বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:১১ হুমায়ূন আহমেদ

বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:১১

মিসির আলি সেই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। ইয়াসিনের মনটা খারাপ হয়ে গেল আহারে লোকটা কী কষ্টে পড়েছে! দুনিয়াদারিই তার মাথায় নাই। লোকটার মাথায় মেয়েটা ঘুরছে। লোকটাকে মেয়ের হাত থেকে বঁচাতে হবে। বাঁচানোর সরঞ্জাম তার হাতেই আছে-এক নম্বুরি ভোম্বল। এই ভোম্বল লোহা হজম করে ফেলে। এই ভোম্বল সহজ, ভোম্বল না।ইয়াসিন চা বানাতে গেল। মিসির আলি না চাইলেও সে সুন্দর করে চা বানিয়ে সামনে রাখবে। মনে মনে বলবে–এত চিন্তার কিছু নাই। আমি আছি না। আমি একবার যারে ভালো পাই তারে জন্মের মতো ভালো পাই।

মিসির আলি বেতের চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর হাতে সিগারেট। সামনে চায়ের কাপ। চায়ের কাপের চা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে–তিনি খালি কাপেই চুমুক দিচ্ছেন। হাতের সিগারেটের ছাইও সেইখানেই ফেলছেন। তাঁর মুখের কাঠিন্য কমে আসছে। দলিলের রহস্য পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। তিনি এগুচ্ছেন। সহজ লজিক দিয়ে। সহজ লজিক তাকে যেখানে পৌঁছে  দিচ্ছে সেই জায়গাটা উঠার পছন্দ না। তিনি এই জায়গাটায় পৌঁছতে চাচ্ছেন না।

মিসির আলি লজিকের সিঁড়িগুলি এইভাবে দাড়া করিয়েছেন—

১. দলিলের লেখাগুলি তার হাতের। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

২. কোনো নেশার বস্তু খাইয়ে ঘোরের মধ্যে এই লেখা আদায় করা হয় নি। কারণ লেখা স্পষ্ট, পরিষ্কার।

৩. মানুষকে হিপনোটাইজ করে কিছু লেখা লেখানো যায়-সেই লেখাও হবে নেশাগ্ৰস্ত মানুষের হাতের লেখার মতো। ছােট কোনো বাক্যও সম্পূর্ণ করা প্রায় অসম্ভব। নেশাগ্ৰস্ত এবং হিপনোটিক ইনফ্লুয়েন্সের লেখা হবে কঁপা কঁপা। এই সময় ভিশন ডিসটন্টেড হয় বলে কেউ সরলরেখা টানতে পারে না, এবং সরলরেখায় লিখতেও পারে না।

কাজেই তিনি দলিলের লেখাগুলি ঠাণ্ডা মাথায় এবং অবশ্যই সূক্ষ্ম মস্তিষ্কে লিখেছেন।

৪. প্রতিমা তাকে দলিল দেখাবার সময় খুব মজা পাচ্ছিল এবং হাসাহাসি করছিল। কাজেই দলিলের ব্যাপারটা মেয়েটার কাছে সিরিয়াস কোনো ব্যাপার না-মজার কোনো খেলা। এই খেলা সে প্রথম খেলছে না। আগেও খেলেছে।

বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:১১

তা হলে ব্যাপার এই দাঁড়াচ্ছে যে মেয়েটি মজা করার জন্যে মিসির আলিকে দিয়ে লেখাগুলি লিখিয়ে নিয়েছে। এবং মেয়েটি জানে এই লেখার বিষয় মিসির আলির মনে নেই। মনে থাকলে তো খেলাটার মজা থাকত না।

তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে মেয়েটা মিসির আলিকে দিয়ে কাগজে লেখার মতো জটিল কাজটি করিয়ে নিয়েছে এমনভাবে যে মিসির আলি কিছু বুঝতেই পারেন নি। যার স্মৃতি পর্যন্ত মস্তিষ্কে নেই। অর্থাৎ মিসির আলির মস্তিষ্কের পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল মেয়েটির কাছে। মেয়েটি কোনো এক অস্বাভাবিক ক্ষমতায় মানুষের মাথার ভেতর সরাসরি ঢুকে যেতে পারছে। এই ক্ষমতা বিজ্ঞান স্বীকার করে না। তবে এ ধরনের ক্ষমতার উল্লেখ বারবারই প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়।

পৌরাণিক কাহিনীতে পাওয়া যায়। আমেরিকার ডিউক ইউনিভার্সিটি এই বিষয়ের ওপর দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে প্রমাণ করেছে যে, এই ক্ষমতার কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি শুধুমাত্রই লজিক বিশ্বাস।মিসির আলি আরেকটা সিগারেট ধরালেন। বুক শেলফ থেকে সাইকোপ্যাথিক মাইন্ড বইটি হাতে নিলেন–কিন্তু পাতা উন্টলেন না।

তাঁর স্মৃতিশক্তি আগের মতো নেই–তার পরেও এই বইটির প্রতিটি পাতা তার প্রায় মুখস্থ।পৃথিবীর ভয়ঙ্কর সব খুনিদের মানসিক ছবি বা সাইকোলজিক্যাল প্ৰফাইল এই বইটিতে দেওয়া আছে। প্রতিটি ভয়ঙ্কর অপরাধীর ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছে-অপরাধীর একটি অস্বাভাবিক ক্ষমতার কথা-অন্যকে বশীভূত করার ক্ষমতা।এই ক্ষমতার উৎস কী? অপরাধী কি অন্যের মাথার ভেতর ঢুকে পড়ছে? তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে?

এই ক্ষমতা শুধু যে ভয়ঙ্কর অপরাধীদের আছে তা না-মহান সাধুসন্তদেরও আছে বলে বলা হয়ে থাকে। তারাও মানুষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারতেন। একজনের নিয়ন্ত্রণ আলোর দিকে-অন্যজনের নিয়ন্ত্রণ অন্ধকারের দিকে।স্যার চা খাইবেন? মিসির আলি চমকে তাকালেন। ইয়াসিন তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টিটা যেন কেমন। যেন অশুভ কিছু সেখানে আছে।মিসির আলি বললেন, না চা খাব না। আমি রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটব। স্যার অ্যাপনের শইল কি খারাপ? না।আমার শরীর ভালো।

বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:১১

ফজলু খুব লজ্জিত বোধ করছে। ফতে নামের এমন একজন ভালো মানুষের ব্যাপারে সে এত খারাপ ধারণা করেছিল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! প্রথম থেকেই তার মনে হয়েছিল-লোকটা খারাপ। লোকটার ভেতর মতলব আছে। লোকটার নজর দিলজনের দিকে। লোকটা যখন তাকে সিগারেট দিত–তার কাছে মনে হত সে কোনো মতলবে সিগারেটটা দিচ্ছে। তার নিতে ইচ্ছা করত না, লোভে পড়ে নিত। লোভ খুব খারাপ জিনিস।

ফজলু দিলজনকে বলে দিয়েছে যেন কখনো ফতের কাছে না যায়। ফতে যদি তাকে ডাকে সে যেন ঘরে ঢুকে পড়ে। ফজলু নিশ্চিত ছিল-ফতে দিলজানকে ডাকবে। ফতে ডাকে নি। কোনোদিনও ডাকে নি। তার পরেও ফজলুর সন্দেহ দূর হয় নি। আজ সন্দেহ পুরোপুরি দূর হয়েছে। ফতে তাকে নার্সারিতে কাজ যোগাড় করে দিয়েছে। প্ৰতিদিন তিন ঘণ্টা কাজ করবে। গাছে পানি দেবে-গোবর আর মাটি মিশিয়ে মশলা তৈরি করবে। বিনিময়ে পঞ্চাশ টাকা পাবে।

কাজটা শেখা হয়ে গেলে সে নিজেই একটা নার্সারি দিবে। কোনো একটা রাস্তার ফুটপাত দখল করে বসে পড়বে। সে টাকা জমাতে শুরু করেছে। বন্ধর্কি বসতবাড়ি ছাড়িয়ে এনে স্ত্রী-কন্যাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেবে। মেয়ের বিয়ে দেবে।ফজলু গাঢ় স্বরে বলল, আপনি আমার বড় একটা উপকার করলেন।

ফতে বলল, এটা কোনো উপকার হল নাকি। এটা কোনো উপকারই না। নাও একটা সিগারেট নাও।ফজলু আনন্দে অভিভূত হয়ে সিগারেট নিল। এমন একটা ভালোমানুষের বিষয়ে সে কী খারাপ ধারণাই না করেছিল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।ফতে বলল, চা খাবে নাকি? চল এক কাপ চা খাই।ফজলু বলল, চলেন। চায়ের দাম কিন্তু আমি দিমু। এইটা আমার একটা আবদার।

বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:১১

ফতে চা খাচ্ছে। রাস্তার পাশের দোকানের টুলের উপর সে একা বসে আছে। ফতের এটা দ্বিতীয় কাপ। প্রথম কাপের দাম ফজলু দিয়ে চলে গেছে। দ্বিতীয় কাপে সে একা বসে চুমুক দিচ্ছে।তার হাতে সময় বেশি নেই। বড় ঘটনা আজ রাতেই ঘটবে। এই ভেবে তার মনে আলাদা কোনো উত্তেজনা নেই বরং শান্তি শান্তি লাগছে। ঘটনাগুলি সে সাজিয়ে রেখেছে। সাজানোর কোনো ভুল নেই। তার পরেও প্রতিটি ঘটনায় একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার। ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করা।

ফতের মাথা ঠাণ্ডাই আছে। যে কোনো বড় ঘটনা ঘটাবার আগে তার মাথা ঠাণ্ডা থাকে। বড় ঘটনা এর আগে সে চারবার ঘটিয়েছে–তিনবার গ্রামে, একবার শহরে। কোনোবারই তার মাথা এলোমেলো ছিল না। চারটা বড় ঘটনার বিষয়ে কেউই কিছু জানে না। এবারো কেউ কিছু জানবে না। এবারেরটা আরো বেশি গোছানো।আজ বুধবার তার মামি গিয়েছেন তার আদরের বুড়ো ভাইয়ার কাছে। সেই ভাইয়া মনের সুখে পুটুরানী পুটুরানী করে আদর করছে।

আদরটাদর খেয়ে মামি বাসায় ফিরবে। তার আগেই বাড়ির গেটের কাছে ফতে বসে থাকবে লুনাকে নিয়ে। লুনা তার মাকে দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে বলবে-পুটুরানী পুটুরানী। এটা লুনা বলবে কারণ ফতে তাকে শিখিয়ে দেবে। এই ঘটনার ফলাফল কী হবে। ফতে জানে না। হয়তো মা মেয়েকে চড়ুথাপ্নড় দেবে। কিংবা হাত ধরে মেয়েকে ঘরে নিয়ে যাবে। যাই করুক না কেন ফতের কিছু যায় আসে না।

সে জানে মামি তাকে অকারণে কিছুক্ষণ ধমক ধমকি করবে। তারপর পাঠাবে কোনো একটা কিছু দোকান থেকে কিনে আনতে। কাপড় ধোয়ার সাবান, সয়াবিন তেল, কিংবা কাঁচা মরিচ বা ধনেপাতা।ফতে গায়ে চাদর জড়িয়ে বাজার আনতে যাবে। চাদরের নিচে গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকবে লুনা। গেট দিয়ে যখন ফতে বের হবে তখন কেউ বুঝতেও পারবে না, ফতের চাদরের নিচে কী আছে।

বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:১১

ফতে কিছুক্ষণের জন্যে লুনাকে রাখবে ফজলুর কাছে। লুনা খুব স্বাভাবিকভাবেই থাকবে-হইচই করবে না, কান্নাকাটি করবে না। নিজের মনে মুঠি বন্ধ করা এবং মুঠি খোলার খেলা খেলতে থাকবে। লুনাকে রেখে ফতে অতিদ্রুত বাজার শেষ করে বাড়ি ফিরবে। তখন ফতের মামি আতঙ্কিত গলায় ফতেকে জিজ্ঞেস করবেন-লুনা কোথায়। ওকে পাচ্ছি না। ফতে বলবে, আপনার সঙ্গেই তো ছিল। মামি তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বলবেন, দেখছি নাতো।

ফতে তৎক্ষণাৎ লুনার খোঁজে রাস্তায় বের হবে। চলে যাবে ফজলুর কাছে। সেখান থেকে লুনাকে নিয়ে যাবে বুড়িগঙ্গায়। যে নৌকাটা সে থাকার জন্যে ভাড়া করেছে সেই নৌকায়। আসল ঘটনা নৌকায় ঘটানো হবে।তারপর সে আবার বাড়ি ফিরে আসবে। ততক্ষণে পুলিশ চলে এসেছে। বাড়িতে কান্নাকাটি হচ্ছে। ফতে আবারো লুনার খোঁজে বের হবে। এবার বের হবে বেবিট্যাক্সি নিয়ে।

তার চাদরের নিচে বড় কালো পলিথিনের ব্যাগে সযত্নে রাখা মাথাটা বের করে সে যাত্রীদের সিটের এক কোনায় রেখে দেবে। আসল খেলা শুরু হবে তখন।লুনা মেয়েটাকে নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। এই মেয়েটা বড় হয়ে বাবামার জন্যে যন্ত্রণ ছাড়া কিছু নিয়ে আসবে না। সব যন্ত্রণার সমাধান। এক অর্থে ফতে তার মামা-মামির উপকারই করছে।পুরো ব্যাপারটা ভাবতে ফতের খুব মজা লাগছে। হাসি চাপিতে পারছে না। চায়ের দোকানি অবাক হয়ে বলল, ভাইজান একলা একলা হাসেন ক্যান?

ফতে হাসি না থামিয়েই বলল, আমার মাথা খারাপ। এই জন্যে একা এক হাসি। দেখি আরেক কাপ চা দেন। চিনি বেশি করে দেবেন। সব পাগল চিনি বেশি খায়।ফতে শরীর দুলিয়ে শব্দ করে হাসবে। তার কাছে মনে হচ্ছে কালো পলিথিনের ব্যাগে মোড়া জিনিসটা একবার এই দোকানদারকে দেখিয়ে দিলে হয়। এই সব চায়ের দোকান অনেক রাত পৰ্যন্ত খোলা থাকে।

বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:১১

রাত একটা দেড়টার দিকে দোকান খোলা থাকার কথা। বেবিট্যাক্সি দোকানোর সামনে রেখে সে চা খেতে আসতে পারে। তখন দোকানিকে বলতে পারে–ভাইসাব আমার বেবিট্যাক্সির সিটে একটা জিনিস আছে। দেখলে মজা পাবেন। দেখে আসেন।বদরুল সাহেবের বাড়ির সামনে জটিল হইচই হচ্ছে। বদরুল সাহেবের স্ত্রীর তীক্ষ্ণ গলা শোনা যাচ্ছে। মিসির আলি ইয়াসিনকে বললেন, কী হয়েছে রে?

ইয়াসিন বলল, জানি না। মনে হয় চোর ধরছে।সন্ধ্যার দিকে ঐ বাড়িতে রোজই হইচই হয়। এতে গুরুত্ব দেবার কিছু নেই। কিন্তু মহিলার তীক্ষ্ণ গলার স্বর কানে লাগছে।মিসির আলি ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার জন্যে মাথা ধরার ট্যাবলেট নিয়ে এস। খুব মাথা ধরেছে।ইয়াসিন বলল, মাথা বানায়া দেই।

মিসির আলি বললেন, মাথা বানাতে হবে না। মাথা বানানোই আছে। তুমি মাথা ধরার ট্যাবলেট কিনে এনে খুব কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে দাও! ইয়াসিন চলে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফতে ঘরে ঢুকল। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আপনার ঘরে কি লুনা লুকিয়ে আছে? মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, নাতো।ফতে বলল, মেয়েটারে পাওয়া যাচ্ছে না! চুপিচুপি এসে খাটের নিচে হয়তো লুকিয়ে আছে। স্যার একটু খুঁজে দেখি?

হ্যাঁ দেখ।ফতে সবগুলি ঘর খুঁজল। বাথরুমে উঁকি দিল। খাটের নিচে দেখল। ফতের সঙ্গে সঙ্গে মিসির আলিও খুঁজলেন।ফতে বলল, নাহ। এদিকে আসে নাই।মিসির আলি বললেন, ফতে তোমাকে একটা কথা বলি শোন। তুমি মেয়েটাকে খুঁজতে এসেছ-খাটের নিচে উঁকি দিয়েছ-কিন্তু তুমি কিন্তু মেয়েটাকে খুঁজছিলে না।ফতে শান্ত গলায় বলল, স্যার এটা কেন বললেন?

বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:১১

মিসির আলি বললেন, আমার খাটের নিচে দুটা বইভর্তি ট্রাংক আছে। সত্যি সত্যি মেয়েটাকে খুঁজলে তুমি অবশ্যই ট্রাংকের ওপাশে কী আছে দেখার চেষ্টা করতে। তা ছাড়া তুমি বাথরুমে উঁকি দিয়েছ? বাথরুমের ভেতরটাও তুমি দেখ নি। বাথরুমের দরজা খুলে তুমি তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে।

ফতে বলল, স্যার আপনি ঠিক ধরেছেন। আমি আসলে খুঁজি নাই। কারণ আমি জানি লুনা এই দিকে আসে নাই। সে নিজে নিজে কোনোদিকে যায় না। তার মার মনের শান্তির জন্যে আমি এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করতেছি। ছাদে গিয়েছি দুইবার। ছাদের পানির টাংকির মুখ খুলে ভিতরে দেখেছি।মিসির আলি বললেন, ফতে তুমি একটু বস তো। এই চেয়ারটায় বস।ফতে বসল।

মিসির আলি বললেন, বাচ্চা একটা মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়ের মা কান্নাকাটি করছে–আমি কিন্তু তোমার ভেতর কোনো উত্তেজনা লক্ষ করছি না। তোমাকে খুবই স্বাভাবিক লাগছে।ফতে বলল, সব মানুষ তো একরকম না স্যার। আমি যেরকম, আপনি সেরকম না। কিছু কিছু মানুষ উত্তেজিত হলেও বাইরে থেকে বোঝা যায় না। স্যার কী করে বুঝলেন যে আমি খুব স্বাভাবিক আছি?

আমার কপাল ঘামে নাই, আমার কথাবার্তা জড়ায়ে যায় নাই এই জন্যে।না, তা না। তুমি খুব স্বাভাবিক আছ এটা বুঝেছি সম্পূর্ণ অন্য একটা ব্যাপার থেকে। তুমি লেফট হ্যান্ডার। বাহাতি মানুষ। বাহাতি মানুষ উত্তেজিত অবস্থায় ডান হাত ব্যবহার করতে শুরু করে। তুমি তা করছ না। তুমি বা। হাতই ব্যবহার করছি। অথচ তোমাদের বাড়িতে আজ ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে।

বাঘবন্দি মিসির আলি পর্ব:১১

ফতে মনে মনে বলল, শাবাশ বেটা। তুই মানুষের মাথার ভিতর ঢুকতে পারিস না। তার পরেও তুই অনেক কিছু বুঝতে পারিস। তোর সাথে পাল্লা দিতে পারলে খারাপ হয় না। আমি তোকে চিনে ফেলেছি, তুই কিন্তু এখনো আমাকে চিনস নাই।মিসির আলি বললেন, ফতে শোন তুমি এতই স্বাভাবিক আছ যে আমার সন্দেহ হচ্ছে মেয়েটা কোথায় আছে তুমি জন। এবং আমার ধারণা মেয়েটাকে তুমিই সরিয়েছ।

ফতে আবারো মনে মনে বলল, শাবাশ। শাবাশ। আয় দুইজনে একটা খেলা খেলি। বাঘবন্দি খেলা। তুই একটা চাল দিবি। আমিও একটা চাল দিব।মিসির আলি বললেন, ফতে কিছু একটা বল। চুপ করে আছ কেন? মেয়েটাকে তুমি সরাও নি? ফতে বলল, গেটে দারোয়ান আছে! লুনাকে নিয়ে গেট থেকে বের হলে দারোয়ান দেখত না?

মিসির আলি বললেন, তোমার গায়ে ভারী চাদর। এই চাদর দিয়ে ঢেকে মেয়েটাকে সরিয়ে নিলে কারোর সন্দেহ করার কিছু নেই। চাদরের নিচ থেকে মেয়েটাও কোনো শব্দ করবে না। কারণ সে তোমাকে খুব পছন্দ করে। তাকে চাদরের নিচে ঢুকিয়ে তুমি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছ এই দৃশ্য আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি।

ফতে মনে মনে বলল, তুই বাঘবন্দি খেলা খেলতে চাস, আয় খেলি। তুই তিনচারটা ভালো চাল দিয়ে ফেলেছিস। আমি কোনো চাল দেই নাই। এখন দেব।মিসির আলি বললেন, ফতে কথা বল। চুপ করে থেক না। বাচ্চা মেয়েটাকে তুমি সরিয়েছ? জি।মেয়েটা কোথায় আছে?

খুব ভালো জায়গায় আছে, স্যার কোনো সমস্যা নেই। আপনি এত দুশ্চিন্তা কইরেন না স্যার। নেন একটা সিগারেট খান।তুমি এই কাজটা কেন করলে? ফতে হেসে ফেলে বলল, মামা করতে বলেছে। এই জন্যে করেছি।বদরুল সাহেব বলেছেন? জি। মামার হুকুমে লুনাকে এক বাসায় রেখে এসে এমন ভাব করতেছি যেন আমি খুব পেরেশান হয়ে খুঁজতেছি।মিসির আলি বললেন, তোমার মামা এই কাজটা কেন করছেন?

 

Read more

বাঘবন্দি মিসির আলি শেষ:পর্ব হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *