বহুব্রীহি পর্ব (২৪)- হুমায়ূন আহমেদ

তুআনিসকে দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, স্লমালিকুম

বহুব্রীহি আনিস বলল, ওয়ালাইকুম সালামতুমি এমদাদ সাহেবের নাতনী তাই না? পুতুল তােমার নাম

দেখেছ কি অবস্থা? পুতুল কিছু না বলে মুখ নীচু করে হাসলআনিস বলল, এদের যন্ত্রণায় অস্থির হয়েছিএরা যা করছে তার নাম দুষ্টুমী নাহচ্ছে ইচ্ছা করে আমাকে কষ্ট দেয়া! তােমার পানির গ্লাসটা কি আমাকে দিতে পার

পুতুল গ্লাস এগিয়ে দিলআনিস এক চুমুকে পানি খেয়ে ফেললবিষন্ন গলায় বলল, এই ঘটনা কিন্তু আজ নতুন ঘটছে নাএটা পুরনাে ঘটনাআগেও কাটাকুটি খেলা একবার হয়েছেতখন তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কোনদিন খেলবে নাবার বার তো এটা হতে দেয়া যায় না। 

পুতুল বলল, বাদ দেনএরা ছােট মানুষতুমি ভুল বলছ পুতুওরা ছােট হলেও আমার সঙ্গে যা শুরু করেছে তা বড় মানুষদের খেলাএক ধরনের দাবা খেলাতারা একরকম চাল দিচ্ছে আমি এক রকম চাল দিচ্ছিআমার সংসার টিকে থাকবে কি থাকবে না এটা নির্ভর করছে এই খেলায় জয় পরাজয়ের উপর। 

এই মানুষটার কথা গুলি পুতুলের বড় ভাল লাগছেকি সহজ সরল ভঙ্গিতেই না পুতুলের সঙ্গে সে কথা বলছেযেন পুতুল তার কত দীর্ঘদিনের চেনা মানুষ অথচ এর আগে একদিন মাত্র কথা হয়েছেতাওকি নাম? দেশ কোথায়? রকম কথা। 

জ্বি। 

ওরা কোথায় পালিয়েছে তােমার কোন ধারণা আছে? জ্বি না। 

আচ্ছা ওদের খুঁজে বের করছি, তার আগে এসাে আমরা দুজন এক কাপ করে চা খাইনা কি তুমি চা খাও না

খাই” 

তাহলে বরং চা বানাওচা খাবার পর ঠিক করব টগর এবং নিশাকে কি শাস্তি দেয়া যায়। 

কত সহজ কত আন্তরিক ভাবেই না লােকটা কথা বলছে, শুনতে ভাল লাগছেমনে হচ্ছে তারা সবাই একই ছাদের নিচে দীর্ঘদিন ধরে আছে, যে ছাদের উপর ঝড়ে পড়েছে কত বৃষ্টি কত জ্যোত্মা। 

চা বানানাের কেরােসিন কুকার ঘরের এক কোণেই আছেকেরােসিন কুকার ধরাতে অসুবিধা হল নাচা বানাতে বানাতে হােট হােট সব কথা হতে লাগলপ্রতিটি প্রশ্নের জবাব আনিস খুব মমতার সঙ্গে দিলযেমন পুতুল বলল, ভাইজান আফনে কি করেন

আনিস হাসতে হাসতে বলল, আমি কিছুই করিনা, আবার অনেক কিছুই করিসেইটা কেমুন? আমি লিখি। একজন লেখককে দেখলে কখনাে মনে হবে না সে বিশেষ কিছু করছেহাতে হেলাফেলা করে ধরা একটা কাগজএকটা কলম বা পেন্সিলএকজন শ্রমিককে বিশাল এক খন্ড পাথর উপড়ে তুলতে কত না পরিশ্রম করতে হয়টপ টপ করে তার মাথা বেয়ে ঘাম পড়ে অথচ একজন লেখককে দেখবে কত অনায়াসে লিখছেঅপূর্ব সব লেখাএইসব লেখা কি তুমি কখনাে পড়েছ?‘ 

পুতুলের কথা শুনতেই ভাল লাগছে, জবাব দিতে ইচ্ছা করছে নাওদিকের মানুষটি বােধ হয় তা বুঝতে পারছেসে বলছেদেখ পুতুল লেখালেখি কি অদ্ভুত জিনিস মাত্র চার লাইনের একটা কবিতা, মাত্র দুলাইনের দুটি বাক্যে ধরা দিতে পারে মহান কোন বােধ, জীবনের গভীর ক্রন্দন। 

পুতুল চুপি চুপি বলল, একটা বলবেন? হ্যাঁ বলবআমি টগর নিশাকে প্রায়ই বলিতুমি যদি আস তুমিও শুনবেআজ না আজ থাকআজ আমার মনটা খারাপবাচ্চা দুটি বড় কষ্ট দিচ্ছেকি চাচ্ছে কিছু বুঝতেও পারছি নাপুতুল। 

তুমি কি আমাকে আরেক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াবে? কত সামান্য কথা অথচ পুতুলের এত ভাল লাগলতার ইচ্ছা করছে আনন্দে একটু কাঁদেতার কেন এত আনন্দ হল? এই আনন্দের উৎস কোথায়? এইত চোখ ভিজে উঠছেকেন, চোখ ভিজে উঠল কেন

টগর নিশা বিলুর পেছনে পেছনে রাত দশটায় শােবার ঘরে ঢুকল এবং কোনদিকে না তাকিয়ে বিছানায় উঠে পড়লমুহূর্তের মধ্যে তাদের চোখ বন্ধবড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেযেন ঘুমিয়ে কাদা! বিলু বলল, আনিস সাহেব দয়া করে এবারের মত বাচ্চাদের ক্ষমা করে দিনওরা যা করেছে তার জন্যে খুব লজ্জিত, দুঃখিত এবং অনুতপ্তভয়ে ঘরে আসতে চাচ্ছিল 

আমি অভয় দিয়ে নিয়ে এসেছি। 

আনিস বলল, থ্যাংক। ওরা আমাকে কথা দিয়েছে আর কোনদিন এরকম করবেনা। 

এই কথা, কথা পর্যন্তই! ওরা আবারাে রকম করবে এবং আপনার মতাে অন্য কাউকে ধরে নিয়ে আসবে যাতে ক্ষমা করা হয়কাজেই এবার ক্ষমার প্রশ্নই উঠে না” 

বিলু অবাক হয়ে বলল, আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি তারপরেও আপনি ক্ষমা করবেন ? তারপরেও এরকম কঠিন করে কথা বলছেন

হী বলছিকারণ আপনার আগে আপনার বাবা এদের একবার নিয়ে এসেছেন, আপনার মা নিয়ে এসেছেন,মিলি এনেছেএকবার কাদের এদের প্রটেকশন দিয়ে এনেছে। 

বিলু কঠিন স্বরে বলল, অথাৎ আপনি ওদের শাস্তি দেবেন

কি শাস্তি জানতে পারি? ওরা জানে কি শাস্তিওদেরকে আমি বলে রেখেছিযে, আবার যদি তারা কাটাকুটি খেলাখেলে তাহলে ওদের ফেলে রেখে আমি চলে যাবআপনি ওদের ফেলে রেখে চলে যাবেন? হাঁ‘ 

বেশ চলে যানআপনার সংসার আপনি চালাবেনযেভাবে চললে ভাল হয় সে ভাবে চালাবেন। 

আনিস রাত ১১টা দশ মিনিটে ব্যাগ হাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলবিলু সারাক্ষণই ভাবছিল এটা এক ধরণের ঠাট্টা হয়ত গেট পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসবেদেখা গেল ব্যাপার মােটেই ঠাট্টানাআনিস সত্যি সত্যি চলে গেছে

এমদাদ বলল, ভাইসাব এখন তাহলে উঠি? এগারােটার উপরে বাজে। সােবাহান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আমার লেখাটা পছন্দ হচ্ছে না

এমদাদ চোখ বড় বড় করে বলল, পছন্দ হচ্ছে না এইটা ভাইসাব কি বললেনজীবনের সার কথা তাে সবটাই আপনার লেখার মধ্যেক্ষুধা বিষয়টা যে কি আপনের লেখা পড়ার আগে জানতাম না। উপাষ দিছি ঠিকই কিন্তু ক্ষুধা বুঝি নাইএখন বুঝলাম। 

সােবাহান সাহেব বললেন, তাহলে কি বাকিটা পড়ব

অবশ্যই পড়বেনদেড়শ পৃষ্ঠার মত লেখা হয়েছে আমি ভাবছি আরাে দুই পৃষ্ঠা লিখে ফেলবমােটামুটি সাড়ে তিনশ পৃষ্ঠার একটা কাজ। 

ভাইসাব টেনে টুনে এটারে পাঁচশ করেনএকটা কাজ যখন হইতেছে ভাল করেই হােক। 

পড়তে শুরু করি তাহলে? আলহামদুলিল্লাহএমদাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস গােপন করে চেয়ারে পা তুলে বসলগত দুঘন্টা যাবত এই জিনিষ শুনতে হচ্ছেএখন মাথা ঘুরছে ভন ভন করে অথচ বলতে হচ্ছে অসাধারণএর নাম কপাল। 

এমদাদ সাহেব। 

আপনি যদি কোন পয়েন্টে আমার সঙ্গে ডিফার করেন তাহলে দয়া করে বলে ফেলবেনসংকোচ করবেন নাআমি নােট রাখবকারণ বইটা অনেকবার রিরাইট করতে হবেশুরু করি তাহলে

জি আচ্ছাসােবাহান সাহেব শুরু করলেন

আমি ক্ষুধা সম্পর্কে প্রচুর উক্তি সংগ্রহ করিয়াছিআগে জানিতে চাহিয়াছি অন্যে, ক্ষুধা প্রসঙ্গে কি ভাবিয়াছেনতাহাদের ভাবনা আপাতত অত্যন্ত মনকাড়া হইলেও আমার কাছে কেন জানি ভ্রান্ত বলিয়া প্রতিয়মান হইতেছে। ক্ষুধা নিয়া বড় বড় মানুষ রঙ্গ রসিকতা করিয়াছেন মূল ধরিতে পারেন নাইযেমন ফ্রাংকলিন বলিয়াছেন, না খেয়ে মানুষকে মরতে দেখেছি খুবই কম, অতিরিক্ত খেয়ে মরতে দেখেছি অনেককে। 

ইহাকে আমি রসিকতা ছাড়া আর কি বলিব? উইল রজার বলিয়াছেনক্ষুধার্তরা তীক্ষ তলােয়ারের চেয়েও ধারালাে। 

ইহাও কি একটি সুন্দর মিথ্যা নয়? ক্ষুধার্তা তীক্ষ্ণ তলােয়ারের মত ধারালাে হইলে দেশে বিপ্লব হইয়া যাইততাহা হয় নাই। – 

এমদাদ সাহেব কি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? জ্বি না! এই চোখ বন্ধ করে আছিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়, চউখটা বন্ধ থাকলে শুনতে ভাল লাগে” 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *