ছবির খুটি নাটি কাদের এত ভাল বােঝে যে ফরিদ প্রায়ই চমৎকৃত হয়। যেমন স্পটাকার্স ছবির এক অংশ স্পটাকার্সের সঙ্গে নিগ্রো গ্লাডিয়েটরের যুদ্ধ হবে। যুদ্ধের আগের মুহূর্তে দুজন একটা ঘরে অপেক্ষা করছে।
উত্তেজনায় টাকা কেমন যেন করছে। তার অস্থিরতা দেখে নিগ্রো হেসে ফেলল। অসাধারণ অংশ। ফরিদ বলল, দৃশ্যটা কেমন কাদের? কাদের বলল, বড়ই চমৎকার মামা কিন্তুক বিষয় আছে।
‘কি বিষয়? | ‘হাসিটা কম হইছে। আরেকটু বেশী হওনের দরকার। | ‘উহু, বেশী হলে নান্দনিক দিক ক্ষুন্ন হবে।
‘কিন্তুক মামা, হাসি যেমন হঠাৎ আইছে তেমন হঠাৎ গেলে ভাল হইত। এই হাসি হঠাৎ যায় না, ঠোঁটের মইদ্যে লাইগ্যা থাকে।
ফরিদ সত্যি সত্যি চমৎকৃত হল। এ রকম প্রতিভা, বাজার করে আর ঘর ঝাঁট দিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে ভাবতেই খারাপ লাগে ।
‘মামা কি করছ? ‘কিছু করছি নারে মিলি। আয়। মিলি ঘরে ঢুকল। হাসি মুখে বলল, তােমাদের ছবি এখনাে শুরু হয় নি?
আজ কি ছবি? ‘টাকাস।‘ ‘টকাস না একবার দেখলে। ‘একবার কেন হবে, এ পর্যন্ত পাঁচবার হল। ভাল জিনিস অনেকবার দেখা যায়।
বহুব্রীহি পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
‘আচ্ছা মামা এই যে তুমি কিছুই কর না, খাও দাও ঘুমাও ছবি দেখ, তােমার খারাপ লাগেনা?
না তাে। খারাপ লাগবে কেন? তুই যদি পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করিস তাহলে জানতে পারবি পৃথিবীর জনগুষ্ঠির একটা বড় অংশ এইভাবে জীবন কাটিয়ে দেয়। জনগুষ্ঠির ইকুইলিব্রিয়াম বজায় রাখার জন্যেই এটা দরকার। জনতার এই অকর্মক অংশের কাজ হচ্ছে কর্মক অংশগুলির টেনশন ‘বজর্ভ করা। অর্থাৎ শক এবজর্ভারের মত কাজ করা।
“সব ব্যাপারেই তােমার একটা থিওরী আছে, তাই না মামা?
‘থিওরী বলা ঠিক হবে না, বলতে পারিস হাইপােথিসিস। থিওরী আর হাইপােথিসিস কিন্তু এক না | ‘চুপ করতাে মামা।
‘তুইও দেখি তাের বাবার মত হয়ে যাচ্ছিস। সব কিছুতে–চুপ কর, চুপ কর।
মিলি গম্ভীর গলায় বলল, আজ তােমার থিওরী শুনতে আসিনি মামা। আজ এসেছি তােমার সঙ্গে ঝগড়া করতে।
‘আমি কি করলাম? ‘তুমি খুব অন্যায় করেছ মামা।
অন্যায় করেছি? ‘হ্যা করে। বাবার স্বভাব চরিত্র তুমি খুব ভাল করেই জান। তুমি জান বেচারা কত অল্পতে আপসেট হয়। সব জেনেশুনে তুমি তাকে আপসেট কর। মাছের সমস্যাটা নিয়ে বাবা এতদিন ধরে ভাবছে, হতে পারে তার ভাবনাটা ঠিক না। কিন্তু কেউ যেখানে ভাবছে না বাবাতাে সেখানে ভাবছে।‘
‘তা ভাবছে। ‘তাকে আমরা সাহায্য না করতে পারি–ডিসকারেজ করব কেন?
