বালিস। টেবিলের উপর কয়েকখানি বাঙ্গালা মাসিকপত্র পড়িয়া ছিল–তাহারই একখানি তুলিয়া খগেন্দ্র পাঠ করিতে লাগিল।
কয়েক মিনিট পরে খানসামা ফিরিয়া আসিয়া বলিল, বাবু, দাওয়ানজি ঘুমুচ্ছেন।
কখন উঠবেন?
আর বেশী দেরী নেই। আপনি বসবেন কি?
হ্যা আমি রইলাম। তিনি জাগলেই তাঁকে বোলো।
তামাক দেব?
না। বড় গ্রীষ্ম, পাখাটা খুলে দাও।
বৈদ্যুতিক পাখার চাবি খুলিয়া দিয়া খানসামা প্রস্থান করিল।
খগেন্দ্র তখন মাসিকপত্রখানি ফেলিয়া, টেবিলে হেলান দিয়া, হাতের উপর মাথা রাখিয়া চিন্তামগ্ন হইল। ভাবিতে লাগিল যা মনে করেছিলাম তা ত হল না। বউরাণীকে বিধবা বিয়ে করাটা ত ফস্কেই গেল। কোথাকার কে তার ঠিক নেই–উড়ে এসে জুড়ে বসল! কনক ত লিখেছে, তার দৃঢ় বিশ্বাস সে লোকটা ভবেন্দ্র নয়। আর, ঐ সুরবালাটাই বা কে? –গঙ্গায় ভেসে এসে উপস্থিত! অথচ দুইজনে ষড়যন্ত্র করে আসেনি, তাও কনকের বিশ্বাস। আমার বোধ হয় ওটি কনকের ভুল। নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র করে এসেছে। বিধবা বিয়ে ত অদৃষ্টে নেই দেখছি–তবু, ঐ ভবেন্দ্রটা যে কে, যদি ধরতে পারি–তা হলেও কিঞ্চিৎ অর্থাগম হয়। আপাততঃ লাখখানেক টাকার আমার ত বিশেষ দরকার। এ রহস্যটি যদি ভেদ করতে পারি, তবে ভবেন্দ্রকে গিয়ে বলি–বাপু হে–আমি সবই জেনেছি–সাক্ষী–সাবুদও সব মজুত। এখন বার কর দিকিন একটি লাখ টাকা। এখন নগদ এক লক্ষ সেলামী–আর মাসিক হাজার টাকা পেন্সন হলেই আমার হবে। স্বীকার হও, উত্তম–না হও, বল থানায় যাই। তা মাসে হাজার টাকা হলে আমার একরকম করে চলে যাবে। বউরাণীকে বিয়ে করতে পারতাম–ষোল আনার মালিক হতাম। তা যখন হল না–এই হলেই বাঁচি। ঘরপোড়া বাঁশ যা লাভ!
চিন্তাস্রোতে এইরূপ গা ভাসাইয়া খগেন্দ্র কত কি অভিসন্ধি করিতে লাগিল। ক্রমে ঘড়িতে ঠং ঠং করিয়া চারিটা বাজিল। বাহিরে বরফওয়ালা তাহার সাধা গলায় হাঁকিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে পূৰ্ব্বকথিত খানসামা আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইয়া বলিল, দাওয়ানজি উঠেছেন। খবর দিয়েছি।
প্রায় দশ মিনিট পরে, দেওয়ানজি তাহার বিপুল দেহখানি লইয়া চটিজুতা পায়ে খালি গায়ে হেলিতে দুলিতে আসিয়া প্রবেশ করিলেন।
খগেন্দ্র চেয়ার ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমাকে চিনতে পারেন?
দেওয়ানজি বলিলেন, খগেন্দ্রবাবু? প্রণাম। বোসো বোসো। তারপর খবর ভাল ত?
খগেন্দ্র বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার কি আজই আসা হয়েছে?
হ্যাঁ, আজ বেলা ৯টার সময় এসে পৌঁছেছি। তা, তুমি আমার সন্ধান পেলে কি করে? কনকলতা লিখেছিলেন বুঝি!
আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার শরীর বেশ ভাল আছে?
আর বাবা, ষাট বৎসর বয়স হল, এখন শরীর ভাল আর মন্দ! তোমার খবর কি বল। পশ্চিমে কোথাও যাবার ঠিক করলে?
কই আর করলাম?
দেরী করছ কেন?
খগেন্দ্ৰ মুখখানি বিমর্ষ করিয়া বলিল, অর্থাভাব। পশ্চিমে গিয়ে ওকালতী ব্যবসা ফেঁদে বসতে হলে কিছু টাকা চাই ত। আইনের বই–ই অন্ততঃ দুতিনশো টাকার লাগবে। তা ছাড়া, কাপড়–চোপড়, টেবিল চেয়ার আলমারি–এ সবই ত চাই। তার পর কোথাও গিয়ে বসবামাত্রই কিছু মক্কেলের ভীড় লেগে যাবে না। অন্ততঃ পাঁচ ছমাসের বাসাখরচটা ত হাতে করে নিয়ে যেতে হবে।
দেওয়ানজি মনে মনে বলিলেন, তোমার যে রকম আইনজ্ঞান, পাঁচ ছমাসের কেন, পাঁচ ছবচরের বাসাখরচটা হাতে করে নিয়ে যেতে পারলেই ভাল হয়! প্রকাশ্যে বলিলেন–একটি মাষ্টারি করতে না?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ৪০ টাকা মাইনের একটি মাষ্টারি করতাম এখন বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। মেসের বাসায় থাকি, কায়ক্লেশে যতদূর কম খরচে পারি, চালাচ্ছি। টাকাটা হাতে হলেই বেরিয়ে পড়ব।
কোথা যাবে কিছু স্থির করেছ?
আজ্ঞে হ্যাঁ, সেটা একরকম স্থিরই আছে। গয়া যাব।
গয়া? ওহে কেষ্টদাস, কোথা গেলে, এক ছিলিম তামাক সাজ ত বাপু।
গয়া? বেশ জায়গা–তীর্থস্থান। ওদিকে মামলা মোকদ্দমা খুব হয়?
খগেন্দ্র একটু হাসিয়া বলিল, তা মন্দ নয়। তবে সেখানে একটা ভারি সুবিধে আছে।
দেওয়ানজি বলিলেন, তামাক সেখানকার উৎকৃষ্ট।
খগেন্দ্র একটু হাসিয়া বলিল, আজ্ঞে না, তামাকের কথা বলিনি। একটা খুব সুবিধে সেখানে এই যে, প্রাকটিস যদি জমে গেল, তা হলে ত কথাই নেই; আর তা যদি না জমল, কমিশন করেও খেতে পারব। সেখানে খুব বাটোয়ারা মোকদ্দমা হয়–উঁকিলেরা বড় বড় কমিশন পায়। শুনেছি সেখানে জুনিয়ার উঁকিলেরাও নাকি অনেকে কমিশন করে মাসে দুতিনশো টাকা রোজগার করে। এমন সুযোগটি আর কোনও জেলায় নেই।
দেওয়ানজি বলিলেন, তবে সেই ভাল। গয়াতেই যেও।
আজ্ঞে হ্যাঁ। তাই আপনার কাছে এসেছিলাম একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে।
এই সময় কৃষ্ণদাস ভৃত্য, গড়গড়া হাতে করিয়া কলিকায় ফুৎকার দিতে দিতে প্রবেশ করিল।
নল মুখে দিয়া, দুই চারি টান টানিয়া দেওয়ানজি জিজ্ঞাসা করিলেন, হা, কি বলছিলে?
আজ্ঞে জিজ্ঞাসা করছিলাম, এখন বাবু বাড়ী এসেছেন, কনককে আর বউরাণীর দরকার হবে কি?
দেওয়ানজি গড়গড়ায় আরও দুই চারি টান টানিয়া বলিলেন, তা আমি কি করে বলব বাপু, সে বউরাণী জানেন। বউরাণী যে কনকলতার উপর ইদানীং অসন্তুষ্ট তাহা দেওয়ানজি শুনিয়াছিলেন।
মুখখানি স্নান করিয়া খগেন্দ্র বলিল, আপনারা বড়লোক, আমার বোনটি আপনাদের আশ্রয়ে ছিল, আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। কনক যতদিন সেখানে আছে, ততদিন মেসে থেকে কষ্টে সৃষ্টে কিছু টাকা জমাতে পারি। সে যদি সেখান থেকে চলে আসে, আমায় মেস ছেড়ে দিয়ে বাড়ী ভাড়া করতে হবে; পঞ্চাশটি টাকায় সংসার খরচই কুলোবে না, বরং যা দুপয়সা জমিয়েছিলাম তাও যাবে। তা হলে আমার ওকালতী করা, অবস্থার উন্নতি করা এ সবই আকাশকুসুম হয়ে যাবে। মাষ্টারি করে আধপেটা খেয়েই জীবন কাটাতে হবে। –বলিয়া খগেন্দ্র মাথাটি নীচু করিয়া একটি বড় রকমের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
তাহার অবস্থা দেখিয়া দেওয়ানজির মনে দুঃখ হইল। কিয়ৎক্ষণ নীরবে বসিয়া ধুমপান করিতে লাগিলেন। অবশেষে বলিলেন–আচ্ছা তুমি সে জন্যে ভেব না। আমি গিয়ে বউরাণীকে জিজ্ঞাসা করব এখন। যদিও বা তিনি বলেন যে কনকলতাকে আর আবশ্যক নেই, আমি তাকে অনুরোধ করব, যাতে তোমার ভাগিনী এখন দু এক বছর থাকতে পারেন সে বন্দোবস্ত করে দেব। তার পর তুমি গয়ায় গিয়ে প্র্যাকটিস জমিয়ে, তোমার বোনকে নিয়ে যেও।
খগেনের মুখখানি আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। মনে মনে ভাবিল একটা কায হাসিল হইয়াছে, এখন তথাকথিত ভবেন্দ্র সম্বন্ধে দুই চারিটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া দেখা যাইক। তাই, দুই চারিটি অন্যকথার পর জিজ্ঞাসা করিল–বাবু বরাবরই কি কাশীতে ছিলেন? কাশী হইতেই যে প্রথম সংবাদ আসে, ইহা খগেন্দ্র কনকলতার পত্রে জানিয়াছিল।
দেওয়ানজি বলিলেন, না কাশীতে বেশী দিন ছিলেন না। বাড়ী আসবার আগে দিনকতক কাশীতে ছিলেন মাত্র।
খগেন্দ্র উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিল, কাশী–আহা কাশী বড় সুন্দর স্থান। বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, মাস ছয় আমরা কাশীতে ছিলাম কিনা। দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছেই আমাদের বাসা ছিল। সন্ধ্যার পর দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে বসলে আর উঠে আসতে ইচ্ছে করত না। তা, বাবু কাশীতে কোন্খানে ছিলেন?
দশাশ্বমেধের কাছাকাছি। এক যাত্রীবাড়ীতে।
যাত্রীবাড়ীতে? দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে আমাদের একজন চেনা লোক আছেন যাত্রীওয়ালা–তার নাম রামদাস। বড় ভাল লোক। বাবু কোন্ বাড়ীওয়ালার বাড়ীতে ছিলেন?
এই প্রশ্নটি শুনিয়া দেওয়ানজির গড়গড়ার ডাক বন্ধ হইয়া গেল। তিনি একটু সন্দিগ্ধ ভাবে খগেন্দ্রের মুখের পানে চাহিলেন। শেষে বলিলেন, –সে কথা ত বাবুকে আমি জিজ্ঞাসা করিনি। কেন? কোনও প্রয়োজন আছে? –তখনও তাহার তীক্ষ্ণদৃষ্টি খগেন্দ্রের উপর স্থাপিত।
খগেন্দ্র বুঝিল। তৎক্ষণাৎ অন্য কথা পাড়িল। প্রায় দশ মিনিট পরে বলিল–তা হলে এখন উঠি। আপনি এখন আছেন ত?
হ্যাঁ, দিন চার পাঁচ আছি। কতকগুলো কাযকৰ্ম্ম আছে সেগুলো সেরে তবে বাড়ী যাব।
আচ্ছা–আবার এসে দেখা করব এখন। আপনি বোধ হয় এ কদিন ব্যস্ত থাকবেন। যদি এসে দেখা না পাই–ফিরে যাই–বলা রইল গরীবের কথা ভুলবেন না। –বলিয়া খগেন উঠিয়া দাঁড়াইল।
উঠলে? –আচ্ছা, এস, প্রণাম।
খগেন্দ্র তখন বিদায় লইল। দেওয়ানজি আর এক ছিলিম তামাকের হুকুম করিলেন।
০২. “বঙ্গসাহিত্যে যুগান্তর”
বাড়ী গিয়া খগেন ভাবিতে লাগিল, এ দেওয়ানজি লোকটি সহজ নয়–ইহাকে ভুলাইয়া কথা বাহির করা একেবারে অসম্ভব। জমিদারীর কাৰ্য্য করিয়া যে ব্যক্তি চুল। পাকাইয়াছে–কত লোককে ঠকাইয়াছে–কত জজ–ম্যাজিষ্ট্রেটের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ। করিয়াছে–তাহার চক্ষে ধূলি দেওয়ার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। সুতরাং অন্য উপায় দেখিতে হইবে।
প্রতিদিন সন্ধ্যার পর খগেন্দ্র বেড়াইতে বাহির হইত, নানারূপ আমোদ–প্রমোদ করিয়া অনেক রাত্রে বাড়ী ফিরিত। আজ আর সে বাহির হইল না। আপনার বসিবার কক্ষে, একখানি ঈজিচেয়ারে পড়িয়া চক্ষু মুদিত করিয়া কেবলই চিন্তা করিতে লাগিল।
তাহার যে মহা বিপদ উপস্থিত। কলিকাতা সহরে এমন ধনী মহাজন অল্পই আছে যাহার কাছে খগেন্দ্র ঋণগ্রস্ত নহে। কেহ কেহ নালিশ করিয়া ডিক্রী পাইয়াছে, কাহারও কাহারও নালিশ এখন বিচারাধীন, অনেকে নালিশ করিবে বলিয়া শাসাইতেছে। যাহারা ডিক্রী পাইয়াছে তাহারা কোনদিন আসবাবপত্র ও বাড়ীখানি ক্রোক করিতে আসে ঠিকানা নাই। দুই একমাসের মধ্যে অন্তত: পঞ্চাশ ষাট হাজার টাকা সংগ্রহ করিতে না পারিলে তাহার উপায় নাই। –খগেন্দ্র মাথায় হাত দিয়া বসিয়া কেবল এই সকল কথাই চিন্তা করিতে লাগিল।
ক্ষুদিরাম চা আনিয়া দেখিল, বাবুর এই অবস্থা! মনে মনে বলিল–সুবিধে হয়নি!–সুবিধে হয়নি!
রাত্রে খগেন্দ্র নাম মাত্র আহারে বসিল। বিছানায় পড়িয়া ঘুমাইল না–কেবল এ পাশ ও পাশ করিতে লাগিল–আর ভাবিতে লাগিল।
রাত্রি যখন বারোটা তখন সে মহা উৎসাহের সহিত উঠিয়া বসিল। আপন মনে বলিতে লাগিলহয়েছে–এইবার নির্ঘাত। বাতি জ্বালিয়া, কাগজ কলম লইয়া লিখিতে বসিল।
বঙ্গসাহিত্যে যুগান্তর
অচিন্তিতপূৰ্ব্ব, অভাবনীয়, স্বপ্নাতীত
নূতন কাণ্ড
ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, ভ্রমণবৃত্তান্ত, জীবনচরিত
ও কিম্বদন্তীর অপূর্ব সমন্বয়!
বঙ্গীয় জমিদার–চরিতমালা
সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা এই বঙ্গভূমিতে, কমলার বরপুত্র ভূম্যধিকারিগণই প্রকৃত ভূষণস্বরূপ। ইহাদের বংশাবলীর ইতিহাস, বঙ্গদেশের ইতিহাসের সর্বপ্রধান অংশ আজ আমরা সেই ইতিহাস উদ্ধার করিবার জন্য বদ্ধপরিকর। এই মহাগ্রন্থে, বঙ্গের বহুসংখ্যক জমিদার বংশের আমূল ইতিহাস প্রকাশিত হইতেছে। সেই সঙ্গে সঙ্গে, উক্ত মৃত মহানুভবগণের প্রতিষ্ঠিত দেবমন্দির, জলাশয়, চতুস্পাঠী প্রভৃতি এবং অন্যান্য পূর্ত কার্য্যেরও সচিত্র বিবরণ প্রদত্ত হইবে। আমাদের প্রতিনিধিগণ বঙ্গের গ্রামে গ্রামে গমন করিয়া এই সকল বিবরণ সংগ্রহ করিয়াছেন এবং এখনও করিতেছেন। প্রধান প্রধান জমিদার বংশের বর্তমান বংশধরগণের সচিত্র জীবনচরিতও পুস্তকে সন্নিবিষ্ট হইতেছে। দেড় সহস্র পৃষ্ঠার অধিক, প্রায় তিনশত হাফটোন ছবি সহ বিপুল ও মহা প্রয়োজনীয় গ্রন্থের মুদ্রাঙ্কণ বহু ব্যয়সাধ্য! আমরা অকাতরে যেরূপ পরিশ্রম ও রাশি রাশি অর্থব্যয় করিতেছি–তাহাতে পুস্তকের মূল্য ১০ টাকা ধার্য্য করিলেও অধিক হইত না। কিন্তু বহি বিক্রয় করিয়া আমরা লাভের প্রত্যাশী নহি, দেশের উপকারই আমাদের উদ্দেশ্য। মুদ্রণাদির ব্যয় স্বরূপ ৪ টাকা মাত্র লইয়া এই মহাগ্রন্থ আমরা জনসমাজে বিতরণ করিব। ভাদ্র সংক্রান্তির মধ্যে পত্র লিখিয়া যাহারা গ্রাহক হইবেন, তাঁহাদের পক্ষেই এই নিয়ম, তাহার পর মূল্য বৃদ্ধি হইবে। ১লা আশ্বিন পুস্তক প্রচারিত হইবে। যাহারা হাতে লইবেন, তাঁহারাই ৪ টাকায় পাইবেন। ডাকমাশুল ও ভি–পি খরচ স্বতন্ত্র।
ক্যালকাটা পাবলিশিং কোং
৪৫, হরিমোহন পালের লেন,
কলিকাতা।
এই মুসাবিদাটি প্রস্তুত করিবার পর খগেন্দ্রের তপ্ত মস্তিষ্ক কতকটা শীতল হইল। তখন সে বাতি নিভাইয়া ঘুমাইল।
পরদিন প্রাতে উঠিয়া, চা পান শেষ করিয়াই খগেন্দ্র বাহির হইয়া পড়িল। মসজিদবাড়ী স্ট্রীটের একটি ছাপাখানায় গিয়া, প্রিন্টারকে ডাকিয়া বলিল, মশায়, আমায় এইটি শীগগির ছেপে দিতে পারেন? –বলিয়া পূর্বোক্ত হ্যাণ্ডবিলখানি, প্রিন্টারের হাতে দিল।
প্রিন্টার সেটি দেখিয়া বলিল, কবে চাই?
আজই দশটার মধ্যে।
প্রিন্টার ঘাড় নাড়িয়া বলিল, দশটার মধ্যে হয়ে উঠবে না। সন্ধ্যার সময় দিতে পারি। কত হাজার ছাপতে হবে?
একশো।
মোটে একশো?
হ্যাঁ।
প্রিন্টার লোকটি কিছুক্ষণ ভাবিল, মাঝে মাঝে খগেন্দ্রের মুখের পানে চাহিতে লাগিল। ক্রমে বলিল–বুঝেছি। এখন একশো ছেপে বিলি করে দেখবেন–যদি তেমন ফল হয়, তবে বেশী ছাপবেন, নয়?
খগেন হাসিয়া বলিল, ঠিক ধরেছেন।
নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় প্রদান করিয়া, প্রিন্টারের মনে একটা আত্মগৌরব উপস্থিত হইল। বলিল–আচ্ছা আর একটা কথা বলব?
কি?
এই যে লিখেছেন পুস্তকের মুদ্রাঙ্কণ আরম্ভ হইয়া গিয়াছে–একটা ব্যবসাদারী মাত্র। ছাপা মোটেই আরম্ভ হয়নি। যদি তেমন অর্ডার আসতে থাকে তবেই ছাপতে আরম্ভ করবেন, নইলে এই পৰ্য্যন্ত।
খগেন্দ্র মনে মনে হাসিল। বলিল–উঃ–আপনার কি বুদ্ধি! ঠিক অবিকলটি ধরেছেন।
প্রিন্টার অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল। বলিল–আজ্ঞে, এই কায করতে করতে চুল পাকালাম। আচ্ছা, এগারোটার সময় আপনি আসবেন। এরি মধ্যে দুটো প্রুফ আমরা দেখে রাখব। আপনি শেষ প্রুফ দেখে দিয়ে বসে থাকবেন আপনার সামনেই ঝড়াঝড় করে বারোটার মধ্যে ছেপে দেব। কাগজের জন্যে একটা টাকা দিয়ে যান।
খগেন্দ্র একটা টাকা দিয়া সেখান হইতে বাহির হইল। চিৎপুর রোডে তাহার পরিচিত একজন ফোটোগ্রাফার ছিল। তাহার নাম ভুবন। খগেন্দ্র সেই ফোটোগ্রাফারের দোকানে গিয়া উপস্থিত হইল।
খগেন্দ্র প্রবেশ করিবামাত্র ভুবন বলিল, আসুন–আসুন–অনেক দিন পরে যে!
খগেন্দ্র একখানা চেয়ার টানিয়া বসিয়া বলিল, বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি। মফস্বলে যেতে পারবে?
কবে?
আজ সন্ধ্যার গাড়ীতে। রীতিমত দক্ষিণা পাবে।
পারব। কি করতে হবে?
একজন জমিদারের ফটো তুলে আনতে হবে–আর তাকে জিজ্ঞাসা করে তাঁর জীবনচরিতও লিখে আনতে হবে।
ভুবন বলিল, ব্যাপার কি?
খগেন্দ্র হাসিতে হাসিতে বলিল, দেশ সুদ্ধ হৈ হৈ পড়ে গেছে–আজ তুমি বললে ব্যাপার কি? আমি যে বই ছাপাচ্ছি–জান না?
না–কি বই ছাপাচ্ছেন?
বঙ্গীয় জমিদার–চরিতমালা। যত সব বড় বড় জমিদারের তাতে জীবনচরিত থাকবে–আর ছবি থাকবে।
বিক্রী হবে?
এরই মধ্যে পাঁচ সাতশো অর্ডার এসে গেছে। অনেক জমিদার উপযাচক হয়ে নিজের নিজের ছবি আর জীবন–চরিত লিখে পাঠাচ্ছে। কোন জমিদার দশ, কেউ বিশ, কেউ পঞ্চাশ কপি বইয়ের অর্ডার দিয়েছে।
ভুবন হাসিয়া বলিল, বন্ধুবান্ধবদের বিলোবে। ফন্দি করেচেন ভাল। আপনার খুব মাথা কিন্তু! তা, আমায় কোথা যেতে হবে। ?
বাশুলিপাড়া।
সে কোথা?
খগেন তখন ভুবনকে বাশুলিপাড়া যাওয়া সম্বন্ধে সমস্ত উপদেশ দিল। জমিদারের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়া বলিল, তুমি কাল গিয়ে পৌঁছবে। যত শীঘ্র পার কায সেরে চলে আসবে, দুচার দিনের বেশী দেরী না হয়।
কেন বলুন দেখি?
সেই জমিদারের এক বুড়ো দেওয়ান আছে–ভারি ধড়িবাজ। সে থাকলে সব পণ্ড করে দেবে। সে না থাকলে যদি পঁচিশখানা বইয়ের অর্ডার আনতে পারতে, সে গিয়ে পৌঁছলে, একখানার বেশী অর্ডার পাবে না।
বুঝেছি। তা, কি কি জিজ্ঞাসা করে লিখে আনব বলে দিন।
খগেন্দ্র বলিল, হ্যাণ্ডবিল ছাপা হচ্ছে–একটার সময় তোমায় এনে দেব এখন। প্রথমে হ্যাণ্ডবিল খানকতক বাবুকে পাঠিয়ে দেবে। তারপর তার ছবি তুলে নেবে–খান চার পাঁচ–নানা রকম পশ্চারে। আর জীবনচরিত সম্বন্ধে এই এই কথাগুলি বিশেষ করে জেনে এস। –বলিয়া খগেন তাহাকে উপযুক্ত উপদেশ দিতে লাগিল।
উঠিবার সময় বলিল–আর একটা কথা। খবর্দার যেন ঘুণাক্ষরে আমার নামটি কোরো না। যদি জিজ্ঞাসা করে কারা এসব করছে–যা মনে আসে একটা বলে দিও, বুঝলে?
বুঝেছি।
যদি আমার কাযটি করে আসতে পার, তা হলে ফী যা তাত পাবেই তার উপর ভাল করে তোমায় খুশী করব। আজ সন্ধ্যার গাড়ীতে তোমার যাওয়া নিশ্চয় ত?
নিশ্চয়।
এই নাও খরচের টাকা। আর ফীর বাবদ কিছু। –বলিয়া খগেন ভুবনের হাতে কয়েকখানি নোট দিল।
চতুর্থ দিবসে ভুবন ফিরিয়া আসিয়া স্টেশন হইতে একেবারে খগেন্দ্রের বাড়ীতে গিয়া নামিল। বলিল–মশাই এমন জায়গাতেও পাঠিয়েছিলেন!
কেন, কি হল?
কিছুই হল না। প্রথমে দুদিন ত বাবুর দেখাই পেলাম না। যখনই খোঁজ নিই, তখনই শুনি বাবু অন্দরমহলে। কাল সকালে বাবুর সঙ্গে দেখা হল। আমাকে ত যাচ্ছেতাই বললেন। আগেই হ্যাণ্ডবিলগুলো তাঁকে পাঠিয়েছিলাম কিনা।
কি বললেন?
বললেন, ও সব তোমাদের জুয়াচুরি। দেশে এত বড় বড় রাজা জমিদার থাকতে আমার কাছে এসেছ কেন? –ছবি ছাপাতে হয়, জীবনচরিত লিখতে হয় বড় বড় রাজা মহারাজের কাছে যাও। বর্ধমান রয়েছেন, কুচবেহার রয়েছেন, নাটোর রয়েছেন, কাশিমবাজার, দীঘাপতিয়া–সেখানে না গিয়ে আমার কাছে এসেছ কেন? আমি ছবিও তুলতে দেব না, জীবনচরিতও বলব না।
অতঃপর ভবেন্দ্ৰ যে জুয়াচোর, সে সম্বন্ধে খগেন্দ্রের কোনও সন্দেহই রহিল না।
সেইদিন বৈকালে দেওয়ানজিকে গিয়া বলিল, গ্রীষ্মের ছুটিতে ইস্কুল বন্ধ হয়েছে। কনককেও অনেকদিন দেখিনি। যদি অনুমতি করেন তবে আপনার সঙ্গে বাশুলিপাড়ায় যাই।
দেওয়ানজি স্নেহপূর্ণ স্বরে বলিলেন, যাবে? বেশ ত। আমি পরশু যাব। আমার সঙ্গে চল।
যথাদিনে খগেন্দ্র দেওয়ানজির সহিত বাশুলিপাড়ায় গিয়া পৌঁছিল।
০৩. পাপের মন
খগেন্দ্র যে সময় বাশুলিপাড়ায় পৌঁছিল, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। বৈঠকখানা বাড়ীতে যে কক্ষে পূৰ্ব্বে সে বাস করিয়া গিয়াছে, সেইখানে নিজের জিনিষপত্র রাখিল। একজন ভৃত্য তাহার হস্তপদাদি ধৌত করিবার জন্য জল আনিয়া দিল। অন্তঃপুর হইতে থালায় করিয়া জলযোগের উপকরণ আসিল। আহারাদি করিয়া খগেন্দ্র কাছারির বারান্দায় একখানি বেঞ্চিতে একাকী চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। কনকের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করিবার অত্যন্ত ইচ্ছা–কিন্তু কেই বা অন্তঃপুরে সংবাদ দেয়, কেই বা বন্দোবস্ত করে! দেওয়ানজি নাই, বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া নিজ বাটীতে প্রস্থান করিয়াছেন। শুনিল, আজ আর তিনি আসিবেন না, কল্য প্রাতে আবার তাঁহার দর্শন পাওয়া যাইবে।
একাকী বসিয়া বসিয়া খগেন্দ্রের বিরক্তি ধরিয়া গেল। উঠিয়া বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। আজ শুক্লা চতুর্দশী–কিন্তু আকাশে অল্প অল্প মেঘ থাকাতে জ্যোৎস্নাটি স্নান দেখাইতেছিল। একবার ইচ্ছা হইল, যাই গ্রামের পথে পথে একটু বেড়াইয়া আসি। কিন্তু অধিকাংশ পথেরই দুই পার্শ্বে জঙ্গল, পল্লীগ্রামে সর্পভয়–তাই সে কাৰ্য্য কলিকাতাবাসী যুবকের সাহসে কুলাইল না। পদচারণা করিয়া শ্রান্ত হইয়া খগেন্দ্র আবার বেঞ্চিতে উপবেশন করিল। আপন মনে নানা প্রকার চিন্তা করিতে লাগিল। সুরবালার গঙ্গায় ভাসিয়া আসা, বাগানে হঠাৎ ভবেন্দ্রকে দেখিয়া তাহার ভাবপরিবর্তন, আহারে উপবিষ্ট ভবেন্দ্রের পানে সে রাত্রে সুরবালার একদৃষ্টে চাহিয়া থাকা, পরে কনকের সহিত তাহার কথোপকথন–কনকের পত্রে এ সমস্ত খগেন্দ্র অবগত হইয়াছিল। সকল কথা বারম্বার পর্যালোচনা করিয়া তাহার মনে স্থির বিশ্বাস জন্মিয়াছে, সুরবালার ভাসিয়া আসাটা দৈবাধীন ঘটনা নহে–তথাকথিত ভবেন্দ্র ও তাহার মধ্যে চক্রান্তেরই অংশ বিশেষ। ভবেন্দ্রের পরিচয় আবিষ্কার করা যদি কঠিনও হয়, সুরবালা কে, তাহা ধরিতে পারিলেই ভবেন্দ্রের প্রকৃত ব্যাপার ধরা পড়িয়া যাইবে। কনকের সঙ্গে সাক্ষাৎ একবার বিশেষ আবশ্যক–তাহার কোনও সুযোগ না পাইয়া খগেন্দ্ৰ ছটফট করিতে লাগিল।
খগেন্দ্র যেখানে ছিল, তাহার অল্প দূরেই কাছারি বাড়ী। সেখানে দুই চারিজন লোককে বসিয়া থাকিতে দেখিল। ভাবিল, এখানে একাকী বসিয়া কি করিব–যাই উহাদের সঙ্গে গল্পগুজব করি।
এইরূপে বৃথা কাযে সন্ধ্যা কাটিয়া গেল। রাত্রি দশটার সময় কাছারি বাড়ীতে আমলাদের সঙ্গে বসিয়া আহার করিয়া খগেন আবার বৈঠকখানায় ফিরিয়া আসিল। দেখিল, ভৃত্যগণ কেহ সিঁড়িতে আলো জ্বালিতেছে, কেহ ব্যস্তভাবে উপরে উঠিতেছে, কেহ নামিয়া আসিতেছে। খগেন্দ্র বুঝিল, উপরে বাবুর জন্য শয্যাদি প্রস্তুত হইতেছে।
কিয়ৎক্ষণ পরেই লণ্ঠনধারী বর্কন্দাজের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অন্তঃপুরের দিক হইতে কে আসিতেছে দেখা গেল। ভৃত্যগণ বলাবলি করিয়া উঠিল–হুজুর আসিতেছেন।
রাখাল, বারান্দায় পৌঁছিতেই খগেন্দ্র সসম্ভ্রমে দাঁড়াইয়া উঠিল। নিকটে আসিলে মস্তক ঈষৎ অবনত করিয়া বাবুকে নমস্কার করিল।
রাখাল বলিল, আপনি কে?
বর্কন্দাজ আলোটা একটু উচ্চ করিয়া ধরিল। রাখাল দেখিল, এ ব্যক্তি অপূৰ্ব্ব রূপলাবণ্যশালী
খগেন্দ্র নিজের নাম বলিল। রাখাল বিস্মিত দৃষ্টিতে তাহার মুখের পানে চাহিয়া বলিল, দেওয়ানজির সঙ্গে কলকাতা থেকে এসেছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার ভগ্নী রা
খাল বাধা দিয়া বলিল, আমি জানি। তা–আপনার আহারাদি হয়েছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ভৃত্যগণের পানে চাহিয়া বলিলেন, বাবুর বিছানা-টিছানা করে দিয়েছিস?
ভৃত্যগণ বলিল, হুজুর
কোথা?
ঝাড়লণ্ঠনের গুদামের পাশে সেই কোণের ঘরটায়। বাবু আরও একবার এসেছিলেন, সেই ঘরেই শুতেন।
রাখাল বলিল, হ্যাঁ–তা জানি! আপনার কোনও রকম অসুবিধা হচ্ছে না ত? –খগেন্দ্রকে উত্তর দিবার অবসর না দিয়াই রাখাল বর্কন্দাজকে অগ্রসর হইতে ইঙ্গিত করিল। সঙ্গে সঙ্গে বলিল–চলুন দেখি বিছানা–টিছানা কি করেছে।
রাখালের এই ব্যবহার খগেন্দ্রের একেবারে অপ্রত্যাশিত। বাবুকে আসিতে দেখিয়া সে ভাবিয়াছিল, তিনি নমস্কার প্রত্যর্পণ করিয়া বিনা বাক্যব্যয়ে সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া যাইবেন। বার্ষিক লাখ টাকা যাঁহার আয়, তিনি, যাহাকে মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনের ইস্কুলের মাষ্টার বলিয়া জানেন, তাহার ভোজন ও বাসস্থানের সুবিদা অসুবিধার বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হইবেন, ইহা খগেন্দ্র কল্পনাই করে নাই। মূঢ়ের ন্যায় বাবুর পশ্চাতে পশ্চাতে গিয়া নির্দিষ্ট শয়নকক্ষের মধ্যে প্রবেশ করিল।
রাখাল কক্ষখানির চতুর্দিকে মনোযোগের সহিত দৃষ্টিপাত করিল। শয্যার দিকে চাহিয়া বলিল–একটা পুরোনো মশারি দিয়েছিস কেন? আর মশারি ছিল না?
ভৃত্য বলিল, কাল বদলে দেব এখন।
আর, এক কলসী জল রাখিসনি? এই গ্রীষ্মকালরাত্রে যদি পিপাসা পায়, একটু জলের জন্যে কাকে ডাকাডাকি করতে যাবেন? যা–এক কলসী ভাল জল, একটা গেলাস, এনে রেখে দে। আর তক্তপোষখানা আর একটু সরিয়ে ঐদিকে করে দিলে, দুদিকে দুটো জানালার হাওয়া পেতেন–যে গরম!
ভৃত্যগণ তৎক্ষণাৎ তক্তপোষ সরাইয়া দিল। দুই তিন হস্তের ব্যবধানে মাথার কাছে একটা এবং পার্শ্বে একটা লোহার গরাদেযুক্ত বড় জানালা পড়িল।
দেখিয়া শুনিয়া রাখাল বলিল, এবার বিশ্রাম করুন–অনেক রাত্রি হয়েছে। –বলিয়া সে প্রস্থান করিল।
বাবু চলিয়া গেলে, খগেন্দ্র অনেকক্ষণ মাথায় হাত দিয়া শয্যাপ্রান্তে বসিয়া রহিল। ভাবিতে লাগিল, বাবু এ রকম ব্যবহার করিলেন কেন? তাহার মনে কোনও গূঢ় অভিসন্ধি নাই ত? তিনি আমার গোপন অভিপ্রায়টি কোনও সূত্রে অনুমান করিয়াছেন কি? আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন–অর্ধেক কথা আমি বলিতে না বলিতেই, তিনি বলিলেন, জানি। আমি পূৰ্বে আসিয়া যে এই কক্ষে শয়ন করিয়াছিলাম, ভৃত্য তাহা ইঙ্গিত করিবামাত্র আবার বলিলেন, জানি। এতবড় একটা জমিদারের বৈঠকখানা বাড়ী, নিত্য কত লোক আসিতেছে, যাইতেছে, কোন্ ঘরে কে শয়ন করিল তাহার সংবাদ রাখা বাবুর পক্ষে একটু অস্বাভাবিক নহে কি? –যদি বাবু কিছু সন্দেহ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমাকে সহজে ত ছাড়িবেন না! হয় আমার প্রাণহানি পৰ্য্যন্ত করিতে পারেন।
খগেন সেই মানুষ-সমান খোলা জানালা দুটির পানে চাহিয়া দেখিল। মেঘ কাটিয়া গিয়াছে, জ্যোৎস্না টক্ টক্ করিতেছে। এক দিকের জানালার বাহিরে পতিত জমি–কতকগুলা আগাছা জন্মিয়াছে। অল্পদূরেই গোটা দুই তিন বাঁশঝাড়। বাতাসে বংশপত্রগুলার পরস্পর সম্মাতে চিট পিট শব্দ উত্থিত হইতেছে। অপর দিকের জানালাটির বাহিরে চারি পাঁচ হাত অন্তরেই জঙ্গল। কতকগুলা গাবৃভেরাণ্ডা ও শেওড়া গাছ ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তাহার পশ্চাতে, উচ্চতর বৃক্ষ–অল্প আলোকে ভাল চেনা যাইতেছে না। সেই দিকটা হইতে ঝিঁঝিপোকার অবিশ্রান্ত শব্দ শুনা যাইতেছে। একটা কি রকম গন্ধও সেদিক হইতে আসিতেছে–খগেন্দ্র পল্লীবাসী হইলে বুঝিতে পারিত তাহা ঘেঁটুফুলের গন্ধ। সে দিকটায় চাহিয়া খগেনের মনে একটু একটু ভয় হইতে লাগিল। ভাবিল, আচ্ছা ধর–অনেক রাত্রে, আমি ঘুমাইয়া আছি, ঐ জঙ্গল হইতে বাবুর বেতনভোগী, মাথায় কঁকড়া চুল, ষণ্ডামার্কা একজন বাঙ্গী কি দুলে যদি সড়কি হাতে করিয়া বাহির হইয়া আসে–এই খোলা জানালার গরাদের ভিতর দিয়া, সড়কী চালাইয়া আমার মস্তকের মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দেয়? –ভাবিতে খগেন্দ্রের সৰ্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিল।
একাকী সেই গভীর রাত্রে–তাহার পাপ মনে সন্দেহ ক্রমে বৃদ্ধি হইতে লাগিল। ভাবিল–ভুবন ফটোগ্রাফওয়ালা আসিয়া নিষেধসত্ত্বেও কোন কথা প্রকাশ করে নাই ত? হয়ত বা দেওয়ানজিই আসিয়া বাবুর কাছে গল্প করিয়াছেন–তোমার সম্বন্ধে অনেক খুঁটিনাটি কথা খগেন্দ্র আমায় জিজ্ঞাসা করিতেছিল। তবে ত আর রক্ষা নাই! নিশ্চয়ই আমাকে গোপনে হত্যা করিবার বন্দোবস্ত হইয়াছে। আমার শয়নের কি ব্যবস্থা হইয়াছে। কেবলমাত্র তাহাই দেখিবার জন্য–আমার অসুবিধা নিবারণের জন্য–বাবু আসেন নাই। শুধু আমার গায়ে বাতাস লাগিবে বলিয়াই তক্তপোষ সরাইবার ব্যবস্থা করেন নাই। জানালার কাছে হইলে সড়কী চালাইবার সুবিধা হইবে, এই তাহার অভিসন্ধি। ভয়ে, উৎকণ্ঠায় খগেন্দ্রের গাত্রময় ঝর ঝর করিয়া ঘৰ্ম্ম বহিতে লাগিল।
বসিয়া বসিয়া খগেন্দ্র আবার ভাবিল, এখন কি করা যায়? দুয়ারটি খুলিয়া আস্তে আস্তে বাহির হইয়া, পলায়ন করিব? –আবার মনে হইল, যদি ইহারা আমায় খুন করিবার মলবই করিয়া থাকে–তবে নিশ্চয়ই পাহারা আছে। পলাইতেছি দেখিলেই লাঠির ঘায়ে আমার মাথা ভাঙ্গিয়া ফেলিবে। যদি পলাইতে হয়, তবে সে বরং কল্য দিবাভাগে। ভাবিয়া চিন্তিয়া, খগেন্দ্র উঠিয়া জানালা দুইটি বেশ করিয়া বন্ধ করিয়া দিল। বাতি ধরিয়া দেখিল, জানালার কপাটগুলি মজবুত শাল কাষ্ঠের নির্মিত–কজা ছিটকিনি প্রভৃতিও হাল্কা নহে। বদ্ধ দ্বারের নিকটে আলোক লইয়া গিয়া দেখিল, দ্বার ও অর্গলাটও জানালারই মত সুদৃঢ়; হঠাৎ বাহির হইতে কেহ ভাঙ্গিতে পারিবে না। তখন দ্বার বন্ধ করিয়া খগেন্দ্র মশারির ভিতর প্রবেশ করিল। শয়ন করিল না–বিছানায় বসিয়া রহিল। আবদ্ধ ঘরে জ্যৈষ্ঠ মাসের গুমটে হঠাৎ নিদ্রা আসিবারও সম্ভাবনা ছিল না। হাতপাখা দিয়া নিজেকে বাতাস করিতে করিতে, ঢুলিতে ঢুলিতে, কখনও শুইয়া কখনও বসিয়া, কাছারির পেটা ঘড়িতে ক্রমে বারোটা, একটা, দুইটা, এবং তিনটা বাজা শুনিল।
তাহার পর ঘুমাইয়া পড়িল, কিন্তু সেও অধিকক্ষণ নহে। একটা বিভীষিকাময় স্বপ্ন দেখিয়া জাগিয়া উঠিল। বাহিরে তখন কাক ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছে। জানালার ফাঁক দিয়া প্রভাতের আলোক কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিতেছে।
০৪. সাবাস্ কনক–সাবাস্
বেলা সাতটার সময় দেওয়ানজি আসিলেন। খগেন তাঁহার নিকটভগ্নীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার বাসনা জানাইল। দেওয়ানজি বলিলেন, আচ্ছা, আমি বন্দোবস্ত করিয়া দিতেছি।
ঘণ্টাখানেক পরে অন্তঃপুরের ঝি আসিয়া খগেন্দ্রকে লইয়া গেল। একটি কক্ষে . প্রবেশ করিয়া দেখিল, একখানি চেয়ার রহিয়াছে, তাহার নিকটে কনক সহাস্যবদনে দাঁড়াইয়া আছে।
এই যে–আসুন!–বলিয়া কনক তাঁহাকে সস্মিত বদনে অভিবাদন করিল। পৌঁছিয়া দিয়া ঝি চলিয়া গেল।
খগেন কাছে গিয়া মৃদুস্বরে বলিল, গৃহস্থ বাড়ীতে থেকে থেকে অভিনয় করাটা ভুলে গেলে?
কনক অল্প হাসিয়া বলিল, কেন?
আমি তোমার দাদা–গুরুজন–পূজনীয় ব্যক্তি। কতদিন পরে এসেছি–আমায় প্রণাম করলে না? –ঝি কি মনে করলে?
কনক হাসিয়া বলিল, ঝি মনে করলে–-কলকাতার লোকদের কেতাই বুঝি এই রকম; গুরু লঘু জ্ঞান ক্রমেই তাদের লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বসুন। –বলিয়া চেয়ারখানি দেখাইয়া দিল।
নিকটে শতরঞ্জ মোড়া এক তক্তপোষ ছিল, তাহারই প্রান্তে কনক উপবেশন করিয়া বলিল, আমাকে আর কতদিন এখানে রাখবেন? আমার প্রাণ যে হাঁপিয়ে উঠলো!
কেন, এখানে তোমার কিছু কষ্ট হচ্ছে?
কনক মুক্তদ্বারের পানে নিমেষের জন্য চাহিয়া, অভিনয় ভঙ্গিতে বলিল, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে কে বাঁচিতে চায়!
খগেনও চকিতভাবে দ্বারের পানে চাহিয়া তাড়াতাড়ি বলিল, হয়েছে–হয়েছে, তুমি অভিনয় ভোলনি! এখনও বেশ পার।
কনক, বাইজীর অনুকরণে সেলাম করিয়া বলিল, ওস্তাদজী–আপহি কা কুদরৎ।
পরস্পরের শারীরিক স্বাস্থ্য সম্বন্ধে দুই চারিটা বচন-বিনিময়ের পর খগেন্দ্র কিয়ৎক্ষণ নীরব রহিল।
কনক বলিল, ভাবছেন কি?
না–ভাবিনি কিছু। তোমাদের বউরাণীর খবর কি বল।
বউরাণী ত মশগুল হয়ে রয়েছেন।
কি রকম?
কি রকম আর? নতুন প্রেমে পড়লে যে রকম হয়।
তবে যে শুনলাম ওদের দেখাশুনো নেই।
রাত্রে নেই–দিনে ত আছে। দুতিন দিন থেকে দেখছি, বিকেল থেকে সন্ধ্যের পর পৰ্য্যন্ত, অন্দরের বাগানে চাঁদের আলোয় দুজনে পাইচারি করে বেড়ান।
খগেন বলিল, তাতে দোষ কি?
না–দোষ নেই, তবে আপনি বড় আশাটা করেছিলেন–হতাশ হলেন। হতাশের আক্ষেপ–টাক্ষেপ একটা কিছু লিখে ফেলুন। –বলিয়া অভিনয়ের সুরে ঊর্ধ্বমুখী হইয়া বলিল
ওরে দুষ্ট দেশাচার, কি করিলি খগেন দাদার,
কার ধন কারে দিলি, তাহার সে হল না।
আবার কৃত্রিম দুঃখে মুখখানি অবনত করিয়া, অঞ্চলপ্রান্ত চক্ষে দিয়া, কাল্পনিক অশ্রু মুছিতে লাগিল।
খগেন্দ্র বলিল, এখন অভিনয় থাক। কাযের কথা বল দেখি। এ লোকটা কে, কিছু সন্ধান পেলে?
কি করে পাব? আমি কি ডিটেকটিভ?
আগে কোথায় থাকত, এ সব কিছু শোননি?
পশ্চিমের কোন্ এক মঠের মোহান্ত ছিল।
সে মঠের নাম কি? কোথা সে মঠ?
কি করে জানব বলুন?
বউরাণীর সঙ্গে এত গল্প হয় নিশ্চয়ই এতদিন বলেছে। বউরাণীর কাছ থেকে কথায় কথায় জেনে নিতে পার না? মঠের মোহান্ত ছিল, এ কথাই বা তুমি জানলে কি করে?
কাশী থেকে উনি দেওয়ানজিকে প্রথম যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতেই ছিল। সে চিঠি দেওয়ানজি রাণীমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন।
সে চিঠিতে মঠের নাম ঠিকানা লেখা ছিল?
চিঠি ত আমি শুনিনি। রাণীমাই বলেছিলেন, মঠের মোহান্তগিরি ছেড়ে দিয়ে কাশীতে এসে রয়েছেন।
সে চিঠি কোথা? দেওয়ানজি রাণীমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন?
তা ত বলতে পারিনে।
রাণীমা কোন ঘরে শোন? তাঁর বাক্স-টাক্স কোথা থাকে?
কনক হাসিয়া বলিল, কেন, আমাকে কি রোহিণী হতে হবে?
দেখই না চেষ্টা করে।
যখন ধরা পড়ব–গোবিন্দলাল কোথা পাব? আমায় থানায় পাঠিয়ে দেবে যে!
খগেন্দ্র হাসিয়া বলিল, গোবিন্দলাল ত হাতের কাছেই রয়েছে। রাজার ন্যায় ঐশ্বৰ্য্য–বছরে লক্ষ টাকা আয়–তোমার মত একটি রোহিণী পেলে সে ত বেঁচে যায়। সে কথা যাক। আচ্ছা, ঐ সুরবালা সম্বন্ধে তোমার কি এখনও বিশ্বাস, ও আগে। থেকেই এই জাল ভবেন্দ্রকে চিনত?
আমার তাই বিশ্বাস।
তা হলে নিশ্চয়ই ওরা দুজনে ষড়যন্ত্র করে এসেছে। একজন জুয়াচোর এতবড় একটা ফন্দী করে আসবে, সে একলা কখনই আসবে না। অন্তঃপুরের মধ্যে তার একজন গোয়েন্দা আবশ্যক। সুরবালাই সেই গোয়েন্দা।
কনক বলিল, তা যদি হয়, তা হলে সেদিন বাগানে প্রথমে বাবুকে দেখে সুরবালা অমন চমকে উঠবে কেন? যা অভাবনীয়, তাই দেখেই না মানুষ চমকায়!
খগেন্দ্র বলিল, আমারও প্রথম প্রথম তাই মনে হত বটে। কিন্তু অনেক ভেবে চিন্তে, আমি ও সমস্যার একটা উত্তর বের করেছি।
কি বলুন দেখি?
ওরা দুজনে যে সময় ষড়যন্ত্র করেছিল, সে সময় এটা স্থির হয়নি যে ঐ জুয়াচোর সন্ন্যাসী সেজে আসবে। এই স্থির হয়ে থাকবে যে, সাধারণ বেশেই এখানে আসবে–বলবে আমি সন্ন্যাসী ছিলাম, সে সব ছেড়ে–ছুঁড়ে দিয়ে আবার ঘরে ফিরে এলাম। ওদের এ পরামর্শ হবার পরেই, সুরবালা নৌকায় এসে, অন্দরের ঘাটে নেমে জলে ডোবা মড়া সেজে শুয়েছিল। তার মাস দুই পরে জাল ভবেন্দ্র এসেছে। সুরবালার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর হয়ত সে মনে মনে করেছে, এখন সন্ন্যাসী বেশে যাওয়া ভাল–মাস ছয় এখন জপ তপ ব্রহ্মচর্য্য বুজরুকি দেখালে, কেউ আর কোনও সন্দেহ করবে না। সুরবালা যে চমকে উঠেছিল, সে জাল ভবেন্দ্রকে দেখে নয়, তার সন্ন্যাসী বেশ দেখে।
খগেনের কথা শেষ হইলে, কনক দুই মিনিট কাল–গালে হাত দিয়া বসিয়া ভাবিল। শেষে বলিল–ঠিক বলেছেন খগেনবাবু।
খগেন বলিল, তুমি যদি কথায় কথায়, কৌশলে, অন্ততঃ সুরবালার কিছু পরিচয় আদায় করতে পার–
কনক বাধা দিয়া তাড়াতাড়ি বলিল, তা হলে আপনার কাৰ্যসিদ্ধি হয়?
নিশ্চয়। দুজন ষড়যন্ত্রকারীর মধ্যে একজনের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারলেই, অন্যজনেরও সব কথা ধরা পড়বে।
উত্তেজিত স্বরে কনক বলিল, তা যদি হয়, তবে তা হলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।
খগেনও উত্তেজিত হইয়া বলিল, পার?
পারি। সুরবালার বাপের বাড়ী কোথা তা জানি।
কোথা? কোথা? কেমন করে জানলে?
একদিন কথায় কথায় ও বলে ফেলেছিল–আমাদের বসন্তপুরে ছেলেবেলায় দেখেছি–বলেই সামলে নিলে।
সেখানে ওর বাপের বাড়ী কি শ্বশুরবাড়ী কি করে জানলে?
ঐ যে বললে–ছেলেবেলায়।
খগেন্দ্র কুঞ্চিত করিয়া একটু ভাবিয়া বলিল, হ্যাঁ–বাপের বাড়ী হতেও পারে। যদি শ্বশুরবাড়ী হয়, তাতেও ক্ষতি নেই। বসন্তপুর কোথা, কিছু আন্দাজ করতে পার?
ওর কথাবার্তায় ওকে বর্ধমান জেলার লোক বলেই বোধ হয়। রকে বলে ড়–ড়কে বলে র। আমরা কাপড় পরি, ও কাপর পড়ে। –বলিয়া কনক হাসিতে লাগিল।
খগেন্দ্র একমিনিট কাল চিন্তা করিল। তাহার পর, সহাস্যমুখে কনকের পৃষ্ঠে মৃদু আঘাত করিয়া বলিল, সাবাস কনক–সাবাস। এইবার অন্ধকারে পথ পেলাম।
কি করবেন এখন?
আমি আজই কলকাতায় ফিরে যাব। পোষ্ট আপিসের বই থেকে এই বসন্তপুর কোথা, বের করে, সেখানে গিয়ে গোপন অনুসন্ধান করব।
কিন্তু মনে রাখবেন, হয়ত ওর আসল নাম সুরবালা নয়।
সে আমায় বলতে হবে না। সেই গ্রামের কোন্ স্ত্রীলোক, চৈত্রমাসের পূৰ্ব্বে ছিল, চৈত্রমাস থেকে আর গ্রামে নেই–এই খবরটি পেলেই সবই ক্রমে জানতে পারব।
কনক একটু ভাবিয়া বলিল, যদি এ রকম হয়–পাঁচ সাত বছর সে গ্রামও পরিত্যাগ করেছে–এখানে অন্যত্র থেকে এসেছে কলকাতা কি কৃষ্ণনগর?
কপাল টিপিয়া ধরিয়া খগেন্দ্র বলিল, হ্যাঁ–তা হলে মুস্কিল বটে। আচ্ছা–যে শাড়ীখানা পরে ও ভেসে এসেছিল, সে শাড়ীখানা কোথা?
আছে। কেন?
সে শাড়ীখানা আমায় দিতে পার?
সে শাড়ীখানা ওর ঘরে আলনায় কালও আমি দেখেছি।
কোনও অছিলা করে সেখানি চেয়ে এনে আমায় দিতে পার না?
কি করবেন?
বসন্তপুরের ধোপাদের সে শাড়ী দেখালেই, কার শাড়ী তারা বলে দিতে পারবে। শাড়ীখানা আমায় চাই-ই চাই।
আমি বিধবা মানুষ। পাড়ওয়ালা শাড়ী কি অছিলায় চেয়ে আনব?
আচ্ছা, একবার এনে আমায় দেখাও শুধু।
হ্যাঁ–তা অনায়াসে পারি। –বলিয়া কনক উঠিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে শাড়ীটি বস্ত্রের মধ্যে লুকাইয়া আনিয়া দিল।
খগেন আগ্রহের সহিত শাড়ীটির চারিকোণ পরীক্ষা করিল। এককোণে ধোপার চিহ্ন পাইল। নিমেষ মধ্যে, পকেট হইতে ছুরি বাহির করিয়া, সেই অংশটুকু তির্য্যভাবে কাটিয়া লইল।
কনক বলিলও কি করলেন?
খগেন্দ্র কোনও উত্তর না দিয়া কৰ্ত্তিক অংশটুকু নিজের পকেটে পুরিল। তাহার পর শাড়ীর ছিন্ন প্রান্তটি আঙুলে টানিয়া টানিয়া খানিক সূতা বাহির করিয়া ফেলিল। বলিল–এখন আর কাটার মত দেখাচ্ছে না, ছেঁড়ার মত দেখাচ্ছে। যাও যেখানকার শাড়ী সেখানে রেখে এস। আমি এখন উঠি। বিকেলে এখান থেকে রওনা হব।
আজই চললেন
হ্যাঁ–আজই।
আমায় আর কতদিন এখানে থাকতে হবে?
বড় জোর দুমাসের মধ্যেই এই জাল ভবেন্দ্রের সমস্ত নাড়ী–নক্ষত্র আমি যদি জানতে না পারি, তবে আমার নাম খগেন্দ্র নয়। –বলিয়া খগেন্দ্র উৎসাহদীপ্ত মুখে দণ্ডায়মান হইল। পকেট হইতে কতকগুলি নোট বাহির করিয়া বলিল–এই নাও কনক তোমার দুমাসের মাইনের টাকা। আর দুটো মাস তুমি অপেক্ষা করে থাক। তা হলেই কাৰ্যসিদ্ধি।
পরদিন কলিকাতায় পৌঁছিয়া অনুসন্ধানে খগেন্দ্র আবিষ্কার করিল, বর্ধমান জেলায় একটা, ছাপরা জেলায় একটা এবং পূর্ণিমা জেলায় একটা–সৰ্ব্বসুদ্ধ তিনটা মাত্র বসন্তপুর আছে। সুতরাং তৎপরদিন সে নিঃসংশয়ে বর্ধমান জেলার বসন্তপুরে গিয়া উপনীত হইল।
০৫. বসন্তপুরে সোণার হরিণ
বসন্তপুর গ্রামের ডাকঘরটি ঠিক বাজারের মধ্যস্থলে অবস্থিত। তখন বেলা একটা বাজিয়াছে। আকাশে মেঘ করিয়াছে, বায়ু বন্ধ, গ্রীষ্মে প্রাণ অস্থির হইয়া উঠে। ডাক আসিবার সময় হইয়াছে, আপিস কক্ষের বাহিরে বারান্দায় বসিয়া ডাকবাবু অপেক্ষা করিতেছিলেন। ডাকটা আসিলেই চিঠিপত্রগুলা পিয়নের জিম্মা করিয়া দিয়া বাসায় গিয়া তিনি একটু বিশ্রাম করিবেন। মেমারি স্টেশন হইতে ঘোড়ার গাড়ীতে ডাক আসে–চারিজন যাত্রীর বসিবার স্থান সে গাড়ীতে আছে, প্রত্যেককে দুই টাকা ভাড়া দিতে হয়। জানালার ভিতর দিয়া আপিস কক্ষের ঘড়িটি দেখা যাইতেছে। একটা বাজিয়া দশ মিনিট হইল, পনেরো মিনিট হইয়া গেল, তথাপি ডাকগাড়ীখানির দেখা নাই। পোষ্টমাষ্টার চেয়ারে বসিয়া দুলিতেছেন, মাঝে মাঝে জাগিয়া উঠিয়া ঘড়ির পানে চাহিতেছেন, টেবিলের উপর হইতে ভি-পি রেজিষ্টার বহিখানি তুলিয়া নিজেকে বাতাস করিতেছেন, হাই তুলিতেছেন, আবার ঢুলিয়া পড়িতেছেন।
গ্রীষ্ম ক্রমে বাড়িয়া উঠিল, দেড়টাও বাজিয়া গেল। খড়মের খটখট শব্দে হঠাৎ ডাকবাবুর তন্দ্রাভঙ্গ হইল। চাহিয়া দেখিলেন, মুখুয্যে মহাশয়। আজ শনিবার বঙ্গবাসী আসিবার দিন। গায়ে সেই হাতকাটা পিরাণ, বগলে ছাতি, আহারান্তে পাণ চিবাইতে চিবাইতে মুখোপাধ্যায় আসিয়া দর্শন দিলেন। বলিলেন–ডাকগাড়ী এল ভায়া?
ডাকবাবু ভাল করিয়া জাগিয়া উঠিয়া বলিলেন, আসুন মুখুয্যে মশায়, বসতে আজ্ঞা হোক। ওহে পিয়ন, ভিতর থেকে বাবুকে একখানা চেয়ার এনে দাও ত। কই না, ডাকগাড়ীর ত এখনও দেখা নেই।
মুখোপাধ্যায় উপবেশন করিয়া বলিলেন, আজ এত দেরী কেন?
কি জানি, রেলগাড়ী বোধ হয় লেট করে এসেছে।
দুই এক কথার পর পিয়নের দিকে চাহিয়া মুখোপাধ্যায় বলিলেন, ওহে, এক ছিলিম তামাক খাওয়াও না।
পিয়ন তামাক সাজিতে গেল। মুখোপাধ্যায় বলিলেন, গেল সপ্তাহের বঙ্গবাসী পড়েছ?
ডাকবাবু বলিলেন, না।
লেডি ইস্মিথে যে ভয়ানক কাণ্ড! ইংরেজদের অবস্থা বড় সঙ্গীন।
ডাকবাবু নিতান্ত ঔদাস্যের সহিত বলিলেন, বটে!
হা হে, কখন কি হয় বলা যায় না। হয়েছে কি জান? –বলিয়া ফস করিয়া মনি অর্ডারের একখানা শাদা ফৰ্ম্মে, মুখোপাধ্যায় তাড়াতাড়ি যুদ্ধক্ষেত্রের একটা নক্সা আঁকিয়া ফেলিলেন। গত সপ্তাহের বঙ্গবাসী অনুসারে ইংরাজ সৈন্য কিরূপ সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পতিত, তাহাই বুঝাইতে লাগিলেন। ডাক আসিতে বিলম্ব হওয়ায় নিজের অবস্থা কিরূপ সঙ্কটাপন্ন, সেই চিন্তাতেই ডাকবাবু ব্যস্ত ছিলেন–ইংরাজ সৈন্যের সঙ্কটে তাদৃশ মনোযোগ দিলেন না। বুঝান শেষ হইলে মুখোপাধ্যায় বলিলেন, বললে তুমি বিশ্বাস করবে না, ইংরেজদের কি হল কি হল ভেবে ভেবে এ একসপ্তাহ রাত্রে আমার ঘুম। হয়নি।
ইতিমধ্যে তামাক আসিয়াছিল, ডাকবাবু তাহার সদ্ব্যবহারে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁহার হাত হইতে হুঁকাটি লইয়া মুখোপাধ্যায় দুশ্চিন্তা দমনে যত্নবান হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরেই দূরে ডাকগাড়ীর ঘড় ঘড় শব্দ উত্থিত হইল।
ক্রমে গাড়ী আসিয়া পোষ্ট আপিসের সম্মুখে দাঁড়াইল। পক্ষিরাজের সুযোগ্য বংশধর দুইটি, ঘর্মাক্ত কলেবরে দাঁড়াইয়া হাঁপাইতে লাগিল। গাড়ীর ভিতর হইতে তিনজন আরোহী অবতরণ করিল–দুইজন গ্রামের লোক, এক ব্যক্তি অপরিচিত। শেষোক্ত লোকটির সোণার চশমা, আলবার্ট টেরি, সুগৌর কান্তি এবং সুন্দর গঠন দেখিয়া ডাকবাবু ও মুখোপাধ্যায় তাহার মুখের পানে ফ্যালফ্যাল্ করিয়া চাহিয়া রহিলেন। বলা বাহুল্য সে খগেন্দ্র।
গাড়ীর ছাদ হইতে পিয়ন ডাকের ব্যাগ নামাইয়া লইল, ক্যোচমান ও তাহার সহকারী আরোহিগণের জিনিষপত্র নামাইয়া দিল। অপর দুইজন আরোহীকে খগেন্দ্র বলিল, একটু দাঁড়ান। নিজের তোরঙ্গ খুলিয়া একতাড়া কাগজ বাহির করিল। তাহাদের হস্তে এক একখানি কাগজ দিয়া বলিল–এই বইখানি বেরুচ্ছে। ভারি ভাল বই, বিজ্ঞাপনটি অনুগ্রহ করে পড়ে দেখবেন। তাহার পর ডাকঘরের বারান্দায় উঠিয়া, বিনীতভাবে শিরোনমন করিয়া বলিল–মশায়–সঙ্গে সঙ্গে ডাকবাবুকে একখানি, মুখোপাধ্যায়কে একখানি সেই বিজ্ঞাপন দিল। একখানি টুল সেখানে ছিল, বিনা আহ্বানেই তাহার উপর বসিয়া পড়িল।
হাতকাটা পিরাণের বুক–পকেটে চশমার খোল অনুসন্ধান করিতে করিতে মুখোপাধ্যায় বলিলেন, মশায়ের নাম?
আমার নাম শ্রীখগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
নিবাস?
কলকাতা।
কোথায় যাওয়া হবে?
আপাততঃ আপনাদের এই গ্রামেই এসেছি।
কাদের বাড়ী?
কারু বাড়ীতে নয়।
কি মনে করে আসা হয়েছে?
আজ্ঞে একখানা বই বের করেছি, বিজ্ঞাপনটি পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন। সেই বইয়ের জন্যে মাল মশলা সংগ্রহ করাই উদ্দেশ্য। আর যদি দুচারটে গ্রাহকও জোটাতে পারি। –বলিয়া খগেন্দ্র পোষ্টমাষ্টার ও মুখোপাধ্যায়ের মুখের দিকে পৰ্য্যায়ক্রমে মিনতিপূর্ণ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল। পোষ্টমাষ্টার বিনা বাক্যব্যয়ে ডাকের ব্যাগ কাটিতে নিযুক্ত রহিলেন।
মুখোপাধ্যায় তখন চশমাটি পরিয়া, বিজ্ঞাপনের কাগজখানি চোখের সম্মুখে ধরিয়া পড়িতে লাগিলেন।
বঙ্গসাহিত্যে যুগান্তর
অচিন্তিতপূর্ব অভাবনীয় স্বপ্নাতীত
নূতন কাণ্ড
ইত্যাদি। পাঠশেষে মুখোপাধ্যায় বলিলেন, পয়লা আশ্বিন বেরুবে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
যদি কিছু মনে না করেন ত একটা কথা বলি। –বলিয়া মুখোপাধ্যায় মুখখানি গম্ভীর করিয়া রহিলেন। তাঁহার ভাবটা যেন–-উঃ কলিকালে কি সব অনাচার আরম্ভ হইল!
কি?
মাসের পয়লা তারিখটে ত ভাল দিন নয়, অগস্ত্য–যাত্রা কিনা!
খগেন্দ্র হাসিয়া বলিল, আজ্ঞে সেই জন্যেই ত ঐ তারিখে বের করা।
মুখোপাধ্যায় একটা দ্বিধায় পড়িয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি রকম?
অগস্ত্য-যাত্রায় যে বেরোয় সে আর ফেরে না–এই শাস্ত্র ত?
হ্যাঁ।
আমার বইখানি, ১লা তারিখে অগস্ত্য–যাত্রায় বেরিয়ে, সবগুলি বিক্রী হয়ে যায়–পাঁচ সাত বছর পরে বইওয়ালাদের আলমারি থেকে, দপ্তরী মিঞার গুদাম থেকে দাগী হয়ে পোকায় কাটা অবস্থায় আমার বাড়ীতে আর ফিরে না আসে–সেই আমার কামনা। –বলিয়া খগেন্দ্র যোড়হস্ত হইয়া মুখোপাধ্যায়ের পানে চাহিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল।
লোকটির সরস কথাবার্তা ও বিনীতভাব দেখিয়া মুখুয্যে মহাশয় প্রীত হইলেন। বলিলেন–তা এখানে কি মাল মশলা সংগ্রহ করবেন?
ঘোড়ার গাড়ীতে সহযাত্রিগণের নিকট হইতে খগেন্দ্র কিছু কিছু সংবাদ সংগ্রহ করিয়াছিল। বলিল–শুনেছি আপনাদের জমিদার রায় মশায়েরা খুব বনিয়াদি বংশ। সারদাবাবুর বংশের একটি বংশের একটি ইতিহাস–বেশী নয় এই পাতা দুই–আর তার একটু জীবনচরিত–ধরুন এই পাতা চার পাঁচ–সংগ্রহ করতে হবে। তার কাছে কখন গেলে দেখা পাওয়া যেতে পারে?
এই সময় একব্যক্তি পোষ্টকার্ড কিনিতে আসিল, তাহার হাতে খগেন্দ্র একখানি বিজ্ঞাপন দিল। মুখোপাধ্যায় উত্তর করিলেন, সকালে আটটা নটার পর প্রায়ই বাবু বৈঠকখানায় বসেন, সেই সময় যাওয়াই সুবিধা। আপনি আছেন ক দিন?
দিন চার পাঁচ থাকতে হবে। আসেপাশের গ্রামগুলোতেও গিয়ে গিয়ে বিজ্ঞাপন বিলি করব। এখানে একটা বাড়ী-টাড়ী ভাড়া পাওয়া যাবে না?
বাড়ী? এখানে ভাড়ার বাড়ী কোথায় পাবেন? এ কি মশায় আপনার কলকাতা সহর?
পোষ্টমাষ্টারবাবু ডাক পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, কই, কৃষ্ণদাসবাবুর বঙ্গবাসী ত আজ আসেনি।
মুখোপাধ্যায় বলিয়া উঠিলেন, আঁ!–আসেনি?
না। কেবল সারদাবাবুর বেঙ্গলী এসেছে। আর কারু কোনও কাগজ আসেনি।
ইংরাজি-অনভিজ্ঞ মুখোপাধ্যায় মহাশয় ভারি হতাশ হইয়া পড়িলেন। বলিলেন–আসেনি? –তাই ত!
খগেন্দ্র বলিল, আপনি কি এবারকার বঙ্গবাসী খুঁজছেন?
হ্যাঁ। আছে?
আছে। বঙ্গবাসী আছে, বসুমতী আছে, হিতবাদীও আছে–কাল আসবার সময় গাড়ীতে সময় কাটাবার জন্যে হ্যারিসন রোডের মোড়ে এক একখানা বিনেছিলাম যে।
মুখোপাধ্যায় যেন কত কৃতার্থ হইয়া বলিলেন, আছে? আছে? কই?
আমার ট্রাঙ্কে আছে। –বলিয়া খগেন্দ্র বাক্স খুলিয়া কাগজ তিনখানি বাহির করিয়া মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের হস্তে দিল। পাইয়া তাঁহার মুখে হাসি আর ধরে না। বলিলেন–দেখ, একেই বলে, যব মালিক দেতা তব ছাপ্পর ফোড়কে দেতা হায়। –একখানি কাগজের জন্যে আকুলি বিকুলি করেছিলাম–একেবারে তিন তিনখানা। আঁ!–তা ভায়া, এ কাগজগুলি আমি এখন বাড়ী নিয়ে গিয়ে পড়িগে। কেমন? পড়ে তোমায় দেব। তুমি কোথায় থাকবে?
খগেন্দ্র বলিল, কোথায় থাকব–তাই ত ভাবছি। ভাড়ার বাড়ী পাওয়া যায় না বললেন–
মুখোপাধ্যায় দাঁড়াইয়া উঠিয়াছিলেন। বলিলেন–হয়েছে। সে ঠিক হবে এখন। ভায়া, তুমি যে রকম সজ্জন ব্যক্তি, আমার বাড়ীতেই তোমায় নিয়ে যেতাম। আমার বৈঠকখানায় একটি মোটে ঘর, আবার কদিন হল আমার ভাগ্নীজামাইটি এসেছে, সঙ্গে তার একটি বন্ধুও আছে। সেখানে থাকতে তোমার কষ্ট হবে। ঐ যে গাছগুলো দেখছ–ঐ–ঐগুলোর আড়ালে একটা সাদা মত বাড়ী দেখা যাচ্ছে, ঐটি আমাদের ইস্কুলঘর। আমি ইস্কুল কমিটির একজন মেম্বর। মাইনর ইস্কুল, বেশ ভাল রেজাল্ট হয়, গত বৎসর একটি ছেলে পাস করে চার টাকা জলপানি পেয়েছে। তা এখন গ্রীষ্মের বন্ধ, ইস্কুল নেই, চল ইস্কুলে একটা ঘর আমি তোমায় ঠিক করে দিচ্ছি। ঐখানে থাকবে, আর আমার বাড়ীতে গরীবের ক্ষুদকুঁড়ো যা জোটে চারটি চারটি খাবে। আমিও ব্রাহ্মণ–আমার নাম শ্রীরামতারণ মুখোপাধ্যায়। –বলিয়া তিনি ব্রাহ্মণত্বের প্রমাণ স্বরূপ, হাতকাটা পিরাণটির বোতামগুলি পটাপট খুলিয়া যজ্ঞোপবীত বাহির করিয়া দেখাইলেন।
খগেন্দ্র তাহাকে নমস্কার করিল ৷ বলিল–বেশ ত আমি ইস্কুলে থাকব এখন, কিন্তু খাওয়া সম্বন্ধে আপনাকে কষ্ট দেওয়া–
মুখোপাধ্যায় বাধা দিয়া বলিলেনকিছু কষ্ট নয়। আমি ত আর তোমায় কালিয়ে পোলাও কাবাব কো খাওয়াচ্ছিনে–সে সব এ পাড়াগাঁয়ে পাবই বা কোথায়? আমরা যেমন খাই সেই রকম ডাল–ভাতই খাওয়াব। আমাদের কোনও কষ্ট নেই তবে তোমার কষ্ট হতে পারে বটে।
খগেন্দ্র বলিল, আমিও ত ডাল–ভাতই খেয়ে থাকি মশায়। রোজ রোজ কালিয়া পোলাও আর পাব কোথা? আমিও গরীব মানুষ–নইলে আর বই ছাপাচ্ছি কেন? পেটের দায়েই ত ছাপাচ্ছি।
আচ্ছা তবে চল। একটা ঘর খালি করে দেব এখন। বিছানা ত তোমার সঙ্গেই রয়েছে। খান তিন চার বেঞ্চি একত্র করে নিলেই তক্তপোষের কায হবে। ইস্কুলে দরোয়ান আছে, জেতে কৈবর্ত, তোমার জলটা আসটা এনে দিতে পারবে। আমার বাড়ীও বেশী দূরে নয়–এস।
একজন লোক ডাকিয়া বাক্স বিছানা তাহার মাথায় দিয়া খগেন্দ্রকে লইয়া মুখুজ্যে মহাশয় অগ্রবর্তী হইলেন।
পথে যাইতে যাইতে ভদ্র বেশধারী যাহাকে দেখিল, তাহাকেই খগেন্দ্র একখানি করিয়া বিজ্ঞাপন বিলি করিল।
স্কুলঘরে পৌঁছিয়া সমস্ত ঠিকঠাক করিয়া দিয়া মুখোপাধ্যায় বলিলেন, এখন তবে আমি চলোম। ভাত চড়িয়ে দিতে বলিগে। ভাত হলেই ডেকে পাঠাব এখন।
খগেন্দ্র বলিল অসময়ে এখন আর সে ভাত খাইবে না। একেবারে রাত্রে যথাসময়ে আহার করিবে।
মুখোপাধ্যায় বলিলেন, বেশ। সন্ধ্যার পর হ্যারিকেন নিয়ে আমার ছেলে আসবে এখন। তার সঙ্গে যাবে। এখন তবে আসি।
খগেন্দ্র বলিল, আপনাকে অনেক কষ্টই দিলাম। আর একটা উপকার যদি করেন।
কি?
অনেকগুলো কাপড় ময়লা হয়ে গেছে। কলকাতা থেকে আসবার সময় ধোপা বেটাও এসে পৌঁছল না–এখানে ভাল ধোপা আছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, এখানে ধোপা আছে একজন, তার নাম নীলমণি। নামেও নীলমণি কাযেও নীলমণি।
কি রকম?
সবে ধন নীলমণি। কাপড় নেহাৎ মন্দ কাঁচে না। তবে তোমাদের কলকাতার ধোপার মত কি পারবে?
তা হোক–এখন কায–চলা গোছ হলেই হল। অনুগ্রহ করে সেই নীলমণিকে যদি খবর দেন।
আচ্ছা, বাড়ী গিয়েই তাকে ডাকিয়ে পাঠাচ্ছি। আসি তবে। –বলিয়া দুর্লভ রত্নের মত সেই সংবাদপত্রগুলি হস্তে করিয়া মুখোপাধ্যায় গৃহাভিমুখে চলিলেন।
খগেন্দ্র ষ্টোভ জ্বালিয়া চায়ের জন্য জল চড়াইয়া দিল। রুটি, মাখন, পটে মীট তাহার টিফিন–বাক্সেই ছিল।
০৬. নব্য দারোগাবাবু
তিনটি দিন কাটিল। এ তিনদিন খগেন্দ্র অদম্য উৎসাহে বঙ্গসাহিত্যে–যুগান্তরের বিজ্ঞাপন বিলি করিতেছে, ভদ্র শূদ্র ছোট বড় অনেক লোকের সহিত মিশিয়াছে–কয়েকটি আড্ডাতে গিয়াও বসিয়াছে। এখনও জমিদার সারদা–চরণবাবুর সহিত সাক্ষাৎ হয়। নাই–তাহার শরীর অসুস্থ। তাঁহার স্বমুখে জীবনচরিত শ্রবণ করিবার অছিলায় খগেন্দ্র বিলম্ব করিতে লাগিল। এ তিন দিনে সে দুইটি তথ্য আবিষ্কার করিয়াছে। প্রথম, গত মাঘ মাস হইতে জমিদারবাবুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা নীবনচন্দ্র এবং কৃষ্ণদাস ঘোষালের যুবতী কন্যা লীলাবতী নিরুদ্দেশ, দ্বিতীয়তঃ যে দিন হইতে ইহারা নিরুদ্দেশ, তাহার পূৰ্ব্ব রাত্রে এই গ্রামের দুলেদের সৈরভির মাকে নবীনবাবুর সহিত গাজনতলার হাটের নিকট একত্র দেখা গিয়াছিল। নবীনচন্দ্রের বয়স আকার প্রকার প্রভৃতি সম্বন্ধেও খগেন্দ্র অনুসন্ধান করিয়াছে। ফলে, তাহার মনে একটা ধারণা জন্মিয়াছে, গঙ্গায় ভাসিয়া আসা সেই সুরবালা লীলাবতী ভিন্ন আর কেহই নহে এবং নবীনচন্দ্রই ভবেন্দ্ৰ সাজিয়া বাশুলিপাড়ায় জমিদারী করিতেছে। এসব এখনও অনুমানমাত্র। তেমন বিশ্বাসজনক প্রমাণ খগেন্দ্র এখনও কিছুই পায় নাই। এমন কি নীলমণি রজককে শাড়ীর সেই ছিন্ন প্রান্তটুকু দেখাইবার অথবা সৈরভির মাতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিবার সুযোগও তাহার হইতেছিল না।
এ কয়দিন মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের গৃহেই খগেন্দ্র দিবাভাগে আহার করিয়াছিল। রাত্রে দোকান হইতে গরম গরম লুচি এবং আলু বেগুন ভাজাইয়া আনিয়া তাহাই খায়। এ সপ্তাহের বঙ্গবাসী সঞ্জীবনী হিতবাদী ও বসুমতী–এই চারিখানি সংবাপত্র বাহির হইবামাত্র পাঠাইয়া দিবার জন্য খগেন্দ্ৰ কলিকাতায় পত্র লিখিয়া দিয়াছে–মুখোপাধ্যায়ও দিবস গণনা করিতেছেন।
চতুর্থ দিন দ্বিপ্রহরে আহারাদি করিয়া খগেন্দ্র পোষ্ট আপিসে গেল, কলিকাতা হইতে আর এক প্যাকেট বিজ্ঞাপন ছাপিয়া আসিবার কথা ছিল। ডাকবাবু সেইমাত্র আহার করিয়া পাণ চিবাইতে চিবাইতে বাহির হইয়া আসিতেছেন। ডাকগাড়ী আসিবার এখনও বিলম্ব আছে–দুইজনে বসিয়া গল্পগুজব করিতে লাগিলেন। ইতিমধ্যে গাজনতলা থানার দারোগাবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
দারোগাবাবু যে–আসুন আসুন–ওরে, আপিসের ভিতর থেকে বড় চেয়ারখানা বের করে আন্। –বলিতে বলিতে ডাকবাবু দাঁড়াইয়া উঠিলেন। একজন রাণার গিয়া ঘোড়ার লাগাম ধরিল। দারোগাবাবু নামিয়া আসিলেন।
খগেন্দ্র দেখিল, দারোগাবাবুটির বয়স অল্প–চতুর্বিংশতির অধিক হইবে না। সরকারী খাকী পোষাকটার জন্যই একটু ভীষণ দেখাইতেছে, নতুবা হাস্যবদন প্রিয়দর্শন যুবক।
ডাকবাবু বলিলেন, এখন আসছেন কোথা থেকে?
নিকটেই একটা গ্রামে গিয়েছিলাম–একটা তদন্ত ছিল। –বলিয়া খাকী পোষাকের পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া দারোগাবাবু ললাট ও হস্তদ্বয় হইতে ঘৰ্ম্মজল অপনোদন করিতে লাগিলেন।
আহারাদি এখনও হয়নি বোধ হয়?
না।
এইখানেই স্নানটান করুন না–চারটা ভাত চড়িয়ে দিতে বলি।
দারোগাবাবু বিনীত হাস্যের সহিত বলিলেন, না না–সে সব কায নেই। বড় তেষ্টা পেয়েছে–এক গেলাস ঠাণ্ডা জল যদি আনিয়ে দেন।
জল? –কেন তার চেয়ে খানিকটে সরবৎ–বেশ করে নেবু দিয়ে।
আবার অত কষ্ট করবেন?
কিছু কষ্ট না। আমি বাড়ীতে বলে আসি। –খগেনবাবু ততক্ষণ আপনি দারোগাবাবুর সঙ্গে আলাপ করুন। –বলিয়া ডাকবাবু অদৃশ্য হইলেন।
দারোগাবাবু খগেনের দিকে চেয়ারখানি ফিরাইয়া বলিলেন, আপনার পুরো নাম কি?
খগেন্দ্র নাম বলিল।
দারোগাবাবু বলিলেন, আমার নাম শ্রীঅবনীমোহন মিত্র। আপনাকে ত কখনও দেখিনি!
আমি আজ চারদিন মাত্র এখানে এসেছি। আপনি কতদিন আছেন?
আমি? দুবছর হল। প্রথম দারোগাগিরিতে পাকা হয়েই এখানে এসেছি।
এই প্রকার কথোপকথন হইতে হইতে ডাকবাবু ফিরিয়া আসিলেন। বলিলেন–সরবৎ করে আনছে। খগেন্দ্রবাবুর সঙ্গে আলাপ হল? দিন না খগেন্দ্রবাবু, আপনার একখানা বিজ্ঞাপন দারোগাবাবুকে দিন। ইনি সেকালের মুখ্যু দারোগা নন–নব্যতন্ত্রের দারোগা–রীতিমত লেখাপড়া জানা লোক, বি–এ ফেল।
খগেন্দ্র বলিল, বিজ্ঞাপন আর নেই। আজ ডাকে আসবার কথা আছে।
দারোগাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, কি বিজ্ঞাপন মশায়?
ডাকবাবু বলিলেন, উনি যে একখানা বই ছাপাচ্ছেন।
দারোগা বলিলেন, কি? আপনি গ্রন্থকার? কাব্য না উপন্যাস?
খগেন্দ্র হাসিয়া বলিল, কাব্যও নয় উপন্যাসও নয়। বরং কতকটা ইতিহাসের ধরণের–বঙ্গীয় জমিদার–চরিতমালা।
পোষ্ট মাষ্টারের ভৃত্য একটি গেলাসে লেবুর সরবৎ আনিয়া দাঁড়াইল। দারোগাবাবু তাহা পান করিয়া সুস্থ হইয়া বলিলেন–আঃ।
খগেন্দ্র পকেট হইতে নিজের পাণের ডিবাটি বাহির করিয়া, খুলিয়া দারোগাবাবুর সম্মুখে ধরিল
দারোগা বলিলেন, থ্যাঙ্কস। আমি পাণ খাইনে।
খগেন্দ্র বলিল, সে কি মশায়, পাণ খান না কি রকম? পাণ খাওয়াই হল পুলিশের প্রধান কাৰ্য্য।
ডাকবাবু হাসিয়া বলিলেন, না–আমাদের দারোগাবাবু এ পাণও খান না সে সব পাণ–টানও খান না। গভর্ণমেন্ট এইসব লেখাপড়া জানা ভদ্রলোক পুলিশে ঢুকিয়ে ডিপার্টমেন্টটাই মাটি করে ফেললে!–বলিয়া তিনি হা হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন। একটু থামিয়া বলিলেন–কে একজন পয়সা–কড়ির অভাবে কোন্ দারগাকে পাণ খাবার জন্যে একটি বাছুর দিয়েছিল না?
দারোগাবাবু বলিলেন, হ্যাঁ–সে একটা পুরোনো গল্প আছে বটে।
এমন সময় ডাকগাড়ীখানি আসিল। খগেন্দ্রের নামে একতাড়া বিজ্ঞাপন ছাপিয়া আসিয়াছিল, প্যাকেট খুলিয়া খগেন্দ্র দারোগাবাবুকে একখানি দিল।
দারোগাবাবু সেখানি মনোযোগের সহিত পাঠ করিয়া, একটু খুঁটিনাটি ভাবেই খগেন্দ্রের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। এখানে কতদিন আসা হইয়াছে, আর কতদিন থাকা হইবে, এ কয়দিনে কায কতদূর অগ্রসর হইল–ইত্যাদি। প্রস্তাবিত পুস্তক সম্বন্ধেও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। অবশেষে বলিলেন–ইচ্ছা করেন ত খানকতক বিজ্ঞাপন আমাকে দিতে পারেন। গাজনতলায় অনেক লোকজন আসে–থানায়, পোষ্ট আপিসে, ইস্কুলে–এই রকম জায়গায় টাঙ্গিয়ে দেওয়াব এখন। –বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
দারোগাবাবুকে বহু ধন্যবাদ দিয়া খগেন্দ্র তাঁহার হাতে একগোছা বিজ্ঞাপন দিল। সেগুলি পকেটে লইয়া, পোষ্ট মাষ্টারকে অভিবাদনান্তর তিনি ঘোড়া ছুটাইয়া দিলেন।
০৭. জমিদার গৃহে
তিনদিন পরে সংবাদ আসিল, সারদাবাবু একটু ভাল আছেন, আজ বিকালে খগেন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিবেন।
নিজে সঙ্গে করিয়া বাবুর নিকট লইয়া যাইবেন, পূৰ্ব্ব হইতে মুখোপাধ্যায় মহাশয় খগেন্দ্রকে আশ্বাস দিয়া রাখিয়াছিলেন। কিন্তু আজ ডাকে তিন–তিনখানি সংবাদপত্র আসিয়াছে। মুখোপাধ্যায় যুদ্ধকাহিনী পাঠে এমন মশগুল হইয়া পড়িলেন যে তাঁহার আর মাথা তুলিবার অবকাশ নাই; সুতরাং বেলা চারিটার সময় খগেন্দ্র একাকীই জমিদার বাটী অভিমুখে যাত্রা করিল। ইতিমধ্যে লোকমুখে শুনিয়া সারদাবাবুর জীবন–চরিত কতকটা লিখিয়া রাখিয়াছিল, সে কাগজগুলি সঙ্গে করিয়া লইল।
দ্বিতলের একটি সুপ্রশস্ত কক্ষে বাবুর বৈঠকখানা। মেঝের উপর ফরাস বিছানা পাতা রহিয়াছে। মধ্যস্থলে পুরু গালিচার উপর তাকিয়া হেলান দিয়া বাবু উপবিষ্ট। রূপার গুড়গুড়িতে বিষ্ণুপুরের সুগন্ধি তামাক পুড়িতেছে, নলটি হাতে করিয়া বাবু পাত্রমিত্রগণের সহিত গল্প করিতেছেন–মধ্যে মধ্যে ধুমপানও করিতেছেন। ভিত্তিগাত্রে কয়েকখানি বিলাতী ছবি–দুইখানি বৃহদাকার দর্পণ এবং একটি মাৰ্ব্বেল পাথরের ক্লকঘড়ী শোভা পাইতেছে। খগেন্দ্র সেখানে নীত হইয়া নমস্কার করিয়া দাঁড়াইল।
বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনারই নাম খগেন্দ্রবাবু?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আসুন। বসুন। এ কদিন আমার শরীরটে বড়ই খারাপ ছিল, তাই আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎও করতে পারিনি, আপনার কোনও তত্ত্বও নিতে পারিনি। শুনলাম আমাদের ইস্কুল ঘরেতে আপনি আছেন, কোনও কষ্ট হচ্ছে না ত?
আজ্ঞে না–কোনও কষ্ট হয়নি, বেশ আছি। –বলিয়া খগেন্দ্র বিনীতভাবে সারদাবাবুর পানে চাহিল।
বাবু দুই চারি টান ধুমপান করিয়া বলিলেন, আপনার বাড়ী কলকাতাতেই বুঝি? আপনার বিজ্ঞাপনটি পড়লাম। আপনি বই বের করছেন–বঙ্গীয় জমিদার–চরিতমালা। কেমন?
খগেন্দ্র মাথা নোয়াইয়া অনুচ্চস্বরে বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
সারদাবাবু ওষ্ঠযুগল গুটাইয়া, মাথাটি একদিকে হেলাইয়া চক্ষু ঘুরাইয়া বলিলেন, বঙ্গীয় জমিদার–চরিতমালা। মালা! মালা!
পারিষদগণ এই ভঙ্গী দেখিয়া বুঝিল বাবু শ্লেষ করিতেছেন; কিন্তু শ্লেষের প্রকৃত কারণটি কেহই অনুধাবন করিতে পারিল না। তথাপি তাহারা পরস্পরের প্রতি চাহিয়া চাপা হাসির দৃষ্টি বিনিময় করাটাই সুযুক্তি মনে করিল।
বাবু বলিলেন, মালা!–আচ্ছা মালা কিসের হয় খগেন্দ্রবাবু? ফুলেরই ত হয়?
খগেন্দ্র বলিল, ফুলের হয়–মুক্তার হয়–আরও
বাধা দিয়া বাবু বলিলেন, অর্থাৎ ভাল জিনিষেরই হয়। সুন্দর সুন্দর জিনিষেরই হয়। কেমন কিনা? কিন্তু ধরুন এই ঘঁটে, ছেঁড়া জুতো, তালের আঁটি, ছাই ফেলার কুলো–এমন সব চীজের কি মালা হয় মশায়? আমাদের এই বাঙ্গালা দেশে যত সব জমিদারবাবুরা আছেন, তাঁদের চরিতগুলি কি মালা তৈরী করবার মতন সুন্দর পবিত্র জিনিষ বলে আপনি মনে করেন? –বলিয়া হা হা করিয়া হাসিয়া, বাবু ধূমপানে মনোযোগ করিলেন।
খগেন্দ্র মুহূৰ্ত্তমাত্র চিন্তা করিয়া বলিল, আপনি ঠিক বলেছেন, সুন্দর পবিত্র জিনিষেরই মালা হয়, কুৎসিত জিনিষের হয় না। কিন্তু মালা যে গাঁথে সে নিৰ্বাচনও করে। হাতের কাছে যা পায় তাই নিয়েই গেঁথে ফেলে না। ফুলও ত কত রকমের আছে। গোলাপ, বেল, যুঁই থেকে আরম্ভ করে, ঘেঁটু কাঠমল্লিকা পর্যন্ত। কিন্তু মালীরা বেল যুঁই গোলাপ এই সবগুলিই নিয়ে কায করে। আমিও সেই রকম নির্বাচন করেই এ মালা গাঁথতে বসেছি। এই ধরুন, আমি আপনাকে পূর্বে কখনও চক্ষেও দেখিনি, কিন্তু আপনার সৌরভ, আমি সেই কলকাতায় বসেই পেয়েছি। আপনি এই পাড়াগায়ে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে ফুটে আছেন বটে–কিন্তু সৌরভটুকু লুকোবেন কি করে?
শুনিয়া সারদাবাবু মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন। স্পষ্ট বুঝা গেল, তাঁহার মনটা বেশ খুসী হইয়া উঠিয়াছে। পারিষদগণ প্রশংসমান চক্ষে খগেন্দ্রের পানে চাহিতে লাগিল। একজন বলিল, বাঃ বাঃ অতি সুন্দর উপমাটি হয়েছে। ইনি অতি যথার্থ কথাই বলেছেন। আমাদের বাবুমশায়ের তুল্য গুণবান ভূস্বামী এ অঞ্চলেই নেই।
অতঃপর বিশেষ সহৃদয়তার সহিত বাবু পুস্তকের কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। পাঁচ খণ্ড পুস্তকের গ্রাহক হইতে স্বীকৃত হইলেন। জীবনী সম্বন্ধে, খগেন্দ্র যেটুকু লিখিয়া আনিয়াছিল, তাহা পড়িয়া শুনাইল। বাবু মাঝে মাঝে যে সকল পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করিবার প্রস্তাব করিলেন, খগেন্দ্র সেগুলি নোট করিয়া লইতে লাগিল। দুই তিন বৎসরের পুরাতন একখানি ফোটোগ্রাফ অন্তঃপুরে আছে, সেখানি কল্য প্রাতে খগেন্দ্রকে পাঠাইয়া দিবেন বলিলেন।
অবশেষে খগেন্দ্র বলিল, আপনার কনিষ্ঠ নবীনবাবুর কথা এতে তেমন কিছুই লেখা হয়নি। তার সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে?
বাবু যেন একটু বিরক্ত হইয়া বলিলেন, নবীন? সে ত এখানে নেই।
তিনি কোথায়?
কলকাতায়।
কলকাতা? –তা হলে ত আমি নিজে গিয়েই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারব। তাঁর ঠিকানাটি যদি অনুগ্রহ করে
বাবু বলিলেন, সেদিন তার একখানা চিঠি এসেছে। কি একটা ঠিকানা দিয়েছে। কি ঘোষের লেন লিখেছে ভুলে যাচ্ছি। ওহে মাষ্টার
অন্য কক্ষ হইতে এক ব্যক্তি আসিয়া দাঁড়াইল। সারদাবাবু বলিলেন, ছোটবাবু এবার চিঠিতে যে ঠিকানাটি লিখেছেন, একটি কাগজে সেটি টুকে এই বাবুকে এনে দাও ত।
কাগজখানি লইয়া খগেন্দ্র বলিল, ওদিকে আমি প্রায়ই যাই। কলকাতায় ফিরেই তার সঙ্গে দেখা করব। কাল সকালে তা হলে, মনে করে, ফটোগ্রাফখানি পাঠিয়ে দেবেন। এখন তা হলে আসি। নমস্কার। –বলিয়া খগেন্দ্র প্রস্থান করিল।
০৮. গাছে না উঠতেই এক কাঁদি
বাসায় ফিরিয়া খগেন্দ্র বিমর্ষভাবে চিন্তা করিতে বসিয়া গেল। নবীনচন্দ্ৰ কলিকাতায় রহিয়াছে? তবে ত খগেন্দ্রের সকল অনুমানই মিথ্যা হইয়া যায়! সে জাল ভবেন্দ্র তবে কে? সুরবালাই বা কে? জাল ভবেন্দ্র যদি নবীন না হয়, তাহা হইলে সুরবালার লীলাবতী। হওয়ার সম্ভাবনা কোথায়? আর, সুরবালা যদি বাস্তবিকই লীলাবতী হয়, তবে ভবেন্দ্র নবীনচন্দ্র ছাড়া আর কে হইতে পারে? এ কয়দিন খগেন্দ্র যাহা কিছু সিদ্ধান্ত করিয়াছিল, সমস্তই ওলট পালট হইয়া গেল।
রাত্রে তাহার লুচি ও বেগুনভাজা আসিল বটে, কিন্তু অর্ধেক অভুক্ত পড়িয়া রহিল।
অনেক রাত্রে তাহার হঠাৎ মনে হইল, আমি ত একটা মস্ত ভুল করিয়া বসিয়াছি। সুরবালার পিত্রালয় বা শ্বশুরালয় বসন্তপুরে, শুধু এইটুকুর উপর নির্ভর করিয়া আমি এই পোষ্ট অফিস বসন্তপুরে আসিয়াছি। সুরবালার সে বসন্তপুর যদি এমন কোনও বসন্তপুর হয় যেখানে ডাকঘর নাই?
পরদিন প্রাতে উঠিয়া খগেন্দ্র নীলমণি রজককে ডাকিয়া পাঠাইল। ছিন্ন বস্তুটুকু আজ তাহাকে দেখাইয়া সংশয় ভঞ্জন করিবে। সৈরভির মাতার সহিত কথোপকথনের কি উপায় হয়, তাহাও খগেন্দ্র বসিয়া চিন্তা করিতে লাগিল।
ইতিমধ্যে থানা হইতে একজন কনেষ্টবল, দারোগাবাবুর একখানি পত্র আনিয়া খগেন্দ্রকে দিল। দারোগাবাবু লিখিয়াছেন, বিজ্ঞাপনগুলি পাঠ করিয়া অনেকেই পুস্তকখানির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিতেছেন, খগেন্দ্রবাবু যদি আসিয়া দুই চারিদিন গাজনতলায় থাকেন, তবে কিছু গ্রাহক সংগ্রহ হইতে পারে।
দারোগাবাবুকে ধন্যবাদ দিয়া খগেন্দ্র লিখিয়া দিল, শীঘ্র একদিন গিয়া সে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবে। কনেষ্টবল পত্র লইয়া চলিয়া গেল। ধোপাবাড়ী হইতে লোক ফিরিয়া বলিল–বাবুর বস্ত্রাদি এখনও প্রস্তুত হয় নাই। প্রস্তুত করিয়া বিকালে নীলমণি লইয়া আসিবে।
সারাদিন কাটিল। বিকালে গাজনতলা থানা হইতে একজন কনেষ্টবল, দারোগাবাবুর দ্বিতীয় পত্র লইয়া পৌঁছিল। তিনি লিখিয়াছেন, আগামী কল্য প্রাতে দুইজন বড় জমিদার থানায় আসিবেন–তাঁহারা অনেক খণ্ড পুস্তকের গ্রাহক হইবেন আশা আছে। অতএব, কল্য বেলা নয়টা দশটার মধ্যে খগেন্দ্র নিশ্চয়ই যেন থানায় যায়। কোনও মতে অন্যথা না হয়–পত্র পড়িয়া খগেন্দ্র কনেষ্টবলকে বলিল, তুমি বাইরে একটু বস। আমি চা খেয়ে জবাব লিখে দিচ্ছি। –কনেষ্টবল গিয়া বাহিরে বসিল।
খগেন্দ্র চা পান করিতেছে, এমন সময় নীলমণি রজক ধৌত–বস্ত্রের মোট কাঁধে করিয়া প্রবেশ করিল।
বস্ত্র মিলাইয়া খগেন্দ্র বলিল, ওহে রজক, এই টুকরোটি দেখ দেখি। এর কোণে এই যে চিহ্ন রয়েছে, এটি কি তোমার দেওয়া চিহ্ন?
টুকরাটি হাতে করিয়া নীলমণি চিহ্ন দেখিল। বাহিরে চাহিয়া দেখিল কনেষ্টবল বৃক্ষতলে বসিয়া আছে। সন্দিগ্ধভাবে খগেন্দ্রের মুখপানে সে চাহিতে লাগিল।
খগেন্দ্র বলিল, এ চিহ্ন তোমার দেওয়া ত? এ কার বাড়ীর চিহ্ন সেইটি আমি জানতে চাই।
শাড়ীর পাড়টিও নীলমণি চিনিয়াছিল–উহা কৃষ্ণদাস ঘোষালের নিরুদ্দিষ্ট কন্যা লীলাবতীর। তাহার সম্বন্ধে গ্রামে যে সব গুজব আছে, তাহাও সে বিলক্ষণ জানিত। সুতরাং মনে মনে প্রমাদ গণিল। ঢোক গিলিয়া বিকৃত কণ্ঠে বলিল–আজ্ঞে এ মার্কা–কার তা কি করে বলব? –আপনি এ পেলেন কোথায়?
খগেন্দ্র বিরক্ত স্বরে বলিল, যেখানেই পাই, তোমার সে খোঁজে কায কি? যা জিজ্ঞাসা করি তার উত্তর দাও না।
নীলমণি হাতজোড়া করিয়া বলিল, আজ্ঞে–আজ্ঞে–আমি গরীব মানুষ।
খগেন্দ্র রাগিয়া উঠিল। কঠোরস্বরে বলিল–আ মর বেটা! তুই গরীব কি তালেবর তা কে জিজ্ঞাসা করছে? তোর দেওয়া মার্কা কি না সত্যি করে বল।
ধমক খাইয়া নীলমণি কাঁপিতে আরম্ভ করিল। কাতরস্বরে বলিল–বাবুমশায়, কি হয়েছে?
খগেন্দ্র হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, খুন হয়েছে।
নীলমণি কাঁদ কাঁদ হইয়া বলিল, অ্যাঁ–অ্যাঁ? দিদিঠাকরুণকে খুন করেছে?
খগেন্দ্র যাহা জানিতে চাহিয়াছিল, তাহা জানিল। তথাপি কৃতনিশ্চয় হইবার জন্য জিজ্ঞাসা করিল, হ্যা খুন করেছে। তোমাদের দিদিঠাকরুণের নাম কি বল দেখি?
নীলেবতী। ঘোষালদের মেয়ে নীলেবতী দিদি। আহাহা, কে খুন করলে বাবুমশায়?
খগেন্দ্রের মনের সকল সন্দেহ দূর হইল। একটু রঙ্গ করিবার অভিপ্রায়ে বলিল, কে আর খুন করবে? তোমাদের জমিদারের ভাই।
ছোটবাবু? –আহাহা!–তা আমরা সেই কালেই জানি। তা বাবুমশায়, কি হবে এখন? আপনি কি ফুলুস?
খগেন্দ্র গম্ভীরভাবে বলিল, হ্যাঁ–আমি পুলিশের ডিটেকটিভ।
আজ্ঞে কি বললেন?
ডিটেকটিভ ডিটেকটিভ–তোরা যাকে টিকটিকি বলিস। –বলিয়া খগেন্দ্র নিজের গোঁফযোড়াটি মুচড়াইতে লাগিল।
নীলমণি বাহিরে কনেষ্টবলের পানে আবার চাহিয়া দেখিল। শেষে খগেন্দ্রের পা দুইটি জড়াইয়া ধরিয়া কাতরস্বরে বলিল, দোহাই হুজুর–আমি গরীব মানুষ–কিছু জানিনে। আমায় যেন সাক্ষীর ফেসাদে ফেলবেন না। বরং হুজুরের কাপড় যা কেচেছি তার দাম চাইনে–সে টাকাটা হুজুরের পাণ খাবার জন্যে দিলাম। দোহাই টিকটিকিবাবু, দয়া করুন।
খগেন্দ্র হাসিয়া বলিল, আচ্ছা–যা যা। এসব কথা খবর্দার কাউকে যেন বলিসনে।
নীলমণি নিজের দুই কাণ ধরিয়া মর্দন করিতে করিতে বলিল, কখনই না হুজুর–কাউকে বলব না–জিভ্যে কেটে ফেললেও না। –বলিয়া সে প্রস্থান করিল।
বাহির হইয়া নীলমণি ধীরপদে অগ্রসর হইল। পশ্চাতে চাহিতে চাহিতে ঘুরপথ দিয়া, একেবারে জমিদার–বাটির খিড়কী দ্বারে উপস্থিত। ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, সারদাবাবু বারান্দায় বসিয়া সায়ংসন্ধ্যা করিবার জন্য হস্তপদাদি প্রক্ষালন করিতেছেন।
নীলমণি ধপাস্ করিয়া উঠানে বসিয়া পড়িয়া বলিল, হুজুর মা বাপ–আপনার অন্নেই প্রতিপালিত হয়েছি, একটা খবর দিতে এলাম–বড়ই বিপদ।
সারদাবাবু বলিলেন, কি রে নীলমণি, কি হয়েছে?
ক্রন্দনের স্বরে নীলমণি বলিল, আজ্ঞে–খুনী মামলা। গাঁয়ে, ফুলুসের কি বলে, সেই তাই এসেছে।
আশ্চর্য্য হইয়া সারদাবাবু বলিলেন, কি এসেছে রে? ব্যাপার কি? পুলিশের কি এসেছে?
আজ্ঞে নামটা ভুলে গেলাম হুজুর। সেই যে দেওয়ালে পাঁচিলে বেড়ায়, মাথা নাড়ে, ন্যাজ নাড়ে।
সারদাবাবু অধিকতর আশ্চর্য্য হইয়া বলিলেন, মাথা নাড়ে ন্যাজ নাড়ে কি বলছিস রে? ক্ষেপে গেলি নাকি?
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নীলমণি বলিল, আজ্ঞে ক্ষেপে যাওয়ারই দাখিল। হ্যাঁ মনে পড়েছে–টিকটিকি। ফুলুসের টিকটিকি গায়ে এসেছে। –বলিয়াই স্কুলঘরে যাহা কিছু ঘটিয়াছিল, সমস্তই নীলমণি বৰ্ণনা করিল। শেষে করযোড়ে বলিল–এ খবরটি যে আমি দিলাম, সেটা যেন প্রকাশ না হুজুর–তা হলে গরীব মারা যাবে। চিরকাল নুন খেয়েছি, সেটা ভুলতে না পেরেই খবরটা দিয়ে গেলাম। ছোটদাদা ঠাকুরের প্রাণ বাচাবার জন্যে যা করতে হয় তা করুন। এখন প্রণাম হই।
নীলমণি চলিয়া গেলে সারদাবাবুর সায়ংসন্ধ্যা করা ঘুরিয়া গেল। পোষ্ট আপিসে দারোগার সহিত খগেন্দ্রের সাক্ষাৎ হওয়া, অদ্য প্রাতে থানা হইতে তাহার নিকট কনেষ্টবল আসা সারদাবাবু শুনিয়াছিলেন। নবীনের কলিকাতার ঠিকানা জানিবার জন্য খগেন্দ্র যে ব্যগ্রতা প্রকাশ করিয়াছিল, তাহাও মনে পড়িল। সুতরাং নীলমণির দেওয়া সংবাদ অবিশ্বাস করার কোনই কারণ পাইলেন না। দ্বিতলের উপরে উঠিয়া জননী ভগিনী প্রভৃতির সহিত কিয়ৎক্ষণ গোপন পরামর্শ করিলেন। অবশেষে বৈঠকখানায় আসিয়া একজন বিশ্বস্ত কর্মচারীকে ডাকিয়া পাঠাইলেন।
অল্পক্ষণ পরামর্শের পর, রাত্রি নয়টার সময়–কর্মচারী বাহির হইয়া গেল। অর্ধঘণ্টা পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল–সে ত পাঁচ হাজারের কম কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। বলছে খুনের বিশিষ্ট প্রমাণ তার হাতে আছে–কেবল স্ত্রীলোকটি কে, সেইটুকু জানতে বাকী ছিল, তাও এখানে এসে জেনেছে। বললে এখন অর্ধেক টাকা–আড়াই হাজার দাখিল করতে হবে–প্রমাণ অভাবের খাতেমা রিপোর্ট দিয়ে বাকী আড়াই হাজার নেবে।
সারদাবাবু অন্তঃপুরে গিয়া আবার পরামর্শ করিলেন। একটা পুঁটুলিতে, দশ টাকার নোটে গিনিতে আড়াই হাজার টাকা বাঁধিয়া আনিয়া কর্মচারীর হস্তে দিলেন।
গভীর রাত্রে খগেন্দ্র টাকাগুলি গণিয়া লইয়া, কর্মচারীকে অভয় দিয়া বিদায় করিল। শয়ন করিয়া আপন মনে হাসিতে লাগিল, আর বলিতে লাগিল, একেই বলে গাছে না উঠতেই এক কাঁদি।
০৯. বন্ধুলাভ
অনেক রাত্রি অবধি খগেন্দ্র ঘুমাইল না। সে মনে এই প্রকার চিন্তা করিতে লাগিল–যখন এতদূর অগ্রসর হইয়াছি, তখন কোন মতেই ছাড়া হইবে না–ঐ জাল ভবেন্দ্র যে কে তাহা আবিষ্কার করিতেই হইবে। পূর্বে মনে করিয়াছিলাম, সে নবীন নহে–কিন্তু ইহা ঠিক কি? কলিকাতা হইতে একখানা চিঠি আসিয়াছে, তাহাতে ঠিকানাটা দেওয়া আছে, কেবলমাত্র এইটুকু হইতেই কেন সিদ্ধান্ত করিব যে নবীন বাশুলিপাড়ায় গিয়া ভবেন্দ্র সাজে নাই। আমি ত এই বসন্তপুরে রহিয়াছি; কলিকাতার ঠিকানা দিয়া কাহাকেও একখানা চিঠি যদি লিখি–অপর খামের মধ্যে তাহা ভরিয়া যদি কলিকাতায় কোনও বন্ধুর নিকট পাঠাইয়া দিই এবং তাহাকে ঐখানি ডাকবাক্সে ফেলিয়া দিতে বলি–তাহা হইলে কি প্রমাণ হয়? কিছুই না। সুতরাং এবার কলিকাতায় গিয়াই অনুসন্ধান করিতে হইবে–ঐ ঠিকানায় নবীন যথার্থ বাস করে কিনা। আচ্ছা–যদি গিয়া দেখি–নবীন সেখানে সশরীরে বর্তমান আছে–তাহা হইলে কি করিব? এই লীলাবতী এখান হইতে কোথা দিয়া কোথায় কোথায় গেল, কি করিল, সেই সমস্ত অনুসন্ধান করিলেই জাল ভবেন্দ্রের আসল পরিচয় পাওয়া যাইবে। সেটা এখান হইতে সারিয়াই যাওয়া কর্তব্য। সৈরভির মাকে জিজ্ঞাসা–বাদ্র করিতে হইবে। কিন্তু সে প্রকৃত কথা বলিবে কি? –লীলাবতী খুন হইয়াছে, আমি ডিটেকটিভ এখানে তদন্তে আসিয়াছি, একথা কল্য গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া যাইবে সন্দেহ নাই। সুতরাং সৈরভির মার কাছে কোনও কথা বাহির করা শক্ত হইবে। এক, যদি আমি সত্য সত্যই পুলিশ হইতাম, সঙ্গে দুই চারিজন কনেষ্টবল চৌকিদার থাকিত, হাতকড়ি থাকিত, হাজতে বন্ধ করিতে পারিতাম, তাহা হইলে ভয় দেখাইয়া স্তোক দিয়া, কোনও রকমে তাহাকে স্বীকার করাইতে পারিতাম। সে সব কিছুই নাই–আমি হইয়াছি ঢাল নাই তরোয়াল নাই নিধিরাম সর্দার। এখন কি করা যায়?
বিছানা হইতে উঠিয়া খগেন্দ্র আলো জ্বালিল। ঘরের মধ্যে কিয়ৎক্ষণ পায়চারি করিয়া বেড়াইল। বেড়াইতে বেড়াইতে হঠাৎ দারোগার লিখিত শেষ চিঠিখানির উপর তাহার দৃষ্টি পড়িল। সেখানি খুলিয়া খগেন্দ্র আর একবার পাঠ করিয়া শেষে আপন মনে বলিতে লাগিল, এই ত এই ত একজন আসল পুলিশ রহিয়াছে। বাক্সে আমার টাকাও যথেষ্ট রহিয়াছে। টাকায় বশীভূত করিয়া এই দারোগার দ্বারাতেই ত কাৰ্য উদ্ধার করিতে পারিতাম! কিন্তু ইনি যে আবার পাণ খান না–কিয়ৎক্ষণ পদচারণা করিয়া, দীপ নিৰ্ব্বাণ করিয়া খগেন্দ্র আবার শয়ন করিল।
শয়ন করিয়া খগেন্দ্র আবার ভাবিতে লাগিল, পাণ খান না–আবার কবিতা পড়েন। আমি পুস্তক ছাপাইতেছি শুনিয়াই প্রথমে জিজ্ঞাসা করিলেন কাব্য না উপন্যাস। আচ্ছা, এক কায করিলে হয় না? লোকটা ত নব্যতন্ত্রের কলেজ–পড়য়া শুনিলাম। আমি যদি একটি বেশ প্রণয়ের গল্প বানাইয়া উহাকে বলিতে পারি–আমি নিজেই যেন নায়ক–এই রহস্যটি উঘাটন করিতে পারিলেই যেন আমাদের মিলন সম্পন্ন হয়–তাহা হইলে নিশ্চয়ই উহার মন ভিজিবে এবং তাহার কনেষ্টবল হাতকড়ি ও হাজত সমস্ত লইয়া আমায় সাহায্য করিতে অগ্রসর হইবে। এই ঠিক হইয়াছে। এখন গল্পটি কিরূপ তৈয়ারি করা যায়? –ঐ সব কথাই কেবল–একটু উলট পালট–কোথাও বা কিঞ্চিৎ পরিবর্তন, কোথাও বা একটু পরিবর্ধন, আবশ্যক মতে অল্পবিস্তর পরিবর্জন। সে ঠিক হইবে এখন।
সে রাত্রে খগেন্দ্র যখন নিদ্রা গেল তখন প্রায় তিনটা বাজিয়াছে।
পরদিন বেলা সাতটার সময় তাহার ঘুম ভাঙ্গিল। চা পান ইত্যাদি শেষ করিয়া পদব্রজে গাজনতলার থানা অভিমুখে সে যাত্রা করিল।
গাজনতলা, বসন্তপুর হইতে দেড়ক্রোশ দূরে অবস্থিত। আট ঘটিকার পর থানায় পৌঁছিয়া শুনিল দারোগাবাবু তখনও অন্তঃপুর হইতে বাহির হন নাই। ভৃত্যমুখে নিজ আগমন সংবাদ পাঠাইয়া, দারোগাবাবুর বৈঠকখানায় খগেন্দ্র উপবেশন করিল।
কিয়ৎক্ষণ পরে দারোগাবাবু গেঞ্জি গায়ে, চটিজুতা পায়ে হাসিতে হাসিতে বাহির হইয়া আসিলেন। তাঁহার হাতে একখানি নূতন মাসিকপত্র। খগেন্দ্রকে অভ্যর্থনা করিয়া বলিলেন–এক পেয়ালা চা খাবেন?
খগেন্দ্র বলিল, ধন্যবাদ। আমি একদফা চা খেয়ে বেরিয়েছি যে!
এতখানি পথ হেঁটে এসেছেন, শ্রান্ত হয়েছেন, আরও এক দফা হোক না মশায়।
খগেন্দ্র সম্মতি জানাইলে, দারোগাবাবু ভৃত্যকে ডাকিয়া চা আনিতে আদেশ করিলেন।
দুই চারিটি শিষ্টাচারের কথার পর দারোগাবাবু বলিলেন, আপনি এত সকালে এসে পড়েছেন! আপনার জমিদার–চরিতমালার খদ্দেররা ত দশটার আগে আগে এসে পৌঁছবে না।
ঈষৎ হাসিয়া খগেন্দ্র বলিল, আমি এই বঙ্গীয় জমিদার-চরিতমালার বিজ্ঞাপন নিয়ে বেরিয়েছি, এটা একটা ভাণ মাত্র।
দারোগাবাবু কয়েক মুহূর্তকাল খগেন্দ্রের মুখপানে সকোতুকে চাহিয়া রহিলেন। শেষে বলিলেন–আমি তা জানি।
এই উত্তরে খগেন্দ্র একটু বিস্মিত ও শঙ্কিত হইল। তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিল, কি জানেন? কেমন করে জানলেন?
দারোগাবাবু বলিলেন, সেদিন পোষ্ট আপিসে আপনার সঙ্গে কথাবার্তা করে আমার মনে একটু সন্দেহ উপস্থিত হয়। আমি তাই আপনার বিজ্ঞাপনের কাগজখানি সেইদিনই কলকাতায় পুলিশ কমিশনারের কাছে পাঠিয়ে দিই। কাল রাত্রে তার কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেয়েছি, ও ঠিকানায় কোন পাবলিশিং ফারম নেই এবং কলকাতার কোনও ছাপাখানায় ও রকম কোন বই কেউ ছাপতে দেয়নি।
খগেন্দ্রের বুকের ভিতরটা গুর গুর করিয়া উঠিল। কিন্তু সে ভাবটা যথাসাধ্য গোপন করিয়া বলিল, আর কি জেনেছেন?
দারোগাবাবু হাসিয়া বলিলেন, আর জেনেছি যে আপনি ফেরারী আসামী নন–বদমায়েসের তালিকাতেও আপনার নাম নেই।
খগেন্দ্র ক্ষীণস্বরে বলিল, আর?
আর কিছু এখনও জানতে পারিনি।
শুনিয়া খগেন্দ্র মনে কতকটা আশ্বাস পাইল। বলিল–আচ্ছা, আমার প্রতি আপনার এরকম গুরুতর সন্দেহই যদি ছিল, তবে আমার কেতাবের খদ্দের জোটাবার জন্যে আপনি চেষ্টা করলেন কেন? –আমাকে ডেকেই বা পাঠালেন কেন?
দারোগা বলিলেন, যখন ডেকে পাঠিয়েছিলাম, তখনও কলকাতা থেকে তার পাইনি। তেমন তেমন টেলিগ্রাম এলে আপনাকে গ্রেপ্তার করার জন্যে কোথায় খুঁজে বেড়াব–তাই ডেকে পাঠিয়েছিলাম। কেতাবের খদ্দের–উদ্দের–আপনার ভাষাতেই বলি, ওগুলো আমার ভান মাত্র। –বলিয়া দারোগাবাবু হা হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন।
খগেন্দ্র কিন্তু হাসিল না। মুখখানি মলিন করিয়া আনত নেত্রে সে নীরব রহিল
দারোগাবাবু মাঝে মাঝে তাহার পানে চাহিতে লাগিলেন। শেষে অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন–খগেনবাবু–আপনি কি রাগ করলেন? দেখুন, আমরা পুলিশের লোক, সন্দেহ করাই আমাদের ব্যবসা। আমি সরকারী চাকরের কর্তব্য পালন করেছি মাত্র। আপনি তাতে দুঃখিত হচ্ছেন কেন?
খগেন্দ্র মুখ না তুলিয়াই বলিল, সে ত ঠিক কথা।
দারোগাবাবু কোমল স্বরে বলিলেন, তবে আপনি মুখখানি অমন বিমর্ষ করে রয়েছেন কেন?
খগেন্দ্র এবার চোখ তুলিল–ধীরে ধীরে বলিল, আপনি আমায় চোর বদমায়েস বলে সন্দেহ করেছিলেন–তার জন্যে আমি দুঃখিত হইনি। আমি একটা আশা করে আপনার কাছে এসেছিলাম–সেই আশা ভঙ্গ হবার উপক্রম দেখেই আমার মনটা কিছু ব্যাকুল হয়েছে।
দারোগাবাবু আশ্চর্য্য হইয়া বলিলেন, আমার কাছে আশা করে এসেছিলেন? কি বিষয়?
কতকগুলি বিষয়ের অনুসন্ধান করবার জন্যেই আমার এ অঞ্চলে আসা। তার উপর আমার সারা জীবনের সুখ দুঃখ নির্ভর করছে। আপনি পুলিশের কর্মচারী–আপনি মনে করলেই তদন্ত করে খবরগুলি আমায় দিতে পারতেন।
দারোগাবাবু বলিলেন, আমি তদন্ত করে আপনাকে খবর দিতে পারতাম? –ব্যাপার কি কিছুই বুঝতে পারছিনে। আচ্ছা, খগেনবাবু, যদি আপনার প্রকৃত নাম খগেনবাবুই হয়–আপনার আশাভঙ্গ হবার কারণটি কি আমায় যদি খুলে বলেন, তা হলে আমি বুঝতে পারি–আপনার কোনও সাহায্য আমার দ্বারা হবে কি না।
খগেন্দ্র বলিল, আপনার মনে এখনও যখন সন্দেহ যে আমি নিজের নাম যা বলেছি তা আমার প্রকৃত নাম নয়, তখন আপনার কাছে আমার সাহায্য লাভের আশা কি?
ভৃত্য চা আনিল। খগেন্দ্র পেয়ালাতে চামচ সঞ্চালন করিতে করিতে বলিল, আমি এখানে সম্পূর্ণ অপরিচিত কাকেই বা ডেকে এনে প্রমাণ করি যে আমার নাম প্রকৃতই খগেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়!
দারোগাবাবু অল্পক্ষণ কি চিন্তা করিয়া বলিলেন, আমার দ্বারায় যদি আপনার কোনও উপকার হয়–আর, আমি ধৰ্ম্মপথে থেকে উপকারটুকু করতে পারি তা হলে নিশ্চয়ই করব। আপনার নামের জন্যে আটকাবে না।
খগেন্দ্র আগ্রহের সহিত বলিল, আপনি ধৰ্ম্মপথে থেকেই আমার উপকার করতে পারেন। শুধু আমার উপকার নয়–বাঙ্গালা দেশের একটি প্রাচীন সম্রান্ত পরিবারও আপনার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।
দারোগাবাবু বলিলেন, ব্যাপারটা তা হলে আমায় খুলে বলুন।
খগেন্দ্র চায়ের পেয়ালায় মুখ দিল। তিন চারি চুমুক পান করিয়া বলিল–সমস্তই আমি খুলে বলছি–বলিয়া চা–টুকু নিঃশেষ করিয়া পেয়ালা নামাইয়া রাখিয়া, রুমালে মুখ মুছিতে মুছিতে আরম্ভ করিল–একজন পুরুষ আর একজন স্ত্রীলোক কোন স্থানে গিয়ে–একটা বিষম জুয়াচুরি করবার ফন্দীতে আছে। আমি তাদের সে জুয়াচুরিতে বাধা দিতে চাই। স্ত্রীলোকটি যে কে তা আমি এখানে এসে জানতে পেরেছি কিন্তু পুরুষটি যে কে তা এখনও নিশ্চিত ভাবে জানতে পারিনি।
দারোগাবাবু বলিলেন, কোথায় এ জুয়াচুরি হচ্ছে?
খগেন্দ্র বলিল, সেইটি এখন বলব না–মাফ করবেন। তবে এই পর্যন্ত বলতে পারি, এখান থেকে সে স্থান বহুদূর। এ জেলাতে নয়–এ ডিভিজনেও নয়।
স্ত্রীলোকটি কে?
বসন্তপুরের কৃষ্ণদাস ঘোষালের মেয়ে লীলাবতী। কি করে জানতে পারলাম তাও বলি। বলিয়া, শাড়ীর আঁচল হইতে টুকরা কাটিয়া আনা, নীলমণি রজককে তাহা দেখান, এবং নীলমণির স্বীকারোক্তি খগেন্দ্র বর্ণনা করিল।
দারোগা শুনিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, আপনি ইংরেজি ডিটেকটিভের গল্প খুব পড়েন বুঝি? –আপনি দেখছি একজন দ্বিতীয় শার্লক হোম!
খগেন্দ্র বলিল, শার্লক হোমের প্রতিভা আমাতে থাকলে আর ভাবনা কি ছিল!
দারোগাবাবু মাসিক–পত্রখানির পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি বললেন, পুরুষটি যে কে, তা আপনি নিশ্চিত জানতে পারেন নি। কাউকে আপনার সন্দেহ হয় কি? ।
খগেন্দ্র বলিল, হয়। যে রাত্রে লীলাবতী তার শ্বশুরবাড়ী ময়নামতী গ্রাম থেকে নিরুদ্দেশ হয় সেই রাত্রেই আপনার এই গাজনতলার কাছেই, বসন্তপুরের সৈরভির মা বলে একটা স্ত্রীলোকের সঙ্গে, জমিদার সারদাবাবুর ছোট ভাই নবীনকে একত্র পথ চলতে দেখা গিয়েছিল। নবীনও সেই রাত্রি থেকে নিরুদ্দেশ তাই আমার সন্দেহ, হয়ত বা ঐ নবীনের সঙ্গেই লীলাবতী গৃহত্যাগ করে গিয়েছে–আর তারাই গিয়ে ঐ জুয়াচুরিটি করবার চেষ্টায় আছে।
দারোগাবাবু ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন, ওরে–যা ত–মুন্সীবাবুর কাছ কাছ থেকে চার পাঁচ মাসের পুরোণো স্টেশন–ডায়রিগুলি সব নিয়ে আয়।
খগেন বলিল, আপনার স্টেশন–ডায়রিতে এ সম্বন্ধে কিছু আছে নাকি?
দারোগাবাবু সে কথার উত্তর না দিয়া বলিলেন, আপনি যে জুয়াচুরিতে বাধা দিতে চাইছেন–এ সব অনুসন্ধান করছেন–এ শুধু ধৰ্ম্ম ভেবে পরের উপকার করবার জন্যে?
খগেন্দ্র বলিল, মোটেই নয়। আমার ঘোর স্বার্থ আছে।
কি রকম?
খগেন্দ্র তখন যে কল্পিত উপন্যাসটি আরম্ভ করিল তাহা সংক্ষেপে এই–এই জমিদারের একটি মাত্র পুত্র ছিল, পিতামাতার সহিত পুরীধামে রথযাত্রা দেখিতে যাইয়া সে হারাইয়া যায়। সে আজ পঁচিশ বৎসরের কথা। জমিদার বাবুর স্ত্রীবিয়োগ হইলে অধিক বয়সে তিনি দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেন–সে স্ত্রীর গর্ভে একটি কন্যা জন্মে। খগেন্দ্রের সহিত সেই মেয়েটির পরিচয় এবং ভালবাসা। বাড়ীতে মেম রাখিয়া জমিদারবাবুর মেয়েটিকে ইংরাজি পড়াইতেন, খগেন্দ্র তাহাকে বাংলা শিক্ষা দিত। দুই বৎসর হইল জমিদারবাবু পরলোক গমন করিয়াছেন। তিনি উইল করিয়া গিয়াছেন, কন্যাটির ষোল বৎসর বয়স হইলে খগেন্দ্রের সহিত বিবাহ হইবে এবং উভয়ে সম্পত্তি সমভাবে পাইবে। ইতিমধ্যে দেওয়ান বালিকার অভিভাবক স্বরূপ সম্পত্তি রক্ষা করিবেন। মেয়েটির বয়স এখন পনেরো বৎসর, আর এক বৎসর পরেই তাহাদের দুইজনের বহুদিন পোষিত মিলনাশা ফল হইত, কিন্তু দুইমাস হইল এক ব্যক্তি আসিয়া বলিতেছে, আমিই সেই পুরীতে হারাইয়া যাওয়া বংশধর। গ্রামেই দুই চারিজন প্রধান। লোক ও কয়েকজন অসন্তুষ্ট আমলাকে বশ করিয়া বিষয় সম্পত্তি দখলের জন্য সে মোকদ্দমা করিবার আয়োজন করিতেছে। সে আসিবার কিছু পূৰ্ব্বে অন্তঃপুরে এক অপরিচিত স্ত্রীলোক নিজেকে অনাথা বলিয়া পরিচয় দিয়া প্রবেশ করিয়াছিল এবং আশ্রয়ও পাইয়াছিল। সম্প্রতি ধরা পড়িয়াছে যে ঐ স্ত্রীলোকটা সেই পুরুষকে গোপনে গোপনে নানা সংবাদ দিয়া পত্র লেখে। স্ত্রীলোকটা যে লীলাবতী ইহা নীলমণি রজকের দ্বারায় প্রমাণ হইতেছে; কিন্তু পুরুষটা যে কে সেইটি জানিতে পারিলেই কাৰ্যসিদ্ধি হয়।
নব্য দারোগাবাবু এই কাহিনী বিস্ময়–বিস্ফারিত নেত্রে শুনিয়া যাইতেছিলেন। শেষ হইলে বলিলেন–এ যে মশাই রীতিমত একখানি উপন্যাস! আশ্চর্য্য কাণ্ড ত!
খগেন্দ্র দেখিল ঔষধটি বেশ ধরিয়াছে।
একজন কনেষ্টবল এই সময় খানকয়েক স্টেশন–ডায়রি বহি আনিয়া দারোগাবাবুর সম্মুখে রাখিল। তিনি কিছুক্ষণ সেগুলার পাতা উল্টাইয়া একটা স্থান অভিনিবেশ সহকারে পড়িতে লাগিলেন। বহি হইতে চক্ষু না তুলিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন–সে স্ত্রীলোকটার কি নাম বললেন? কার মা?
খগেন্দ্র বলিল, সৈরভির মা।
দারোগাবাবু মৃদু হাস্য করিয়া বলিলেন, এই দেখুন।
খগেন্দ্র দেখিল, ময়নামতী গ্রামের চৌকিদার বছিরদ্দি শেখ লিখাইয়াছে–গত রাত্রে রোধ দিতে বাহির হইয়া ময়নামতী ও গাজনতলায় সরহদ্দের নিকট দুইজন স্ত্রীলোককে সন্দেহজনক অবস্থায় যাইতে দেখে এবং চৌকিদারের জিজ্ঞাসায় তাহারা যাহা যাহা বলিয়াছিল, তাহাও ডায়রিভুক্ত করা হইয়াছে।
খগেন্দ্র পরিশেষে বলিল, তবে ত দেখছি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম। নবীনের সঙ্গে লীলাবতী পালিয়েছে।
দারোগা বলিলেন, আমারও তাই বিশ্বাস।
অনেকক্ষণ ধরিয়া এই প্রসঙ্গ চলিল। যদি মাফ করেন ত জিজ্ঞাসা করি। –ইত্যাকার সসঙ্কোচ ভূমিকা করিয়া মাঝে মাঝে দারোগাবাবু সেই কাল্পনিক মেয়েটির কথাও খগেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। লজ্জায় রাঙা হইয়া, কণ্ঠের স্বর সাধ্যমত কম্পিত করিয়া খগেন্দ্র যে সকল উত্তর দিতে লাগিল, তাহা হইতে দারোগাবাবুর স্পষ্টই ধারণা জন্মিল, মেয়েটি রূপে লক্ষ্মী গুণে স্বরস্বতী; এবং এ দুজনের প্রেমটি স্বর্গেরই জিনিষ–মর্ত্তে তাহার তুলনা নাই।
ফলে দারোগাবাবু প্রতিশ্রুত হইলেন, বে-আইনি না করিয়া, নিজ এলাকা মধ্যে খগেন্দ্রকে যতদূর সাহায্য তিনি করিতে পারেন তাহা করিবেন।
১০. কয়েকখানি পত্র
(১)।
বসন্তপুর
২৫শে জ্যৈষ্ঠ
প্রিয় ভগ্নী কনকলতা
তোমায় শেষ পত্র লিখিবার পর অনেকগুলি নূতন কথা জানিতে পারিয়াছি। এখানকার দারোগাবাবু আমার একজন পরম বন্ধু। তাহার সাহায্যে সৈরভির মাকে রীতিমত জেরা করিয়া অনেক কথা বাহির করা গিয়াছে। মাগী কি সহজে বলে!–যখন কনেষ্টবল তাহাকে হাতকড়ি পরাইতে উদ্যত হইল তখন সকল কথা সে প্রকাশ করিল। নবীনচন্দ্র তাহাকে টাকা খাওয়াইয়া ময়নামতী পাঠাইয়া দিয়াছিল। সেখানে সন্ধ্যার পর পৌঁছিয়া নির্জন পুকুর ঘাটে লীলাবতাঁকে পাইয়া সে বলে, তোমার মা অত্যন্ত পীড়িতা, হঁহারা পাঠাইবেন না জানিয়া গোপনে তিনি পাল্কী পাঠাইয়া দিয়াছেন, ষোলজন বেহারা ও পাল্কী গ্রামের বাহিরে অপেক্ষা করিতেছে, রাত্রি দশটার সময় আমি খিড়কীর দরজার নিকট দাঁড়াইয়া থাকিব, তুমি বাহির হইয়া আসিও, মার সঙ্গে দেখা করাইয়া আবার তাড়াতাড়ি তোমায় ফিরাইয়া আনিব। বোকা মেয়ে সেই কথায় বিশ্বাস করিয়া সৈভির মার সহিত বাহির হয়। গ্রাম হইতে কিছুদূরে, বটবৃক্ষের ছায়ায় গরুর গাড়ী লইয়া নবীন লুকাইয়া ছিল–সে লীলাবতাঁকে ধিরয়া, মুখে কাপড় খুঁজিয়া গরুর গাড়ীতে তুলিয়া প্রস্থান করে। সৈরভির মা বলিল সে গাড়োয়ানের নাম বলাই ঘোষ। দারোগাবাবু বলাই ঘোষকে আনাইয়াও জিজ্ঞাসাবাদ করিয়াছেন। সেও সৈরভির মার উক্তি (মুখে কাপড় খুঁজিয়া জোর করিয়া গাড়ীতে উঠান প্রভৃতি) সমর্থন করে। তাহার নিকট হইতে আরও জানা গিয়াছে, নয়নপুরের নিকট এক বাগানবাড়ীতে ইহারা গিয়া উঠিয়াছিল। আগামী কল্য দারোগাবাবু সহ আমি নয়নপুর যাত্রা করিব। সেখানে যেরূপ শুনিতে পাই তাহা পরে জানাইব।
তোমার স্নেহের খগেন দাদা।
(২)
বসন্তপুর
২৭শে জ্যৈষ্ঠ
কল্যাণবরাসু,
গত পরশু দিবস তোমায় একখানি পত্র লিখিয়াছি, পাইয়া থাকিবে। দারোগাবাবু আমায় সঙ্গে লইয়া যান নাই–তিনি একাই নয়নপুরের বাগান বাড়ীতে অনুসন্ধান করিতে। গিয়াছিলেন। তিনি ফিরিয়া অদ্য বলিলেন, লীলাবতী প্রায় মাসাবধি কাল ঐ বাগানবাড়ীতে আবদ্ধ ছিল। নবীন মাঝে মাঝে আসিত এবং লীলাবতাঁকে অনেক অনুনয় বিনয় করিত। লীলা কিন্তু সর্বদা কাঁদাকাটা করিত এবং নবীনকে দেখিলেই বলিত–যদি আমার কাছে আসিবে ত আমি ছাদ হইতে লাফাইয়া পড়িব। মাসখানেক পরে, এখান হইতে নবীন লীলাবতাঁকে রাত্রিকালে কালনায় লইয়া যায় এবং নৌকাযোগে সেখান হইতে কোথায় যাত্রা করে তাহা এখনও প্রকাশ হয় নাই। দারোগাবাবুর সাহায্য না পাইলে আমি এ সকল কিছুই জানিতে পারিতাম না। সৌভাগ্যক্রমে কালনা থানার ইনস্পেক্টরবাবু আমাদের এই দারোগাবাবুর বন্ধু। তিনি আমায় চিঠি দিয়া সেখানে পাঠাইতেছেন। কালনায় গিয়া তাঁহার সাহায্যে আমি যদি সেই সকল মাঝি–মাল্লাকে বাহির করিতে পারি, তবে সেখান হইতে তাহারা কোথায় গেল কি করিল সবই জানা যাইবে।
এখন যতদূর দেখিতেছি, সম্ভবতঃ সুরবালা ওরফে লীলাবতী ক্রমে নবীনের কবল হইতে পলাইয়া গিয়াছিল এবং পরে ঐ জাল ভবেন্দ্রের সহিত কোথাও একত্র হইয়া ষড়যন্ত্র করিয়া তোমাদের ওখানে পৌঁছিয়াছে। তুমি যদি ইতিমধ্যে কোনও সংবাদ পাইয়া থাক তবে তুমি আমায় কালনার ঠিকানায় পুলিশের ইনস্পেক্টরবাবুর কেয়ারে পত্র লিখিবে।
তোমার স্নেহের খগেন দাদা।
(৩)
বাশুলিপাড়া
৩১শে জ্যৈষ্ঠ
প্রণামপূৰ্ব্বক নিবেদনমিদং
পরম পূজনীয় দাদামহাশয় পত্রদ্বারা আমার বহু বহু প্রণাম জানিবেন। পরে আপনার শ্রীচরণাশীৰ্বাদে এ জনার প্রাণগতিক মঙ্গল হয় বিশেষ। দেখুন ঠিক হল ত? এবার আর বলিতে পারিবেন না যে আপনাকে জ্যেষ্ঠোচিত ভক্তিশ্রদ্ধা প্রদর্শনে আমি ত্রুটি করিতেছি।
আপনার পত্র দুইখানি পাইয়াছি। একটি সংবাদ আমি জানিতে পারিয়াছি। যিনি ভবেন্দ্র সাজিয়াছেন, তিনি পূৰ্ব্বে নাকি তিনতারিয়া মঠের মোহান্ত ছিলেন। বাবু একদিন দেওয়ানজির সহিত কথোপকথন করিতেছিলেন, আমি আড়ালে থাকিয়া শুনিয়াছিলাম। কিন্তু এই তিনতারিয়া কোথায় তাহা কিছুই প্রকাশ করেন নাই।
এ বাটীর সমস্ত মঙ্গল। ভবেন্দ্রবাবু যেই হউন–সত্যই হউন আর জালই হউন–তিনি বউরাণীর সহিত সত্যকার প্রেমেই পড়িয়া গিয়াছেন। মাঝে বউরাণীর জ্বর হইয়াছিল, একদিন অবস্থা একটু শঙ্কাজনক হইয়া উঠে। সেদিন বউরাণীর বিছানার নিকট চেয়ার পাতিয়া তিনি বসিয়াছিলেন–আমি হঠাৎ ঢুকিয়া দেখি তাহার চোখ দিয়া টপ্ টপ করিয়া জল পড়িতেছে। কেহ যদি কাহাকেও সত্য সত্য ভালবাসে, দেখিতে আমার বড় ভাল লাগে। আপনার কুশল সংবাদ লিখিবেন। ইতি
আপনার স্নেহের ভগ্নী
কনকলতা
(৪)
কালনা
৬ই আষাঢ়
কল্যাণীয়াসু,
কয়েক দিন হইল তোমার একখানি পত্র পাইয়াছি। তুমি লিখিয়াছ যে জাল ভবেন্দ্র পূৰ্ব্বে তিনতারিয়া মঠে থাকিত, কিন্তু সে যে কোথায় তাহা আমি কিছুতেই নির্ণয় করিতে পারিতেছি না। সেখানে কোনও ডাকঘর নাই, থাকিলে পোষ্টাল গাইডেই নাম খুঁজিয়া পাইতাম। –যাহা হউক সে অনুসন্ধান শীঘ্রই আমাকে করিতে হইবে।
এখানে আসিয়া ইনস্পেক্টরবাবুর সাহায্যে মাঝি–মাল্লাগণকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া যাহা শুনিয়াছি, তাহাতে রহস্য গভীরতর হইয়া পড়িয়াছে। দরিবুল্লা মাঝির কথায় ইহাই প্রকাশ হইতেছে যে, একজন বাবু একটি রুগ্না স্ত্রীলোককে লইয়া তাহার নৌকায় আহরণ করেন। স্ত্রীলোকটি ঐ বাবুর প্রতি অত্যন্ত বিমুখ ছিল, এবং সর্বদা কাঁদাকাটা করিত। কোনও দিন আহার করিত, কোন দিন করিত না। বাবুকে কাছে যাইতে দিত না। একদিন অপরাহ্নকালে হঠাৎ নৌকায় গোল উঠে, ছুরি আন ছুরি আন। স্ত্রীলোকটি আত্মহত্যা করিবার অভিপ্রায়ে গলায় দড়ি দিয়াছিল। বাবু তাহা দেখিতে পাইয়া গোল করেন। তখন সকলে গিয়া দড়ি কাটিয়া তাহাকে নামাইল। স্ত্রীলোকটি প্রথমতঃ অজ্ঞান অবস্থায় ছিল, অনেক শুশ্রূষায় সন্ধ্যার পরে তাহার চৈতন্য হয়। নৌকার ভিতর একা শয়ন করিত, সেদিনও একাকী ছিল। বাবুটি ছত্রীর বাহিরে শয়ন করিতেন। প্রাতে উঠিয়া স্ত্রীলোকটিকে নৌকায় আর দেখা যায় নাই। একজন দাঁড়ি বলে, দেওয়ানগঞ্জ বা ঐরূপ কোন স্থানে নিকট রাত্রি তৃতীয় প্রহরের সময় জলে ঝপাস করিয়া কি একটা পড়িবার শব্দ সে শুনিয়াছিল, কিন্তু শুশুক লাফাইতেছে ভাবিয়া ওদিকে আর খেয়াল করে নাই।
সুতরাং অনুমান হইতেছে, পলায়ন বা আত্মহত্যা অভিপ্রায়ে লীলাবতীই রাত্রে জলে লাফাইয়া পড়িয়াছিল; ভাসিয়া গিয়া ডাঙ্গায় উঠিয়াছিল। দরিবুল্লা আরও বলে, সেদিন দোল ছিল। পঞ্জিকায় দেখিলাম উহা ২৯শে ফাল্গুন। কোন্ দিন সুরবালাকে বাগানের ঘাটে পাওয়া গিয়াছিল অনুসন্ধান করিয়া আমায় লিখিবে। তাহা হইলেই বুঝা যাইবে, মাঝিগণ বর্ণিত এই বাবু ও স্ত্রীলোক, নবীন ও সুরবালা কিনা।
তোমার দাদা
(৫)
বাশুলিপাড়া
১০ই আষাঢ়
প্রিয় খগেনবাবু,
পত্র পাইলাম। তাড়াতাড়ি এক ছত্র লিখিয়া দিতেছি। দোলের পরদিন প্রাতেই সুরবালাকে বাগানের ঘাটে পাওয়া গিয়াছিল।
আপনার
কনক।
(৬)
কলিকাতা
২০শে আষাঢ়
প্রিয় কনক,
তোমার পত্র পাইয়া অনেকটা হতাশ হইতে হইল। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, সুরবালা ঐ জাল ভবেন্দ্রের সহিত পরামর্শ করিয়া আসে নাই। উহার সম্বন্ধে যত কিছু অনুসন্ধান করিলাম, সকলই ব্যর্থ হইল–জাল ভবেন্দ্র যে কে, তাহার কিছুই নির্ণয় হইল না।
এখানে ফিরিয়া নবীনচন্দ্রের সন্ধানে আমি গিয়াছিলাম। তাঁহার ঠিকানায় গিয়া শুনিলাম, কয়েকদিন পূৰ্বে ঘোড়ার গাড়ী উল্টাইয়া পড়িয়া তিনি বিষম আঘাত পান এবং মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে আছেন। সেখানে কয়েকদিন উপর্যুপরি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি। গতকল্য তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। মরিবার পূর্বে তিনি উকীল ডাকাইয়া হাসপাতালে এক উইল করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাতে লিখিয়াছেন, লীলাবতীর উপর অত্যাচার করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, সেই পাপেই তাহার এই অপঘাত মৃত্যু হইল। আরও লিখিয়াছেন, ঈশ্বরকৃপায় তিনি তাঁহার দুশ্চেষ্টায় সফল হন নাই–লীলাবতী সতী–নিষ্পাপ শরীর। তাঁহার প্রাপ্য সম্পত্তির অর্ধাংশ, নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ তিনি লীলাবতাঁকে দান করিয়াছেন। অপরাদ্ধ তাঁহার ভ্রাতৃম্পুত্রগণকে বিভাগ করিয়া দিয়াছেন। আমিও সেই উইলে সাক্ষী হইয়াছি।
আমি আগামী কল্য প্রাতে কাশী যাত্রা করিব। সেখানে অনেক সাধু সন্ন্যাসী থাকেন। তিনতারিয়া মঠ কোথায়–আমি সেখানে থাকিয়া অনুসন্ধান করিব। সে মঠে গেলে, ভবেন্দ্ৰ যে কে হয়ত নির্ণীত হইতে পারে।
তোমার স্নেহের
খগেন্দ্র
(৭)
কলিকাতা
১৫ই শ্রাবণ
প্রিয় কনক,
আমার এতদিনের পরিশ্রম সফল হইয়াছে। কাশী হইতে সন্ধান পাইয়া আমি তিনতারিয়া মঠে গিয়াছিলাম। সেখানে জানিলাম, তাহাদের ভূতপূৰ্ব্ব মোহান্ত বাস্তলিপাড়া নিবাসী ভবেন্দ্ৰই ছিলেন। অল্পদিন পরে ফিরিয়া আসিব এইরূপ বলিয়া, গত ফাঙ্গুন মাসে তিনি বঙ্গদেশে যাত্রা করেন। একমাসের অধিক কাল কোনও সংবাদ না পাইয়া তাহার চেলারা অনুসন্ধান করিতে কলিকাতায় আসে। পুলিশ, রেল আপিস, প্রভৃতি স্থানে অনুসন্ধান করিয়া তাহারা জানিতে পারে, ঐ সময় খুস্রুপুর ষ্টেশনে এক সন্ন্যাসীর মৃতদেহ ট্রেণ হইতে নামিয়াছিল। সেই সন্ন্যাসীর পরিত্যক্ত বাক্স প্রভৃতি রেল আপিসে জমা ছিল, তাহা দেখিয়া তাহারা সেই মোহান্তের জিনিষ বলিয়া চিনিতে পারিয়াছে।
এ সম্বন্ধে আরও অধিক অনুসন্ধান করিবার জন্য আমি খুস্রুপুরে গিয়াছিলাম। সেখানে সন্ন্যাসীর মৃতদেহ নামার সংবাদ পাইলাম–আরও জানিলাম–যে সময় ঐ মৃতদেহ নামিয়াছিল, সে রাত্রে ময়নামতীর রাখাল ভট্টাচাৰ্য্য–লীলাবতীর স্বামী–ডিউটিতে ছিল। মৃতদেহ সমস্ত রাত্রি তাহারই জিম্মায় থাকে। কয়েকদিন পরেই চাকরি হইতে অবসর লইয়া রাখাল কাশী যাত্রা করে।
খুস্রুপুর হইতে আমি ময়নামতীতে গিয়াছিলাম। সেখানে রাখালের এক দাদা আছেন। তিনি অদ্যাবধি রাখালের কোনও সংবাদ পান নাই। সে জীবিত কি মৃত তাহাও তিনি অবগত নহেন।
সুতরাং এখন দিনের আলোর মত স্পষ্টই বুঝিতে পারিতেছি, ঐ রাখালই, মৃত সন্ন্যাসীর কাগজপত্র হইতে তাহার নামধাম এবং অন্যান্য কথা অবগত হইয়া ভবেন্দ্র সাজিয়া বাশুলিপাড়ায় গিয়াছে। সেদিন বিকালে গঙ্গার ঘাট হইতে ফিরিবার সময় বাগানে হঠাৎ জাল ভবেন্দ্রকে দেখিয়া সুরবালা কেন চমকাইয়া উঠিয়াছিল, তাহাও বেশ বোঝা যাইতেছে।
আরও কিছু কিছু সংবাদ সংগ্রহ করিতে এখনও বাকী আছে–তাহা শেষ করিয়া আমি বাশুলিপাড়ায় গিয়া কাৰ্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইব।
তোমার স্নেহের
খগেন্দ্র
পঞ্চম খণ্ড
০১. জমিদারীর কর্মভোগ
শ্রাবণের অপরাহ্ন। আজ এক সপ্তাহ ধরিয়া বৃষ্টির বিরাম নাই। দেওয়ানজি একটি ফ্ল্যানেলের কামিজ গায়ে দিয়া বসিয়া কাছারির কায করিতেছেন এবং খুক খুক করিয়া কাসিতেছেন। মাঝে মাঝে বাহিরের পানে চাহিয়া দেখিতেছেন। এখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতেছে। বড় জরুরী একটা সংবাদ আসিয়াছে–সেই জন্য দর্শনপ্রার্থী হইয়া অন্তঃপুরে বাবুর কাছে এত্তেলা পাঠাইয়াছিলেন। বাবু বলিয়াছেন, শীঘ্র কাছারিতে আসিতেছি। এক ঘণ্টা হইয়া গেল, কই এখনও ত বাবুর দেখা নাই।
একজন ঝি কাছারিবাড়ীর প্রাঙ্গণ দিয়া যাইতেছিল, দেওয়ানজি তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সে আসিলে জিজ্ঞাসা করিলেন–বাবু কোথায় ঝি?
অন্দরে।
কি করছেন?
বউরাণীর কাছে বসে আছেন।
কেমন আছেন বউরাণী এবেলা?
ভাল আছেন।
আচ্ছা–যা।
ঝি চলিয়া গেল।
একটু অন্ধকার হইয়া আসিয়াছিল। চশমার সাহায্যেও দেওয়ানজি কাগজে কালির রেখা আর স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছেন না। কলমটি তুলিয়া মনে মনে বাবুর বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। অস্ফুটস্বরে বলিলেন, ক্রমে যে রকম স্ত্রৈণ হয়ে উঠছে–বিষয় সম্পত্তি রাখবে কি করে? তদারক অভাবেই যে সব নষ্ট হবে দেখছি! যে রকম শুনছি, দুটিতে জোটের পায়রার মত অষ্টপ্রহর এক সঙ্গে আছে। ব্রত করছেন না আমার মুণ্ড করছেন! স্ত্রীকে ছুতে বারণ–কিন্তু এ যে ছোঁয়ার বাবা! এর চেয়ে যে ছোঁয়া ভাল ছিল। স্ত্রী এখন জপতপ–স্ত্রীই এখন ছোকরার ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছে!
গুরু গুরু ধ্বনিতে আকাশে মেঘগর্জন হইল। অন্ধকার বাড়িয়া উঠিল। বনের মধ্যে দুই একটা ঝি ঝি পোকাও বাগিনী ভঁজিতে সুরু করিয়াছে। যুবকের এই দাম্পত্যলীলার কথা চিন্তা করিতে করিতে, দেওয়ানজির নিজ যৌবনের স্মৃতিও জাগিয়া উঠিল। বাবুর কথা ছাড়িয়া, তখন তিনি নিজ জীবনের মিষ্ট মিষ্ট পুরাতন টুকরাগুলি মনের মধ্যে উলট পালট করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ এইরূপে কাটিলে, একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ভৃত্যকে ডাকিলেন। বলিলেন–অন্দরমহলে বাবুমশায়ের কাছে খবর দে যে দেওয়ানজি আপনার অপেক্ষায় বসে আছেন।
যে আজ্ঞে। –বলিয়া ভৃত্য প্রস্থান করিল। ফিরিয়া আসিয়া সংবাদ দিল, বাবু শীঘ্ন আসিবেন।
ক্রমে সন্ধ্যা উপস্থিত হইল, তথাপি বাবুর দেখা নাই। দেওয়ানজির সম্মুখে এখন আলো জ্বলিতেছে। ঘড়ির পানে চাহিয়া দেখিলেন, প্রায় সাড়ে ছয়টা। সায়ংসন্ধ্যা করিবার সময় বহিয়া যায়–সুতরাং দেওয়ানজি উঠিলেন। একজন কর্মচারীকে বলিলেন–তুমি এইখানে বসে থাক। বাবু যদি আসেন ত বোলো আমি সন্ধ্যে–আহ্নিক সেরে রাত্রি আটটার মধ্যে ফিরে আসব।
যথাসময়ে ফিরিয়া দেওয়ানজি শুনিলেন বাবু এখনও বাহির হন নাই। একবার ভাবিলেন, তাহাকে কথাটা স্মরণ করাইবার জন্য পুনরায় তোক পাঠাইবেন। আবার ভাবিলেন, আটটা ত বাজিয়াছে, নয়টার সময় বাবু বৈঠকখানা বাড়ীতে শয়ন করিতে আসিবেন, সেই সময়ই সাক্ষাৎ হইবে। সুতরাং দেওয়ানজি সবুর করিলেন।
বাবুর আচরণে দেওয়ানজি আজ মনে মনে বিলক্ষণ বিরক্ত হইয়াছেন। ভাবিতেছেন, আমার ষাট বছর বয়স হইয়াছে–আমি আর কয়দিন? এখন হইতে সব দেখিয়া শুনিয়া না লইলে, বিষয় কেমন করিয়া রক্ষা হইবে? আমার অবর্তমানে অন্য দেওয়ান নিযুক্ত হইবে–কিন্তু সে কি আমার মত প্রাণ দিয়া মনিবের স্বার্থরক্ষা করিবে? কর্তার এরূপ অমনোযোগ পাইলে সে ত দুই হাতে লুটিবে।
বাবুর মন বিষয়কার্যের দিকে আকৃষ্ট করিবার জন্য কি উপায় অবলম্বন করা যাইতে পারে, তাহাই দেওয়ানজি এখন মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলেন। জলে না পড়িলে লোকে সাঁতার শিখে না। অতএব তিনি স্থির করিলেন, নিজে দিনকতকের জন্য কোনও অছিলায় সরিয়া যাইবেন। বিষয়ের সমস্ত বোঝাটি নিজের মাথায় পড়িলে, তখন নিশ্চয়ই বাবুর চেতনা হইবে।
রাত্রি নয়টার পর লণ্ঠনবাহী ভৃত্যের পশ্চাতে অন্তঃপুর হইতে রাখাল ছাতা মাথায় দিয়া বাহির হইল। তখন আবার বৃষ্টি পড়িতেছিল। বৈঠকখানার বারান্দায় বেঞ্চির উপর দেওয়ানজি বসিয়া ছিলেন, বাবুর আগমনে তিনি দাঁড়াইয়া উঠিলেন।
রাখাল বলিল, কাকা–এখনও বাড়ী যান নি?
ক্রোধ ও বিরক্তির ভাব যথাসাধ্য দমন করিয়া নরম সুরে দেওয়ানজি বলিলেন, না বাবা–একটু জরুরী কায় ছিল তাই।
রাখাল বলিল, ওহো–আপনি আমায় বিকেলে একবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন–নয় কাকা?
হ্যা বাবা–প্রথম একবার চারটের সময় বলে পাঠিয়েছিলাম–তুমি বলেছিলে শীগগির আসছি। সাড়ে পাঁচটা অবধি অপেক্ষা করে–তোমায় মনে করিয়ে দেবার জন্যে আবার একবার লোক পাঠিয়েছিলাম।
রাখাল বলিল, ঠিক ঠিক। ভারি অন্যায় হয়ে গেছে–ও কথাটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। আমায় মাফ করুন কাকা। আপনার ভারি কষ্ট হয়েছে।
দেওয়ানজির মন এবার যথার্থই নরম হইল। বলিলেন–না বাবা–কষ্ট আর কি?
রাখাল বলিল, এই শ্রাবণ মাসের রাত্রি–অন্ধকার ঘুট ঘুট্ করছে, বৃষ্টি পড়ছে। এত রাত্রে জলকাদায় আপনাকে বাড়ী যেতে হবে। সন্ধ্যার আগেই বাড়ী গেলেন না কেন? বড় কি জরুরী কায ছিল?
হ্যা বাবা–বিশেষ জরুরী কায।
আচ্ছা তবে উপরে আসুন। সেখানেই শুনব। –বলিয়া রাখাল সিঁড়ি দিয়া উঠিতে আরম্ভ করিল।
দেওয়ানজি পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে যাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, বউরাণী এখন কেমন আছেন?
কথাটা শুনিয়া রাখাল একটু লজ্জানুভব করিল। বুঝিল আমি যে বউরাণীকে লইয়া মত্ত হইয়া পড়িয়াছি–কর্তব্যের অবহেলার কারণ যে বউরাণীই–তাহা বুড়া ধরিয়া ফেলিয়াছে। উত্তর করিল–দিনের বেলায় ত ভাল ছিলেন। বিকেল থেকে গা–টা আবার গরম হচ্ছে। এই এখন উত্তাপ দেখে এলাম–১০১ উঠেছে।
দেওয়ানজি বলিলেন, ও আর বেশী কি? ভারি বর্ষাটা পড়েছে–জোলো হাওয়ায় এসময় একটু আধটু জ্বরজাড়ি হয়েই থাকে। তার জন্যে কিছু ভাবনা নেই।
রাখাল নীরবে উঠিয়া নিজ শয়নকক্ষে উপনীত হইল। একটা চেয়ারে বসিয়া ভৃত্যকে বলিল–শুকনো তোয়ালে দিয়ে আমার পা বেশ করে মুছে দে। –দেওয়ানজিকে বলিল–বসুন কাকা। ব্যাপার কি বলুন।
দেওয়ানজি উপবেশন করিয়া বলিলেন, আজ সদর থেকে মতিবাবু পেস্কার চিঠি লিখেছেন যে পরশু তারিখে কালেক্টরসাহেব মির্জাহাটের ডাকবাঙ্গলায় এসে পৌঁছবেন, সেখানে তিনদিন থাকবেন।
রাখাল বলিল, এই ঘোর বর্ষায় সাহেব সফরে বেরিয়েছেন?
মির্জাহাটের কাছেই একটা বড় জলা আছে, সেখানে সাহেব পাখী শিকার করবেন–পেস্কার লিখেছেন। গত বৎসরও এসেছিলেন। আমাদের এলাকায় আসছেন, ভাল রকম অভ্যর্থনা করতে হবে ত? –জেলার মালিক–যে সে হাকিম ত নয়!
রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, ডালি–টালি দিতে হবে বোধ হয়?
ডালি ত দিতে হবেই। সে বন্দোবস্ত করেছি। তোমায় জিজ্ঞাসা না করেই, হরিচরণকে বিকেলে কলকাতা রওয়ানা করে দিয়েছি। এ সকল বিষয়ে সে ভারি হুঁসিয়ার। উইলসনের হোটেল থেকে খাবার জিনিষপত্র, দুবোতল শ্যাম্পেন, আধ ডজন হুইস্কি–আরও সব কি কি–আমাদের পাকা ফর্দই তৈরি করা আছে–সেই অনুসারে সব জিনিষ কিনে, কাল সন্ধ্যের গাড়ীতে হরিচরণ কলকাতা থেকে সোজা একেবারে মির্জাহাট রওনা হবে।
রাখাল বলিল, মির্জাহাটে আমাদের কাছারি-টাছারি আছে?
দেওয়ানজি ভাবিলেন, প্রায় তিনমাস আসিয়াছেন–এখনও কোথায় আমাদের কোন কাছারি আছে অবগত নহেন। এমনি করিয়াই কি জমিদারী চলিবে? প্রকাশ্যে বলিলেন–না, মির্জাহাটে আমাদের কাছারি নেই; তবে সেখান থেকে দেড় ক্রোশ অন্তরে ভদ্রকালী বলে একটা গ্রাম আছে, সেখানে আমাদের বেশ ভাল কাছারিই আছে। ও অঞ্চলে ঐটাই আমাদের প্রধান কাছারি। বেশ দোতলা বাড়ী। ছেলেবেলায় তুমি কৰ্ত্তামশায়ের সঙ্গে দুএকবার গিয়েছিলে, বোধ হয় স্মরণ নেই।
রাখাল মনে মনে হাসিয়া বলিল, কই মনে পড়ে না।
দেওয়ানজি বলিলেন, সেখানকার নায়েবের নামেও পরোয়ানা পাঠিয়েছি। সাহেবের। জন্যে, মুর্গী, ডিম, ঘি, দুধ, মাছ, শাকসজী এই সব যোগাড় করে রাখবে।
রাখাল বলিল, তবে ত সব বন্দোবস্তই হয়ে গেছে।
দেওয়ানজি বলিলেন, হ্যাঁ। কিন্তু একটা কথা ভাবছি। নায়েবের উপর ভর দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা কি ঠিক?
রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, আপনি নিজে যাবেন? সে হলে ত ভালই হয়।
দেওয়ানজি ধীরে ধীরে বলিলেন, আমি–নিজে অবশ্য যেতে পারি। কিন্তু তুমি গেলেই ভাল হয় বাবা।
রাখাল বলিল, আমি? আমি এখন কি করে–
দেওয়ানজি বলিলেন, বউরাণী এখন ত ক্রমেই ভাল হয়ে উঠছেন। ঐ সামান্য জ্বরটুকু কবিরাজ দুদিনেই ভাল করে দেবে এখন। আমি রইলাম, সৰ্ব্বদাই খবর নেব। তোমার না যাওয়াটা ভাল দেখায় না বাবা।
রাখাল নীরব হইয়া বসিয়া রহিল। ইতিমধ্যে ভৃত্য পা মুছাইয়া তাহাকে শুষ্ক চটিজুতা পরাইয়া দিয়াছিল।
দেওয়ানজি, বাবুর মনের ভাব বুঝিয়া বলিলেন, এ সময় তোমায় যেতে বলতাম। কিন্তু একে ত এসে অবধি তুমি কালেক্টর সাহেবের সঙ্গে দেখা করনি। তার উপর তোমার এলাকায় তিনি আসছেন, তুমি স্বয়ং গিয়ে তার অভ্যর্থনা করবে না–এতে সাহেব হয়ত মনে মনে চটে যাবেন। হাকিমের মেজাজ, বলা ত যায় না।
ভাবিয়া চিন্তিয়া রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, আমায় কি করতে হবে?
দেওয়ানজি বলিলেন, বেশী কিছু নয়। তুমি কাল আহারাদির পর পাল্কীতে রওনা হয়ে ভদ্রকালী কাছারিতে যাও। সন্ধ্যে নাগাদ পৌঁছে যাবে এখন। হরিচরণও ডালি নিয়ে রাত দুপুরে সেখানে পৌঁছবে। মুর্গী–টুর্গী, ঘি–দুধ, শাক–সজীগুলো, আর ডালির জিনিষপত্র সকালবেলাই নায়েবের সঙ্গে রওনা করে দিও। তারা ডাকবাঙ্গলায় গিয়ে বসে থাকবে। বেলা ৮টা ৯টার আগে সাহেব পৌঁছবেন না। সাহেব পৌঁছলে, ঘি–দুধ, শাক–সজীগুলো নায়েব গিয়ে সাহেবের খানসামাকে দেবে এখন। কলকাতার ডালিটে রেখে দেবে। একজন ঘোড়সওয়ার সেখানে হাজির থাকবে–এদিকে কাছারিতে তোমার পাল্কী বেহারা প্রস্তুত রাখবে। সাহেব এসে ডাকবাঙ্গলায় পৌঁছলেই ঘোড়সওয়ার ছুটে এসে তোমায় খবর দেবে। তুমি পাল্কীতে বেরিয়ে পোড়। সাহেবের কাছে নিজের কার্ড পাঠিয়ে দিও। দিলেই সাহেব তোমায় ডেকে পাঠাবেন–শেহ্যাণ্ড করে চেয়ারে বসাবেন। হুজুর কেমন আছেন, মেমসাহেব কেমন আছেন, তিনি এলেন না কেন, পথে হুজুরের কোনও কষ্ট হয়নি ত–এই সব তাকে জিজ্ঞাসা করবে।
রাখাল বলিল, বাঙ্গলায়?
দেওয়ানজি বলিলেন, না–না–ইংরেজিতেই বলবে। ওটা ভুলে যাচ্ছিলাম। কৰ্ত্তামশায় বাঙ্গলাতেই ঐ রকম করে বলতেন কিনা, তাই আমার মাথায় ঘুরছিল। তুমি ইংরেজিতেই বলবে। ইংরেজিতে আর হুজুর বলতে হবে না। দুচারবার বা ইওর অনার বললে–দু একবার বা সার বললে। ইওর অনারটাই বেশী। এসব হয়ে গেলে তখন বলবে, হুজুরের সেবার জন্যে কিঞ্চিৎ মুর্গী, ডিম, শাক–সজী পূর্বেই পাঠিয়েছিলাম–আমার কর্মচারীরা সে সব খানসামার জিম্মা করে দিয়েছে। আর হুজুরের জন্যে যৎসামান্য একটি ডালি নিয়ে এসেছি, এইটি গ্রহণ করলে কৃতার্থ হই। হরিচরণকে ইসারা করবে, সে ঢুকে ডালিটি সাহেবের সম্মুখে রেখে দেবে।
রাখাল বলিল, বাবা!–এত কাণ্ড করতে হবে? কৰ্ম্মভোগও কম নয়!
ঈষৎ হাসিয়া দেওয়ানজি বলিলেন, তা কি আর আমি বুঝিনে বাবা? কিন্তু কি করবে? –হাকিমেরা হলেন কলির দেবতা তাদের পূজা স্তব না করলে কি রক্ষে আছে?
রাখাল একটু চিন্তা করিয়া বলিল, তারপর–পূজো করে আমি এখানে ফিরে আসতে পারব ত?
দেওয়ানজি বলিলেন, না–সেটা ভাল দেখায় না। তিনদিন সাহেব থাকবেন, রোজ সকালে একবার করে গিয়ে দেখাটা করা উচিত।
কি বলব রোজ রোজ?
দেখা করে বলবে, হুজুরের কোনও কষ্ট হচ্ছে না ত? কোনও বিষয়ের অসুবিধে হয় ত বলুন, আমি বন্দোবস্ত করি। এই রকম দুটো চারটে শিষ্টাচারের কথা বলে চলে আসবে। একটু খোসামোদ করা আর কি!
অগত্যা রাখাল সম্মত হইল। বলিল–আচ্ছা, আমার যাওয়াটা নিতান্তই দরকার যখন আপনি বলছেন–তখন যেতেই হবে। সব বন্দোবস্ত করে দিন।
রাত্রি হইয়াছিল, দুই চারিটা কথায় পর দেওয়ানজি বিদায় লইলেন। রাখাল শুইয়া অন্ধকারের মধ্যে ভাবিতে লাগিল, আড়াই মাস এসেছি, এখনও একদিনের জন্যেও ছাড়াছাড়ি হইনি। তাকে না দেখে, এ তিনদিন কেমন করে বাঁচব?
বউরাণীর রোগাপাণ্ডুর মুখখানি মনে করিয়া, ভাবী বিরহের যন্ত্রণা রাখালের আরও বাড়িয়া গেল। অস্ফুটস্বরে সে বলিল, যদি একখানা মোটরকার থাকত, তাহলে এ কষ্টটি পেতে হত না। রোজ ভোরে উঠে বোঁ করে বেরিয়ে যেতাম। খোসামোদ বরামদ উঞ্ছবৃত্তি যা করবার করে, বেলা দুপুর নাগাদ আবার বাড়ী ফিরে আসতাম। এখন, এ তিনদিন সে ভাল থাকলে বাঁচি।
০২. ঘাত-প্রতিঘাত
পরদিন প্রাতে উঠিয়া অন্তঃপুর হইতে সংবাদ আনাইয়া রাখাল জানিল, বউরাণী একটু ভাল আছেন।
স্নানাদি সমাপন করিয়া, বেলা আটটার সময় রাখাল অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল। বউরাণীর কক্ষের দ্বারের নিকট গিয়া দেখিল, দুইটি স্ত্রীলোক তাহার শয্যাপার্শ্বে বসিয়া আছে, রাখালকে দেখিয়া তাহারা সরিয়া গেল।
প্রবেশ করিয়া রাখাল দেখিল, তিনটি বালিস উপর্যুপরি রাখা, তাহাতে হেলান দিয়া বউরাণী বসিয়া আছে। রাখালকে দেখিয়া তিনি মাথায় কাপড় টানিয়া দিলেন।
শয্যার নিকট চেয়ারে বসিয়া রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, এখন কেমন আছ ইন্দু?
ক্ষীণস্বরে বউরাণী বলিলেন, ভাল আছি।
গা এখন গরম নেই ত?
পাণ্ডুবর্ণ ওষ্ঠাযুগল ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া বউরাণী উত্তর করিলেন, আমি কি জানি? গা জানে।
রাখাল তাহার মনোভাব বুঝিল। বউরাণীকে সে স্পর্শ করিল না, তাহার ললাটে অথবা হস্তে হস্ত রাখিয়া উত্তাপ পরীক্ষা না করিয়া মৌখিক প্রশ্ন করিল, তাই তাঁহার অভিমান। বিষাদপূর্ণ নেত্রে একবার বউরাণীর পানে চাহিয়া, পরক্ষণেই দৃষ্টি আনত করিয়া রাখাল ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিল। বলিল–তুমি ত জান ইন্দু!
আমি কি জানি?
জান ত–আমার দুর্ভাগ্য কি। রাখালের কণ্ঠস্বর অশ্রুবাষ্পে আপ্রায়।
বউরাণীও একটি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিলেন। তাহার পর চেষ্টাকৃত হাসির সহিত বলিলেন–না–না তুমি রাগ কোরো না। আমি তামাসা করে বলেছি বই ত নয়। দুর্ভাগ্য কেন? যে ব্রত ধারণ করেছ, সে ব্রত পালন করার মত শক্তি সংযম তোমার আছে, সে কি দুর্ভাগ্য–আমার গা এখন বেশ আছে। গরম নেই।
ঔষধ পথ্যাদির কথা, কবিরাজের কথা প্রভৃতির পর বউরাণী বলিলেন, তুমি এখনও মুখখানি অমন বিষণ্ণ করে রয়েছ কেন? আমি ঐ কথা বলেছি বলে?
রাখাল বলিল, না।
তবে তুমি কি ভাবছ?
রাখাল বলিল, দেখ ইন্দু, তুমি আজ ঐ কথা বলেছ বলেই যে আমার মন বিষণ্ণ হয়েছে, তা নয়। আমার ভারি অসহ্য হয়ে পড়েছে। এই ব্রতের ফেরে পড়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে। যতদিন তুমি সুস্থ ছিলে, ততদিন তোমায় ছুঁতে না পাবার জন্যে আমার কষ্ট হয়েছে বটে কিন্তু সে কষ্ট আমি সইতে পেরেছিলাম। কিন্তু যতদিন থেকে তুমি অসুখে পড়তে আরম্ভ করেছ–এইবার নিয়ে তোমার তিনবার অসুখ হল–ততদিন থেকে আমার সহ্য করবার ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। জ্বরের সময় মাথার বেদনায় তুমি ছটফট কর, তখন তোমার মাথাটিতে আমি হাত বুলিয়ে দিতে পাইনে, তোমার হাতটি ধরে আমি ওঠাতে অক্ষম, তোমার যখন শীত করে, তোমার গায়ে কাপড়খানা টেনে দেবারও অধিকার নেই–আমার মনের মধ্যে যে কি হয় তা তোমায় কি করে জানাব ইন্দু? ভাবছি, ব্রত–ট্ৰত ঢের হয়েছে, আর কায নেই–এইখানেই একে সাঙ্গ করে দিই।
বউরাণী অন্যদিকে চাহিয়া কয়েক মুহূর্ত নীরবে বসিয়া রহিলেন। তাঁহার যেন কান্না পাইতেছে। কিন্তু মনের সে ভাব তিনি প্রাণপণে দমন করিতে লাগিলেন। কৃতকাৰ্য্য হইয়া বলিলেন–তা কি হতে পারে? আমি কি তা হতে দিতে পারি? কখনই নয়। আমি তোমার ধর্মের সহায় না হয়ে কি অধৰ্ম্মের কারণ হব?
রাখাল কিছু বলিল না। তাহার হৃদয়ে বউরাণীর প্রতি একটা অবিমিশ্র শ্রদ্ধার ভাব উদিত হইল।
কয়েক মুহূর্ত পরে বউরাণী স্মিতমুখে বলিলেন, কেবল, একটি ঘটনা হলে, আমি বোধ হয় খুব স্বার্থপরের মত কায করব–তোমার ব্রত ভেঙ্গে দেব।
রাখাল বিস্মিত হইয়া বউরাণীর মুখের প্রতি চাহিল। রুদ্ধ কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করিল–কি সে ঘটনা ইন্দু?
বউরাণী ধীরে ধীরে বলিতে লাগিলেন, তোমার ব্রত উদযাপন হবার আগে, এ সাড়ে তিনমাসের ভিতর যদি আমার অন্তিমকাল উপস্থিত হয়–তা হলে–তা হলে–
রাখাল ভর্ৎসনার স্বরে বলিল, ছি ইন্দু–অমন কথা কি বলতে আছে? অমন অমঙ্গলের কথা মুখে এন না।
বউরাণী বলিলেন, অমঙ্গল? স্ত্রীলোকের পক্ষে এর চেয়ে আর কি মঙ্গল, কি সৌভাগ্য হতে পারে? সেদিন কিন্তু আমি আর শুনব না। মরবার সময় তোমার কোলে মাথা রেখে আমি মরব–তোমার ব্রত আমি মানব না।
কথা শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে বউরাণীর নেত্রযুগল অপূর্ণ হইয়া আসিল। মুখে হাসি, চোখে জল–সেই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখিয়া রাখাল মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া রহিল। কিন্তু তাহা অল্পক্ষণের জন্য মাত্র। ধীরে ধীরে তাহার হৃদয়ে একটা বেদনার সঞ্চার হইল। সে বেদনা আত্মগ্লানিপ্রসূত–নিজের প্রতি ধিক্কারজনিত।
বউরাণী মনে করিলেন, তাঁহার মরিবার কথাতেই রাখাল বুঝি ব্যথা পাইয়াছে। মন ফিরাইবার জন্য অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন। চক্ষু মুছিয়া বলিলেন–হ্যা গা, শুনলাম নাকি কালেক্টার সাহেব আমাদের কোন গ্রামে আসছেন?
রাখাল বলিল, হ্যাঁ, মির্জাহাটে আসছেন।
সে কতদূর
ভদ্রকালীর কাছে।
তবে ত অনেক দূর! বন্দোবস্ত–টন্দোবস্ত হয়েছে?
হয়েছে। কলকাতায় তোক গেছে ডালি কিনে আনতে। অন্য জিনিষপত্র সরবরাহ করবার জন্যে দ্রকালীর নায়েবের কাছে হুকুমনামা পাঠান হয়েছে। সে সব ত হয়েছে, কিন্তু আমি বড় মুস্কিলে পড়ে গেছি।
কেন কি হয়েছে?
দেওয়ানজির সঙ্গে রাখালের গতরাত্রে যে সমস্ত কথাবার্তা হইয়াছিল তাহা বউরাণীকে শুনাইয়া বলিল, তোমার শরীরের এই অবস্থা, এখন ততদিন তোমায় ছেড়ে আমি কি করে যাই?
বউরাণী একটু ভাবিলেন। তাঁহার মুখে অভিমানের ছায়া আসিয়া জমা হইতে লাগিল। হঠাৎ বলিলেন–তিনদিন ছেড়ে থাকতে কাতর হচ্ছ, ষোল বছর আমায় ছেড়ে ছিলে কি করে? তাহার ওষ্ঠযুগল আজ অল্প স্ফীত হইয়া উঠিল।
রাখাল মনে করিল বলি, তখন যে তোমায় চিনিনি বুঝিনি। বেশ উত্তর হইত–ভালবাসাও প্রকাশ পাইত–কিন্তু এ মিথ্যা কৈফিয়ৎ তাহার কণ্ঠমূলে আসিয়া বাধিয়া গেল। সে ভাবিল, ছি ছি–আমার প্রতি এত বিশ্বাস, এত ভালবাসা যার, তাহাকে মিথ্যা কথা বলিয়া আমি প্রবঞ্চনা করিব? আমায় ধিক্। সেই ক্ষোভ সেই আত্মগ্লানি আবার তাহার বুকে তরঙ্গ তুলিল। রাখাল নীরব হইয়া রহিল।
বউরাণী ভুল বুঝিয়া মনে করিলেন তাঁহার শ্লেষে লজ্জা পাইয়াই সে অমন করিয়া রহিল। তাড়াতাড়ি বলিলেন–তোমার মনে কি আমি দুঃখ দিলাম? আমি আজ ক্রমাগত তোমায় আঘাত করছি। রোগ হয়ে কি যেন এক জন্তু হয়ে গেছি!–তুমি আমায় মাফ কর। দেখ, তোমার কাছে যদি অভিমান না করব, তবে কার কাছে করব?
বউরাণীর কণ্ঠস্বরটি এমন কোমল করুণামাখা, এমন মধুর মিনতিপূর্ণ, এমন একটা আত্মসমর্পণের সুর তাহার মধ্যে ধ্বনিত হইয়া উঠিল যে রাখালের আত্মগ্লানি বাড়িল বই কমিল না। তাহার এ ভাবও বউরাণী লক্ষ্য করিলেন, করিয়া ব্যথিত হইলেন। রাখালের মন অন্যদিকে ফিরাইবার জন্য আর একবার যত্ন করিলেন। বলিলেন–ভদ্রকালীতে বড় জাগত্র কালী আছেন শুনেছ?
না। খুব জাগ্রত নাকি?
হ্যা গো, সকলেই বলে।
রাখাল কম্পিত স্বরে বলিল, তবে আমি সেখানে মার কাছে পূজো মানত করে আসব, যাতে তুমি আমার শীগগির ভাল হয়ে উঠ।
বউরাণী বলিলেন, দেখ–এই বলে মানত কোরো যে, ভাল হয়ে, আমরা দুজনে একত্র গিয়ে মার পূজো দিয়ে আসব–কেমন?
হ্যাঁ, তাই মানত করব।
আর, মার প্রসাদী একটু সিঁদূর আমার জন্যে নিয়ে এস–কেমন?
অবশ্য নিয়ে আসব।
এই সময় পর্দার বাহিরে দাঁড়াইয়া রাণীমা বলিলেন, বাবা ভবেন।
রাখাল বলিল, কি মা?
বউমা এখন সাবু খাবেন কি? সাবু তৈরি হয়েছে। –বলিতে বলিতে পর্দা সরাইয়া তিনি প্রবেশ করিলেন।
রাখাল দাঁড়াইয়া উঠিল, বুঝিল তাহাকে বাহিরে যাইতে হইবে।
কাছে আসিয়া রাণীমা জিজ্ঞাসা করিলেন, হ্যা বাবা, কবিরাজী চিকিৎসা ত এতদিন হল, জ্বরটুকু ছেড়েও ছাড়ছে না, বার বার তিনবার ঘুরে ঘুরে পড়লেন। সদর থেকে কোনও ডাক্তারকে আনিয়ে একবার দেখালে ভাল হয় না?
রাখাল বলিল, হ্যা মা আমিও সেই কথা ভাবছিলাম। যাই দেওয়ান কাকাকে জিজ্ঞাসা করি, দেখি তিনি কি বলেন।
তাই পরামর্শ করে একটা ব্যবস্থা কর বাবা। মার আমার শরীর শুকিয়ে আধখানি হয়ে গেছে। যদি ডাক্তার হাওয়া–টাওয়া বদলাতে বলে, না হয় হাওয়া বদলাতেই নিয়ে যাও।
বউরাণীর সাক্ষাতে এ বিষয়ে অধিক চর্চা করা রাখালের ইচ্ছা নহে। দেখি ডাক্তার এসে কি বলেন। –বলিয়া তাড়াতাড়ি সে বাহির হইয়া গেল।
০৩. মুসলমান ও মেষশাবক
আহারাদির পর রাখাল রওয়ানা হইল। পাল্কীতে এত দীর্ঘপথ পূৰ্ব্বে কখনও সে অতিক্রম করে নাই। ছাড়িবার সময় পাল্কীর মাঝখানটিতে রাখাল বসিয়াছিল। ক্রোশখানেক পথ, দুই পার্শ্বে শস্যক্ষেত্র দেখিতে দেখিতে চলিল। ক্রমে দোলানিতে তাহার দ্ৰিাবেশ হইল। ধীরে ধীরে সাবধানে সে শয়ন করিল এবং শীঘ্রই ঘুমাইয়া পড়িল। ঘণ্টাখানেক পরে আবার তাহার চেতনা হইল। ঘড়ি খুলিয়া দেখিল, বেলা দুইটা বাজিয়াছে। উপাধানের নিম হইতে পাণের ডিবা বাহির করিয়া একটা পাণ মুখে দিয়া, অলসভাবে বাহিরের পানে চাহিয়া রহিল। ধীরে ধীরে বউরাণীর চিন্তা তাহার মনের মধ্যে প্রবেশ করিল। ভাবিতে লাগিল–আজ তাহাকে দেখিতে পাইব না। কল্য নয়–পরশুও নয়। তৎপরদিন সন্ধ্যা নাগাদ আবার সাক্ষাৎ হইবে। বউরাণী এখন কি করিতেছেন, কি বলিতেছেন, কে কে তাহার কাছে আছে, গা–টি এখনও শীতল আছে কি না–এই সকল কথা রাখাল চিন্তা করিতে লাগিল। বারম্বার এই কথাই তাহার মনে বেদনা দিতে লাগিল–তিনদিন তাহার সহিত দেখা হইবে না–তার পর দিন? –দেখা হইবে ত? মানুষের শরীর–পদ্মপত্রের জল–বলা ত যায় না। যদি ফিরিয়া দেখি–বউরাণী নাই!–কঠিন পীড়া, কখন কি হয় বলা ত যায় না। –যদি গিয়া দেখি, বাড়ীর লোক সকলে কাঁদিতেছে–সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে! এ কথা ভাবিতে রাখালের হৃৎকম্প উপস্থিত হইল, সৰ্ব্বশরীর শিহরিয়া উঠিল–ধীরে ধীরে সে চক্ষু মুদ্রিত করিল। তাহার সেই মুদ্রিত চক্ষু হইতে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়াইয়া পাল্কীর বিছানায় পড়িতে লাগিল।
কিয়ৎক্ষণ এইরূপে কাটিলে, রাখাল চক্ষু খুলিল। ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল। আলখাল্লার প্রান্ত দিয়া চক্ষু মুছিয়া মনে মনে বলিল–না, তাই কি হতে পারে? ভগবান কি আমার উপর এমনই নিষ্ঠুর হবেন? –কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার তাহার মনে। হইল–আমাকে ভগবান দয়া করবেন কেন? আমি যে মহাপাপী। ফুলের মত কোমল নিৰ্ম্মল যে জঙ্গাজলের মত স্নিগ্ধ পবিত্র যে–তারই আমি সৰ্ব্বনাশ করতে বসেছি–ভগবান আমায় কৃপা করবেন কি?
এইরূপ চিন্তায় একঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইলে পাল্কী একটি ক্ষুদ্র গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করিল। পথের একপার্শ্বে বৃহৎ বটবৃক্ষ–অন্য পার্শ্বে একটি পুরষ্করিণী–কিয়দ্দূরে মুড়ি–মুড়কি পাটালিগুড় প্রভৃতির একখানি দোকান দেখা যাইতেছে। বেহারাগণ সেই বটবৃক্ষতলে পাল্কীখানি নামাইল। তাহাদের মধ্যে যে ব্যক্তি প্রবীণ সে আসিয়া যোড়হস্তে বলিল, হুজুর, যদি হুকুম হয় ত এইখানে আমরা একটু জিরিয়ে জল খেয়ে নিই।
বেশ। এই নাও। –বলিয়া রাখাল একটি টাকা বেহারার হাতে দিল। পাল্কীতে একভাবে অনেকক্ষণ থাকিয়া তাহারও দেহ আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছিল, তাই সে নামিয়া পড়িল। জিজ্ঞাসা করিল–এটা কোন্ গ্রাম?
বেহারা বলিল, এটা চেড়াগা হুজুর। এখানে মুসলমানই বেশী–হিঁদু খুব কম।
কার জমিদারী?
মৌগঞ্জের সিঙ্গিবাবুদের।
রাখাল সিংহবাবুদের নাম শুনিয়াছিল। অত্যাচারী প্রজাপীড়ক বলিয়া তাহাদের অখ্যাতি আছে।
হাত পা ধুইবার জন্য বেহারাগণ পুষ্করিণীতে নামিল। রাখাল পদচারণা করিতে করিতে গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করিল। ছোট ছোট নীচু বাটীর ঘর–কাহারও একখানি কাহারও বা দুইখানি মাত্র–উঠানে হাঁস মুর্গী চরিতেছে, চালে লাউ কুমড়ার গাছ। কোথাও বা কোন মুসলমান রমণী কুটীরের দাওয়াতে চরকা কাটিতেছে; কোনও সম্পন্ন গৃহস্থের বিবি চোখে কাজল কাণে রূপার ঝুমকা হাতে রূপার বাজু পরিয়া উঠানে বসিয়া শিশুকে স্তন্যপান করাইতেছে। এই সকল দেখিতে দেখিতে রাখাল অগ্রসর হইল।
কিয়দ্দূর গিয়া দেখিল একটা কুটীরের অঙ্গনে কয়েকজন লোক একত্র হইয়া গোলমাল করিতেছে। দুই ব্যক্তি, একটা হৃষ্টপুষ্ট মেষশাবকের বন্ধনরঙ্কু ধরিয়া টানাটানি ও বচসা করিতেছে–বাকী লোক দাঁড়াইয়া তামাসা দেখিতেছে। একজন–সে মুসলমান–বলিতেছে–এ ভেড়া আমি কিছুতেই দিমুনা–জান্ গেলেও না। অপর ব্যক্তি হিন্দু–ইহার হস্তে একটা লাঠি এবং মাথায় পাগড়ী–বলিতেছে–দিবিনে? তোর বাপ যে সে দেবে। জমিদারের হুকুম। দিবিনে? –মুসলমান বলিতেছেজমিদারের জমি মাংনা ত রাখিনে। খাজনা নেয় না? পোষা ভেড়া আমি দিমু ক্যান? এহ–জুলুম! কুটীরের দাওয়াতে একটি দশ বারো বৎসরের ছেলে মুখখানি কাদ কাদ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে; তাহার পশ্চাতে চালের বাতা ধরিয়া একজন বয়স্কা রমণী, বোধ হয় বালকের মাতা।
ব্যাপারটা কি বুঝিতে না পারিয়া পথ হইতে রাখাল অঙ্গনে উঠিয়া বলিল, তোমরা সব এখানে কি গোলমাল লাগিয়েছ?
মুসলমানটি বলিল, ঠাউর, সেলাম। আপনি ত হেঁদুরের সাধু, আপনি কন্ ত। আমি এই ভেড়াটি আপনার পুতের মত পেলেছি পুষেছি। নিজে না খেয়ে ওকে খাওয়াইয়েছি। খাইয়ে এত বড়ষ্টা করেছি। আমার পেয়ারের জানোয়ার, আমি দিমু ক্যান হুজুর? নিয়ে গিয়ে ওকে জবা করবে!
অপর লোকটা চীকার করিয়া বলিল, বেটার সয়তানি দেখ! জমিদারের বাড়ীতে কাল খানা–কলকাতা থেকে বড় বড় বাবুরা এসছে–দিবিনে? দিবি ত দে, নৈলে জুতিয়ে খাল খিচে দেব। –বলিয়া দড়ি ধরিয়া সে একটা হেঁচকা টান দিল, ভেড়াটা মাটীতে পড়িয়া ভ্যা ভ্যা করিতে লাগিল।
রাখাল ক্রদ্ধ হইয়া বলিল, তুই কে রে?
সে মুখ বিকৃতি করিয়া উত্তর করিল, ঈস–লাট এসেছেন! ভারি ত সাধু–ওনার কাছে নিকেশ দিতে হবে আমি কে রে! আমি সিঙ্গিবাবুদের বর্কন্দাজ–কারু তোয়াক্কা রাখি? যাও যাও ঠাকুর–এগায়ে ভিখ মিলবে না–এখানে সব মুসলমান।
রাখাল ধৈৰ্য্য হারাইয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, চোপরাও হারামজাদা! যার জিনিষ সে দেবে না, তুই জোর করে নিয়ে যাবি?
অন্যান্য মুসলমান যাহারা এতক্ষণ দর্শকভাবে উপস্থিত ছিল মাত্র, দুর্দান্ত জমিদারের ভয়ে কথাটি কহিতে সাহস করিতেছিল না–অপরিচিত সন্ন্যাসীর এই জোর দেখিয়া তাহাদেরও মুখ ফুটিল। কেহ বলিল–হবিব ভাই, দিসনে। তোর ভেড়া তুই দিবি ক্যান? কেহ বলিল, জুলুম? দেখি ত বন্দাজের ছাওয়াল ক্যামনে এ ভেড়া নিয়ে যায়!–কেহ বা আরও চড়া চড়া কথা বলিতে লাগিল।
সাধু সন্ন্যাসীর অভিশাপের ভয়েই হউক, অথবা মুসলমানেরা সমবেত হইতেছে দেখিয়াই হউক, এতক্ষণে বৰ্কন্দাজ একটু নরম হইল। সুর নামাইয়া বলিল–আমি ত আর অমনি চাচ্ছিনে। যা উচিত মূল্য হয়–নে। টাকা দিচ্ছি।
হবিবুল্লা বলিল, রাখি দে তোর ট্যাকা। যারে পেয়ার করি, তার গলায় ছুরি দিতে দিমু ক্যান্? ক খনো না। জান গেলেও না।
রাখাল বলিল, ওহে জমিদারের বর্কন্দাজ, ভাল চাও ত মানে মানে বিদায় হও। তোমার মনিবের ভেড়া খেতে সাধ হয়ে থাকে ত, যে ইচ্ছ করে বেচবে তার ভেড়া কিনে নিয়ে যাও। গরীবের উপর জুলুম কোরো না।
বর্কন্দাজ রাখালের প্রতি দৃকপাত মাত্র না করিয়া তর্জনী হেলাইয়া বলিল, আচ্ছা থাক বেটারা। জমিদারের অপমান! মজাটা দেখাচ্ছি। –বলিয়া রাগে গর গর করিতে করিতে প্রস্থান করিল।
রাখাল দেখিল, বৰ্কন্দাজের শেষের কথা শুনিয়া সকলেই একটা আতঙ্ক উপস্থিত হইয়াছে। তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল, এই দফা সারলে রে! একখানকে সাতখান করে গিয়ে নাগাবে। জমিদার হয়ত নেঠে পেঠিয়ে দেবে। –হবিবুল্লা বলিল, দেয় দেবে। মরি ত মরব–একবার বই ত নয়।
রাখাল বলিল, দেখ, তোমাদের জমিদার ভাল লোক নয়। যদি তোমাদের উপর কোনও অত্যাচার হয়–কালকে মির্জাহাটে কালেক্টার সাহেবের তাবু পড়বে, তিনদিন তিনি সেখানে থাকবেন–তোমরা তাঁকে গিয়ে সব কথা জানিও। –বলিয়া রাখাল প্রস্থান করিল; মুসলমানগণ সসম্মানে তাহাকে অভিবাদন করিতে লাগিল।
পাল্কীর নিকট পৌঁছিয়া রাখাল দেখিল, বেহারাগণ জল পান করিয়া প্রস্তুত হইয়া বসিয়া আছে। পাল্কী আবার গন্তব্যপথ ধরিল।
বসিয়া বসিয়া রাখাল এইমাত্ৰ–দৃষ্ট ব্যাপারটি মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিল। আর সকল কথার উপরে–যারে পেয়ার করি তার গলায় ছুরি দিতে দিমু ক্যান্। –এই কথাগুলিই তাহার কর্ণে যেন বারম্বার ধ্বনিত হইতে লাগিল। একজন সামান্য মুসলমান, সে যে প্রবল পরাক্রান্ত জমিদারের রোষানল উপেক্ষা করিয়া, নিজ নিশ্চিত বিপদকে তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া, আপন স্নেহের পাত্রটিকে রক্ষা করিল–ইহাতে রাখাল লোকটার প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করিতে লাগিল। মনে মনে বলিল, এই ত চাই।
মানসিক উত্তেজনা কতকটা নিবৃত্ত হইলে, রাখাল আবার বউরাণীর চিন্তায় মগ্ন হইল। আসিবার সময় তাহাকে ভাল দেখিয়া আসিয়াছে। ভাবিল ফিরিয়া গিয়া কৃষ্ণনগর হইতে ডাক্তার সাহেবকে আনাইয়া একবার দেখাইব; তিনি যদি বায়ু পরিবর্তনের উপদেশ দেন, তবে বায়ু পরিবর্তনে লইয়া যাইব। সিমলা হউক–নৈনিতাল হউক–দার্জিলিঙ হউক, ডাক্তার সাহেব যেমন বলিবেন। তাহা হইলেই বউরাণী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করিবেন। আমার অলীক ব্রতের কাল প্রায় তিনমাস অতীত হইয়াছে। আর তিনমাস পরেই। হঠাৎ রাখালের মুখ বিমর্ষ হইয়া গেল। কে যেন তাহার বুকে সজোরে এক চাবুক মারিল। তাহার চক্ষু বিস্কুরিত হইল, নাসিকা স্ফীত হইল, নিশ্বাস ঘন ঘন বহিতে লাগিল।
অল্পে অল্পে রাখালের মস্তকটি অবনত হইয়া পড়িল। স্তব্ধ হইয়া এই ভাবে অনেকক্ষণ সে বসিয়া রহিল। বসিয়া অনেকক্ষণ ভাবিল। তাহার চোখ দিয়া ফোঁটা ফোঁটা জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। শেষে অস্ফুটস্বরে রাখাল বলিল, সেই নিরক্ষর নীচ মুসলমানের যেটুকু ধৰ্ম্মজ্ঞান আছে, আমার কি তাও নেই? যে যাকে পেয়ার করে, অন্য কেউ পাছে তার গলায় ছুরি দেয় এজন্যে সে আপনার জান কবুল করেছে। আমি যাকে ভালবাসি, আমি যে স্বহস্তেই তার গলায় ছুরি দিতে উদ্যত হয়েছি! আমায় ধিক্–আমার অদৃষ্টকে ধিক্।
০৪. ব্যাধি বড় প্রবল
কালেক্টর সাহেবকে খাতির করিয়া তিনদিন পর রাখাল বাশুলিপাড়ায় ফিরিল। তখন অপরাহ্নকাল। সকলে তাহাকে দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। এ তিনদিনে তাহার মুখ চক্ষু যেন কেমন হইয়া গিয়াছে। অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতেই রাণীমা শঙ্কিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, বাবা ভবেন, সেখানে গিয়ে কিছু অসুখ–বিসুখ হয়েছিল?
রাখাল বলিল, না মা!
তবে তোমার চেহারা অমন হয়ে গেল কেন বাবা?
বোধ হয় পথের কষ্টে। –বলিয়া রাখাল সেখান হইতে সরিয়া পড়িল।
বউরাণীর নিকট গিয়া দেখিল, তিনি একটু ভাল আছেন। সে অবধি আর জ্বর আসে নাই, কাসিটাও একটু কমিয়াছে। বউরাণীও তাহার ভাবান্তর লক্ষ্য করিলেন। বলিলেন–তুমি সেখানে কেমন ছিলে?
ভাল ছিলাম।
তোমার চোখ মুখ অমন বসে গেছে কেন?
রাখাল বলিল, না, ও কিছু নয়।
বউরাণীও মনে করিলেন বোধ হয় পথের কষ্টে ওরূপ হইয়াছে। দুইচারিটি অন্যান্য কথার পর জিজ্ঞাসা করিলেন–মা দ্রকালীকে দর্শন করে এসেছ?
এসেছি।
যা বলেছিলাম, সেই রকম পূজো মানৎ করেছ?
কয়েক মুহূর্তকাল নীরব থাকিয়া রাখাল বলিল, না।
এ উত্তরে বউরাণী একটু বিস্ময় অনুভব করিলেন। কি হইয়াছে কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। রাখালও অধিকক্ষণ সেখানে রহিল না। জলযোগদি সারিয়া বহিৰ্বাটিতে আসিয়া বসিল।
সন্ধ্যার পর দেওয়ানজি আসিলেন। বউরাণীর স্বাস্থ্য, কালেক্টার সাহেবের সংবাদ প্রভৃতির আলোচনা শেষ হইলে তিনি বলিলেন–বাবা, আমাকে মাসখানেক ছুটি দিতে হচ্ছে।
রাখাল বলিল, কেন কাকা?
আমার শরীরটা এদানী বড়ই খারাপ হয়েছে। তাই মনে করছি, দার্জিলিঙে গিয়া মাসখানেক থাকি। সে বছর কর্তার সঙ্গে দার্জিলিঙ গিয়েছিলাম, পনেরটি দিন মাত্র ছিলাম, তাতে যথেষ্ট উপকার হয়েছিল। খুব বেড়াতাম, খুব ক্ষিধে হত। একবার ঘুরে আসি।
রাখাল বলিল, তা আপনার স্বাস্থ্যের জন্যে যদি আবশ্যক বিবেচনা করেন, বেশ ত ঘুরে আসুন।
দেওয়ানজি বলিলেন, কিন্তু কাযকৰ্ম্ম তুমি একটু দেখো শুনো বাবা। নায়েব দেওয়ান যিনি আছেন তিনি অবশ্য পাকা লোক; কিন্তু নিজের সম্পত্তি নিজে না দেখলে সব নয়ছয় হয়ে যাবে।
অতঃপর দেওয়ানজি কাযকৰ্ম্ম সম্বন্ধে রাখালকে নানা উপদেশ দিতে লাগিলেন, কিন্তু কোন কথাই রাখালের কাণে প্রবেশ করিল না। তাহার মন জমিদারী হিসাবপত্রের শতযোজন উর্দ্ধে বিচরণ করিতেছিল। এ কয়দিন সে যে চিন্তায় ব্যাপৃত ছিল সেই চিন্তাতেই বিভোর হইয়া রহিল।
বহুক্ষণ বাক্যব্যয়ের পর দেওয়ানজি বুঝিলেন শ্রোতার মনোযোগ নাই!
তখন তিনি থামিলেন–একটি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন–আচ্ছা বাবা, আজ তা হলে উঠি, রাত হল।
রাখালও দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, আসুন কাকা।
দেওয়ানজি বিদায় লইলে রাখাল তামাক হুকুম করিল। ধূমপান করিতে করিতে সেই নির্জন কক্ষে বসিয়া কত কি আকাশ পাতাল চিন্তা করিতে লাগিল। কয়েকটান টানিবার পর, আলবোলার নল তাহার হাত হইতে খসিয়া পড়িল। লোকে বলে তাম্রকূটের ধূম চিন্তা–ব্যাধির মহৌষধি। কিন্তু ব্যাধি যখন বড় প্রবল, তখন মহৌষধিও আর ফলদায়ক হয় না। রাখালের এখন সেই অবস্থা।
কিয়ৎক্ষণ পরে ভোজন প্রস্তুত হইবার সংবাদ আসিল। রাখাল অন্তঃপুরে গিয়া ভোজনে বসিল, কিন্তু সে নাম মাত্র। আহাৰ্য্যদ্রব্য যেমন ছিল, পাতে প্রায় তেমনিই পড়িয়া রহিল। রাণীমা কাছে বসিয়া ছিলেন, উঠিতে দেখিয়া বলিলেন–ওকি ভবেন, কিছুই যে খেলিনে!
রাখাল বলিল, না মা, আজ ক্ষিধে নেই।
শরীর ভাল আছে ত?
আছে।
রাণীমা কাতরস্বরে বলিলেন, না বাবা, আমায় ভাড়াসনে। তোর কি হয়েছে বল্। তোর শরীর নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে। কবিরাজ মশাইকে ডেকে পাঠাব?
রাখাল বলিল, না, কবিরাজ ডাকতে হবে না। আপনিই সেরে যাবে। –বলিয়া সে মুখ প্রক্ষালনে ব্যাপৃত হইল।
অন্যান্য দিন-বিশেষ যখন হইতে বউরাণী পীড়িত হইয়াছেন–শয়ন করিতে যাইবার পূৰ্ব্বে রাখাল তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, দুই দণ্ড কথাবার্তা কহিয়া তবে যায়।
আজ আর তাহা করিল না। বৈঠকখানা বাড়ীতে গিয়া শয়নকক্ষের দ্বার বন্ধ করিল; ভৃত্য তামাক সাজিয়া আনিয়াছিল, দ্বার বন্ধ দেখিয়া কিয়ৎক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করিল, দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কলিকায় ফুঁ দিল, একটু আধটু গলার আওয়াজ করিল, যদি বাবু দ্বার খুলিয়া দেন–তথাপি কোনও ফল হইল না। ভৃত্য তখন অগত্যা কলিকাটি খুলিয়া লইয়া নীচে নামিয়া গেল এবং সবন্ধু সেটির সদ্ব্যবহারে প্রবৃত্ত হইল।
০৫. রাখাল মনস্থির করিল
দুই দিবস পরে বউরাণী অন্নপথ্য করিলেন। পরদিন দেওয়ানজি দার্জিলিঙ যাত্রা করিলেন।
এ উভয় ঘটনার জন্যই রাখাল অপেক্ষা করিয়াছিল, নচেৎ সে মনস্থির করিয়াছে–বুক বাঁধিয়া লইয়াছে। তাহার সকল দ্বিধাই কাটিয়া গিয়াছে। ভালবাসার বুকে সে ছুরি মারিবে না, বিশ্বাসের স্থানে সে প্রতারণা করিবে না, বউরাণীকে সকল কথাই সে খুলিয়া বলিবে। তাহার পর যাহা হয় হউক।
দ্বিপ্রহরের পর দেওয়ানজিকে পাল্কীতে তুলিয়া দিয়া, নিজ শয়নকক্ষে ফিরিয়া আসিয়া রাখাল আবার ভাবিতে বসিল। এখন তাহার মুখমণ্ডলে বিগত কয়েক দিনের সে অশান্তির ছায়াটা আর নাই। স্বীয় কর্তব্য সম্বন্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া তাহার মনে শান্তি ফিরিয়া আসিয়াছে। কিন্তু যাতনারও অন্ত নাই, চিন্তারও অবধি নাই।
এখন তাহার প্রধান চিন্তা নিজ ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে। এখান হইতে যাইতে হইবে–কালই হউক পরশুই হউক। এইখানেই প্রতিমাখানিকে বিসর্জন দিয়া যাইতে হইবে, এ জীবনে দেখা হইবে না। না দেখিয়া, জীবন কি করিয়া কাটিবে?
অন্ধকারময় নিজ ভবিষ্যৎ জীবনের মধ্যে রাখাল কোথাও যে একটু আলোকের সন্ধান না পাইতেছে এমন নহে। এখন সে ভাবিতেছে, আমার বড় সাধের প্রতিমা বিসর্জন দিয়া যাইতে আমার বুক ফাটিয়া যাইবে। তা যাউক–আমার পূজার প্রতিমাখানিকে আমি অপবিত্র করিলাম না, এই আমার সান্ত্বনা। ঐটুকুই আমার অবশিষ্ট জীবনের চির অন্ধকারের মধ্যে আলোক রেখা। যাহাকে ভালবাসিয়াছি, তাহার গলায় যে আমি ছুরি দিলাম না, যাহাকে পূজা করিবার জন্য বুকের সিংহাসন পাতিয়াছিলাম তাহাকে কলঙ্কিত করিলাম না–ইহাই আমার ভাবী জীবন আলো করিয়া রত্নদীপের মত জ্বলিবে।
রাখাল স্থির করিয়াছে, আজ বিকালে বউরাণীকে অন্তঃপুরের উদ্যানে লইয়া গিয়া, সকল কথা তাহাকে বলিবে। কৃত অপরাধের জন্য তাঁহার পায়ে শত সহস্র ক্ষমা চাহিয়া, চিরবিদায় গ্রহণ করিবে।
ঘড়িতে চারিটা বাজিলে, মনে মনে এই সঙ্কল্প লইয়া রাখাল অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল। গিয়া দেখিল বউরাণী তাঁহার কক্ষে বসিয়া একখানি পুস্তক পাঠ করিতেছেন। রাখালকে দেখিয়া তিনি লজ্জিত হইয়া পুস্তক বন্ধ করিলেন।
রাখাল নিকটস্থ একখানি চেয়ারে বসিয়া বলিল, চল, বাগানে বেড়াতে যাবে? –বলিয়া সে নিজেই বুঝিতে পারিল, তাহার কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন অদ্ভুত রকম শুনাইল।
বউরাণী তাহার মুখের পানে শঙ্কিত দৃষ্টিতে কয়েক মুহূৰ্ত্ত চাহিয়া রহিলেন। শেষে বলিলেন–কেমন আছ?
রাখাল বলিল, ভাল আছি।
তোমার গলা এমন ভারি হয়েছে, চোখ ফুলেছে কেন?
রাখাল সে কথায় উত্তর না দিয়া বলিল, বাগানে এস, সেইখানে বলব।
পূর্বপ্রথা মত প্রথমে বউরাণী উদ্যানে গেলেন। কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিয়া রাখালও সেখানে গিয়া নির্দিষ্ট স্থানে বউরাণীর সহিত মিলিত হইল।
দুইজনে তখন পাশাপাশি হইয়া বাগানে বেড়াইতে লাগিল। বউরাণী মাঝে মাঝে কাতরদৃষ্টিতে রাখালের পানে চাহিতে লাগিলেন।
নিজ বক্তব্য আরম্ভ করিবার জন্য রাখাল প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিল, কিন্তু একবারও কৃতকাৰ্য্য হইল না। কণ্ঠ অবধি আসিয়া কথা বাধিয়া যায়, কিছুতেই বাহির হইতে চায় না।
বউরাণী কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলেন, আমার একটি কথা রাখবে?
রাখাল বলিল, কি বল।
বউরাণী বলিলেন, তোমার শরীর মন দুই খারাপ হয়েছে। ষোল বচ্ছর পশ্চিমে ছিলে, হঠাৎ এ বাঙ্গলা দেশে এসে এখানকার জলহাওয়া তোমার সহ্য হচ্ছে না। আর ষোল বচ্ছরকাল সে একভাবে জীবন কাটিয়েছ, এখন সম্পূর্ণ অন্যরকম অবস্থার মধ্যে পড়েছ, মনও তোমার বিকল হয়ে গেছে। আমি বলি কিচল, কিছুদিন তোমাতে আমাতে পশ্চিমে বেড়িয়ে আসি। মাও অনেকদিন থেকে তীর্থে যাব যাব করছেন–চল, আমরা দুজনে ওঁকে তীর্থ–দর্শন করিয়ে নিয়ে আসি। মাসদেড়েক বেড়িয়ে, পূজোর আগে আবার ফিরে আসা যাবে। কি বল?
উত্তরের জন্য বউরাণী কিয়ৎক্ষণ নিষ্ফল অপেক্ষার পর আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি বল?
রাখালের যেন হঠাৎ চমক ভাঙ্গিল। জিজ্ঞাসা করিল–আঁ?
বউরাণী বলিলেন, কি বল? যাবে? তাহলে আমি মাকে বলি, সব উয্যুগ করি?
রাখাল বলিল, কোথা যাবার কথা বলছ?
বউরাণী বলিলেন, আমি এতক্ষণ যা বললাম শোননি?
রাখাল লজ্জিত হইয়া বলিল, আমি একটা অন্য বিষয় ভাবছিলাম। তেমন মনোযোগ করিনি। কি বলছিলে বল ত।
বউরাণী তাহার পূর্ব প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি করিলেন। শুনিয়া রাখাল বলিল, আচ্ছা, ভেবে দেখি।
এতক্ষণে রাখাল হৃদয়ঙ্গম করিয়াছে, যাহা বলিবার আছে তাহা বউরাণীর সাক্ষাতে বলার মত শক্তি তাহার নাই। আজ রাত্রে বসিয়া একখানি চিঠিতে তাহাকে সকল কথা। সে লিখিবে, কল্য সুযোগমত কোনও সময় সেখানি তাঁহার হস্তে দিবে।
.
রাত্রে আহারাদির পর শয়নকক্ষে আসিয়া, রাখাল বউরাণীকে পত্র লিখিতে বসিল।
এক পৃষ্ঠা, দুই পৃষ্ঠা, তিন পৃষ্ঠা লেখে, লিখিয়া ছিঁড়িয়া ফেলে, আবার আরম্ভ করে। এক একবার কলম নামাইয়া, উৰ্দ্ধমুখ হইয়া বসিয়া ভাবে–আবার লিখিতে থাকে। মাঝে মাঝে চেয়ারে হেলিয়া পড়িয়া হস্ত দ্বারায় চক্ষু আবৃত করিয়া খানিক কাদিয়া লয়। চক্ষু মুছিয়া আবার লেখে। এইরূপ করিতে করিতে রাত্রি একটা বাজিল, দুইটা বাজিল, তিনটাও বাজিয়াও গেল।
পত্র লেখা প্রায় শেষ হইয়াছে, আর পৃষ্ঠাখানেক হইলেই হয়। কিন্তু এখন রাখালের হাত কাঁপিতে লাগিল। সারারাত বাতির কাছে বসিয়া থাকিয়া মাথা কেমন ঝিম ঝিম করিয়া উঠিল। তাই সে ভাবিল, বাহিরে গিয়া ছাদের মুক্ত–বায়ুতে একটু বেড়াই, তাহার পর পত্র শেষ করিয়া শয়ন করিব।
এই ভাবিয়া টেবিল ছাড়িয়া রাখাল উঠিল। দ্বার খুলিয়া বাহিরে গিয়া ছাদে পদচারণা। করিতে লাগিল। ভাদ্রমাস, তথাপি আকাশ আজ মেঘ শূন্য। চন্দ্র অস্তগত, সেই নিৰ্ম্মেঘ আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলিতেছে। চারিদিক নিস্তব্ধ–বনের ঝিল্লীরাও ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। মৃদুমন্দ বাতাস বহিতেছে।
কিছুক্ষণ পদচারণা করিতে করিতে হঠাৎ কি একটা কথা রাখালের মনে হইল–ছাদের মাঝে থমকিয়া সে দাঁড়াইল। কিছুক্ষণ ভাবিল। তাহার পর কক্ষমধ্যে ফিরিয়া আসিয়া, পত্রখানির শেষ পৃষ্ঠা লিখিয়া, আলোক নিৰ্ব্বাণ করিয়া শয়ন করিল।
যতক্ষণ নিদ্রা না আসিল, ততক্ষণ রাখাল পত্রের শেষাংশের কথাটিই ভাবিতে লাগিল। মনে মনে বলিল–বৃথা আশা! বৃথা আশা! সেই যে পড়েছিলাম।
কিন্তু মজ্জমান জন শুনিয়াছি ধরে।
তৃণে, যদি আর কিছু না পায় সম্মুখে।
আমার এ আশাও তাই। যাই হোক, দুটো দিন বই ত নয়। কালই এখান থেকে চলে যাব ভেবেছিলাম, না হয় আর দুটো দিন রইলাম। গোলমাল একটা হবেই–হয়ত এরা আমাকে পুলিশেও দিতে পারে। জেল হবে? হয় হোক, জেলের বাইরে জেলের ভিতরে, আমার পক্ষে দুই সমান।
ক্রমে রাখাল নিদ্রিত হইয়া পড়িল।
০৬. বজ্রাঘাত
পরদিন বউরাণী আশা করিয়াছিলেন, আহ্নিক ও জলযোগের সময় তিনি যখন অন্তঃপুরে আসিবেন, তখন নিশ্চয়ই তাহার সহিত দেখা হইবে এবং তীর্থ পৰ্য্যটনের প্রস্তাব সম্বন্ধে তিনি কিছু না কিছু বলিবেন। তাহার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা দেখিয়া বউরাণী ব্যাকুল হইয়া পড়িয়াছেন, গত রাত্রে ভাল করিয়া নিদ্রা হয় নাই।
তাঁহার আশা কিন্তু পূর্ণ হইল না। রাখাল জলযোগাদির জন্য যথাসময়ে অন্তঃপুরে আসিল বটে, কিন্তু বউরাণীর সহিত সাক্ষাৎ না করিয়াই আবার বাহির হইয়া গেল।
তখন বউরাণী আশা করিতে লাগিলেন, মধ্যাহ্নকালে আহারের সময় নিশ্চয়ই সাক্ষাৎ হইবে। কিন্তু রাখাল আসিয়া আহার করিয়া গেল–সাক্ষাৎ হইল না
বউরাণীর মনে তখন একটু অভিমান উপস্থিত হইল। তিনি ভাবিতে। লাগিলেন–কেন? এমন করিয়া আমার নিকট হইতে পলাইয়া বেড়াইতেছেন কেন? আমি কি করিয়াছি? –জানিয়া শুনিয়া কোনও অপরাধ ত আমি করি নাই। পূৰ্ব্বে আমাকে এত ভালবাসিতেন, আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য কত ব্যাকুল হইয়া থাকিতেন, এখন এমন হইয়া গেলেন কেন? ভদ্রকালী হইতে ফিরিয়া আসা অবধি এই পরিবর্তন দেখিতেছি। কি হইল কিছুই ত আমি বুঝিতে পারিতেছি না!
ভাবিয়া চিন্তিয়া বউরাণী অবশেষে স্থির করিলেন, তাহার শরীর খারাপ হইয়াছে। বলিয়াই এমন হইয়া গিয়াছেন। যাহা হউক, আজ বিকালে দেখা হইলে তীর্থযাত্রার কথাটা পাকাঁপাকি করিয়া ফেলিতেই হইবে।
শ্বশ্রূঠাকুরাণীকে খাওয়াইয়া, আহার করিয়া বউরাণী যখন আপনার কক্ষে ফিরিয়া আসিলেন তখন বেলা প্রায় একটা। প্রভাত হইতেই আকাশে মেঘ করিতেছিল, এতক্ষণে মেঘটা বেশ ঘন হইয়া আসিয়াছে। পশ্চিম দিকের জানালায় দাঁড়াইয়া বউরাণী সেই মেঘের লীলা দেখিতে লাগিলেন। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকিতেছে–আজ জল না হইয়া আর যায় না।
দেহ দুর্বল, অধিকক্ষণ বউরাণী দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না। একটি সোফার উপর আসিয়া বসিলেন। একটু পরেই কনক সুরবালা আসিবে, তাহাদের এখনও বোধ হয় আহার শেষ হয় নাই। একখানা নূতন মাসিকপত্র আসিয়াছিল, তাহারই মোড়ক খুলিয়া বউরাণী ছবিগুলি দেখিতে লাগিলেন। ঘড়িতে ঠং করিয়া একটা বাজিল।
সঙ্গে সঙ্গে বাহিরে পদশব্দ শুনা গেল। অমনি বউরাণীর হৃদয়যন্ত্রে শোণিতপ্রবাহ খরতর বেগে বহিল–এই পদশব্দ পরিচিত ও আকাঙ্ক্ষিত। বস্ত্রাদি তিনি তাড়াতাড়ি সম্বরণ করিয়া লইলেন। মুহূর্ত পরে রাখাল আসিয়া প্রবেশ করিল।
বউরাণী উঠিয়া দাঁড়াইলেন। অনুযোগের স্বরে বলিলেন–আজ এতক্ষণে মনে পড়ল?
রাখাল মস্তক অবনত করিয়া রহিল, কোনও উত্তর করিল না।
বউরাণী বলিলেন, বস। বসবে না?
রাখাল বলিল, না। –বলিয়া আংরাখার বুকের ভিতরে হাত পুরিয়া খামে ভরা। চিঠিখানি বাহির করিয়া, কম্পিত হস্তে বউরাণীর নিকটে ধরিল।
বউরাণী জিজ্ঞাসা করিলেন, কার চিঠি?
তোমার।
হাত বাড়াইয়া বউরাণী চিঠিখানি লইয়া খামের এপিঠ ওপিঠ দেখিয়া বুঝিলেন ইহা ডাকে আসে নাই। জিজ্ঞাসা করিলেন–কে লিখেছে?
খুলে দেখ। –বলিয়া রাখাল মাতালের মত টলিতে টলিতে বাহির হইয়া গেল।
তাহার আচরণে বউরাণীর মনে একটা প্রবল শঙ্কা জাগিয়া উঠিল–যেন একটা অপরিচিত রাক্ষস মুখব্যাদান করিয়া তাহাকে গ্রাস করিতে আসিতেছে। তাহার বিবর্ণ মুখ আরও বিবর্ণ হইয়া গেল। হস্তপদ কাঁপিতে লাগিল। কোনও ক্রমে পত্রখানি খুলিলেন। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের সেই অল্পালোকে পাঠ করিলেন
আমি তোমাকে কি বলিয়া সম্বোধন করিব জানি না। তুমি আমার জীবনের একমাত্র সুখ, একমাত্র আনন্দ–কিন্তু বিধির বিড়ম্বনায় তোমা ধনে আমি বঞ্চিত হইতে বসিয়াছি। তেমন লেখাপড়া শিখি নাই, মনের সকল কথা গুছাইয়া বলিবার ক্ষমতা নাই, নহিলে এই পত্রেও আমার অকৃত্রিম ভালবাসার প্রমাণ দিতে পারিতাম। আমি আজন্ম দুঃখী, মনে করিয়াছিলাম এতদিনে বুঝি বিধাতা আমার সুখের মুখ দেখাইলেন; কিন্তু অদৃষ্ট ছাড়া পথ নাই, আমার সব ভস্ম হইয়া গেল। আমি অতি অকৃতী অধম দুরাচার। তোমার নিকট আমি যে অপরাধ করিলাম, জানি তাহার ক্ষমা নাই। সতী সাধ্বী হিন্দু স্ত্রী তাহা ক্ষমা করিতে পারে না। আমি ক্ষমার অযোগ্য ও অশিক্ষিত। আমি মূর্খ, কিন্তু তোমাকে ভালবাসিয়া এই কয়মাসে আমার যে শিক্ষালাভ হইয়াছে তাহারই ফলে আজি আমি তোমাকে এই পত্র লিখিতে বসিয়াছি। আমি তোমাকে যেরূপ ভালবাসিয়াছি, জীবনে কখনও কাহাকেও সেরূপ ভালবাসি নাই। ভালবাসা কাহাকে বলে, তোমাকে দেখিবার পূৰ্ব্বে তাহা আমার জ্ঞানের অগোচর ছিল। তোমাকে ভালবাসিয়াছি, সুতরাং তোমার সহিত প্রবঞ্চনা করিব না। তুমি আমাকে অকৃত্রিমভাবে বিশ্বাস করিয়াছ, তোমার বুকে ছুরি মারিব এমন নরাধম আমি নহি। তবে আসল কথা বলি শুন। আমার নাম ভবেন্দ্র নয়, আমি তোমার স্বামী নহি। তোমার স্বামী ভবেন্দ্র এখন পরলোকে, তাহাই জানিতে পারিয়া বিষয়ের লোভে আমি ভবেন্দ্র সাজিয়া–
এই পর্যন্ত পাঠ করিয়া, বউরাণী চক্ষে অন্ধকার দেখিলেন। সম্বিৎ হারাইয়া সোফার উপর হইতে সশব্দে নিমে পড়িয়া গেলেন।
ইহার অর্ধ মিনিট পরে, পাণ চিবাইতে চিবাইতে হেলিতে দুলিতে কনকলতা আসিয়া পৌঁছিল। দ্বারে পদার্পণ মাত্র আঁ? কি হল? –বলিয়া সে ছুটিয়া বউরাণীর নিকট গেল। চিঠিখানি মেঝের উপর পড়িয়াছিল–সেখানি কুড়াইয়া লইয়া ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে এখানে এক ছত্র, ওখানে দুই ছত্র পাঠ করিয়া, ব্যাপারটা মোটামুটি বুঝিতে পারিল। তাড়াতাড়ি চিঠি বস্ত্রমধ্যে লুকাইয়া, ওগো কি হল গো! বলিয়া চীৎকার আরম্ভ করিয়া দিল। তখন বাড়ীর মধ্যে একটা ছুটাছুটি পড়িয়া গেল। প্রথমে আসিল সুরবালা, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ হাঁফাইতে হাঁফাইতে হাবার মা এবং আরও কয়েকজন আসিল। হাবার মা হাউমাউ করিয়া বাড়ী মাথায় করিবার উপক্রম করিয়াছিল, কনক অনেক কষ্টে তাহাকে থামাইল। শেষে রাণীমা আসিয়া পৌঁছিলেন। মুখে জল ছিটাইয়া পাখার বাতাস করিয়া অনেক কষ্টে বউরাণীর চেতনা সম্পাদন করা হইল। তিনি চক্ষু খুলিলেন। ধরিয়া তাহাকে সোফায় বসান হইল।
রাণীমা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, কি হয়েছিল মা? হঠাৎ অমন মূর্ছা গেলে কেন?
বউরাণী কোনও কথা না বলিয়া, হস্তদ্বারা শুধু নিজ ললাট স্পর্শ করিলেন। কনক লক্ষ্য করিল, বউরাণী চক্ষু পত্রখানির অম্বেষণ করিতেছে না। তাঁহার দৃষ্টি ঊর্ধ্বে।
রাণীমা বলিলেন, মা, বিছানায় শোবে কি?
বউরাণী ইঙ্গিতে সম্মতি জানাইলেন।
তখন কয়েকজন ধরাধরি করিয়া তাহাকে শয্যায় লইয়া গেল। বস্ত্রাদি পরিবর্তনের পর শুশ্রূষা চলিতে লাগিল।
ব্যাপারটা কি সম্যক অবগত হইবার জন্য কনকের প্রাণ ছটফট করিতেছিল। জ্যাকেটের নিমে পত্রখানা যেন তপ্ত অঙ্গারের মত তাহাকে দগ্ধ করিতে লাগিল। ধীরে ধীরে বউরাণীর শয্যা–কক্ষ পরিত্যাগ করিয়া কনক নিজের কক্ষে গিয়া উপস্থিত হইল। সাবধানে দ্বারটি রুদ্ধ করিয়া বাহিরের দিকের খোলা জানালার নিকট গিয়া সে দাঁড়াইল, তখন বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে। জানালা দিয়া জলের ছাট আসিতে লাগিল। একটু পশ্চাতে সরিয়া বক্ষের ভিতর হইতে পত্রখানি বাহির করিয়া কনক পড়িতে আরম্ভ করিল। –এলোমেলো গোছের একটা ভূমিকার পর রাখাল তাহার নিজ জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আরম্ভ করিয়াছে। স্ত্রী লীলাবতীর সহিত প্রণয়াভাব, ছুটি লইয়া তাহাকে আনিতে গৃহে গমন, সেখানে গিয়া স্ত্রীকে না পাওয়া, নবীনের সহিত পলায়নের গুজব, খুস্রপুরে ফিরিয়া আসিয়া নিজের অবস্থাসঙ্কট, রেলগাড়ী হইতে সন্ন্যাসীর লাস নামা, রাত্রে তাহার বাক্স খুলিয়া টাকা ও কাগজের বস্তা অপহরণ, কাগজপত্র হইতে মৃত ব্যক্তি পরিচয়লাভ, ডায়ারির কথা, তাহাদের উভয়ের বয়স ও আকারগত সাদৃশ্য–অবশেষে ভবেন্দ্র সাজিয়া বাশুলিপাড়ায় আগমনের অভিসন্ধি ও তৎপক্ষে আয়োজনাদি সমস্ত বর্ণনা, করিয়া অবশেষে রাখাল লিখিয়াছে–
আমি যে দুরভিসন্ধিটি করিয়াছিলাম–তাহা সম্পূর্ণরূপেই সিদ্ধ হইয়াছিল। আমাকে কেহই তোমরা জাল বলিয়া সন্দেহ করিতে পার নাই। আমি নিৰ্বিয়ে এই বিপুল সম্পত্তি ভোগ করিতে পারিতাম। কিন্তু আমার হিসাবে একটা ভুল হইয়াছিল। তখন জানিতাম না, ভালবাসা কি পদার্থ। জানিতাম না, ভালবাসিলে মানুষের মনের গতির কিরূপ পরিবর্তন হয়। এখন তাহা জানিয়াছি; সুতরাং আমার সকল আয়োজনই ব্যর্থ হইয়া গেল তোমার পায়ে আমি যে অপরাধ করিয়াছি–তাহার জন্য শত সহস্র ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া, আমি চিরবিদায় গ্রহণ করিলাম। যতদিন বাঁচিয়া থাকিব, ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিব যেন তুমি ভাল থাক, সুখে থাক, ধৰ্ম্মপথে থাকিয়া জীবন অতিবাহিত করিতে পার। তোমার নিকট যেমন সকল কথা প্রকাশ করিয়া লিখিলাম, আমার উচিত ছিল পরম পূজনীয়া রাণীমাতার নিকটও সমস্ত বলিয়া তাঁহার পায়ে ধরিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া যাওয়া। কিন্তু আমি একটা কথা ভাবিয়া তাহা হইতে বিরত রহিলাম। কথাটা তাহা হইলে হয়ত বাটীর সকলের নিকট প্রচার হইয়া যাইবে–ক্রমে গ্রামময় দেশময় রাষ্ট্র। হইবে। তাহাতে লোকে তোমার কলঙ্ক ঘোষণা করিবে। তুমি যে কত পবিত্র তাহা লোকে বুঝিবে না। তোমার অনিষ্ট যাহা করিবার তাহা ত করিয়াছি–আর বেশী করিব না। আমার কথা তোমার মন হইতে মুছিয়া ফেলিও। আমার ন্যায় হতভাগ্য আর ধরাতলে নাই। ইতি–
শ্রীরাখালদাস ভট্টাচার্য্য
পুনশ্চ
একটা কথা মনে পড়িয়া গেল, তাই বিদায় লইয়াও আবার আসিলাম। সে কথা তোমাকে লিখিয়া আমার কৃত অপরাধ আরও গুরুতর করিতেছি কি না জানি না। আমার এখন বুদ্ধি লোপ হইয়াছে, কি লিখিতেছি তাহা জানি না। এ কয়মাসে আমার প্রতি তোমার মনের ভাব কিরূপ হইয়াছে জানি না। আমি যেমন তোমাকে জ্ঞানশূন্য হইয়া ভালবাসিয়াছি, তুমিও যদি আমাকে সেইরূপ বাসিয়া থাক, এবং যদি বিধবার পুনৰ্ব্বার বিবাহকে পাপ ও অন্যায় বলিয়া মনে না কর, তবে এস আমরা নূতন বিধান অনুসারে যথাশাস্ত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। তুমি যদি ইহাতে সম্মত হও, তবে আমি হাতে স্বর্গ পাইব তাহা বলাই বাহুল্য। আর যদি এ বিষয়ে তোমার অমত হয়, তবে তাহা জানিতে পারিবামাত্র আমি এখান হইতে চিরদিনের জন্য বিদায় গ্রহণ করিব। আমার সকল অপরাধ তুমি মার্জনা কর, ইহাই তোমার চরণে আমার শেষ ভিক্ষা। ইতি
শ্রীরাখাল
বৃষ্টিটা এতক্ষণে বেশ চাপিয়া আসিয়াছে। আকাশ মাঝে মাঝে গর্জন করিতেছে। পত্রখানি পাঠ শেষ করিয়া কনকলতা কিয়ৎক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া বাহিরের পানে চাহিয়া রহিল। তাহার পর সেখানি নিজের বাক্সের মধ্যে চাবিবন্ধ করিতে করিতে মনে মনে বলিল–ভাগ্যিস্ এখানি আমার হাতে পড়েছে, তাই রক্ষে–অন্য কারু হাতে পড়লে এতক্ষণে বাড়ীময় টী টী হয়ে যেত। রাখাল চলে যাক, লোকে মনে করুক সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে গেছে–ঘরে তার মন টিকলো না। রাখাল ঠিকই বলেছে–জানাজানিটে না হলেই মঙ্গল।
বাক্স বন্ধ করিয়া আবার কনক জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়া বৃষ্টি দেখিতে লাগিল–অস্ফুটস্বরে বলিল–আশ্চর্য্য!–আশ্চর্য্য!–লোকটা মানুষ না দেবতা? পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করছে।
এমন সময় দ্বারে ঘন ঘন করাঘাত করিয়া সুরবালা বলিল, কনকদিদি, কি করছ, শীগগির এস। বউরাণীর আবার ফিট হয়েছে।
কনক তখন দ্বার খুলিয়া বউরাণীর শয়নকক্ষের দিকে ছুটিল।
০৭. কনকলতার অভিসার
রাখাল বৈঠকখানার বাড়ীতে শয্যায় শয়ন করিয়া এপাশ ওপাশ করিতেছিল। কিয়দ্দূরে টেবিলের উপর আলো জ্বলিতেছে। বউরাণীর অবস্থা মোটেই ভাল নহে, রাত্রি দশটা অবধি সে তাহার সংবাদ পাইয়াছে। কবিরাজ ঘন ঘন অন্তঃপুরে যাতায়াত করিতেছেন।
সে মনে মনে ভাবিতেছে, এ আমি কি করিলাম? ইন্দুর শরীর যেরূপ দুৰ্বল, তাহাতে এ অবস্থায় সে এই বিষম আঘাত সহ্য করিতে পারিবে না, ইহা আমি বুঝিলাম না কেন? ইহা বুঝিবার জন্য ত বিশেস বুদ্ধিমত্তারও প্রয়োজন ছিল না–ছি ছি–আমি কি নিৰ্ব্বোধ!–কি নিৰ্ব্বোধ! ইন্দু যদি না বাঁচে, তবে আমিই ত তাহাকে হত্যা করিলাম! হত্যা বলিয়া হত্যা–একেবারেই জবাই নিষ্ঠুরতার একশেষ। স্ত্রীহত্যা করিব ইহাও কি আমার অদৃষ্টে ছিল? ছি ছি–অদৃষ্ট লইয়াই পৃথিবীতে আসিয়াছিলাম!–রাখালের চক্ষু দিয়া প্রবল অশ্রুপ্রবাহ ছুটিল–বালিসে মুখ খুঁজিয়া সে কাঁদিতে লাগিল।
কিয়ৎক্ষণ পরে কতকটা আত্মসংবরণ করিয়া ভাবিতে লাগিল–যাহা আমি আশা করিয়াছিলাম তাহা হইবার নহে। স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে। যদি ইন্দুর বিবাহকরিবার মত হইত, তবে সে আমার পত্র পড়িয়া কখনই এতদূর আঘাত পাইত না। নৈরাশ্যজনিত কতকটা দুঃখ সে পাইত বটে সন্দেহ নাই–কিন্তু আশার সূচনাও তাহার মধ্যে একটু থাকিত; কিন্তু তাহা হয় নাই। আর কেমন করিয়াই হইবে? এখানেও আমার হিসাবে ভুল। আজন্ম হিন্দু–সংস্কারের অধীন হিন্দুগৃহে প্রতিপালিতা–সে কেমন করিয়া পত্যন্তর গ্রহনের কথা মনে স্থান দিবে? কত শতাব্দী ধরিয়া যে দেশে কুলরমণীগণ, বিধবার অন্য পতিগ্রহণকে মহাপাপ বলিয়া মনে ধারণা করিয়া আসিয়াছেন, তাঁহাদের বংশে জন্মিয়া হঠাৎ কোনও রমণী কি বংশপরম্পরাগত বদ্ধমূল সে সংস্কারকে উৎপাটিত করিতে পারেন? –আমার তাহা আশা করাই বাতুলতা হইয়াছিল। আমি বাতুল নহি ত কি? –না, বাতুল হইলে ত বাঁচিয়া যাইতাম, এ দুঃসহ মৰ্ম্মযাতনার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইতাম। –রাখাল শয্যায় উঠিয়া বসিয়া, করতলে মস্তক রাখিয়া চক্ষু মুদিত করিয়া বলিতে লাগিল, আহা যদি পাগল হইয়া যাইতাম। যদি পাগল হইতাম!
কাছারির পেটা ঘড়িতে ঢং করিয়া একটা বাজিলে রাখাল হঠাৎ চমকিয়া উঠিল। সে তখন শয্যা হইতে নামিয়া একটি জানালার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। এখান হইতে অন্তঃপুরের প্রবেশদ্বার দেখিতে পাওয়া যায়। আকাশে মেঘ আছে, তাই জ্যোৎস্না ভাল করিয়া ফুটিতে পারিতেছে না। সেই সামান্য আলোকেও রাখাল যেন অনুভব করিল, দাস–দাসীগণ মাঝে মাঝে সে দ্বারপথে যাতায়াত করিতেছে। শূন্যদৃষ্টিতে রাখাল দ্বারে পানে চাহিয়া কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল। অবশেষে শ্রান্তি অনুভব করিয়া শয্যায় ফিরিয়া আসিল। চক্ষু মুদিত করিয়া পড়িয়া রহিল, যদি নিদ্রা আসে। কিন্তু যে হতভাগ্য, নিদ্রা তাহার কাছে আসিবে কেন?
কিছুক্ষণ এইরূপে পড়িয়া থাকিবার পর রাখাল চকিত হইয়া শুনিল, তাহার বন্ধ দুয়ারে কে বাহির হইতে করাঘাত করিতেছে। বিদ্যুতের মত সহসা এই চিন্তা তাহার মনে প্রবেশ করিল–বুঝি বউরাণীর অন্তিম সময় উপস্থিত হইয়াছে, সেই সংবাদই কেহ দিতে আসিয়াছে। তৎক্ষণাৎ উঠিয়া বসিয়া জড়িত কণ্ঠে রাখাল বলিল, কে?
কোনও উত্তর নাই। দ্বারে করতাড়না পূৰ্ব্বত চলিতে লাগিল।
রাখাল তখন উঠিয়া কম্পিত করে দ্বার মোচন করিয়া সবিস্ময়ে দেখিল, এক বিধবাবেশিনী রমণীমূৰ্ত্তি। কম্পিত জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল–কে? কে তুমি?
রমণী নীরবে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া, ক্ষিপ্রহস্তে দ্বার বন্ধ করিল। পরে রাখালের দিকে ঘুরিয়া দাঁড়াইল। মাথার কাপড় পশ্চাতে একটু টানিয়া দিয়া, একগোছা চুল কাণের কাছে আসিয়া পড়িয়াছিল তাহা সরাইয়া রাখালের পানে চাহিয়া রহিল। রাখাল দেখিল রমণী যুবতী, বয়সে অনুমান বিংশতিবর্ষ, মুখখানি সৌন্দর্য্যের প্রভায় ঝলমল করিতেছে, কেবল চক্ষু দুইটি যেন একটু বিষ।
রাখাল আবার জিজ্ঞাসা করিল, তুমি–আপনি–কে?
রমণী বলিল, আমি কনকলতা।
রাখাল কনকলতার নাম জানিত, দূর হইতে একবার তাহাকে না দেখিয়াছিল এমন নয়। বলিল–ওঃ–তা কি খবর? বউরাণী কেমন আছেন?
কনক গম্ভীরভাবে বলিল, মোটেই ভাল নেই।
রাখাল রুদ্ধশ্বাসে বলিল, ভাল নেই? তবে কি– বলিয়া আর তাহার কথা বাহির হইল না; সে ফ্যাল ফ্যাল করিয়া কনকের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
কনক পূৰ্ব্ববৎ বলিল, কবরেজ জবাব দিয়েছে। রাত কাটে কিনা সন্দেহ।
এ কথা শুনিয়া রাখাল পালঙ্কের প্রান্তে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল
কনক বাতিটা উজ্জ্বল করিয়া দিল। খড়খড় করিয়া চেয়ারখানা পালঙ্কের নিকট টানিয়া, আলোকের দিকে মুখ করিয়া বসিল। প্রায় এক মিনিট কাল নীরবে থাকিয়া, অতি মিষ্ট অতি কোমল স্বরে বলিল–সে আর এখন ভাবলে কি হবে বলুন? যার অদৃষ্টে যা লেখা আছে, তাই হবে ত। সে কি কেউ খণ্ডাতে পারে? –চোখের জল ফেলবেন না, ছি আপনি ত জ্ঞানবান।
রাখাল ধীরে ধীরে মাথাটি তুলিল। জিজ্ঞাসা করিল–বউরাণী কি আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন?
না। তার কি জ্ঞান আছে?
জ্ঞান নেই? কতক্ষণ থেকে অজ্ঞান আছেন?
সেই আপনি যখন চিঠি দিয়ে বেরিয়ে এলেন–তারপর থেকে দুএকবার মাত্র খুব অল্প সময়ের জন্যে জ্ঞান হয়েছিল, নইলে বরাবরই ত অজ্ঞান রয়েছেন।
রাখাল ভাবিতে লাগিল, চিঠির কথা এ জানে দেখিতেছি। এতক্ষণ কি আর চাপা আছে, বাড়ীর সবাই জানিয়াছে সন্দেহ নাই। তা জানুক, কিন্তু কোনও গোলমাল এখনও উঠিল না কেন? বোধ হয় বউরাণীকে লইয়া সকলে ব্যস্ত–প্রাণ লইয়া টানাটানি–তাই এখনও আমার কথা কেহ ভাবে নাই; কিন্তু এ কনকলতা আসিয়াছে কি অভিপ্রায়ে?
রাখালকে চিন্তাকুল দেখিয়া কনক সান্ত্বনার স্বরে বলিল, আপনি বউরাণীকে আজ যে চিঠিখানি দিয়ে এসেছিলেন–বুঝেছেন রাখালবাবু–সে চিঠিখানি ভাগ্যিস প্রথমে আমার হাতে পড়েছিল–আমি সেখানিকে লুকিয়ে ফেলেছি।
রাখাল আশ্চর্য্য হইয়া বলিল, আপনি চিঠি লুকিয়ে ফেলেছেন কেন?
কনক চেয়ারে একটু নড়িয়া চড়িয়া একবার রাখালের পানে, একবার ভূমির দিকে চাহিয়া বিষণ্ণ স্বরে বলিল, সে চিঠি অন্য লোকের হাতে পড়লে এতক্ষণ কি রক্ষে থাকত? পুলিশে এতক্ষণ–
রাখাল বলিল, থানা পুলিশ এলে কি হত?
কি না হত? সৰ্ব্বনাশ হত। আপনাকে বেঁধে নিয়ে যেত।
যেত যেতই–তার জন্যে আপনার মাথাব্যথা কি?
কনক ঠোঁট দুখানি ফুলাইয়া অভিমানের স্বরে বলিল, মাথা থাকলেই মাথাব্যথা হয়। আপনার হাতে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যেত, তাই আমার চক্ষে দেখতে হত ত? কেন, আমার বুকটা কি পাথর দিয়ে গড়া, না লোহা দিয়ে গড়া? –শেষের দিকে কনকের কণ্ঠস্বর ভারি হইয়া আসিয়াছিল, তাহার চক্ষুযুগলও ছল ছল করিতে লাগিল।
এই সকল ভাবভঙ্গি দেখিয়া রাখালের বিস্ময় উত্তরোত্তর বর্ধিত হইয়া চলিল। জিজ্ঞাসা করিল–আপনি কি শুধু এই কথা বলতেই এখানে এসেছেন?
কনক রাখালের পানে একটি কটাক্ষবাণ হানিয়া বলিল, কেন, এসে কোনও দোষ করেছি? আপনি বিরক্ত হয়েছেন?
রাখাল এ প্রশ্ন উপেক্ষা করিয়া বলিল, এতরাত্রে কি করে এলেন?
আজ অন্দরের সব দরজাই ত খোলা রয়েছে। আমি একটা সুযোগে টুপ করে বেরিয়ে এসেছি।
রাখাল একটু বিরক্তির স্বরে বলিল, আপনার সাহস ত কম নয়!
কনক মধু ছড়াইয়া বলিল, আমাকে বারবার আপনি আপনি বলে কেন লজ্জা দিচ্ছেন? আমি ত মান্যগণ্য কেউ নই–আমি আপনার দাসী মাত্র। শেষ কথাটির সঙ্গে সঙ্গে কনক দ্বিতীয়বার রাখালের প্রতি এক বিলোল কটাক্ষ নিক্ষেপ করি না। তাহার পর মুখটি নত করিয়া বলিল–সাহস কি সাধে হয়েছে? –প্রাণের দায়ে।
রাখাল বুঝিল, ইহার মনে কোনও গুঢ় অভিসন্ধি আছে। জিজ্ঞাসা করিল–তোমার প্রাণের আবার কি দায়?
কনক কথা কহে না। তাহার মস্তক যেমন অবনত ছিল, তেমনই রহিল।
একটু অপেক্ষা করিয়া রাখাল আবার বলিল, তোমার উদ্দেশ্য কি?
আড়নয়নে রাখালের প্রতি চাহিয়া লজ্জাজড়িত স্বরে, থামিয়া থামিয়া কনক বলল, যদি–দাসীকে–চরণে স্থান দেন–এই আশায় এসেছি। আর উদ্দেশ্য কি? –বলিয়া একটি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
কথাটা শুনিয়া রাখালের পিত্তসুদ্ধ জ্বলিয়া গেল। ঘৃণায় সে মুখ অন্যদিকে ফিরাইল।
কয়েক মুহূর্ত পরে কনক কাতরকণ্ঠে বলিতে লাগিল, দেখুন, বউরাণীর কপালে যা ছিল, তা ত হল। বোধ হয় রাত পোয়াতে পোয়াতেই সব শেষ হয়ে যাবে। এত বিষয়–এ রাজার সম্পত্তি বারো ভূতে লুটে খাবে সে কি ভাল? আপনিই কেন ভোগ করুন না! আপনার ত–আপনার ত–
রাখাল মুখ ফিরাইয়া বলিল, আমার কি?
কনক মাথার কাপড় একটু সম্মুখে টানিয়া, বীণা–বিনিন্দিত কণ্ঠে বলিল, আপনার ত–বিধবা বিবাহ করতে–কোনও আপত্তি নেই।
রাখাল বিদ্রুপের স্বরে বলিল, তোমাকে নাকি?
ক্ষতিই বা কি? আমিও ব্রাহ্মণের মেয়ে–আমার বাপেরা বেশ ভাল কুলীনই ছিলেন।
রাখাল পূৰ্ব্ববৎ বলিল, সেই কুল তুমি উজ্জ্বল করতে চাও?
এই শ্লেষকে গ্রাহ্য না করিয়া কনক বলিল, আপনি যেমন ভবেন্দ্র সেজে আছেন, সেই ভবেন্দ্রই থাকবেন। কে জানবে বলুন? আমরা দুজনে রাজার হালে থাকব।
রাখাল মনে মনে বলিতে লাগিল–এ মানবী না পিশাচী? উঃ–কি অর্থলোভ! আমি যে কোনকালে ইহাকে পত্নীভাবে ভালবাসিতে পারিব, বউরাণীকে লিখিত আমার চিঠি পড়ার পর সে আশা অবশ্য ইহার নাই। কেবল মাত্র বিষয়ের লোভে ধৰ্ম্মে জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত হইয়াছে। উঃ কি শয়তানী!
রাখালকে নীরব দেখিয়া কনক কটাক্ষ হানিয়া বলিল, একটা উত্তর দিন। দাসীকে চরণে রাখবেন কি? ।
দন্তে দন্তে চাপিয়া, কঠোরস্বরে রাখাল বলিল, ইচ্ছে করছে, তোমায় চিৎ করে ফেলে তোমার গলাতেই চরণ দুখানি রাখি। একটা স্ত্রীহত্যা করেছি–লোভ হচ্ছে–আরও একটা না হয় করি–যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন।
কনক উঠিয়া দাঁড়াইল। মুহূর্ত মধ্যে অভিনেত্রীর ভাবভঙ্গি সমস্তই পরিবর্তিত হইয়া গেল। কমনীয় কণ্ঠে বলিল–রাখালবাবু–আমারও যে সে লোভ না হচ্ছে তা নয়। যদি তা করেন, ঐ পা দুখানি যদি আমার গলায় চেপে আমার এ ব্যর্থ কলঙ্কিত জীবন শেষ করে দিতে পারেন, তাহলে বোধ হয়, আমি যে আমি–আমিও উদ্ধার হয়ে যাই। কিন্তু সে সব কাব্য–সে হবার নয়। দিন–আমি আপনার পায়ের ধূলো নেব। আমার প্রগল্ভতা ক্ষমা করবেন। –বলিয়া কনক ক্ষিপ্ৰকরে রাখালের পদযুগল স্পর্শ করিল।
কনকের এই অভিনয় আচরণ দেখিয়া রাখাল অবাক হইয়া গিয়াছিল। তাহাকে বিস্ময়ের অবসর না দিয়া কনক বলিতে লাগিল–আপনার সেইচিঠি পড়ে অবধি আপনার পায়ের ধূলো নেবার জন্যে আমি ছটফট করছিলাম। মানুষ যে এমন সাচ্চা, এমন ত্যাগী হতে পারে, তা আমার ধারণাই ছিল না। আমি আপনাকে প্রেম জানাতে আসিনি রাখালবাবু, ভক্তি জানাতেই এসেছিলাম; কিন্তু অঙ্গারঃ শতধৌতেন–তার ময়লা যাবে কোথা বলুন? –ওরই মধ্যে দুষ্টামি বুদ্ধিও এল, ভাবলাম একটুখানি অভিনয় করে নিই। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, আমি নিষ্ঠাবতী হিন্দু বিধবা–টিধবা কিছুই নই–আমি একজন অভিনেত্রী। মুখে রঙ মেখে কলকাতার পেশাদারী থিয়েটারের ষ্টেজে দাঁড়িয়ে। প্রেম করে করে আর প্রেমের গান গেয়ে গেয়ে আমার মুখে রক্ত উঠে গেছে রাখালবাবু! আমার প্রকৃত পরিচয় এখানে কেউ জানে না–আজ আপনি জানলেন। আপনি যেমন সেজে এসেছেন, আমিও তাই।
রাখাল বলিল, আপনি সেজে এসেছেন? কেন?
আমার অদৃষ্টের দোষ। সে অনেক কথা রাখালবাবু–অবসর পাই ত অন্য কোন সময় বলব। আর অদৃষ্টের দোষই বা কেন বলি? বরং গুণই বলা উচিত। আপনার মত লোক যে পৃথিবীতে আছে–এখানে না এলে ত জানতে পারতাম না। আমি এখানে আর বেশীদিন থাকব না; কিন্তু যে কদিন আছি, আপনার কোনও উপকার যদি করতে পারি–আমি করব। এখন আসি তবে, প্রণাম।
রাখাল কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে কনকের পানে চাহিল। বলিল–একটু বসুন। বউরাণীর কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি।
কনকলতা আবার উপবেশন করিল।
রাখাল বলিল, চিঠিখানি আপনার হাতে কি করে পড়ল?
যে অবস্থায় চিঠি কনকের হস্তগত হইয়াছিল তাহা সে বর্ণনা করিল।
রাখাল বলিল, তারপর দুএকবার যে বউরাণীর জ্ঞান হয়েছিল, তখন আপনি কাছে ছিলেন?
ছিলাম।
তিনি কি বললেন তখন?
বিশেষ কিছুই বলেন নি।
রাখাল সঙ্কোচের সহিত জিজ্ঞাসা করিল, আমার উপর কি খুব বিরক্ত হয়েছেন বলে বোধ হল?
কনক গম্ভীরভাবে বলিল, রাখালবাবু, সে কথা জিজ্ঞাসা করা বৃথা। জ্ঞান হলে চিঠিখানার খোঁজ পৰ্য্যন্ত তিনি আর করেন নি।
রাখাল একটি দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করিল।
কনক বলিতে লাগিল, এখন সে সব আর ভেবে কি হবে বলুন? আপনি যে শেষরক্ষে করেছেন–এজন্যে বউরাণী নিশ্চয়ই আপনার উপর খুব কৃতজ্ঞ। এখন ভাগ্যে ভাগ্যে যদি তিনি বেঁচে ওঠেন তাহলেই মঙ্গল। আপনি এখন কি করবেন?
রাখাল বলিল, আমি এখান থেকে চলে যাব। বউরাণীর জীবনের আশঙ্কা নেই–এই সংবাদটুকু জানতে পারলেই আমি চলে যাই।
কোথায় যাবেন?
কিছুই স্থির করিনি। যে দিকে দুচক্ষু যাবে।
কনক বলিল, রাখালবাবু আমার একটি অনুরোধ রাখবেন?
কি বলুন।
যাবার পূর্বে আমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাবেন।
কেন?
বিশেষ কারণ আছে।
কি কারণ?
সে তখন বলব। এখন এইমাত্র বলি, যদি আমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যান, তবে না জেনে আপনি একটা মানুষের সর্বনাশ করে ফেলবেন। অথচ সে নির্দোষ। আমায় কথা দিন যে আমার সঙ্গে দেখা না করে যাবেন না।
রাখাল ধীরে ধীরে বলিল, এর মধ্যে কি গুঢ় রহস্য আছে, আমি ত কিছুই বুঝিতে পারছিনে। আচ্ছা, আপনি যখন অত করে বলছেন, তখন তাই হবে।
কনক উঠিল। বলিল–এখন আসি তবে, প্রণাম।
রাখালও উঠিয়া দাঁড়াইল। কনকের পশ্চাৎ পশ্চাৎ দ্বার অবধি গিয়া বলিল–এখন গিয়ে বউরাণীকে কেমন দেখেন, রামাকে দিয়ে বলে পাঠাবেন?
আচ্ছা–পাঠাচ্ছি। –বলিয়া কনক চলিয়া গেল।
কিয়ৎক্ষণ পরে রামা আসিয়া সংবাদ দিল, রাত্রি দুইটার সময় বউরাণী জাগিয়াছিলেন। কথাবার্তা কহিয়াছেন, দুগ্ধপান করিয়াছেন–এখন আবার ঘুমাইতেছেন।
এই সংবাদ শুনিয়া রাখালের মন কতকটা সুস্থির হইল। কনকের সহিত কথোপকথন, তাহার কর্তৃক সেই গূঢ় রহস্যের ইঙ্গিত প্রভৃতি ভাবিতে ভাবিতে শেষ রাত্রিতে সে ঘুমাইয়া পড়িল।
০৮. নবাবে নবাবে
প্রভাত হইলে রাখালের নিদ্রাভঙ্গ হইল। সে তখন শয্যাত্যাগ করিয়া ছাদে গিয়া বেড়াইতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে মুখাদি প্রক্ষালন করিয়া আসিয়া শুনিল বউরাণী জাগিয়াছেন, ভাল আছেন, ঔষধ পান করিয়াছেন, কবিরাজ বলিয়াছেন আর কোন আশঙ্কা নাই।
ইহার অল্পক্ষণ পরে একজন ঝি আসিয়া বলিল, রাণীমা তাহাকে স্মরণ করিয়াছেন।
রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, বউরাণী কি করছেন?
সুরোদিদি তাঁর কাছে আছেন, তারই সঙ্গে কথাবার্তা কইছেন।
সুরবালা নামী এক অনাথা ব্রাহ্মণ কন্যা অন্তঃপুরে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া আছে, ইহা রাখাল জানিত; কিন্তু তাহাকে চক্ষে কখনও দেখে নাই। সে ইহাও জানিত, সুরবালা বউরাণীর একজন প্রিয়পাত্রী।
রাখাল অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতেই রাণীমা বলিলেন, হ্যা বাবা, তোর মুখ চোখ এ কি হয়ে গেছে? রাত্রে ঘুমুসনি বুঝি?
রাখাল কোনও উত্তর করিল না। নতনেত্রে দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার চক্ষু দিয়া ফোঁটা ফোঁটা করিয়া জল পড়িতে লাগিল।
রাণীমা বলিলেন, ভবেন, কাদিসনে কাঁদিসনে। তোর চোখে জল দেখলে আমার বুক যে ফেটে যায় বাবা! রাত দুপুরের পর থেকে আর ফিট হয়নি, তখন থেকে বউমা ভালই আছেন। ভয় কি? কবরেজ বলে গেছেন আর কোনও ভয় নেই। কাল রাত্রে তুই কি খেলি না খেলি কিছুই আমি দেখতে পারিনি। যা স্নান করে আয়, আমি তোর আহ্নিকের যোগাড় করে রাখি। আহ্নিক করে একটু জল মুখে দে। যাবি, বউমাকে এখনি দেখবি?
রাখাল নীরবে মাথা নাড়িল।
স্নান আহ্নিক সারিয়া জলযোগান্তে রাখাল যখন বাহিরে আসিল, তখন নয়টা বাজিয়াছে। বৈঠকখানা বাড়ীর নিকটস্থ হইয়া দেখিল, বারান্দায় বেঞ্চিখানির উপর খগেন্দ্রনাথ বসিয়া আছে। তাহার গায়ে ইংরাজি সাইক্লিং পোষাক, মাথায় সোলা হ্যাঁট। বাইসিক্লখানি বারান্দার নিয়ে রাখা রহিয়াছে। রাখালকে দেখিবামাত্র সে উঠিয়া দাঁড়াইল, টুপী খুলিয়া বলিল–নমস্কার মশায়।
রাখাল বলিল, নমস্কার। আপনি হঠাৎ যে? কোথা থেকে?
কলকাতা থেকে আসছি। আপনার কাছে একটা বিশেষ কার্য আছে।
কায় আছে? আচ্ছা বেশ–স্নান–টান করুন, জল খান। তার পর কাযের কথা হবে এখন।
খগেন্দ্র বলিল, আজ্ঞে না। বিশেষ জরুরি কায। আমায় আবার বিকেল তিনটের গাড়িতেই ফিরতে হবে। কথাটা সেরে ফেলাই যাক না।
লোকটার ভাব দেখিয়া রাখাল মনে মনে একটু বিরক্ত হইল। ভাবিল, ভগিনী ত থিয়েটারের অভিনেত্রী–ইনি আসিয়াছেন যেন একটি নবাব। বলিল–আচ্ছা, অপেক্ষা করুন, আমার অবসর হলে আপনাকে ডেকে পাঠাব। –বলিয়া রাখাল সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া গেল।
খগেন্দ্র মনে মনে বলিল–ছিলেন ত রেলের কেরাণী–পঁচিশ মুদ্রা বেতন। এখানে আসিয়া নবাব হইয়াছেন। নবাবী শীঘ্রই ভাঙ্গিয়া দিতেছি।
খগেন্দ্র সেখানে বসিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল এবং মাঝে মাঝে পকেট হইতে ঘড়ি খুলিয়া দেখিতে লাগিল। অর্ধ ঘণ্টা হইয়া গেল, বাবু ডাকাইয়া পাঠাইলেন না। তখন খগেন্দ্ৰ আপন মনে বলিয়া উঠিল, ড্যাম্। আমি কিসের জন্যে এখানে বসে উমেদারী করি? উমেদার আমি, না ঐ রাস্কেল? নিজেই যাই–থোড়াই কেয়ার করি। –বলিয়া খটমট শব্দে বুটের আওয়াজ করিতে করিতে খগেন্দ্র সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া গেল।
রাখাল তাহার শয়নকক্ষে খোলা জানালার কাছে একখানি ঈজিচেয়ার টানিয়া বসিয়া আকাশ পাতাল চিন্তা করিতেছিল। হঠাৎ জুতার শব্দে চমকিয়া দ্বারের পানে চাহিয়া দেখিল।
খগেন্দ্র প্রবেশ করিয়া ব্যঙ্গস্বরে বলিল, ভারি ব্যস্ত আছেন নাকি? –বলিয়া একখানা চেয়ার টানিয়া উপবেশন করিল।
বিরক্তিতে ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া রাখাল বলিল, আপনি কি চান?
পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া হাতে ঘুরাইতে ঘুরাইতে খগেন্দ্র বলিল, আমার কিছু টাকার প্রয়োজন।
রাখাল বলিল, তা, আমার কাছে কেন? আপনার ভগ্নীর বেতন বাবদ যদি কিছু বাকী থাকে, আপনার ভগ্নীকে গিয়ে বলুন। দেওয়ানজি নেই, নায়েব দেওয়ান আছেন–তিনি হিসাব করে দেবেন এখন।
খগেন্দ্র মনে মনে বলিল, নবাব!–প্রকাশ্যে বলিল, আজ্ঞে না–ভগ্নীর বেতনের হিসাব নয়। আপনার কাছেই কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা রাখি। বেশী নয়, উপস্থিত এক লক্ষ টাকা, আর মাসে মাসে বেঙ্গল ব্যাঙ্কের উপর দুহাজার টাকার একখানি করে চেক। এই হলেই হবে।
বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে রাখাল খগেন্দ্রের মুখের পানে চাহিল। শেষে বলিল–নেশাটেশা কিছু করেন?
করতাম। এদানি টাকার অভাবে আর বড় পারিনে। একবোতল জনিওয়াকার ত আমার জলযোগ ছিল। নেশা করে আপনার কাছে আসিনি, দিব্যি শাদা চোখেই এসেছি। টাকাটা চট পট বের করুন দেখি। এক লক্ষ টাকার কোম্পানির কাগজ যদি মজুদ থাকে, তবে তাই এণ্ডোর্স করে দিন। কিম্বা ব্যাংকের উপর চেক্ হলেও চলতে পারে, কলকাতায় গিয়ে আমি ভাঙ্গিয়ে নেব এখন।
রাখাল বলিল, আপনাকে আমি টাকা দেব কেন?
খগেন্দ্ৰ হা হা করিয়া হাসিয়া বলিল, আমি যে আপনার ভাই হই। –পরে স্বর নামাইয়া বলিল, আপন ভাই নই–মাসতুতো ভাই। অর্থাৎ চোরে চোরে যা হয়। এত বড় বিষয়টা একলা একলাই খাবেন মশায়–মাসতুতো ভাইকেও কিছু বখরা দিন। সমস্ত বিষয় স্বচ্ছন্দে ভোগ করুন; আমি কেবল নগদ এক লক্ষ আর মাসে মাসে দুহাজার পেলেই সুন্তুষ্ট থাকব। এখন বাঙ্গলা কথাটা বুঝলেন?
রাখাল বলিল, বাঙ্গলা কথাটা কি?
কথাটা এই যে, আপনি মোটেই ভবেন্দ্র চাটুয্যে নন, আপনি রাখাল ভটচায্যি–খুস্রুপুরে ঘকাঘট করে টেলিগ্রাপ করতেন, ঘটাঘট করে টিকিট বেচতেন, ট্রেণ এল ছেঁড়া জুতো ফটাফট্ করে ট্রেণ পাস করতে প্ল্যাটফর্মে ছুটতেন। এখন বুঝলেন ত? না আরও টীকে আবশ্যক?
রাখাল বলিল, এসব আপনি জানলেন কি করে?
খগেন্দ্ৰ বুক চিতাইয়া বলিল, বিস্তর পরিশ্রম করে, বিস্তর অর্থব্যয় করে।
রাখাল বলিল, তবে আপনার পরিশ্রম অর্থব্যয় বৃথা হয়েছে।
কারণ?
কারণ আপনি টাকা পাবেন না। খগেন্দ্র
একটুকু না দমিয়া বলিল, টাকা পাব না?
না।
খগেন্দ্র কয়েক মুহূর্ত কি ভাবিল। শেষে বলিল–রাখালবাবু, আপনি বোধ হয় মনে করছেন সব ফাঁকা আওয়াজ? তা নয় মশায়। বোধ হয় ভাবছেন, আমি এত বড় সম্পত্তিটার মালিক, ও কোথাকার কে, ও আমার কিই বা করতে পারবে, সাক্ষী সাবুদই। বা পাবে কোথা। মশায়, আমরা কলকাতার লোক, কাঁচা কায করিনে। প্রমাণ সাক্ষী সাবুদ সমস্তই মজুত। আমি আপনার ময়নামতীতে গিয়েছিলাম, বসন্তপুরে গিয়েছিলাম, খুস্রুপুরে গিয়েছিলাম–আর আপনি যেখানে কখনও যান নি–সেই তিনতারিয়া মঠে অবধি গিয়েছিলাম। খুসুপুরের আপনার সিগন্যালম্যান, পানিপাড়ে, দুজন খালাসী–এরা ছুটী নিয়ে এসেছে। কলকাতায় আমার বাড়ীতে বসে ডালরুটির শ্রাদ্ধ করছে। তারা সনাক্ত করবে আপনি তাদের ভূতপূৰ্ব্ব ছোটবাবু রাখাল ভটচায্যি। তিনতারিয়া মঠের চারজন সন্ন্যাসীকেও এনেছি–গোঁসাই লছমন গির, ভৈরো গির, বাসদেও গির আর দামোদর গির। তাদের গাঁজার গন্ধে বাড়ীতে আমার টেকা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তারা আপনাকে দেখে বলবে, আপনি তাদের ভূতপূৰ্ব্ব মোহন্ত ভজনানন্দন গির ২০১ নন। সাক্ষীগুলিকে টাকা দিয়ে মশায় যে ভাঙ্গিয়ে নেবেন, সে পথ রাখিনি। আমার বাড়ীর দরজায় চারজন দরোয়ান অষ্টপ্রহর পাহারা দিচ্ছে। –সমস্ত এখন শুনলেন। ত? –টাকাটা চটপট বের করুন দেখি। নয় ত বলুন, কৃষ্ণনগরে গিয়ে পুলিশ সাহেবের কাছে সব ব্যাপারটা কাল বলি। এখানে পিনাল কোড আছে? না থাকে ত দেওয়ানজির সেরেস্তা থেকে আনিয়া ৪১৯ ধারাটা দেখুন দেখি!
রাখাল তাচ্ছিল্যের সহিত বলিল, দেখেছি।
দেখেছেন ত? তিনটি বচ্ছর শ্রীঘর। এখন আপনার মতটা বদলাল কি?
রাখাল হাই তুলিয়া বলিল, না। –আপনি টাকা পাবেন না। আমায় মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছেন। আমি কালই বউরাণীর কাছে সকল কথা প্রকাশ করেছি।
ইহা শুনিয়া খগেন্দ্র আকাশ হইতে পড়িল। বলিল–আঁ? প্রকাশ করেছেন?
হ্যাঁ। আপনার–ভগ্নীই হোন আর যেই হোন–সেই কনকলতাকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন। –বলিয়া ভৃত্যকে ডাকিল। ভৃত্য আসিলে বলিল–বাবুকে নীচে নিয়ে যা–স্নান–টানের বন্দোবস্ত করে দিগে। আর যদি ওঁর বোনের সঙ্গে দেখা করতে চান, অন্দরে ঝিকে ডেকে রাণীমার কাছে এত্তেলা পাঠিয়ে দিস।
০৯. খগেন্দ্র প্রতিশোধ লইল
নামিয়া বারান্দায় আসিয়া খগেন্দ্র ধপাস্ করিয়া বেঞ্চিখানার উপর বসিয়া পড়িল। ভৃত্য একবাটি তৈল আনিয়া বলিল, বাবু, কিছু কাপড়–চোপড় আছে, না আমলাদের কারু কাছ থেকে একখানা ধুতি চেয়ে আনব?
খগেন্দ্র বলিল, ধুতি চাইনে।
ভৃত্য বলিল, তবে চান করবেন কি করে?
স্নান করব না।
খগেন্দ্রের মুখভাব দেখিয়া ভৃত্য কিঞ্চিৎ বিস্মিত ও ভীত হইল। একটু চুপ থাকিয়া আবার বলিল–তবে জলখাবার আনিয়ে দিই?
খগেন্দ্র মাথা ঝাঁকিয়া বলিল, নাঃ।
ভৃত্য মনে করিল, আর কিছু নয়, বাবু ইহাকে বোধ হয় খুবই অপমান করিয়াছেন, মনের সেই খেদে স্নান অথবা জলযোগ কিছুই করিতে চাহিতেছে না। এদিক ওদিক ঘুরিয়া বলিল–আপনার ভগ্নীর সঙ্গে দেখা করবেন কি? এত্তেলা পাঠাব?
পাঠা। –বলিয়া খগেন্দ্র অন্যমনস্ক হইল। ভূত্য চলিয়া গেল।
তখন খগেন্দ্র তাহার কোটের ভিতর দিককার বুকপকেট হইতে একটি রৌপ্য নির্মিত ফ্ল্যাস্ক বাহির করিল। ইহার মধ্যে ব্র্যাণ্ডি ভরা ছিল। ভ্রু ঘুরাইয়া ফ্লাস্কের মুখটি খুলিয়া সেই নির্জলা সুরা দুই তিন ঢোক পান করিল। ফ্ল্যাস্কটি আবার পকেটে রাখিয়া, গালে হাত দিয়া চিন্তা আরম্ভ করিল।
বড় আশা করিয়াই সে আসিয়াছিল, তাহার বহুদিনের আশা আজ চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছে। একে নৈরাশ্যের বেদনা, তাহার উপরে খালি পেটে ব্র্যাণ্ডির প্রভাব–সে ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া উঠিল। রাখাল কি অভিপ্রায়ে যে বউরাণীর নিকট সকল কথা প্রকাশ করিয়াছে, তাহা খগেন্দ্র কিছুই অনুমান করিতে পারে নাই এবং সে বিষয়ে চিন্তা করিবার শক্তিও তাহার মস্তিষ্কে এখন নাই। তাহার নাক ও কাণ হইতে আগুন ছুটিতে লাগিল; কিন্তু বুকের ভিতরটা ঠাণ্ডা হিম হইয়া উঠিতেছে। সুতরাং ফ্ল্যাস্কটি বাহির করিয়া খগেন্দ্র আরও কিঞ্চিৎ পান করিল।
অল্পক্ষণ পরেই তাহার ইচ্ছা হইতে লাগিল, কাছারির প্রাঙ্গণে খানিক ছুটিয়া বেড়ায়। বুদ্ধিও যোগাইল, কিন্তু লোকে তাহা হইলে ভাবিবে তাহার নেশা হইয়াছে, অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতে দিবে না, কনকের সহিত সাক্ষাৎ হইবে না।
এইরূপ অবস্থায় প্রায় কুড়ি মিনিট কাটিলে, ভৃত্য ফিরিয়া আসিয়া বলিল, বাবু আসুন।
খগেন্দ্র উঠিয়া টলিতে টলিতে, ভূতের সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
পূৰ্ব্বপরিচিত অন্তঃপুর কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করিয়া খগেন্দ্র দেখিল, কনকলতা তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। চেয়ারে গিয়া বসিয়া উৰ্দ্ধদৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করিল–কনক, কি খবর?
কনক শঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি অমন হয়ে গেলেন কেন? –আপনার কি হয়েছে?
খগেন্দ্র বলিল, তুমি জান না?
না।
তবে কি বিলকুল মিথ্যে কথা নাকি? আমার সঙ্গে ধাপ্পাবাজি করলে?
কে?
কে আবার। তোমাদের ঐ রাখাল।
তার সঙ্গে দেখা হয়েছে? কি বলেছেন তিনি?
আমি এসে তার কাছে টাকা চাইলাম। না দিলে সব প্রকাশ করে দেব বললাম। সে বললে, আমি কাল বউরাণীর কাছে নিজেই সব প্রকাশ করে দিয়েছি। এ কথা কি। সত্যি না মিথ্যে?
কনক বলিল, সত্যি।
খগেন ফ্লাস্ক বাহির করিয়া আর একটু পান করিয়া বলিল, বাড়ীর সকলে শুনে কি বলছে?
বাড়ীর কেউ এখনও জানে না; শুধু বউরাণী জানেন। কিন্তু আপনি এখন খালিপেটে ব্র্যাণ্ডি খাচ্চেন কেন?
রত্নদীপ খগেন্দ্র বলিল, ব্রাণ্ডি মোদের রাজাঃ। একটু খাবে?
কনক বলিল, না–না–আপনিও খাবেন না। ভদ্রলোকের বাড়ীর মধ্যে এ সব কি?
ওঃ। –বলিয়া খগেন্দ্র চক্ষু মুদ্রিত করিল। প্রায় দুই মিনিট কাল পরে নিজ মস্তকের উপরিভাগে সঘন কর–সঞ্চালন করিতে করিতে, খিল খিল করিয়া আপন মনে হাসিতে লাগিল।
তাহার ভাব দেখিয়া কনক বলিল, ওকি করেন? বাড়ীর লোকে মনে করবে কি?
খগেন্দ্র চক্ষু বুজিয়া বলিতে লাগিল, প্রথমটা–আমারই বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছিল–হা হা হা। দেখ, প্রথম যখন রাখাল আমায় ঐ কথা বললে–হা হা–তখন হা হা, ভেবে নিলাম–ও হঠাৎ সাধু হয়ে, বুঝেছ কনক, সমস্ত পরিত্যাগ করে যাবার মলব করেছে। এখন তোমার কথা শুনে তবে না স্পষ্ট বুঝতে পারছি ওর চালাকি!–হা হা–খেলাটা–খেলেছে ভাল।
কনক জিজ্ঞাসা করিল, কি খেলা?
কি খেলা তুমি জান না? বুঝতে পারছ না? স্ত্রীবুদ্ধি আর কত হবে! হা হা হা! ও ভাবলে কি বুঝেছ–ভাবলে–একদিন না একদিন আমার এ জাল ত ধরা পড়েই যাবে–তখন আমার কি হবে? দেখলে বউরাণী ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্চে। হা হা–মাছ বড়শী গিলেছে–আর যায় কোথা? এখন যদি বউরাণী শোনে ও ভবেন্দ্র নয়–তা হলেও বউরাণী ওকে আর ঠেলতে পারবে না। কি বল কনক? হা হা। তাই স্থির করলে, বউরাণীকে সকল কথা বলে, বিধবা বিবাহ হোক সিভিল ম্যারেজ হোক–একটা কিছু করে রাখি। –এসব কথা চাপা থাকে বহুৎ আচ্ছা। –প্রকাশ হয় ড্যাম্ কেয়ার। উঃ–কি বুদ্ধি–কি বুদ্ধি!–বলিয়া খগেন্দ্র ধীরে ধীরে মাথাটি নাড়িতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ এইরূপ করিয়া বলিল, আচ্ছা! আচ্ছা! যাবেন কোথা? বউরাণীকে হাত করেছেন–কথাটা প্রকাশ হলে না হয় জেলে যাবার কি অর্ধচন্দ্র খাবার ভয়ই রইল না, কিন্তু কলঙ্ক? বউরাণীর একটা কলঙ্ক কি হবে না? –কি বল কনক? আমি ফের যাচ্ছি। রাখালের কাছে। গিয়ে বলছি, তো–তোমার সব মঃ–মলবই আমি বুঝেছি। টাঃ–টাকা দেবে ত দাও–নইলে সব প্রকাশ করে দেব। সিভিল ম্যারেজই কর, আর বিধবা বিবাহই কর, গিয়ে বঃ–বঙ্গবাসীতে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ অ্যাসা ছড়া কাটতে আরম্ভ করব, যে বাপ বাপ বলে দেঃ দেশ থেকে পালাতে হবে। সহজে ছাড়ছিনে বাবা!–সহজে ছাড়ছিনে। কিন্তু কনকতুঃ –তুমি ভাই–কোনও কঃ–কর্মের নও। সেই ত বউরাণী বিঃ–বিধবা বিবাহে রাজি হল–আমার তরফ থেকে ত রার–রাজি করতে পারলে না। –বলিয়া খগেন্দ্র মাথাটি নাড়িয়া নাড়িয়া মুদিত নেত্র করিয়া গান ধরিল–ভেঁচে থাক ভিদ্যেসাগর–ছিরজীবী হয়ে থুমি।
খগেন্দ্রের অবস্থা দেখিয়া কনক ভীত হইয়া পড়িল। সে তাহার স্কন্ধে হস্তাৰ্পণ করিয়া বলিল, খগেনবাবু–ও খগেনবাবু।
খগেন্দ্র যেন সুপ্তোত্থিতের ন্যায় চক্ষু খুলিয়া বসিল, খি?
আপনি অমন করছেন কেন?
খেন–খি খরেছি?
আপনার ভয়ানক নেশা হয়েছে। আবোল তাবোল বকছেন।
খি আবোল তাবোল বকছি? হুঁ।
কনক বলিল, আপনি ও সব মৎলব পরিত্যাগ করুন। রাখালবাবুর কাছে আর যাবেন না। টাকা পাবার আপনার আর কোন আশা নেই।
খোনও–আশা হ্নেই?
না।
খেন হ্নেই?
সে অনেক কথা–এখন শুনলে আপনি বুঝতেও পারবেন না। আপনার শরীর ভাল নেই। এখন বাইরে যান, স্নান করে খেয়ে একটু ঘুমুন। ও বেলা আবার কথাবার্তা হবে।
খগেন্দ্র দাঁড়াইয়া উঠিল। তাহার চক্ষু দুইটা লাল টক্ টক্ করিতেছে–আগুনের মত জ্বলিতেছে। জিজ্ঞাসা করিল–হামার–খোন–আশা–হ্নেই?
কনক সভয়ে একটু সরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, না।
খগেন্দ্র হঠাৎ উন্মত্তের ন্যায় লম্ফ দিয়া, তাহাকে এক ধাক্কা দিল। কনক ভূতলশায়িনী হইল। অভিনেতার ভঙ্গীতেফাপীয়সী এই হোর শাস্তি। –বলিয়া খগেন্দ্র সেখান হইতে টলিতে টলিতে বাহির হইল। সিঁড়ি নামিয়া, অঙ্গনের মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া, দুই হস্তে তেঁড়রা বাজাইবার সঙ্কেত করিয়া ভাঙ্গা গলায় চীৎকার করিয়া বলিল–তেরে দুম–তেরে দু তেরে দুম–ভাই সকল, কে কোথায় আছ। ঘ্রবণ কর। ও ভবেন্দ্র নয়–ভবেন্দ্র নয়–ভবেন্দ্র নয়। ও রাখালও রাখাল; আর তোমাদের ঐ সুরবালাও রাখালের স্ত্রীরররী। –বলিয়া টলিতে টলিতে খগেন্দ্র অন্তঃপুর হইতে বাহির হইল, টলিতে টলিতে কাছারি বাড়ীর প্রাঙ্গন পার হইয়া রাস্তায় গিয়া পড়িল।
তাহার অবস্থা দেখিয়া গ্রামবাসীরা সন্ত্রস্থ হইয়া পথ ছাড়িয়া দিল। পল্লীবালকেরা নিরাপদ ব্যবধান হইতে হাততালি দিয়া বলিতে লাগিল, ওরে মাতাল সাহেব দেখবি আয়। –কিন্তু খগেন্দ্র কোনও দিকে দৃকপাত মাত্র না করিয়া, অনাবশ্যক পদঘর্ষণে ধূলা উড়াইতে উড়াইতে স্টেশন অভিমুখে চলিল।
বাইসিক্লখানি কথা তাহার মনে পড়িল না।
১০. রাণীমার হুকুম
আজ প্রাতঃকাল হইতে বউরাণী ভাল আছেন–ঔষদ পথ্যাদি সেবন করিয়াছেন। কিন্তু অন্তরের মধ্যে তিনি যে দুঃসহ যাতনা ও লজ্জা অনুভব করিতেছিলেন, ঘুণাক্ষরেও তাহা কাহারও নিকট প্রকাশ করেন নাই। রাণীমা প্রভৃতির ধারণা, শারীরিক দোৰ্ব্বল্যের জন্যই হঠাৎ তিনি ওরকম মূর্হিত হইয়াছিলেন। কনক আজ মাঝে মাঝে বউরাণীমার সহিত একা ছিল বটে, কিন্তু স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ও প্রসঙ্গ উত্থাপন করে নাই, বউরাণীও তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেন নাই। কনক দেখিল চিঠিখানি কি হইল, কাহার হাতে পড়িল, এ সকল সম্বন্ধে তাহার বিন্দুমাত্রও উৎকণ্ঠা বা কৌতূহল নাই।
কনক যখন কক্ষান্তরে খগেন্দ্রের সঙ্গে কথাবার্তা কহিতেছিল, বউরাণী তখন বালিসে হেলান দিয়া শয্যায় বসিয়া, করতলে কপোল রাখিয়া, আকুল নয়নে নিজ অদৃষ্ট বিড়ম্বনার কথা চিন্তা করিতেছিলেন। চিন্তার কূল কিনারা নাই। ভাবিতেছিলেন, জন্মান্তরে আমি না জানি কি মহাপাপ করিয়াছিলাম, যাহার জন্য এ শাস্তি, এ কলঙ্ক আমায় ভোগ করিতে হইল। তাহার চক্ষু এখন শুষ্ক। বুকের ভিতর খাণ্ডবদহন–চোখের জল মরিয়া গিয়াছে।
সিঁড়ি দিয়া খগেন্দ্র যখন নামিতে লাগিল তখন তাহার বুটের প্রবল শব্দ বউরাণীর কাণে গেল। এই অপরিচিত শব্দে তিনি চমকিয়া উঠিয়া সেই দিকে কাণ দিয়া রহিলেন। শব্দ ক্রমে নীচে নামিল। তাহার পর অঙ্গন হইতে সেই বীভৎস চীৎকার–প্রত্যেক কথাটি বউরাণীর কাণে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীতে একটা সোরগোল উঠিল তাহাও তিনি অনুভব করিলেন। অপমান ও ধিক্কার তাহার চারিদিকে বেড়া-আগুনের মত যেন নূতন তেজে জ্বলিয়া উঠিল। মাথা ঝিম্ ঝিম্ করিতে লাগিল–চেতনা লুপ্ত হইল–তিনি শয্যার উপর মূর্হিত হইয়া পড়িলেন। কেহ তাহা দেখিতে পাইল না–জানিল না।
ওদিকে খগেন্দ্র প্রস্থান করিবামাত্র অঙ্গনে অন্তঃপুরিকাগণ সমবেত হইয়া পরস্পর। মুখ চাওয়া–চাওয়ি করিতে লাগিল। পূজার ঘর হইতে রাণীমা আলুথালুবেশে ছুটিয়া আসিলেন। যাহাকে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন–কি বলে গেল? –কণকের ভাই ও কি বলে গেল? –রাণীমার কাণেও খগেন্দ্রের সকল কথা প্রবেশ করিয়াছিল; কিন্তু নিজের কাণকে তিনি যেন বিশ্বাস করিতে পারিতে ছিলেন না। এমন সৰ্ব্বনাশের কথা কি সহসা বিশ্বাস হয়?
কেহ রাণীমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। তখন তিনি রুদ্ধশ্বাসে বলিতে লাগিলেন, কোথায় কনক কোথায়? সুরবালা কোথায়?
একজন রমণী একটা কক্ষের দিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করিয়া বলিল, সুরবালা ঐ ঘরে আছে।
রাণীমা তখন পাগলিনীর মত সেই কক্ষে গিয়া প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন সুরবালা দেওয়াল ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে–কাঁদিতেছে।
রাণীমা দুই চক্ষু কপালে তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, সুরো–সুরো–ও আমার ভবেন নয়?
সুরবালা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, না।
ও তোমার স্বামী?
হ্যাঁ। –বলিয়া সুরবালা ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল।
রাণীমা তখন বাহিরে আসিয়া ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। হাঁফাইতে হাঁফাইতে বলিতে লাগিলেন–কনক? –কনক কই?
একজন ছুটিয়া উপরে গিয়া কনককে ডাকিয়া আনিল। তাহাকে দেখিবামাত্র রাণীমা বলিলেন, হ্যা কনক, তোমার দাদা উঠানে দাঁড়িয়ে কি বলে গেল বাছা?
কনক কোনও উত্তর না দিয়া অবনতমুখে রহিল।
রাণীমা বলিলেন, যে এসেছে ও কি আমার ভবেন নয়?
কনক স্পষ্ট বলিল, না।
ও সুরবালার স্বামী?
হ্যাঁ।
রাণীমা কপালে করাঘাত করিয়া বলিলেন, হা জগদীশ্বর!–বলিয়া ছিন্নমূল তরুর ন্যায় কাঁপিতে কাপিতে সেইখানে লুটাইয়া পড়িলেন।
ওদিকে বহিৰ্ব্বাটীতেও এ সংবাদ পৌঁছিতে বিলম্ব হয় নাই। খগেন্দ্র টলিতে টলিতে কাছারির প্রাঙ্গণ পার হইবার এক মিনিট পরেই আমলাদের নিকট সংবাদ পৌঁছিল। নায়েব–দেওয়ান কালীকান্তবাবু তখনও কাছারিতে আসেন নাই–তাঁহাকে ডাকিবার জন্য একজন আমলা ছুটিল। নায়েববাবু তখন ভোজনে বসিয়াছেন। তাড়াতাড়ি সে কাৰ্য্য সমাধা করিয়া, আচমনান্তে গোটা দুই পাণ মুখে দিয়া স্থলোদরের উপর চাপকানের বোতাম আঁটিতে আঁটিতে ছুটিয়া আসিলেন। কাছারিতে পৌঁছিয়া হাঁফাইতে হাঁফাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, পালিয়েছে?
আমলারা বলিল, না।
নায়েববাবু তখন, জমাদার হনুমান সিং–জমাদার হনুমান সিং। –বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন।
জমাদার হনুমান সিং আসিয়া দাঁড়াইল। নায়েববাবু হুকুম দিলেন–এই জমাদার। হনুমান সিং–ঐ যে বেক্তি হামলোগকো বাবু সাজকে আয়া হ্যাঁয়–উ বাবু নেই হ্যাঁয়–জোচ্চোর হ্যাঁয়। যেৎনা পাইক বরকন্দাজ সব লোক যাও, বৈঠকখানা বাড়ীমে পাহারা দেও! বাবুকে ভাগনে মৎ দেও।
যো হুকুম। –বলিয়া জমাদার পাইক বরকন্দাজ একত্র করিতে ছুটিল।
নায়েববাবু কপালের ঘৰ্ম্ম মুছিয়া দুই গ্লাস জল পান করিলেন। বলিতে লাগিলেন–আমি সেইকালেই সন্দেহ করেছিলাম, কাউকে বলিনি তাই। ষোল বচ্ছর যে মানুষ নিরুদ্দেশ, সে কি আর ফেরে? দেওয়ানজি যে কাকা কাকা শুনেই গলে গেলেন! হতাম যদি আমি দেওয়ান, দেখতাম আমার চক্ষে কেমন করে ধূলো দিত। ভাগ্যিস আমি চার্জে রয়েছি। হেঁ হেঁ, আটকালাম ত–পালাতে ত দিলাম না! দেওয়ানজি যদি থাকতেন, এতক্ষণ ও পাঁচিল পগার ডিঙিয়ে পালিয়ে যেত। ওরে আর এক গেলাস জলদে।
একজন বৃদ্ধ আমলা বলিল, তা যেন হল। এখন, কর্তব্য কি?
নায়েব দেওয়ান মহাশয় গেলাস নামাইয়া বলিলেন, থানায় খবর পাঠাই।
বৃদ্ধ বলিল, দারোগা যখন জিজ্ঞাসা করবে–উনি যে ভবেন্দ্রবাবু নন–তার প্রমাণ কি? –শুধু সেই মাতালের কথাটুকুর উপর নির্ভর বই ত নয়। বর্ধমানের জাল প্রতাপৰ্চাদের মোকদ্দমার কথা জানেন ত। জাল প্রমাণ করা সোজা কথা নয়।
কথাটা শুনিয়া নায়েববাবু দমিয়া গেলেন। তখন সহসা তাহার মনে হইল, যদি মাতালের কথা মিথ্যা হয়, এই যে আমি বাবুর চারিদিকে পাহারা বসাইলাম–বাবু কি মনে করিবেন? –কল্যই ত আমার চাকরি যাইবে। প্রকাশ্যে বলিলেন–তা সে মাতাল গেল কোথা? তাকে ডেকে ভাল করে জিজ্ঞাসাই করা যাক না। কতক্ষণ গেছে?
একজন বলিল, বড় জোর আধ ঘণ্টা।
নায়েববাবু তখন আবার পেয়াদা পাইকগণকে ডাকাডাকি আরম্ভ করিলেন। তাহারা আসিলে, মাতাল বাবুকে খুঁজিয়া ডাকিয়া আনিবার জন্য আদেশ প্রচার করিলেন।
বৃদ্ধ আমলাটি বলিল, আমার বিবেচনায়, একবার রাণীমার সঙ্গে কথা কইলে আপনি ভাল করতেন। আমরা, ধরুন সবাই চাকর। তার হুকুম নিয়ে কায করাই ভাল। তিনি কি বলেন, থানায় খবর পাঠাতে বলেন–কিম্বা দার্জিলিঙে দেওয়ানজিকে তার করতে বলেন–সেটা জানলে হত।
নায়েবাবু বলিলেন, যাবই ত। রাণীমার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করবই ত। তাকে না জিজ্ঞাসা করেই কি কোনও কায করব? –ওরে কে আছিস? যা ত–অন্দরে রাণীমার কাছে এত্তেলা পাঠা যে নায়েববাবু একবার প্রণাম করতে চান।
রাণীমার হুকুম আসিতে বিলম্ব হইতে লাগিল। নায়েববাবু চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। লোকের উপর লোক পাঠাইতে লাগিলেন। শেষে তাহার তলব হইল।
অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া কালীকান্তবাবু যথাস্থানে নীত হইলেন। পর্দার আড়ালে রাণীমা ছিলেন। কালীকান্ত উদ্দেশে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিলেন, মা, যা শুনছি এ সব কি সত্য?
ঝির মুখে রাণীমার উত্তর উচ্চারিত হইল, সত্য।
উনি তা হলে আমাদের বাবু নন?
না।
তবে এখন উপায়?
উপায়–ঈশ্বর যা করবেন।
থানায় একটা খবর পাঠাব? –আমি তাকে নজরবন্দীতে রেখেছি।
থানায় খবর পাঠিও না। পাইক বর্কন্দাজ সরিয়ে নাও। ওঁকে কেউ যেন অপমান বা বিরক্ত না করে। উনি যখন নিজের ইচ্ছায় চলে যাবেন, তখন যাবেন।
আর কোনও হুকুম আছে?
বউমার ব্যারাম বড্ড বেড়েছে। ষ্টেশনে ঘোড়সওয়ার ছুটিয়ে দাও। কৃষ্ণনগরের সাহেব ডাক্তারকে টেলিগ্রাফ কর যেন তিনি সন্ধ্যার গাড়ীতে নিশ্চয় এসে পৌঁছন। যত টাকা আবশ্যক টেলিগ্রাফে তাকে পাঠিয়ে দাও। সন্ধ্যার গাড়ীর সময় ষ্টেশনে পাল্কী নিয়ে। ষোলজন বেহারা যেন উপস্থিত থাকে, ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে আসবে।
আর কোনও হুকুম আছে? দেওয়ানজিকে আসতে টেলিগ্রাফ করব কি?
না।
প্রণাম করিয়া নায়েব মহাশয় বিদায় গ্রহণ করিলেন। রাণীমার আচরণে তিনি হতভম্ব হইয়া পড়িয়াছেন। ধীরপদবিক্ষেপে কাছারিতে ফিরিয়া প্রথমে রাণীমার হুকুমগুলি তামিল করিলেন। তাহার পর, নিজ কেশহীন মস্তকাগ্রভাগে হস্ত–সঞ্চালন করিতে করিতে করিতে ক্রমাগত ভাবিতে লাগিলেন, যে ব্যক্তি এমন সৰ্ব্বনাশ করিয়াছে, যাহাকে মাটীতে কোমর অবধি পুঁতিয়া ডালকুত্তা দিয়া খাওয়াইলেও রাগ যায় না–সেই জুয়াচোরের উপর। রাণীমা এমন সদয় কেন?
সদয় হইবার কারণ আছে। কনকলতা চিঠি বাহির করিয়া তাঁহার নিকট প্রমাণ করিয়াছে, মাতাল আসিয়া একথা প্রকাশ করিবে যখন ঘুণাক্ষরেও রাখাল জানিত না, তখন সেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া বউরাণীকে সমস্ত জানাইয়াছিল। কনক তাঁহাকে বুঝাইয়াছে, রাখাল যে সময়মত সাবধানতা অবলম্বন করিয়া এই পবিত্রকুলের দীপ্তিটুকু অপরিম্লান রাখিল, এজন্য সে ইহাদের কৃতজ্ঞতারই পাত্র; এবং জন্মদরিদ্র হইয়াও এই বিপুল সম্পত্তিলাভের প্রলোভনকে জয় করিয়া ধৰ্ম্মপথে অটল রহিল, সে জন্য ভক্তির পাত্র বটে।
১১. কড়ি না মাণিক?
সেই যে খগেন্দ্রের উন্মত্ত গর্জন শুনিয়া বউরাণী সংজ্ঞা হারাইয়াছিলেন, তাহার পর সেই অবস্থাতেই তিনি পড়িয়া রহিলেন, অর্ধঘণ্টা কাল কেহ তাহার খোঁজ খবর লইল না।
অর্ধঘণ্টা পরে একজন পরিচারিকা কি করিতে সে কক্ষে আসিয়াছিল, সেই প্রথমে সকলকে সংবাদটা দিল। অনেক কষ্টে তাহার মূৰ্ছাভঙ্গ করা হইল, মূর্ছাভঙ্গের অনতিকাল পরে তিনি প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হইয়া পড়িলেন।
সন্ধ্যার গাড়ীতে কৃষ্ণনগরের সিভিল সার্জন আসিলেন। তিনদিন জ্বরভোগের পর, ডাক্তার সাহেবের অবিশ্রান্ত চিকিৎসায় রাত্রি দ্বিপ্রহর হইতে বউরাণীর জ্বরটা নরম পড়িতে লাগিল। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাহার লুপ্তচেতনাও ফিরিয়া আসিল।
সুরবালা তখন বউরাণীর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া তাহার মাথাটির কাছে মৃদু মৃদু পাখার বাতাস করিতেছিল। সুরবালার পানে চাহিয়া অত্যন্ত ক্ষীণস্বরে বলিলেন–তুমি সারারাত বসে রয়েছ?
সুরবালা বলিল, না আমি ত বেশীক্ষণ আসিনি। রাণীমা এতক্ষণ ছিলেন, আমাকে বসিয়ে তিনি গঙ্গাস্নানে গেছেন। তিনি এ দুদিন স্নানও করেন নি, খানও নি।
বউরাণী বলিলেন, দুদিন? কদিন আমার অসুখ করেছে?
আজ তিনদিন হল না? –পরশু দুপুরবেলা তুমি হঠাৎ মূৰ্ছা গিয়েছিলে।
বউরাণী যেন ভাবিতে চেষ্টা করিয়া বলিতে লাগিলেন, পরশু–দুপুরবেলা? ওঃ–হ্যাঁ। বলিয়া তিনি চক্ষু মুদিত করিলেন। তাঁহার সেই মুদিত চক্ষুরই পল্লব ভেদ করিয়া ফোঁটা ফোঁটা জল পড়িতে লাগিল।
তাঁহাকে কাঁদিতে দেখিয়া সুরবালা কি করিবে, কি বলিবে, কিছুই ভাবিয়া পাইল না। হঠাৎ বলিয়া ফেলিল–ডাক্তারসাহেব কাল বলছিলেন। –বলিয়া চুপ করিল।
বউরাণী চক্ষু খুলিয়া, সুরবালার মুখের পানে চাহিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন–কে?
সুরবালা বলিল, ডাক্তারসাহেব।
ডাক্তারসাহেব কে?
কৃষ্ণনগর থেকে ডাক্তারসাহেব এসেছেন কিনা।
কৃষ্ণনগর থেকে ডাক্তারসাহেব এসেছেন বুঝি? কবে?
পরশু সন্ধ্যাবেলা।
বটে!–বলিয়া বউরাণী অন্যদিকে চাহিয়া কি ভাবিতে লাগিলেন।
সুরবালা বলিল, তিনি বলেছেন, তুমি একটু ভাল হলেই তোমাকে হাওয়া বদলাতে নিয়ে যেতে।
বউরাণীর চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল। বলিলেন–তার আর দরকার নেই।
সুরবালা বলিল, কেন?
সব শুনেছ ত?
শুনেছি।
তবে–আর আমার বেঁচে কি হবে?
সুরবালা বলিল, তুমি ও কথা বলছ কেন ভাই? একদিন আমি ও কথা বলেছিলাম, তাতে তুমি আমায় কি বলে তিরস্কার করেছিলে মনে করে দেখ।
বউরাণী একটি কম্পিত দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন। পরে বলিলেন–তোমার অবস্থায় আমার অবস্থায় যে অনেক প্রভেদ ভাই! আমার জীবন যে কলঙ্কিত হয়ে গেছে। এ জীবন যত শীঘ্র শেষ হয় ততই ভাল নয় কি?
সুরবালা পাখাটি নামাইয়া আকুলভাবে বউরাণীর একখানি হাত নিজ হাতের মধ্যে লইল। বলিল–ও কথা তুমি কেন বল? তোমার ত কোনও দোষ নেই।
বউরাণী মাথাটি নাড়িয়া বলিলেন, আমার পোড়া অদৃষ্টের দোষ।
সুরবালা বলিল, তুমি ত নিজের স্বামী জেনেই–
এ কথায় বউরাণী একটু উত্তেজিত হইলেন। তাঁহার চক্ষুযুগল প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। বলিলেন–সে কথা একশো বার–হাজার বার।
সুরবালা উৎসাহিত হইয়া বলিল, তা হলে তোমার দেহ মন দুই ত খাঁটি আছে। কলঙ্কিত হয়েছে কেন বলছ? পাথরের মূর্তিকে মানুষ যে ঈশ্বর মনে করে পূজো করে–সে পূজো পাথর পায়, না ঈশ্বর পান? তুমিও তেমনি তোমার স্বামীকেই পূজো করেছ।
বউরাণী চক্ষু মুদিয়া বলিলেন, আচ্ছা, ভেবে দেখি।
সুরবালা আগ্রহে তাঁহার মুখখানির পানে চাহিয়া রহিল। বউরাণীর চক্ষুর পল্লব মাঝে মাঝে কাঁপিতে লাগিল, নিশ্বাসও মাঝে মাঝে কাঁপিয়া কাপিয়া উঠিল। কিয়ৎক্ষণ এইরূপ কাটিলে তিনি চক্ষু খুলিয়া আবার সুরবালার দিকে চাহিলেন, সে দৃষ্টি কৃতজ্ঞতা মাখান। বলিলেন–হ্যা ভাই–তুমি ঠিক বলেছ। তুমি ঠিক বলেছ। একটা কায কর না ভাই।
সুরবালা জিজ্ঞাসা করিল, কি? বল।
আমার ঐ দেরাজে, মাঝের খাটালে, ডানদিকের দেরাজটি খোল। তার ডানদিকের কোণে সবার নীচে, একটি হাতীর দাঁতের বাক্স আছে–নিয়ে এস।
সুরবালা উঠিয়া গিয়া দেরাজ খুলিয়া বাক্সটি বাহির করিয়া আনিল। বউরাণী বাক্সটি লইয়া যেন স্নেহের সহিত বুকের উপর রাখিলেন।
সুরবালা বলিল, এতে কি আছে ভাই?
বউরাণী বাক্সটি আস্তে আস্তে খুলিলেন। ভিতরে একটা রেশমী রুমালে কি বাধা রহিয়াছে দেখা গেল। পুঁটুলিটি বুকের উপর রাখিয়া আস্তে আস্তে খুলিতে লাগিলেন। বাহির হইল গুটিকতক কড়ি।
সুরবালা জিজ্ঞাসা করিল, কিসের কড়ি ভাই?
বউরাণীর অধর প্রান্তে একটু হাসি খেলিয়া গেল। বলিলেন–বাসি বিয়ের পরদিন, ফুলশয্যার আগে, কড়ি খেলতে হয় না? –এগুলি আমাদের সেই খেলার কড়ি।
কথাটি শুনিয়া সুরবালার চক্ষু জলে ভরিয়া আসিল। বউরাণী সুরবালার দিকে পাশ ফিরিলেন। রুমালখানি বিছানায় মেলিয়া, হাত দিয়া সেখানিকে চোস্ত করিয়া কড়িগুলি একটি একটি করিয়া গণিয়া তাহার উপর রাখিলেন। শেষেরটি রাখিয়া ব্যস্ত হইয়া বিছানায় হাতড়াইতে লাগিলেন। বলিলেন–একটা যে কম ভাই!
রত্নদীপ সুরবালা খুঁজিতে লাগিল। একটি কড়ি কি করিয়া দলভ্রষ্ট হইয়া পাশের বালিসের নীচে আত্মগোপন করিয়াছিল। সুরবালা সেটি কুড়াইয়া বউরাণীর হাতে দিল।
বউরাণী সেটিকে হাতে লইয়া নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। যেন কড়ি নয় একটি মানিক–হারানো মাণিক পাওয়া গিয়াছে। দেখিয়া, সেটি রুমালের উপর রাখিয়া, আবার সকল কড়ি গণনা করিলেন। তাহার পর রুমালটি সযত্নে বাঁধিয়া, বাক্সে রাখিয়া বলিলেন–দেরাজে সেইখানে আবার রেখে এস ভাই।
সুরবালা দেরাজ বন্ধ করিয়া আসিয়া দেখিল, বউরাণীর চক্ষু মুদিত। সুরবালা তাঁহার কাছে বসিলে ক্ষণেকের জন্য চক্ষু খুলিয়া বলিলেন–আমার ঘুম আসছে।
ঘুমোও। –বলিয়া সুরবালা তাঁহার মাথার উপর আবার মৃদু মৃদু পাখা করিতে লাগিল। বউরাণী শীঘ্রই ঘুমাইয়া পড়িলেন। সুরবালা দেখিল তাঁহার সেই সুপ্তিমগ্ন মুখে, কয়েক দিবস পরে আজ শান্তির ছায়া, বিরাজ করিতেছে।
১২. শেষ
অন্তঃপুরমধ্যে সুরবালা পরিচয়ে যে স্ত্রীলোক বাস করিতেছে, সে রাখালের স্ত্রী, এ কথা খগেন্দ্র প্রচার করিয়া যাইবার কিছুক্ষণ পরে রাখালের কর্ণেও প্রবেশ করিল। শুনিয়া তাহার বিস্ময়ের অবধি রহিল না। পাঁচ ছয়মাস পূর্বে যে লীলাবতী বসন্তপুর হইতে নবীনচন্দ্রের সহিত নিরুদ্দেশ হইয়াছিল, সে যে কি ঘটনাচক্রে আসিয়া এই পরিবারমধ্যে আশ্রয় লাভ করিতে সমর্থ হইল, তাহা রাখাল কিছুই বুঝিতে পারিল না। স্মরণ করিয়া দেখিল সুরবালার নাম যে বারংবার শুনিয়াছে, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও সে তাহাকে চক্ষে দেখিতে পায় নাই। সুতরাং সে যে নিজেকে রাখালের চক্ষু হইতে অন্তরালে রাখিতে বিশেষ যত্নবতী ছিল, ইহাতে রাখালের অণুমাত্র সন্দেহ রহিল না। এই সকল বিষয় চিন্তা করিয়া তাহার কৌতূহল ক্রমেই বর্ধিত হইয়া উঠিল। কাহাকেই বা জিজ্ঞাসা করে? অন্তঃপুরের দ্বার তাহার জন্য চিরদিনের মত রুদ্ধ। দুই একজন ঝি এখনও মাঝে মাঝে তাহার নিকট কাৰ্য্য উপলক্ষে আসিতেছে বটে, কিন্তু তাহাদিগকে এ বিষয়ে কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিতে রাখালের প্রবৃত্তি হইল না। কনকলতার সঙ্গে তাহার শেষ কথা। হইয়াছিল, তাহারও রাখালের স্মরণ হইল। এখান হইতে বিদায় গ্রহণের পূর্বে একবার সাক্ষাতের জন্য কনকের সনির্বন্ধ অনুরোধ তখন প্রহেলিকা বলিয়াই মনে হইয়াছিল। এখন রাখাল বেশ বুঝিতে পারিল, এই ব্যাপারের সহিত সে অনুরোধের নিশ্চয়ই কোনও সম্বন্ধ আছে।
বউরাণীর অবস্থা আর নিতান্ত সঙ্কটাপন্ন নহে, এইটুকু শুনিবার জন্যই রাখাল অপেক্ষা করিয়া ছিল, এখন তাহা শুনিয়াছে অথচ যাইতে পারিতেছে না। লীলাবতীর সহিত পুনৰ্ম্মিলিত হইবার আকাঙ্ক্ষা তাহার নাই। সে যেরূপ শুনিয়াছে এবং বিশ্বাস করিয়াছে, তাহাতে সে আকাঙ্ক্ষা থাকিতেও পারে না। তবে যাহাকে মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া বিবাহ করিয়াছিল, এত বৎসর ধরিয়া যাহাকে স্বীয় অর্ধাঙ্গিনীর স্বরূপ মনে করিত, তাহার কি হইয়াছে এবং পরিণামে কি হইবে, ইহা জানিবার জন্য একটা আগ্রহ রাখালের মনকে অধিকার করিয়া রহিল। কনকলতার সহিত কেমন করিয়াই তাহার সাক্ষাৎ হয়–এবং সাক্ষাৎ না করিয়া চলিয়া যাইতেও সে পারে না, এইরূপ দ্বিধায় পড়িয়া আরও দুইদিন কাটিয়া গেল।
তৃতীয় দিন প্রাতে শুনিল, দেওয়ানজিকে দার্জিলিঙে টেলিগ্রাম করা হইয়াছে–কল্য তিনি আসিয়া পৌঁছিবেন। রাণীমা এবং বউরাণী তীর্থযাত্রার আয়োজন করিতেছেন–দিনও স্থির হইয়া গিয়াছে। শুনিয়া রাখাল ভাবিল, আমি নড়িতে চাহিতেছি না, তাই ইহারা তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইতেছেন; দুর্জনের জন্য স্থানত্যাগে উদ্যত হইয়াছেন। সুতরাং তাহার আর বিলম্ব করা চলে না। সে বিকালের গাড়ীতে রওনা হইবে স্থির করিল। রাণীমা যে তাহার প্রতি নিতান্ত নিষ্করুণ নহেন, তাহারই আজ্ঞায় নজরবন্দীর পাহারা, অন্যান্য প্রকারের অপমান এবং পুলিশের হাতকড়ি হইতে নিষ্কৃতি পাইয়াছে, ইহা সে অবগত ছিল। তাই ভাবিল, তাহাকে একবার প্রণাম করিতে যাইবে। এবং সেই সঙ্গে কনকলতার সহিত একবার সাক্ষালাভের অনুমতি প্রার্থনা করিবে।
স্নানাদি শেষ হইলে রাখাল অন্তঃপুরে এত্তেলা পাঠাইয়া দিল, সঙ্গে সঙ্গে রাণীমা তাহাকে আহ্বান করিলেন। অন্তঃপুরে প্রবেশ করিবামাত্র যেটি সর্বপ্রথম কক্ষ, ঝি সেই কক্ষে রাখালকে বসাইল। অল্পক্ষণ পরে রাণীমা আসিয়া প্রবেশ করিলেন।
রাখাল দেখিল তাঁহার মুখ অবনত, মেঘের মত গম্ভীর। তাঁহার বসিবার আসন ছিল কিন্তু তিনি উপবেশন করিলেন না। রাখাল এক পা এক পা করিয়া তাঁহার সম্মুখে আসিল। কি বলিয়া সম্বোধন করিবে? মা বলিবার অধিকার আর তিনি তাহাকে দিবেন কি না, স্থির করিতে পারিল না। ধীরে ধীরে নতজানু হইয়া ভূমিতে মস্তকস্পর্শ করিয়া সে প্রণাম করিল। তাহার পর কষ্টে অশ্রুরোধ করিয়া নতনেত্রে বলিল–আমার সকল অপরাধ ক্ষমা করুন। –বলিয়া সে আকুলনয়নে ঊর্ধ্বমুখে রাণীমার দিকে চাহিল। দেখিল তাহার দুইচক্ষু দিয়া দরদর ধারায় অশ্রু বহিতেছে।
দেখিয়া রাখালেরও চক্ষের বাঁধ ভাঙ্গিল। কম্পিতকণ্ঠে সে বলিল, আপনাকে মা বলে সম্বোধন করার যোগ্য আমি নই, আমি মহাপাপী। যদি অনুমতি করেন, তা হলে আপনার পায়ে ধূলো নিয়ে জন্মের মত বিদায় হই।
রাণীমার ওষ্ঠযুগল কাঁপিতে লাগিল। তিনি বলিলেন, বাবা আর কিছু বলিতে পারিলেন না। প্রবল অশ্রুবন্যায় তাঁহার বক্তব্য ভাসিয়া গেল অঞ্চলটি মুখের উপর চাপিয়া তিনি ফোঁপাইতে লাগিলেন।
রাখাল বলিল, আমি নিজেকে যত দুর্ভাগ্য মনে করেছিলাম দেখছি তা নই। আপনি আমায় পুত্র সম্বোধন করে আপনাকে মা বলবার অধিকার আমায় দিলেন। মা, তবে আসি। –বলিয়া রাখাল ভূমিতে আবার প্রণত হইল।
চক্ষু হইতে অঞ্চল উন্মোচন করিয়া রাণীমা বলিলেন, বাবা এসআশীৰ্বাদ করি যেন ধৰ্ম্মে মতি অচল থাকে। যেন আবার তুমি সুখী হও। –বলিয়া ধীরে ধীরে তিনি দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলেন। দ্বারের নিকট পৌঁছিয়া হঠাৎ থামিয়া বলিলেন–একটু অপেক্ষা কর, কনক তোমার সঙ্গে দেখা করবে। –রাখাল কিন্তু কনকের সহিত সাক্ষাৎ করিবার কথা ভুলিয়া গিয়াছিল।
প্রায় পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করিবার পর, কনকলতা সেই কক্ষে প্রবেশ করিল। রাখাল তখন একটা চেয়ারে বসিয়া ছিল। কনক আসিয়া রাখালের অনতিদূরে দাঁড়াইল; এবং তাহার অনুরোধ সত্ত্বেও উপবেশন করিল না।
কনক মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি আজই চললেন?
রাখাল বলিল, বিকেলের গাড়ীতে যাব। বউরাণী এখন কেমন আছেন?
কনক বলিল, লোকের কাছে দেখাতে চাচ্ছেন যে তিনি খুব ভালই আছেন, কিন্তু আমার বিশ্বাস তা নয়।
রাখাল বলিল, শুনছি পরশু দিনই তীর্থযাত্রা করবেন। শরীরের এ অবস্থায় এত তাড়াতাড়ি যাওয়াটা ঠিক হবে?
সে কথা আমরা সকলে তাকে বলে বলে হেরে গেছি। তিনি আর কিছুতেই এখানে থাকতে চাচ্ছেন না।
কোথায় যাওয়া স্থির হয়েছে?
কাশী। আপনি এখন কোথায় যাবেন?
রাখাল বলিল, আমি কলকাতায় যাচ্ছি। তারপর সেখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাব।
কনক বলিল, লীলাবতী এখানে রয়েছে তা শুনেছেন কি?
রাখাল বলিল, শুনেছি।
তার কি ব্যবস্থা করলেন?
নিজের ব্যবস্থা সে ত নিজেই করেছে, আমি আর তার কি করব? আপনি ত সবই জানেন।
আমি জানি, কিন্তু আপনি জানেন না। লীলাবতীর সম্বন্ধে আপনি একটা মহাভ্রমে পড়েছেন।
এ কথা শুনিয়া রাখাল চমকিয়া উঠিল। বলিল–কেন? কি ভ্রমে পড়েছি?
কনক বলিল, আপনার স্ত্রী সতী সাধ্বী, তবে কিঞ্চিৎ নির্বোধ। শুধু নিজের বুদ্ধি দোষে এই ফ্যাসাদটি বাধিয়েছে।
রাখাল আগ্রহে উদ্গ্রীব হইয়া বলিল, কি রকম, কি রকম?
কনক তখন একটু একটু করিয়া লীলাবতীর ইতিহাস রাখালের নিকট ব্যক্ত করিল।
রাখাল শুনিয়া কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল। শেষে বলিল–এ কথা তুমি ত ঐ লীলারই কাছে শুনেছ? ওর কথায় বিশ্বাস কি? নিজের দোষ ঢাকবার জন্যে এই রকম একটা কিছু ও ত এখন বলবেই।
কনক বলিল, ওর কাছে প্রথম একথা শুনিনি রাখালবাবু।
প্রথমে তবে কার কাছে শুনলে?
আপনার কোনও বন্ধুর কাছে।
আমার বন্ধু? কে?
সেই যে–যিনি ব্র্যাণ্ডি খান–খগেন্দ্রবাবু। আপনার প্রতি অকৃত্রিম বন্ধুতাবশতঃ তিনি আপনার জীবনচরিতের উপকরণ সংগ্রহ করতে করতে এই সমস্ত কথা জানতে পেরেছিলেন।
রাখাল কনকের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। তাহার মনে সন্দেহ হইতে লাগিল, লীলাবতীর প্রতি স্নেহবশতঃ তাহার মঙ্গলার্থ এ হয়ত মিথ্যা করিয়া আমায় এ সমস্ত বলিতেছে।
কনক বলিল, ও কি, আমার কথায় আপনি অবিশ্বাস করছেন নাকি?
রাখাল বলিল, আপনার এ সকল কথা সত্য তার প্রমাণ কি?
কনক বলিল, প্রথম, আমি আপনাকে মিথ্যা কেন বলব? আমার তাতে লাভ?
লীলাবতী আপনার সখী। সখীর উপকার করা।
লীলাবতী আমার সখী নয়।
তবে বিপন্নের উপকার করা।
কনক একটু হাসিল। বলিল–কারু উপকার করা আমার কুষ্ঠীতেই লেখেনি রাখালবাবু! সে সব কিছু নয়। কিন্তু আপনি প্রমাণ যদি চান–আমি অকাট্য প্রমাণ দিতে পারি।
রাখাল বলিল, কি প্রমাণ?
কনক বলিল, আপনার পরমবন্ধুর হস্তাক্ষর। –বলিয়া তাড়াতাড়ি বাহিরে গেল। দুই মিনিট পরে ফিরিয়া আসিয়া রাখালের হাতে কয়েকখানি চিঠি দিল।
রাখাল একে একে সেই পত্রগুলি পড়িল, খামগুলি উল্টিটা পাল্টিয়া ডাকঘরের ছাপগুলি পরীক্ষা করিল। অবশেষে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া অন্য দিকে চাহিয়া রহিল।
কনক বলিল, ভাবছেন কি? লীলার উপর আর আপনার কোনও সন্দেহ আছে নাকি?
রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, রাণীমা এসব কথা জানেন?
এখন তিনি সবই জানতে পেরেছেন।
তার এ সম্বন্ধে মত কি?
কনক বলিল, তার মত আপনি কি তাঁর ব্যবহারেই বুঝতে পারেন নি?
রাখাল আশ্চৰ্য্য হইয়া বলিল, কেন? কি ব্যবহার?
কনক বলিল, আমার সঙ্গে দেখা করতে তিনি কি আপনাকে বলে যান নি?
ওঃ হাঁ, ঠিক বটে। আচ্ছা রাণীমা কি বলেছেন কনক?
সকল কথা শুনে, এই চিঠি সব পড়ে, রাণীমা আপনার গিন্নীর বুদ্ধির তারিফ করতে লাগলেন।
রাখাল অধীর হইয়া বলিল, লীলাবতাঁকে আমার গ্রহণ করা সম্বন্ধে তিনি কিছু মত প্রকাশ করেছেন?
কনক বলিল, হ্যাঁ, তা করেছেন বইকি! তিনি বলছিলেন নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে বিনা দোষে ত্যাগ করে রাখাল কখনই অধৰ্ম্ম করবে না।
অবনত মুখে রাখাল চিন্তা করিতে লাগিল। আবার তুমি সুখী হবে। রাণীমার এই আশীৰ্ব্বচনের গূঢ় ইঙ্গিতটুকু সে বুঝিতে পারিল।
কনক বলিল, লীলাকে এখানে পাঠিয়ে দেব?
রাখাল বলিল, না, এখন থাক্। আমার সঙ্গে সে যাবে, তাকে প্রস্তুত থাকতে বলবেন। এখন বিদায় নিই। আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলব না।
.
সেইদিন অপরাহ্নে রাখাল ও তাহার স্ত্রীকে লইয়া গ্রাম হইতে দুইখানি পাল্কী বাহির হইল। কলিকাতায় পৌঁছিয়া সেখানে একটি ক্ষুদ্র বাড়ী ভাড়া লইয়া, মাসখানেক থাকিয়া রাখাল চাকরীর চেষ্টা করিতে লাগিল। রাণীমা লীলাবতীকে কিছু অর্থ দিয়াছিলেন, সুতরাং রাখালকে কোনও কষ্টে পড়িতে হয় নাই। একমাস হাঁটাহাঁটির পর, বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের একটি ছোট ষ্টেশনের ছোটবাবু হইয়া রাখাল কলিকাতা পরিত্যাগ করিল।
.
আরও মাস দুই পরে, লীলাবতী একদিন কনকলতার নিকট হইতে একখানি পত্র পাইল। তাহা পাঠে জানা গেল, কনকও রাণীমার হাতে পায়ে ধরিয়া, ইঁহাদের সহিত কাশী গিয়াছিল। সেখানে পৌঁছিয়া, বউরাণীর পীড়া উত্তরোত্তর বর্ধিত হইতে থাকে। বিগত রাসপূর্ণিমার দিন তাহার কাশীলাভ হইয়াছে। মৃত্যুর দুদিন পূৰ্ব্বে ফুলশয্যা-উৎসবের সেই কড়িগুলি তিনি আঁচলে সৰ্ব্বদা বাঁধিয়া রাখিতেন; এবং তাহারই অনুরোধক্রমে কড়িগুড়িও তাঁহার সহিত চিতায় স্থানলাভ করিয়াছে।