আলিশান দালান তুলতে হবে––
‘আমার এত সব দরকার নেই। আমি সুখেই আছি। ‘সুখে আছ? ‘য় সুখে।
মনসুর আসলেই সুখে আছে। তার উপর সংসারের দায় দায়িত্ব কিছু নেই। তার বাবা ময়মনসিংহ শহরে ওকালতী করেন। দেশের বাড়ির অবস্থা মন্দ নয়। ময়মনসিংহের এত বড় বাড়িতে মানুষ বলতে বাবা–মা এবং ছােট বােন নীলিমা। মনসুরকে টাকা রােজগার করে সংসার চালানাের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না। উল্টা প্রতিমাসে মনসুরের বাবা এক হাজার করে টাকা পাঠিয়ে ছােট একটা চিঠি লিখেন। প্রতিটি চিঠির ভাষা এবং বক্তব্য এক।
বাবা মনু,
টাকা পাঠালাম। শরীরের যত্ন নেবে। তুমি ঢাকা শহরে কেন পড়ে আছ তা বুঝতে পারছি না। তােমার নিজের শহরে প্র্যাকটিস করতে অসুবিধা কি? একটা ভাল
জায়গায় তােমার জন্য চেম্বার করে দেবার সামর্থ পরম করুণাময় আল্লাহতালা আমাকে দিয়েছেন। পত্রপাঠ মন স্থির করে আমাকে জানাবে।
–ইতি তােমার আবা। পুনশ্চ ১৪ আরাে টাকার দরকার হলে লিখবে। এই নিয়ে সংকোচ করবে না। টাকা পয়সা
তােমাদের জন্যেই। পুনশ্চ ২ঃ তােমার মার ইচ্ছা তােমার একটি বিবাহ দেন। ব্যাপারটা ভেবে দেখ। তােমার এখন
পঁচিশ চলছে। আমি চৰ্বিশ বছর বয়সে তােমার মাকে বিবাহ করি। বিবাহের জন্যে
এটাই উপযুক্ত বয়স। পুনশ্চ ৩ঃ তােমার নিজের কোন পছন্দ থাকলে আমাদের কোনই আপত্তি নাই, এটা তােমাকে
বলে রাখলাম। | বাবার চিঠির সঙ্গে মা‘র চিঠি থাকে। সেই চিঠিতে নানান অবান্তর কথার সঙ্গে একটি মেয়ের কথা থাকে। পুরাে চিঠি জুড়ে থাকে সেই মেয়ের রূপ এবং গুণের বর্ণনা, এবং সেই রূপবতী এবং গুণবতীর কয়েকটি রঙ্গীন ছবি।
গত সপ্তাহের চিঠিতে যে মেয়ের কথা ছিল তার নাম রূপা। মনসুরের মা লিখেছেন
বাবা মনু, এই মেয়েটির দিকে একবার তাকাইলে চোখ ফিরাইতে ইচ্ছা করে না। বড়ই রূপবতী মেয়ে। আচার ব্যবহারেও চমৎকার। এই সবই হয়েছে বংশের গুণ। মেয়ের মাতুল বংশ খুবই উচ্ছ। নান্দাইল রােডের সরদার পরিবার। এক ডাকে সবাই চিনে। মেয়ে মমিনুন্নেসা কলেজে বি এ ফাষ্ট ইয়ারে পড়ে। মেট্রিক ফাষ্ট ডিভিসন এবং জেনারেল অংকে লেটার পেয়েছিল। অসুখ নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ায় ফল বেশী ভাল হয় নাই। মেয়ে খুব ভাল গান গায়। কলেজের সব ফাংশানে নজরুল গীতি গায় এবং খুব প্রশংসা পায়। মেয়ের তিনটি ছবি পাঠালাম। তােমার পছন্দ হলে আরাে কথা বার্তা বলব।
চিঠির সঙ্গে খুব সেজেগুজে তােলা তিনটা ছবি। একটা ছবিতে সে টেলিফোন তুলে কার সঙ্গে কথা বলছে। একটীয় অবাক বিস্ময়ে পৃথিবীর দিকে অথাৎ ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্য ছবিটা ফুলের বাগানে তোেলা। আউট অব ফোকাস হওয়ায় মেয়েটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, ফুলগুলি বড় সুন্দর এসেছে।
এইসব চিঠি এবং চিঠির সঙ্গে ছবি পেতে মনসুরের মন্দ লাগে না। ভালই লাগে। কোন এক লজ্জাবনত তরুনীর সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে এই কল্পনাও তার কাছে মধুর বলে মনে হয়।
গ্রীন ফার্মেসীর জীবন এবং তার সঙ্গে মধুর কিছু কল্পনায় তার সময় ভালই কাটছিল। একটা মেয়ে হঠাৎ করে এসে সব এলােমেলাে করে দিল। ঐ মেয়েটার কারণে ক দিন ধরেই মনসুরের মনে হচ্ছে–মানব জীবন একটা যন্ত্রণা বিশেষ। তার রাত্রে ভাল ঘুম হচ্ছে না। হজমের অসুবিধা হচ্ছে। ঘটনাটা এ রকম
গত বুধবারে খুব মেঘলা হিল। দুপুরে টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। কুদ্স সাহেব ভাত খেতে গেছেন। দোকানের এক কর্মচারী মজনু বলল, স্যার আপনি একটু বসেন আমি লন্ডী থেকে কাপড় নিয়ে আসি। মনসুর বলল, যাও আমি আছি। মজনু চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি মেয়ে এসে ঢুকল। পরণে সাধারণ নীল রঙের একটা শাড়ি। মাথার চুল খােপা করা। খােপা ভাল করে করা হয়নি–চুল এলােমেলাে হয়ে আছে। মেয়েটির দিকে তাকিয়েই মনসুরের কেমন যেন লাগতে লাগল। এমন সুন্দর মানুষ এই পৃথিবীতে আছে? ছেলেবেলার রূপকথার বই–এ যে সব বন্দিনী রাজকন্যার ছবি থাকে এই মেয়ে তারচেয়েও লক্ষগুণ সুন্দর। কেমন।
মায়া মায়া চোখ, সমস্ত চেহারায় কি অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধ ভাব। মেয়েটা এত সুন্দর যে তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত মনসুরের কষ্ট হচ্ছে।
মেয়েটা নরম স্বরে বলল, আপনাদের কাছে স্যাভলন বা ডেটল জাতীয় কিছু আছে? মনসুর কীপা কাঁপা গলায় বলল, জ্বি আছে। ‘মাজারি সাইজের একটা ফাইল দিন।
এক্ষুণী দিচ্ছি। আপনি বসুন। ঐ চেয়ারটায় বসুন। মেয়েটি বিস্মিত গলায় বলল, বসতে হবে কেন? জিনিসটা দিন চলে যাই। দাম কত? মনসুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, দাম লাগবে না। মেয়েটি আরাে অবাক হয়ে বলল, দাম লাগবে না কেন?
না মানে কোম্পানী থেকে আমরা অনেক স্যাম্পল ফাইল পাইতাে–এটা হচ্ছে একটা স্যাম্পল ফাইল। | মেয়েটি বিরক্ত গলায় বলল, স্যাম্পল ফাইল আমাকে দেবার দরকার নেই অন্য কাউকে দেবেন। দাম কত বলুন।
‘দামতো আমি জানি না। দাম জানেন না মানে? ‘আমাদের কর্মচারী লীতে গেছে। ওসব জানে। এক্ষুণী এসে পড়বে। ‘আপনি তাহলে কে?‘ ‘আমি ডাক্তার। মানে এই ফার্মেসীতে বসি। সকাল বিকাল দু’বেলাই থাকি। আপনি ঐ চেয়ারটায় বসুন।
‘বসতে পারব না আমার তাড়া আছে। আমার মা বটিতে হাত কেটে ফেলেছেন। হাতে ডেটল দিতে হবে।
মনসুর অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে বলল, চলুন যাই ড্রেস করে দিয়ে আসি। কাটা ছেড়া ছােট হলেও একে অবহেলা করা ঠিক না। সেপটিক হয়ে যেতে পারে।
মেয়েটি খুবই অবাক হল। কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকাতে লাগল। শান্ত গলায় বলল, মা‘র হাতের কাটা এমন কিছু না। | মজনু এই সময় ফিরে এল। মেয়েটা টাকা দিয়ে স্যাভলনের শিশি হাতে নিয়ে চলে গেল। মনসুরের সারাটা দিন আর কোন কাজে মন বসল না। আশ্চর্যের ব্যাপার সেই রাতে সে ঘুমুতে পারল না। একটা মেয়েকে একবার দেখে কারাের এমন হয়?
দ্বিতীয় দিনে মেয়েটির সঙ্গে আবার দেখা। বই খাতা নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিল। ভাগ্যিস ঠিক সেই সময়ে মনসুর বের হয়েছিল সিগারেট কিনতে। মনসুর জীবনে যা কোনদিন করেনি তাই করল, এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার মা ভাল আছেন?
মেয়েটি বিস্মিত হয়ে বলল, আমাকে বলছেন? মনসুর থতমত খেয়ে বলল, জ্বি। আপনাকে তাে আমি চিনতে পারছিনা। ‘আমি গ্রীণ ফার্মেসীতে বসি। ডাক্তার। আপনি এক বােতল স্যাভলন কিনে নিয়ে গেলেন। আপনার মা‘র হাত কেটে গিয়েছিল।
ও আচ্ছা মনে পড়েছে। মা ভাল আছেন। আমি এখন যাই, কেন?
মেয়েটি তাকে চিনতে পারল না এই দুঃখে দ্বিতীয় রাতে ও কম এi ! দু‘ সিডাকসিন খেয়েও সে সারা রাত জেগে কাটাল। মেয়েটির সম্পকে যাৰ তথ্য সে এখন
জানে। তার নাম মিলি। ভাল নাম ইয়াসমীন। ইকনমিক্সে অনার্স পড়ে–সেকেন্ড ইয়ার। যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়ির নাম নিরিবিলি! বাড়ির গেটে একটা সাইনবাের্ড ঝুলে, সেখানে লেখা–কুকুর হইতে সাবধান। যদিও সে বাড়িতে কুকুর নেই। মেয়েটি বিকেলে বাড়ির ছাদে একা হাঁটাহাটি করে। সে ইউনিভার্সিটিতে যায় সকাল আটটায়। রাস্তার মােড় পর্যন্ত হেঁটে যায়। তারপর রিকশা নেয়। রিকশার হুড তুলে না। সব সময় শাড়ি পরে। মেয়েটার নিশ্চয়ই অনেক শাড়ি! এখন পর্যন্ত এক শাড়ি দু’বার পরতে মনসুর দেখেনি। মেয়েটি ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পরে। অবশ্যি সে বেশ লম্বা, হিল পরবার তার প্রয়ােজন নেই। | মেয়েটি তাকে চিনতে পারে কি–না এটা পরীক্ষা করবার জন্যে আজ সকালে সে মেয়েটার ইউনিভার্সিটিতে যাবার সময় সামনাসামনি পরে গেল। মেয়েটি চোখ তুলে তাকে দেখল। মনসুর কীপা গলায় বলল, ভাল আছেন?