বাগেরহাট দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশের একটি জেলা। এটি খুলনা বিভাগ এর অন্তর্গত। বাগেরহাট জেলা মোট ৯ টি উপজেলায় বিভক্ত। বাগেরহটে প্রথম বসতি স্থাপন করে অনার্য শ্রেণীর মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছে ভূমধ্য সাগরীয় অষ্ণল হতে আসা অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় এবং মঙ্গোলীয় আলাপাইন প্রভৃতি। এ অষ্ণলে অনার্য প্রভাবের বড় নিদর্শন হল পৌন্ড্রক্ষত্রিয় সম্প্রদায়। এ জেলার বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে রামপাল উপজেলায় এ সম্প্রদায়ের লোক বেশী বাস করে। পৌন্ড্র শব্দের অপভ্রংশ পুড়া বা পোদ।
পৌন্ড্র শব্দজাত যার অর্থ ইক্ষু। অনার্য শ্রেণীভূক্ত নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ ও বাগেরহাটে প্রচুর বাস করে। এদের পূর্ব নাম চন্ডাল। এরা বরেন্দ্র অষ্ণল হতে এসে এখানে বসবাস শুরু করে। এ ছাড়া বাগেরহাটে এক শ্রেণীর মৎস্য শিকারী বা জেলে বসবাস করে যাদের আদি পুরুষ নিগ্রোবটু (নিগ্রয়েড)। এরা ভারত উপমহাদেশের আদিমতম অধিবাসী।
খ্রীষ্ট্রের জন্মের প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়া হতে এ অষ্ণলে আর্য তথা আদি নর্কিভ বা ইন্ডিভদের আগমণ ঘটে। আর্য-অনার্যের শোণিত ধারাই এ অষ্ণলের অধিবাসীদের মধ্যে বসত্ত পূজারী অনার্যগণ কৌমধর্ম (টাইবাল ধর্ম) অনুসরণ করতো। শক্তি পূজারী আর্যরা উভয় ধর্মের আচার অনুষ্ঠান রীতিনীতির মিশ্রণে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দুধর্ম।
বাগেরহাটের অতি প্রাচীন স্থান পানিঘাটে প্রাপ্ত কষ্টি পাথরের অষ্টায়ণ ভূজা দেবীমূর্তি, মরগা খালের তীরে খানজাহান আলী (রঃ) এর পাথর ভর্তি জাহাজ ভিড়বার স্থান জাহাজঘাটায় মাটিতে গ্রোথিত পাথরে উৎকীর্ণ অষ্টাদশ ভূজ মহিষ মর্দিনী দেবীমূর্তি, চিতলমারী উপজেলাধীন খরমখালি গ্রামে প্রাপ্ত কৃষ্ণ প্রস্তরের বিষ্ণু মূর্তি ইত্যাদি নিদর্শন।
এখানে হিন্দু সভ্যতা বিকাশের পরিচয় বহন করে। ১৪৫০ খ্রিঃ খানজাহান আলী (রঃ) খাঞ্জেলী দীঘি খনন করান। এ সময় অনন্য সাধারণ ধ্যাণী বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে বৌদ্ধ পুরোহিত বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো পাল আমলে নির্মিত ঐ বৌদ্ধমূর্তিটি কমলাপুর বৌদ্ধ বিহারে সংস্থাপন করেন। এটা এ অষ্ণলে বৌদ্ধ প্রভাবের পরিচয় বহন করে।
বাগেরহাট জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
- দশ গম্বুজ মসজিদ
- রেজা খোদা মসজিদ
- কোদাল মঠ
- নয় গম্বুজ মসজিদ
- মংলা বন্দর
- রণবিজয়পুর মসজিদ
- খান জাহান আলী (রঃ) এর মাজার
- ষাট গম্বুজ মসজিদ
- সুন্দরবন
- করমজল
- সুন্দরবন রিসোর্ট বারাকপুর
- চন্দ্রমহল রনজিতপুর
- চুনাখোলা মসজিদ
- ঠান্ডা পীর মসজিদ
- বিবি বেগুনি মসজিদ
- সিংগাইর মসজিদ
- জিন্দা পীর মসজিদ
ষাটগম্বুজ মসজিদ, বাগেরহাট
ষাটগম্বুজ বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। মসজিদটির গায়ে কোন শিলালিপি নেই। তাই এটি কে নির্মাণ করেছিলেন বা কোন সময়ে নিমার্ণ করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে এটি যে খান-ই-জাহান নির্মাণ করেছিলেন, সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকে না। ধারণা করা হয়, তিনি ১৫০০ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেন। এ মসজিদটি বহু বছর ধরে এবং বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে।
এটি বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো এ সম্মান প্রদান করে। মসজিদের চার কোণে চরটি মিনার আছে। মসজিদের ভেতরে ৬০টি স্তম্ভ আছে। এগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণে ছয় সারিতে অবস্থিত এবং প্রত্যেক সারিতে ১০টি করে স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভই পাথর কেটে বানানো, শুধু পাঁচটি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এই ৬০টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ। মসজিদটির নাম ষাটগম্বুজ (৬০গম্বুজ) হলেও এখানে গম্বুজ মোটেও ৬০টি নয়, গম্বুজ ১১টি সারিতে মোট ৭৭টি।
খানজাহান আলী সমাধিসৌধ
খানজাহান আলী (রহ.) কে বলা হতো রাজনৈতিক সন্ন্যাসী। রাজ্য শাসন ছিল তার দায়িত্ব, ধর্ম প্রচার ছিল তার কর্তব্য, সুফিসাধনা ছিল তার আধ্যাত্ন, প্রজার কল্যাণ ছিল তার লক্ষ্য এবং শিল্পসমৃদ্ধ স্থাপনা নির্মাণ ছিল তার আনন্দ। বস্তুত তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত নির্মাতা। সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের পথে-প্রান্তরে রয়েছে তার অসংখ্য কীর্তিমাখা নিদর্শন। বাগেরহাট শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং খুলনা শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে খানজাহান আলী (রহ.) সমাধিসৌধ অবস্থিত। খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক থেকে ৩০০ গজ দূরে এর অবস্থান। বাস থেকে নেমে এটুকু পথ আপনাকে হেঁটে যেতে হবে। পথের পাশে রয়েছে সারি সারি দোকান। দূর থেকে স্থানটি আপনকে হেটে যেতে হবে। পথের পাশে রয়েছে সারি সারি দোকান।
দূর থেকে স্থানটি টিলার মতো উঁচু মনে হবে। ধারণা করা হয় খাঞ্জালি দীঘিটি খননের ফলে যে বিপুল মাটির স্তূপ জমা হয়, তার ওপর এই স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এই সমাধিতে প্রবেশের সময় আপনার চোখে পড়বে একটি আকর্ষণীয় উঁচু ফটক। এই ফটক পার হলেই সমাধিসৌধটি দৃষ্টিগোচর হবে। এই সমাধিসৌধের প্রবেশপথ রয়েছে দুটি। পূর্বদিকের প্রবেশপথটি কারুকার্যময়। তবে সবসময় বদ্ধ থাকে।
দক্ষিণের প্রবেশপথটি সবসময় খোলা থাকে। বর্তমানে এই কমপ্লেক্সের ভেতর আপনি আরও দেখতে পাবেন নজরকাড়া এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি বিশাল মসজিদ। খানজাহান আলীর (রহ.) সমাধিসৌধের নির্মাণশৈলী ও নির্মাণসামগ্রী আপনাকে বিস্মিত করবে। এর উপরের অংশটি ইট নির্মিত একটি অর্ধবৃত্তাকার বিশাল গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। চারকোণে চার-চারটি কুইঞ্জ গম্বুজটির ভার বহন করছে। কুইঞ্জের কোণে ৪টি টাওয়ার রয়েছে। এতে রয়েছে ঘুরানো ত্রিমাত্রিক বাঁকানো কার্নিশ। বৈশিষ্ট্যে তা বাংলার স্বকীয় স্থাপত্য রীতির পরিচয় বহন করে।
এই সমাধিসৌধের গোলাকৃতির টাওয়ার, দেয়ালের খালি গাত্রাদেশ এবং খিলানের নির্মাণরীতি বাইরে থেতে আগত। সমাধিসৌধের নিচের দিকটি পাথরে নির্মিত। লক্ষ্য করলে দেখবেন বড় বড় খাজকাটা পাথর দ্বারা তা নির্মিত হয়েছে। সমাধিসৌধের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখতে পাবেন খানজাহান আলী (রহ.) কবরটি কালো পাথরে নির্মিত। তাতে ফার্সি ভাষায় বিভিন্ন উদ্ধিৃতি লেখা রয়েছে। সমাধিসৌধের বাইরে রয়েছে এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি বিশাল মসজিদ। নির্মাণকাল ১৪৫০ সাল। এই মসজিদে খানজাহান আলী জুমার নামাজ পড়তে আসতেন এবং নামাজ শেষে এখানে বিচারকাজ করতেন।
বাগেরহাটের খাঞ্জালি দীঘি
প্রত্নতাত্ত্বিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাগেরহাট। এ জেলায় রয়েছে শত শত বছরের প্রাচীন মঠ, মন্দির, মসজিদ ও সমাধিসৌধ। তবে যে কারণে বাগেরহাট জেলার খ্যাতি তা হচ্ছে, এখানে রয়েছে সাড়ে পাঁচশত বছরের প্রাচীন একটি চিত্তাকর্ষক সমাধিসৌধ এবং খাঞ্জালি দীঘি।খানজাহান আলী (রহ.) সমাধিসৌধের লগোয়া দক্ষিণ দিকে রয়েছে এই বিশাল দীঘিটি। তিনি যে ৩৬০টি দীঘি খনন করেছিলেন, তাদের মধ্যে এই দীঘিটি সর্ববৃহৎ। প্রায় ৪০ একর জমিতে এই দীঘি খনন করা হয়েছে। খননকৃত মাটি এর চারদিকের পাড়ে ফেলায় সমতল ভূমি থেকে খুব উচুঁ হয়। বিশেষ করে দক্ষিণ পাড় পাহাড়ের মতো উচুঁ।
দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে এই দরগার ফকির-খাদেমদের বসতি গড়ে উঠেছে। দীঘির জল স্বচ্ছ ও সুপেয়। এই জল যাতে কেউ অযথা অপরিস্কার না করে সে জন্য খনজাহান কালাপাহাড় ও ধলাপাহাড় নামে কয়েকটি কুমির এই দীঘিতে ছেড়েছিলেন। তবে এসব কুমির মানুষকে আক্রমণ করে না। যদি আপনার ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকে তবে এদের দেখতে পাবেন। আরও দেখতে পাবেন ভক্তরা মুরগি নিয়ে দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে কুমিরকে তীরে আসার জন্য হাঁকডাক দিচ্ছে। তাছাড়া বহু মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এসে এই দীঘির পাড়ে বিশ্রাম নেয়। দীঘির পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম। দক্ষিণ দিকের গাছ-গাছালি দেখে গভীর বন মনে হবে। এই দীঘির পশ্চিমে দরগা থেকে ২৫০-৩০০ গজ দূরে রয়েছে জিন্দা পীরের মাজার ও দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে নয়গম্বুজ মসজিদ। সে সবও আপনি দেখে আসতে পারেন।
যেভাবে যাবেন :
প্রতিদিন অসংখ্য বাস মতিঝিল, গাবতলী ও সায়েদাবাদ থেকে বাগেরহাট-খুলানা যাতায়াত করে। এসি-নন এসি ও সাধারণ কোচ সব ধরনের বাসই পাবেন। সময লাগে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা।
থাকার ব্যবস্থা :
বাগেরহাটে থাকার সুব্যবস্থা এখনও গড়ে উঠেনি। মাজার কমপ্লেক্সেও থাকার মতো বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না। তবে খুলনা থেকে বাগেরহাটে আসতে সময় ১ ঘন্টা লাগার কারণে খুলনাতেই থাকা ভালো।