বিপ্লবী জোৎস্না নিয়োগী স্বরণে- শুভজিত নিয়োগী

বিপ্লবী জোৎস্না নিয়োগী স্বরণে- শুভজিত নিয়োগী
১৯৯০ সালের ২৭ জানুয়ারির আজকের দিনটিতেই ‘খুকু’ চললেন না ফেরার দেশে- পৈতৃক নাম জ্যোৎস্না রানি মজুমদার তবে বিবাহ সূত্রে নাম শেষে যুক্ত হয়ে গেছে ‘নিয়োগী’ টাইটেল। মাত্র বারো বছর বয়সেই বাবা-মা সবাইকে হারিয়ে ফেলা এতিম এক শিশু টিকে থাকার প্রতিকূলতা অনুধাবন করেছেন ক্ষণে ক্ষণেই, তাই হয়তো পা বাড়াতে পেরেছিলেন নিশ্চিত প্রতিকূলতায় ঘেরা অনাগত ভবিষ্যতের দিকে…

১৯৪১ সালে বিয়ে হয় তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের চোখে সেলুলার জেল ফেরৎ দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বিপ্লবী রবি নিয়োগীর সাথে। কনে নীরিক্ষন অনুষ্ঠানেই তিনি বেছে নিয়েছেন এই বিপদকে। হবু স্বামী অনুষ্ঠানস্থলে নিজেই বলেছেন -“রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদানের অপরাধে আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল; সাত বছর আন্দামান জেল খেটে আমি ছাড়া পেয়েছি মাত্র কিছুদিন আগে। ভবিষ্যতেও আমি রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেবো, তাই আবারও জেল খাটার এমনকি তার চেয়ে বেশি কিছুরও আশঙ্কা আছে। এসব জেনেও কি আপনি এই বিয়েতে রাজি আছেন?”
-জটিল পরিস্থিতি আর অদ্ভুত এক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েও খুব বেশি সময় নেননি তিনি, সম্মতি জানান মাথা নেড়ে।

বিয়ে হবার পর সংসার সামলানোর সাথে দ্রুতই রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করে লাভ করলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ, ১৯৪২ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জলায় “মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি” গঠিত হলে তিনি সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে রাজনৈতিক আন্দোলন, সেবামূলক কর্মকাণ্ড থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সর্বদা অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন। নানকার প্রথা বিরোধী আন্দোলন থেকে ভাওয়ালী প্রথা বিরোধী আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন থেকে টঙ্ক প্রথা বিরোধী আন্দোলন আর এসবের মাঝেই শাসকের পালা বদলে ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তানি দুষ্ট চক্রের আগমন যেনো দমন প্রক্রিয়ার চক্রবৃদ্ধি বিস্তার ঘটে। শোষকের এই চরম দমনকে উপেক্ষা করেই একের পর এক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কারান্তরালে কাটিয়েছেন আট বৎসরাধিক কাল।

শেরপুরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে রাখেন সক্রিয় ভূমিকা । তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে ‘আমরা কজনা’ নামের মেয়েদের নিয়ে করা নাট্যদল তাছাড়া ‘সাংস্কৃতি সংসদ’, ‘গণ সংস্কৃতি সংসদ’ সহ ‘পাতাবাহার খেলাঘর আসর’ গড়ে ওঠে তাঁরই প্রত্যক্ষ্য সহযোগিতায়। নিজ সন্তানদের পাশাপাশি প্রতিবেশী-সংগঠন কর্মী- পরিচিত জনদের সবার জ্ঞান বিকাশ এবং ব‌ই পড়ার চর্চা তৈরি করার লক্ষ্যে দেবর বিপ্লবী মনি নিয়োগীর নামানুসারে বাড়িতেই গড়ে তুলেছিলেন ‘মনিন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার’।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বারেঙ্গা পাড়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচারণা চালান, তাছাড়া শরনার্থী শিবিরে আশ্রিতদের সেবাশুশ্রূষা সহ তাঁদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে আত্ননিয়োগ করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর শেরপুরে ফিরে এসে দেখেন দালান বাড়িটি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে, বাগানের গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে, পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ফসলের ক্ষেত। তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে নিয়োগী দম্পতি সংসার শুরু করলেন টিন নির্মিত ঘরে।পাশাপাশি দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন-সম্পৃক্ত করেন সন্তানদেরকেও।

১৯৭২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই মহিলা পরিষদ এর শেরপুর জেলা শাখা গড়ে ওঠে। ৮০-এর দশকে শেরপুরে ‘উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’ সংগঠনটি গড়ে তুলতেও রাখেন প্রত্যক্ষ্য অবদান। উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সত্যেন সেন- জ্যোৎস্না নিয়োগীর কর্মযজ্ঞকে অবলোকন করে তাঁকে নিয়েই লিখেছিলেন “আশ্চর্য্য মেয়ে !”।

সত্যেন সেন এর আশ্চর্য্য মেয়ে-আমার ঠাকুরমা বিপ্লবী জ্যোৎস্না নিয়োগীর আজ ৩৪ তম প্রয়াণ বার্ষিকী (২৭/০১/১৯৯০)। অনেকটা নিভৃতেই কেটে যাচ্ছে আরেকটি বছর- এই আলোকিত মানুষগুলোকে স্মরণে রাখার লোকের আজ বড়ই অভাব…

(পুরাতন লেখাটা সামান্য পরিমার্জন করা হয়েছে)
– শুভজিত নিয়োগী

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *