বহুব্রীহি পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ

 ছবির খুটি নাটি কাদের এত ভাল বােঝে যে ফরিদ প্রায়ই চমৎকৃত হয়যেমন স্পটাকার্স ছবির এক অংশ স্পটাকার্সের সঙ্গে নিগ্রো গ্লাডিয়েটরের যুদ্ধ হবেযুদ্ধের আগের মুহূর্তে দুজন একটা ঘরে অপেক্ষা করছে

বহুব্রীহি

উত্তেজনায় টাকা কেমন যেন করছেতার অস্থিরতা দেখে নিগ্রো হেসে ফেললঅসাধারণ অংশফরিদ বলল, দৃশ্যটা কেমন কাদের? কাদের বলল, বড়ই চমৎকার মামা কিন্তুক বিষয় আছে। 

কি বিষয়? | হাসিটা কম হইছেআরেকটু বেশী হওনের দরকার| উহু, বেশী হলে নান্দনিক দিক ক্ষুন্ন হবে। 

কিন্তুক মামা, হাসি যেমন হঠাৎ আইছে তেমন হঠাৎ গেলে ভাল হইতএই হাসি হঠাৎ যায় না, ঠোঁটের মইদ্যে লাইগ্যা থাকে। 

ফরিদ সত্যি সত্যি চমৎকৃত হল। এ রকম প্রতিভা, বাজার করে আর ঘর ঝাঁট দিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে ভাবতেই খারাপ লাগে । 

মামা কি করছ? কিছু করছি নারে মিলি। আয়মিলি ঘরে ঢুকলহাসি মুখে বলল, তােমাদের ছবি এখনাে শুরু হয় নি

আজ কি ছবি? টাকাসটকাস না একবার দেখলেএকবার কেন হবে, পর্যন্ত পাঁচবার হলভাল জিনিস অনেকবার দেখা যায়। 

বহুব্রীহি পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ

আচ্ছা মামা এই যে তুমি কিছুই কর না, খাও দাও ঘুমাও ছবি দেখ, তােমার খারাপ লাগেনা

না তােখারাপ লাগবে কেন? তুই যদি পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করিস তাহলে জানতে পারবি পৃথিবীর জনগুষ্ঠির একটা বড় অংশ এইভাবে জীবন কাটিয়ে দেয়জনগুষ্ঠির ইকুইলিব্রিয়াম বজায় রাখার জন্যেই এটা দরকারজনতার এই অকর্মক অংশের কাজ হচ্ছে কর্মক অংশগুলির টেনশন বজর্ভ করাঅর্থাৎ শক এবজর্ভারের মত কাজ করা। 

সব ব্যাপারেই তােমার একটা থিওরী আছে, তাই না মামা

থিওরী বলা ঠিক হবে না, বলতে পারিস হাইপােথিসিসথিওরী আর হাইপােথিসিস কিন্তু এক না | চুপ করতাে মামা। 

তুইও দেখি তাের বাবার মত হয়ে যাচ্ছিসসব কিছুতেচুপ কর, চুপ কর। 

মিলি গম্ভীর গলায় বলল, আজ তােমার থিওরী শুনতে আসিনি মামাআজ এসেছি তােমার সঙ্গে ঝগড়া করতে। 

আমি কি করলাম? তুমি খুব অন্যায় করেছ মামা। 

অন্যায় করেছি? হ্যা করেবাবার স্বভাব চরিত্র তুমি খুব ভাল করেই জানতুমি জান বেচারা কত অল্পতে আপসেট হয়সব জেনেশুনে তুমি তাকে আপসেট করমাছের সমস্যাটা নিয়ে বাবা এতদিন ধরে ভাবছে, হতে পারে তার ভাবনাটা ঠিক নাকিন্তু কেউ যেখানে ভাবছে না বাবাতাে সেখানে ভাবছে‘ 

তা ভাবছেতাকে আমরা সাহায্য না করতে পারিডিসকারেজ করব কেন

এইসব উদ্ভট আইডিয়াকে তুই সাপাের্ট করতে বলছিস?হ্যা বলছিএতে বাবা শান্তি পাবে, সে বুঝবে যে সে একা নাতুই এমন চমৎকার করে কথা বলা কোথেকে শিখলি?সিনেমা দেখে দেখে শিখিনিএইটুকু বলতে পারিতাের কথা বলার ধরণ দেখে অবাকই হচ্ছিছােটবেলায় তাে হাবলার মত ছিলিকি যে তােমার কথা মামা

বহুব্রীহি পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ

আমি আবার কবে হাবলার মত ছিলাম? | মিলি উঠে দাঁড়ালফরিদ বলল, আচ্ছা যা তাের কথা রাখলামট্রং সাপাের্ট দেরমিলি বলল, কিছুতেই তুমি বাড়াবাড়ি কর মামা, ইং সাপাের্টের দরকার নেইদেখ না কি করি‘ 

মিলি চিন্তায় পড়ে গেলমামার কাজ কর্মের কোন ঠিকঠিকানা নেইকি করে বসবে কে জানেমামাকে কিছু না বলাই বােধ হয় ভাল ছিলমিলি নিজের ঘরে চলে গেলমনটা কেন জানি খারাপ লাগছেমন খারাপ লাগার যদিও কোন কারণ নেইইদানিং এই ব্যাপারটা ঘন ঘন ঘটছেঅকারণে মন খারাপ হচ্ছে। 

আফা ঘুমাইছেন? মিলি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রহিমার মা দাঁড়িয়ে আছেকি ব্যাপার রহিমার মা

একটা সমিস্যা হইছে আফাকি সমস্যাচশমা দেওনের পর থাইক্যা সব জিনিস দুইটা করে দেখি। 

বল কি ? আফাএই যে আফনে চেয়ারে বইয়া আছেন মনে হইতাহে দুইখান আফাএকজন ডাইনের আফা একজনৰীয়ের আফা। 

মিলি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলরহিমার মা বলল, টেবিলের উফরে একখান গেলাস থাকে তখন আমি দেখি দুইখান গেলাস, এই দুই গেলাসের মাৰামাঝি হাত দিলে আসল গেলাস পাওয়া যায়। 

কি সর্বনাশের কথাচশমা পরা বাদ দাও না কেন? | অত দাম দিয়া একখান জিনিস কিনছি বাদ দিমু ক্যান? সমিস্যা একটু হইতাছে, তা কি আর করা কন আফা, সমিস্যা ছাড়া এই দুনিয়ায় কোন জিনিস আছে? সব ভাল জিনিসের 

মইদ্যে আল্লাহতালা মন্দ জিনিস ঢুকাইয়া দিয়েএইটা হইল আল্লাহতালার খুদরতযাই আফা‘ 

রহিমার মা চলে যাচ্ছেপা ফেলছে খুব সাবধানে, কারণ সে শুধু যে প্রতিটি জিনিস দুটা করে দেখছে তাই না ঘরের মেঝেও উঁচু নিচু দেখছেতার কাছে মনে হচ্ছে চারদিকে অসংখ্য গর্তএইসব গর্ত বাঁচিয়ে তাকে সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছেচশমা পরা খুব সহজ ব্যাপার নয়। 

বহুব্রীহি পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ

মিলির পড়ায় মন বসছে নাসে বাতি নিভিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালউপর থেকে টগর এবং নিশার খিলখিল হাসি শােনা যাচ্ছেএত রাতেও বাচ্চা দুটি জেগে আছে। এদের কোন ঠিক ঠিকানা নেইকোনদিন সন্ধ্যা না মিলতেই ঘুমিয়ে পড়ে আবার কোনদিন গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকেআনিস সাহেব বাচ্চা দুটিকে ঠিকমত মানুষ করতে পারছেন নাসারাদিন কোথায় কোথায় নিয়ে ঘুরেনআগের স্কুল অনেক দূরে কাজেই তারা এখন স্কুলেও যাচ্ছে নাভদ্রলােকের উচিত আশেপাশের কোন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়াতিনি তাও করছেন না। 

বাচ্চাদের হাসির সঙ্গে সঙ্গে এবার তাদের বাবার হাসিও শােনা গেলকি নিয়ে তাদের হাসাহাসি হচ্ছে জানতে ইচ্ছা করছেনিশ্চয়ই কোন তুচ্ছ ব্যাপারএমন নির্মল হাসি সাধারণত তুচ্ছ কোন বিষয় নিয়েই হয়। 

মিলির ধারণা সত্যিঅতি তুচ্ছ বিষয় নিয়েই হাসাহাসি হচ্ছেআনিস তার ছেলেবেলার গল্প করছে, তাই শুনে একেকজন হেসে গড়িয়ে পড়ছেআনিসের ছেলেবেলা সিরিজের প্রতিটি গল্পই এদের শােনা, তবু কোন এক বিচিত্র কারণে গল্পগুলি এদের কাছে পুরানাে হচ্ছে না। 

বহুব্রীহি পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ

নিশা বলল, তুমি খুবই দুষ্টু ছিলে তাই না বাবা

না দুষ্ট ছিলাম নাআমার বয়েসী ছেলেদের মধ্যে আমি ছিলাম সবচে শান্ততবু কেন জানি সবাই আমাকে খুব দুষ্ট ভাবত‘ 

বাবা আমরা কি দুষ্ট না শান্ত

তােমরা খুবই দুষ্ট কিন্তু তােমাদের সবাই ভাবে শান্তঅনেক রাত হয়ে পড়েছে এসাে শুয়ে পড়ি । 

টগর বলল, আজ ঘুমুতে ইচ্ছা করছে নাকি করতে ইচ্ছা করছে? গল্প শুনতে ইচ্ছা করছেতােমাদের বিয়ের গল্পটা কর না বাবা*এই গল্পতো অনেকবার শুনেছ, আবার কেন? আরেকবার শুনতে ইচ্ছা করছে। 

এই গল্প শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমুতে যাবে তাে? হ্যাঁ যাবতােমার মা ছিল খুব চমৎকার একটি মেয়ে নিশা বাবার কথা শেষ হবার আগেই বলল, আর ছিল খুব সুন্দর। 

হ্যাঁ খুব সুন্দরও ছিলতখনাে আমি তাকে চিনি নাএকদিন নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে বই কিনতে গিয়েছি, একই দোকানে তােমার মাওগিয়েছে 

টগর বলল, মার পরণে আসমানী রঙের একটা শাড়িহ্যাঁ তার পরণে আসমানী রঙের শাড়ি ছিলনিশা বলল, সে বই কিনতে গিয়েছে কিন্তু বাসা থেকে টাকা নিয়ে যায় নিআনিসহেসে ফেললনিশা বলল, হাসছ কেন বাবা?

বহুব্রীহি পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ

তােমরা দুজনে মিলেইতাে গল্পটা বলে ফেলছ, এই জন্যেই হাসি আসছেচল আজ শুয়ে পড়া যাকঠান্ডা লাগছে‘ 

তারা আপত্তি করল নাবিছানায় নিয়ে শােয়ানাে মাত্র ঘুমিয়ে পড়লঅনেকদিন পর আনিস তার খাতা নিয়ে বসলউপন্যাসটা যদি শেষ করা যায়নিতান্তই সহজ সরল ভালবাসাবাসির গল্পঅনেকদূর লেখা হয়ে আছে কিন্তু আর এগুনাে যাচ্ছে নাএকেই বােধ হয় বলে রাইটার্স ব্লক, লেখক চরিত্র নিয়ে ভাবতে পারেন, মনে মনে কাহিনী অনেকদূর নিয়ে যেতে পারেন কিন্তু লিখতে গেলেই কলম আটকে যায়যেন অদৃশ্য কেউ এসে হাত চেপে ধরে, কানে কানে বলে 

তুমি লিখতে পারবে না| আনিস রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে দুপৃষ্ঠা লিখলঘুমুতে যাবার আগে সেই দু পৃষ্ঠা ছিড়ে কুচি কুচি করে ফেলল। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *