ফেল-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ফেল-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ল্যাজা এবং মুড়া, রাহু এবং কেতু, পরস্পরের সঙ্গে আড়াআড়ি করিলে যেমন দেখিতে হইত এও ঠিক সেইরকম। প্রাচীন হালদার-বংশ দুই খণ্ডে পৃথক হইয়া প্রকাণ্ড বসত-বাড়ির মাঝখানে এক ভিত্তি তুলিয়া পরস্পর পিঠাপিঠি করিয়া বসিয়া আছে; কেহ কাহারো মুখদর্শন করে না।

নবগোপালের ছেলে নলিন এবং ননীগোপালের ছেলে নন্দ একবংশজাত, একবয়সি, এক ইস্কুলে যায় এবং পারিবারিক বিদ্বেষ ও রেষারেষিতেও উভয়ের মধ্যে সম্পূর্ণ ঐক্য।

নলিনের বাপ নবগোপাল অত্যন্ত কড়া লোক। ছেলেকে হাঁপ ছাড়িতে দিতেন না, পড়াশুনা ছাড়া আর কথা ছিল না। খেলা খাদ্য ও সাজসজ্জা সম্বন্ধে ছেলের সর্বপ্রকার শখ তিনি খাতাপত্র ও ইস্কুল-বইয়ের নীচে চাপিয়া রাখিয়াছিলেন।

নন্দর বাপ ননীগোপালের শাসনপ্রণালী অত্যন্ত শিথিল ছিল। মা তাহাকে অত্যন্ত ফিট্‌ফাট্‌ করিয়া সাজাইয়া ইস্কুলে পাঠাইতেন, আনা-তিনেক জলপানিও সঙ্গে দিতেন; নন্দ ভাজা মসলা ও কুলপির বরফ, লাঠিম ও মার্বেলগুলিকা ইচ্ছামত ভোগবিতরণের দ্বারা যশস্বী হইয়া উঠিয়াছিল।

মনে মনে পরাভব অনুভব করিয়া নলিন কেবলই ভাবিত, নন্দর বাবা যদি আমার বাবা হইত এবং আমার বাবা যদি নন্দর পিতৃস্থান অধিকার করিত, তাহা হইলে নন্দকে মজা দেখাইয়া দিতাম।

কিন্তু, সেরূপ সুযোগ ঘটিবার পূর্বে ইতিমধ্যে নন্দ বৎসরে বৎসরে প্রাইজ পাইতে লাগিল, নলিন রিক্তহস্তে বাড়ি আসিয়া ইস্কুলের কর্তৃপক্ষদের নামে পক্ষপাতের অপবাদ দিতে লাগিল। বাপ তাহাকে অন্য ইস্কুলে দিলেন, বাড়িতে অন্য মাস্টার রাখিলেন, ঘুমের সময় হইতে একঘন্টা কাটিয়া পড়ার সময়ে যোগ করিলেন, কিন্তু ফলের তারতম্য হইল না। নন্দ পাশ করিতে করিতে বি. এ. উত্তীর্ণ হইয়া গেল, নলিন ফেল করিতে করিতে এন‌‌্‌ট্রান্‌‌স‌‌ ক্লাসে জাঁতিকলের ইঁদুরের মতো আটকা পড়িয়া রহিল।

এমন সময় তাহার পিতা তাহার প্রতি দয়া করিলেন। তিনি মরিলেন। তিন বৎসর মেয়াদ খাটিয়া এন‌‌্‌ট্রান্‌‌স‌‌ ক্লাস হইতে তাহার মুক্তি হইল এবং স্বাধীন নলিন আংটি, বোতাম, ঘড়ির-চেনে আদ্যোপান্ত ঝক্‌মক্‌ করিয়া নন্দকে নিরতিশয় নিষ্প্রভ করিয়া দিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। এন্‌ট্রান্স্-ফেলের জুড়ি চৌঘুড়ি, বি. এ. পাসের একঘোড়ার গাড়িকে অনায়াসে ছাড়াইয়া যাইতে লাগিল; বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ওয়েলারঘোড়ার সহিত সমান চালে চলিতে পারিল না।

এ দিকে নলিন এবং নন্দের বিবাহের জন্য পাত্রীর সন্ধান চলিতেছে। নলিনের প্রতিজ্ঞা, সে এমন কন্যা বিবাহ করিবে যাহার উপমা মেলা ভার, তাহার জুড়ি এবং তাহার স্ত্রীর কাছে নন্দকে হার মানিতেই হইবে।

সবচেয়ে ভালো জন্য যাহার আকাঙ্ক্ষা, অনেক ভালো তাহাকে পরিত্যাগ করিতে হয়। কাছাকাছি কোনো মেয়েকেই নলিন পছন্দ করিয়া খতম করিতে সাহস করিল না; পাছে আরো ভালো তাহাকে ফাঁকি দিয়া আর কাহারো ভাগ্যে জোটে।

অবশেষে খবর পাওয়া গেল, রাওলপিণ্ডিতে এক প্রবাসী বাঙালির এক পরমাসুন্দরী মেয়ে আছে। কাছের সুন্দরীর চেয়ে দূরের সুন্দরীকে বেশি লোভনীয় বলিয়া মনে হয়। নলিন মাতিয়া উঠিল, খরচপত্র দিয়া কন্যাকে কলিকাতায় আনানো হইল। কন্যাটি সুন্দরী বটে। নলিন কহিল, “যিনি যাই করুন, ফস্‌ করিয়া রাওলপিণ্ডি ছাড়াইয়া যাইবেন এমন সাধ্য কাহারো নাই। অন্তত এ কথা কেহ বলিতে পারিবেন না যে, এ মেয়ে তো আমরা পূর্বেই দেখিয়াছিলাম, পছন্দ হয় নাই বলিয়া সম্বন্ধ করি নাই।”

কথাবার্তা তো প্রায় একপ্রকার স্থির, পানপত্রের আয়োজন হইতেছে, এমন সময় একদিন প্রাতে দেখা গেল, ননীগোপালের বাড়ি হইতে বিচিত্র থালার উপর বিবিধ উপঢৌকন লইয়া দাসীচাকরের দল সার বাঁধিয়া চলিয়াছে।
নলিন কহিল, “দেখে এসো তো হে, ব্যাপারখানা কী।”

খবর আসিল, নন্দর ভাবী বধূর জন্য পানপত্র যাইতেছে।

নলিন তৎক্ষণাৎ গুড়গুড়ি টানা বন্ধ করিয়া সচকিত হইয়া উঠিয়া বসিল; বলিল, “খবর নিতে হচ্ছে তো।”

তৎক্ষণাৎ গাড়ি ভাড়া করিয়া ছড়্‌ ছড়্‌ শব্দে দূত ছুটিল। বিপিন হাজরা ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “কলকাতার মেয়ে, কিন্তু খাসা মেয়ে।”

নলিনের বুক দমিয়া গেল, কহিল, “বল কী হে।”

হাজরা কেবলমাত্র কহিল, “খাসা মেয়ে।”

নলিন বলিল, “এ তো দেখতে হচ্ছে।”

পারিষদ বলিল, “সে আর শক্তটা কী!” বলিয়া তর্জনী ও অঙ্গুষ্ঠে একটা কাল্পনিক টাকা বাজাইয়া দিল।

সুযোগ করিয়া নলিন মেয়ে দেখিল। যতই মনে হইল, এ মেয়ে নন্দর জন্য একেবারে স্থির হইয়া গেছে, ততই বোধ হইতে লাগিল, মেয়েটি রাওলপিণ্ডজার চেয়ে ভালো দেখিতে। দ্বিধাপীড়িত হইয়া নলিন পারিষদকে জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন ঠেকছে হে।”

হাজরা কহিল, “আজ্ঞে, আমাদের চোখে তো ভালোই ঠেকছে।”

নলিন কহিল, “সে ভালো কি এ ভালো।”

হাজরা বলিল, “এ ই ভালো।”

তখন নলিনের বোধ হইল, ইহার চোখের পল্লব তাহার চেয়েও আরো একটু যেন ঘন;তাহার রঙটা ইহার চেয়ে একটু যেন বেশি ফ্যাকাশে, ইহার গৌরবর্ণে একটু যেন হলদে আভায় সোনা মিশাইয়াছে। ইহাকে তো হাতছাড়া করা যায় না।

নলিন বিমর্ষভাবে চিত হইয়া গুড়গুড়ি টানিতে টানিতে কহিল, “ওহে হাজরা, কী করা যায় বলো তো।”

হাজরা বলিল, “মহারাজ, শক্তটা কী।” বলিয়া পুনশ্চ অঙ্গুষ্ঠে তর্জনীতে কাল্পনিক টাকা বাজাইয়া দিল।

টাকাটা যখন সত্যই সশব্দে বাজিয়া উঠিল তখন যথোচিত ফল হইতে বিলম্ব হইল না। কন্যার পিতা একটা অকারণ ছুতা করিয়া বরের পিতার সহিত তুমুল ঝগড়া বাধাইলেন। বরের পিতা বলিলেন, “তোমার কন্যার সহিত আমার পুত্রের যদি বিবাহ দিই তবে –” ইত্যাদি ইত্যাদি।

কন্যার পিতা আরো একগুণ অধিক করিয়া বলিলেন, “তোমার পুত্রের সহিত আমার কন্যার যদি বিবাহ দিই তবে” ইত্যাদি ইত্যাদি।

অতঃপর আর বিলম্ব মাত্র না করিয়া নলিন নন্দকে ফাঁকি দিয়া শুভলগ্নে শুভবিবাহ সত্বর সম্পন্ন করিয়া ফেলিল। এবং হাসিতে হাসিতে হাজরাকে বলিল, “বি. এ. পাস করা তো একেই বলে। কী বলো হে হাজরা। এবারে আমাদের ও বাড়ির বড়োবাবু ফেল।”

অনতিকাল পরেই ননীগোপালের বাড়িতে একদিন ঢাক ঢোল সানাই বাজিয়া উঠিল। নন্দর গায়ে-হলুদ।

নলিন কহিল, “ওহে হাজরা, খবর লও তো পাত্রীটি কে।”

হাজরা আসিয়া খবর দিল, পাত্রীটি সেই রাওলপিণ্ডির মেয়ে।

রাওলপিণ্ডির মেয়ে! হাঃ হাঃ হাঃ। নলিন অত্যন্ত হাসিতে লাগিল। ও বাড়ির বড়োবাবু আর কন্যা পাইলেন না, আমাদেরই পরিত্যক্ত পাত্রীটিকে বিবাহ করিতেছেন। হাজরাও বিস্তর হাসিল।

কিন্তু, উত্তরোত্তর নলিনের হাসির আর জোর রহিল না। তাহার হাসির মধ্যে কীট প্রবেশ করিল। একটি ক্ষুদ্র সংশয় তীক্ষ্ম স্বরে কানে কানে বলিতে লাগিল, “আহা, হাতছাড়া হইয়া গেল। শেষকালে নন্দর কপালে জুটিল।” ক্ষুদ্র সংশয় ক্রমশই রক্তস্ফীত জোঁকের মতো বড়ো হইয়া উঠিল, তাহার কণ্ঠস্বরও মোটা হইল। সে বলিল, “এখন আর কোনোমতেই ইহাকে পাওয়া যাইবে না, কিন্তু আসলে ইহাকে দেখিতে ভালো। ভারি ঠকিয়াছ।”
অন্তঃপুরে নলিন যখন খাইতে গেল তখন তাহার স্ত্রীর ছোটোখাটো সমস্ত খুঁত মস্ত হইয়া তাহাকে উপহাস করিতে লাগিল। মনে হইতে লাগিল, স্ত্রীটা তাহাকে ভয়ানক ঠকাইয়াছে।

রাওলপিণ্ডিতে যখন সম্বন্ধ হইতেছিল তখন নলিন সেই কন্যার যে ফোটো পাইয়াছিল, সেইখানি বাহির করিয়া দেখিতে লাগিল। “বাহবা, অপরূপ রূপমাধুরী। এমন লক্ষ্মীকে হাতে পাইয়া ঠেলিয়াছি, আমি এতো বড়ো গাধা।”

বিবাহসন্ধ্যায় আলো জ্বালাইয়া বাজনা বাজাইয়া জুড়িতে চড়িয়া বর বাহির হইল। নলিন শুইয়া পড়িয়া গুড়গুড়ি হইতে যৎসামান্য সাত্বনা আকর্ষণের নিষ্ফল চেষ্টা করিতেছে, এমন সময় হাজরা প্রসন্নবদনে হাসিতে হাসিতে আসিয়া নন্দকে লক্ষ্য করিয়া পরিহাস জমাইবার উপক্রম করিল।

নলিন হাঁকিল, “দারোয়ান! ”

হাজরা তটস্থ হইয়া দারোয়ানকে ডাকিয়া দিল।

বাবু হাজরাকে দেখাইয়া দিয়া কহিল, “অব্‌হি ইস্কো কান পকড়্ কে বাহার নিকাল দো।”

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *