প্রিয়তমেষু শেষ : পর্ব হুমায়ূন আহমেদ

প্রিয়তমেষু শেষ :পর্ব

পুষ্পকে কাঠগড়ায় ডাকা হয়েছে। শপথ নেওয়ানো হবে। মিজানের পক্ষের উকিল ক্রস একজামিনেশন শুরু করবে। আদালতে চাঞ্চল্য লক্ষ করা যাচ্ছে। এ-জাতীয় কেইসের ক্রস একজামিনেশন সাধারণত খুব মজার হয়ে থাকে। পুষ্পের ভেতরে একটা দিশাহারা ভাব দেখা যাচ্ছে। সে বারবার নিশাতের দিকে তাকাচ্ছে। জহির বসে আছে নিশাতের পাশে। সে সাত দিনের ছুটি নিয়েছে। বিচার চলাকালীন সময় সে তার স্ত্রীর সঙ্গেই থাকবে। নিশাতের শরীর অসম্ভব খারাপ করেছে। মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করে এক্ষুণি সে এলিয়ে পড়বে। জহির ফিসফিস করে বলল, খুব খারাপ লাগছে?

নিশাত বলল, না। শুধু পানির পিপাসা হচ্ছে।চল, পানি খেয়ে আসা যাক।না, আমি যাব না।মাথার উপরে একটা ফ্যান আছে। কিছুক্ষণ পরপর ঘটাং-ঘটাং শব্দ হচ্ছে। কোর্টঘরে নতুন চুনকাম করা হয়েছে। চুনের গন্ধের সঙ্গে মানুষের ঘামের গন্ধ মিশে কেমন অদ্ভুত একটা গন্ধ তৈরি হয়েছে।সরদার একরিম চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তাঁকেও কেন জানি খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। আসামী পক্ষের উকিল হচ্ছেন মিশ্রবাবু। অত্যন্ত ধুরন্ধর লোক। তিনি কীভাবে ডিফেন্স নেবেন তা আঁচ করা বেশ কঠিন। ক্রস একজামিনেশন তিনি বেশ সহজভাবেই শুরু করেন। কিন্তু সেই সহজ জিনিস অতি দ্রুত কঠিন হতে শুরু করে। সাক্ষী বুঝতেও পারে না তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে চোরাবালিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যতই সে বেরিয়ে আসবার জন্যে ছটফট করবে, ততই তাকে ড়ুবে যেতে হবে।বলুন, আমি শপথ করিতেছি যে, যাহা বলিব সত্য বলিব…..

পুষ্প যন্ত্রের মতো শপথবাক্য উচ্চারণ করল।তারপরই তার বক্তব্য তাকে বলতে বলা হল। পুষ্প বেশ স্বাভাবিকভাবেই বলল। তার মুখ রক্তশূন্য এবং বারবার সে নিশাতের দিকে তাকাচ্ছিল। এ ছাড়া চোখে পড়ার মতো কিছু তার আচরণে ছিল না। দু বার তার কথার মাঝখানে কোর্টে বড় রকমের গুঞ্জন উঠল। জজসাহেবকে হাতুড়ি পিটিয়ে বলতে হল–অর্ডার অর্ডার।তার পাশের কাঠগড়াতেই মিজান দাঁড়িয়ে আছে। সে এক বার মিজানের দিকেও তাকাল। মিজান তাকে কৌতূহলী চোখে দেখছে।মিশ্ৰবাবু এগিয়ে এলেন। তাঁর মুখ হাসি-হাসি। তিনি পুষ্পের দিকে তাকিয়েও অল্প হাসলেন।আপনার নাম? পুষ্প।

এটা তো আপনার ডাকনাম, ভালোনাম বলুন। নাকি আপনি চান আমরা সবাই আপনাকে ডাকনামে চিনি।আদালতে ছোট একটা হাসির গুঞ্জন উঠল। পুষ্প বলল, আমার ভালোনাম রোকেয়া।আপনার স্বামীর নাম হচ্ছে রকিব আহমেদ, তাই না? জ্বি।সাধারণত স্বামীর পদবী মেয়েরা ব্যবহার করে থাকেন, যেমন আপনার নাম হত রোকেয়া আহমেদ। আপনি তা করছেন না, বাবার নামটাই আপনার বহাল আছে—এর কারণ কি? পুষ্প জবাব দিল না। মিশ্ৰবাবু জবাবের জন্যে তেমন অপেক্ষাও করলেন না। দ্রুত অন্য প্রশ্নে চলে গেলেন।আপনি স্বামীর নাম ব্যবহার করতে চান না, তার কারণ সম্ভবত স্বামীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভালো নয়।সম্পর্ক ভালো।আপনার স্বামী কি কোর্টে উপস্থিত আছেন?

জ্বি-না।স্ত্রীর এত বড় একটি কেইসের ট্রায়াল চলছে, অথচ স্বামী উপস্থিত নেই এটা কি ভালো সম্পর্কের কোনো উদাহরণ? কোর্টে বড় রকমের হাসির শব্দ উঠল। পুষ্প অসহায়ভাবে তাকাল নিশাতের দিকে। তার পরই সহজ গলায় বলল, আমাদের একটা খুব ছোট বাচ্চা আছে। আমার স্বামী তার দেখাশোনা করছেন। বাচ্চাটার আজ জ্বর। এক শ দুই জ্বর।আপনি কি আসামীকে চেনেন? জ্বি। আমার স্বামীর বন্ধু।কী রকম বন্ধু। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু কি? জ্বি।আপনার স্বামী দুবার আসামীর কাছ থেকে অর্থসাহায্য নিয়েছেন, এটা কি আপনি জানেন?

জ্বি-না।করিম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তিনি অবজেকশন দিতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু না-দিয়ে বসে পড়লেন। তিনি বলতে চাচ্ছিলেন অর্থসাহায্য যে করা হয়েছে তার কোন প্রমাণ নেই। করিম সাহেব তা বললেন না। কারণ মিশ্রবাবু অতি ধুরন্ধর লোক, বিনা প্রমাণে এই প্ৰসঙ্গ কোর্টে তুলবেন না।অর্থসাহায্য ছাড়াও আপনারা বিভিন্ন সময়ে আসামীর কাছ থেকে নানান সাহায্য নিয়েছেন। আসামী আপনাদের জন্যে বাড়ি ঠিক করে দিয়েছিলেন, তাই না?

জি।আপনাদের ভ্রমণের জন্যে তিনি গাড়ি এবং ড্রাইভার দিতেন।এক দিন দিয়েছিলেন।এখন বলুন, আসামী মিজান মাঝে-মাঝে দুপুরবেলায় আপনাদের বাসায় যেতেন, একটু আগেই এ-কথা বলেছেন আপনি। তাই না? জ্বি। স্বামীর অনুপস্থিতিতে যে উনি আপনার বাসায় আসতেন, আপনার স্বামী কি তা জানতেন? জ্বি, জানতেন।তিনি এটাকে বিশেষ কিছু মনে করেন নি, তাই না? জ্বি।তিনি ইচ্ছে করে আপনাদের এই মেলামেশায় সুযোগ দিচ্ছিলেন।জ্বি-না।আপনার একটি ছোট্ট ছেলে আছে পল্টু তার নাম, তাই না? জ্বি।ঘটনার দিন পল্টু কোথায় ছিল?

নিশাত আপার বাসায়।আমি যদি বলি আপনি স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে যৌন-মিলনের সুবিধার কারণে আপনার ছেলেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, তা হলে আপনি কি বলবেন?পুষ্প হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মিশ্রবাবু বিজয়ীর দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাচ্ছেন। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তাঁর এই দীর্ঘ জেরার মূল উদ্দেশ্যই ছিল মেয়েটিকে কাঁদিয়ে দেওয়া। নিশাত বিড়বিড় করে বলল, লোকটা এসব কী বলছে? এত নোংরা কথা সে কী করে বলছে? জহির তার দিকে তাকিয়ে বলল, আরো হয়তো কত কী বলবে! মনে হচ্ছে এটা মাত্ৰ শুরু। তবলার ঠুকঠাক।

পুষ্পর কান্না তখন পুরোপুরি থামে নি। সে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে উঠছে। এর মধ্যেই আবেগশূন্য গলায় মিশ্রবাবু তাঁর ডিফেন্স পেশ করলেন, এই মামলায় দীর্ঘ ক্রস একজামিনেশন বা প্রচুর সাক্ষ্য-প্রমাণের কোনো প্রয়োজন দেখছি না। ডাক্তারের দেওয়া মেডিকেল রিপোর্টই যথেষ্ট মনে করি। সেখানে বলা হয়েছে কোনন সিমেন পাওয়া যায় নি। ধর্ষণের সময় ভিকটিম সাধারণত প্রবল বাধা দেয়, সে-কারণে তার শরীরে নানান ক্ষত থাকে, তাও নেই। মামলা ডিসমিসের জন্যে এই যথেষ্ট। তবুও ঘটনাটা কী আমি বলছি। বিশ্বাস না-করলেও মামলার ক্ষতি হবে না। তবে ঘটনাটি বিশ্বাসযোগ্য, তা আপনারা সবাই স্বীকার করবেন।

এই সমাজে কিছু-কিছু লোক তাদের সুন্দরী স্ত্রীদের ব্যবহার করে কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধার জন্যে। রকিব সেই রকম একজন মানুষ। সে ক্রমাগত তার ধনী বন্ধুর কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে এবং ইন রিটার্ন এগিয়ে দিচ্ছে সুন্দরী স্ত্রীকে। স্ত্রীও স্বামীর কথামতোই কাজ করছেন। মিলনের ক্ষেত্র তৈরি করবার জন্যে পুত্ৰকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি মহিলার প্রতি কৃতজ্ঞ যে পুত্রের সামনে বৃন্দাবন লীলা না দেখানোর মতো সুবুদ্ধি তাঁর হয়েছে।

কোর্ট সেদিনকার মতো অ্যাডজর্নড হয়ে গেল। নিশাত চোখে অন্ধকার দেখল। এ তো ভরাড়ুবি! সরদার এ করিম কোর্ট অ্যাডজর্নড হবার সঙ্গে-সঙ্গেই চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কী হবে এ নিয়ে সে কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারল না। পুষ্প ক্রমাগত কাঁদছে। তাকে সামলাননও এক মুশকিল। লোকজনের কৌতূহলেরও কোন সীমা নেই। এক ফটোগ্রাফার বিশেষ অ্যাংগেল থেকে পুষ্পর কান্নার ছবি তোলবার চেষ্টা করছে। ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসাও মুশকিল। নিশাতের নিজেরও কান্না পেয়ে গেল।

আজ আসামীর ক্রস একজামামিনেশন হবে।আসামী কাঠগড়ায় উপস্থিত।সরদার এ. করিম এগিয়ে গেলেন।আপনার নাম মিজানুর রহমান? জ্বি।পুষ্প নামের মেয়েটিকে আপনি চেনেন? জ্বি চিনি।সে যে অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে করেছে সেই সম্পর্কে আপনি কী বলতে চান? অভিযোগ সত্যি নয়।আমার জেরা শেষ হয়েছে। আপনি নেমে যেতে পারেন। এখন আমি আমার বক্তব্য পেশ করব।মিজান অবাক হয়ে তাকাল। জজসাহেব তাকালেন। কোর্টে মৃদু একটা গুঞ্জন হল। করিম সাহেব সুবার বিস্ময় উপভোগ করলেন। নিশাতের দিকে তাকিয়ে হাসির মতো ভঙ্গি করলেন। ইচ্ছে করেই এই নাটকীয়তা তিনি করছেন। এতে সবার মনোযোগ খুবই তীব্রভাবে তিনি আকর্ষণ করতে পারলেন। এর প্রয়োজন ছিল।

মাননীয় আদালত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আমি এখানে একটি দুর্বল মামলা পরিচালনা করতে এসেছি। আমার মক্কেলের মেডিকেল রিপোর্টে কিছু পাওয়া যায় নি। কোন প্রত্যক্ষদশীর সাক্ষ্য আমরা জোগাড় করতে পারি নি।আপনাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, এ-দেশের ধর্ষিতা মেয়েদের মেডিকেল রিপোর্টে কখনো কিছু পাওয়া যায় না। ধর্ষিতা মেয়েরা প্রথমে যে কাজটি করেন তা হচ্ছে ধর্ষণের সমস্ত চিহ্ন শরীর থেকে মুছে ফেলেন। অনেক বার করে স্নান করেন। গায়ে সাবান ঘষেন। কারণ তাঁদের ধারণা নেই যে, এটা করা যাবে না। এটা করলে আসামীকে আমরা আইনের জালে আটকাতে পারব না।

আসামীকে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে আরেকটি বড় বাধা সামাজিক বাধা। এই লজ্জা এবং অপমানের বোঝ কোনো মেয়ে সাহস করে নিতে চায় না। যখন কেউ সাহস করে, তখন কোর্ট তাকে মোটামুটিভাবে ব্যাভিচারিণী হিসেবে প্রমাণ করে দেয়। আমার মক্কেলের ব্যাপারেও সেটা ঘটেছে। তবে আমার মক্কেল শেষ পর্যন্ত কোনে মামলা নিয়ে আসতে পেরেছে, এটা তার জন্যে একটা বড় বিজয়। অনেকেই তা পারে না। তাদের মামলা তুলে নিতে হয়। যেমন মামলা তুলে নিতে হয়েছিল ২১-বাই-বি ঝিকাতলার আশরাফী খানমকে।আশরাফী খানম আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ৫ই এপ্রিল ১৯৭৬ তারিখে মোহাম্মদপুর থানায় ডাইরি করিয়েছিলেন।

সেই ডাইরিতে উল্লেখ আছে যে জনৈক মিজানুর রহমান তাঁকে ধর্ষণ করে। যথারীতি পুলিশ তদন্ত হয়। তবে তদন্তের মাঝামাঝি ফরিয়াদী পক্ষ কেইস উঠিয়ে নেয়। হয়তোবা আমি বলতে পারি কেইস উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়। যদি সেদিন সে তা উঠিয়ে না নিত তা হলে আজ এই মেয়েটি ধর্ষিতা হত না।মাননীয় আদালতের কাছে আমি জানতে চাচ্ছি আমরা কি তৃতীয় একটি মেয়েকে ধর্ষিতা হবার ক্ষেত্র প্রস্তুত রাখব নাকি রাখব না।আমার বক্তব্য এই পর্যন্তই। আশরাফী খানম মোহাম্মদপুর থানায় যে-জবানবন্দি দিয়েছিলেন তার কপি আমি আদালতে পেশ করেছি।করিম সাহেব বসে পড়লেন। দীর্ঘ সময় আদালতে কোন সাড়াশব্দ হল না। এ. করিম সাহেব নিশাতের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, আমার তো ধারণা আমরা কেইস জিতে গেছি। আপনার কি তাই মনে হচ্ছে না?

নিশাত খুব কাঁদছে। জহির অবাক হয়ে বলল, তুমি এত কাঁদছ কেন? মামলা তো জিতে গেলে একটা লোককে সারা জীবনের জন্যে জেলে পাঠিয়ে দিলে। আজ তো তোমার আনন্দ করার দিন। ব্যাপারটা কি বল তো? ব্যাপারটা নিশাত বলতে পারল না। কারণ তা বলার মতো নয়। একই ঘটনা তার জীবনেও ঘটেছিল। সে তখন মাত্র কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। বড় দুলাভাই এক দুপুরবেলা তার ঘরে ঢুকে পড়লেন। কী লজ্জা, কী অপমান, কাকে সে বলবে? মীরু আপাকে? মাকে? বাবাকে? কাউকেই সে বলে নি। বলতে পারে নি। আজো পারবে না।

তবে আজ সে মুক্তি পেয়েছে। মনের একটা বিরাট দরজা এত দিন বন্ধ ছিল। আজ খুলে গেছে। এক ঝলক সূর্যের আলো ঢুকে গেছে। আজ সে কাঁদছে আলোর স্পর্শে।*

*উপন্যাসে বর্ণিত প্রতিটি চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক।

 

Read more

নন্দিত নরকে পর্ব:০১ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *