বহুব্রীহি পর্ব (৬)- হুমায়ূন আহমেদ

আপনার পুত্রতাে সর্বনাশ করে দিয়েছিলদোতলায় উঠে দেখি বুন্দা বুন্দা ধূয়াকোথায় আমাকে দেখে ভয় পাবে তা না উল্টা ছেলে আমাকে বলেআপনি এখন যান, আমরা খেলছিআপনাকে দেখে মনেই হয় না যে আপনার এমন বিচ্ছু ছেলে মেয়ে আছে। 

বহুব্রীহিআনিস গম্ভীর গলায় বলল, আপনি আপনার বাবার মত হয়েছেন, সবাই সে রকম হয় না। 

খুবই খাটি কথাতাছাড়া বড় ভাই সাহেব একটা ব্যাপার কি জানেন? অল্প বয়সে মা মারা গেলে ঘাড়ের একটা রগ তেড়া য়ে যায়ওদের তাই হয়েছেরগ হয়ে গেছে তেড়া। 

হতে পারে। 

এদের সামলাবার জন্যে আপনার একটা বিবাহ করা দরকারঘরের শাসন হচ্ছে আসল শাসননেন কেক মুখে দেনফ্রেঞ্চ বেকারীর কেকএকশ টাকা পাউন্ড। 

আনিস কেক মুখে দিলসুলায়মান সাহেব মধুর গলায় বললেন, অনেক পুরুষ আছে যারা মনে করে সংসারে সৎ মা এলে ছেলেপুলেদের উপর অত্যাচার হবেকথা ঠিকঅত্যাচার হয়তবে বুঝে শুঝে বউ আনলে য় না| আমি বুঝে সুঝেই আনব‘ 

বুদ্ধি কম এমন মেয়ে বিবাহ করতে হবেবুদ্ধি কম মেয়ে মুখের একটা মিষ্টি কথাতেই খুশি হয়এদের খুশি করা খুব সােজানিউ মার্কেট থেকে আসার পথে এক টাকা দিয়ে একটা ফুলের মালা কিনে নিয়ে গেলেনএতেই খুশি আর বৌ যদি বুদ্ধিমতী হয় তাহলে কিছুতেই খুশি হবে না। জ্বালিয়ে মারবেবােকা স্ত্রীর সংসার হচ্ছে সুখের সংসার। 

আনিস বলল, বােকা মেয়ে পাওয়াইতাে মুশকিলসব মেয়েরই বুদ্ধি বেশিবড় ভাই সাহেব, ভুল কথা বললেন, পুরুষের চেয়ে মেয়েদের বুদ্ধি অনেক কমতাইনাকি

হ্যাআমার মুখের কথা না, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারএকজন পুরুষ মানুষের ব্রেইনের ওজন হচ্ছে ,৩৭৫ গ্রামআর একজন মেয়ে মানুষের ,২২৫ গ্রামএকশ পঞ্চাশ গ্রাম কম। 

এই তথ্য পেয়েছেন কোথায়? খােজ খবর রাখি বড় ভাইএকেবারে মূখতাে নাকই, এখানে চা দিল নাপেপসি খেলামতাে আবার চা কেন? পেপসি খেলেন পানির বদলেচা ছাড়া নাস্তা শেষ হয় নাকি? হয় না। 

আনিস নাস্তার শেষে চা এর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলসুলায়মান সাহেব বললেন, বড় ভাই সাহেব, এবার একটু কাজের কথা বলি। 

বলুনফ্ল্যাটটা যে বড়ভাই ছেড়ে দিতে হয়ছেড়েই দেব। বাড়ি খুঁজছিবিশ্বাস করুন খুজছিপাওয়া মাত্র ছেড়ে দেব। 

বুধবারের মধ্যেই যে ছেড়ে দিতে হয় ভাই সাহেবআমি একজনকে জবান দিয়ে ফেলেছি, সে বুধবারে বাড়িতে উঠবেজবান তাে বড় ভাই সাহেব রক্ষা করতে হয়। 

আমি যদি এর মধ্যে কিছু খুঁজে না পাইআমি যাব কোথায়? আমি আমার একটা ঘর ছেড়ে দিবমেহমান হিসেবে কয়েকদিন থাকবেনচা এসে গিয়েছেআনিস চায়ে চুমুদিলকি বলবে ভেবে পেল নাবড় ভাই সাহেবজ্বি বলুন। 

বলতে শরম লাগছেনা বলেও পারছি নাআপনার কাছে তিন মাসের ভাড়া পাওনা আছেবলেছিলেন একটা ব্যবস্থা করবেন‘ 

অবশ্যই করব‘ 

তা করবেন জানিকিন্তু ভাইসাহেব যাওয়ার আগে করে যাওয়াটা কি ভাল নাএকবার চলে গেলে আপনার হয়ত মনে থাকবে না‘ 

আনিস তিক্ত গলায় বলল, এই মুহূর্তে আমার হাত একেবারে খালি তবে স্ত্রীর কিছু গয়না আছেঐগুলি বিক্রী করে হলেও আপনার পাওনা মিটিয়ে দেব। 

এইটা খুব ভাল কথা বলেছেনযে পুরুষ ঋণ রেখে এক কদম পা ফেলে না, সে হচ্ছে সাঙ্গা পুরুষবড় ভাই সাহেব, আমার একটা পরিচিত গয়নার দোকান আছেআপনি যদি চান আপনাকে নিয়ে যাব‘ 

ঠিক আছে যাব আপনার সঙ্গেকাল বিকালে কি আপনার সময় হবে

হবেএখন তাহলে উঠি? নাকি আরাে কিছু খাওয়াবেন? সুলায়মান সাহেব হাে হাে করে অনেকক্ষণ হাসলেনযেন এরকম মজাদার কথা অনেকদিন শােনেননিআনিস শীতল গলায় বলল, এরকম শব্দ করে হাসবেন না সুলায়মানসাহেবশব্দ করে হাসলে হার্টে প্রেসার পড়েআপনার যা বয়স তাতে হার্টে বাড়তি প্রেসার দেয়াটা ঠিক হবে না। 

সত্যি বলছেন

হ্যা সত্যিহাসাহাসি একেবারেই করবেন নাসব সময় মন খারাপ করে বসে থাকবেনতাহলেই দেখবেন হার্ট ভাল থাকবে, অনেক দিন বাচতে পারবেন‘ 

‘অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছা করে নাযত তাড়াতাড়ি কবরে যেতে পারব ততই ভালতাড়াতাড়ি করে চলে গেলে এই যে টাকা পয়সা রােজগার করছেন সেগুলি ভােগ করবে কে? ভােগ করবার জন্যেই তাে আপনার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা দরকার। 

আপনি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেনহা করছিহাসলে হার্টের উপর চাপ পড়ে ঐটাও তাহলে ঠাট্টা? না ঐটা ঠাট্টা নাঐটা সত্যিযে কারণে হাসি খুশী মানুষদের বেশী দিন বাঁচতে দেখা যায় বেঁচে থাকে খিট খিটে গম্ভীর মানুষজনদেখেন না পৃথিবী ভর্তি বদমেজাজী বুড়ােবুড়ি। 

কথাটাতাে ভাইসাহেব খুবভুল বলেন নাই। 

কথা আমি সচরাচর ভুল বলি নাআচ্ছা আজ তাহলে যাইকাল সন্ধ্যায় দেখা হবেএক সঙ্গে গয়নার দোকানে যাব‘ 

ইনসাআল্লাহ। 

হাসির ব্যাপারটা মনে রাখবেনহাসি সম্পূর্ণ বন্ধদীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে হলে রাম গরুর ছানা হতে হবে। 

নিজের ঘরে ঢুকে আনিসের মন খারাপ হয়ে গেলটগর এখনাে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছেনিশা রণে ভঙ্গ দিয়ে ছবি আঁকছেবাবাকে দেখে নিশা বলল, টগর ভাইয়ার শাস্তি আর কতক্ষণ হবে বাবা

আনিস বলল, শাস্তি শেষটগর বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলআনিস বলল, পা ব্যথা করছে? হু করছে। 

আর কোনদিন ফায়ার ব্রিগেড খেলা খেলবে না তাে? টগর না সূচক মাথা নাড়লআনিস বলল, মাথা নাড়লে হবে না! বল, আর কোনদিন খেলব । 

আর কোনদিন খেলব নাভেরি গুড। তােমরা এখন হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসআমি রান্না শেষ করিনিশা বলল, আমি কি তােমাকে সাহায্য করব বাবা? নাসাহায্য লাগবে নাআজ তােমাদের কি খেতে ইচ্ছা করছে বল? ডিমের ভাজী না তরকারী

টগর বলল, আমরা রােজ ডিম খাচ্ছি কেন বাবা? ডিম রান্না সবচে সহজ এই জন্যে রােজ ডিম খাচ্ছি। 

নিশা গম্ভীর গলায় বলল, আমরা পৃথিবীর সব ডিম খেয়ে শেষ করে ফেলছি তাই না বাবা

হ্যা তাইএখন বই নিয়ে বসবই নিয়ে বসতে ইচ্ছা করছে না। 

কি ইচ্ছা করছে? নিশা অবিকল বড়দের মত গলায় বলল, কি যে ইচ্ছা করছে তাও তাে জানি না। 

আনিস হেসে ফেললতার ছােট মেয়েটি বড় মায়াবতী হয়েছেকথা বলার কি অদ্ভুত ধরণকোথেকে পেয়েছে এসব

টগর বলল, আজ রাতে কি গল্প বলার আসর বসবে বাবা? এখনাে বুঝতে পারছি নাসাম্ভাবনা আছে‘ 

গল্প বলার আসর শেষ পর্যন্ত বসল নানিশা ঘুমিয়ে পড়েছেএকা একা গল্প শুনতে টগরের ভালাে লাগে নাঅথচ তার ঘুমও আসছে না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *