ফুলচোর পর্ব:৭ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

ফুলচোর পর্ব:৭

ফুলচোর পর্ব:৭

কথাটা ভেবে দেখার মতো। বাস্তবিকই তো আমি চোর ধরার জন্য লুকোইনি, লুকিয়েছি চোরেরই ভয়ে। কিন্তু সেটা কবুল করি কী করে? এ চোরও আলাদা ধাতের। কোথায় আমি চোরকে জেরা করব, তা নয় চোরই উল্টে আমার নিকেশ নিচ্ছে। আমি একটু দুর্বল গলায় বলি, কথাটা ঠিক, আপনি পালান না। তার মানে, হয়তো আমার কাকা কাকিমার সঙ্গে আপনার চেনা আছে।বাব্বাঃ, ভীষণ বুদ্ধি তো আপনার। এতই যদি বুদ্ধি তবে বলুন লুকোলেন কেন? সেটা বলা শক্ত। হঠাৎ আপনাকে দেখে কেন যেন লুকোতে ইচ্ছে হল।ফুলচোর হি হি করে হাসে। বলে, সাধে কি লোকে নাম দিয়েছে পাগলা দাশু!আমি কথাটা শুনি না শুনি না করে পাশ কাটিয়ে বলি, আজ কী চুরি করবেন? দেখুন, বাগানটার দুর্দশা!আপনার সাজানো বাগান কি শুকিয়ে গেল?- ফুলচোর এখনও হাসছে।

একটা বড় শ্বাস হঠাৎ বেরিয়ে যায় বুক থেকে। জবাব দিই না। কোনও জবাব মাথায় আসছেও না। ফাজিল মেয়েদের সঙ্গে টক্কর দিতে যাওয়াটাই বোকামি।ফুলচোর গলা একটু মাখো মাখো করে বলে, গান শেখা ছেড়েছেন, ফুটবলের মাঠে যান না, সাইকেলেও চড়তে দেখা যায় না আজকাল, আপনার কী হয়েছে বলুন তো!আমি ফুলচোরের ব্যবহারে খুবই অবাক হয়েছি আজ! তবে কি ফুলচোর আমার প্রেমে পড়েছে। এই ভোরে সেই ভালবাসাই জানাতে এল। আমার মাথার ভিতরে হঠাৎ পশুপতির গলার স্বর প্রম্পট করতে থাকে, বলে ফেলুন! বলে ফেলুন! ভালবাসা একেবারে ছানার মতো ছেড়ে যাবে। কিন্তু কিছুই বলার নেই আমার। ফুলচোরের বাবাকে আমি টাকা ধার দিইনি। ওর বাবা কে তাই জানি না। পশুপতি ভুল পার্ট প্রম্পট করছে।

আমি গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বললাম, আজ আপনি ফুল চুরি করতে আসেননি।তবে কী করতে এসেছি? আপনার অন্য মতলব আছে।আছেই তো!আমার সম্পর্কে এত খবর আপনাকে কে দিল? খবর জোগাড় করতে হয়।কেন জোগাড় করতে হচ্ছে? আমার মতলব আছে যে।আপনি একটু বেশিরকম ডেসপারেট।সেটাও সবাই বলে। নতুন কথা কিছু আছে?- ফুলচোর মুখে ভালমানুষি মাখিয়ে বলে।আছে। আমি গভীর ভাবে বলি, এর আগে আপনাকে আমি কোথাও দেখেছি।ফুলচোর হি হি করে হেসে বলে, আমারও তাই মনে হয়,জানেন! মনে হয় যেন, কত কালের চেনা।আমার গা জ্বলে যায়। বলি, কী বলতে এসেছেন বলুন তো! রাগ করলেন?

না, সাবধান হচ্ছি। আমার কাকা কাকিমাও আরলি রাইজার। যে কোনও সময়ে এদিকে এসে পড়তে পারেন।ও বাবা!বলে ফুলচোর চকিতে একবার চারদিক দেখে নেয়। এখনও যথেষ্ট আলো ফোটেনি। আবছা আলোর মধ্যে এখনও ভুতুড়ে দেখাচ্ছে গাছপালা, ঘরবাড়ি। ফুলচোর আমার দিকে আবার মুখ ফিরিয়ে বলে, লিচুর সঙ্গে কি আপনার ঝগড়া হয়েছে?

তা দিয়ে আপনার কী দরকার? লিচু ভীষণ কাঁদছে যে।কাঁদছে! কেন কাঁদছে? তার আমি কী জানি? পাড়ার লোকে বলছে, আপনার সঙ্গে নাকি ওর ভাব ছিল।মোটেই নয়। ফুলচোর আচমকা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ন্যাপথালিন খেলে কি লোকে মরে? আমি জানি না। কেন? লিচু ন্যাপথালিন খেয়ে মরার চেষ্টা করেছিল। হাসপাতালে পর্যন্ত নিতে হয়।উদ্বেগের সঙ্গে আমি জিজ্ঞেস করি, বেঁচে আছে তো! আছে। কিছু হয়নি। বেশি খায়ওনি। হাসপাতালে পেটে নল ঢুকিয়ে সব বের করে দিয়েছে।মরতে চেয়েছিল কেন?

বোধহয় আপনার জন্য। অবশ্য ভেঙে কিছু বলছে না।আমি একটু রেগে গিয়ে বলি, এতক্ষণ ইয়ার্কি না করে এই সিরিয়াস খবরটা অনেক আগেই আপনার দেওয়া উচিত ছিল।আপনার সঙ্গে যে আমার ইয়ার্কিরও একটা সম্পর্ক আছে।তার মানে? পালাই, আপনার অত ভয়ের কিছু নেই। লিচু ভাল আছে।কিন্তু ইয়ার্কির সম্পর্ক না কী যেন বলছিলেন।না, বলছিলাম যে, আমি ভীষণ ইয়ার্কি করি। বাড়িতে তার জন্য অনেক বকুনিও খাই। বলে ফুলচোর আবার হি হি করে হাসে। তারপর বলে, লিচু কিন্তু খুব কাঁদছে।তার আমি কী করতে পারি? আপনি কি ওকে রিফিউজ করেছেন?

রিফিউজের প্রশ্ন ওঠে না। ফর ইয়োর ইনফর্মেশন, আমি একজনকে অলরেডি ভালবাসি! তাই বলুন। বাব্বা! ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।কেন? আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম, আপনি লিচুকেই বুঝি বিয়ে করবেন।বিয়ে অত সস্তা নয়।আপনার লাভার কি কলকাতার মেয়ে? হ্যাঁ।খুব স্মার্ট? তা জেনে কী হবে? বলুন না। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে।স্মার্ট বটে, তবে আপনার মতো নয়।

দেখতে? তাও আপনার মতো নয়। রূপটাই কি সব? সে অবশ্য ঠিক। গায়ের রং কেমন? খুব ফরসা? না। শ্যামলা। আপনার পাশে দাঁড়ালে কালোই বলবে লোকে।লম্বা? লম্বা আপনার মতো নয়। অ্যাভারেজ।রোগা? হ্যাঁ, বেশ রোগা।বোধ হয় পড়াশুনোয় ব্রিলিয়ান্ট? একদম নয়। তবে গ্র্যাজুয়েট।বয়স? আমার প্রায় সমান। আপনার তুলনায় বুড়ি।বারবার আমার সঙ্গে তুলনা দিচ্ছেন কেন? খুশি করার জন্য! মেয়েরা অন্য মেয়েদের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দেখতে ভালবাসে।আচ্ছা, আচ্ছা। এবার বলুন তার নাম কী? সায়ন্তনী। আপনার নামটা কি তার চেয়ে ভাল?

চালাকি করে নাম জেনে নেবেন, আমি তত বোকা নই।নামটা বলতে দোষ কী? চোরেরা নাম বলে না।না কি অন্য কোনও কারণ আছে? থাকতে পারে। সকাল হয়ে এল, আমি যাই! আবার কবে আসছেন? নিচু হয়ে ঝোপ পেরোতে পেরোতে এবার ফিরে তাকায় ফুলচোর। চাপা স্বরে বলে, এলে খুশি হবেন? বোধ হয় খারাপ লাগবে না। আজ তো বেশ লাগল।ফুলচোর হি হি করে হাসে, তাহলে আসব।বলে ঝোপটা জোর পায়ে পেরিয়ে চলে গেল ফুলচোর। ওকে বলা হল না যে, সব কথা আমি সত্যি বলিনি। কী করে বলব? সায়ন্তনীর চেহারাটা আমার মনে পড়ছে না যে।আজ দুপুরে হাউহাউ করে হঠাৎ পপির জন্য খানিকটা কাঁদলাম।

দুপুরে এক বারনাচওলাকে ধরে এনেছিল বাঁটুল, দড়ি বাঁধা দুটো বাদর ডুগডুগির তালে নাচল, ডিগবাজি খেল, পরম্পরকে পছন্দ করল, বিয়ে করল। খেলার ফাঁকে ফাঁকে পুটুর পুটুর চেয়ে দেখল ভিড়ের মানুষদের। বসে বসে আমাদের দেওয়া কলা ছাড়িয়ে খেল।বড় কষ্ট বাঁদরগুলোর। খেলা দেখতে দেখতে অবোলা জীবের কষ্টেযখন বুকে মোচড় দিল একটু তখনই পপির কথাও মনে পড়ে গেল। কাজল-পরানো মায়াবী একজোড়া চোখ ছিল পপির। কী মায়া ছিল ওর দৃষ্টিতে! তাকিয়ে থাকত ঠিক যেন আনজনের মতো। কথাটাই শুধু বলত না, কিন্তু আর সবই বোঝাতে পারত হাবেভাবে। এসব মনে পড়তেই বুকের মোচড় দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। ঘরে গিয়ে কাঁদতে বসলাম।

কাঁদতে যে কী সুখ! কাঁদতে কাঁদতে পপিকে ছেড়ে আরও কত কী ভাবতে ভাবতে আরও কাঁদতে থাকি।গতবারই কলকাতায় একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়ে গেল। ভৈরবকাকার সঙ্গে মা আর আমরা ভাইবোনেরা মামাবাড়ি বেড়াতে গেলাম। মার বাপের বাড়ি যাওয়া আর সেই সঙ্গে কলকাতা থেকে পুজোর বাজার করে আনা, দুই-ই হবে। মামারা কেউ এক জায়গায় থাকে না। তাছাড়া কারওরই বাসা খুব বড় নয়। ফলে আমরা এক এক বাসায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লাম। আমাকে নিয়ে গেল হাতিবাগানের বড়মামা।

বলতে কী মামাবাড়িতে আমাদের বড় একটা যাওয়া হয় না। কলকাতা শহরটা আমাদের কাছে বড় ভয়ের। সে এক সাংঘাতিক ভিড়ে ভরা শহর। মাথা গুলিয়ে দেওয়া ধাঁধার মতো রাস্তাঘাট। তার ওপর আত্মীয়দের কারও বাড়িতেই হাত পা ছড়িয়ে থাকার মতো জায়গা হয় না! আমরা সেখানে গেলে একা বেরোতে পারি না, রাস্তা পেরোতে বুক ঢিপ ঢিপ করে। ফলে আমরা কলকাতায় কালেভদ্রে যাই। হয়তো নিচার বা পাঁচ বছর পর। ততদিনে কলকাতার আত্মীয়দের সঙ্গে আবার একটু অচেনার পর্দা পড়ে যায়।

বড়মামার মেয়ে মঞ্জু আমার বয়সী, ছেলে শঙ্কু তিন-চার বছরের বড়। সেই বাড়িতে পা দিতে না দিতেই আমি টের পেলাম আমার মামাতো দাদা শঙ্কর মাথা আমি ঘুরিয়ে দিয়েছি। বলতে নেই, ব্যাপারটা আমি উপভোগই করেছিলাম। কাছাকাছি একটা কাঁচা বয়সের ছেলে রয়েছে, অথচ আমাকে দেখে সে হাঁ করে চেয়ে থাকছে না, নিজের কেরানি দেখানোর জন্য নানা বোকা-বোকা কাণ্ড করছে না বা নিজের কৃতিত্বের কথা বলতে গিয়ে আগডুম বাগড়ম বকছে না–সেটা আমার অহংকারে লাগে।

তবু হয়তো আমার সাবধান হওয়া উচিত ছিল। একে তো আমার বিয়ে একজনের সঙ্গে পাকা হয়ে আছে, তার ওপর শঙ্কুদা আমার আপন মামাতো ভাই। কিন্তু বয়সটাই এমন যে, আত্মীয়তার বেড়া বাঁধ মানতে চায় না। যাতায়াত কম বলে আত্মীয়তাটা তেমন জোরালোও হয়ে ওঠেনি। ভাই বোন বলে জানি, কিন্তু সেরকম কিছু একটা দায়িত্ব বোধ করি না। আরও একটা কথা আছে। সেটা হল কিছু কিছু মানুষ বোধ হয় এরকম অসামাজিক, বাঁধভাঙা কাণ্ড করতে বেশি আনন্দ পায়।লম্বার ওপর শঙ্কুদার চেহারাটা খারাপ নয়। একটু মস্তানের মতো হাবভাব। এ জি বেঙ্গলে সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে এবং বিয়ে-টিয়ের কথাও ভাবছে। দ্বিতীয় দিন অফিস থেকে ফিরেই আমাকে বলল, সাত দিনের ছুটি নিলাম। তোকে কলকাতা শহরটা খুব ঘুরিয়ে দেখাব বলে।

আমি মুখেও হাসলাম, মনে মনেও হাসলাম। দুটো অবশ্য দু’রকম হাসি মুখে বললাম, খুব ভাল করেছ। কলকাতাকে যা ভয় আমার। মনে মনে বললাম, সব জানি গো, সব বুঝি! ছেলে নতুন চাকরিতে ঢুকে ছুটি নেওয়ায় মামা মামি খুশি হননি তা তাদের মুখ দেখেই বুঝলাম। মধু তো মুখের ওপরেই বলল, তোকে দরকার কী? কলকাতা তো কাটুকে আমিই দেখাতে পারি।কিন্তু শুধু আমিই মাঝে মাঝে টের পাচ্ছিলাম কলকাতা দেখানো না হাতি!শঙ্কুদ পরদিনই গুচ্ছের ট্যাকসি ভাড়া দিয়ে আমাকে আর মঞ্জুকে নিয়ে গিয়ে পার্ক স্ট্রিট দেখাল, রেস্টুরেন্টে খাওয়াল, সিনেমায় নিয়ে গেল। মঞ্জু বারবার আমার কানে কানে বলছিল, ইস্! কী পরিমাণ টাকা ওড়াতে দেখেছিস!

শুনে আমার একটু লজ্জা হল। বেচারা শকুদা! এখন তো ওর মাথার ঠিক নেই। পরদিনই বাড়িশুদ্ধু সবাইকে স্টারে থিয়েটার দেখাল। মামি বলল, যাক, কাটুর কল্যাণে শঙ্কুর পয়সায় থিয়েটার দেখা গেল।এমনি দু’-তিন দিন যাওয়ার পরই বাড়ির লোক কিছু ক্লান্তি বোধ করে ক্ষ্যামা দিল। তখন শঙ্কুদা আমাকে নিয়ে একা বেড়াতে বেরোল। চার দিনের দিন ট্যাকসিতে আমার হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, পুজোর আগে কিন্তু ছাড়ছি না। কলকাতার পুজো দেখে যাও এবার।তুই থেকে তুমিতে প্রোমোশন পেয়ে আমি আবার মুখে আর মনে দু’রকম হাসি হাসলাম। বললাম, যাঃ, তাই হয় নাকি?

কেন হবে না? ইচ্ছে থাকলেই হয়। আমি পিসিকে বলে পারমিশন নেব।মা আমাকে রেখে যাবেই না।খুব যাবে।উঁহু। পুজোর পরেই আমার পরীক্ষা।পরীক্ষা-টরিক্ষা রাখো তো। পুজোর পর কেন, সারা জীবনই যদি আর যেতে না দিই? কথাটা বড় সোজাসুজি বলে ফেলে বোধ হয় নিজেই ঘাবড়ে গিয়েছিল শঙ্কুদা। তাড়াতাড়ি বলল, সাবিরের রেজালা খেয়েছ? চলো আজ খাওয়াব।বাঁধ ভাঙতে আমার খারাপ লাগে না। কিন্তু তার একটা মাত্রা আছে। দিন পাঁচেকের মধ্যেই বুবলাম, শহুদাকে একটু বেশি প্রশ্রয় দিয়ে আমি বিপদ ডেকে এনেছি। ভাড়াটে বাড়ির ছাদে ওঠার এজমালি সিঁড়িতে শম্ভুদা আমাকে সেদিন চুমু খাওয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। দু’ দিনের দিন সকালে ওর ঘোর লাল চোখ দেখে বুঝলাম, সারা রাত ঘুমোয়নি। আমার কথা ভেবেছে।

বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছিল। পুরুষরা জন্মসূত্রেই বোকা, মেয়েরা তো তা নয়। আমি সাবধান হই। মামাকে সেদিনই বললাম, আজ খিদিরপুরে মেজোমামার বাড়িতে যাব। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মামার মাথায় তো ঘোরপ্যাঁচ নেই। বলল, তা আমার তো অফিস, তোকে বরং শঙ্কু গিয়ে রেখে আসুক। প্রস্তাব শুনে শদা আমার দিকে নিস্পলক অদ্ভুত পাগলা দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ঠিক আছে, বিকেলে নিয়ে যাব। বলেই বেরিয়ে গেল। দুপুরে বেশ দেরিতে ফিরে এসেই বলল, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।আমি তৈরিই ছিলাম। ভাত খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। রাস্তায় পা দিয়েই শঙ্কুদা বলল, কাটু, আমাকে বিট্রে করবে না তো? তাহলে কিন্তু মারা যাব।

বলতে নেই, আমি বুদ্ধিমতী। ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, এখন যদি কোনও কড়া কথা বলি তাহলে একদম খেপে যাবে। তাই মুখে হাসি মাখিয়ে বললাম, তুমি এরকম করছ কেন বলো তো! আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি।আমেরিকার ছেলেটাকে চিঠি লিখে দাও যে, তুমি তাকে বিয়ে করবে না।আমার বুক তখন ধুকপুক করছে। বললাম, ওরম কোরো না। তোমাকে ভীষণ অন্যরকম দেখাচ্ছে।পুরুষেরা বোকা বটে, কিন্তু কখনও-সখনও ভারী বিপজ্জনকও। বিশেষ করে প্রেমট্রেমে পড়লে। সেটা বুঝলাম যখন আমাদের ট্যাক্সি খিদিরপুরে না গিয়ে বিচিত্র সব পথে চলতে লাগল।

শঙ্কু পাগলের মতো কখনও আমার হাত চেপে ধরে, কখনও কাঁধে হাত রেখে, কখনও গলা পেচিয়ে ধরে কেবল ভালবাসার কথা বলে যেতে লাগল। সেদিন শঙ্কুদার সব বাঁধ ভেঙে গেছে, কোনও আত্রু নেই, লুকোছাপা নেই, লজ্জা নেই, ভয় ভীতি নেই। বলে, বিশ্বাস করো আমার মা বাবা কিছু মনে করবে না..আমি আলাদা বাসা করব…বিয়ে করেই দ্যাখো, প্রথমে একটু সবাই হয়তো রাগ টাগ করবে, কিন্তু দু’দিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে…কলকাতায় এরকম ভাইবোনে কত বিয়ে হয়, এটাই আজকাল ফ্যাশান…আমি আলাদা বাসা নেব, না হয় খুব দুরে বদলি হয়ে চলে যাব…

শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা। মাথা চক্কর দিচ্ছে। লজ্জাও হচ্ছিল খুব।ট্যাকসিতেই অবশ্য শেষ হয়নি। ট্যাকসিওয়ালা স্পষ্টই সব শুনছে।আমরা ময়দানে বসলাম, রেস্টুরেন্টেও খেলাম, রাস্তাতেও হটলাম।বেলা পড়ে এলে বললাম, শঙ্কুদা, এবার আমাকে দিয়ে এসো। আমি না গেলে মা আর ভৈরবকাকা পুজোর বাজার করতে বেরোবে না।ও! পুজোর বাজার এখন রাখো। তার আগে আমাদের বিয়ের বাজার তো হোক।শঙ্কুদা সত্যিই নিউ মার্কেটে নিয়ে গিয়ে আমাকে একটা দেড়শো টাকার শাড়ি কিনে দিল জোর করে। এত খারাপ লাগছিল কী বলব।সন্ধে হয়ে এল, তবু শঙ্কদা আমাকে রেখে আসার নাম করে না। বরং বলল, চলো, একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। এক জায়গায় আমার বন্ধুরা আসবে।

আমি ভয়ে কেঁপে উঠে বললাম, না না।চলো না। তারপর ঠিক রেখে আসব।

ডাক ছেড়ে তখন আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। শঙ্কুদা যত পাগলামি করছে তত ওর ওপর বিতৃষ্ণা আসছে আমার। পারলে তখন ছুটে পালাই। কিন্তু চারদিকেই তো বিপজ্জনক অচেনা কলকাতা। কোথায় যাব? ধর্মতলার কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে সত্যিই নিয়ে গেল আমাকে শঙ্কুদা। সেখানে পাঁচ-ছ’জন ছোকরা বসে আছে। শঙ্কুদা আমাকে তাদের সামনে হাজির করে বলল, এই আমার ভাবী ওয়াইফ। তারপরই একটু হেসে বলল, ভাবীও নয়। শুধু ওয়াইফ!আমার কান মুখ ঝা ঝা করছে এখন। রাগে দুঃখে ছিঁড়ে যাচ্ছে বুক। কিন্তু অত লোকের সামনে কী করব? হেসে বরং ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

কথাটথাও বলতে হল। বন্ধুগুলো খারাপ নয়! তবে এক-আধজন একটু মোটা ইঙ্গিত করছিল। আমি তাদের মুখের দিকে ভাল করে তাকাতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছি বন্ধুদের কাছে আমাকে নিজের বউ পরিচয় দিয়ে শঙ্কুদা আমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। সাক্ষী রাখতে চাইছে। বেঁধে ফেলতে চাইছে।একবার পালাতে পারলে জীবনে আর কোনওদিন ওর ছায়া মাড়াব না, মনে মনে তখন ঠিক করেছি। তাই দাতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে যাচ্ছিলাম। জানি, আর একটু পরেই মুক্তি পাব।কিন্তু খুব ভুল ভেবেছিলাম! আমি মাঝে মাঝে তাড়া দিচ্ছিলাম।

তবু বন্ধুদের সঙ্গে অনেক রাত করে ফেলল শকুদা।রাত ন’টা নাগাদ বন্ধুদের বিদায় দিয়ে শঙ্কুদা রাস্তায় নেমে বলল, এত রাতে আর কোথায় যাবে কাটু?আমি চমকে উঠে বলি, তার মানে? এখন বাস ট্রামের অবস্থা খুব খারাপ! ট্যাকসিও খিদিরপুর যেতে চাইবে না।তাহলে? শঙ্কুদা হেসে বললে, আমাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারো, কিন্তু সেটা হয়তো খারাপ দেখাবে।তুমি কী বলতে চাইছ?ভয় পেয়ো না কাটু। আমি একটা খুব ভাল পথ ভেবে বের করেছি। আজকের রাতটা আমরা একটা হোটেলে কাটাব।শুনে আতঙ্কে কেমন হাত পা ছেড়ে দিল আমার। বুক ঠেলে কান্না এল। কোনও বাধা মলিন। সেই কান্না আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললাম, এব তুমি কী বল?

শঙ্কুদা অনেক সান্ত্বনা দিচ্ছিল, ক্ষমা চাইছিল। বলল, বুঝছ না কেন, কেউ টের পাবে না। রং এত রাতে কোনও বাড়িতে গিয়ে উঠলেই সন্দেহ করবে বেশি। কোনও ভয় নেই।পুরুষরা যখন পাগল হয় তখন বেকামির মধ্যেও তাদের শয়তানি বুদ্ধি কাজ করে। আমার তখন পাগলের মতো এলোমেলো মাথা। তবু আমি বুঝতে পারলাম, আমি যে ওকে কাটাতে চাইছি তা ও বুঝতে পেরেছে। তাই আমাকে এটো করে রাখতে চায়, যাতে আমি বাধ্য হই মাথা নোয়াতে।কোথায় সেই হোটেলটা ছিল তা আমি আজও বলতে পারব না। তবে কলকাতার মাঝামাঝি কোথাও। হোটেলটার নামও আমি লক্ষ করিনি। কিছুই লক্ষ করার মতো অবস্থা নয়।

তবে মনে হচ্ছিল, আগে থেকেই বন্দোবস্ত করা ছিল সব।দোতলার একটা ছোট ঘরে আমাকে নিয়ে তুলল শকুদা। সে ঘরে একটা মাত্র অবল খাটের বিছানা। টেবিলে দুজনের খাবার দিয়ে গেল বেয়ারা, কিছু না বলতেই। শসা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ঘাবড়ে যেয়ো না। ওসব কিছুই কেউ জানবে না। তুমি হাতমুখ ধুয়ে এসো।বিপদের অনুভূতির প্রথম প্রবল ভাবটা কেটে গেল তখন। বাথরুমে গিয়ে আমি অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলাম। মাথা বশে এল একটু। বুকে ঢিপিঢিপিনি কমে গেল।মানুষের মনে কত কী থাকে তার হিসেব নেই। সেই হোটেলের ঘরে আবার যখন কছিলাম তখন খুব খারাপ লাগল না। বরং মনে হল, দোষ কী? কে জানবে? আমার জীবনটা বড় বাধা পথে চলছে। একটু এদিক ওদিক তোক না।

এমনকী আমি তখন ভাতও খেতে পারলাম। হয়তো খাওয়ার পর বিছানাতেও চলে যেতাম কিছু পরে।কিন্তু শঙ্কুদা যখন দরজার ছিটকিনি তুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, তখন সমস্ত প্রতিটা কেটে গেল।ছেলেদের মুখে ওরকম কাঙালপনা দেখতে আমার এমন ঘেন্না হয়।শঙ্কুদা আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতে এসে ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেল।কেন নয় কাটু? একটুখানি। একবার। কেউ জানবে না।তা হয় না। মেয়েরা ও জিনিসটা এত সহজে দিতে পারে না।প্লিজ কাটু। আজ থেকে তুমি তো আমার স্ত্রী।

 

Read more

ফুলচোর পর্ব:৮ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *