আপনার পুত্রতাে সর্বনাশ করে দিয়েছিল। দোতলায় উঠে দেখি বুন্দা বুন্দা ধূয়া। কোথায় আমাকে দেখে ভয় পাবে তা না উল্টা ছেলে আমাকে বলে—আপনি এখন যান, আমরা খেলছি। আপনাকে দেখে মনেই হয় না যে আপনার এমন বিচ্ছু ছেলে মেয়ে আছে।
আনিস গম্ভীর গলায় বলল, আপনি আপনার বাবার মত হয়েছেন, সবাই সে রকম হয় না।
খুবই খাটি কথা। তাছাড়া বড় ভাই সাহেব একটা ব্যাপার কি জানেন? অল্প বয়সে মা মারা গেলে ঘাড়ের একটা রগ তেড়া হয়ে যায়। ওদের তাই হয়েছে। রগ হয়ে গেছে তেড়া।
হতে পারে।
এদের সামলাবার জন্যে আপনার একটা বিবাহ করা দরকার। ঘরের শাসন হচ্ছে আসল শাসন। নেন কেক মুখে দেন। ফ্রেঞ্চ বেকারীর কেক। একশ টাকা পাউন্ড।
আনিস কেক মুখে দিল। সুলায়মান সাহেব মধুর গলায় বললেন, ‘অনেক পুরুষ আছে যারা মনে করে সংসারে সৎ মা এলে ছেলেপুলেদের উপর অত্যাচার হবে। কথা ঠিক। অত্যাচার হয়। তবে বুঝে শুঝে বউ আনলে হয় না। | আমি বুঝে সুঝেই আনব।‘
‘বুদ্ধি কম এমন মেয়ে বিবাহ করতে হবে। বুদ্ধি কম মেয়ে মুখের একটা মিষ্টি কথাতেই খুশি হয়। এদের খুশি করা খুব সােজা। নিউ মার্কেট থেকে আসার পথে এক টাকা দিয়ে একটা ফুলের মালা কিনে নিয়ে গেলেন–এতেই খুশি আর বৌ যদি বুদ্ধিমতী হয় তাহলে কিছুতেই খুশি হবে না। জ্বালিয়ে মারবে। বােকা স্ত্রীর সংসার হচ্ছে সুখের সংসার।
আনিস বলল, বােকা মেয়ে পাওয়াইতাে মুশকিল। সব মেয়েরই বুদ্ধি বেশি। ‘বড় ভাই সাহেব, ভুল কথা বললেন, পুরুষের চেয়ে মেয়েদের বুদ্ধি অনেক কম। ‘তাই–না–কি?
‘হ্যা। আমার মুখের কথা না, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। একজন পুরুষ মানুষের ব্রেইনের ওজন হচ্ছে ১,৩৭৫ গ্রাম। আর একজন মেয়ে মানুষের ১,২২৫ গ্রাম। একশ পঞ্চাশ গ্রাম কম।
এই তথ্য পেয়েছেন কোথায়? ‘খােজ খবর রাখি বড় ভাই। একেবারে মূখতাে না। কই, এখানে চা দিল না। ‘পেপসি খেলামতাে আবার চা কেন? ‘পেপসি খেলেন পানির বদলে। চা ছাড়া নাস্তা শেষ হয় নাকি? হয় না।
আনিস নাস্তার শেষে চা এর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। সুলায়মান সাহেব বললেন, বড় ভাই সাহেব, এবার একটু কাজের কথা বলি।
‘বলুন। ‘ফ্ল্যাটটা যে বড়ভাই ছেড়ে দিতে হয়। ‘ছেড়েই দেব। বাড়ি খুঁজছি। বিশ্বাস করুন খুজছি। পাওয়া মাত্র ছেড়ে দেব।
বুধবারের মধ্যেই যে ছেড়ে দিতে হয় ভাই সাহেব। আমি একজনকে জবান দিয়ে ফেলেছি, সে বুধবারে বাড়িতে উঠবে। জবান তাে বড় ভাই সাহেব রক্ষা করতে হয়।
‘আমি যদি এর মধ্যে কিছু খুঁজে না পাই–আমি যাব কোথায়? ‘আমি আমার একটা ঘর ছেড়ে দিব। মেহমান হিসেবে কয়েকদিন থাকবেন। চা এসে গিয়েছে। আনিস চায়ে চুমুক দিল। কি বলবে ভেবে পেল না। ‘বড় ভাই সাহেব। “জ্বি বলুন।
‘বলতে শরম লাগছে–না বলেও পারছি না। আপনার কাছে তিন মাসের ভাড়া পাওনা আছে। বলেছিলেন একটা ব্যবস্থা করবেন।‘
‘অবশ্যই করব।‘
‘তা করবেন জানি। কিন্তু ভাইসাহেব যাওয়ার আগে করে যাওয়াটা কি ভাল না। একবার চলে গেলে আপনার হয়ত মনে থাকবে না।‘
আনিস তিক্ত গলায় বলল, এই মুহূর্তে আমার হাত একেবারে খালি তবে স্ত্রীর কিছু গয়না আছে। ঐগুলি বিক্রী করে হলেও আপনার পাওনা মিটিয়ে দেব।
‘এইটা খুব ভাল কথা বলেছেন। যে পুরুষ ঋণ রেখে এক কদম পা ফেলে না, সে হচ্ছে সাঙ্গা পুরুষ। বড় ভাই সাহেব, আমার একটা পরিচিত গয়নার দোকান আছে। আপনি যদি চান আপনাকে নিয়ে যাব।‘
‘ঠিক আছে যাব আপনার সঙ্গে। ‘কাল বিকালে কি আপনার সময় হবে?
হবে। এখন তাহলে উঠি? না–কি আরাে কিছু খাওয়াবেন? সুলায়মান সাহেব হাে হাে করে অনেকক্ষণ হাসলেন। যেন এরকম মজাদার কথা অনেকদিন শােনেননি। আনিস শীতল গলায় বলল, এরকম শব্দ করে হাসবেন না সুলায়মান। সাহেব। শব্দ করে হাসলে হার্টে প্রেসার পড়ে। আপনার যা বয়স তাতে হার্টে বাড়তি প্রেসার দেয়াটা ঠিক হবে না।
‘সত্যি বলছেন?
‘হ্যা সত্যি। হাসাহাসি একেবারেই করবেন না। সব সময় মন খারাপ করে বসে থাকবেন। তাহলেই দেখবেন হার্ট ভাল থাকবে, অনেক দিন বাচতে পারবেন।‘
‘অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছা করে না। যত তাড়াতাড়ি কবরে যেতে পারব ততই ভাল। ‘তাড়াতাড়ি করে চলে গেলে এই যে টাকা পয়সা রােজগার করছেন সেগুলি ভােগ করবে কে? ভােগ করবার জন্যেই তাে আপনার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা দরকার।
আপনি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন। “হা করছি।” ‘হাসলে হার্টের উপর চাপ পড়ে ঐটাও তাহলে ঠাট্টা? ‘না ঐটা ঠাট্টা না। ঐটা সত্যি। যে কারণে হাসি খুশী মানুষদের বেশী দিন বাঁচতে দেখা যায় । বেঁচে থাকে খিট খিটে গম্ভীর মানুষজন। দেখেন না পৃথিবী ভর্তি বদমেজাজী বুড়াে–বুড়ি।
‘কথাটাতাে ভাইসাহেব খুবভুল বলেন নাই।
কথা আমি সচরাচর ভুল বলি না। আচ্ছা আজ তাহলে যাই। কাল সন্ধ্যায় দেখা হবে। এক সঙ্গে গয়নার দোকানে যাব।‘
‘ইনসাআল্লাহ।
হাসির ব্যাপারটা মনে রাখবেন। হাসি সম্পূর্ণ বন্ধ। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে হলে রাম গরুর ছানা হতে হবে।
নিজের ঘরে ঢুকে আনিসের মন খারাপ হয়ে গেল। টগর এখনাে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশা রণে ভঙ্গ দিয়ে ছবি আঁকছে। বাবাকে দেখে নিশা বলল, টগর ভাইয়ার শাস্তি আর কতক্ষণ হবে বাবা?
আনিস বলল, শাস্তি শেষ।। টগর বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল। আনিস বলল, পা ব্যথা করছে? ‘হু করছে।
আর কোনদিন ফায়ার ব্রিগেড খেলা খেলবে না তাে? টগর না সূচক মাথা নাড়ল। আনিস বলল, মাথা নাড়লে হবে না! বল, আর কোনদিন খেলব ।
আর কোনদিন খেলব না। ‘ভেরি গুড। তােমরা এখন হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস। আমি রান্না শেষ করি। ‘নিশা বলল, আমি কি তােমাকে সাহায্য করব বাবা? ‘না। সাহায্য লাগবে না। আজ তােমাদের কি খেতে ইচ্ছা করছে বল? ডিমের ভাজী না তরকারী ?
টগর বলল, আমরা রােজ ডিম খাচ্ছি কেন বাবা? ‘ডিম রান্না সবচে সহজ এই জন্যে রােজ ডিম খাচ্ছি।
নিশা গম্ভীর গলায় বলল, আমরা পৃথিবীর সব ডিম খেয়ে শেষ করে ফেলছি তাই না বাবা?
‘হ্যা তাই। এখন বই নিয়ে বস।” ‘বই নিয়ে বসতে ইচ্ছা করছে না।
কি ইচ্ছা করছে? নিশা অবিকল বড়দের মত গলায় বলল, কি যে ইচ্ছা করছে তাও তাে জানি না।
আনিস হেসে ফেলল। তার ছােট মেয়েটি বড় মায়াবতী হয়েছে। কথা বলার কি অদ্ভুত ধরণ। কোথেকে পেয়েছে এসব?
টগর বলল, আজ রাতে কি গল্প বলার আসর বসবে বাবা? ‘এখনাে বুঝতে পারছি না। সাম্ভাবনা আছে।‘
গল্প বলার আসর শেষ পর্যন্ত বসল না। নিশা ঘুমিয়ে পড়েছে। একা একা গল্প শুনতে টগরের ভালাে লাগে না। অথচ তার ঘুমও আসছে না।