এইসব উদ্ভট আইডিয়াকে তুই সাপাের্ট করতে বলছিস?” ‘হ্যা বলছি। এতে বাবা শান্তি পাবে, সে বুঝবে যে সে একা না।” ‘তুই এমন চমৎকার করে কথা বলা কোথেকে শিখলি?” ‘সিনেমা দেখে দেখে শিখিনি–এইটুকু বলতে পারি।‘ ‘তাের কথা বলার ধরণ দেখে অবাকই হচ্ছি–ছােটবেলায় তাে হাবলার মত ছিলি।” ‘কি যে তােমার কথা মামা।
বহুব্রীহি পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
আমি আবার কবে হাবলার মত ছিলাম? | মিলি উঠে দাঁড়াল। ফরিদ বলল, আচ্ছা যা তাের কথা রাখলাম। ট্রং সাপাের্ট দের। মিলি বলল, কিছুতেই তুমি বাড়াবাড়ি কর মামা, ইং সাপাের্টের দরকার নেই। ‘ই দেখ না কি করি।‘
মিলি চিন্তায় পড়ে গেল। মামার কাজ কর্মের কোন ঠিক–ঠিকানা নেই। কি করে বসবে কে জানে। মামাকে কিছু না বলাই বােধ হয় ভাল ছিল। মিলি নিজের ঘরে চলে গেল। মনটা কেন জানি খারাপ লাগছে। মন খারাপ লাগার যদিও কোন কারণ নেই। ইদানিং এই ব্যাপারটা ঘন ঘন ঘটছে। অকারণে মন খারাপ হচ্ছে।
‘আফা ঘুমাইছেন? মিলি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রহিমার মা দাঁড়িয়ে আছে। ‘কি ব্যাপার রহিমার মা?
একটা সমিস্যা হইছে আফা। কি সমস্যা। ‘চশমা দেওনের পর থাইক্যা সব জিনিস দুইটা করে দেখি।
বল কি ? ‘হ আফা। এই যে আফনে চেয়ারে বইয়া আছেন মনে হইতাহে দুইখান আফা। একজন ডাইনের আফা একজনৰীয়ের ‘আফা।
মিলি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। রহিমার মা বলল, টেবিলের উফরে একখান গেলাস থাকে তখন আমি দেখি দুইখান গেলাস, এই দুই গেলাসের মাৰামাঝি হাত দিলে আসল গেলাস পাওয়া যায়।
‘কি সর্বনাশের কথা। চশমা পরা বাদ দাও না কেন? | ‘অত দাম দিয়া একখান জিনিস কিনছি বাদ দিমু ক্যান? সমিস্যা একটু হইতাছে, তা কি আর করা কন আফা, সমিস্যা ছাড়া এই দুনিয়ায় কোন জিনিস আছে? সব ভাল জিনিসের
মইদ্যে আল্লাহতালা মন্দ জিনিস ঢুকাইয়া দিয়ে। এইটা হইল আল্লাহতালার খুদরত। যাই আফা।‘
রহিমার মা চলে যাচ্ছে। পা ফেলছে খুব সাবধানে, কারণ সে শুধু যে প্রতিটি জিনিস দুটা করে দেখছে তাই না ঘরের মেঝেও উঁচু নিচু দেখছে। তার কাছে মনে হচ্ছে চারদিকে অসংখ্য গর্ত। এইসব গর্ত বাঁচিয়ে তাকে সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। চশমা পরা খুব সহজ ব্যাপার নয়।
বহুব্রীহি পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
মিলির পড়ায় মন বসছে না। সে বাতি নিভিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। উপর থেকে টগর এবং নিশার খিলখিল হাসি শােনা যাচ্ছে। এত রাতেও বাচ্চা দু’টি জেগে আছে। এদের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কোনদিন সন্ধ্যা না মিলতেই ঘুমিয়ে পড়ে আবার কোনদিন গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। আনিস সাহেব বাচ্চা দু’টিকে ঠিকমত মানুষ করতে পারছেন না। সারাদিন কোথায় কোথায় নিয়ে ঘুরেন। আগের স্কুল অনেক দূরে কাজেই তারা এখন স্কুলেও যাচ্ছে না। ভদ্রলােকের উচিত আশেপাশের কোন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া। তিনি তাও করছেন না।
বাচ্চাদের হাসির সঙ্গে সঙ্গে এবার তাদের বাবার হাসিও শােনা গেল। কি নিয়ে তাদের হাসাহাসি হচ্ছে জানতে ইচ্ছা করছে–নিশ্চয়ই কোন তুচ্ছ ব্যাপার। এমন নির্মল হাসি সাধারণত তুচ্ছ কোন বিষয় নিয়েই হয়।।
মিলির ধারণা সত্যি। অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়েই হাসাহাসি হচ্ছে। আনিস তার ছেলেবেলার গল্প করছে, তাই শুনে একেকজন হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আনিসের ছেলেবেলা সিরিজের প্রতিটি গল্পই এদের শােনা, তবু কোন এক বিচিত্র কারণে গল্পগুলি এদের কাছে পুরানাে হচ্ছে না।
বহুব্রীহি পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
নিশা বলল, তুমি খুবই দুষ্টু ছিলে তাই না বাবা?
না দুষ্ট ছিলাম না। আমার বয়েসী ছেলেদের মধ্যে আমি ছিলাম সবচে শান্ত। তবু কেন জানি সবাই আমাকে খুব দুষ্ট ভাবত।‘
‘বাবা আমরা কি দুষ্ট না শান্ত?
তােমরা খুবই দুষ্ট কিন্তু তােমাদের সবাই ভাবে শান্ত। অনেক রাত হয়ে পড়েছে এসাে শুয়ে পড়ি ।।
টগর বলল, আজ ঘুমুতে ইচ্ছা করছে না। “কি করতে ইচ্ছা করছে? ‘গল্প শুনতে ইচ্ছা করছে। তােমাদের বিয়ের গল্পটা কর না বাবা। *এই গল্পতো অনেকবার শুনেছ, আবার কেন? ‘আরেকবার শুনতে ইচ্ছা করছে।
এই গল্প শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমুতে যাবে তাে? ‘হ্যাঁ যাব। ‘তােমার মা ছিল খুব চমৎকার একটি মেয়ে নিশা বাবার কথা শেষ হবার আগেই বলল, আর ছিল খুব সুন্দর।
‘হ্যাঁ খুব সুন্দরও ছিল। তখনাে আমি তাকে চিনি না। একদিন নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে বই কিনতে গিয়েছি, একই দোকানে তােমার মাও–গিয়েছে
টগর বলল, মার পরণে আসমানী রঙের একটা শাড়ি। ‘হ্যাঁ তার পরণে আসমানী রঙের শাড়ি ছিল। নিশা বলল, সে বই কিনতে গিয়েছে কিন্তু বাসা থেকে টাকা নিয়ে যায় নি। আনিসহেসে ফেলল। নিশা বলল, হাসছ কেন বাবা?
বহুব্রীহি পর্ব (১২)- হুমায়ূন আহমেদ
‘তােমরা দুজনে মিলেইতাে গল্পটা বলে ফেলছ, এই জন্যেই হাসি আসছে। চল আজ শুয়ে পড়া যাক। ঠান্ডা লাগছে।‘
তারা আপত্তি করল না। বিছানায় নিয়ে শােয়ানাে মাত্র ঘুমিয়ে পড়ল। অনেকদিন পর আনিস তার খাতা নিয়ে বসল। উপন্যাসটা যদি শেষ করা যায়। নিতান্তই সহজ সরল ভালবাসাবাসির গল্প। অনেকদূর লেখা হয়ে আছে কিন্তু আর এগুনাে যাচ্ছে না। একেই বােধ হয় বলে রাইটার্স ব্লক, লেখক চরিত্র নিয়ে ভাবতে পারেন, মনে মনে কাহিনী অনেকদূর নিয়ে যেতে পারেন কিন্তু লিখতে গেলেই কলম আটকে যায়। যেন অদৃশ্য কেউ এসে হাত চেপে ধরে, কানে কানে বলে
তুমি লিখতে পারবে না। | আনিস রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে দু’পৃষ্ঠা লিখল। ঘুমুতে যাবার আগে সেই দু পৃষ্ঠা ছিড়ে কুচি কুচি করে ফেলল।