মিসির আলির দিন শুরু হয়েছে রুটিন মতোই। সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখেছেন মশারির ভেতর দিয়ে খবরের কাগজটা ঢুকিয়ে দেওয়া। একসময় বাসিমুখে খবরের কাগজ পড়তে তিনি আনন্দ পেতেন, এখন পান না, কিন্তু অভ্যাসটা রয়ে গেছে। অভ্যাস সহজে যায় না। খবরের কাগজ পড়তে পড়তেই ইয়াসিন চা নিয়ে আসে। মশারির ভেতরে ঢুকিয়ে গলা খাকারি দেয়।
সেই চা, চা-না অতিরিক্ত চিনির কারণে সিরাপ জাতীয় ঘন তরল পদার্থ। ইয়াসিনকে অনেক বলেও চিনি কমানোর ব্যবস্থা মিসির আলি করতে পারেন নি। এখন মিসির আলির গরম সিরাপ খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রায়ই তাকে বলতে শোনা যায়-ইয়াসিন আরেক চামচ চিনি দে। ইংরেজি প্রবচনটা এতই সঠিক-Old habit die hard. পুরোনো অভ্যাস সহজে মরে না।
মিসির আলির হাতে খবরের কাগজ। তিনি খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন—হঠাৎ এমন কোনো খবর চোখে পড়ে কি না যা মনে গেঁথে যায়। এমন কিছু চোখে পড়ছে না। হত্যা, ধর্ষণ ছাড়া তেমন কিছু নেই। মিসির আলির মনে হল সব পত্রিকার উচিত এই দুটি বিষয়ে আলাদা পাতা করা। খেলার পাতা, সাহিত্য পাতার মতো ধর্ষণ পাতা, হত্যা পাতা।
যারা ঐ সব বিষয় পড়তে ভালবাসে তারা ঐ পাতাগুলি পড়বে। যারা পড়তে চায় না তারা পাতা আলাদা করে রাখবে। বিশেষ দিনে হত্যা এবং ধর্ষণ বিষয়ে সচিত্র ক্রোড়পত্র বের হবে।পত্রিকায় নতুন একটি বিষয় চালু হয়েছে–জন্মদিনের শুভেচ্ছা। মামণির এক বছর বয়সপূর্তি উপলক্ষে পিতা-মাতার শুভেচ্ছা। মিসির আলি বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়ছেন।
বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:০৮
অনিক
পৃথিবীতে আজ যত গোলাপ ফুটেছে সবই তোমার জন্যে
তোমার বাবা ও মা
অনিকের ছবি। দুই হাতে ভর দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত গোলাপের মালিক হাঁ করে বসে আছে। তার জিহ্বা দেখা যাচ্ছে।
শিপ্রা,
আজ আমাদের শিপ্রার শুভ জন্মদিন
পৃথিবীর সব দুঃখ করবে সে বিলীন ।
শিপ্রার
নানা নানু ছোট মামা, ছোট মামি ও রনি।
পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ যে বিলীন করবে। সেই শিপ্রার ক্ৰন্দনরতা একটা ছবি। শিপ্রার হাতে চকবার।মিসির আলি ছবিটির দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন। মেয়েটি কাঁদছে কেন? চোখে মুখে কি চকবারের কাঠির খোচা লেগেছে?
জন্মদিনের শুভেচ্ছায় শুধু ছোট মামা, ছোট মামি আছেন। যেহেতু ছোট মামার উল্লেখ করা আছে। অবশ্যই ধরে নিতে হবে বড় মামাও আছেন। বড় মামা-মামি কি আলাদা বাণী দেবেন? তিনি কি পরিবারের সঙ্গে থাকেন না? নাকি বড় মামা মারা গেছেন। শুভেচ্ছা বাণীতে বড় মামা নেই কেন? আরেকটা নাম আছে। রনি! এই রনিটা কে? কাজিন? মামাতো ভাই। শিপ্রা মেয়েটির কি কোনো খালা নেই।
ইয়াসিন চায়ের কাপ মশারির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। যথারীতি গরম সিরাপ। মিসির আলি চুমুক দিলেন–তার কাছে মনে হল মিষ্টি সামান্য বেশি। তবে খেতে খারাপ না। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিসির আলি শিক্ষার্থীর পাতা উল্টালেন। শিক্ষার্থীর পাতা বলে আরেকটা জিনিস খবরের কাগজে চালু হয়েছে। আজ আছে ক্লাস সিক্সের বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি বিষয়ে আলোচনা। অগ্রণী গার্লস হাই স্কুলের ফার্স্ট গার্লের ইন্টারভু। ভিকারুননিসা নুন স্কুলের একজন শিক্ষিকার বৃত্তি পরীক্ষার ওপর কিছু-টিপস। মিসির আলি প্রথম পড়তে শুরু করলেন ফার্স্ট গার্ল নাজনিন বেগমের ইন্টারভ্যু–
বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:০৮
তুমি দৈনিক কত ঘণ্টা পড়াশোনা কর?
আমি দৈনিক পাঁচ থেকে ছঘণ্টা পড়াশোনা করি।
তুমি অবসর সময়ে কী করা?
আমি অবসর সময়ে গল্পের বই পড়ি। টিভি দেখি।
তোমার পড়াশোনার পেছনে কার অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি কাজ করে?
আমার পিতা-মাতা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা।
তুমি কি কোনো কোচিং সেন্টারে যাও?
আমি একটি কোচিং সেন্টারে সপ্তাহে তিনদিন যাই।
তোমার সাফল্যের রহস্য কী?
আমি দিনের পড়া দিনে তৈরি করে রাখি।
তোমার বয়সী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি তোমার কী উপদেশ?
তোমরা নিয়মিত পড়াশোনা কর।
ফার্স্ট গার্ল নাজনিন বেগমের ইন্টারভ্যু শেষ করে মিসির আলি ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষিকার কঠিন উপদেশগুলি পড়তে শুরু করলেন। তার খানিকটা মন খারাপ হতে শুরু করেছে–তার কাছে মনে হচ্ছে সবাই বাচ্চাগুলির পেছনে লেগেছে। শিশুর স্বপ্ন, শিশুর আনন্দ কেড়ে নেবার খেলা শুরু করেছে। শিশুদের শিশুর মতো থাকতে দিলে কেমন হয়। বৃত্তি পরীক্ষা উঠিয়ে দিলে কেমন হয়ঃ পরীক্ষার ব্যাপারটা কি উঠিয়ে দেওয়া যায় না।
পরীক্ষা নামের ব্যাপারগুলি রেখে অতি অল্পবয়সেই শিশুদের মাথায় একটা জিনিস আমরা ঢুকিয়ে দিচ্ছি–তোমাদের মধ্যে কেউ ভালো, কেউ খারাপ। তোমাদের মধ্যে একদল বৃত্তি পায়, একদল পায় না। তোমাদের মধ্যে একজন হয়। ফার্স্ট গার্ল নাজনিন। আরেকজন খুব চেষ্টা করেও দশের ভেতর থাকতে পারে না। যেদিন স্কুলে রেজাল্ট দেয় সেদিন সে কান্না কান্না মুখে বাড়ি ফেরে। এবং তার মা মেয়ের ওপর প্রচণ্ড রাগ করেন। এই মা-ই আবার মেয়েকে গান শেখান–আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে।
বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:০৮
আমরা যে সবাই রাজা না, কেউ কেউ রাজা কেউ কেউ প্ৰজা, পরীক্ষা নামক ব্যবস্থাটা তা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়।মিসির আলি পত্রিকা ভাঁজ করে রাখলেন। মশারির ভেতর থেকে বের হলেন না। সকালে মশারির ভেতর থেকে তিনি বেশ আয়োজন করে বের হন। যেন তিনি জেলখানা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন, সারা দিন কাজকর্ম করবেন আবার রাত এগারোটা বারোটায় জেলখানায় ঢুকবেন।কলিংবেল বাজছে।
নটা বাজে। প্রতিমা এসে পড়েছে। সে নটায় আসবে বলেছিল-ঠিক নটায় এসেছে। পাঁচ-ছমিনিট আগেই হয়তো এসেছে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে নটা বাজার অপেক্ষা করেছে। এ ধরনের মানুষ খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়। মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেললেন। মানুষের সঙ্গ তাঁর কাছে খুব আনন্দদায়ক কোনো ব্যাপার না। তিনি একা থেকে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। অন্যরা ব্যাপারটা বুঝতে পারে না।
মিসির আলির ধারণা যেসব মানুষ দীর্ঘদিন একা থাকে এবং বই পড়ে সময় কাটায় তারা অন্য রকম। মানুষকেও তারা বই মনে করে। যে বই তার পছন্দ সে লাইব্রেরি থেকে সেই বই টেনে নেয়। ঠিক একইভাবে যে মানুষটি তার পছন্দ সেই মানুষকে সে ডেকে নিয়ে আসে। কোনো মানুষ নিজে তাদের কাছে উপস্থিত হবে এটা তাদের পছন্দ না।মিসির আলি অপ্ৰসন্ন মুখে মশারির ভেতর থেকে বের হলেন। বসার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন প্ৰতিমা আসে নি। বেতের চেয়ারে ফতে মিয়া বসে আছে।স্যার কেমন আছেন?
মিসির আলি বললেন, ভালো আছি।ফতে বলল, চলে যাচ্ছি তো স্যার, এইজন্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। একটু দোয়া রাখবেন।কোথায় যাচ্ছে? গতকাল আপনাকে বললাম না। আমি একটা দরজির দোকান দিচ্ছি। এখন থেকে দোকানেই থাকব।ও আচ্ছা।আপনাকে একদিন আমার দোকানে নিয়ে যাব।মিসির আলি ফতের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ঠিক আছে।
বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:০৮
আমার একটা আবদার আছে স্যার। যদি রাখেন খুব খুশি হব।কী অবদার? আমার দোকানের প্রথম দরজির কাজটা আপনাকে দিয়ে করবে। আপনার জন্যে একটা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া দিয়ে দোকানের শুরু। আপনাকে কখনো ফতুয়া পরতে দেখি নাই। আপনি কি ফতুয়া পরেন? পোশাক নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। পোশাক নিয়ে আমি তেমন ভাবি না।স্যার আপনি কি নাশতা করেছেন?
আমিও নাশতা করি নাই। ইয়াসিনকে বলেছি আমাদের দুজনের নাশতা দিতে। শুধু পরোটা ভাজতে বলেছি। আমি বিরিয়ানি হাউস থেকে মুরগির লটপট নিয়ে এসেছি। মুরগির লটপট জিনিসটা কখনো খেয়েছেন? না।
হোটেলে অনেক মুরগি রান্না হয় তো। সেই সব মুরগির গিলা, কলিজা, পাখনা, এইগুলো কী করবে? ফেলে তো দিতে পারে না–হোটেলওয়ালারা এইগুলো দিয়ে একটা ঝোলের মতো বানায়। এটাকে বলে লটপট। পরোটা দিয়ে লটপট খেতে খুবই সুস্বাদু।ও আচ্ছা।ফতে মিয়া হাসতে হাসতে বলল, সকালবেলা এসে আপনার সঙ্গে বকবক শুরু করেছি, আপনার খুব বিরক্ত লাগছে তাই না স্যার?
মিসির আলি বললেন, খুব বিরক্তি লাগছে না, তবে কিছুটা যে বিরক্ত হচ্ছি না–তা না। অকারণ কথাবার্তা বলতে আমার ভালো লাগে না।ফতে বলল, আমি তো চলেই যাচ্ছি স্যার। এরপর আর রোজ রোজ এসে আপনাকে বিরক্ত করব না। যান হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, একসঙ্গে নাশতা খাই! আমি স্যার গজফিতা নিয়ে এসেছি–আপনার ফতুয়ার মাপ নিব। আমি মাপ নেওয়া শিখেছি। আপনাকে দিয়ে বিসমিল্লাহ করব।
বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:০৮
মিসির আলি অপ্ৰসন্ন মুখে বাথরুমের দিকে রওনা হলেন। ফতে মিয়া ঘণ্টাখানেক সময় নষ্ট করবে। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই প্ৰতিমা চলে আসবে। সে তো আর সহজে যাবে না। বাজারটাজার নিয়ে আসবে। মহাউৎসাহে মাছ ভাজতে শুরু করবে। ঘর ধোয়া মোছা করবে। প্রতিমার কর্মকাণ্ড এখানেই শেষ হবে না। সে অবশ্যই চেষ্টা করবে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। বাড়াবাড়ি এই মেয়ে করবেই।
মানুষের জিনের মধ্যে এমন কিছু কি আছে যা তাকে দিয়ে বাড়াবাড়ি করায়। ডিএনএ অণুতে প্রোটিনের এমন কোনো বিশেষ অবস্থান যা বাড়াবাড়ি করতে বিশেষ বিশেষ মানুষকে প্রেরণা দেয়। সেই মানুষ যখন ঘৃণা করে বাড়াবাড়ি ধরনের ঘৃণা করে। যখন ভালবাসে বাড়াবাড়ি ভালবাসে। অনেক অসুখের মতো এটাও যে একটা অসুখ তা কি মানুষ জানে? এখন না জানলেও একদিন জানবে। কোনো ওষুধ কোম্পানি ওষুধ বের করে ফেলবে।
যেসব মানুষের বাড়াবাড়ি করার রোগ আছে তারা ট্যাবলেট খেয়ে রোগ সারাবে। একসময় হুপিং কফ, পোলিওর মতো বাড়াবাড়ি। রোগেরও টিকা বের হবে। শিশুদের বয়স ছয় মাস হবার আগেই তাদের বাড়াবাড়ি প্রবণতা রোগের টিকা দেওয়া হবে। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার দেখা যাবে আপনার শিশুঁকে কি বাড়াবাড়ি প্রবণতার টিকা দিয়েছেন?
বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিসির আলি বিরক্ত মুখে নিজের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করছে। তাঁর যদি প্রচুর টাকা থাকত তিনি সমুদ্রের কোনো জনমানবশূন্য দ্বীপে একটা ঘর বানাতেন। আলেকজান্ডিয়ার লাইব্রেরির মতো-সেখানে তাঁর বিশাল লাইব্রেরি থাকত। তিনি দ্বীপে ঘুরে ঘুরে বই পড়তেন। ঘুম পেলে বালির ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। রবিনসন ক্রুশোর আনন্দময় জীবন।
বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:০৮
মিসির আলির চোখ-মুখ জ্বালা করছে। তিনি মুখে ঠাণ্ডা পানির ছিটা দিচ্ছেন তাতেও জ্বালা কমছে না! হঠাৎ তার খুব মেজাজ খারাপ লাগছে। এতটা মেজাজ খারাপ হবার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি সমাজে বাস করছেন। সমাজের আর দশটা মানুষের মতোই তাকে থাকতে হবে। সামাজিকতা করতে হবে। কেউ তার সঙ্গে গল্প করতে চাইলে গল্প করতে হবে। কেউ লটপট নামক বস্তু নিয়ে এসে তার সঙ্গে নাশতা খেতে চাইলে নাশতা খেতে হবে। কোনো উপায় নেই। তিনি সমাজে বাস করছেন-বাস করার মূল্য তাঁকে দিতেই হবে।
মিসির আলি বাথরুম থেকে বের হয়ে ইয়াসিনকে গরম পানি দিতে বললেন। গোসল করবেন। সকালে গোসল করার অভ্যাস তার নেই। এখন গোসলে যাওয়ার অর্থ কিছুটা সময় নিজের করে পাওয়া। ফতে তার গজফিতা নিয়ে থাকুক একা একা। একা থাকার অভ্যাস করাটাও জরুরি।
ফতে সিগারেট ধরিয়েছে। পা নাচাচ্ছে। সে আনন্দেই আছে। তার মুখ হাসি হাসি। সে ঠিক করেই এসেছে আজ মিসির আলি সাহেবকে সে চমকে দেবে। ছোটখাটো চমক না, বড় ধরনের চমক। ছোটখাটো চমকে এই লোকের কিছু হবে না। ছোটখাটো চমক সে দিয়ে দেখেছে। ঘড়ি না দেখে ঘড়ির সময় বলেছে। আজ তার চেয়ে বেশি কিছু করবে।
সকালবেলা মিসির আলি সাহেব যখন তার সামনে এসে বসেছিলেন তখন ফতে পরিষ্কার বুঝতে পারছিল উনার মাথায় ঘুরছে রনি নামের একজনের নাম। রনিটা কে তিনি বুঝতে পারছিলেন না। রনির সঙ্গে শিপ্রার সম্পর্ক কী তা নিয়ে তিনি চিন্তিত। ফতে ইচ্ছা করলে এই কথাটা বলেও তাকে চমক দিতে পারত। কিংবা সে সকল নটায় যখন এসেছে তখন বলতে পারত,–নটার সময় অন্য একজনের আসার কথা। সে আসে নি। আমি এসেছি। যার আসার কথা তার নাম প্রতিমা।
বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:০৮
ফতে জানে সে ক্ষমতাধর একজন মানুষ। অন্যের মাথার ভেতর সে ঢুকে পড়তে পারে। ছোটবেলা থেকেই পারে। তার ধারণা ছিল সব মানুষই এটা পারে। ব্যাপারটা যে অন্যরা পারে না। শুধু সে একা পারে এটা ধরতে তার অনেক সময় লেগেছে। ক্লাস ফাইভে যখন পড়ে তখন তার হঠাৎ চিন্তা হল-সে কী ভাবছে অন্যরা তা বুঝতে পারছে না কেন? অন্যদের তো বুঝতে পারা উচিত।ক্লাসের স্যার যখন তাকে প্রশ্ন করলেন, ফতে বল তিব্বতের রাজধানী কী?
ফতে খুবই অবাক হল। প্রশ্ন করার দরকার কী? স্যার কেন তার মাথার ভেতর ঢুকে পড়ছেন না! মাথার ভেতর ঢুকলেই তো স্যার জানতে পারতেন। তিব্বতের রাজধানীর নাম ফতে জানে না। তবে এই মুহুর্তে জানে—কারণ স্যারের মাথায় নামটা ঘুরছে। তিব্বতের রাজধানী-লাসা। এই প্রশ্নের পরে স্যার কী প্রশ্ন করতেন এটাও সে জানে। তার পরের এক্স-ফুটানের রাজধানীর নাম কী। উত্তর সারের মাথায় আছে— থিম্পু।
মানুষের মাথার ভেতর ঢুকতে পারার অস্বাভাবিক ক্ষমতা দিয়ে ফতের কোনো লাভ হয় নি। সে কিছুই করতে পারে নি। এই ক্ষমতার কারণে স্কুল জীবনটা তার মোটামুটি ভালো কেটেছে–স্যারদের মার খেতে হয় নি। প্রশংসা শুনেছে–। ইতিহাসের স্যার তো গৰ্ব করে বলতেন-ইতিহাসের সন তারিখ সব ফতের মুখস্থ। তার সমস্যা একটা পরীক্ষার খাতায় কিছু লিখতে পারে না।
বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:০৮
ক্ষমতা পাওয়ায় ফতের লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে। তাকে সারাক্ষণ চিন্তার ভিতর থাকতে হয়-অন্য কেউ কি আমার মাথার ভিতর ঢুকে পড়ছে! চুকে পড়লে ভয়ঙ্কর হবে। কারণ আমার মাথার ভেতর ভয়ঙ্কর সব জিনিস আছে। ফতে তার জীবনটাই কাটাল আতঙ্ক নিয়ে। কেউ অন্য রকমভাবে তার দিকে তাকালেই তার বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে। সর্বনাশ কি হয়ে গেল?
কেউ তার মাথার ভিতর ঢুকতে পেরেছে। এ রকম কোনো প্রমাণ তার হাতে নেই— তবে মাঝে মাঝেই সে লক্ষ করেছে তার দিকে তাকানোর সময় কেমন করে যেন তাকাচ্ছে। তার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। শিশুদের ব্যাপারে এই ঘটনাটা বেশি ঘটে। বেশিরভাগ শিশুই তাকে দেখলে কাঁদতে শুরু করে। সাধারণ কান্না না। চেঁচিয়ে বাড়ি মাত করে ফেলার মতো কান্না। তখন ফতের ভয়ঙ্কর রাগ লাগে। ইচ্ছা করে আছড়ে দিয়ে মাথাটা ফাটিয়ে ফেলতে।
আরো একজনের সঙ্গে ফতের দেখা হয়েছিল যাকে দেখে সে নিজে আতঙ্কে অস্থির হয়েছিল। ঘটনাটা এ রকম-ফাতের মামা ফতেকে দোকানে পাঠিয়েছিলেন-টুথপেষ্ট আনতে। ফতে টুথপেষ্ট কিনল। ষ্টেশনারি দোকানের পাশের সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কেনার সময় হঠাৎ পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বললেন, কিছু মনে করবেন না। আপনার নাম কী?
অপরিচিত কোনো মানুষ হঠাৎ এ ধরনের কথা বলে না। ফতে হকচকিয়ে গেল। তার বুকে ধাক্কার মতো লাগল। ঘটনা কী? লোকটা কি সব বুঝে ফেলেছে। ফতে বলল, আমার নাম ফতে।
আপনি কোথায় থাকেন?
ফতে ক্ষীণ স্বরে বলল, কেন?
আপনার বিষয়ে আমার কৌতূহল হচ্ছে এই জন্যেই জানতে চাচ্ছি।
বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:০৮
ফতে খুব নার্ভাস হয়ে গেল। তার বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়ে গেল। সে ইচ্ছা করলে লোকটার মাথার ভিতর ঢুকতে পারে। লোকটা কেন এ রকম প্রশ্ন করছে তা জানতে পারে—সমস্যা হচ্ছে ফতে যখন ভয় পেয়ে যায় তখন তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তখনো হল। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা একটা লোক রোগা। খুতনিতে সামান্য দাড়ি আছে। শান্ত ভদ্র চেহারা। লোকটা তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ চোখে। ফতে নিজেকে শান্ত করার জন্যে সিগারেট ধরাল। লোকটা বলল, আপনি কী করেন জানতে পাবি?
ফতে নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বলল, আমি কী করি তা দিয়ে আপনার প্ৰয়োজন কী?
লোকটা বলল, প্রয়োজন নেই। শুধুই কৌতূহল।
ফতে বলল, এত কৌতূহল ভালো না।
Read more