কি নিয়ে ভাবছ?” ‘দেশে মাছের যে ভয়াবহ সমস্যা ঐটা নিয়ে ভাবছি। কি করা যায় তাই ।
ঐ সব ভাববার লােক আছে। তােমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।‘ ‘এইতাে একটা ভুল কথা বললে মিনু। দেশের সমস্যা নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। সবাই যদি ভাবে তাহলেই সমস্যার কোন একটা সমাধান বের করা যাবে।
বেশতাে সকাল বেলা সমাধান বের করবে। বারটা বাজে, এখন শুয়ে পড়। নাও পানিটা খাও।
সােবাহান সাহেব চোখ থেকে চশমা খুলে রেখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, ঘড়িতে বারটা বাজে না, বাজে এগারােটা। তােমরা এই ঘরের ঘড়ি এক ঘন্টা আগিয়ে দাও। যেদিন প্রথম করলে সেদিনই টের পেয়েছি। তােমাদের বুঝতে দেই নি। তােমরা যা করছ, আমার প্রতি মমতা বশতই করছ তবু কাজটা ঠিক না। তােমরা ধোঁকা দেবার চেষ্টা করছ। ধোঁকা দেয়া অন্যায়। যাও শুয়ে পড়।
মিনু কথা বাড়ালেন না, শুয়ে পড়লেন। স্বামীকে তিনি খুব ভাল করে চেনেন। এই মুহূর্তে তাকে ঘাঁটানাে ঠিক হবে না।
‘মিনু। ‘বল। ‘আচ্ছা বলতাে তােমরা কি আমাকে খুব অল্প বুদ্ধির মানুষ বলে মনে কর? ‘তা মনে করব কেন?
‘এই যে ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা আগিয়ে দিলে, মনটাই একটু খারাপ হল। তােমরা আমাকে নিয়ে এমন একটা ছেলেমানুষী ব্যাপার করছ।
‘মিলি করেছে। এই সব মিলির বুদ্ধি। দাও এক্ষুণী ঠিক করে দিচ্ছি। | ‘দরকার নেই। আমার ঘরের ঘড়ি এক ঘন্টা এগিয়েই থাকুক। আমি মানুষটা অবশ্যি অনেকখানি পিছিয়ে আছি। এই দিক দিয়ে ঠিকই আছে। তুমি ঘুমাও মিনু। বয়সতাে শুধু আমার একার বাড়ছে না, তােমারও বাড়ছে। আমার যেমন বিশ্রাম দরকার, তােমারও দরকার। সমাজটাই এমন যে পুরুষের প্রয়ােজনটাই বড় করে দেখা হয়। মেয়েদেরটা দেখা হয় না। এই সমস্যা নিয়েও ভাবতে হবে।
বহুব্রীহি পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ
সােবাহান সাহেব নিজেই উঠে ঘরের বাতি নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিয়ে চেয়ারে বসলেন। তাঁর সামনে একটা বিশাল খাতা। খাতায় লেখা—মৎস্য সমস্যা।
খাতার প্রথম পাতায় এদেশের সব রকম মাছের নাম লেখা আছে। দেশে কত ধরনের মাছ পাওয়া যায়, কোন অঞ্চলে কোন মাছের কি নাম সব আগে লেখা দরকার। সব জাতের মাছের ব্রিডিং টাইম কি এক–না একেক মাছের একেক সময় তাও জানা দরকার। মাছের খাবার কি? সােবাহান সাহেবের মন খারাপ লাগছে, তিনি মাছের দেশের মানুষ অথচ মাছের ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানেন না। শুধু জানেন বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসে যখন আকাশ গুড় গুড় করে উঠে তখন কৈ মাছের ঝাক পানি ছেড়ে শুকােয় উঠে আসে। রহস্যময় ব্যাপার। এই পৃথিবী যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কত অদ্ভুত রহস্য চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁকে চিনতে হবে এইসব রহস্যের মাঝে।
বারান্দায় মিলি হাঁটছে। | হাঁটতে হাঁটতে শুনগুন করে গাইছে। মেয়েটার গানের গলা চমৎকার অথচ ভাল করে গান শিখল না। তাঁর ইচ্ছা করল মেয়েকে ডেকে পাশে বসিয়ে গান শুনেন। তা সম্ভব হবে না। গাইতে বললে মিলি গাইতে পারে না। সে না –কি গান করে নিজের জন্যে, অন্য কারাে জন্যে
মিলি গাইছে বলি গাে সজনী যেয়াে না, যেয়াে না তার কাছে আর যেয়াে না। সুখে সে রয়েছে, সুখে সে থাকুক, মাের কথা তারে বলাে না বােলােনা।
সন্দর গানতাে। সােবাহান সাহেবের মন আনন্দে পূর্ণ হল। তিনি খাতা বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। মিলি রেলিং–এ হেলান দিয়ে আছে। আকাশ ভরা জোছনা। কি অপরূপ ছবি। এমন সুন্দর পৃথিবী ফেলে রেখে তাঁকে চলে যেতে হবে ভাবতেই কষ্ট হয়। স্বৰ্গ কি এই পৃথিবীর চেয়েও সুন্দর হবে? তাও কি সম্ভব?
মিলি গান বন্ধ করে বাবার দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বলল, আমার মন অসম্ভব খারাপ হয়ে আছে বাবা।
বহুব্রীহি পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ
‘কাল আমার টিউটোরিয়েল, কিছু পড়া হয় নি। পড়তে ভাল লাগে না, কি–যে করি।
সোবাহান সাহেব সস্নেহে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। মিলি বলল, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা আমরা পড়া লেখা করে নষ্ট করি। কোন মানে হয় না।
নিরিবিলি বাড়ির সবচে সরব মহিলা–রহিমার মার মুখে আজ সারাদিন কোন কথা নেই। মিনু। ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন, জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে রহিমার মা?
রহিমার মা থমথমে গলায় বলল, কিছু হয় নাই। গরীবের আবার হওয়া হওয়ি। গরীবের কিছুই হয় না।
মিনু আর তাকে ঘটালেন না। চুপচাপ আছে ভাল আছে, কথা বলা শুরু করলে মুশকিল।
সন্ধ্যায় চা বানাতে বানাতে রহিমার মা নিজের মনেই বলল, গরীবের দুঃখু কেউ বুঝে না। মাইনষেতে বুঝেই না আল্লায়ও বুঝে না।
খুবই ফিলসফিক কথা। এ জাতীয় কথাবার্তা বলা শুরু করলে বুঝতে হবে ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে। | যা ঘটেছে তাকে ভয়াবহ বলা ঠিক হবে না। ঘটনা ঘটেছে গত রাতে। কাদের এবং রহিমার মা এক ঘরে ঘুমােয়। কাজকর্ম শেষ করে রাত এগারােটার দিকে রহিমার মা ঘুমুতে এসে দেখে কাদের জেগে বসে আছে। কাদেরের চোখে নতুন চশমা। কাদেরকে কেমন ভদ্রলােক ভদ্রলােক লাগছে। কাদের বলল, কেমন দেহায় খালাজী ?
রহিমার মা তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারল না। বিস্ময় সামলাতে সময় লাগল। চশমা কই পাইছস?‘ ‘কিনলাম। একশ দশ টেকা দাম। টেকা পয়সার দিকে চাইলেতাে হয় না খালাজী। টেকা পয়সা হইল বটপাতা। আইজ আছে কাইল নাই। জেবন তাে বটপাতা না। জেবনের সাধ আহ্লাদ আছে। কি কন খালালী?
রহিমার মা জবাব দিল না। কাদের চোখ থেকে চশমা খুলে গম্ভীর ভঙ্গিতে কাঁচ পরিষ্কার করতে করতে বলল, জিনিসটার প্রয়ােজনও আছে খালাজী। চেহাৱা সুশরের কথা বাদ দিলেও জিনিসটার বড়ই দরকার। চউক্ষে ধূলাবালি পড়ে না। রইদ কম লাগে। চউক্ষের আরাম হয়।
বহুব্রীহি পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ
‘দাম কত কইলি?
‘একশ দশ। পাওয়ার দিলে আরাে বেশী পড়ত। বিনা পাওয়ারে নিলাম। বুড়াকালে পাওয়ার কিনমু।
রহিমার মা দীর্ঘ নিঃশ্বাস আটকে রাখতে পারল না। এই কাদের ছােকরা বড়ই শৌখিন। বেতনের টাকা পেলেই এটা ওটা কিনে ফেলে। গত মাসে কিনেছে কলম। কলম কিনে এনে গম্ভীর গলায় বলেছে, কলম কিনলাম একটা খালাজী, চাইনীজ।
রহিমার মা অবাক হয়ে বলেছে, কলম দিয়া তুই করবি কি? লেহা পড়া জানছ?
কাদের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেছে লেহাপড়া কপালে নাই করমু কি কন? লেহাপড়া না জানলেও কলম একটা থাকা দরকার। পকেটে কলম থাকলে বাইরের একটা লােক ফট কইরা তুমি বইল্যা ডাক দিব না। বলব, ভাইসাব।
রহিমার মা’রও খুব শখ ছিল একটা কলম কেনার। তবে কাদের যেমন কলম পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারে সে তা পারবে না জেনে কেনে নি। এখন আবার চশমা কিনে ফেলেছে। ঈষায় রহিমার মা’র চোখ জ্বালা করতে লাগল।
কাদের বলল, দেহায় কেমন খালাজী? রহিমার মা বিরক্ত মুখে বলল, যেমুন চেহারা তেমুন দেহায়। ভ্যান ভ্যান করিস না।
আয়নায় অনেকক্ষণ কাদের নিজেকে দেখল। তারপর বারান্দায় একটু হেঁটে আসল। চশমা পরার পর তার হাঁটার ভঙ্গিও বদলে গেছে। | সেই রাতে মনের কষ্টে রহিমার মার ঘুম হল না। তার মেজাজ খারাপের এই হচ্ছে পূর্ব ইতিহাস। মিনু পূর্ব ইতিহাস জানেন না। কাজেই রহিমার মা যখন এসে তাঁকে বলল, “আমার চউক্ষে যেন কি হইছে আম্মা,” তখন তিনি সঙ্গত কারণেই চিন্তিত হয়ে বললেন, কি হয়েছে?
চউখ খালি কড় কড় করে। ‘তাই নাকি? ‘আবার চিলিক দিয়া বেদনা হয়। ‘ডাক্তার দেখাও। ‘ডাক্তার লাগতাে না আম্মা। চশমা দিলে ঠিক হইব। চশমার দাম বেশী না–একশ দশ। কাদের কিনছে।
বহুব্রীহি পর্ব (১০)- হুমায়ূন আহমেদ
‘কাদের চশমা কিনেছে?
জ্বি আম্মা। জেবনের একটা সাধ আহলাদ আছে না? | মিনু বিরক্ত হয়ে বললেন, কাদের যা করে তােমাকে তাই করতে হবে? তুমি বড় যন্ত্রণা কর রহিমার মা।
‘কয় দিন আর বীচমু আম্মা কন?‘ ‘আচ্ছা ঠিক আছে যাও চশমা দেয়া হবে।