তুল আনিসকে দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, স্লমালিকুম।
আনিস বলল, ওয়ালাইকুম সালাম। তুমি এমদাদ সাহেবের নাতনী তাই না? পুতুল তােমার নাম ?
দেখেছ কি অবস্থা? পুতুল কিছু না বলে মুখ নীচু করে হাসল। আনিস বলল, এদের যন্ত্রণায় অস্থির হয়েছি। এরা যা করছে তার নাম দুষ্টুমী না। এ হচ্ছে ইচ্ছা করে আমাকে কষ্ট দেয়া! তােমার পানির গ্লাসটা কি আমাকে দিতে পার?
পুতুল গ্লাস এগিয়ে দিল। আনিস এক চুমুকে পানি খেয়ে ফেলল। বিষন্ন গলায় বলল, এই ঘটনা কিন্তু আজ নতুন ঘটছে না। এটা পুরনাে ঘটনা। আগেও কাটাকুটি খেলা একবার হয়েছে। তখন তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কোনদিন খেলবে না। বার বার তো এটা হতে দেয়া যায় না।
পুতুল বলল, বাদ দেন। এরা ছােট মানুষ। ‘তুমি ভুল বলছ পুতুল–ওরা ছােট হলেও আমার সঙ্গে যা শুরু করেছে তা বড় মানুষদের খেলা। এক ধরনের দাবা খেলা। তারা একরকম চাল দিচ্ছে আমি এক রকম চাল দিচ্ছি। আমার সংসার টিকে থাকবে কি থাকবে না এটা নির্ভর করছে এই খেলায় জয় পরাজয়ের উপর।
এই মানুষটার কথা গুলি পুতুলের বড় ভাল লাগছে। কি সহজ সরল ভঙ্গিতেই না পুতুলের সঙ্গে সে কথা বলছে। যেন পুতুল তার কত দীর্ঘদিনের চেনা মানুষ অথচ এর আগে একদিন মাত্র কথা হয়েছে। তাওকি নাম? দেশ কোথায়? এ রকম কথা।
‘জ্বি।
ওরা কোথায় পালিয়েছে তােমার কোন ধারণা আছে? ‘জ্বি না।
“আচ্ছা ওদের খুঁজে বের করছি, তার আগে এসাে আমরা দুজন এক কাপ করে চা খাই। না কি তুমি চা খাও না?
‘খাই।”
‘তাহলে বরং চা বানাও। চা খাবার পর ঠিক করব টগর এবং নিশাকে কি শাস্তি দেয়া যায়।
কত সহজ কত আন্তরিক ভাবেই না লােকটা কথা বলছে, শুনতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে তারা সবাই একই ছাদের নিচে দীর্ঘদিন ধরে আছে, যে ছাদের উপর ঝড়ে পড়েছে কত বৃষ্টি কত জ্যোত্মা।
চা বানানাের কেরােসিন কুকার ঘরের এক কোণেই আছে। কেরােসিন কুকার ধরাতে অসুবিধা হল না। চা বানাতে বানাতে হােট হােট সব কথা হতে লাগল। প্রতিটি প্রশ্নের জবাব আনিস খুব মমতার সঙ্গে দিল। যেমন পুতুল বলল, ভাইজান আফনে কি করেন?
আনিস হাসতে হাসতে বলল, আমি কিছুই করিনা, আবার অনেক কিছুই করি। সেইটা কেমুন? ‘আমি লিখি। একজন লেখককে দেখলে কখনাে মনে হবে না সে বিশেষ কিছু করছে। হাতে হেলাফেলা করে ধরা একটা কাগজ। একটা কলম বা পেন্সিল। একজন শ্রমিককে বিশাল এক খন্ড পাথর উপড়ে তুলতে কত না পরিশ্রম করতে হয়। টপ টপ করে তার মাথা বেয়ে ঘাম পড়ে অথচ একজন লেখককে দেখবে কত অনায়াসে লিখছে–অপূর্ব সব লেখা। এইসব লেখা কি তুমি কখনাে পড়েছ?‘
পুতুলের কথা শুনতেই ভাল লাগছে, জবাব দিতে ইচ্ছা করছে না। ওদিকের মানুষটি বােধ হয় তা বুঝতে পারছে। সে বলছে–দেখ পুতুল লেখালেখি কি অদ্ভুত জিনিস মাত্র চার লাইনের একটা কবিতা, মাত্র দু‘লাইনের দুটি বাক্যে ধরা দিতে পারে মহান কোন বােধ, জীবনের গভীর ক্রন্দন।।
পুতুল চুপি চুপি বলল, একটা বলবেন? ‘হ্যাঁ বলব। আমি টগর ও নিশাকে প্রায়ই বলি। তুমি যদি আস তুমিও শুনবে। আজ না আজ থাক। আজ আমার মনটা খারাপ। বাচ্চা দু’টি বড় কষ্ট দিচ্ছে। কি চাচ্ছে কিছু বুঝতেও পারছি না। পুতুল।
‘তুমি কি আমাকে আরেক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াবে? কত সামান্য কথা অথচ পুতুলের এত ভাল লাগল। তার ইচ্ছা করছে আনন্দে একটু কাঁদে। তার কেন এত আনন্দ হল? এই আনন্দের উৎস কোথায়? এইত চোখ ভিজে উঠছে। কেন, চোখ ভিজে উঠল কেন?
টগর ও নিশা বিলুর পেছনে পেছনে রাত দশটায় শােবার ঘরে ঢুকল এবং কোনদিকে না তাকিয়ে বিছানায় উঠে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে তাদের চোখ বন্ধ। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। যেন ঘুমিয়ে কাদা! বিলু বলল, আনিস সাহেব দয়া করে এবারের মত বাচ্চাদের ক্ষমা করে দিন। ওরা যা করেছে তার জন্যে খুব লজ্জিত, দুঃখিত এবং অনুতপ্ত। ভয়ে এ ঘরে আসতে চাচ্ছিল
আমি অভয় দিয়ে নিয়ে এসেছি।
আনিস বলল, থ্যাংক। ‘ওরা আমাকে কথা দিয়েছে আর কোনদিন এরকম করবেনা।
এই কথা, কথা পর্যন্তই! ওরা আবারাে এ রকম করবে এবং আপনার মতাে অন্য কাউকে ধরে নিয়ে আসবে যাতে ক্ষমা করা হয়। কাজেই এবার ক্ষমার প্রশ্নই উঠে না।”
বিলু অবাক হয়ে বলল, ‘আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি তারপরেও আপনি ক্ষমা করবেন ? তারপরেও এরকম কঠিন করে কথা বলছেন?
‘হী বলছি। কারণ আপনার আগে আপনার বাবা এদের একবার নিয়ে এসেছেন, আপনার মা নিয়ে এসেছেন,মিলি এনেছে। একবার কাদের এদের প্রটেকশন দিয়ে এনেছে।
বিলু কঠিন স্বরে বলল, অথাৎ আপনি ওদের শাস্তি দেবেন?
‘কি শাস্তি জানতে পারি? ‘ওরা জানে কি শাস্তি। ওদেরকে আমি বলে রেখেছি–যে, আবার যদি তারা কাটাকুটি খেলা। খেলে তাহলে ওদের ফেলে রেখে আমি চলে যাব। ‘‘আপনি ওদের ফেলে রেখে চলে যাবেন? ‘হাঁ।‘
‘বেশ চলে যান। আপনার সংসার আপনি চালাবেন। যেভাবে চললে ভাল হয় সে ভাবে চালাবেন।
আনিস রাত ১১টা দশ মিনিটে ব্যাগ হাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। বিলু সারাক্ষণই ভাবছিল এটা এক ধরণের ঠাট্টা হয়ত গেট পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসবে। দেখা গেল ব্যাপার মােটেই ঠাট্টানা। আনিস সত্যি সত্যি চলে গেছে।
এমদাদ বলল, ভাইসাব এখন তাহলে উঠি? এগারােটার উপরে বাজে। সােবাহান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আমার লেখাটা পছন্দ হচ্ছে না?
এমদাদ চোখ বড় বড় করে বলল, পছন্দ হচ্ছে না এইটা ভাইসাব কি বললেন। জীবনের সার কথা তাে সবটাই আপনার লেখার মধ্যে। ক্ষুধা বিষয়টা যে কি আপনের লেখা পড়ার আগে জানতাম না। উপাষ দিছি ঠিকই কিন্তু ক্ষুধা বুঝি নাই। এখন বুঝলাম।।
সােবাহান সাহেব বললেন, তাহলে কি বাকিটা পড়ব?
অবশ্যই পড়বেন। ‘দেড়শ পৃষ্ঠার মত লেখা হয়েছে আমি ভাবছি আরাে শ’ দুই পৃষ্ঠা লিখে ফেলব। মােটামুটি সাড়ে তিনশ পৃষ্ঠার একটা কাজ।
‘ভাইসাব টেনে টুনে এটারে পাঁচশ করেন। একটা কাজ যখন হইতেছে ভাল করেই হােক।
পড়তে শুরু করি তাহলে? আলহামদুলিল্লাহ। এমদাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস গােপন করে চেয়ারে পা তুলে বসল। গত দু‘ঘন্টা যাবত এই জিনিষ শুনতে হচ্ছে। এখন মাথা ঘুরছে ভন ভন করে অথচ বলতে হচ্ছে অসাধারণ। এর নাম কপাল।।
‘এমদাদ সাহেব।
‘আপনি যদি কোন পয়েন্টে আমার সঙ্গে ডিফার করেন তাহলে দয়া করে বলে ফেলবেন। সংকোচ করবেন না। আমি নােট রাখব। কারণ বইটা অনেকবার রিরাইট করতে হবে। শুরু করি তাহলে?
‘জি আচ্ছা। সােবাহান সাহেব শুরু করলেন,
আমি ক্ষুধা সম্পর্কে প্রচুর উক্তি সংগ্রহ করিয়াছি। আগে জানিতে চাহিয়াছি অন্যে, ক্ষুধা প্রসঙ্গে কি ভাবিয়াছেন। তাহাদের ভাবনা আপাতত অত্যন্ত মনকাড়া হইলেও আমার কাছে কেন জানি ভ্রান্ত বলিয়া প্রতিয়মান হইতেছে। ক্ষুধা নিয়া বড় বড় মানুষ রঙ্গ রসিকতা করিয়াছেন মূল ধরিতে পারেন নাই। যেমন ফ্রাংকলিন বলিয়াছেন, না খেয়ে মানুষকে মরতে দেখেছি খুবই কম, অতিরিক্ত খেয়ে মরতে দেখেছি অনেককে।
ইহাকে আমি রসিকতা ছাড়া আর কি বলিব? উইল রজার বলিয়াছেন–ক্ষুধার্তরা তীক্ষ তলােয়ারের চেয়েও ধারালাে।
ইহাও কি একটি সুন্দর মিথ্যা নয়? ক্ষুধার্তা তীক্ষ্ণ তলােয়ারের মত ধারালাে হইলে দেশে বিপ্লব হইয়া যাইত। তাহা হয় নাই। — – –
এমদাদ সাহেব কি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? ‘জ্বি না! এই চোখ বন্ধ করে আছি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, চউখটা বন্ধ থাকলে শুনতে ভাল লাগে।”