বহুব্রীহি পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

ঠিক বলছেনআমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছেক্ষুধা সম্পর্কে পাশ্চাত্যের মানুষদের ধ্যানধারণা চিন্তা ভাবনা সঠিক ছিল না। ক্ষুধার ভয়াবহ রূপ তাঁরা ধরতে পারেননিতবে সবাই যে পারেন নি তা না

বহুব্রীহি

যাঁরা নিজেরা ক্ষুধার্ত থেকেছেনঅভুক্ত থেকেছেন তারা পেরেছেনযেমন ইংল্যান্ডের চার্লস ডিকেন্স এবং রাশিয়ার ম্যাক্সিম গর্কিহ্যাংগার বা ক্ষুধা নামক একটা বিখ্যাত গ্রন্থ আছে নুট হামসুনের লেখাসেই বইটিতেও ক্ষুধার ভয়াবহ বর্ণনা আছেযদিও সেই বর্ণনা আমার কাছে যথাযথ মনে হয়নিএমদাদ সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?” 

জ্বি নামনে হচ্ছিল নাক ডাকের মত শব্দ হচ্ছে। 

জনাব এইটা হইল আমার অভ্যাসখুব চিন্তাযুক্ত হইয়া যদি কিছু শুনি তখন এই রকম শব্দ হয়। 

আজ না হয় গ্র্যাকঅন্য আরেকদিন পড়ব। 

এমদাদ উঠতে উঠতে বলল, এইসব আসলে আমাদের শুনায়ে কোন লাভ নাইআমরা আছিইবা কয়দিন। এইসব শােনা দরকার অল্প বয়স্ক পুলাপানদেরযেমন ধরেন এই বাড়ির ফরিদ, তারপর ধরেন ডাক্তারসােবাহান সাহেব উৎসাহিত হয়ে বললেন

কথাটা ভুল বলেন নিডাক্তার অনেকদিন আসছেও নাআচ্ছা দেখি কাল খবর পাঠাব| এমদাদ হাঁপ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালঘন্টার পর ঘন্টা ক্ষুধা বিষয়ে পড়ার চেয়ে ক্ষুধায় ছটফট করতে করতে মরে যাওয়া ভাল” 

বহুব্রীহি পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

ভাইসাব তাহলে যাইস্লমালিকুমওয়ালাইকুম সালামকাল দুপুর থেকে বসে যাববাকিটা একটানে পড়ব কেমন এমদাদ শুকনাে গলায় বললেন, জ্বি আচ্ছা। 

রাতে মশারী ফেলতে এসে মিলি বলল, বাবা আনিস সাহেব যে পালিয়ে গেছেন সেই খবরটাকি শুনেছ

সােবাহান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, পালিয়ে গেছে মানে? বাচ্চাদুটিকে রেখে বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়েছেন। 

কারণটা কি? বাচ্চারা তার কথা শুনে নাতিনি বাচ্চা দুটিকে শিক্ষা দিতে চান। 

ওরা কান্না কাটি করছে না? না ওরা সুখেই আছেবিলু আপার সঙ্গে শুয়েছেবিলু আপা ক্রমাগত কবিতা আবৃত্তি করছে ওরা শুনছেএত রাত হয়েছে অথচ ঘুমুবার কোন লক্ষণ নেই” 

বাচ্চা দুটি তাহলে ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিয়েছে? হ্যাঁএবং মনে হচ্ছে এই নাটকীয় ঘটনায় তারা বেশ আনন্দিত‘ 

সােবাহান সাহেব অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে পড়লেনমিলি খুব হালকা গলায় বলল, বাবা বিলু আপা বাচ্চা দুটিকে যে কি রকম পছন্দ করে তা কি তুমি জান

না জানি নাঅতিরিক্ত রকমের পছন্দ। এর ফল ভাল নাও হতে পারে বাবাফল ভাল হবে না কেন? | সব কিছু আমি তােমাকে গুছিয়ে বলতে পারব নাআমার লজ্জা লাগবেশুধু এইটুকু বলি ছােট মেয়েটি বিলু আপাকে আড়ালে ডাকে আমি’ 

তাতে অসুবিধা কি? আমরাতাে অনেকেই মা ডাকিতা ডাকিতবে আড়ালে ডাকি নাএই মেয়েটা ডাকছে আড়ালে। 

বহুব্রীহি পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

এই নাও বাবা তােমার রিলাক্সিনখেয়ে ঘুমাও : বিলুকে একটু ডেকে আনতাে কথা বলিআজ থাক বাবাআজ বিলু আপা ওদের কবিতা শােনাচ্ছে। 

মিলিজ্বি। 

ডাক্তার অনেকদিন আসছেনা ব্যাপারটা কি? মিলি ঈষৎ লাল হয়ে বলল, আমি জানি না কেন আসছে না। 

ওকে খবর পাঠাস তাে!মিলি অারাে লাল হয়ে বলল, খবর পাঠাতে হবে নাএম্নিতেই আসবে। 

সােবাহান সাহেব হঠাৎ অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বললেন, ডাক্তার ছেলেটা ভালমিলি থমথমে গলায় বলল, বার বার তার প্রসঙ্গ আসছে কেন বাবা

ওকে ক্ষুধা বিষয়ক রচনাটা পড়ে শুনাতে চাইখবর দিবিতেআচ্ছা দেবগােপনে গােপনে আস্মি ডাকছেএটাও চিন্তার বিষয়তােমাকে এত চিন্তা করতে হবে নাতাের মা এখন আমার সঙ্গে ঘুমুচ্ছে নাআলাদা ঘুমুচ্ছে এই বিষয়টা কি বলতাে

জানি না বাবা, এটা তােমাদের ব্যাপার তােমরা ফয়সালা করবেআমি এখন যাচ্ছিআর কিছু তােমার লাগবে

নাখাওয়ার পানি দিয়েছিস

যাবার আগে ক্ষুধা সম্পর্কে লাষ্ট যে পাতাটা লিখলাম সেটা কি পড়ব, শুনবি

রক্ষা কর বাবাক্ষুধা সম্পর্কে জানার আমার কোন আগ্রহ নেইতুমি জেনেছ এইতাে যথেষ্টএকটা ফ্যামিলি থেকে একজন জানাই কি অনেক জানা না? ফ্যামিলির সব মেম্বারদের জানতে হবে?‘ 

‘হ্যাঁ হবেআমি এই জিনিসটা তাের মাকে বুঝাতে পারি না। 

বহুব্রীহি পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

বাবা তুমি ঘুমাও তাে টগর এবং নিশা জেগে আছেজেগে আছে বিলুসে পড়ছে দেবতার গ্রাসখুব সহজ কোন কবিতা না কিন্তু টগর এবং নিশা মুগ্ধ হয়ে শুনছেটগরের চোখে জলএকটু পর পর তার ঠোট কেঁপে উঠছেবিলু অবাক হয়েছেএকটা বাচ্চা ছেলের মধ্যে এত আবেগআশ্চর্য তাে

রাখাল যাইবে সাথে স্থির হল কথা অন্নদা লােকের মুখে শুনি সে বারতা ছুটে আসি বলে, বাছা কোথা যাবি ওরে! রাখাল কহিল হাসি, চলিনু সাগরে। 

আবার ফিরিব মাসি! পাগলের প্রায় অন্নদা কহিল ডাকি, ঠাকুরমশায়, বড়ো যে দুরন্ত ছেলে রাখাল আমার

কে তাহারে সামালিবে! জন্ম হতে তার মাসি ছাড়া বেশিক্ষণ থাকেনি কোথাও– 

পড়া এইটুকু আসতেই টগর বিলুকে হতভম্ব করে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলনিশাও ঘন ঘন চোখ মুছছে

বিস্মিত বিলু বলল, রকম কীদার তাে কিছু হয়নিকাঁদছ কেন টগর? টগর কিছু বলল

নিশা বলল, টগর এমন করে কাঁদছে কারণ আমাদের আম্মু এই কবিতা আমাদের শুনাতােআম্মু বই পড়ে বলতাে নাপুরােটা মুখস্ত বলতাে। 

বিলু বলল, এটা ছাড়া আর কোন কবিতা তিনি বলতেন? সামান্য ক্ষতিকবিতাটাও বলতেন। 

ঐটাও বিশ্যি খুব সুন্দরটগর লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, এই কবিতাটা আম্মু বলতে নেচে নেচেবিলু অবাক হয়ে বলল, নেচে নেচে মানে

হাত পা দুলিয়েনাচতনেচে নেচে বলতবাহ চমৎকারভােতােমাদের তাে দেখছি অদ্ভুত একটা মা ছিলহ্যাঁ ছিলসেই রাতে বাকি কবিতাটা আর পড়া হল না। 

বহুব্রীহি পর্ব (শেষ)- হুমায়ূন আহমেদ

রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছে আনিসখারাপ লাগছে নাভালই লাগছেবিয়ের আগে এইভাবে হেঁটে হেঁটে কত রাত সে পার করে দিয়েছেরাতের ঢাকায় কত কি দেখার আছেরূপহীনা কিছু তরুণী কেমন মাছের মত চোখে তাকায় চলমান পুরুষদের দিকেযদি কেউ তাকে পছন্দ করেযদি কেউ এগিয়ে আসেঅর্থ দিয়ে অল্প কিছু আনন্দ যদি কিনে নিতে চায়সৃষ্টির কোন এক সঙ্গে বিধাতা শরীর দিয়ে মানব এবং মানবী পাঠিয়েছিলেনসেই শরীরে বপন করেছেন

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *