‘ঠিক বলছেন– আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে–ক্ষুধা সম্পর্কে পাশ্চাত্যের মানুষদের ধ্যান। ধারণা চিন্তা ভাবনা সঠিক ছিল না। ক্ষুধার ভয়াবহ রূপ তাঁরা ধরতে পারেননি। তবে সবাই যে পারেন নি তা না।
যাঁরা নিজেরা ক্ষুধার্ত থেকেছেন। অভুক্ত থেকেছেন তারা পেরেছেন। যেমন ইংল্যান্ডের চার্লস ডিকেন্স এবং রাশিয়ার ম্যাক্সিম গর্কি। হ্যাংগার বা ক্ষুধা নামক একটা বিখ্যাত গ্রন্থ আছে নুট হামসুনের লেখা। সেই বইটিতেও ক্ষুধার ভয়াবহ বর্ণনা আছে। যদিও সেই বর্ণনা আমার কাছে যথাযথ মনে হয়নি। এমদাদ সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?”
জ্বি না। মনে হচ্ছিল নাক ডাকের মত শব্দ হচ্ছে।
জনাব এইটা হইল আমার অভ্যাস। খুব চিন্তাযুক্ত হইয়া যদি কিছু শুনি তখন এই রকম শব্দ হয়।
‘আজ না হয় গ্র্যাক। অন্য আরেকদিন পড়ব।
এমদাদ উঠতে উঠতে বলল, এইসব আসলে আমাদের শুনায়ে কোন লাভ নাই। আমরা আছিইবা কয়দিন। এইসব শােনা দরকার অল্প বয়স্ক পুলাপানদের। যেমন ধরেন এই বাড়ির ফরিদ, তারপর ধরেন ডাক্তার। সােবাহান সাহেব উৎসাহিত হয়ে বললেন,
‘কথাটা ভুল বলেন নি। ডাক্তার অনেকদিন আসছেও না–আচ্ছা দেখি কাল খবর পাঠাব। | এমদাদ হাঁপ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘন্টার পর ঘন্টা ক্ষুধা বিষয়ে পড়ার চেয়ে ক্ষুধায় ছটফট করতে করতে মরে যাওয়া ভাল। ”
বহুব্রীহি পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ
‘ভাইসাব তাহলে যাই–স্লমালিকুম। ‘ওয়ালাইকুম সালাম। কাল দুপুর থেকে বসে যাব। বাকিটা একটানে পড়ব কেমন এমদাদ শুকনাে গলায় বললেন, জ্বি আচ্ছা।
রাতে মশারী ফেলতে এসে মিলি বলল, বাবা আনিস সাহেব যে পালিয়ে গেছেন সেই খবরটাকি শুনেছ?
সােবাহান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, পালিয়ে গেছে মানে? ‘বাচ্চাদু’টিকে রেখে বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়েছেন।
“কারণটা কি? ‘বাচ্চারা তার কথা শুনে না। তিনি বাচ্চা দু’টিকে শিক্ষা দিতে চান।
ওরা কান্না কাটি করছে না? ‘না ওরা সুখেই আছে। বিলু আপার সঙ্গে শুয়েছে। বিলু আপা ক্রমাগত কবিতা আবৃত্তি করছে ওরা শুনছে। এত রাত হয়েছে অথচ ঘুমুবার কোন লক্ষণ নেই।”
‘বাচ্চা দু’টি তাহলে ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিয়েছে? ‘হ্যাঁ। এবং মনে হচ্ছে এই নাটকীয় ঘটনায় তারা বেশ আনন্দিত।‘
সােবাহান সাহেব অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে পড়লেন। মিলি খুব হালকা গলায় বলল, বাবা বিলু আপা বাচ্চা দু’টিকে যে কি রকম পছন্দ করে তা কি তুমি জান?
না জানি না। ‘অতিরিক্ত রকমের পছন্দ। এর ফল ভাল নাও হতে পারে বাবা। ‘ফল ভাল হবে না কেন? | ‘সব কিছু আমি তােমাকে গুছিয়ে বলতে পারব না। আমার লজ্জা লাগবে। শুধু এইটুকু বলি ছােট মেয়েটি বিলু আপাকে আড়ালে ডাকে –‘আমি’
‘তাতে অসুবিধা কি? আমরাতাে অনেকেই মা ডাকি। ‘তা ডাকি। তবে আড়ালে ডাকি না–এই মেয়েটা ডাকছে আড়ালে।
বহুব্রীহি পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ
এই নাও বাবা তােমার রিলাক্সিন। খেয়ে ঘুমাও : ‘বিলুকে একটু ডেকে আনতাে কথা বলি। ‘আজ থাক বাবা। আজ বিলু আপা ওদের কবিতা শােনাচ্ছে।
মিলি। ‘জ্বি।
ঐ ডাক্তার অনেকদিন আসছেনা ব্যাপারটা কি? মিলি ঈষৎ লাল হয়ে বলল, আমি জানি না কেন আসছে না।
ওকে খবর পাঠাস তাে!‘ মিলি অারাে লাল হয়ে বলল, খবর পাঠাতে হবে না। ও এম্নিতেই আসবে।
সােবাহান সাহেব হঠাৎ অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বললেন, ডাক্তার ছেলেটা ভাল। মিলি থমথমে গলায় বলল, বার বার তার প্রসঙ্গ আসছে কেন বাবা?
‘ওকে ক্ষুধা বিষয়ক রচনাটা পড়ে শুনাতে চাই। খবর দিবিতে। “আচ্ছা দেব।‘ ‘গােপনে গােপনে আস্মি ডাকছে। এটাও চিন্তার বিষয়। ‘তােমাকে এত চিন্তা করতে হবে না।‘ “তাের মা এখন আমার সঙ্গে ঘুমুচ্ছে না। আলাদা ঘুমুচ্ছে এই বিষয়টা কি বলতাে?
‘জানি না বাবা, এটা তােমাদের ব্যাপার তােমরা ফয়সালা করবে। আমি এখন যাচ্ছি। আর কিছু তােমার লাগবে?
‘না। খাওয়ার পানি দিয়েছিস?
‘যাবার আগে ক্ষুধা সম্পর্কে লাষ্ট যে পাতাটা লিখলাম সেটা কি পড়ব, শুনবি?
‘রক্ষা কর বাবা। ক্ষুধা সম্পর্কে জানার আমার কোন আগ্রহ নেই। তুমি জেনেছ এইতাে যথেষ্ট। একটা ফ্যামিলি থেকে একজন জানাই কি অনেক জানা না? ফ্যামিলির সব মেম্বারদের জানতে হবে?‘
‘হ্যাঁ হবে। আমি এই জিনিসটা তাের মাকে বুঝাতে পারি না।
বহুব্রীহি পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ
বাবা তুমি ঘুমাও তাে টগর এবং নিশা জেগে আছে। জেগে আছে বিলু। সে পড়ছে দেবতার গ্রাস। খুব সহজ কোন কবিতা না কিন্তু টগর এবং নিশা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। টগরের চোখে জল। একটু পর পর তার ঠোট কেঁপে উঠছে। বিলু অবাক হয়েছে। একটা বাচ্চা ছেলের মধ্যে এত আবেগ। আশ্চর্য তাে!
রাখাল যাইবে সাথে স্থির হল কথা অন্নদা লােকের মুখে শুনি সে বারতা ছুটে আসি বলে, “বাছা কোথা যাবি ওরে! রাখাল কহিল হাসি, চলিনু সাগরে।
আবার ফিরিব মাসি! পাগলের প্রায় অন্নদা কহিল ডাকি, ঠাকুরমশায়, বড়ো যে দুরন্ত ছেলে রাখাল আমার,
কে তাহারে সামালিবে! জন্ম হতে তার মাসি ছাড়া বেশিক্ষণ থাকেনি কোথাও। –
পড়া এইটুকু আসতেই টগর বিলুকে হতভম্ব করে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। নিশাও ঘন ঘন চোখ মুছছে।
বিস্মিত বিলু বলল, এ রকম কীদার তাে কিছু হয়নি। কাঁদছ কেন টগর? টগর কিছু বলল।
নিশা বলল, টগর এমন করে কাঁদছে কারণ আমাদের আম্মু এই কবিতা আমাদের শুনাতাে। আম্মু বই পড়ে বলতাে না। পুরােটা মুখস্ত বলতাে।
বিলু বলল, এটা ছাড়া আর কোন কবিতা তিনি বলতেন? ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতাটাও বলতেন।
ঐটাও অবিশ্যি খুব সুন্দর। টগর লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, এই কবিতাটা আম্মু বলতে নেচে নেচে। বিলু অবাক হয়ে বলল, ‘নেচে নেচে মানে?
‘হাত পা দুলিয়েনাচত। নেচে নেচে বলত। ‘বাহ চমৎকারভাে। তােমাদের তাে দেখছি অদ্ভুত একটা মা ছিল। ‘হ্যাঁ ছিল।” সেই রাতে বাকি কবিতাটা আর পড়া হল না।
বহুব্রীহি পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ
রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছে আনিস। খারাপ লাগছে না। ভালই লাগছে। বিয়ের আগে এইভাবে হেঁটে হেঁটে কত রাত সে পার করে দিয়েছে। রাতের ঢাকায় কত কি দেখার আছে। রূপহীনা কিছু তরুণী কেমন মাছের মত চোখে তাকায় চলমান পুরুষদের দিকে। যদি কেউ তাকে পছন্দ করে। যদি কেউ এগিয়ে আসে। অর্থ দিয়ে অল্প কিছু আনন্দ যদি কিনে নিতে চায়। সৃষ্টির কোন এক সঙ্গে বিধাতা শরীর দিয়ে মানব এবং মানবী পাঠিয়েছিলেন। সেই শরীরে বপন করেছেন