প্রিয়তমেষু পর্ব:০৫ হুমায়ূন আহমেদ

প্রিয়তমেষু পর্ব:০৫

জহির এখনন ফিরছে না। রাত আটটার আগে সে সাধারণত ফেরে না। আজ যদি সকাল-সকাল আসত। নিশাত ঘরে তালা লাগিয়ে বারান্দায় এসে দেখল—পর বাবা সিড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। তার এক হাতে বাজারের ব্যাগ, অন্য হাতে দড়িতে বাঁধা কলা। নিশাতের চোখে চোখ পড়ামাত্র সে চোখ নামিয়ে নিল।রকিব সাহেব।রকিব অবাক হয়ে তাকাল।আপনি একটু আমার ঘরে আসুন।আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। আসুন।হাত গুটিয়ে রকিব বসে আছে। কলাগুলো তার কোলের উপর রাখা। সে ছোট-ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলছে। তার কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। সে মাথা নিচু করে শুনছে। মাঝে-মাঝে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন কোনো কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে সিগারেট বের করে আবার পকেটে রেখে দিল। নিশাত বলল, আপনি সিগারেট খান, কোনো অসুবিধা নেই।পল্টু। পল্টু কোথায়?

আছে, ওর মার কাছেই আছে। আপনাকে শক্ত হতে হবে, বুঝতে পারছেন? এখন। যান, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলুন। ঘুমিয়ে থাকলে ঘুম ভাঙাবেন না। অপেক্ষা করবেন। আপনার স্ত্রীর মানসিক অবস্থাটা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? রকিব জবাব দিল না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নিশাত বলল, পুলিশে খবর দিতে হবে। আমি অনেক আগেই দিতাম। আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।পুলিশ? হ্যাঁ, পুলিশ। এত বড় একটা ঘটনার পরও আপনি পুলিশে খবর দেবেন না? রকিব চুপ করে রইল। নিশাত বলল, আপনি আপনার বন্ধুকে শাস্তি দিতে চান না? চাই।হ্যাঁ, নিশ্চয়ই চান। কেন চাইবেন না?

লোক জানাজানি হবে।তা তো হবেই। কিন্তু আজ যদি ঐ লোকটির শাস্তি না হয়, তা হলে কী হবে ভেবে দেখুন। ও বুক ফুলিয়ে অন্য কোনো মেয়ের কাছে যাবে। ঠিক একই অবস্থা হবে অন্য একটা মেয়ের।আমি একটু ভেবে দেখি।এর মধ্যে ভেবে দেখার কিছু আছে কি? রকিব জবাব দিল না। নিশাত বলল, যান, আপনার স্ত্রীর কাছে যান। আমিও আসছি।রকিব উঠে দাঁড়াল। সবগুলো কলা মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। রকিব নিচু হয়ে কলাগুলি তুলছে। মনে হচ্ছে সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে।রকিব সাহেব, আপনি আপনার স্ত্রীর কাছে যান। আমি একটু পরেই আসছি। রকিব ঘর থেকে বের হতে আবার দরজায় একটা ধাক্কা খেল। কলাগুলি আবার মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল। টেলিফোন বাজছে। নিশাত ফোন ধরল।

মা নিশু! হ্যাঁ বাবা।একটু পরপর টেলিফোন করছি, কৈউ ধরছে না।আমি ছিলাম না।মেয়েটির ব্যান্ড কি এসেছে? হ্যাঁ, এসেছে।পুলিশ কেস করতে চায়? কেন চাইবে না? চায়।এখন হয়তো ঝোঁকের মাথায় চাচ্ছে। তারপর যখন চারদিকে হৈচৈ শুরু হবে, তখন মাথার চুল ছিড়বে।তখনকার কথা তখন হবে।আমাদের সোসাইটিকে তুমি চেন না মা।আমার চেনার দরকার নেই। বাবা, তুমি কি তোমার গাড়িটা পাঠাতে পারবে? পারব। গাড়ি দিয়ে কী হবে?

থানায় যাব।নিশু মা, আমার একটা কথা শোন।তুমি গাড়িটা পাঠাও তো বাবা! নিশাত টেলিফোন নামিয়ে ঘড়ি দেখল। সাতটা পাঁচ বাজে। জহিরের আসতে এখনও অনেক দেরি।সে তালাবন্ধ করে পাশের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজা বন্ধ। বেশ কয়েক বার কলিংবেল টেপার পর রকিব দরজা খুলে দিল।পুষ্প মেঝেতে মাথা নিচু করে বসে আছে। নিশাতকে ঢুকতে দেখেই বলল, ও পুলিশের কাছে যেতে চাচ্ছে না আপা। তুমি আমাকে নিয়ে চল। ওরা তো টাকা নেবে, তাই না? আমার কাছে টাকা আছে। আমার নানিজান আমাকে পাঁচ হাজার টাকা। দিয়েছেন।

পুষ্প হু-হু করে কেঁদে ফেলল। রকিব চেয়ারে বসে আছে। তার দৃষ্টি ভাবলেশহীন।আপা, ও আমাকে পুলিশের কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছে না আপা।তুমি যদি চাও আমি নিয়ে যাব। এক্ষুণি নিয়ে যাব। আর শুনুন ভাই, আপনি কেন নিতে চাচ্ছেন না? রকিব জবাব দিল না। পল্টু জেগে উঠেছে। সে হামাগুড়ি দিয়ে তার মাকে ধরতে গেল। পুষ্প বাঁ হাতে এক ঝটকা দিয়ে তাকে ফেলে দিল। এই শিশু মার কাছ থেকে। কখনন এরকম ব্যবহার পায় নি। সে এতই অবাক হল যে কাঁদতে পারল না। চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে রইল। অভিমানে তার ঠোট বেঁকে যাচ্ছে। চোখ ছলছল করছে।

মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ তাকিয়ে আছেন। পুলিশেরা কোনো ব্যাপারেই কৌতূহলী হয় না। কৌতূহল ও বিস্ময় তাদের থাকে না। কিন্তু এই অফিসারটির গলায় খানিকটা আগ্রহ যেন আছে। তিনি নিশাতের চোখে চোখ রেখে বললেন, বলুন।আমি কি একটু নিরিবিলিতে বলতে পারি? থানা হচ্ছে একটা বাজার। মাছের বাজার। এর মধ্যে নিরিবিলি কোথায় পাবেন! যা বলতে চান এর মধ্যে বলতে হবে।এর মধ্যে আমি কিছু বলতে পারব না।বসুন, দেখি কি করা যায়।অফিসার ইনচার্জ অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অতি দ্রুত মোটা খাতায় কী সব লিখতে লাগলো। এর মধ্যে টেলিফোন আসছে।

রোগা একটা লোক প্রতি বারই দূর থেকে উঠে এসে টেলিফোন ধরছে, যদিও টেলিফোনের কাছেই অন্য একজন লোক বসে আছে। হাত বাড়ালেই সে টেলিফোন ধরতে পারে। ধরছে না। ঘরজোড়া বিরাট একটা টেবিল। রাজ্যের কাগজপত্র সেখানে। সেইসব কাগজপত্রের উপর প্লাস্টিকের বড় থালায় বানাননা পান। দেয়ালে বড় একটা ঘড়ি। ঘড়িটা পনের মিনিট ফাস্ট। ঘরের এক কোথায় কোমরে দড়ি বাঁধা দাড়িওয়ালা দু জন লোক বসে আছে। এরা প্রচণ্ড মার খেয়েছে। এক জনের ঠোট কাটা। কাটা ঠোঁট বেয়ে রক্ত পড়ছিল। সেই রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধেছে। লোকটি কিছুক্ষণ পরপর ও আল্লা গো বলে চেচিয়ে উঠে কাঁদছে। সেদিকে কেউ কোনো রকম গুরুত্ব দিচ্ছে না।নিশাত বলল, আমরা কতক্ষণ অপেক্ষা করব?

হাতের কাজটা সেরে নিই। ওয়াসিম, রেকর্ড-রুমটা খুলে দাও। যান, আপনারা ঐ রুমে গিয়ে বসুন। ওয়াসিম, ওঁদের নিয়ে যাও। আমি দু-তিন মিনিটের মধ্যে চলে আসব।সেই রেকর্ড-রুমেও তারা পনের মিনিটের মতো বসে রইল। একটা ছেলে এসে দু কাপ চা এবং প্লেটে করে পান দিয়ে গেল। এই ঘরটা বাথরুমের কাছে। বিকট গন্ধ আসছে। ঘোট ঘর, কিন্তু আলো খুব কড়া। দু শ পাওয়ারের একটা বা জ্বলছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ ককর করে।পুষ্প চুপচাপ বসে আছে। একটি কথাও বলছে না। নিশাত দু-একটা টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করছে। পুষ্প জবাব দিচ্ছে না। মাঝে-মাঝে একটু যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। খুব সম্ভবত তার জ্বর।শরীর খারাপ লাগছে?

না।বসে থাকতে ভালো লাগছে না, তাই না? পুষ্প জবাব দিল না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। বাইরে ঘন অন্ধকার, দেখার কিছু নেই। তবু পুষ্প মনে হয় অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছে।আমি অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। কিছু মনে করবেন না। ইচ্ছা করে বসিয়ে রাখি নি। আপনারা মনে হচ্ছে কোনো রেপ কেস রিপোর্ট করতে এসেছেন, তাই না? নিশাত বিস্মিত হয়ে বলল, হ্যাঁ।এগার বছর পুলিশে চাকরি করছি, কিছু-কিছু বুঝতে পারি। আমার নাম নুরুদ্দিনপুলিশ ইন্সপেক্টর। পুরো ঘটনা বলুন। ঘটনাটা কখন ঘটল? * নিশাত কাল পুষ্পের দিকে। পুষ্প মাথা নিচু করে বসে রইল। নুরুদ্দিন বললেন,

আপনি যা জানেন তাই বলুন। ওনার সঙ্গে আমি পরে কথা বলব।নিশাত গুছিয়ে কিছু বলতে পারল না। তার বারবারই মনে হল অফিসারটি মন দিয়ে কিছু শুনছেন না। বারবার নড়াচড়া করছেন। কথার মাঝখানে দুবার উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে থুথু ফেললেন। একবার নিশাতকে চমকে দিয়ে খুবই উচু গলায় ডাকলেন, ওয়াসিম, ওয়াসিম। ওয়াসিম নামের কেউ-একজন এসে দাঁড়াল।নিশাত কথা বন্ধ করে চুপ করে রইল। নুরুদ্দিন সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, গাড়ি এসেছে?

জ্বিনা স্যার। চাকা নাকি পাংচার হয়েছে।চাকা ঠিক করতে সারা দিন লাগে? যান দেখুন কী ব্যাপার। দশ মিনিটের ভেতর গাড়ি চাই। যান যান, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ওয়াসিম চলে যেতেই নিশাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, তারপর কী হল বলুন।যা বলার বলে ফেলেছি। এর বেশি বলার কিছু নেই।নুরুদ্দিন তাকালেন পুষ্পের দিকে। গম্ভীর গলায় বললেন, আপনার স্বামী আসেন নি কেন? ওনার কি কেইস ফাইল করার ইচ্ছা নেই? পুষ্প জবাব দিল না। সে এখনো জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে।আপনি কেইস করতে চান? হ্যাঁ।আপনি গোসল করেছেন, তাই না?

হ্যাঁ।বেশ কয়েকবার, তাই না? হ্যাঁ।এইখানেই একটা সমস্যা করেছেন। মেডিকেল রিপোর্টে হয়তো কিছু পাওয়া যাবে না।নিশাত বলল, রিপোর্টে কিছু না পাওয়া গেলে কি কেইস হবে না? অবশ্যই হবে। তবে যদি পাওয়া যায় তা হলে আমি আজ রাতেই ৩৭৬ ধারায় ভদ্রলোককে গ্রেফতার করব। এটা নন-বেইলেবল। কাজেই বেল হবে না। মিজান সাহেবের ঠিকানা কি জানা আছে? পুষ্প বলল, না।আপনার স্বামী নিশ্চয়ই জানেন।হ্যাঁ।আমরা ওনার কাছ থেকে জেনে নেব। চলুন যাওয়া যাক।কোথায় যাব?

মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ডাক্তারি পরীক্ষাটা হয়ে যাক। এই জাতীয় : কেইসের শুরুটা খুব ঝামেলার। অনেকেই এ-সব ঝামেলার ভেতর দিয়ে যেতে চান না।নিশাত বলল, কি ধরনের শাস্তি হতে পারে বলতে পারেন? পারি। প্রমাণ করতে পারলে কুড়ি বছরের সাজা হয়ে যাবে।প্রমাণ করা কি শক্ত? হ্যাঁ, শক্ত। বেশ শক্ত। তবে ভিকটিমের মনের জোর যদি থাকে তা হলে পারা যায়।পুষ্প বলল, আমি ডাক্তারি পরীক্ষা করাব না। আমি বাসায় চলে যাব।নুরুদ্দিন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। শান্ত গলায় বললেন, অসুবিধাটা কোথায়? মহিলা-ডাক্তাররা আপনাকে পরীক্ষা করবেন।

আমি বাসায় চলে যাব।দশ মিনিটের ব্যাপার।এক বার তো বললাম, আমি বাসায় যাব।যদি আপনি মেডিকেল টেস্টটা করান তা হলে আমি এক ঘন্টার মধ্যে এই হারামজাদাকে ধরে হাজতে ঢুকিয়ে দেব। আর যদি না করান, সে রাতের বেলা আরামে ঘুমুবে। হয়তো অন্য কোনো মেয়ের কাছে যাবে। আমি নিজে খুব যে একজন অনেস্ট অফিসার, এটা দাবি করব না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই ভদ্র অপরাধীগুলিকে ধরতে চাই। তাদের চোদ্দ পুরুষের বাপের নাম ভুলিয়ে দিতে চাই। আপনারা যদি সাহায্য না করেন কীভাবে করব?

আমি বাসায় যাব।নিশ্চয়ই যাবেন। মেডিকেল কলেজের ঝামেলাটা মিটিয়েই চলে যাবেন। আমি নিজে পৌছে দিয়ে আসব। আপনার স্বামীর সঙ্গে কথা বলব।পুষ্পের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। একট পরপর সে ফুঁপিয়ে উঠছে। নুরুদ্দিন বললেন, যে-ব্যাপারটা আজ আপনার জীবনে ঘটেছে, আপনার মেয়ের জীবনেও এটা ঘটতে পারে। পারে না? চলুন রওনা হই।পুষ্প উঠে দাঁড়াল।নিশাত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে-ঘরটায় বসে অপেক্ষা করছে, এটা সম্ভবত নার্সদের কমনরুমজাতীয় ঘর। নার্সরা আসছে-যাচ্ছে। মোটামুটি একটা বাজারের মতো ব্যাপার। এরা কেউ নিশাতকে তেমন লক্ষ করছে না। তবে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা নুরুদ্দিনকে দেখছে কৌতূহলী হয়ে এক জন জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার স্যার? নুরুদ্দিন হাই তুলে বললেন, কোনো ব্যাপার না। আপনাদের দেখতে এলাম। আপনারা ভালো আছেন?

পুলিশ অফিসারের এই ভঙ্গিটি নিশাতের বেশ পছন্দ হল। খুবই স্বাভাবিক আচরণ। যেন কিছুই হয় নি। ব্লাড-প্ৰেশার মাপাবার জন্যে এক জন রুগীকে নিয়ে এসেছেন। সারাটা পথ রেপ কেস প্রসঙ্গে বা মিজান সম্পর্কে একটি কথাও বলেন নি, বরং প্রতিমন্ত্রীর বাড়ির সামনে কয়েকটা নেড়িকুত্তা জটলা পাকাচ্ছিল, তাতে কী সমস্যা হল সেই গল্প শুরু করলেন। মন্ত্রী টেলিফোনে পুলিশের সাহায্য চাইলেন। পুলিশ বলল, নেড়িকুত্তা তো স্যার আমাদের ব্যাপার না। এটা মিউনিসিপ্যালেটির ব্যাপার। প্রতিমন্ত্রী রেগে আগুন, মিউনিসিপ্যালেটি বুঝি না আপনাদের অ্যাকশন নিতে বলেছি, আপনারা অ্যাকশন নিন। প্রতি রাতে বাড়ির সামনে রাজ্যের কুকুর ঘেউঘেউ করবে, তা হলে আপনারা আছেন কি জন্যে? আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ফায়ার ওপেন করতে হলে এক জন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লাগে। আমরা তা হলে এক জন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা বলি? প্রতিমন্ত্রী ঘাবড়ে গিয়ে বললো, এই সামান্য ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেট লাগবে?

জ্বি স্যার লাগবে। গুলী কোনো সামান্য ব্যাপার না। এখন বাজে রাত তিনটা। আবাসিক এলাকায় গুলী চলবে। সবাই টেলিফোন করবে পত্রিকা অফিসে। পত্রিকার রিপোর্টাররা আসবে আমার কাছে। আমি তাদের পাঠাব আপনার কাছে। সম্পাদকীয় লেখা হবে। প্রেসিডেন্ট তদন্ত কমিটি গঠন করবেন। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি….।

থামুন। আপনাকে কিছু করতে হবে না।নিশাত বুঝতে পারছিল ভদ্রলোক এইসব বলছেন পরিস্থিতি হালকা করার জন্যে। এটা নিশাতের কাছে চমৎকার লাগল। এক জন সেনসেবল মানুষ।এই যে এখন তারা দুজন মুখোমুখি বসে আছে, ভদ্রলোক একটি কথাও বলছেন। না—কারণ তাঁর কথা বলার প্রয়োজন নেই। কথা যারা বেশি বলে তারা কাজ তেমন করতে পারে না। এই অফিসারটি নিশ্চয়ই কাজের।নুরুদ্দিন সাহেব! বলুন।এই জাতীয় কেইস কি আপনাদের কাছে অনেক আসে? না। খুব কম আসে। লোকলজ্জার ভয়েই কেউ আসে না। যা আসে লোয়ার ক্লাস থেকে। রিকশাওয়ালা, মজুর—এই রকম। লোকলজ্জার ভয় ওদের তেমন নেই, আমাদের যেমন আছে। তা হয়তো ঠিক।

একেবারেই যে হয় না তা নয়। কিছু-কিছু হয়। মাঝপথে সেইসবও নষ্ট হয়ে যায়। পত্রিকাওয়ালারা বড় ঝামেলা করে। নানান রকম কেচ্ছাকাহিনী ছাপে। ধর্ষণের খবরগুলি যেন একটা চাটনি। ছবিটবি বক্স করে ছেপে দেয়। কোনো-কোনো খবরে ধর্ষণের বর্ণনাও থাকে। পড়লে মনে হবে পর্নোগ্রাফী। যিনি লিখেছেন, তিনি লেখার সময় খুব মজা পেয়েছেন এটা বোঝা যায়। আপনার কখনো চোখে পড়ে নি? এইসব খবর আমি পড়ি না।আমার পড়তে ইচ্ছা করে না, কিন্তু পড়তে হয়। বাধ্য হয়ে পড়তে হয়।এত দেরি হচ্ছে কেন?

একটু সময় লাগবে। নানান ফ্যাকড়া আছে। এরকমও হয়েছেডাক্তার চমৎকার রিপোর্ট দিয়েছেন, রিপোর্টের উপরই কনভিকশন হয়ে যাবে এমন অবস্থা, কিন্তু আমরা সে-সব রিপোর্ট কাজে লাগাতে পারি নি।কেন? বাদীপক্ষ কেইস উইথড্র করে। এগোতে চায় না। এই ক্ষেত্রেও তাই হয়তো হবে। দেখলেন না, স্বামী বেচারার কোনো আগ্রহ নেই। এল না পর্যন্ত। আমি যখন যাব আমার সঙ্গে কথাও বলবে না।পুষ্পকে আসতে দেখা যাচ্ছে। তার সঙ্গে বুডোমতো এক জন ডাক্তার। রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। নুরুদ্দিন রিপোর্টে চোখ বোলালেন। নিশাত বলল, কী আছে রিপোর্টে?

নুরুদ্দিন জবাব দিলো না। রিপোর্টটা পকেটে রেখে দিলেন। ডাক্তার সাহেব নিশাকে বললেন, আমি কিছু সিডেটিভ প্রেসক্ৰাইব করেছি। সিডেটিভ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। প্রচণ্ড মানসিক চাপ গেছে। পূর্ণ বিশ্রাম দরকার।নুরুদ্দিন বললেন, চলুন পৌঁছে দিয়ে আসি। আমার কিছু ইনফরমেশনও দরকার। ঐ সঙ্গে নিয়ে আসব।গাড়িতে নিশাত আরেক বার বলল, রিপোর্ট কী পাওয়া গেছে? নুরুদ্দিন প্রশ্নের জবাব দিলেন না। অন্য একটা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর সম্ভবত এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করবার ইচ্ছা নেই। নিশাত আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।

জহির এখন ফেরে নি।নিশ্চয়ই বন্ধুবান্ধুব জুটিয়েছে। মাঝেমাঝে বন্ধুবান্ধব জুটে যায়। বাড়ি ফিরতে রাত হয়। তার চোখেমুখে অপ্ৰস্তুত ভাব লেগে থাকে। লজ্জিত-অনুতপ্ত মানুষের আচরণ দেখতে ভালো লাগে। নিশাতের মনে হল আজ তাই দেখবে।সে রান্না চড়াল। সামান্য কিছু রান্না করবে—ভাত, দু পিস মাছ ভাজা, ডাল। ভাগ্যিস জহির তার বাবার মতো লোজনবিলাসী হয় নি। হলে মুশকিল হত। রান্নাঘরে সময় দিতে তার ভালো লাগে না।

 

Read more

প্রিয়তমেষু পর্ব:০৬ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *