বিষাদ সিন্ধু – মীর মশাররফ হোসেন -মহরম পর্ব ২১ প্রবাহ

বিষাদ সিন্ধু – মীর মশাররফ হোসেন -মহরম পর্ব ২১ প্রবাহ
বিষাদ সিন্ধু – মীর মশাররফ হোসেন মহরম পর্ব ২১ প্রবাহ

কয়েকদিন দিনরাত্রি অবিশ্রান্ত পর্যটন করিয়া-মারওয়ান প্রেরিত মদিনার কাসেদ্ দামেস্ক নগরে পৌঁছিল। এজিদ যথাসময়ে কাসেদের আগমন সংবাদ পাইলেন।-সভাভঙ্গ করিয়া কাসেদ্‌কে নির্জনে লইয়া গিয়া সমুদয় অবস্থা শুনিলেন। মারওয়ান-পত্রপাঠে অনেক চিন্তা করিয়া মহারাজ এজিদ্ তৎক্ষণাৎ আবদুল্লাহ্ জেয়াদকে একখানি পত্র লিখিলেন। পত্র শেষ করিয়া কোষাধ্যক্ষের প্রতি আদেশ করিলেন, “তিন লক্ষ টাকা, তদুপযোগী বাহন এবং ঐ অর্থ রাক্ষার্থে কয়েকজন সৈনিকপুরুষ,-এই কাসেদের সমভিব্যাহারে দিয়া এখনই কুফা নগরে পাঠাইতে প্রধান কার্যকারককে আমার আদেশ জানাও।” কোষাধ্যকে এই কথা বলিয়া কাসেদ্‌কে বলিলেন, “তুমি এই উপস্থিত কার্যের উপযুক্ত পাত্র। কুফা নগরে যাইয়া আবদুল্লাহ্ জেয়াদকে বলিয়ো, আশার অতিরিক্ত ফল পাইবে, কুফা রাজ্য একচ্ছত্ররূপে আপনারই অধিকৃত হইবে। দামেস্করাজ আর কখনোই আপনাকে অধীন রাজা বলিয়া মনে করিবেন না, মিত্ররাজ্য বলিয়াই আখ্যা হইবে। সেই মিত্র ব্যবহার জগতে চন্দ্র-সূর্য থাকা পর্যন্ত সমভাবে থাকিবে।” দামেস্কাধাপতি এই বলিয়া কাসেদ্‌কে বিদায় করিলেন। কাসেদ্ অভিবাদন করিয়া বিদায় হইল।

সৈন্যচতুষ্টয়ের সহিত দামেস্কের দূত বিংশতি দিবসে কুফা নগরে উপস্থিত হইল। দামেস্ক হইতে বিস্তর অর্থ সহিত সৈন্যসহচর রাজদূত রাজসমীপে উপস্থিত হইবে, এই কথা আবদুল্লাহ্ জেয়াদের কর্ণগোচর হইলে, তিনি একেবারে আশ্চর্যান্বিত হইলেন। “মহারাজ এজিদ্ আমার নিকট অর্থ, সৈন্য এবং কাসেদ্ পাঠাইবেন-এ কী কথা!” আবদুল্লাহ্ জেয়াদ এই ভাবনা ভাবিতেছেন, এমন সময়ে প্রতিহারী আসিয়া করজোড়ে নিবেদন করিল, “দামেস্ক হইতে কয়েকটি লোক কি উদ্দেশ্যে আসিয়াছে, কাহারো নিকট কিছু বলে না; তাহাদের ইচ্ছা যে, একেবারে মহারাজের সহিত সাক্ষাৎ করে। দামেস্করাজের প্রেরিত, কী কাহার প্রেরিত, তাহা তাহারা কিছুই বলিল না। আমরা যাহাকে কাসেদ্ বলিয়া অনুমান করিতেছি, সে লোকটি বিশেষ চতুর এবং বিশেষ বিচক্ষণ। তাহার সঙ্গে তাহার রক্ষকস্বরূপ কয়েকজন প্রহরী এবং প্রচুর অর্থ আছে।”

আবদুল্লাহ্ জেয়াদ বলিলেন, “তাহাদিগকে সমুচিত আদর করিয়া উপযুক্ত স্থানে স্থান দাও। সময় মত আহ্বান করিয়া তাহাদের কথা শুনিব।”

যথাযোগ্য প্রণিপাত করিয়া প্রতিহারী বিদায় লইল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ অনেক চিন্তা করিলেন। কী কারণ, কে পাঠাইল, কী উদ্দেশ্যে আসিয়াছে, নানা প্রকার দুশ্চিন্তায় মনোনিবেশ করিলেন। নিতান্ত উৎসুক হইয়া অনতিবিলম্বেই সেই কাসেদ্‌কে আহ্বান করিলেন। কাসেদ্ আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া এজিদের আদেশমত সমুদয় বৃত্তান্ত একে একে বর্ণনা করিল। এজিদের স্বহস্তলিখিত পত্রখানিও জেয়াদের সম্মুখে রাখিয়া দিল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ সহস্রবার পত্র চুম্বন করিয়া ভক্তির সহিত পাঠ করিলেন। কাসেদ্কে বলিলেন, “তোমরা নির্দিষ্ট স্থানে গিয়া বিশ্রাম কর, অদ্যই বিদায় করিব।”

বিষাদ সিন্ধু – মীর মশাররফ হোসেন মহরম পর্ব ২২ প্রবাহ

প্রণয়, স্ত্রী, রাজ্য, ধন-এই কয়েকটি বিষয়ের লোভ বড় ভয়ানক। এই লোভে লোকের ধর্ম, পুণ্য, সাধুতা, পবিত্রতা সমস্তই একেবারে সমূলে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। অতিকষ্টে উপার্জিত বন্ধুরত্নটাও ঐ লোভে অনেকেই অনায়াসে বিসর্জন দেয়। মানুষ ঐ লোভে অনায়াসেই যথেচ্ছ ব্যবহারে অগ্রসর হইতে পারে। এজিদ্ দামেস্কের রাজা, কুফা তাঁহার অধীন রাজ্য। হোসেনের সহিত আবদুল্লাহ্ জেয়াদের কেবলমাত্র বন্ধুত্বভাব সম্বন্ধ। উপরিউক্ত চারি প্রকার লোভের নিকট বন্ধুত্বভাব সর্বত্র অকৃত্রিমভাবে থাকা অসম্ভব। অধিকন্তু আবদুল্লাহ্ জেয়াদের নিকটে তাহার আশা করাও যাইতে পারে না। কারণ, আবদুল্লাহ্ জেয়াদ মূর্খ ও অর্থলোভী; মূর্খের প্রণয়ে বিশ্বাস নাই, কার্যেও বিশ্বাস নাই, লোভীও তদ্রূপ।

আবদুল্লাহ্ জেয়াদ সেই রাত্রিতেই দামেস্কের দূতকে বিদায় করিলেন। শয়নগৃহে শয্যার এক পার্শ্বে বসিয়া মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “হোসেনের প্রণয়ে লাভ কী? শুধু মুখের প্রণয়ে কী হইতে পারে?”-এইরূপ অনেক আন্দোলন করিয়া নিদ্রাভিভূত হইলেন।

প্রধান অমাত্য, সভাসদ এবং রাজসংক্রান্ত কর্মচারিগণ কেহই এই নিগূঢ় তত্ত্বের কারণ কিছুই জানিতে পারিলেন না। কি উদ্দেশ্যে উহারা দামেস্ক হইতে আসিয়াছিল, এক দিবস অতীত না হইতেই কেনই-বা ফিরিয়া গেল, এই বিষয় লইয়া সকলে নানা প্রকার আন্দোলন করিতে লাগিলেন।

রজনী প্রভাত হইল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ রাজসিংহাসনে উপবেশন করিয়া সমুদয় সভাসদ্গণকে সম্বোধনপূর্বক বলিতে লাগিলেন, “গত রজনীতে আমি হজরত মোহাম্মদ মোস্তফাকে স্বপ্নে দেখিয়াছি। হস্তে কৃষ্ণবর্ণ আশা (যষ্টি), শিরে শুভ্রবর্ণ উষ্ণীষ, অঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শুভ্র পিরহান। আমার শিয়রে দণ্ডায়মান হইয়া তিনি বলিতে লাগিলেন, ‘আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্! তোমাকে একটি কার্য করিতে হইবে।’ আমি স্বপ্নযোগে সেই পবিত্র পদ চুম্বন করিয়া জোড়হস্তে দণ্ডায়মান থাকিলাম। নূরনবী দুঃখিত স্বরে বলিতে লাগিলেন, ‘হোসেন ভ্রাতৃহীন হইয়া আমার সমাধিক্ষেত্রে পড়িয়া, নিঃসহায়রূপে দিবারাত্রি ক্রন্দন করিতেছে। তুমি তাহার পক্ষ অবলম্বন কর। তোমার সাধ্যানুসারে তাহার সহায়তা কর। সৈন্য-সামন্ত-ধন দ্বারা হোসেনের উপকার কর।’ এই কথা বলিয়াই পবিত্র মূর্তি অন্তর্হিত হইল। আমারও নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল; স্বর্গীয় সৌরভে সমুদয় ঘর আমোদিত হইয়া উঠিল। সেই সময় আমার মনে যে অনুপম আনন্দ ও ভক্তিভাব উদয় হইল, তাহা এক্ষণে মুখে প্রকাশ করিতে সাধ্য হইতেছে না। আর নিদ্রাও হইল না। তখনই কায়মনে হজরত ইমাম হোসেনের প্রতি আত্ম-সমর্পণ করিলাম। এই রাজ্য, এই সৈন্য-সামন্ত, এই ভাণ্ডারস্থ ধনরত্ন মণিমুক্তা সকলই হোসেনের। এই সিংহাসন আজ হইতে হোসেনের নামে উৎসর্গ করিয়া তাঁহাকে ইহার যথার্থ অধিকারী করিলাম। আপনারা আজ হইতে মহামান্য ইমাম হোসেনের অধীন হইলেন। আজ হইতে আমি তাঁহার আজ্ঞাবহ কিঙ্করমাত্র থাকিলাম। অমাত্যগণ! এখনই আপনারা নগরের ঘরে ঘরে ঘোষণা করিয়া দেন যে, এ রাজ্য আজ হইতে ইমাম হোসেনের অধিকৃত হইল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ তাঁহার আজ্ঞাবহ হইয়া রহিলেন। অধীন রাজা, রাজপ্রতিনিধি, রাজসংস্রবী, যিনি যেখানে আছেন কিংবা রাজ্যশাসন করিতেছেন, অদ্যই তাঁহাদের নিকট এই শুভ সংবাদ অগৌণে জ্ঞাপন করা হউক। আর অদ্যই আমার স্বপ্ন বিবরণসহ রাজ্যপরিত্যাগ-সংবাদ ইমাম হোসেনের গোচরকরণ জন্য মদিনায় কাসেদ্ প্রেরণ করা হউক। রাজাবিহনে রাজ্য শাসন হওয়া নিতান্তই কঠিন, রাজসিংহাসন শূন্য থাকাও অযৌক্তিক। যত শীঘ্র হয়, ইমাম হোসেন কুফা নগরে আসিয়া রাজপাট অধিকার এবং আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। ইহাও জানাইও,-যতদিন ইমাম হোসেন এই রাজসিংহাসনে উপবেশন না করিতেছেন, ততদিন প্রধান উজির রাজকার্য পরিচালনা করিবেন। আমার সহিত রাজ্যের আর কোন সংস্রব রহিল না।”

প্রধান উজির নতশিরে রাজাজ্ঞা প্রতিপালন করিলেন। সকলেই হোসেনের নামে রাজভক্তির পরিচয় দিয়া শত শত আশীর্বচন প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদকেও একবাক্যে সকলে ধন্যবাদ দিয়া বলিলেন, “এমন সাহসী ধর্মপরায়ণ সরলহৃদয় ধার্মিক জগতে কেহ হয় নাই, হইবেও না। এমন পুণ্যকার্য এ পর্যন্ত কেহ কোন দেশেই করে নাই। এ কথাও সত্য যে, যিনি ইহকাল-পরকালের রাজা, প্রাণ দিয়া তাঁহার উপকার করা সকল মুসলমানের কর্তব্য। এজিদের চক্রান্তে ভ্রাতৃহারা-রাজ্যহারা-একে একে সর্বহারা হইবার উপক্রম হইয়াছেন, এ সময় যিনি যত প্রকারে ইমামের উপকার করিবেন, ঈশ্বর তাঁহাকে তাহার কোটি কোটি গুণে পুণ্যময় করিয়া পরকালের প্রধান স্বর্গে তাঁহার স্থান নির্ণয় করিয়া রাখিবেন। আপনি সৈন্যসামন্ত সহিত রাজ্য-ধন ইমামকে দান করিলেন; আমরা চিরকাল হইতে তাঁহার আজ্ঞানুবর্তী দাসানুদাস আছি। আজ হইতে জীবন, ধন, সমস্তই হোসেনের নামে উৎসর্গ করিলাম।”

প্রধান উজির রাজাজ্ঞানুসারে সমুদয় স্থানে ঘোষণা করিয়া দিলেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদের স্বপ্নবৃত্তান্তও বিস্তারিতরূপে বর্ণনা করিয়া, রাজ্যদান-সংক্রান্ত সমস্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করিযা হোসেন-সমীপে কাসেদ্ প্রেরণ করিলেন।

ক্রমে সর্বত্র প্রকাশ হইল যে, কুফাধিপতি আবদুল্লাহ্ জেয়াদ তাঁহার সমুদয় রাজ্য হোসেনকে অর্পণ করিয়াছেন। এজিদের স্বপক্ষীয়েরা ব্যতীত সকলেই একবাক্যে আবদুল্লাহ্ জেয়াদকে শত শত ধন্যবাদ দিয়া ঈশ্বর সমীপে হোসেনের দীর্ঘায়ু ও সর্বমঙ্গল প্রার্থনা করিলেন। ক্রমে মদিনা পর্যন্ত এই সংবাদ রটিয়া গেল।

হোসেন পূর্ব হইতেই মদিনা পরিত্যাগ করিয়া কুফা নগরে আসিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ্ জেয়াদ কর্তৃক আদৃত না হইয়া তথায় গমন করা যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করেন নাই। লোকমুখে জেয়াদের বদান্যতা, বিপদ সময়ে সাহায্য এবং অকাতরে রাজ্য পর্যন্ত দানের বিষয় শুনিয়া ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া কৃতজ্ঞতার সহিত উপাসনা করিলেন। কিন্তু জেয়াদ্-প্রেরিত নিশ্চয় সংবাদ না পাইয়া অন্য কাহাকেও কিছু বলিলেন না।

মারওয়ান আজ মদিনা আক্রমণ করিবে, রওজা আক্রমণ করিবে, হোসেনের প্রাণ হরণ করিবে, সর্বসাধারণের মুখে এই সকল কথার আন্দোলন। মদিনাবাসীরা সকলেই হোসেনের পক্ষ হইয়া এজিদের সৈন্যের সহিত যথাসাধ্য যুদ্ধ করিবে, প্রাণ থাকিতে হোসেনের পরিজনদিগকে বন্দি করিয়া দামেস্কে লইয়া যাইতে দিবে না, এ কথাও রাষ্ট্র হইয়াছে। ‘আজ যুদ্ধ হয়, কাল যুদ্ধ হয়’-এই কথারই তর্কবিতর্ক। এজিদের সৈন্যগণ মদিনা আক্রমণ না করিলে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবে কি-না এই বিষয় লইয়াই-এই চিন্তাতেই ইমাম-বংশের চিরহিতৈষী মদিনাবাসীরা সকলে মহা ব্যতিব্যস্ত। দিবরাত্রে কাহারই যেন আহার-নিদ্রা নাই।

কয়েকদিন যায়, শেষে সাব্যস্ত হইল যে, শত্রুগণ নগরের প্রান্তভাগে-প্রান্তরের শেষ সীমায় শিবির নির্মাণ করিয়া যে প্রকার শান্তভাবে রহিয়াছে, তাহাতে আশু বিরোধের সম্ভাবনা কী? কোন বিষয়ে অনৈক্য, কোন বিষয়ে বাধা কিংবা কোন কথার প্রসঙ্গে অযথা উত্তর না করিলে কী প্রকারে বিবাদে প্রবৃত্ত হওয়া যায়; এই বিবেচনা করিয়া সকলেই যুদ্ধের অপেক্ষায় বিবাদের সূচনার প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছেন। একদিন কুফা নগরের কাসেদ্ মদিনায় দেখা দিল। মদিনাবাসীরা জেয়াদের বদান্যতার বিষয় পূর্বেই শুনিয়াছিলেন, নিশ্চয় সংবাদ না পাইয়া অনেকে অনেক সন্দেহ করিতেছিলেন, আজ সে সন্দেহ দূর হইল। একমুখে বলিতে শত শত মুখে জিজ্ঞাসিত হইল, “কুফার সংবাদ কী?”

কাসেদ্ উত্তর করিল, “কুফাধিপতি মাননীয় আবদুল্লাহ্ জেয়াদ তাঁহার সিংহাসন, রাজ্য, ধন, সৈন্যসামন্ত সমস্তই হজরত ইমাম হোসেনের নামে উৎসর্গ করিয়াছেন। তিনি এক্ষণে রাজকার্য হইতে অপসৃত হইয়াছেন। ইমাম হোসেন কুফা-সিংহাসনে উপবেশন না-করা পর্যন্ত প্রধান উজিরের হস্তে রাজকার্যের পরিচালনার ভার রহিয়াছে। ইমাম হোসেন কোথায় আছেন আপনারা বলুন, আমি তাঁহার নিকটে যাইয়া এই সংবাদ দিব।” একজন বলিতে শত শত লোক কাসেদের অগ্র-পশ্চাতে চলিতে লাগিল। কেহ আবদুল্লাহ্ জেয়াদের প্রশংসা, কেহ কেহ হোসেনের কুফাগমনজনিত দুঃখ, কেহ এজিদের দৌরাত্ম্যে হোসেন দেশত্যাগী, এই সকল কথার শাখা-প্রশাখা বাহির করিয়া পরস্পর বাদানুবাদ ও তর্ক-বিতর্ক করিতে করিতে হজরতের রওজায় উপস্থিত হইল। প্রধান প্রধান লোকেরা কাসেদের বৃত্তান্ত ইমামের নিকট বিবৃত করিলেন।

আবদুল্লাহ্ জেয়াদের পত্র পাঠ করিয়া হোসেন সেই পত্রহস্তে কাসেদ সমভিব্যাহারে নিজ ভবনের প্রবেশদ্বারে উপস্থিত হইয়া মদিনাবাসীদিগকে বলিতে লাগিলেন, “ভাই সকল! আপনারা কেন আর কষ্ট পাইতেছেন? যদি কুফার অন্ন-জল ঈশ্বর আমার অদৃষ্টে লিখিয়া থাকেন, তবে আপনারা আমার কৃতদোষ মার্জনা করিবেন। সময়ে আমি আপনাদের প্রত্যেকের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিব। এক্ষণে এত ব্যস্ত হইবার কোন কারণই দেখিতেছি না।”

মদিনাবাসীরা সকলেই একবাক্যে হোসেনকে আশীর্বাদ করিয়া স্ব-স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।

জেয়াদের পত্র লইয়া হোসেন মাননীয়া বিবি সালেমার হোজ্‌রা (নির্জন স্থান) সমীপে গমন করিলেন। সংবাদ পাইয়া বিবি সালেমা হোজ্‌রা হইতে বহির্গত হইলেন। ইমাম হোসেন মাতামহীর (হজরত হোসেনের আপন মাতামহী বিবি খাদিজা। বিবি সালেমা হযরত মোহাম্মদের অন্য স্ত্রী।) পদধূলি গ্রহণ করিয়া জেয়াদের পত্রবিবরণ প্রকাশ ও কুফা নগরে গমন প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন।

রওজা হইতে হোসেনের আগমনবৃত্তান্ত শুনিয়া পরিজন, আত্মীয়, বন্ধু অনেকেই বিবি সালেমার হোজ্‌রায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

হোসেন সকলের নিকটেই কুফা-গমনসঙ্কল্পে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করায়, কেহই কোন উত্তর না করিয়া নিস্তব্ধভাবে রহিলেন। বিবি সালেমা গম্ভীর স্বরে বলিতে লাগিলেন, “আবদুল্লাহ জেয়াদ্ যাহাই লিখুক, আমি তোমাকে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করিতেছি, তুমি কখনোই কুফায় গমন করিয়ো না-হজরতের রওজা ছাড়িয়া কোন স্থানেই যাইয়ো না; হজরত আমাকে বলিয়া গিয়াছেন যে, হোসেন আমার রওজা পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে গমন করিলে অনেক প্রকার বিপদের আশঙ্কা। আমি পুনঃ পুনঃ নিষেধ করিতেছি, তুমি কখনোই রওজা হইতে বাহির হইও না। এখানে কাহারো ভয় নাই, কোন প্রকার শত্রুতা সাধন করিবার ক্ষমতা কাহারো নাই, তুমি স্বচ্ছন্দে নিশ্চিন্তভাবে রওজায় বসিয়া থাক।”

হোসেন বলিলেন, “কতকাল এইভাবে বসিয়া থাকিব? কাফেরগণ ক্রমশঃই তাহাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া মদিনার নিকটে একত্রিত হইতেছে। আমি কি করি, কতদিন এই প্রকারে বসিয়া কাটাইব? একা আমার প্রাণের জন্য কত লোকের জীবন বিনষ্ট হইবে? তাহা অপেক্ষা আমি কিছুদিন স্থানান্তরে বাস করি, ইহাতে দোষ কি? বিশেষ কুফা নগরের সমুদয় লোক মুসলমান-ধর্মপরায়ণ, সেখানে যাইতে আর বাধা কী?”

সালেমা বিবি বিরক্তভাবে বলিতে লাগিলেন, “আমি বৃদ্ধা হইয়াছি, আমার উপদেশ তোমাদের গ্রাহ্য হইবে কেন? যাহা হয় কর।” এই বলিয়া হোজ্রামধ্যে চলিয়া গেলেন। তৎপরে হোসেনের মাতার সহোদরা ভগ্নী উম্মে কুলসুম্ হোসেনের হস্তধারণ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “হোসেন! সকলের গুরুজন যিনি, প্রথমেই তিনি নিষেধ করিতেছেন, তাঁহার কথার অবাধ্য হওয়া নিতান্তই অনুচিত। বিশেষ আমিও বলিতেছি, তুমি কুফার নাম পর্যন্তও করিয়ো না। কুফার নাম শুনিলে আমার হৃদয় কাঁপিয়া উঠে। তোমার কি স্মরণ হয় না যে, তোমার পিতা কুফায় যাইয়া কত কষ্ট পাইয়াছিলেন? কুফা-নগরবাসীরা তাঁহাকে কতই-না যন্ত্রণা দিয়াছিল, সে কথা কি একেবারে ভুলিয়াছ? কুফায় যাইবার বাসনা অন্তর হইতে একেবারে দূর কর। নিশ্চিন্তভাবে রওজায় বসিয়া থাক, আমি সাহস করিয়া বলিতেছি, জগতে এমন কেহই নাই যে, তোমার অঙ্গ স্পর্শ করে।”

হোসেন বলিলেন, “আমার মন অত্যন্ত অস্থির হইয়াছে! তিলার্ধ কালও মদিনায় থাকিতে ইচ্ছা হইতেছে না। আপনারা আর আমায় বাধা দিবেন না। মিনতি করিয়া বলিতেছি, অনুমতি করুন, শীঘ্রই যাহাতে কুফায় যাত্রা করিতে পারি।”

উম্মে কুলসুম্ বিরক্ত হইয়া চলিয়া যাইতে যাইতে বলিলেন, “ঈশ্বর অদৃষ্টফলকে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা রদ করিবার কাহারো সাধ্য নাই। তোমার যাহা ইচ্ছা তাহাই কর।”

হোসেনের বন্ধুবান্ধব একবাক্য হইয়া সকলেই কুফাগমনে নিষেধ করিলেন। প্রতিবেশীগণের মধ্যে একজন বলিলেন, “মদিনার মায়া একেবারে অন্তর হইতে অন্তর করিবেন না। এজিদের ভয়ে মদিনা পরিত্যাগ নিতান্ত পরিতাপ ও দুঃখের বিষয়। তাহারা প্রকাশ্য যুদ্ধে কী করিবে? মদিনাবাসীদের একজনেরও প্রাণ দেহে থাকিতে শত্রুগণ কি আপনার অঙ্গ স্পর্শ করিতে পারে? কাহার সাধ্য? আমাদের স্বাধীনতা, স্বদেশের গৌরব রক্ষা, ইহা তো আছেই; তাহা ছাড়া আপনার প্রাণের জন্য এজিদের সৈন্যের সম্মুখীন হইতে আমরা কখনোই পরাক্সমুখ হইব না। আমরা শিতি নহি, তাহা স্বীকার করি; কিন্তু আপনার প্রাণরার জন্য আমাদের প্রাণ শত্রুহস্তে অর্পণ করিতে শিক্ষার আবশ্যক কি? আমরাও যদি শত্রুহস্তে বিনাশপ্রাপ্ত হই, তথাপি মদিনার একটি স্ত্রীলোক জীবিত থাকিতে এজিদ্ আপনার অনিষ্ট সাধন করিয়া কখনোই মদিনার সিংহাসনে বসিতে পারিবে না। আপনি কাহার ভয়ে-কোন্ শত্রুর শত্রুতায় মদিনা পরিত্যাগ করিবেন? আমাদের জীবন থাকিতে আমরা আপনাকে যাইতে দিব না। আপনার আজ্ঞার প্রতিবন্ধকতা করিতে আমাদের ক্ষমতা নাই। যদি আপনি মদিনা পরিত্যাগ করিতে নিতান্তই কৃতসঙ্কল্প হইয়া থাকেন, করুন; কিন্তু মদিনাবাসীরা আপনাকে কখনোই পরিত্যাগ করিবে না। যেখানে যাইবেন, তাহারাও আপনার সঙ্গে সেইখানে যাইবে।”

হোসেন বলিতে লাগিলেন, “ভাই সকল! এজিদের জীবনের প্রথম কার্যই আমাদের বংশ বিনাশ করা। যে উপায়ে হউক, এজিদ্ আমার প্রাণ বিনাশ করিবে। যখন দুই ভ্রাতা ছিলাম, তখন এজিদের সৈন্যেরা সাহস করিয়া প্রকাশ্য যুদ্ধ করিতে অগ্রসর হয় নাই। কয়েকবার পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছে এবং আপনারাও দেখিয়াছেন। এক্ষণে আমার সাহস, বল, বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির অনেক লাঘব হইয়াছে। কারণ, ভ্রাতৃশোকে আমি যে প্রকার দুঃখিত ও কাতর আছি, তাহা আপনারা স্বচক্ষে দেখিতেছেন; যে হৃদয় কখনোই ভয়ের নাম জানিত না, শত্রুনামে যে হৃদয় কদাচ আতঙ্কিত হইত না, সেই ভয়শূন্যহৃদয় আজ ভ্রাতৃ-বিয়োগ-দুঃখে সামান্য যুদ্ধের নামে আতঙ্কে কাঁপিয়া উঠিতেছে। আমার নিজের মনই যদি নিরুৎসাহ থাকিল-শত্রুভয়ে কম্পমান রহিল, তখন কাহার উৎসাহে-কাহার উত্তেজনায়, আপনারা সেই দুর্দান্ত শত্রুর অস্ত্রসম্মুখে-অসংখ্য সেনার অসংখ্য অস্ত্রসম্মুখে দণ্ডায়মান হইবেন? বলুন তো, কাহার সাহসের উপর নির্ভর করিয়া বিধর্মীর অস্ত্রাঘাতের জন্য বক্ষ বিস্তার করিয়া দিবেন? শিক্ষিতি সৈন্যের তরবারির গতি কাহার প্রোৎসাহবাক্যে প্রতিরোধ করিবেন? আমি অনেক চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি, এক্ষণে মদিনা পরিত্যাগ করাই আমার পক্ষে শ্রেয়ঃ এবং মদিনাবাসীর পক্ষে মঙ্গল। আমার জন্য আমি আপনাদিগকে বিপদগ্রস্ত করিতে বাসনা করি না। এজিদের হস্তে, কিংবা তাহার সৈন্যের হস্তে বিধি যদি আমার জীবন-শেষের বিধি করিয়া থাকেন, তবে তাহা নিশ্চয়ই ঘটিবে। যেখানেই কেন যাই না, আমার প্রাণহন্তা সেইখানেই উপস্থিত হইবে। কারণ, জগদীশ্বরের কার্য অনিবার্য। আমার স্থানান্তর হওয়ায় মদিনাবাসীরা তো এজিদের রোষাগ্নি হইতে রক্ষা পাইবে। তাহাই আমার পক্ষে মঙ্গল।”

প্রতিবেশীগণের মধ্যে একজন প্রাচীন ছিলেন, তিনি বলিতে লাগিলেন, “ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্য অনিবার্য, এ কথা কে না স্বীকার করিবে? কিন্তু আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ হঠাৎ এইভাবে এত বড় রাজ্য আপনাকে অযাচিতভাবে ছাড়িয়া দিল, ইহার কারণ কী? এ কথাও রাষ্ট্র হইয়াছে যে, এজিদ্পক্ষীয় কাসেদ্ তিন লক্ষ টাকা লইয়া কুফা নগরে জেয়াদের নিকট গিয়াছিল। জেয়াদ্ও দামেস্কের কাসেদ্‌কে এবং তৎসমভিব্যাহারী সৈন্যচতুষ্টয়কে বিশেষ পুরস্কৃত করিয়া বিদায় করিয়াছেন। তাহার পরদিবসই স্বপ্নবিবরণ সভায় প্রকাশ করিয়া রাজসিংহাসন ও রাজ্য আপনাকে অর্পণ করিয়াছেন। ইহারই-বা কারণ কী? যদি এজিদের মন্ত্রণায় সে অসম্মত হইবে, কি এজিদের আদেশ প্রতিপালনে অনিচ্ছুক হইবে, তবে নিঃস্বার্থ বন্ধুর চিরশত্রুপ্রেরিত কাসেদ্‌কে কেন পুরস্কৃত করিবে? কেন তাহার প্রদত্ত অর্থ নিজ ভাণ্ডারে রক্ষা করিবে? যে রাজ্য আপনার পিতা বহু পরিশ্রম করিয়াও নিষ্কণ্টকে হস্তগত করিতে পারেন নাই, কয়েকবার তাঁহাকে ঐ নগরবাসীরা, যে প্রকার কষ্টে নিপাতিত করিয়াছিল, তাহা বোধ হয় আপনি পরিজ্ঞাত আছেন। এইণে কুফাধিপতি জেয়াদ্ হঠাৎ নূরনবী মোহাম্মদের স্বপ্নাদেশে সেই রাজ্য অকাতরে আপনাকে দান করিল, ইহাতে আমার বিশেষ সন্দেহ আছে।”

হোসেন বলিলেন, “এমন কথা মুখে আনিবেন না। আবদুল্লাহ্ জেয়াদের ন্যায় আমার প্রকৃত বন্ধু মদিনা ব্যতীত অন্য কোন স্থানেই নাই। তাঁহার গুণের কথা কত বলিব। তিনি আমার জন্য এজিদের মুণ্ডপাত করিতেও বোধ হয় কখনোই কুণ্ঠিত হইবেন না। জেয়াদের বাক্য ও কার্যে আমার কিছুমাত্র সংশয় নাই।”

বৃদ্ধ পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “জেয়াদের বাক্যে ও কার্যে আপনার কোন সংশয় হয় না, অবশ্যই না হইতে পারে। কিন্তু আমি বলি, মানুষের মনের গতি কোন্ সময় কী হয়, তাহা যাহার মন, সেও জানিতে পারে না। একটু চিন্তা করিয়া কার্য করায় ক্ষতি কী? আমার বিবেচনায় অগ্রে জনৈক বিশ্বাসী এবং সাহসী লোককে কুফা নগরে প্রেরণ করা হউক। কুফাবাসীরা যদি কোনরূপ চক্রান্ত করিয়া থাকে তবে অবশ্যই প্রকাশ হইবে। গুপ্ত মন্ত্রণা ক’দিন গোপন থাকিবে? একটু সন্ধান করিলেই সকল জানা যাইবে। আর জেয়াদের রাজ্যদানসঙ্কল্পও যদি যথার্থ হয়, তবে আপনার কুফা গমনে আমি কোন বাধা দিব না।”

হোসেন বলিলেন, “এ কথা মন্দ নয়; কিন্তু অনর্থক সময় নষ্ট এবং বিলম্ব। তা যাহাই হউক, আপনার কথা বারবার লঙ্ঘন করিব না। অগ্রে তথায় পাঠাইতে কাহাকে মনস্থ করিয়াছেন? এমন সাহসী বিশ্বাসী পাত্র কে আছে?”

দ্বিতীয় মোস্‌লেম নামক জনৈক বীরপুরুষ গাত্রোত্থান করিয়া করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “হজরত ইমামের যদি অনুমতি হয় তবে এ দাসই কুফা নগরে যাইতে প্রস্তুত আছে। আপনি কিছুদিন অপেক্ষা করুন, আমি কুফায় যাইয়া যথার্থ তত্ত্ব জানিয়া আসি। যদি আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ সরলভাবে রাজ্য দান করিয়া থাকেন, তবে মোস্লেম আনন্দের সহিত শুভ সংবাদ লইয়া ফিরিয়া আসিবে। আর যদি ইহার মধ্যে কোন ষড়যন্ত্র থাকে, তবে বুঝিবেন, মোস্‌লেমের এই শেষ বিদায়। আপনার কার্যে মোস্‌লেমের প্রাণের মায়া, সংসারের আশা, সুখ-দুঃখের চিন্তা, স্ত্রী-পরিবারের স্নেহবন্ধন, কিছুমাত্র মনে থাকিবে না। আজ মোস্লেম আপনার কার্যে জীবন উৎসর্গ করিল। এই মুহূর্তেই কুফায় যাত্রা করিবে। এখানে অনেকেই আছেন, যাহা বলিতে ইচ্ছা করেন বলুন; মোস্‌লেম সে কথার অন্যথা কিছুতেই করিবে না।”

বৃদ্ধ পুনরায় বলিলেন, “মোস্‌লেম তো যাইতেই প্রস্তুত। মোস্‌লেমের প্রতি আমার তো সম্পূর্ণ বিশ্বাসই হয়, কিন্তু একা মোস্‌লেমকে কুফায় প্রেরণ করা যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না। শিক্ষাত হউক কি অশিক্ষিত হউক, সৈন্যনামধারী কতিপয় লোককে মোস্‌লেমের সঙ্গে দিতে হইবে।”

বৃদ্ধের মুখে এই কথা শুনিবামাত্র নিতান্ত আগ্রহের সহিত অনেকে যাইতে ইচ্ছুক হইলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এক হাজার লোক মোস্‌লেমের সঙ্গী হইতে সমুৎসুক হইল। কুফার রহস্য-ভেদ ষড়যন্ত্রের মূলোচ্ছেদ করিতে তাহারা প্রাণপণে প্রস্তুত। সমুদয় কথা সাব্যস্ত হইয়া গেল; অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করিয়া মোস্‌লেম এক হাজার সৈন্য লইয়া কুফা নগরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। বীরবরের দুই পুত্রও পিতার সঙ্গে চলিল।

বিষাদ সিন্ধু – মীর মশাররফ হোসেন মহরম পর্ব ২৩ প্রবাহ

স্বার্থপ্রসবিনী গর্ভবতী আশা যতদিন সন্তান প্রসব না করে, ততদিন আশাজীবী লোকের সংশিত মানসাকাশে ইষ্টচন্দ্রের উদয় হয় না। রাত্রির পর দিন, দিনের পর রাত্রি আসিতে লাগিল। এই রকমে দিবা-রজনীর যাতায়াত। জেয়াদের মানসাকাশে এতদিন শান্তিচন্দ্রের উদয় হয় নাই। সর্বদা অন্যমনস্ক। সর্বদাই দুশ্চিন্তাতে চিরনিমগ্ন। ইহা এক প্রকার মোহ। জেয়াদ্ দিন-দিন-দিন গণনা করিতেছেন, ক্রমে গণনার দিন পরিপূর্ণ হইল। মদিনা হইতে কাসেদ্ ফিরিয়া আসিল, কুফা আগমনে হোসেনের ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এতদিন না-আসিবার কারণ কী? দিনের পর দিন যাইতে লাগিল, সূর্যের পর চন্দ্র আসিতে লাগিল, বিনা চন্দ্রে নক্ষত্রের উদয় সম্ভব। সে দিনও ক্রমে ক্রমে উত্তীর্ণ হইল, নিশ্চয় যেদিন আসিবেন সাব্যস্ত করিয়াছিলেন, তাহাও গত হইয়া গেল, তাহার পর পরিজন লইয়া একত্র আসিবার যে বিলম্ব সম্ভব তাহাও গণনা করিয়া শেষ করিলেন। কিন্তু হোসেন আসিলেন না; জেয়াদ্ বড়ই ভাবিত হইলেন। দিবারাত্রি চিন্তা! কি কৌশলে হোসেনকে হস্তগত করিয়া বন্দিভাবে এজিদের হস্তে সমর্পণ করিবেন, সেই চিন্তাই মহা প্রবল। পুনরায় সংবাদ পাঠাইতে মনস্থ করিয়া ভাবিলেন, “যে বংশের সন্তান, অন্তর্যামী হইতেই-বা আশ্চর্য কী? আমার অব্যক্ত মনোগত ভাব বোধ হয় জানিতে পারিয়াছেন। আবার সংবাদ দিয়া কি নূতন প্রকার নূতন বিপদে নিপতিত হইব?” পরামর্শ স্থির হইল না। নানাপ্রকার ভাবিতেছেন, এমন সময়ে নূতন সংবাদ আসিল, মদিনা হইতে হোসেনের প্রেরিত সহস্র সৈন্যসহ মোস্‌লেম আসিয়া নগরে উপস্থিত! রাজদরবারে আসিতে ইচ্ছুক। পরম্পরায় এই সংবাদ শুনিয়া জেয়াদ্ আরো চিন্তিত হইলেন। হোসেন স্বয়ং না আসিয়া দূত পাঠাইবার কারণ কি? হইতে পারে এটি আমার প্রথম পরীক্ষা। আমার মনোগত ভাব জানিবার জন্যই হয়তো দূত প্রেরণ। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া সাদরে মোস্‌লেমকে অভ্যর্থনা করিয়া সভাগৃহে আনিতে প্রধান মন্ত্রীকে আদেশ করিলেন।

মোস্‌লেম সভায় উপস্থিত হইলে জেয়াদ্ করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “দূতবর! বোধ হয়, প্রভু হোসেনের আজ্ঞাক্রমেই আপনার আগমন হইয়াছে। প্রভুর না আসিবার কারণ কী? এ সিংহাসন তাঁহার জন্য শূন্য আছে। রাজকার্য বহুদিন হইতে বন্ধ রহিয়াছে। প্রজাগণ ও সভাসদ্গণ প্রভুর আগমন প্রতীক্ষায় পথপানে চাহিয়া রহিয়াছে। আমি যে চিরকিঙ্কর, দাসানুদাসেরও অনুপযুক্ত, আমিও সেই পবিত্র পদসেবা করিবার আশায় এতদিন সমুদয় কার্য পরিত্যাগ করিয়া বসিয়া আছি। কী দোষে প্রভু আমাদিগকে বঞ্চিত করিলেন, বুঝিতে পারিতেছি না।”

মোস্‌লেম বলিলেন, “ইমাম হোসেন শীঘ্রই মদিনা পরিত্যাগ করিবেন। মদিনাবাসীরা অনেক প্রতিবন্ধকতা করায় শীঘ্র শীঘ্র আসিতে পারেন নাই। আপনাকে সান্ত্বনা করিয়া আশ্বস্ত করিবার জন্য অগ্রে আমাকে পাঠাইয়া দিয়াছেন, তিনি শীঘ্রই আসিবেন।”

আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ পূর্ববৎ করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “আপনি প্রভুর পক্ষ হইতে আসিয়াছেন, আমরা আপনাকে প্রভুর ন্যায়ই গ্রহণ করিব, প্রভুর ন্যায়ই দেখিব এবং প্রভুর ন্যায়ই মান্য করিব।” এই বলিয়া মোস্‌লেমকে রাজসিংহাসনে বসাইয়া আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ ভৃত্যের ন্যায় সেবা করিতে লাগিলেন। অমাত্যগণ, সভাসদ্গণ, রাজকর্মচারিগণ, সকলেই আসিয়া রীত্যানুসারে উপঢৌকন সহিত নতশিরে ভক্তিসহকারে রাজদূতকে রাজা বলিয়া মান্য করিলেন। ক্রমে অধীন রাজগণও মর্যাদা রক্ষা করিয়া ন্যূনতা স্বীকারে নতশিরে প্রণিপাত করিলেন।

মোস্‌লেম কিছুদিন নির্বিঘ্নে রাজকার্য চালাইলেন, অধীন সর্বসাধারণ তাঁহার নিরপেক্ষ বিচারে আশার অতিরিক্ত সুখী হইলেন; সকলেই তাঁহার আজ্ঞাকারী। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ সদাসর্বদা আজ্ঞাবহ কিঙ্করের ন্যায় উপস্থিত থাকিয়া মোস্‌লেমের আদেশ প্রতিপালনে ভক্তির প্রাধান্য দেখাইলেন। মোস্‌লেমের মনে সন্দেহের নামমাত্রও রহিল না। অনেক অনুসন্ধান করিয়াও কোনপ্রকারে কপট ভাবের লক্ষণ, ষড়যন্ত্রের কু-অভিসন্ধি, এজিদের সহিত যোগাযোগের কুমন্ত্রণা, এজিদের পক্ষ হইয়া বাহ্যিক প্রণয়ভাব, অন্তরে তদ্বিপরীত, ইহার কিছুই জানিতে পারিলেন না। দুই কর্ণ হইলে তো সন্ধানের অঙ্কুর পাইবেন? যাহা আছে, তাহা জেয়াদের অন্তরেই রহিয়াছে। কুফা নগরে জেয়াদের অন্তর ভিন্ন হোসেন সম্বন্ধীয় নিগূঢ় কথা কাহারো কর্ণে প্রবেশ করে নাই। এমন কি, জেয়াদ্ অন্তর হইতে সে কথা আপন মুখে আনিতেও কত সতর্কভাব অবলম্বন করিয়াছেন, অপরের কর্ণে যাইবার কোনই সম্ভাবনা নাই। মোস্‌লেম পরাস্ত হইলেন। তাঁহার সন্ধান ব্যর্থ হইল, চতুরতা ভাসিয়া গেল। বাধ্য হইয়া কুফার আনুপূর্বিক সমস্ত বিবরণ মদিনায় লিখিয়া পাঠাইলেন।

এই লিখিলেন,-

“হজরত! নির্বিঘ্নে আমি কুফায় আসিয়াছি। রাজা জেয়াদ্ সমাদরে আমাকে গ্রহণ করিয়াছেন। কোন কপটতা জানিতে পারি নাই। নগরবাসীরা ইমাম নামে চিরবিশ্বস্ত এবং চিরভক্ত, লক্ষণে তাহাও বুঝিলাম। এখন আপনার অভিরুচি।

বশংবদ- মোস্‌লেম।”

হোসেন পত্র পাইয়া মহা সন্তুষ্ট হইলেন। পুত্র, কন্যা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভ্রাতৃবধূদ্বয় প্রভৃতির সহিত ঈশ্বরের নাম করিয়া কুফায় যাত্রা করিলেন। ষষ্টি সহস্র লোক মদিনা পরিত্যাগ করিয়া হোসেনের অনুগামী হইল। ইমাম হোসেন সকলের সহিত একত্রে কুফাভিমুখে আসিতে লাগিলেন; কিন্তু এজিদের কথা মনে হইলেই তাঁহার মুখ সর্বদা রক্তবর্ণে রঞ্জিত হইয়া উঠিত। হজরতের রওজা আশ্রয়ে থাকায় কোনদিন কোন মুহূর্তে অন্তরে ভয়ের সঞ্চার হয় নাই। এক্ষণে প্রতি মুহূর্তে এই আশঙ্কা যে, এজিদের সৈন্য পশ্চাদ্বর্তী হইয়া আক্রমণ করিলে আর নিস্তার নাই। ক্রমে এগারো দিন অতীত হইল, এগারো দিনের পর হোসেনের অন্তর হইতে এজিদের ভয় ক্রমে ক্রমে দূর হইতে লাগিল। মনে সাহস এই যে, কুফা অতি নিকটে, সেখানে এজিদের ক্ষমতা কি? একেবারে নিশ্চিন্ত হইয়া যাইতে লাগিলেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদের গুপ্তচরগণ চতুর্দিকে রহিয়াছে, হোসেনের মদিনা পরিত্যাগ হইতে এ পর্যন্ত যে দিন যে প্রকারে যে স্থানে অবস্থিতি করিতেছেন, যেখানে যাইতেছেন, সকল সংবাদই প্রতিদিন দামেস্কে এবং কুফায় যাইতেছে। কুফা নগরে মোস্‌লেমেকে প্রকাশ্য রাজসিংহাসনে জেয়াদ্ বিশেষ ভক্তিসহকারে বসাইয়াছেন। মোস্‌লেম প্রকাশ্যে রাজা, কিন্তু জেয়াদের মতে তিনি এক প্রকার বন্দি। সহস্র সৈন্য সহিত মোস্‌লেম কুফায় বন্দি। জেয়াদ্ এমন কৌশলে তাঁহাকে রাখিয়াছেন এবং মোস্‌লেমের আদেশানুসারে কার্য করিতেছেন যে, মোস্‌লেম যে জেয়াদ্-চক্রে বাস্তবিক সৈন্যসহ বন্দি, তাহা তিনি কিছুই জানিতে পারিতেছেন না; কেবল হোসেনের আগমন প্রতীক্ষা।

ঈশ্বরের মহিমার অন্ত নাই। একটি সামান্য বৃক্ষপত্রে তাঁহার শত সহস্র মহিমা প্রকাশ পাইতেছে। একটি পতঙ্গের ক্ষুদ্র পালকে তাঁহার অনন্ত শিল্পকার্য বিভাসিত হইতেছে। অনন্ত বালুকারাশির একটি ক্ষুদ্র বালুকাকণাতে তাঁহার অনন্ত করুণা আঁকা রহিয়াছে। তুমি-আমি সে করুণা হয়তো জানিতে পারিতেছি না; কিন্তু তাঁহার লীলাখেলার মাধুর্য, কীর্তিকলাপের বৈচিত্র, বিশ্বরঙ্গভূমির বিশ্বক্রীড়া একবার পর্যালোচনা করিলে ক্ষুদ্র মানববুদ্ধি বিচেতন হয়। তন্মধ্যে প্রবেশ করিয়া অণুমাত্রও বুঝিবার ক্ষমতা মানুষী বুদ্ধিতে সুদুর্লভ! সেই অব্যর্থ কৌশলীর কৌশলচক্র ভেদ করিয়া তন্মধ্যে প্রবেশ করে কাহার সাধ্য? ভবিষ্যদ্গর্ভে কি নিহিত আছে, কে বলিতে পারে? কোন্ বুদ্ধিমান্ বলিতে পারেন যে, মুহূর্ত অন্তে তিনি কি ঘটাইবেন? কোন মহাজ্ঞানী পণ্ডিত তাঁহার কৌশলের কণামাত্র বুঝিয়া তদ্বিপরীত কার্যে সক্ষম হইতে পারেন? জগতে সকলেই বুদ্ধির অধীন, কিন্তু ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্যে বুদ্ধি অচল, অক্ষম, অস্ফুট এবং অতি তুচ্ছ। ষষ্টি সহস্র লোক হোসেনের সঙ্গে কুফায় যাইতেছে, সূর্যদেব পথ দেখাইতেছেন, তরু পর্বত নির্ঝরিণী পথের চিহ্ন দেখাইয়া লইয়া যাইতেছে, কুফার পথ পরিচিত; কত লোক তন্মধ্যে রহিয়াছে, কত লোক সেই পথে যাইতেছে, চক্ষু বন্ধ করিয়াও তাহারা কুফা নগরে যাইতে অসমর্থ নহে। সেই সর্বশক্তিমান পূর্ণ কৌশলীর কৌশলে আজ সকলেই অন্ধ-চক্ষু থাকিতেও অন্ধ। তাঁহার যে আজ্ঞা সেই কার্য; এক দিন যে আজ্ঞা করিয়াছেন, তাহার আর বৈলক্ষণ্য নাই, বিপর্যয় নাই, ভ্রম নাই। একবার মনোনিবেশপূর্বক অনন্ত আকাশে, অনন্ত জগতে, অনন্ত প্রকৃতিতে বাহ্যিক নয়ন একেবারে নিপ্তি করিয়া যথার্থ নয়নে দৃষ্টিপাত কর, সেই মহাশক্তির কিঞ্চিৎ শক্তি বুঝিতে পারিবে। যাহা আমরা ধারণা করিতে পারি, তাহা দেখিয়া একেবারে বিহ্বল হইতে হয়। তাঁহার আজ্ঞা অলঙ্ঘনীয়, বাক্য অব্যর্থ! হোসেন মহানন্দে কুফায় যাইতেছেন-ভাবিতেছেন, কুফায় যাইতেছি, কিন্তু ঈশ্বর তাঁহাকে পথ ভুলাইয়া বিজন বন কারবালার পথে লইয়া যাইতেছেন, তাহা তিনি কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছেন না। কেবল তিনি কেন, ষষ্টি সহস্র লোক চক্ষু থাকিতে যেন অন্ধ। আবদুল্লাহ্ জেয়াদের সন্ধানী অনুচর গোপনে আবদুল্লাহ্ জেয়াদের নিকট যাইয়া সংবাদ দিল যে, ইমাম হোসেন মদিনা হইতে ষষ্টি সহস্র সৈন্য সঙ্গে করিয়া কুফায় আসিতেছিলেন, পথ ভুলিয়া ঘোর প্রান্তরে কারবালাভিমুখে যাইতেছেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ মহা সন্তুষ্ট হইয়া শুভসংবাদবাহী আগন্তুক চরকে যথোপযুক্ত পুরস্কৃত করিয়া বলিলেন, “তোমাকেই আজ কাসেদ্পদে বরণ করিয়া দামেস্কে পাঠাইতেছি।”

আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ এজিদের নিকট পত্র লিখিলেন, “বাদশার অনুগ্রহে দাসের প্রাণদান হউক! আমি কৌশল করিয়া মোহাম্মদের রওজা হইতে ইমাম হোসেনকে বাহির করিয়াছি। বিশ্বস্ত গুপ্ত সন্ধানী অনুচরমুখে সন্ধান পাইলাম যে, ইমাম হোসেন কুফা নগরের পথ ভুলিয়া দাস্ত কারবালা অভিমুখে যাইতেছেন। তাঁহার পূর্বপ্রেরিত সাহসী মহাবীর মোস্‌লেমকে কৌশলে বন্দি করিয়া রাখিয়াছি। এই অবসরে হোসেনের পশ্চাৎ পশ্চাৎ কতকগুলি ভাল ভাল সৈন্য প্রেরণ করা নিতান্ত আবশ্যক। ওত্‌বে অলীদকে কুফার দিকে সৈন্যসহ পাঠাইলে প্রথমে মোস্‌লেমকে মারিয়া পরে তাহারাও হোসেনের পশ্চাদ্বর্তী হইয়া হোসেনকে আক্রমণ করিবে। প্রথমে মোস্‌লেমকে মারিতে পারিলে, আর হোসেনের মস্তক দামেস্কে পাঠাইতে কিছুই বিঘ্ন হইবে না,-ক্ষণকাল বিলম্ব হইবে না।”

আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ স্বহস্তে পত্র লিখিয়া গুপ্তসন্ধানী অনুচরকে কাসেদ্ পদে নিযুক্ত করিয়া দামেস্কে পাঠাইলেন। এদিকে মোস্লেমের নিকট দিন দিন আরো ন্যূনতা স্বীকার করিয়া, তাঁহার যথোচিত সেবা করিতে লাগিলেন এবং সময়ে সময়ে হোসেনের আগমনে বিলম্বজনিত দুঃখে নানাপ্রকার দুঃখ প্রকাশ করিয়া, মোস্লেমকে নিশ্চিন্ত রাখিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ প্রেরিত কাসেদ্ পুরস্কার-লোভে দিবারাত্রি পরিশ্রম করিয়া দামেস্কে পৌঁছিলেন। দামেস্কাধিপতি এজিদ্ কাসেদের পরিচয় পাইয়া সমুদয় বৃত্তান্ত নির্জনে অবগত হইয়া, মহানন্দে কাসেদ্‌কে যথোচিত পুরস্কৃত করিয়া প্রধান সৈন্য ও সৈন্যাধ্যগণকে আহ্বানপূর্বক বলিতে লাগিলেন, “এত দিনের পর আমার পরিশ্রমের ফল ফলিয়াছে। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ কৌশল করিয়া হোসেনকে মদিনা হইতে বাহির করিয়াছেন, তোমরা এখনই প্রস্তুত হইয়া হোসেনের অনুসরণ কর। মরুস্থল কারবালার পথে যাইলে পলাতক হোসেনের দেখা পাইবে। যদি পথের মধ্যে আক্রমণ করিবার সুযোগ না হয়, তবে একেবারে নির্দিষ্ট স্থানে যাইয়া অগ্রে ফোরাত নদীর পূর্বকূল বন্ধ করিবে। মদিনা হইতে কুফা পর্যন্ত গমনোপযোগী আহারীয় এবং পানীয় বস্তুর সুবিধা করিয়া হোসেন মদিনা পরিত্যাগ করিয়াছেন। সঙ্গেও ষষ্টি-সহস্র লোক। ইহাদের পানোপযোগী জল সর্বদা সংগ্রহ করা সহজ কথা নহে। তোমাদের প্রথম কার্যই কারবালার ফোরাত নদীর কূল আবদ্ধ করিয়া রাখা। হোসেন-পক্ষীয় একটি প্রাণীও যেন ফোরাতকূলে আসিতে না পারে, ইহার বিশেষ উপায় করিতে হইবে। দিবারাত্রি সদাসর্বদা সতর্কভাবে থাকিবে যে, কোন সময়ে কোন সুযোগে এক পাত্র জল হোসেনের কি তৎসঙ্গী কোন লোকের আশু প্রাপ্য না হয়। বারি রোধ করিতে পারিলেই তোমাদের কার্য সিদ্ধ হইবে। হোসেনের মস্তক যে ব্যক্তি এই দামেস্কে আনিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত করিবে, তৎক্ষণাৎ তাহাকে লক্ষ মুদ্রা পুরস্কার দিব এবং বিজয়ী সৈন্যদিগের নিমিত্ত দামেস্কের রাজভাণ্ডার খুলিয়া রাখিব। যাহার যত ইচ্ছা, সে তাহা গ্রহণ করিতে পারিবে; কোন প্রতিবন্ধক থাকিবে না।”

প্রধান প্রধান সৈন্যগণ, ওমর, সীমার প্রভৃতি বলিয়া উঠিলেন, “মহারাজ! এবার হোসেনের মস্তক না লইয়া আর দামেস্কে ফিরিব না।” সীমার অতিদর্পে বলিতে লাগিল, “আর কেহই পারিবে না, আমিই হোসেনের মাথা কাটিব, কাটিব-নিশ্চয়ই কাটিব; পুরস্কারও আমিই লইব। আর কেহই পারিবে না। হোসেনের মাথা না লইয়া সীমার এ নগরে আর আসিবে না। -এ-ই সীমারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।”

এজিদ্ বলিলেন, “পুরস্কারও ধরা রহিল।” এই বলিয়া এজিদ্ সীমারকে প্রধান সৈন্যধ্যক্ষ পদে নিয়োজিত করিয়া বিদায় করিলেন।

পাঠকগণ! এতদিন আপনাদের সঙ্গে আসিতেছি, কোন দিন মনের কথা বলি নাই। বিষাদ-সিন্ধুতে হাসি রহস্যের কোন কথা নাই, তন্নিমিত্ত এ পর্যন্ত হাসি নাই। কাঁদিবার অনেক কথা আছে, অথচ নিজে কাঁদিয়া আপনাদিগকে কাঁদাই নাই। আজ মন কাঁপিয়া উঠিল। সীমার হোসেনের মস্তক না লইয়া আর দামেস্কে ফিরিবে না-প্রতিজ্ঞা করিল। সীমার কে? পরিচয় এখনো প্রকাশ পায় নাই; কিন্তু ভবিষ্যতে ইহার পরিচয় অপ্রকাশ থাকিবে না। সীমারের নামে কেন যে হৃদয়ে আঘাত লাগিতেছে, জানি না। সীমারের রূপ কোন লেখকই বর্ণনা করেন নাই, আমিও করিব না। কল্পনাতুলি হস্তে তুলিয়া আজ আমি এখন সেই সীমারের রূপ বর্ণনে অক্ষম হইলাম। কারণ বিষাদ-সিন্ধুর সমুদয় অঙ্গই ধর্মকাহিনীর সহিত সংশ্লিষ্ট। বর্ণনার কোন প্রকার ন্যূনাধিক্য হইলে প্রথমতঃ পাপের ভয়, দ্বিতীয়তঃ মহাকবিদিগের মূল গ্রন্থের অবমাননাভয়ে তাঁহাদের বর্ণনায় যোগ দিলাম। সীমারের ধবল বিশাল বক্ষে লোমের চিহ্নমাত্র নাই, মুখাকৃতি দেখিলেই নির্দয় পাষাণহৃদয় বলিয়া বোধ হইত-দন্তরাজি দীর্ঘ ও বক্রভাবে জড়িত-প্রাচীন কবির এইমাত্র আভাস এবং আমারও এইমাত্র বলিবার অধিকার, নাম সীমার।

এজিদ্ সৈন্যদিগকে নগরের বাহির করিয়া দিয়া ফিরিয়া আসিলেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদের লিখনানুসারে মারওয়ানকে সৈন্যসহ মদিনা পরিত্যাগ করিয়া কুফা নগরে মোস্‌লেমকে আক্রমণ করিবার জন্য আদেশ প্রদান করিলেন। সংবাদবাহক সংবাদ লইয়া যাইবার পূর্বেই ওত্‌বে অলীদ ও মারওয়ান সৈন্যসহ হোসেনের অনুসরণ করিতে কুফার পথে যাত্রা করিয়াছিলেন। পথিমধ্যে দামেস্কের কাসেদ্মুখে সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া অলীদ এবং মারওয়ান অবিশ্রামে কুফাভিমুখে সৈন্যসমভিব্যাহারে যাইতে লাগিলেন। দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া বুদ্ধির অগম্য; চিন্তার বহির্ভূত-অল্প সময় মধ্যে কুফার নিকটবর্তী হইলে জেয়াদের অনুচরেরা জেয়াদের নিকট সংবাদ দিল যে, “মহারাজ এজিদের সৈন্যাধ্যক্ষ মারওয়ান এবং ওত্‌বে অলীদ সৈন্যসহ নগরপ্রান্তে উপস্থিত হইয়াছেন, কী কর্তব্য?”

জেয়াদ এতৎ সংবাদে মহা সন্তুষ্ট হইয়া মোস্‌লেম-সমীপে যাইয়া করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “বাদশাহ নামদার! এজিদের প্রধান সৈন্যাধ্য মহাবীর মারওয়ান এবং ওত্‌বে অলীদ কুফার অতি নিকটবর্তী হইয়াছে। বোধ হয় অদ্যই নগর আক্রমণ করিবে। প্রভু হোসেনের আশায় এত দিন রহিলাম, তিনিও আসিলেন না; শত্রুপক্ষ নগরের সীমার নিকটবর্তী, এক্ষণে কী আদেশ হয়?”

মোস্‌লেম বলিলেন, “আমরা এমন কাপুরুষ নহি যে, শত্রু-অস্ত্রের আঘাত সহ্য করিয়া নগর রক্ষা করিব? আমি এখনই আমার সঙ্গী সৈন্য লইয়া মারওয়ানের গতিরোধ করিব এবং নগর আক্রমণে বাধা দিয়া তাহাদিগকেই আক্রমণ করিব। আপনি যত শীঘ্র পারেন, কুফার সৈন্য লইয়া আমার পশ্চাদ্বর্তী হউন। সৈন্যসহ আপনি আমার পশ্চাৎ-রক্ষক থাকিলে ঈশ্বর-কৃপায় আমি সহস্র মারওয়ানকে অতি তুচ্ছ জ্ঞান করি!” এই কথা বলিয়াই মোস্লেম মদিনার সৈন্যগণকে প্রস্তুত হইতে অনুমতিসঙ্কেত করিলেন। মদিনাবাসীরা এজিদ্ এবং এজিদের সৈন্য-শোণিতে তরবারি রঞ্জিত করিতে সদাসর্বদা প্রস্তুত। মোস্‌লেমের সাঙ্কেতিক অনুমতি, মারওয়ানের সহিত যুদ্ধের অণুমাত্র প্রসঙ্গ পাইয়াই সৈন্যগণ মার্ মার্ শব্দে শ্রেণীবদ্ধপূর্বক মোস্‌লেমের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। সৈন্যদিগের উৎসাহ দেখিয়া মোস্‌লেম দ্বিগুণতর উৎসাহে অশ্বে আরোহণ করিলেন এবং মুহূর্ত মধ্যে সৈন্যগণ শ্রেণীবদ্ধপূর্বক নগরের বাহির হইলেন। কুফার সৈন্যগণও অত্যল্প সময় মধ্যে সুসজ্জিত হইয়া পূর্বতন প্রভু জেয়াদের সহিত সমরে চলিলেন।

মোস্‌লেম নগরের বাহির হইয়াই দেখিলেন যে, এজিদের চিহ্নিত পতাকাশ্রেণী বায়ু সহিত ক্রীড়া করিতেছে, যুদ্ধবাদ্য মহাঘোর রবে বাদিত হইতেছে। সৈন্যগণকে বলিলেন, “ভাই সকল! যে এজিদ্, যে মারওয়ান, যে ওত্‌বে অলীদের ভয়ে হোসেন মদিনাবাসীদিগের জন্য, মদিনাবাসীদিগের বিপদ উপদ্রব হইতে রক্ষার জন্য, কুফায় আসিতে মনস্থ করিয়া অগ্রে আমাদিগকে পাঠাইয়াছেন, সেই বিধর্মী কাফের তাঁহারই উদ্দেশে, কি আমাদের প্রাণ লইতে, কি আমাদিগকে যে এত সাহায্য করিতেছে, সেই জেয়াদের প্রাণ বিনাশ করিতে আসিয়াছে। কুফার সৈন্য আসিতে এখনও অনেক বিলম্ব। শত্রুকে সময় দিলেই চতুর্গুণ বল বৃদ্ধি হয়। আর অপেক্ষা নাই, ‘কুফার সৈন্য আসিবে, একত্র যাইব’-ইহা বলিয়া আর সময় নষ্ট করিব না। আমরাই অগ্রে গিয়া শত্রুপকে বাধা দিয়া আক্রমণ করি।” মোস্‌লেম সহস্র সৈন্য লইয়া একেবারে শত্রুপক্ষের সম্মুখীন হইলেন এবং তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল।

জেয়াদ্ কুফার সৈন্য সংগ্রহ করিয়া মোস্‌লেমের পশ্চাদ্বর্তী হইলেন। নগরের অন্তসীমা শেষ তোরণ পর্যন্ত আসিয়া দেখিলেন, নগরের অন্তসীমায় যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। সৈন্যগণ অবাক্ হইল। সকলেই পূর্ব প্রভুর আজ্ঞা হঠাৎ লঙ্ঘন করা বিবেচনাসিদ্ধ নহে, এই বলিয়া বিরক্তিভাবে দণ্ডায়মান রহিল।

আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ বলিতে লাগিলেন, “আমি এতদিন মনের কথা তোমাদিগকে কিছুই বলি নাই, আজ বলিবার সময় হইয়াছে বলিয়াই এণে বলিতেছি। হোসেনকে রাজ্যদান আমার চাতুরীমাত্র। আমি মহারাজ এজিদের আজ্ঞাবহ, অনুগৃহীত, আশ্রিত এবং দামেস্কাধিপতি আমার একমাত্র পূজ্য। কারণ আমি তাঁহার অধীনস্থ প্রজা। সেই রাজাদেশে হোসেনকে কৌশল করিয়া বন্দি করাই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য, ঘটনাক্রমে তাহা হইল না। মোস্‌লেমকে যে উদ্দেশ্যে সিংহাসনে বসাইয়াছিলাম, তাহা এক প্রকার সম্পূর্ণ হইল; কিন্তু মূল উদ্দেশ্য সফল হইল না। মহারাজ এজিদের সৈন্য আসিয়াছে, কৌশলে মোস্‌লেমকেও নগরের বাহির করিয়া মহারাজ এজিদের সৈন্যসম্মুখীন করিয়া দিলাম, রাজাজ্ঞা প্রতিপালিত হইল! আমাদের নগরের বাহিরে কোন প্রয়োজন নাই, আমরা যুদ্ধে যাইব না, মোস্‌লেমের সহায়তাও করিব না। নগর-তোরণ আবদ্ধ কর, বলবান সাহসী সৈনিক পুরুষ দ্বারা দ্বার রক্ষা হউক। মোস্‌লেমের বাঁচিবার সাধ্য নাই। ওত্‌বে অলীদের অস্ত্রসম্মুখীন হইলেই মোস্‌লেমের ইহজগৎ পরিত্যাগ করিতে হইবে। তথাচ যদি মোস্‌লেম যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া প্রাণরক্ষার জন্য নগরে আশ্রয় লইতে নগরদ্বারে উপস্থিত হয়, কিছুতেই নগরমধ্যে প্রবেশ করিতে দিবে না।”

সৈন্যাধ্যক্ষ আবদুল্লাহ্ জেয়াদের বাক্যে একেবারে অবাক্ হইয়া রহিল। জেয়াদের মনে এত চাতুরী, এত ছলনা, এত প্রতারণা, ইহাতে আরো আশ্চর্যান্বিত হইল। কি করিবে নগরদ্বার রুদ্ধ করিয়া দ্বারের নিকটবর্তী স্থানেই সৈন্য সহিত সকলেই একত্র হইয়া রহিল। ওত্‌বে অলীদ মোস্‌লেমকে দেখাইয়া সৈন্যগণকে বেগে অগ্রসর হইতে অনুমতি করিলেন। মোস্‌লেম ওত্লবে অলীদের আক্রমণে বাধা দিয়া বিশেষ পারদর্শিতার সহিত ব্যূহ রচনা করিয়া শত্রুসম্মুখে সৈন্যদিগকে দণ্ডায়মান করাইলেন। কিন্তু আক্রমণ করিতে আর সাহসী হইলেন না, আত্মরক্ষাই আবশ্যক মনে করিলেন। কুফার সৈন্য কত নিকটবর্তী হইয়াছে, তাহা দেখিতে পশ্চাতে ফিরিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে মোস্‌লেমের মস্তক ঘুরিয়া গেল। জনপ্রাণীমাত্র নাই, অথচ নগরতোরণ বদ্ধ-মোস্‌লেম একেবারে হতবুদ্ধির ন্যায় হইয়া নগরের দিকে বারংবার চাহিয়া দেখিলেন, পূর্ব প্রকারেই নগরদ্বার বদ্ধ রহিয়াছে। নিশ্চয়ই মনে মনে জানিলেন যে, এ সকল জেয়াদের চাতুরী। চতুরতা করিয়া আমাকে নগরের বাহির করিয়াছে। এখন নিশ্চয়ই জানিলাম যে, জেয়াদের মনে নানাপ্রকার দুরভিসন্ধি ছিল। হোসেন-বধের জন্যই এই মায়াজাল বিস্তার,-তাহার তো আর সন্দেহ নাই। ভালই হইয়াছে, কুফায় আসিলে যে প্রকার বিপদগ্রস্ত হইতেন, তাহা আমার ভাগ্যেই ঘটিল। মোস্‌লেমের প্রাণ যাইয়াও যদি হোসেনের প্রাণরক্ষা হয়, তাহাও মোস্‌লেমের পক্ষে সার্থক।

মোস্‌লেম হতাশ হইলেন না; কিন্তু তাঁহাকে নূতন প্রকার চিন্তার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতে হইল। নিজ সৈন্য এবং কুফার সৈন্যের সাহায্যে যে যে প্রকার যুদ্ধের কল্পনা করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা পরিবর্তন করিয়া নূতনরূপ চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। ওদিকে ওত্‌বে অলীদ কি মনে করিয়া আর অগ্রসর হইলেন না। আপন আয়ত্তাধীনে সম্ভবতঃ দূরে থাকিয়াই দ্বৈরথ যুদ্ধ আরম্ভ করিবার অভিপ্রায়ে মহাবীর ওত্‌বে অলীদ গম্ভীর স্বরে বলিতে লাগিলেন, “মোস্‌লেম, যদি নিতান্তই যুদ্ধসাধ হইয়া থাকে, তবে আইস, আমরাই উভয়ে যুদ্ধ করি, জয়-পরাজয় আমাদের উভয়ের উপরেই নির্ভর। অনর্থক অন্য অন্য প্রাণ বিনষ্ট করিবার আবশ্যক কী?”

মোসলেম সে কথায় উত্তর না দিয়া কতক সৈন্য সহিত ওত্‌বে অলীদকে ঘিরিয়া ফেলিলেন।

ওত্‌বে অলীদ আবার বলিলেন, “মোস্‌লেম! এই কী যুদ্ধের রীতি, না বীরপুরুষের কর্তব্য কার্য? কে তোমাকে বীর আখ্যা দিয়াছিল? ‘কহ মহারথি! এই কী মহারথি-প্রথা’?”

মোস্‌লেম সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া সৈন্যদিগকে বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! বিধর্মীর হস্তে মৃত্যুই বড় পুণ্য। প্রভু মোহাম্মদের দৌহিত্রগণকে যাহারা, যে পাপাত্মারা-যে নরপিশাচেরা শত্রু মনে করে, তাঁহাদের প্রাণবিনাশের চেষ্টা করে, তাহাদের হস্তে প্রাণবিসর্জন করিতে পারিলে, তাহা অপেক্ষা ইহজগতে আর কী অধিকতর সুখ আছে? এক দিন মরিব বলিয়াই জন্মিয়াছি। যে মরণে সুখ, সহস্র সহস্র পাপ থাকিলেও সর্বসুখ ভোগের অধিকার, এমন মরণে কে না সুখী হয়? আমরা যুদ্ধে জয়ী হইব না, আশাও করি না। তবে বিধর্মীয় হস্তস্থিত তরবারি ইসলাম-শোণিতে রঞ্জিত হইয়া পরিণামে আমাদিগকে স্বর্গ-সুখের অধিকারী করিবে, এই আমাদের আশা। জয়ের আশা আর মনে করিয়ো না, আজই যুদ্ধের শেষ-আজই আমাদের জীবনের শেষ।” মোস্লেম এই বলিয়া ওত্‌বে অলীদের প্রতি অস্ত্রবর্ষণ করিতে লাগিলেন; মারওয়ান দেখিলেন যে, অলীদের পরমায়ু শেষ হইল, সমুদয় সৈন্য একত্রিত করিয়া মোস্‌লেম আক্রমণ করিয়াছে! ইহাতে একা এক প্রাণ, কতণ অলীদ রক্ষা করিবে? ক্ষণকাল বিলম্ব না করিয়া মারওয়ান সমুদয় সৈন্যসহ মোস্‌লেমকে আক্রমণ করিলেন। ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ হইল। মোস্‌লেমের জীবনের আশা নাই; তাঁহার সৈন্যগণ বিধর্মীর হস্তে মরিবে, সেই আশায় কেবল মারিতেই লাগিলেন; ভবিষ্যৎ জ্ঞান, পশ্চাৎ লক্ষ্য, পার্শ্বে দৃষ্টি ইত্যাদির প্রতি কিছুই লক্ষ্য রাখিলেন না। মহাবীর মোস্‌লেম দুই হস্তে তরবারি ধরিলেন। অশ্ববল্গা দন্তে আবদ্ধ করিলেন। শত্রুসৈন্য অকাতরে কাটিয়া চলিলেন। মধ্যে মধ্যে “আল্লাহু আক্‌বার” নিনাদে দ্বিগুণ উৎসাহে সৈন্যদিগকে উৎসাহিত করিলেন। ওত্‌বে অলীদ ও মারওয়ান বহু পরিশ্রম ও বহু চেষ্টা করিয়াও মোস্‌লেমের লঘুহস্তচালিত চপলাবৎ তরবারি সম্মুখে আর তিষ্টিতে পারিলেন না। ক্ষণকালমধ্যে সৈন্যগণ ছত্রভঙ্গ হইয়া দিগ্বিদিকে পলাইতে লাগিল। মোস্‌লেমের সৈন্যগণও ঐ পলায়িত শত্রুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইয়া দেহ হইতে বিধর্মী মস্তক মৃত্তিকাশায়ী করিতে লাগিল।

আবদুল্লাহ্ জেয়াদ নগরতোরণোপরিস্থ অতি উচ্চ মঞ্চে উঠিয়া উভয় দলের যুদ্ধ দেখিতেছিলেন। দেখিলেন, মোস্‌লেমের তরবারির সম্মুখে কেহই অগ্রসর হইতে পারিতেছে না। বহুতর সৈন্য মৃত্তিকাশায়ী হইয়াছে। যাহারা জীবিত আছে, তাহারাও প্রাণভয়ে দিশেহারা হইয়া পলাইতেছে। জেয়াদ মঞ্চ হইতে নামিয়াই দ্বাররককে বলিলেন, “দ্বার খুলিয়া দাও।” সৈন্যগণকে আদেশ করিলেন যে, “আমার পশ্চাদ্বর্তী হইয়া মোস্‌লেমকে আক্রমণ কর, আমরা সাহায্য না করিলে ওত্‌বে অলীদের প্রাণ কখনোই রক্ষা হইবে না।”

রাজাজ্ঞা প্রাপ্তিমাত্রই লক্ষাধিক সৈন্য জয়নাদে তুমুল শব্দ করিয়া পশ্চাদ্দিক হইতে মোস্‌লেমকে আক্রমণ করিল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ স্বয়ং যুদ্ধে আসিতেছেন, মোস্‌লেমের সেদিকে দৃষ্টিপাত নাই, কেবল অশ্ববল্গা দন্তে ধারণ করিয়া দুই হস্তে বিধর্মী নিপাত করিতেছেন। যাহাকে যে অবস্থায় পাইতেছেন, সেই অবস্থাতেই দেহ হইতে মস্তক ছিন্ন, কাহাকেও অশ্ব সহিত এক চোটে দ্বিখণ্ডিত করিয়া, জন্মশোধ যুদ্ধের সাধ মিটাইতেছেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ পশ্চাদ্দিক হইতে মোস্‌লেমকে আক্রমণ করিবার উপক্রম করিলেই, ওত্‌বে অলীদ উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “মোস্‌লেম ঈশ্বরের নাম মনে কর; তোমার সাহায্যের জন্য আবদুল্লাহ্ জেয়াদ লক্ষাধিক সৈন্য লইয়া আসিয়াছেন।”

মোস্‌লেম জেয়াদের নাম শুনিয়া চমকিতভাবে পশ্চাতে ফিরিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে আর কিছুই বলিলেন না। কেবলমাত্র বলিলেন, “বিধর্মীর কথায় কে বিশ্বাস করিবে, কাফেরের ভক্তিতে যে মুসলমান ভুলিবে, তাহার দশাই এইরূপ হইবে।” মোস্‌লেম ভীত হইলেন না, যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়াও পরাজয় স্বীকার করিলেন না, পূর্বমত বিধর্মীশোণিতে মৃত্তিকা রঞ্জিত করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহাতে কোনই ফল হইল না। চতুর্দিক হইতে অবিশ্রান্তরূপে মোস্‌লেমের শরীরে শর বিদ্ধ হইতে লাগিল; সর্বাঙ্গে শোণিতধারা ছুটিল। অশ্বপদতলে বিধর্মীর রক্তস্রোত বহিতেছে, যুদ্ধক্ষেত্র মনুষ্যদেহে পরিপূর্ণ হইয়াছে, শোণিতসিক্ত মৃত্তিকায় প্রিগামী অশ্বপদ স্খলিত হইতেছে; তথাচ মহাবীর মোস্‌লেম শত্রুক্ষয় করিতে নিবৃত্ত হইতেছেন না। এত মারিতেছেন, কিন্তু কিছুতেই তাহার শেষ হইতেছে না। দিনমণিও সমস্ত দিন এই ঘোরতর যুদ্ধ দেখিয়া লোহিতবর্ণে অস্তমিত হইলেন। তৎসঙ্গেই ইস্‌লামগৌরব-রবি মহাবীর মোস্‌লেম লোহিত বসনে আবৃত হইয়া-জগৎ অন্ধকার করিয়া শত্রুহস্তে প্রাণবিসর্জনপূর্বক স্বর্গগামী হইলেন। মদিনার একটি প্রাণীও আর বিধর্মীর অস্ত্র হইতে রক্ষা পাইল না।

যুদ্ধাবসানে নরপতি জেয়াদ দর্পের সহিত বলিতে লাগিলেন-

“মদিনার শত্রুকুল,-মহারাজ এজিদ্ নামদারের নামের বলেই এইরূপ নির্মূল হইবে। সেইরূপ চিন্তা করিয়া কৌশলজাল বিস্তার করিয়াছিলাম, তাহাতে বাদশা নামদারের মহাশত্রু আজ সবংশে বিনষ্ট হইত, দৈববিপাকে তাহা হইল না। মোস্‌লেমের যে দশা ঘটিল, প্রধান শত্রু হোসেনকেও সেই দশায় পতিত হইতে হইত। দামেস্ক এবং কুফার সৈন্যের তরবারি-ধারে হোসেন-মস্তক নিশ্চয়ই দেহ-বিচ্ছিন্ন হইত। পরিবার-পরিজন-সঙ্গীরাও আজ কুফার সিংহদ্বারের সম্মুখস্থ প্রান্তরে রক্তমাখা হইয়া গড়াগড়ি যাইত। ভাগ্যক্রমে হোসেন ষষ্টি-সহস্র লোকজনসহ কুফার পথ ভুলিয়া কারবালার পথে গিয়াছে; জেয়াদের হস্ত হইতে রক্ষা পাইয়াছে। সম্পূর্ণরূপে সর্বাংশে যশ লাভ করিতে পারিলাম না, ইহাই আমার নিদারুণ আক্ষেপ! মদিনার একটি প্রাণীও আজ কুফার সৈন্যগণের হস্ত হইতে রক্ষা পায় নাই। সমুদয় শেষ হইয়া যমালয়ে গমন করিয়াছে। একটি প্রাণীও পলাইতে পারে নাই। ধন্য কুফার সৈন্য!”

গুপ্তচর, গুপ্তসন্ধানিগণ মধ্য হইতে একজন বলিল- “ধর্মাবতার! মোস্‌লেমের দুই পুত্র মারা যায় নাই, ধরা পড়িয়া বন্দিও হয় নাই! তাহারা যুদ্ধাবসানে, যুদ্ধক্ষেত্র হইতে অতিত্রস্তপদে নগরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। কি কৌশলে যে তাহারা কুফার সৈন্যগণচক্ষে ধূলি দিয়া প্রাণ বাঁচাইল,-আর এ পর্যন্ত যে জীবিত আছে,-ইহাই আশ্চর্য! মহারাজ! তাহারা দুই ভ্রাতা এই নগরেই আত্মগোপন করিয়া রহিয়াছে। আমরা বিশেষ সন্ধানে জানিতে পারিয়াছি, তাহারা নগরের বাহিরে যায় নাই,-যাইতে পারে নাই।”

আবদুল্লাহ্ জেয়াদ অতি ব্যস্তভাবে বলিতে লাগিলেন, “সে কী কথা? মোস্‌লেমের পুত্রদ্বয় জীবিত আছে?” অমাত্যগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ওহে! এ কী ভয়ানক কথা? ভুজঙ্গ হইতে ভুজঙ্গশিশুর বিষ যে অত্যধিক মারাত্মক, তাহা কি তোমরা জান না? এখনই ডঙ্কা বাজাইয়া ঘোষণা প্রচার কর। নগরের প্রতি রাজপথে, ক্ষুদ্র পথে, প্রকাশ্য স্থানে নগরবাসীর প্রতি দ্বারে ডঙ্কা, দুন্দুভি, ভেরী বাজাইয়া ঘোষণা করিয়া দাও,-যে ব্যক্তি মোসলেমের পুত্রদ্বয়কে ধরিয়া আমার নিকটে আনিতে পারিবে-সহস্র সুবর্ণমুদ্রা তৎক্ষণাৎ পারিতোষিক পাইবে। আর যে ব্যক্তি মোসলেম পুত্রদ্বয়কে আশ্রয় দিয়া গোপনে রাখিবে, প্রকাশমাত্র বিচার নাই,-কোন কথা জিজ্ঞাস্য নাই,-দ্বিতীয় আদেশের অপেক্ষা নাই, শূলদণ্ডই তাহার জীবনের সহচর। শূলদণ্ডকেই চির আলিঙ্গন করিয়া-প্রাণের সহিত আলিঙ্গন করিয়া মজ্জাভেদে মরিতে হইবে।”

আদেশমত তখনই ঘোষণা প্রচার হইল-নগরময় ঘোষণা প্রচার হইল। কতকলোক অর্থলোভে পিতৃহীন বালকদ্বয়ের অন্বেষণে ছুটিল। নানাস্থানে খুঁজিতে আরম্ভ করিল। পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, মাঠ-ঘাট চারিদিকে সন্ধান করিয়া ব্যস্ততাসহকারে ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতে লাগিল।

মোস্‌লেমের পুত্রদ্বয় ঘোষণা প্রচারের পূর্বেই এক ভদ্রলোকের বাটীতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। সে ভদ্রলোকটি কুফা নগরের বিচারপতি (কাজী)। তিনি বালকদ্বয়ের দুঃখে দুঃখিত হইয়া আশ্রয় দিয়াছেন, পরিতোষরূপে আহার করাইয়া শয়নের ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন। মহাবীর মোস্‌লেমের জন্য আক্ষেপ করিতেছেন। ইতিমধ্যে ঘোষণার বিবরণ শুনিয়া কাজী সাহেব নিতান্তই দুঃখিত হইলেন। কী করেন? কী উপায়ে পিতৃহীন বালক দুটির প্রাণ রক্ষা হইতে পারে, তাহারই সুযোগ-সুবিধা খুঁজিতেছেন, চিন্তা করিতেছেন। বহু চিন্তার পর সঙ্কল্প স্থির করিয়া তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র ‘আসাদ্‌কে’ ডাকিয়া বলিলেন, “প্রাণাধিক পুত্র! দেখ, এই পিতৃহীন বালক দুটির প্রাণ রক্ষার উপায় করিতে হইবে। ঘোষণার বিষয় তো শুনিয়াছ! সাবধান, সতর্কে নিশীথ সময়ে বালকদ্বয়কে সঙ্গে করিয়া নগরের প্রবশেদ্বার পার হইবে। কিছুক্ষণ মদিনার পথে দাঁড়াইলেই মদিনার যাত্রীদল অবশ্যই দেখিতে পাইবে। বহু যাত্রীদলই প্রতি রাত্রিতে গমন করে, অদ্যও করিবে; তাহাদের কোন-এক দলের সহিত বালকদ্বয়কে সঙ্গী করিয়া দিলেই ‘কাফেলায়’ মিশিয়া নিরাপদে মদিনায় যাইতে পারিবে। বালক দুটিরও প্রাণ রক্ষা হইবে, আমরাও নরপতি জেয়াদের ঘোষণা হইতে রক্ষা পাইব।”

কাজী সাহেব এই কথা বলিয়াই দুই ভ্রাতার কোমরে পঞ্চাশ পঞ্চাশ মোহর বাঁধিয়া দিলেন এবং খাদ্যসামগ্রীও পরিমাণ মত উভয় ভ্রাতার সঙ্গে যাহা তাহারা অনায়াসে লইয়া যাইতে পারে তাহা দিয়া দিলেন।

কাজী সাহেবের পুত্র আসাদ্ পিতৃহীন বালকদ্বয়কে সঙ্গে করিয়া নিশীথ সময়ে গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন। সাবধান সতর্কে নগরের সিংহদ্বার পার হইয়া দেখিলেন, একদল যাত্রী মদিনাভিমুখে যাইতেছে, কিন্তু তাহারা কিঞ্চিৎ দূরে গিয়া পড়িয়াছে।

আসাদ্ বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! দেখিতেছ! মদিনার যাত্রীদল যাইতেছে, এমন সুযোগ-সুবিধা আর নাও পাওয়া যাইতে পারে। ঐ যে যাত্রীদল যাইতেছে, তোমরা খোদার নাম করিয়া ঐ দলে মিশিয়া চলিয়া যাও। ঐ যাত্রীদলে মিশিতে পারিলে আর ভয়ের কোন কারণ থাকিবে না। তোমাদিগকে এলাহির হস্তে সঁপিলাম। যাও ভাই! আর বিলম্ব করিয়ো না। শীঘ্র যাও। ভাই সেলাম!” আসাদ্ বিদায় হইলেন। ভ্রাতৃদ্বয় ত্রস্তপদে মদিনার যাত্রীদলের পশ্চাৎ অনুসরণ করিয়া যাইতে লাগিলেন। রজনীর ঘোর অন্ধকার। বালুকাময় পথ। তদুপরি প্রাণের ভয়, দুই ভাই একত্রে দৌড়িতে লাগিলেন,-অগ্রগামী কাফেলার দিক্ লক্ষ্য করিয়া দৌড়িতে লাগিলেন।

জগৎকারণ জগদীশ্বরের মহিমার অন্ত নাই। ভ্রাতৃদ্বয় দৌড়িতে দৌড়িতে মদিনার পথ ভুলিয়া পুনরায় নগরের দিকে-কুফা নগরের দিকে আসিতে লাগিলেন। মনে মনে আশা করিয়াছিলেন, যাত্রীদল বেশি দূর যায় নাই, এখনই তাঁহাদের সঙ্গে যাইয়া দলে মিশিতে পারিব। নির্ভয়ে মদিনায় যাইয়া দুঃখিনী মায়ের চরণ দু’খানি দেখিতে পাইব। আশা করিলে কী হয়? মানুষের আশা পূর্ণ হয় কই? অদৃষ্ট ফেরে পথ ভুলিয়া-মদিনার পথ ভুলিয়া, অন্য পথে, কুফা নগরের দিকেই যে আসিতেছেন, দুই ভাই দৈবঘটনার কিছুই বুঝিতে পারিতেছেন না। ত্রস্তপদে যাইতে যাইতে সম্মুখে দেখিলেন, মশালের আলো। আলো লক্ষ্য করিয়া দৌড়িলেন। যাইয়া দেখিলেন যাত্রীদল নহে। রাজকীয় প্রহরীর দল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, প্রত্যেকের হস্তে জ্বলন্ত মশাল। প্রহরীদিগের সম্মুখে পড়িতেই তাহারা বালকদ্বয়কে দেখিয়া, আকার-প্রকার, তাহাদের রূপের ছটা দেখিয়াই যাহা বুঝিবার বুঝিয়া লইল। আর কি যাইবার সাধ্য আছে? ধরিয়া ফেলিল। পুরস্কার লোভে অগ্রে শহর-কোটালের নিকট লইয়া উপস্থিত করিল, নগরপাল কোটাল উভয় ভ্রাতার আকার-প্রকার দেখিয়াই বুঝিয়া লইলেন, এই বালকদ্বয়ই বীরবর মোস্‌লেমের হৃদয়ের সার, প্রিয় আত্মজ। নগরপাল ভ্রাতৃদ্বয়ের রূপলাবণ্য দেখিয়া যত্নপূর্বক আপন গৃহে রাখিয়া অতি প্রত্যূষে মহারাজ জেয়াদের দরবারে উপস্থিত করিলেন।

কুফাধিপতি মোস্‌লেম তনয়দ্বয়ের রূপলাবণ্য, মুখশ্রী, কিঞ্চিৎ কৃষ্ণ কেশের নয়নর ন দৃশ্য দেখিয়া “শিরচ্ছেদ কর” এ কথাটা আর মুখে উচ্চারণ করিতে পারিলেন না। মায়াবশে বশীভূত হইয়া বলিলেন, “এই বালকদ্বয়কে দ্বিতীয় আদেশ না হওয়া পর্যন্ত বন্দিখানায় রাখিতে বল। কারাধ্যকে আদেশ জানাও যে, ইহারা রাজকীয় বন্দি। কোন প্রকারে কষ্ট না পায়। বন্দিগৃহ হইতে বহির্গত হইতেও না পারে, কোন প্রকারে অসম্মান-অবমাননা যেন না হয়।”

দুই ভ্রাতা করজোড়ে-সবিনয়ে, তাঁহাদের মনের কথা মুখে প্রকাশ করিতে উদ্যোগী হইতেই এদিকে প্রহরীদল উভয়কে লইয়া কারাগৃহে প্রধান কার্যকারকের নিকটে চলিয়া গেল। তাঁহারা আবদুল্লাহ্ জেয়াদের নিকট একটি কথা বলিতেও সুযোগ পাইলেন না। কারাগৃহে নীত হইলে কারাধ্যক্ষ, নাম মস্কুর, উভয় ভ্রাতার রূপমাধুরী দেখিয়া এবং ইহারাই বীরশ্রেষ্ঠ বীর মোস্‌লেমের হৃদয়ের ধন ভাবিয়া আদর ও যত্নের সহিত ভালবাসিলেন। বন্দিগৃহে না রাখিয়া স্বীয় ভবনে উভয় ভ্রাতাকে লইয়া আহারাদি করাইলেন। বিশ্রাম জন্য শয্যা রচনা করিয়া দিয়া ভাবিতে লাগিলেন, কি করি! রাত্রি প্রভাতেই হউক কি দুদিন পরেই হউক, নরপতি নিশ্চয়ই ইহাদের শিরচ্ছেদ আজ্ঞা প্রদান করিবেন। দুইটি ভাইকে রক্ষা করি কি প্রকারে?’ অনেক চিন্তার পর, অর্ধ নিশা অতীত হইলে, দুই ভ্রাতাকে জাগাইয়া বলিলেন,-“তোমরা আমার সঙ্গে সঙ্গে আইস, কোন চিন্তা নাই। আমি তোমাদিগকে রক্ষা করিব। ইহাতে আমার অদৃষ্টে যাহা থাকে হইবে। আইস, আমার সঙ্গে আইস।” মোসলেম পুত্রদ্বয় কারাধ্যরে সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। নগরের বাহির হইয়া কারাধ্যক্ষ কিঞ্চিৎ দূরে চলিয়া গিয়া দুই ভ্রাতাকে বলিলেন, “শুন, তোমরা মনোযোগ করিয়া শুন। এই যে পথের উপর দাঁড়াইয়াছি-এই পথ ধরিয়া ‘কুদ্সীয়া’ নগরে যাইবে। এই পথ ধরিয়া একটু দ্রুতপদে চলিয়া গেলে রাত্রি প্রভাতের পূর্বেই কুদ্সীয়া নগরে যাইতে পারিবে। ঐ নগরে আমার ভাই আছেন, তাঁহার নাম- এই নামটি মনে করিয়া রাখিয়ো। নাম করিলে তাঁহার বাসস্থান লোকে দেখাইয়া দিবে। আমি যে তোমাদিগকে পাঠাইতেছি, তাহার নিদর্শন আমার এই অঙ্গুরী দিতেছি, সাবধানে রাখিয়ো! কিছু বলিতে হইবে না। এই অঙ্গুরী আমার ভ্রাতাকে দিলেই তিনি তোমাদিগকে তোমাদের গম্যস্থানের কথা জিজ্ঞাসা করিবেন। তোমরা মদিনার নাম করিয়ো, যে উপায়ে হয়-যে কোন কৌশলে হয়-তোমাদিগকে তিনি মদিনায় পাঠাইয়া দিবেন। এই অঙ্গুরী লও। খোদার হাতে তোমাদিগকে সঁপিলাম। শীঘ্র এই পথ ধরিয়া চলিয়া যাও। কোন ভয়ের কারণ নাই। সর্ববিপদহর জয় জগদীশ তোমাদিগকে রা করিবেন।” ভ্রাতৃদ্বয় বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাইয়া অঙ্গুরীসহ বিদায় গ্রহণ করিয়া কুদ্সীয়ার পথে যাইতে লাগিলেন।

দয়াময় এলাহির অভিপ্রেত কার্যে বাধা দিতে সাধ্য কার? কার ক্ষমতা তাঁহার বিধানের বিপর্যয় করে? ভ্রাতৃদ্বয় সারানিশা ত্রস্তপদে হাঁটিয়া বড়ই ক্লান্ত হইলেন। জ্যেষ্ঠ বলিলেন, “ভাই, বহু দূরে আসিয়াছি। ‘কুফা’ হইতে বহুদূর কুদ্সীয়া নগর-এই সেই কুদ্সীয়া।” রাত্রি প্রভাত হইয়া আসিল। একটু স্থির হইয়া বসিতেই ঊষার আলোকে চতুর্দিক নয়নফলকে প্রতিফলিত হইতে লাগিল। ভ্রাতৃদ্বয় এখনো নির্ভয়ে বসিয়া আছেন, প্রকৃতির কল্যাণে, ঘটনার চক্রে কী সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটিয়াছে, তাহার কিছুই জানিতে পারেন নাই। অদৃষ্টলিপি খণ্ডাইতে মানুষের সাধ্য কী? ভ্রাতৃদ্বয় সারাটি রাত্রি ত্রস্ত পদে হাঁটিয়াছেন -সত্য। মনে মনে স্থির করিয়াছেন, বহু দূরে আসিয়া পড়িয়াছি। এস্থলে আর আবদুল্লাহ্ জেয়াদের ভয়ে ভাবিতে হইবে না। হা অদৃষ্ট! তাঁহাদের ধারণা-ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। কুদ্সীয়ার পথ ভুলিয়া সারাটি রাত্রি কুফা নগরের মধ্যেই ঘুরিয়াছেন। এদিকে রাত্রিও প্রভাত হইল। চক্ষের ধাঁধা ছুটিয়া গেল। প্রাণ চমকিয়া উঠিল। জ্যেষ্ঠ বলিলেন, “ভাই আমাদের কপাল মন্দ! হায়! হায়! কী করিলাম! প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়া সারারাত হাঁটিলাম, কি কপাল! এই তো সেই, আমাদিগকে যে স্থানে রাখিয়া কুদ্সীয়ার পথ দেখাইয়া গিয়াছেন-এ তো সেই স্থান।” কনিষ্ঠ ভ্রাতাও চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন, “হাঁ ভাই! ঠিক কথা! যে স্থান হইতে তিনি বিদায় হইয়াছিলেন, এ তো সেই পথ-সেই পথপার্শ্বের দৃশ্য।”
ঘটিয়াছেও তাহাই। কারাধ্যক্ষ মস্কুর যে স্থানে তাঁহাদিগকে রাখিয়া চলিয়া গিয়াছেন, সারানিশা ঘুরিয়া প্রভাতে আবার সেই স্থানেই আসিয়াছেন।

ভ্রাতৃদ্বয় সেই সময় আকুলপ্রাণে বলিতে লাগিলেন-মোহাম্মদ জ্যেষ্ঠ, এব্রাহিম কনিষ্ঠ, জ্যেষ্ঠ বলিতেছেন, “ভাই এখন উপায়? প্রাণের ভাই এব্রাহিম! এবার আর বাঁচিবার উপায় নাই! এখন উপায়? একবার নয়, দুইবার এইরূপ ভুল! আর আশা কী? ভ্রাতঃ! এইবারে রাজা জেয়াদ আমাদিগকে জীবন্ত ছাড়িবে না।”

এব্রাহিম বলিলেন, “নিরাশ হইয়া এই স্থানে বসিয়া থাকা কথাই নহে। সূর্যোদয় না হইতেই আমরা প্রকাশ্য পথ ছাড়িয়া সম্মুখের ঐ খোরমা প্রভৃতি ফলের বাগানমধ্যে লুকাইয়া থাকি! কোন প্রকারে দিনটা কাটাইতে পারিলেই বোধ হয় বাঁচিতে পারিব। সন্ধ্যা ঘোর হইলে আমরা মদিনার পথ ধরিব।”

মোহাম্মদ বলিল, “ভাই! তবে উঠ, আর বিলম্ব নাই।”

কনিষ্ঠের হস্ত ধরিয়া অতি ত্রস্তপদে নিকটস্থ খোরমার বাগানে যাইয়া দেখিলেন, ছোট-বড় বহু বৃক্ষপূরিত বিস্তৃত ফলের বাগান; বাগানের মধ্যে জলের নহর বহিয়া যাইতেছে। ভ্রাতৃদ্বয় এগাছ-সেগাছ সন্ধান করিয়া নহরের ধারের পুরাতন একটি বৃক্ষের কোটরে দুইদেহ জড়সড়ভাবে এক করিয়া সাধ্যানুসারে আত্মগোপন করিলেন; কিন্তু একদিকে যে ফাঁক রহিল, সেদিকে তাঁহাদের দৃষ্টি পড়িল না। যে সকল বৃক্ষের ছায়া নহরের জলে পড়িয়া ভাসিতেছিল, মৃদুমন্দ বায়ু-আঘাতে ছায়াসকল কখন কাঁপিতেছে, কখনো ক্ষুদ্র-বৃহৎ আকার ধারণ করিয়া জলের মধ্যে যেন ছুটিয়া যাইতেছে। জলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ সহিত বৃক্ষসকলের ছায়াও হেলিয়া দুলিয়া ছুটাছুটি করিতেছে। ভ্রাতৃদ্বয় যে বৃক্ষকোটরে গায় গায় মিশিয়া বসিয়াছেন, কোটরে প্রবেশ অংশের স্থান অনাবৃত থাকায় তাঁহাদের ছায়া জলে পতিত হইয়া, বৃক্ষচ্ছায়া সহিত কম্পিত, সঙ্কুচিত, প্রশস্ত, স্থূল, সূক্ষ্ম, দীর্ঘ আকারে নানাপ্রকার আকার ধারণ করিতেছিল!

বাগানের এক পার্শ্বে ভদ্রলোকের আবাসস্থান। সেই ভদ্রলোকের বাটীর পরিচারিকা নহরের জল লইতে আসিয়া জলে ঢেউ দিয়া কলসী পূর্ণ করিতে করিতে হঠাৎ বৃক্ষচ্ছায়ার প্রতি তাহার দৃষ্টি পড়িল। বৃক্ষকোটরের ছায়ার মধ্যে অন্য একপ্রকার ছায়া দেখিয়া পরিচারিকা কলসী জলে ডুবাইয়া চিন্তা করিতে লাগিল। বৃক্ষকোটরে কিসের ছায়া-দিব্বি দুটো জোড়া মানুষের মত বোধ হইতেছে। কান, ঘাড়, পিঠ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে,-এ কী ব্যাপার! কিছুই স্থির করিতে পারিল না। জলপূর্ণ কলসী ডাঙ্গায় রাখিয়া যে বৃক্ষের ছায়ামধ্যে ঐ অপরূপ ছায়া দেখা যাইতেছিল, এক পা দুই পা করিয়া সেই বৃক্ষের নিকটে যাইয়া দেখে যে, দুইটি বালক উভয়ে উভয়কে জড়াইয়া ধরিয়া একদেহ আকার রহিয়াছে। পরিচারিকা বালকদ্বয়ের অবস্থা দেখিয়া অন্তরে আঘাতপ্রাপ্ত হইল, হৃদয়ে ব্যথা লাগিল। মুখে বলিল,-“আহা! আহা! তোমরা কাহার কোলের ধন? বাছারে! দুইজনে এরূপভাবে এই পুরাতন বৃক্ষের কোটরে লুকাইয়া রহিয়াছ কেন, বাবা? আমাকে দেখিয়া এত ভয় করিতেছ কেন বাপ? আহা বাছা! তোমাদের কি প্রাণের মায়া নেই? ওরে বাপধন! ঐ কোটরে সাপ-বিচ্ছুর অভাব নাই! কার ভয়ে তোরা এভাবে গলাগলি ধরিয়া নীরবে কাঁদিতেছিস্। বাপধন! বল, আমার নিকটে মনের কথা বল, কোন ভয় নাই। বাবা, তোরা আমার পেটের সন্তানতুল্য। দুইখানি মুখ যেন দুইখানি চাঁদের একখানি চাঁদ! বাবা! তোরা কি দুইটি ভাই? মুখের গড়ন, হাতের পিঠের গঠন দেখিয়া তাহাই বোধ হইতেছে। তোরা দুইটি ভাই কি এক মায়ের পেটে জন্মিয়াছিস্ বাপ? কোন্ দুঃখিনীর সন্তান তোরা? বল বাবা-শীঘ্র বল। কার ভয়ে তোরা লুকিয়ে আছিস্?”

ভ্রাতৃদ্বয়ের মুখে কোন কথা নাই। দুই ভাই আরো হাত আঁটিয়া গলাগলি ধরিয়া মাথা নীচু করিয়া রহিলেন।

পরিচারিকা নিকটে যাইয়া মৃদু মৃদু স্বরে সজল চক্ষে বলিতে লাগিল,-“হাঁ বাবা! তোরা কি সেই মদিনার মহাবীর মোস্‌লেমের নয়নের পুত্তলি-হৃদয়ের ধন-জোড়া মাণিক? তাই বুঝি হবে! তাহা না হইলে এত রূপ ‘কুফার’ কোন ছেলের নাই, আহা! আহা! যেন দুটি ননীর পুতুল, সোনার চাঁদ, জোড়া মাণিক। বাবা! তোদের কোন ভয় নাই, আমি-আমি অতি সাবধানে রাখিব। রাজবাড়ীর ঢেডরা শুনিয়াছি। সেজন্য কোন ভয় করি না। আমি তোদের কথা কাহার নিকটেও বলিব না। তোরা আমার পেটের সন্তান, আয় বাবা! আমার অঞ্চলের মধ্যে আয়, প্রাণের মাঝে রাখব।”

ভ্রাতৃদ্বয় কোটর হইতে সজলনয়নে বাহির হইয়া পরিচারিকার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। দয়াবতী বালকদ্বয়কে গাত্রবস্ত্রের আবরণে ঢাকিয়া আপন কর্ত্রীর নিকট লইয়া গেল।

বালকদ্বয়ের কথা কুফানগরে গোপন নাই। দ্বারে দ্বারে ঢেডরা দেওয়া হইয়াছে-ধরিয়া দিতে পারিলেই সহস্র মোহর পুরস্কার, আশ্রয় দিলে আশ্রয়দাতার প্রাণ তখনই শূলের অগ্রভাগে সংহার,-তাহাতে দ্বিতীয় আদেশের অপেক্ষা নাই। গৃহকর্ত্রী এ সকল জানা সত্ত্বেও দুই ভায়ের মস্তকে চুমা দিয়া অঞ্চল দ্বারা তাহাদের চুজল মুছাইয়া বলিতে লাগিলেন,-“বাবা! তোরা ‘এতিম!’ তোদের প্রতি যে দয়া করিবে, তাহার ভাল ভিন্ন মন্দ কখনোই হইবে না। আয় বাবা, আয়! আমি তোদের মা, মায়ের কোল থেকে কেউ নিতে পারবে না। তোদের এই মায়ের প্রাণ দেহ থাকিতে তোদের দুইজনকে নিতে পারবে না। আয়! তোদিগকে খুব নির্জন গৃহে নিয়ে রাখি। আর কিছু খাও বাবা! খোদা তোদের রক্ষক।” গৃহিণী দুই ভ্রাতাকে বিশেষ যত্নে এক নির্জন গৃহে রাখিলেন। বিছানা পাতিয়া দিয়া কিছু আহার করাইলেন। প্রাণের ভয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকিলেও খায় কে? গৃহকর্ত্রী আপন পেটের সন্তানের অনিচ্ছায় যেমন মুখে তুলিয়া তুলিয়া আহার করান, সেইরূপ খাদ্যসামগ্রী হাতে তুলিয়া ভ্রাতৃদ্বয়ের মুখে দিতে লাগিলেন। আহার শেষ হইলে বলিলেন, “বাবা! তোমরা কথাবার্তা বলিয়ো না, চুপ করিয়া এই বিছানায় শুইয়া ঘুমাও। পুনঃ আহারের সময় উপস্থিত হইলে আমি আসিয়া তোমাদিগকে জাগাইয়া খাওয়াইব। তোমরা ঘুমাও, সারারাত জানিয়াছ, আর কত হাঁটাই হাঁটিয়াছ-ঘুমাও, কোন চিন্তা করিয়ো না।”

যে বাড়ির কর্ত্রী দয়াবতী, পরিচারিকাগণও তাঁহারই অনুরূপ প্রায় দেখা যায়। বালকদ্বয়ের কথা কর্ত্রী আর পরিচারিকা ভিন্ন কেহই জানিতে পারিল না।

বাটীর কর্তার নাম হারেস। কর্তা বাটীতে ছিলেন না। কার্যবশতঃ প্রত্যূষেই নগরমধ্যে গমন করিয়াছিলেন। দিন গত করিয়া রাত্রি এক প্রহরের পর আধমরার মত হইয়া বাটীতে আসিলেন। গৃহিণী বিলম্বের কারণ জিজ্ঞাসা করিলে কর্তা বলিলেন, “সে কথা আর কী বলিব। আমার কপাল মন্দ, আমার চক্ষে পড়িবে কেন? সারাটি দিন আর এই রাত্রির এক প্রহর পর্যন্ত কত গলি-পথ, কত বড় বড় রাস্তায়, দোধারী ঘরের কোণের আড়ালের মধ্যে, কত ভাঙ্গা বাড়ির বাহিরে-ভিতরে, কত স্থানে খুঁজিলাম। আমার এ-পোড়া অদৃষ্টে তাহা ঘটিবে কেন? আমি হতভাগ্য, চিরকাল দুঃখ-কষ্টের সহিত আমার ঘনিষ্ঠতা, আত্মীয়তা-আমার চক্ষে পড়িবে কেন? অনটন আমার অঙ্গের ভূষণ, অলক্ষ্মী আমার সংসার ঘিরিয়া বসিয়াছে, শয়তান আমার হিতৈষী বন্ধু সাজিয়াছে, আমি দেখা পাইব কেন? আমার চক্ষে পড়িবে কেন? এত পরিশ্রম বৃথা হইল। সারাটি দিন উপবাস, না খেয়ে কত স্থানেই যে ঘুরিয়াছি দুঃখের কথা কি বলিব? হায় হায়! আমার কপাল! একজনের চক্ষে অবশ্যই পড়িবে,লালে লাল হইবে।”

গৃহিণী বলিলেন, “আসল কথা তো কিছুই শুনিলাম না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এত বিলম্ব হইল কেন? তুমি সাত গ্রাম বেড় দিয়া ভাগ্যলিপি-অদৃষ্ট মন্দ, এই সকল খামখেয়ালী কথা বলে বসলে? সারাটি দিন আর রাত্রিও প্রায় দেড় প্রহর, এত সময় কোথায় ছিলে? কী করিলে? তাহাই শুনিতে চাই। আর একটি কথা। আজ তুমি যেমন দুঃখের সহিত আক্ষেপ করিতেছ,-অদৃষ্টের দোষ দিতেছ, এরূপ আক্ষেপ, কপালদোষের কথা তো আর কখনো তোমার মুখে শুনি নাই?”

হারেস দুঃখিতভাবে নাঁকিসুরে ক্ষীণ স্বরে বলিতে লাগিল, “তোমায় আর কী বলিব। আমাদের বাদশাহ জেয়াদ্, মদিনার হজরত হোসেনকে প্রাণে মারিবার যোগাড় করিয়া, মিথ্যা স্বপ্ন, মিথ্যা রাজ্যদান ভাণ করিয়া হজরত হোসেনের নিকট পত্র দিয়াছেন -”

গৃহিণী বলিলেন, “সে-সকল কথা আমরা জানি। হজরত হোসেনের অগ্রে মোস্‌লেম আসিল, তাহার পর মোস্‌লেমকে কৌশল করিয়া মারিবার কথাও জানি।”

“তবে তো তুমি সকলই জান। সেই মোস্‌লেমের দুই পুত্র পালাইয়াছে। তাহাদের জন্য রাজসরকার হইতে ঘোষণা হইয়াছে, ধরিয়া দিতে পারিলেই একটি হাজার মোহর পুরস্কার পাইবে। প্রথম শহরকোতোয়াল-হাতে ধরা পড়িয়াছিল। বাদশাহ নামদারের দরবারে হাজির করিলে, আমাদের বাদশাহ ছেলে দুইটির মুখের ভাব, সুশ্রী সুন্দর মুখ দুখানি, দেহের গঠন দেখিয়া-মাথা কাটার আদেশ দিতে পারিলেন না। বন্দিখানায় কয়েদ রাখিতে অনুমতি করিলেন। বন্দিখানার প্রধান কর্মচারী ‘মস্কুর’ ছেলে দুইটির রূপে মোহিত হইয়া তাহাদিগকে ছাড়িয়া দেয়! বাদশা নামদার পর্যন্ত সেই খবর হইলে মস্কুরের শিরচ্ছেদ হইয়াছে! আজ নূতন ঘোষণা জারি হইয়াছে, “যে সেই পলায়িত ছেলে দুইটিকে ধরিয়া দিবে, তাহাকে পাঁচ হাজার মোহর পুরস্কার দেওয়া হইবে। যে আশ্রয় দিয়া গোপনে রাখিবে, মস্কুরের ন্যায় তাহারও শিরচ্ছেদ সেই দণ্ডেই হইবে।” আমি মোস্‌লেমের ছেলে দুটির জন্য আহার-নিদ্রা-বিশ্রাম ত্যাগ করিয়া কোথায় না সন্ধান করিয়াছি। ধরিয়া বাদশার দরবারে হাজির করিতে পারিলেই, পাঁচ হাজার মোহর! যে পাইবে, সে কত কাল বসিয়া খাইতে পারিবে! বুঝিয়া চলিলে হয়ত মহা ধনী হইয়া কত পুরুষ পর্যন্ত সুখে থাকিতে পারিবে। এত সন্ধান করিলাম, কিছুই করিতে পারিলাম না। আজ বেশি টাকার লোভে হাজার হাজার লোক পাহাড়-জঙ্গল, যেখানে যাহার সন্দেহ হইতেছে সেইখানেই খুঁজিতেছে। আমি বহু দূরে গিয়াছিলাম। কোথাও কিছু না-পাইয়া শেষে আমারই খোরমার বাগানে খুঁজিয়া তন্নতন্ন করিলাম, প্রতি বৃক্ষের গোড়া, কোটর খুঁজিলাম, কোথাও কিছু পাইলাম না। তাহাতেই বলিতেছিলাম, আমার ভাগ্যে ঘটিবে কেন? হতভাগার চক্ষে পড়িবে কেন?”

গৃহিণী বলিলেন, “হায়! হায়! সেই পিতৃহীন অনাথ বালক দুইটিকে ধরিয়া দুরন্ত জালেম বাদশার নিকটে দিলে পাঁচ হাজার মোহর পাইবে তাহা সত্য, কিন্তু আর একটি হৃদয়বিদারক মর্মাহত সাংঘাতিক কথাটা কী তোমার মনে উদয় হয় নাই? নিরপরাধ দুই এতিমকে বাদশার হাতে দিলে, সে নিষ্ঠুর পাষাণপ্রাণ শাহ জেয়াদ্ কী তাহাদিগকে স্নেহ করিয়া যত্নে রাখিবে? না, তাহাদের চিরদুঃখিনী জননীর নিকট মদিনায় পাঠাইয়া দিবে? হাতে পাইবামাত্র শিরচ্ছেদ-উহু! বালক দুইটির শিরচ্ছেদের হুকুম প্রদান করিবে। তাহা হইলে হইল কি? তুমিই বালক দুইটির বধের উপস্থিত কারণ হইলে। তৎপরিবর্তে কতকগুলি মোহর পাইবে সত্য-আচ্ছা বল তো, সে মোহর তোমার কতদিন থাকিবে? এখন যে অবস্থায় আছ, দয়াময় দাতা অনুগ্রহকারী ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞ হও। তোমার সমশ্রেণীর লোক জগতে কত স্থানে কত প্রকার কষ্ট ভোগ করিতেছে। তোমা অপেক্ষা কত উচ্চশ্রেণীর লোক তোমা হইতে মন্দ অবস্থায় দিন কাটাইতেছে। তুমি সকল বিষয়ে নিশ্চিন্ত-মহা সুখী। ইহার উপরেও তোমার লোভের অন্ত নাই। বিচারকর্তা অদ্বিতীয় এলাহির প্রতিও তোমার ভক্তি নাই ভয়ও নাই, তিনি সর্বদর্শী তাহাও যেন তোমার মনে নাই! হায়! হায়! তোমার মত পাষাণপ্রাণ-পাথরের দেহ তো আমি কাহারো দেখি নাই! পিতৃহীন নিরপরাধ বালকদ্বয়ের দেহ-রক্তের মূল্যই নরপতি জেয়াদ্-চক্ষে পাঁচ হাজার মোহর! হইতে পারে-তাহার চক্ষে অন্যরূপ। হউক পাঁচ হাজার মোহর। তুমি সে রক্তমাখা মোহরের জন্য এত লালায়িত কেন? তুমি কি বুঝ নাই-ঐ দুই বালকের শরীরের রক্তের মূল্য পাঁচ হাজার মোহর। রক্তপোরা মোহরের লোভে অমূল্য বালক দুটির জীবনের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া নিজের বিষময় অস্থায়ী সুখের প্রতি দৃষ্টি করিতেছ। আর এক কথা, সে দেয় কি-না? পাও কি-না? পঞ্চহাজার মোহর তোমার লক্ষ্য, অন্তরেও ঐ কথা জাগিতেছে। বালক দুইটিকে যদি ধরিতে পারি,-পাঁচটি হাজার খাঁটি সোনার টাকা। হা অদৃষ্ট!-আমার কপালে কি তাহা আছে? মনে মনে এই ভাবের কথাই তো ভাবিতেছ? বারবার সেই নর-রক্তমাখা কদর্য মোহরগুলির প্রতিই অন্তর-চক্ষুতে কল্পনার-‘সাজান’-পাত্র দেখিতেছ। মোহরের জন্য প্রকাশ্য অক্ষেপও করিতেছ। বালক দুটির জীবনের মূল্য হইতে মোহরের মূল্যই অধিক স্থির করিতেছ। জালেম, তোমার মনে মায়া দয়ার একটি পরমাণুও নাই। এক ফোঁটা রক্তও নাই। তোমার হৃদয়ে সাধারণ রক্ত নাই,-পাথরচুয়ান রস থাকিতে পারে। কারণ তোমার হৃদয় পাষাণ, দেহটা পোড়া মাটির, অস্থি-মজ্জা সমুদয় কঙ্করে পূর্ণ। ইহাতে আর আশা কী?”

“তুমি বুঝিবে কি? যাহার শরীর কিছুতেই সমানভাবে ঢাকে না হাজার ঢাক, হাজার বেড় দাও-অসমান থাকিবেই থাকিবে। তুমি জগৎ সংসারের কি বুঝিবে? তুমি বোঝ-প্রথম অলঙ্কার, তাহার পর টাকা পয়সা, তাহার পর স্বামীকে একহাতে রাখা। আর কি বোঝ? ছেলে হল মোস্‌লেমের, মাথা কাটিবে জেয়াদ্, তাহাতে তোমার চক্ষে জল আসে কেন? পরের ছেলে পরে কাটিবে আমাদের কি? রাজা জেয়াদ্ মোস্‌লেমকে প্রাণে মারিয়াছে, তাহার ছেলে দুটাকেও মারিয়া ফেলুক, ছেলের মাকে ধরিয়া আনিয়া হয় প্রাণে মারুক,-না হয় ভালবাসিয়া, রাণী করিয়া অন্তঃপুরে রাখুক,-তোমার আমার কি? মাঝখানে আমার পাঁচটি হাজার মোহর লাভ হইবে। এ কার্যে চেষ্টা করিব না? তোমার অঞ্চল ধরিয়া-চেনা নাই, জানা নাই, মোস্‌লেমের জন্য-তাহার দুইটি পুত্রের জন্য কাঁদিতে থাকিব? এইরূপ বুদ্ধি আমার হইলে আর চাই কী?-সংসার টন্টনে-কসা।-একেবারে কাবার। শুন কথা! ছেলে দুইটা যা’র চক্ষে পড়বে সেই ধরবে। ধরলেও নিশ্চিন্ত নহে। বিঘ্ন বাধা অনেক। কত লোক ছুটাছুটি করিতেছে। কত গুণ্ডা ঐ খোঁজে বাহির হইয়াছে। কার হাত থেকে কে কাড়িয়া লইয়া বাদশার দরবারে দাখিল করিবে-তাহা কে জানে? ধরিতে পারিলেও কৃতকার্যের আশা অতি কম। যাহা হউক, শুন আমার মনের কথা। যদি ছেলে দুটিকে হাতে পাই-আর নিরাপদে জেয়াদ-দরবারে লইয়া যাইতে পারি-আর তোমার ভাল হউক-যদি পঞ্চজাহার মোহর পাই, তিন হাজার মোহর ভাঙ্গিয়া মাথা হইতে পা পর্যন্ত, আবার পা হইতে মাথা পর্যন্ত ডবল পেচে সোনা দিয়া তোমার এই সন্দুর দেহখানি মোড়াইয়া জড়াইয়া দিব। দেখ তো এখন লাভ কত?”

গৃহিণী অতিশয় বিষাদভাবে স্বামীর মুখ চোখপানে চাহিয়া বলিতে লাগিলেন, “দেখ! আমি তোমার কথায় বাদ প্রতিবাদ করিব না। বাধা দিতেও চাহি না;-তোমাকে উপদেশ দিবার ক্ষমতাও আমার নাই। আমি তোমার নিকট মিনতি করিয়া বলিতেছি, সবিনয়ে প্রার্থনা করিতেছি, তুমি মোসলেমের সেই ছেলে দুইটির সন্ধানে আর যাইয়ো না;-ইহাই প্রার্থনা। আমি তোমার নিকট রতি পরিমাণ সোনাও চাহি না এবং রক্তমাখা মোহরের জন্য লালায়িতও নহি। পিতৃহীন বালকদ্বয়ের শোণিতরঞ্জিত মোহর চক্ষে দেখিতে ইচ্ছা করি না, ছুঁইতেও পারিব না। জীবন কয় দিনের? ঈশ্বরের নিকট কি উত্তর করিবে? আমি তোমার দুখানি হাত ধরিয়া অনুরোধ করিতেছি, আমার মাথার দিব্বি দিয়া বলিতেছি, তুমি লোভের বশীভূত হইয়া এমন কার্যে প্রবৃত্ত হইও না।”

হারেস স্ত্রীরত্নের কথায় ক্রোধে আগুন হইয়া, রক্ত-আঁখি ঘুরাইয়া বলিলেন, “চুপ! চুপ! নারীজাতির মুখে ধর্মকথা আমি শুনি না। এখন খাইবার কি আছে শীঘ্র নিয়ে এস! একটু বিশ্রাম করিয়া এই রাত্রিতেই আবার সন্ধানে বাহির হইব! দেখি, কপালে কী আছে! তোর ও মিছরিমাখা কথা আমি শুনিতে ইচ্ছা করি না।”

হারেসের স্ত্রী আর কোন কথা কহিলেন না। স্বামীর আহারের আয়োজন করিয়া দিলেন। হারেস মনে মনে নানা চিন্তা করিতে করিতে অন্যমনস্কে আহার করিলেন। হস্ত-মুখ প্রালন করিয়া অমনই শয়ন করিলেন। এত পরিশ্রমেও তাঁহার চক্ষে নিদ্রা নাই। কোথায় মোস্‌লেমের সন্তান দুটিকে পাইবেন; কোন্ পথে, কোথায়, কোন্ স্থানে গেলে তাঁহাদের দেখা পাইবেন? দেখা পাইয়া কী প্রকারে ধরিয়া রাজদরবারে লইয়া যাইবেন;-এই চিন্তা তাঁহার মাথার মধ্যে ঘুরিতে লাগিল। বালক দুটির দেখা পাওয়া-পাঁচ হাজার সোনার টাকা-এই সকল ভাবিতে ভাবিতে বহুক্ষণ পরে ঘুমাইয়া পড়িলেন।

গৃহিণী দেখিলেন স্বামী ঘোর নিদ্রায় অচেতন। কী উপায়ে ছেলে দুটিকে রক্ষা করিবেন, এই চিন্তা করিয়া পরামর্শে বসিলেন। এ পর্যন্ত পরিচারিকা ভিন্ন, বাড়ির অন্য কাহাকেও বালকদ্বয়ের কথা বলেন নাই। এখন বাধ্য হইয়া স্বামীর ঐরূপ ভাব দেখিয়া তাঁহার মুখের কথা শুনিয়া দয়াবতী স্নেহময়ী রমণী অস্থির হইয়াছেন। কী উপায়ে পিতৃহীন বালকদ্বয়কে রক্ষা করিবেন? স্বামীর মনের ভাব-অদ্যকার ভয়ের কারণই অধিক, আর আশ্রয়ের স্থান কোথায়? প্রকাশ হইলে ছেলে দুটির মাথা যায়। হইতে পারে নিজের প্রাণের আশা অতি সঙ্কীর্ণ। স্বামী পুরস্কারের লোভে স্ত্রীর বিরোধী হইতে পারেন। আর একটা গোলের কথা, স্বামীর সঙ্গে বালক দুটি লইয়া কথান্তর হইলে পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই জানিবে! ভাল করিতে কেহ আগে যাইতে চাহে না; মন্দ করিতে কোমর বাঁধিয়া দৌড়িতে থাকে। যাইয়া বলিলেই হইল-অমুকের ঘরে ছিল। অমুক স্ত্রীলোকের আশ্রয়ে ছিল। আর প্রাণের আশা কী?-সকল কথা ভাবিয়া চিন্তিয়া আরো দুইটি লোকের সহিত পরামর্শ করিয়া কার্য করাই স্থির করিলেন।

একজন তাঁহার গর্ভজাত পুত্র; সে বুদ্ধিমান্, বিচক্ষণ-দয়ার শরীর, সে শরীরে পিতার গুণ অল্প ছিল, মাতার গুণ অধিক;-সেই একজন। আর এক পুত্র তাঁহার গর্ভজাত নহে,-পালকপুত্র। শৈশবকাল হইতে আপন স্তন্যপান করাইয়া প্রতিপালন করিয়াছেন। তাঁহার সম্পূর্ণ গুণের অধিকারী সেই পালকপুত্র হইয়াছে। সেই তাঁহার সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। আপন গর্ভজাত পুত্র তাহার পিতা হারেসের কথা অমান্য করিতে পারে না। অন্যায় কার্য হইলেও প্রতিবাদ করে না,-চুপ করিয়া নীরবে থাকে। পালকপুত্রটি তাহা নহে। সে তাঁহারই অনুগত-বাধ্য, হারেসের কথা সে শুনে না। হারেস কোন অন্যায় কথা বলিলে সে অকপটে নির্ভয়ে তাহার প্রতিবাদ করে।

তাহার মনে ধারণাই এই যে, যাঁহার শরীরের শোণিতে আমার জীবন রক্ষা হইয়াছে, দেহ বৃদ্ধি হইয়াছে, যাঁহার স্নেহ-মমতা অনুগ্রহে এত বড় হইয়াছি, তিনিই আমার সর্বস্ব-তিনিই আমার পূজনীয়া, তিনিই আমার মুক্তিদাত্রী মাতা,-মাতাই আমার সম্বল-মাতাই আমার বল। হারেস-জায়া নিশীথ সময়ে দুই পুত্রকে চুপি চুপি ডাকিয়া আনিয়া অন্য কক্ষে অতি নির্জন স্থানে দুই পুত্রকে সম্মুখে করিয়া বসিলেন।

পালকপুত্রকে বলিলেন, “বাবা! তুই আমার পেটে না জন্মিলেও আমি তোকে আমার বুকের দুধ দিয়া প্রতিপালন করিয়াছি। কত মল-মূত্র দুই হাতে পরিষ্কার করিয়া তোকে বাঁচাইয়াছি। বাবা! তুই আমার শরীরের সার অংশ দ্বারা প্রতিপালিত হইয়াছিস্। আমার শরীরের রক্ত অংশে তোর দেহপুষ্টি হইয়াছে।” আপন গর্ভজাত সন্তানের হস্ত ধরিয়া বলিলেন, “বাবা! তোতে আর এতে ভিন্ন কী? অতি সামান্য! সেই সামান্য অংশটুকু ছাড়িয়া দিলে-তুইও যেমন, (পালকপুত্রের হস্ত ধরিয়া-) এও তেমনই। পরিচারিকাকে যে কথা বলিতে বলিয়াছিলাম, তোমাদের দুই জনকে একত্র বসাইয়া সে তাহা বলিয়াছে। তোমরা সকলই শুনিয়াছ। এখন সেই বালক দুইটির রক্ষার উপায় কি? আমি ভাবিয়াছিলাম তোমাদের পিতা বাটী আসিলে, ছেলে দুইটির কথা বলিব। তিনি কতই দুঃখ করিবেন। ছেলে দুইটির রক্ষার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিবেন। এখন দেখিতেছি, তিনিই তাহাদের সংহারক, তিনিই তাহাদের প্রাণনাশক-প্রধান শত্রু। মোহরের লোভে তিনি বালক দুইটিকে ধরিবার জন্য বহু চেষ্টা-বহু পরিশ্রম করিয়াছেন। নিদ্রা হইতে উড়িয়া এই রাত্রিতেই পুনরায় তাহাদের অন্বেষণে ছুটিবেন। তিনি যদি বালক দুইটির সন্ধান পান, তাহা হইলে আর রক্ষা নাই। কিছুতেই তাহারা দুরন্ত বাঘের মুখ হইতে রক্ষা পাইবে না-বাঁচিবে না। এক্ষনে তোমরাই আমার সহায়-সম্বল। তোমরা দুই ভাই যদি আমার সহায়তা কর, তোমরা দুই ভাই যদি আমার পক্ষে থাকিয়া পিতৃহীন বালক দুটির রক্ষ্রর জন্য চেষ্টা কর-তবে তাহারা বাঁচিতে পারে। তোমাদের পিতার চক্ষে পড়িলে আর কিছুতেই রক্ষা পাইবে না।”

দুই ভাই বলিল, “মাতঃ! আপনি ব্যস্ত হইবেন না। আমরা সকলই শুনিয়াছি-বালকদ্বয়ের অবস্থা সকলই শুনিয়াছি, আমাদের বাটীতেই আছে তাহাও জানিয়াছি! আপনি অত উতলা হইবেন না। পিতা গুরুজন, তাঁহার নিন্দা করিব না। আমরা তাঁহার অর্থলালসার কথা শুনিয়া বড়ই দুঃখিত হইয়াছি,-আক্ষেপ করিয়াছি। কি করি, পিতা গুরুজন, তাঁহার কথার প্রতিবাদ করাই মহাপাপ; যাহাই হউক, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন; রাত্রি দ্বিপ্রহর অতীত হইলেই আমরা দুই ভাই, বালকদ্বয়কে সঙ্গে করিয়া মদিনায় যাইব। যদি সুবিধা করিতে পারি ভালই, না করিতে পারি, আমরা সঙ্গে করিয়া লইয়া মদিনায় রাখিয়া আসিব।”

গৃহিণী সন্তুষ্টচিত্তে অথচ চক্ষুজলে ভাসিতে ভাসিতে দুই পুত্রের দুই হাত দুই হাতে ধরিয়া আপন মাথার উপর রাখিয়া বলিলেন, “বাবা, তোরা আমার মাথার উপর হাত রাখিয়া বল যে, আমরা সাধ্যানুসারে বালকদ্বয়কে রা করিব।”

পুত্রদ্বয় অকপটচিত্তে স্বীকার করিল, আর বলিল, “মাতঃ! আপনি নিশ্চয় জানিবেন বালকদ্বয়ের অনিষ্ট সম্বন্ধে আমাদের পিতার কোন কথা আমরা শুনিব না; বরং তাঁহার বিরোধী হইব। আপনার আদেশ-আপনার আজ্ঞা পালন করিতে যদি আমাদের প্রাণও যায় তত্রাচ আপনার আদেশের অন্যথা করিব না, কি পশ্চাৎপদ হইব না।”

দুই পুত্র লইয়া গৃহিণী অন্য গৃহে পরামর্শ করিতেছেন। অন্য কক্ষে অতি নির্জন স্থানে ভ্রাতৃদ্বয় শুইয়া আছে। ভিন্ন আর এক কক্ষে হারেস শুইয়াছেন। ঈশ্বরের মহিমার অন্ত নাই। মোহাম্মদ ও এব্রাহিম, নির্জন কে নিদ্রায় ছিলেন, হঠাৎ মোহাম্মদ জাগিয়া ক্রন্দন করিতে করিতে এব্রাহিমকে জাগাইয়া বলিল, “ভাইরে, আর ঘুমাইও না। শুন-স্বপ্নবিবরণ শুন। এখনই পিতাকে স্বপ্নে দেখিলাম। শুন, অতি আশ্চর্য স্বপ্ন।”

“স্বপ্নে দেখিলাম-আকাশের দ্বার হঠাৎ খুলিয়া গেল। স্বর্গীয় সৌরভে জগৎ আমোদিত ও মোহিত হইল। দেখিলাম, স্বর্গীয় উদ্যানে হজরত মোহাম্মদ রসুল মকবুল (দ.), হজরত আলী (ক.), হজরত বিবি ফাতেমা জোহ্‌রা এবং হজরত ‘হাসন-উদ্যানে ভ্রমণ করিতেছেন। পিতৃদেব তাঁহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ বেড়াইতেছেন। আমরা দুই ভ্রাতা দূরে দাঁড়াইয়া আছি। ইতিমধ্যে হজরত রসুল মকবুল, আমাদের পিতৃদেবকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘মোস্‌লেম! তুমি চলিয়া আসিলে, আর তোমার দুইটি পুত্রকে জালেমের হস্তে রাখিয়া আসিলে?’ পিতৃদেব করজোড়ে নিবেদন করিলেন, “হজরত! এলাহির কৃপায় তাহারাও ‘ইন‌শাআল্লাহ্’ আগামীকল্য পবিত্র পদচুম্বনের জন্য আসিবে।”

এব্রাহিম বলিল, “ভাই! আমিও ঐ স্বপ্ন দেখিয়াছি! আর চিন্তা কি? রাত্রি প্রভাতেই আমরা পিতৃদেবের নিকট যাইব। এস ভাই, এইক্ষণে দুই ভাই গলাগলি করিয়া একবার শয়ন করি। জগতের নিদ্রার আজ শেষ নিদ্রা, নিশিরও শেষ। আমাদের পরমায়ুরও শেষ! এস ভাই, এস! গলাগলি করিয়া একবার শয়ন করি।” দুই ভাই এই বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিতেই, পাপমতি হারেসের নিদ্রাভঙ্গ হইল। অতি ত্রস্তে শয্যা ত্যাগ করিয়া স্ত্রীকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আমার বাড়িতে বালকের ক্রন্দন? কাহার ক্রন্দন! কোথায় তাহারা? কোথা হইতে তাহারা আসিয়াছে? কে তাহাদিগকে তোমার নিকট আনিয়া দিল? শীঘ্র-শীঘ্র প্রদীপ জ্বালিয়া আন। আর যাহারা কাঁদিতেছে, তাহাদিগকেও আমার সম্মুখে লইয়া আইস।”

হারেস-জায়া নীরব। কারণ দুর্দান্ত স্বামীর নিদ্রাভঙ্গ। প্রদীপ জ্বালিতে আদেশ। ‘যাহারা কাঁদিতেছে, তাহাদিগকে আমার সম্মুখে আনয়ন কর’-এই সকল কথায় সতী-সাধ্বী দয়াবতীর প্রাণপাখি যেন দেহপিঞ্জর হইতে উড়ি-উড়ি ভাব করিতে লাগিল। কী করিবেন, কোথা যাইবেন-কিছুই বোধ নাই-জ্ঞান নাই-নীরব। হারেস গৃহিণীর এইরূপ ভাব দেখিয়া অবাক্ হইলেন। এ কী? এ এরূপ হইল কেন? হারেস জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার এ কী ভাব হইল?” কোন উত্তর নাই। নির্বাকে একেবারে স্বামীর মুখপানে চাহিয়া রহিলেন। হারেস স্ত্রীর এইরূপ অন্যমনস্ক ভাব দেখিতে পাইয়া নিজেই প্রদীপ জ্বালিয়া যে গৃহ হইতে ক্রন্দনের শব্দ আসিতেছিল সন্ধান করিয়া প্রদীপহস্তে সেই গৃহে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, দুইটি বালক গলাগলি করিয়া শুইয়া কাঁদিতেছে। হারেস দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইলেন। অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “এ কাহারা? আমার বাড়ির নির্জন স্থানে পরম রূপবান দুইটি বালক শয়নাবস্থায় কাঁদে কেন?” হারেস কর্কশভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোরা কে? কাঁদছিস্ কেন? শীঘ্র বল্-কে তোরা?”

বালকদ্বয় সভয়ে উত্তর করিল, “আমরা হজরত মোস্‌লেমের পুত্র।” হারেস নিকটে যাইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিতে লাগিল, “মোস্‌লেমের পুত্র! তোরাই মোস্‌লেমের পুত্র! আমি কী আহাম্মক-কী পাগল! ঘরে শিকার রাখিয়া জঙ্গলে ঘুরিতেছি! কী পাগলামি! যাক্, যাহা হইবার হইয়াছে। আমার অদৃষ্টজোরেই ঘরে আসিয়াছে। পঞ্চ হাজার মোহর পায় হাঁটিয়া আমার নির্জন ঘরে আসিয়া রহিয়াছে। এখন কী করি! রাত্রি প্রভাত হইতে অনেক বিলম্ব। আর যাইবে কোথা!” এই বলিয়া দুই ভ্রাতার জোলফে জোলফে বন্ধন করিলেন। চুলে টান পড়ায় দুই ভাই কাঁদিয়া উঠিতেই হারেস-নির্দয় হারেস উভয় ভ্রাতার সুললিত কোমল গণ্ডে সজোরে চপেটাঘাত করিয়া বলিল, “চুপ! চুপ! কাঁদবি তো এখনই মাথা কেটে ফেল্‌বো।”

বলিতে বলিতে দুই ভ্রাতার হস্ত বন্ধন করিয়া, দ্বারে জিঞ্জির লাগাইয়া দ্বার ঘেঁষিয়া শয্যা পাতিয়া তরবারিহস্তে বসিয়া রহিলেন। স্বগতঃ বলিতে লাগিলেন, “আর ঘুমাইব না। আর কী-হোঃ হোঃ! আর কী, প্রভাতেই মোহরের তোড়া, মোহরের ঝন‌ঝন্,-এইবার সুখের সীমা কতদূর দেখিয়া লইব।”

গৃহিণী কাঁদিতে কাঁদিতে স্বামীর পা দুখানি ধরিয়া বলিলেন, “ছেলে দুটির প্রতি দয়া কর।” হারেস বলিলেন, “দয়া তো করিবই, রাত্রিটা আছে বলে দয়া দেখিতে পাইতেছ না। একটু পরেই দয়া-মায়া সকলই দেখিবে।”

“দেখ, তুমি আমার স্বামী। তোমার পায়ের উপর মাথা রাখিয়া বলিতেছি ছেলে দুইটির প্রতি কোনরূপ অত্যাচার করিয়ো না। এতিমের উপর কোনরূপ কর্কশ ব্যবহার করিতে নাই। ছেলে দুটির প্রতি দয়া কর। টাকা কয় দিন থাকিবে?”

হারেস স্ত্রীর মাথায় পদাঘাত করিয়া বলিল, “দূর হ!হতভাগিনী, দূর হ! আমার সম্মুখে হতে দূর হ! তোকে কী করিব? তুই চলে যা-তোর কথাই শুনিব কি-না? পাঁচ হাজার মোহর লক্ষ্মীর কথায়, বুড়ী রূপসীর মায়া কান্নায় ছাড়িয়া দিব? এ তো আমার ঘরে তোলা টাকা। দেখ! ফিরে আমার বিছানার নিকট আস্‌বি কি মাথা মাটিতে গড়াইয়া দিব। তোরা সকলে ভেবেছিস্ কী? আমার চক্ষে ঘুম নাই। তোদের চক্ষে ঘুম নাই। আর তোরা কখনোই একথা মনে করিস্ না যে, মোস্‌লেমের দুই পুত্র আমার হাতছাড়া হইয়া মোহরগুলি হাতছাড়া হইবে, তাহা হইবে না। আর তোরা যা ভাবছিস্ তাহাও হইবে না। আমি নিশ্চয় বুঝিয়াছি, মোস্‌লৈমের দুই পুত্রকে জীবন্ত ভাবে, মহারাজ জেয়াদের দরবারে লইয়া যাইতে আমার মত লোকের সাধ্য নাই। পথে বাহির হইলেই, চারিদিক্ হইতে পুরস্কারলোভী গুণ্ডার দল বালক দুটিকে জোর করিয়া লইয়া যাইবে। কী অন্যায় কথা! ধরিলাম আমি, পুরস্কার পাইব আমি। তাহা না হইয়া যার বল বেশি সেই বলপূর্বক লইয়া মহারাজ জেয়াদ্-দরবারে উপস্থিত করিয়া বিজ্ঞাপিত পুরস্কার লইবে। টাকার লোভ বড় শক্ত লোভ। আমি সে সকল ভবিষ্যৎ আশঙ্কার মধ্যেই যাইব না। রাত্রি প্রভাত হইলেই মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের শুধু মস্তক লইয়া রাজদরবারে উপস্থিত করিব। তাহাতেই আশা, পূর্ণ কার্যসিদ্ধি। মহারাজ অধিক পরিমাণে সন্তুষ্ট হইবেন।”

স্ত্রীকে সম্বোধন করিয়া হারেস বলিলেন, “তুই স্ত্রীলোক। ওরে তুই কী বুঝিবি? এ সকল উপার্জনের অঙ্গ তুই কী বুঝিবি রে? ছেলে দুটিও দেখ্ছি ওদের পাগলী মায়ের কথায় পাগল হইয়াছে। আমার চক্ষে ঘুম নাই। তোমাদের চক্ষে ঘুম নাই? যা যা, তোরা বিছানায় যা!”

এদিকে রাত্রি প্রভাত সংবাদ, কুক্কুট দল সপ্তস্বরে কুফা নগরকে জাগ্রত করিতে লাগিল। হারেস প্রত্যূষে উঠিয়াই, মোস্‌লেমের পুত্রদ্বয়কে বন্ধন করিয়া ঘোড়ার পিঠে চাপাইয়া, সু-ধার তরবারি ও ঘোড়ার বাগডোর হস্তে ধরিয়া ফোরাত নদীতীরে যাইতে লাগিল। হারেসের দুই পুত্রও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িল। গৃহিণীও কাঁদিতে কাঁদিতে অশ্ব-পশ্চাতে মাথায় ঘা মারিতে মারিতে ছুটিলেন। গৃহিণীও দুই পুত্রসহ গোপনে পরামর্শ করিয়াছেন, যে উপায়ে হয় তাঁহারা তিনজনে একত্রে বালক দুটিকে রক্ষা করিবেন, উপস্থিত যমের হস্ত হইতে রক্ষা করিবেন। পুত্রদ্বয় মাতার পদস্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, দেহে প্রাণ থাকিতে আমাদের দুই ভ্রাতার শির স্কন্ধে থাকিতে, মোস্‌লেম পুত্রদ্বয়ের শির দেহ-বিচ্ছিন্ন হইতে দিব না। দৌড়িতে দৌড়িতে সকলেই ফোরাতনদী তীরে উপস্থিত হইলেন।

হারেসের ক্ষণকালও বিলম্ব সহিতেছে না। শীঘ্র শীঘ্র কার্য শেষ করিয়া দুই ভ্রাতার দুইটি মাথা মহারাজ জেয়াদ্-দরবারে উপস্থিত করিলেই তাহার কার্যের প্রথম পালা শেষ হয়। দ্বিতীয় পালা মোহরগুলি গণিতে যে বিলম্ব। যে ঘোড়ার পৃষ্ঠে বালকদ্বয়ের মাথা চাপাইয়া রাজদরবারে লইয়া যাইবেন, সেই ঘোড়ার পৃষ্ঠেই মোহরের ছালা তুলিয়া শীঘ্র বাটীতে আসিতে পারিবেন। এইরূপ কার্যপ্রণালী মনে মনে স্থির করিয়া শীঘ্র শীঘ্র বালকদ্বয়ের মাথা কাটিতে আগ্রহ করিতেছেন। বালক দুটিকে অশ্ব হইতে নামাইয়া সম্মুখে খাড়া করিলেন। তাহারা যদিও পিতা মোস্‌লেমকে স্বপ্নে দেখিয়া শীঘ্রই পিতার নিকট যাইতেই হইবে স্বপ্নযোগে শুনিয়া আনন্দিত হইয়াছিল, সে আনন্দ কতক্ষণ? কুহকিনী দুনিয়ার এমনই মায়া যে, তাহাক ছাড়িবার কথা কর্ণে প্রবেশ করিলেই, প্রাণ কাঁদিয়া উঠে। মৃত্যুর কথা মনে পড়িলেই হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হয়; প্রাণের মায়া কাহার না আছে? মোস্‌লেম পুত্রদ্বয়, হারেসের সম্মুখে দণ্ডায়মান। উলঙ্গ খরধার অসিহস্তে, কালান্তকের ন্যায় রক্তজবা সদৃশ আঁখিতে চাহিয়া বালক দুটির আপাদমস্তক প্রতি হারেসের দৃষ্টি। দুই ভাই কাঁদিতে কাঁদিতে হারেসের পদতলে মাথা রাখিয়া বলিতে লাগিলেন, “দোহাই তোমার! আমাদিগকে প্রাণে মারিয়ো না। তোমার পদতলে মাথা রাখিয়া বলিতেছি আমাদিগকে ছাড়িয়া দাও। আমাদের চিরদুঃখিনী মায়ের মুখখানি একবার দেখিতে আমাদিগকে ছাড়িয়া দাও-মদিনায় যাই আর কখনো কুফায় আসিব না।”

বালকদ্বয়ের কাতর ক্রন্দন পাষাণপ্রাণ হারেসের কিছুই হইল না। সে দুরন্ত নরপিশাচ পিতৃহারা বালকদ্বয়ের করুণ ক্রন্দন কর্ণেই করিল না। একটি বর্ণও শুনিল না। হারেস বালকদ্বয়ের শির লক্ষ্য তরবারি উত্তোলন করে, আবার কে যে বাধা দেয় থামিয়া যায়। আবার ক্ষণকাল পরে মুখ-চক্ষু লাল করিয়া আঁখিদ্বয়ের তারা বাহির করিয়া বালকদ্বয়ের শির লক্ষ্য করিয়া তরবারি একবার উত্তোলন করে, আবার থামিয়া যায়। কী মর্মঘাতী দৃশ্য! হারেসের এই অত্যাচার অমানুষিক ব্যবহার ও হৃদয়বিদারক ঘটনার সূত্রপাত মুক্ত আকাশে দিননাথ শত সহস্র কিরণজাল বিস্তার করিয়া দেখিতেছেন। ফোরাত নদী তীরে ঘটনা, ফোরাত জলও দেখিয়া যাইতেছে, প্রবাহে প্রবাহে হারেসের এই কুকীর্তি দেখিয়া বহিয়া চলিয়া যাইতেছে। নদীতীরে পিতৃহারা অনাথ দুটি বালক, কৃপাণধারী যমদূত-সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া কাতর কণ্ঠে বলিতেছে, “ওগো! আমাদিগকে প্রাণে মারিয়ো না।” প্রাণের দায়ে, হন্তার পদতলে লুটাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতেছে, “আমরা দুখিনীর সন্তান। জনমের মত পিতাকে এই দেশে হারাইয়াছি। মায়ের মুখখানি দেখিব। তোমার নিকটে প্রাণভিক্ষা চাহিতেছি-আমাদের দুই ভায়ের প্রাণ এখন তোমারই হাতে। দয়া করিয়া আমাদের প্রাণভিক্ষা দাও। আমরা জীবনে আর কুফায় আসিব না।”

বালক দুইটি কতই অনুনয়-বিনয় করিল-হারেসের মন গলিল না। হারেসের সম্মুখে বধ্যভূমে বালকদ্বয় দণ্ডায়মান। বামপার্শ্বে হারেসের দুই পুত্র-বিষাদবদনে দণ্ডায়মান। দয়াবতী হারেস-জায়াও পুত্রদ্বয়ের পশ্চাৎ-মোস্‌লেম পুত্রদ্বয়ের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া স্বামীর ভয়ে নীরবে কাঁদিয়া চক্ষুজলে ভাসিতেছেন। হারেস এক-এক বার তরবারি উত্তোলন করে, আবার থামিয়া যায়। একবার বালকদ্বয়ের মুখের দিকে, তৎপরেই ফোরাতের জল-স্রোতের দিকে চাহিয়া ঊর্ধ্বে দৃষ্টি করে। ক্রমেই বিলম্ব হইতে লাগিল।

হারেস যেন বিরক্ত হইয়া পালকপুত্রকে বলিল, “পুত্র! ধর তো, আমার এই তরবারি। আজ দেখিব তোমার তরবারির হাত। একচোটে দুইটি বালকের মাথা মাটিতে গড়াইয়া দাও দেখি!”

পুত্র উত্তর করিল, “পিতঃ! আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি উহা পারিব না। নিষ্পাপ, নিরপরাধ, দোষশূন্য দুইটি পিতৃহীন অনাথ বালককে টাকার লোভে খুন করিতে আমি পারিব না। কখনোই পারিব না। বরং ঐ বালকদ্বয়ের প্রাণ রক্ষা করিতে যাহা আবশ্যক হয় তাহা করিব। আমার প্রাণ দিব, তত্রাচ ঐ বালকদ্বয়ের প্রতি কোনরূপ অত্যাচার হইতে দিব না। আমি আপনার এবং এ অবৈধ আদেশ কখনোই প্রতিপালন করিব না। টাকার লোভে মানুষ খুন! এ মানুষের কার্য নহে,-ডাকাত! ডাকাত!”

হারেস রোষকষায়িত লোচনে রক্তআঁখি ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিতে লাগিল, “কী রে পামর! আমার কার্য তোর চক্ষে হইল অবৈধ? তোর এত বিচারে কাজ কী? আর এত লম্বা-চওড়া কথা তুই কার কাছে শিখেছিস্? তুই আমার হুকুম মানিবি কি-না তাহাই বল? তুই বেটা ভারি বৈধ?”

“আপনি যাহাই বলুন, আমি মানুষ খুন করিতে পারিব না। আর এই দুটি বালককে আমি রক্ষা করিব। আমি এতক্ষণ কিছুই বলি নাই। দেখি আপনি পাপের কোন্ সীমায় গিয়া উপস্থিত হন? জানিবেন, পিতা বলিতে ঘৃণা বোধ হইতেছে। জানিবেন দস্যু মহাশয়! জানিবেন লোভীর লোভ পূর্ণ হয় না। ঈশ্বর তাহার মনের আশা পূর্ণ করেন না। এই দেখ তাহার দৃষ্টান্ত।”

বালকদ্বয় প্রতি চাহিয়া বলিল, “এস ভাই! তোমরা এস। আমি তোমাদিগকে এখনই মদিনায় লইয়া যাইতেছি।”

বালকদ্বয় মদিনার নাম শুনিয়াই যেন, প্রাণের ভয় ভুলিয়া গেল। হারেস-পালকপুত্র, হস্ত বাড়াইয়া বালকদ্বয়ের হস্ত ধরিয়া ক্রোড়ের দিকে টানিতেই হারেস ক্রোধে এক প্রকার জ্ঞানহারা হইয়া বিকম্পিত কণ্ঠে বলিল, “ওরে! নিমকহারাম! আমার হাত থেকে, বালকদ্বয়কে তুই কাড়িয়া লইবি! তোর এত বড় ক্ষমতা? এত বড় মাথা! তোকেই আগে শিক্ষা দেই।” পালকপুত্রের দক্ষিণ হস্ত মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের দিকে প্রসারিত, বালকদ্বয়ও ঐ প্রসারিত হস্ত ধরিতে একটু মাথা নোয়াইয়া অগ্রসর চেষ্টা, এই সময়ে হারেসের তরবারি পালকপুত্রের গ্রীবা লক্ষ্যে উত্তোলিত হইল। চক্ষের পলক পড়িতেও অবসর হইল না। হারেসের আঘাতে পালকপুত্রের শির ফোরাতকূলের বালুকা-মিশ্রিত ভূমিতে গড়াইয়া পড়িল। হারেসের রক্তরঞ্জিত তরবারি ঝন‌ঝন্ শব্দে কাঁপিয়া উঠিল। গৃহিণী পালকপুত্রের অবস্থা দেখিয়া আর ক্রন্দন করিলেন না। স্ত্রীস্বভাববশতঃ অস্থির হইয়া চতুর্দিক অন্ধকারও দেখিলেন না-আপন গর্ভজাত পুত্রের প্রতি আদেশ করিলেন, “বাছা এই তো সময়; তোমার প্রতিজ্ঞা পূরণ কর। বালক দুটিকে রক্ষা কর।” মাতৃ আজ্ঞা প্রাপ্তমাত্র পিতৃহীন বালকদ্বয়কে রাক্ষস হারেসের হস্ত হইতে বলপূর্বক কাড়িয়া লইতে একলম্ফে বালকদ্বয়ের নিকটে পড়িলেন। হারেস পালকপুত্রের শির দেহবিচ্ছেদ করিয়া বালকদ্বয়ের প্রতি অসি উত্তোলন করিতেই দয়াবতী গৃহিণীর গর্ভজাত সন্তান প্রতি আদেশ-আদেশমাত্র বীর পুত্র বালকদ্বয়কে বুকের মধ্যে করিয়া আঘাত ব্যর্থ করিলেন। হারেস ক্রোধে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, “ওরে! তুইও তোর মায়ের কথায় আমার বিরোধী হইয়াছিস্? আমার লাভে বাধা দিতে পারিবি না। মোস্‌লেম পুত্রদ্বয়কে রক্ষা করিতে পরিবি না-পারিবি না। ওরে মূর্খ! তোর জন্যও যমদূত দণ্ডায়মান। ছেড়ে দে ছোঁড়া দুটাকে!”

পুত্র বলিল, “কখনোই ছাড়িব না। নরপিশাচ অর্থলোভীর অর্থলাভ জন্য জীবন্ত জীবকে নরব্যাঘ্রের হস্তে দিব না-দিব না।”

“দিবি না? আচ্ছা যা তুইও যা,-বিদ্রোহী পুত্রকে চাহি না। যা বেটা জাহান্নামে যা-” মুহূর্তমধ্যে তরবারি কম্পিত হইয়া বিজলিবৎ চমকিয়া স্বীয় ঔরসজাত পুত্রের গ্রীবাদেশে বসিয়া, পিতার আঘাতে পুত্রের শির ফোরাতকূলে দেহ বিচ্ছিন্ন করিয়া দিল। গৃহিণীর চক্ষের উপর এই সকল হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটিতেছে। পালকপুত্র ও গর্ভজাত পুত্র, দুই পুত্রের খণ্ডিত দেহ মাটিতে পড়িয়া আছে। দুইটি মস্তক যেন তাঁহারই মুখের দিকে চক্ষু সহায়ে তাকাইয়া আছে। এখনো চক্ষুর পাতা বন্ধ হয় নাই। চারিটি চক্ষুই একদৃষ্টে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া আছে। এ দৃশ্য দেখিয়া গৃহিণী পুত্রদ্বয়ের কথা মনেই করিলেন না, স্বামীর ভয়ানক উগ্রমূর্তি দেখিয়া ভয় করিলেন না। বালকদ্বয় প্রতিই তাঁহার লক্ষ্য-কি উপায়ে তাহাদিগকে রক্ষা করিবেন এই চিন্তাই প্রবল। হারেস রক্তরঞ্জিত তরবারি দ্বারা বালকদিগের মস্তকে আঘাত করিবেন এমন সময় গৃহিণী ‘ও কি কর-কি কর’ বলিয়া তরবারিসমেত স্বামীকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, “তুমি স্বামী আমি স্ত্রী, আমি এত বিনয় করিতেছি! মোস্‌লেম পুত্রদ্বয় শিরে অস্ত্র আঘাত করিয়ো না। দেখ! একবার ঐ দিকে চাহিয়া দেখ। তোমার কার্যফল দেখ। টাকার লোভে পুত্রসম পালকপুত্রের প্রাণ বিনাশ করিলে। তোমার হৃদয়ের সার, কলেজার অংশ নয়নের মণি যুবা পুত্রকে টাকার লোভে দুই খণ্ড করিলে! ভালই করিলে! টাকার লোভে আজ তোমার নিকট পিতৃস্নেহ পরাস্ত হইল। ভালই করিলে! তোমার এ কীর্তিগান চিরকাল জগতে লোকে গাহিবে। দুঃখ নাই।-তোমার পুত্রের প্রাণ তুমি বিনাশ করিয়াছ তাহাতে হতভাগিনীর দুঃখ নাই। তোমার ঔরসজাত নয়, আমার গর্ভেও জন্মে নাই, তবে আমার বুকের দুধ দিয়া উহাকে পালিয়া পুষিয়া এত বড় করিয়াছিলাম। তাহারই জন্য মনটা একটু দমিয়াছে। তাই বলিয়া তোমাকে কিছু বলিব না। একথা তুমি নিশ্চয় জানিয়ো-আমি বাঁচিয়া থাকিতে আমার প্রাণ দেহে থাকিতে, আমার সম্মুখে মোস্‌লেম পুত্রদ্বয়ের মাথা কাটিতে দিব না। কখনোই দিব না। আমাকে আগে কাটিয়া খণ্ড খণ্ড কর। তাহার পর মোস্‌লেম পুত্রদ্বয়ের গায়ে হাত দিয়ো-অস্ত্র বসাইয়ো।”

মানুষের কু-প্রবৃত্তি উত্তেজিত হইলে আর কী রা আছে? হারেস বলবান কৌশলী! কৌশলে স্ত্রীর হাত ছাড়াইয়া রক্ত-আঁখি ঘুরাইয়া বলিল, “তোকেও তোর ছেলের নিকট পাঠাচ্ছি। যা তোর ছেলে কোলে করে শুইয়া থাক্!” বিষম রোষে স্ত্রীর প্রতি আঘাত। “যা শুইয়া পড়। শুইয়া শুইয়া তামাশা দেখ-!”

হারেস-স্ত্রী মৃত্তিকায় পড়িতেই-হারেস উচ্চৈঃস্বরে বলিল, “এই মোস্‌লেমের পুত্রদ্বয় যায়। আয়! কে রক্ষা করিবি, আয়?”

মোহাম্মদের শিরে তরবারি আঘাত করিতেই এব্রাহিম কাঁদিয়া বলিল, “দেখ হারেস! আগে আমার মাথা কাটো।”-বলিয়া মাথা নোয়াইয়া দিয়া বলিলেন, “আমি বড় ভাইয়ের মাথা কাটা এই চক্ষে দেখিতে পারিব না। হারেস! তোমার পায়ে ধরি, আগে আমার মাথা কাটো।” হারেস মোহাম্মদকে ছাড়িয়া এব্রাহিমের মাথায় তরবারি বসাইতেই মোহাম্মদ কাঁদিয়া বলিল, “হারেস! অমন কার্য করিয়ো না-করিয়ো না। আমার প্রাণতুল্য কনিষ্ঠ ভাই। আমারই মাথা আগে কাটো, বড় ভাই, ছোট ভাইয়ের মাথা কাটা কোন্ প্রাণে দেখিবে? দোহাই তোমার-দোহাই তোমার ধর্মের-আগে আমার মাথা কাটো।”

হারেস মোহাম্মদের কথায় থতমত খাইয়া ক্ষণকাল স্থিরভাবে থাকিয়াই মহা সাংঘাতিক মূর্তিধারণ করিয়া অসি ঘুরাইয়া বলিল, “তোদের কাহারো কথা শুনিব না। আর শুনিব না, বিলম্ব করিব না। ভ্রাতৃমায়া মিটাইয়া দিতেছি।”-বলিয়া অগ্রে মোহাম্মদের মাথা কাটিল। পরে কনিষ্ঠ ভ্রাতা এব্রাহিমের মাথা মাটিতে গড়াইয়া দিল। সকলের মৃতদেহ ফোরাতজলে নিক্ষেপ করিয়া মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের মস্তক অতি সাবধানে লইয়া অশ্বে চাপিল। রক্তমাখা তরবারিহস্তেই একেবারে মহারাজ জেয়াদের দরবারে উপস্থিত হইয়াই বলিল, “বাদশাহ নামদারের আদেশ প্রতিপালন করিয়াছি। তবে আজ্ঞার কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত হইয়াছে। আপনি যাহা করিতেন, তাহাই করিয়াছি। জীবন্ত আনিতে পারিব না, অপরে কাড়িয়া লইবে সন্দেহে জীবনান্ত করিয়া-এই দুই ভাইয়ের দুটি ‘মাথা’ আনিয়াছি,-এই দেখুন! আমার পুরস্কার-আপনার আদেশিত পুরস্কার আমাকে দিন, আমি চলিয়া যাই। স্বীকৃত পঞ্চ সহস্র মোহর আনিতে আজ্ঞা করুন। মহারাজ! ছেলে দুইটিকে খুঁজিয়া বাহির করিতে যাহা হইবার হইয়াছে, তাহা বলিবার নহে।”

নরপতি আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্, রাজদরবারের সভাসদগণ, অমাত্যগণ, দরবারের যাবতীয় লোক হারেসের এই অমানুষিক কার্য দেখিয়া ক্ষণকাল নিস্তব্ধভাবে রহিলেন। সকলেই মোস্‌লেমের পুত্রদ্বয়ের জন্য অন্তরে বিশেষ আঘাতপ্রাপ্ত হইলেন। কাহারও মুখে কোন কথা সরিল না। নরপতি আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ হারেসের প্রতি লক্ষ্য করিয়া দুঃখিতভাবে বলিলেন, “ওহে! এমন সুন্দর বালক দুইটিকে এইরূপভাবে শিরচ্ছেদ করিলে; কেন? যাও, শীঘ্র দরবার হইতে বাহির হও। উহাদের ধূলি-রক্ত-জমাটযুক্ত মস্তক ধৌত করিয়া পরিষ্কার এক পাত্রে করিয়া আমার সম্মুখে আনয়ন কর!”

তখনই মস্তকদ্বয় ধৌত করিয়া মূল্যবান পাত্রোপরি রাখিয়া নরপতি সম্মুখে উপস্থিত করিল। জেয়াদ্ বলিলেন, “ওহে যুগল-বালকহন্তা পাষাণপ্রাণ হারেস! তোমার মন কী উপকরণে গঠিত বল শুনি? সত্যই কী মানব-রক্তমাংস তোমার দেহে নাই? অন্য কোন প্রকারে জীবনীশক্তি থাকিতে পারে! এই বালক দুটির মুখের লাবণ্য, চক্ষের ভাব, গণ্ডস্থলের স্বাভাবিক ঈষৎ গোলাপী আভা দেখিয়াও কী তোমার মনে কিছুই বলে নাই? হাতের তরবারি কী প্রকারে ঊর্ধ্বে উঠিল? ইহাদের বিষাদমাখা মুখভাব দেখিয়াও কী তরবারি নীচে নামিল না? মহারাজ এজিদ্ নামদার যদি মোস্‌লেম পুত্রদ্বয়কে দামেস্কে পাঠাইতে আদেশ করেন, তখন আমি কী করিব? উপায় কী? অল্পবয়স্ক বালক দুইটিই কী আমার বেশি ভারবোধ হইয়াছিল? তাহাদের জীবিত থাকাই কী আমার বিশেষ ভয়ের কারণ হইয়াছিল? ওহে বীর! বালকহন্তা মহাবীর! আমার ঘোষণায় কি বালকদের শিরচ্ছেদ করিয়া মাথা আনিবার কথা ছিল? না ডঙ্গা বাজাইয়া মাথা আনিবার ঘোষণা করা হইয়াছিল?”

হারেস বলিল,”শিরচ্ছেদের কথা ছিল না। ধরিয়া আনিবার আদেশ ছিল। জীবিত অবস্থায় তাহাদিগকে দরবার পর্যন্ত আনা দুঃসাধ্য বলিয়াই মাথা আনিয়াছি। শত শত জন এই বালকদ্বয়ের সন্ধানে ছিল। আমাকে দরবারে আনিতে দেখিলেই কাড়িয়া লইত। তাহারা রাজদরবারে আনিয়া স্বচ্ছন্দে পুরস্কার লাভ করিয়া যাইত। পরিশ্রম আমার-লাভ করিত ডাকাতদল। আমি বাদশাহ নামদারের মঙ্গলকামী হিতৈষী। চির-শত্রুর বংশে কাহাকেও রাখিতে নাই। হয়তো সময়ে এই বালকদ্বয় বীরশ্রেষ্ঠ বীর শত্রুর ন্যায় দণ্ডায়মান হইত। আমি একেবারে নির্মূল করিয়া দিয়াছি। আমাকে স্বীকৃত পুরস্কারে পুরস্কৃত করিয়া বিদায় করুন, আজ দুই দিন দুই রাত্রি আমার আহার নাই-নিদ্রা নাই-বিশ্রামের সময় অবসর কিছুই নাই। এই দুইটি বালকের মস্তক গ্রহণ করিতে আমার দুটি পুত্র এবং স্ত্রীর মাথা কাটিয়াছি।” দরবার সমেত সকলে মহা দুঃখিত হইলেন। নরপতি জেয়াদ বলিলেন, “ওহে বীর! সে কী কথা?”

“কী কথা! -আপনার শত্রুকুল নির্মূল করিতে আমার বংশ নিপাত করিলাম, তত্রাচ আপনার নিকট যশলাভ করিতে পারিলাম না। যাহার জন্যে এত কাণ্ড তাহা-অর্থাৎ সে মোহরগুলি পাইব কি-না তাহাতেও এখন সন্দেহ হইল।”

মন্ত্রীদল মধ্য হইতে একজন বলিলেন, “আপনার পুরস্কার ধরা আছে। -আর তিনটি খুন কি প্রকারে কোথায় করিলেন বলুন শুনি।”

“তিনটি খুনই বটে! কেন করিলাম শুনুন। আমার দুই পুত্র, এক স্ত্রী-এই তিনটি। তাহারা কিছুতেই এই শত্রুবালকদের শির কাটিতে দিবে না। বাধা দিতে আরম্ভ করিল! একে একে বাধা দিল। একে একে লাল বসন পরাইয়া ফোরাতজলের কূলে শয়ন করাইয়া দিলাম। এক স্থানেই সকলের শিরচ্ছেদে রক্তপাত। -নড়াচড়া-পরে সকলের দেহই ফোরাতজলে ক্ষেপণ। -অবগাহন-নিমজ্জন-বিসর্জন!”

আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ বলিলেন, “এ দৃশ্য আমি দেখিতে পারি না। নিরপরাধ বালকদ্বয়ের শির যে আপন হাতে কাটিতে পারে, সেই কার্যে বাধা দিয়াছিল-কাহারা? এই নরপিশাচের সন্তান দুইজন আর সহধর্মিণী স্বয়ং। তাহাদিগকেও বিনাশ করিয়াছে! -মোহরের এতই লোভ যে দুইটি পুত্র একটি স্ত্রী, সকলকেই বিনাশ করিয়াছে-এমন নররাক্ষসের শির কিছুতেই স্বস্থানে থাকিতে পারে না। হায়! হায়! একই সময়ে পাঁচটি মানবজীবন শেষ করিয়াছে। আমার আদেশ-মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়হন্তা হারেস, এই দুই বালকের শির সম্মানের সহিত মাথায় করিয়া ফোরাতকূলে লইয়া যাইবে। এই দুই বালকের মস্তক যে স্থানে দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়াছিল, সেই স্থানে সেই অস্ত্রে মহাপাপীর মস্তক দেহবিচ্ছিন্ন করিয়া, ফোরাতজলে নিক্ষেপ করিয়া জল অপবিত্র করিয়ো না। শৃগাল-কুকুরের ভক্ষণের সুযোগ করিয়া দিয়ো। স্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের দেহখণ্ড ফোরাতজলে ভাসাইয়া দিয়াছে, কী করিব।-কোন উপায় নাই। বিশেষ সন্ধান করিয়া দেখিয়ো। যদি এই যুগল ভ্রাতার মৃতদেহ প্রাপ্ত হওয়া যায়, তবে রীতিমত কাফন-দাফন করিয়া যথোচিতরূপে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াদি করিয়া আমার আদেশ সম্পূর্ণ করিয়ো এবং কার্য শেষে আমাকে সংবাদ জ্ঞাপন করিয়ো।”

ঘাতক প্রহরী কার্যকারক তখনই রাজাদেশ মত কার্য করিতে প্রবৃত্ত হইল। মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের খণ্ডিত শির, মহামূল্য বস্ত্রে আবরিত করিয়া হারেস-শিরে চাপাইয়া ফোরাতকূলে লইয়া চলিল। ফোরাতকূলে যাইয়া দেখিল, রক্ত আর বালিতে জমাট বাঁধিয়া একস্থানে চিহ্নিত হইয়া রহিয়াছে। আরো এক আশ্চর্য ঘটনা দেখিল যে, মোস্‌লেম পুত্রদ্বয়ের শিরশূন্য যুগল দেহ গলাগলি করিয়া জড়াইয়া জলে ভাসিতেছে। কী আশ্চর্য! স্রোতজলে যে মৃতদেহ ভাসাইয়া দিয়াছিল, স্রোত বিপরীতে কে টানিয়া আনিল? আরো আশ্চর্য সংযোগ করিল কে? রাজকীয় কার্যকারক এই অত্যাশ্চর্য ঘটনা দেখিয়া, তাঁহার মনেও একটা কথা হঠাৎ উদয় হইল। তিনি পাত্রস্থ দুইটি মস্তক ফোরাতজলের নিকটে ধরিতেই জড়িত যুগল দেহ ভাসিতে ভাসিতে আসিয়া আপন-আপন মস্তকে সংলগ্ন হইল। রাজকর্মচারী দুই মৃতদেহ উঠাইয়া পৃথক্ করিতে বহু চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কিছুতেই পৃথক্ করিতে পারিলেন না। সে গলাগলির হস্তবন্ধন ছিন্ন করিতে পারিলেন না। সে অপূর্ব ভ্রাতৃস্নেহ-হস্তবন্ধন বহু যত্নেও ছিন্ন করিতে পারিলেন না। শবদেহের সে আশ্চর্য ভ্রাতৃমায়া বন্ধন ছাড়াইয়া পৃথক্ করিতে সম হইলেন না। বাধ্য হইয়া দুই ভ্রাতার দেহ একত্রে স্নান করাইয়া একত্রে কাফন করিয়া এক গোরে দাফন্ করিলেন।

তাহার পর হারেসের প্রতি রাজাজ্ঞা যাহা ছিল, তাহা সম্পাদন করিতেই হারেস বলিল, “আমার উচিত শাস্তি হইল। অতিরিক্ত লোভের অতিরিক্ত ফল ভোগ করিলাম। হা-পুত্র! হা-স্ত্রী!! হা-লোভ!!!”

হারেসের খণ্ডিত দেহ বধ্যভূমিতে পড়িয়া রহিল।

বিষাদ সিন্ধু – মীর মশাররফ হোসেন মহরম পর্ব ২৪ প্রবাহ

হোসেন সপরিবারে ষষ্টি সহস্র সৈন্য লইয়া নির্বিঘ্নে কুফায় যাইতেছেন। কিন্তু কতদিন যাইতেছেন, কুফার পথের কোন চিহ্নই দেখিতে পাইতেছেন না। একদিন হোসেনের অশ্বপদ মৃত্তিকায় দাবিয়া গেল। ঘোড়ার পায়ের খুর মৃত্তিকা মধ্যে প্রবেশ করিয়া যাইতে লাগিল, কারণ কি? এইরূপ কেন হইল? কারণ অনুসন্ধান করিতে করিতে হঠাৎ প্রভু মোহাম্মদের ভবিষ্যৎ বাণী হোসেনের মনে পড়িল। নির্ভীক হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হইল, অঙ্গ শিহরিয়া উঠিল। হোসেন গণনা করিয়া দেখিলেন, আজ মহরম মাসের ৮ম তারিখ। তাহাতে আরো ভয়ে ভয়ে অশ্বে কশাঘাত করিয়া কিঞ্চিৎ অগ্রে গিয়া দেখিলেন যে, এক পার্শ্বে ঘোর অরণ্য, সম্মুখে বিস্তৃত প্রান্তর। চক্ষুনির্দিষ্ট সীমামধ্যে মানবপ্রকৃতি-জীবজন্তুর নামমাত্র নাই। আতপতাপ নিবারণোপযোগী কোনপ্রকার বৃক্ষও নাই, কেবলই প্রান্তর-মহাপ্রান্তর। প্রান্তর-সীমা যেন গগনের সহিত সংলগ্ন হইয়া ধূ-ধূ করিতেছে। চতুর্দিকে যেন প্রকৃতির স্বাভাবিক স্বরে আক্ষেপ-হায়! হায়! শব্দ উত্থিত হইয়া নিদারুণ দুঃখ প্রকাশ করিতেছে। জনপ্রাণীর নামমাত্র নাই, কে কোথা হইতে শব্দ করিতেছে তাহাও জানিবার উপায় নাই। বোধ হইল যেন শূন্যপথে শতসহস্র মুখে, ‘হায়! হায়!’ শব্দে চতুর্দিক আকুল করিয়া তুলিয়াছে।

হোসেন সকরুণ স্বরে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ করিয়া সঙ্গিগণকে বলিতে লাগিলেন, “ভাই সকল! হাস্য পরিহাস দূর কর; সর্বশক্তিমান্ জগৎ-নিদান করুণাময় ঈশ্বরের নাম মনে কর। আমরা বড় ভয়ানক স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। এই স্থানের নাম করিতে আমার হৃদয় কাঁপিয়া উঠিতেছে, প্রাণ ফাটিয়া যাইতেছে। ভাই রে! মাতামহ বলিয়া গিয়াছেন, ‘যে স্থানে তোমার অশ্বপদ মৃত্তিকায় দাবিয়া যাইবে, নিশ্চয় জানিয়ো, সেই তোমার জীবন বিনাশের নির্দিষ্ট স্থান এবং তাহারই নাম দাস্ত কারবালা।’ মাতামহের বাক্য অলঙ্ঘনীয়; পথ ভুলিয়া আমরা কারবালায় আসিয়াছি, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। তোমরা কি কর্ণে কিছু শুনিতে পাইতেছ? দৈব শব্দ শুনিতেছ?” তখন সকলেই মনোনিবেশ করিয়া শুনিতে লাগিলেন, চতুর্দিকেই, ‘হায়! হায়!!’ রব। ধন্য নূরনবী মোহাম্মদ! হোসেন বলিলেন, “মাতামহ ইহাও বলিয়া গিয়াছেন, চতুর্দিক হইতে যেস্থানে ‘হায়! হায়!!’ শব্দ উত্থিত হইবে নিশ্চয় জানিয়ো সেই কারবালা। ঈশ্বরের লীলা কাহারো বুঝিবার সাধ্য নাই। কোথায় যাইব? যাইবারই-বা সাধ্য কি? কোথায় দামেস্ক, কোথায় মদিনা, কোথায় কুফা, কোথায় কারবালা? আমি কারবালায় আসিয়াছি, আর উপায় কি? ভাই সকল! ঈশ্বরের নাম করিয়া গমনে ক্ষান্ত দাও।” ক্রমে সঙ্গীরা সকলেই আসিয়া একত্রিত হইল। হোসেনের মুখে কারবালার বৃত্তান্ত এবং চতুর্দিকে ‘হায়! হায়!!’ রব স্বকর্ণে শুনিয়া সকলেরই মুখে কালিমা-রেখা পড়িয়া গেল! যে যেখান হইতে শুনিল, সে সেই খানেই অমনি নীরবে বসিয়া পড়িল।

হোসেন বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! আর চিন্তা কি? ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্যে ভাবনা কি? এই স্থানেই শিবির নির্মাণ করিয়া ঈশ্বরের উপর নির্ভর করিয়া, তাঁহারই নাম ভরসা করিয়া থাকিব। সম্মুখে প্রান্তর, পার্শ্বে ভয়ানক বিজন বন, কোথায় যাই? অদৃষ্টে যা লেখা আছে, তাহাই ঘটিবে; এক্ষণে চিন্তা বিফল। শিবির নির্মাণের আয়োজন কর। আমি জানি, ফোরাত নদী এই স্থানের নিকট প্রবাহিত হইয়াছে। কত দূর এবং কোন্ দিকে তাহার নির্ণয় করিয়া কেহ কেহ জল আহরণে প্রবৃত্ত হও। পিপাসায় অনেকেই কাতর হইয়াছেন, আহারাদি সংগ্রহ করিয়া আপাততঃ ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ কর।”

শিবির নির্মাণ করিবার কাষ্ঠস্তম্ভ সংগ্রহ করিতে এবং রন্ধনোপযোগী কাষ্ঠ আহরণ করিতে যাহারা বনমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল, শোণিতাক্ত কুঠার হস্তে অত্যন্ত বিষাদিত চিত্তে বাষ্পাকুললোচনে তাহারা হোসেনের নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিতে লাগিল “হজরত! এমন অদ্ভুত ব্যাপার আমরা কোন স্থানেই দেখি নাই, কোন দিন কাহারো মুখে শুনিয়ো নাই। কী আশ্চর্য! এমন আশ্চর্য ঘটনা জগতে কোন স্থানে ঘটিয়াছে কি-না তাহাও সন্দেহ। আমরা বনে নানা প্রকার কাষ্ঠসংগ্রহ করিতে গিয়াছিলাম; যে বৃক্ষের যে স্থানে কুঠারঘাত করিলাম, সেই বৃক্ষেই অজস্র শোণিত চিহ্ন দেখিয়া ভয় হইল। ভয়ে ভয়ে ফিরিয়া আসিলাম। এই দেখুন! আমাদের সকলের কুঠারে সদ্যশোণিতচিহ্ন বিদ্যমান রহিয়াছে।”

হোসেন কুঠারসংযুক্ত শোণিত দর্শনে বলিতে লাগিলেন, “নিশ্চয়ই এ-ই কারবালা! তোমরা সকলে এই স্থানে ‘শহীদ’ স্বর্গসুখ ভোগ করিবে, তাহারই লক্ষণ ঈশ্বর এই শোণিত চিহ্নে দেখাইতেছেন। উহাতে আর আশ্চর্যান্বিত হইও না, ঐ বন হইতেই কাষ্ঠ সংগ্রহ করিয়া আনয়ন কর। দারু রস শোণিতে পরিণত দেখিয়া আর ভীত হইও না।”

ইমামের বাক্যে সকলেই আনন্দোৎসাহে শিবির সংস্থাপনে যত্নবান্ হইলেন। সকলেই আপন আপন সংস্থানোপযোগী এবং ইমামের পরিজনবর্গের অবস্থান জন্য অতি নির্জন স্থানে শিবির স্থাপন করিয়া যথাসম্ভব বিশ্রাম করিতে লাগিলেন।

আরবদেশে দাসের অভাব নাই। যে সকল ক্রীতদাস হোসেনের সঙ্গে ছিল, তাহারা কয়েকজন একত্রিত হইয়া ফোরাতের অন্বেষণে বহির্গত হইয়াছিল; ম্লানমুখে ফিরিয়া আসিয়া সকাতরে ইমামের নিকট বলিতে লাগিল, “বাদশাহ নামদার! আমরা ফোরাত নদীর অন্বেষণে বহির্গত হইয়াছিলাম। পূর্ব-উত্তর প্রদক্ষিণ করিয়া শেষে পশ্চিমদিকে গিয়া দেখিতে পাইলাম যে, ফোরাত নদী কুলকুল রবে দক্ষিণবাহিনী হইয়া প্রবাহিত হইতেছে। জলের নির্মলতার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া জলপানেচ্ছা আরো চতুর্গুণরূপে বলবতী হইল, কিন্তু নদীতীরে অসংখ্য সৈন্য সশস্ত্রে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া অতি সতর্কতার সহিত নদীর জল রক্ষা করিতেছে। যতদূর দৃষ্টির ক্ষমতা হইল, দেখিলাম এমন কোন স্থানই নাই যে, নির্বিঘ্নে একবিন্দু জল লইয়া পিপাসা নিবৃত্তি করা যায়। আমরা সৈন্যদিগকে কিছু না বলিয়া যেমন নদীতীরে যাইতে অগ্রসর হইয়াছি, তাহারা অমনই অতি কর্কশ বাক্যে বিশেষ অপমানের সহিত আমাদিগকে বিতাড়িত করিয়া দিয়া বলিল, “মহারাজ এজিদের আজ্ঞায় ফোরাত নদীকূল রক্ষিত হইতেছে, এই রক্ষক বীরগণের একটি প্রাণ বাঁচিয়া থাকিতে এক বিন্দু জল কেহ লইতে পারিবে না। আমাদের মস্তকের শোণিত ভূতলে প্রবাহিত না হইলে ফোরাত প্রবাহে কাহাকেও হস্তক্ষেপ করিতে দিব না। জল লইয়া পিপাসা নিবৃত্তি করা তো অনেক দূরের কথা। এবারে ফোরাতকূল চক্ষে দেখিয়া ইহজীবন সার্থক করিয়া গেলে,-যাও; ভবিষ্যতে এদিকে আসিলে আমাদের দৃষ্টির সীমা পর্যন্ত থাকিতে হইবে। নদীর তীরে এক পদও অগ্রসর হইতে দিব না। এই সুতীক্ষ্ণ শর তোমাদের পিপাসা শান্তি করিবে। প্রাণ বাঁচাইয়া ফিরিয়া যাও। নিশ্চয় জানিয়ো, ফোরাতের সুস্নিগ্ধ বারি তোমাদের কাহারো ভাগ্যে নাই।”

কথা শুনিয়া হোসেন মহাব্যস্ত হইলেন। খাদ্যাদির অভাব না থাকিলেও জল বিহনে কিরূপে বাঁচিবেন, এই চিন্তাই প্রবল হইল। মদিনার বহুসংখ্যক লোক সঙ্গে রহিয়াছে। অল্পবয়স্ক বালক-বালিকাগণ যখন পিপাসায় কাতর হইবে, জিহ্বাকণ্ঠ শুষ্ক হইয়া অর্ধোচ্চারিত কথা বলিতেও ক্ষমতা থাকিবে না, তখন কি করিবেন? এই চিন্তায় হোসেন ফোরাত নদীর দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া কি উপায়ে জয়লাভ করিবেন, ভাবিতেছেন, দেখিতে পাইলেন যে, চারিজন সৈনিক পুরুষ তাঁহার শিবির লক্ষ্য করিয়া সম্ভবতঃ কিছু ত্রস্তে চলিয়া আসিতেছে। মনে মনে ভাবিলেন, মোস্‌লেম আমার কুফা গমনে বিলম্ব দেখিয়া হয়ত সৈন্যগণকে কোন স্থানে রাখিয়া অগ্রে আমার সন্ধান লইতে আসিতেছে।

আগন্তুক চতুষ্টয় যত নিকটবর্তী হইতে লাগিল, ততই তাঁহার কল্পনা যে ভ্রমসঙ্কুল, তাহা প্রমাণ করিয়া দিল। শেষে দেখিলেন যে, তাহারা অপরিচিত; এমন কি কোন স্থানে তাহাদিগকে দেখিয়াছেন কি না, তাহাও বোধ হইল না। সৈন্য চতুষ্টয় নিকটে আসিয়াই হোসেনের পদ চুম্বন করিল। তন্মধ্য হইতে অপেক্ষাকৃত সজ্জিত পুরুষ কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া নত শিরে বলিতে লাগিলেন, “হজরত! দুঃখের কথা কী বলিব, আমরা এজিদের সৈন্য, কিন্তু আপনার মাতামহ-উপদিষ্ট ধর্মে দীতি। আমাদের কথায় অবিশ্বাস করিবেন না, শত্রুর বেতনভোগী বলিয়া শত্রু মনে করিবেন না। আমরা কিছুরই প্রত্যাশী নহি, কেবল আপনার দুঃখে দুঃখিত হইয়া কয়েকটি মাত্র কথা বলিতে অতি সাবধানে আপনার শিবিরে আসিয়াছি। সময় যখন মন্দ হইয়া উঠে, তখন চতুর্দিক হইতেই অমঙ্গল ঘটিয়া থাকে। এক্ষণে আপনার চতুর্দিকেই অমঙ্গল দেখিতেছি, মোস্‌লেমের ন্যায় হিতৈষী বন্ধু জগতে আপনার আর কেহ হইবে না। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ আপনার প্রাণ বিনাশ করিবার অভিপ্রায়েই ষড়যন্ত্র করিয়াছিল। ভাগ্যগতিকে মোস্‌লেম কুফায় যাইয়া আবদুল্লাহ্ জেয়াদের হস্তে বন্দি হইলেন! শেষে তাহারই চক্রে ওত্‌বে অলীদ্ এবং মারওয়ানের সহিত যুদ্ধে মোস্‌লেম বীরপুরুষের ন্যায় শত্রু বিনাশ করিয়া সেই শত্রুহস্তেই প্রাণ পরিত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহার সঙ্গে যে সহস্র সৈন্য ছিল, তাহারাও ওত্‌বে অলীদ ও জেয়াদের হস্তে প্রাণবিসর্জন করিয়া স্বর্গবাসী হইয়াছে। এক্ষণে সীমার, ওমর, আপনার প্রাণবধের জন্য নানাপ্রকার চেষ্টায় আছে। মারওয়ান, ওত্‌বে অলীদ্ এ পর্যন্ত আসিয়া উপস্থিত হয় নাই। এজিদের আজ্ঞাক্রমে আমরাই ফোরাতনদীকূল একেবারে বন্ধ করিয়াছি। মনুষ্য দূরে থাকুক পশু-পক্ষীকেও না ছাড়িয়া দিলে নদীতীরে যাইতে কাহারো সাধ্য নাই। সংক্ষেপে সকলই বলিলাম, যাহা ভাল বিবেচনা হয় করিবেন।” এই বলিয়াই আগন্তুক হোসেনের পদচুম্বন করিয়া চলিয়া গেল।

মোস্‌লেমের দেহত্যাগের সংবাদে হোসেন মহাশোকাকুল হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতে লাগিলেন, “হা ভ্রাতঃ মোস্‌লেম! যাহা বলিয়া গিয়াছিলে তাহাই ঘটিল। হোসেনের প্রাণবিনাশ করিতেই যদি আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্ কোন ষড়যন্ত্র করিয়া থাকে, তবে সে যন্ত্রে আমিই পড়িব, হোসেনের প্রাণ তো রক্ষা পাইবে? ভাই! নিজ প্রাণ দিয়া হোসেনকে জেয়াদের হস্ত হইতে রক্ষা করিলে। তুমি তো মহা অক্ষয় স্বর্গসুখে সুখী হইয়া জগৎ-যন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ পাইলে। আমি দুরন্ত কারবালা প্রান্তরে অসহায় হইয়া বিন্দুমাত্র জলের প্রত্যাশায় বোধ হয় সপরিবারে জীবন হারাইলাম। রে দুরন্ত পাপিষ্ঠ জেয়াদ্! তোর চক্রে মোস্‌লেমকে হারাইলাম। তোর চক্রেই আজ সপরিবারে জল বিহনে মারা পড়িলাম!” মোস্‌লেমের জন্য হোসেন অনেক দুঃখ করিতে লাগিলেন। ওদিকে জলাভাবে তাঁহার সঙ্গিগণ মধ্যে মহাকোলাহল উপস্থিত হইল।

ক্রমে সকলেই পিপাসাক্রান্ত হইয়া হোসেনের নিকট আসিয়া বলিতে লাগিলেন, “জলাভাবে এত লোক মরে! পিপাসায় সকলেই শুষ্ককণ্ঠ, এক্ষণে আর তা সহ্য হয় না!”

সকাতরে হোসেন বলিলেন, “কী করি। বিন্দুমাত্র জলও পাইবার প্রত্যাশা আর নাই। ঈশ্বরের নামামৃত পান ভিন্ন পিপাসা-নিবৃত্তির আর এখন কি উপায় আছে? বিনা জলে যদি প্রাণ যায়, সকলেই সেই করুণাময় বিশ্বনাথের নাম করিয়া পিপাসা নিবৃত্তি কর। সকলেই আপন আপন স্থানে যাইয়া ঈশ্বরোপাসনায় মনোনিবেশ কর।” সকলেই পরমেশ্বরে মনোনিবেশ করিলেন। ক্রমে ৯ই তারিখ কাটিয়া গেল। দশম দিবসের প্রাতে হোসেনের শিবিরে মহাকোলাহল। প্রাণ যায় আর সহ্য হয় না! এই প্রকার গগনভেদী শব্দ উঠিতে লাগিল। পরিবারস্থ সকলের আর্তনাদে এবং কাতরস্বরে হোসেন আর তিষ্ঠিতে পারিলেন না। উপাসনায় ক্ষান্ত দিয়া, হাসনেবানু ও জয়নাবের বস্ত্রাবাসে যাইয়া তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। কন্যা, পুত্র এবং অল্পবয়স্ক বালক-বালিকারা আসিয়া এক বিন্দু জলের জন্য তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। সাহারবানু দুগ্ধপোষ্য শিশুসন্তানটি ক্রোড়ে করিয়া আসিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতে লাগিলেন, “আজ সাত রাত নয় দিনের মধ্যে একবিন্দু জলও স্পর্শ করিলাম না। পিপাসায় আমার জীবন শেষ হউক, তাহাতে কিছুমাত্র দুঃখ করি না; কিন্তু স্তনের দুগ্ধ পর্যন্ত শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। এই দুগ্ধপোষ্য বালকের প্রাণনাশের উপক্রম হইল। এই সময়ে একবিন্দু জল-কোন উপায়ে ইহার কণ্ঠে প্রবেশ করাইতে পারিলেও বোধ হয় বাঁচিতে পারিত।” হোসেন বলিলেন, “জল কোথায় পাইব? এজিদের সৈন্যগণ ফোরাত নদীর কূল আবদ্ধ করিয়াছে, জল আনিতে কাহারো সাধ্য নাই।”

সাহারবানু বলিলেন, “এই শিশু সন্তানটির জীবন রক্ষার্থে যদি আপনি নিজে গিয়াও কিঞ্চিৎ জল উহাকে পান করাইতে পারেন, তাহাতেই-বা হানি কী? একটি প্রাণ তো রক্ষা হইবে? আমাদের জন্য আপনাকে যাইতে বলিতেছি না।”

হোসেন বলিলেন, “জীবনে কোন দিন শত্রুর নিকট কী বিধর্মীর নিকট কোন বিষয়ে প্রার্থী হই নাই। কাফেরের নিকট কোনকালে কিছু যাচ্ঞা করি নাই, জল চাহিলে কিছুতেই পাইব না। আর আমি এই শিশুর প্রাণ রক্ষার কারণেই যদি তাহাদের নিকট জল ভিক্ষা করি, তবে আমি চাহিলে তাহারা জল দিবে কেন? আমার মনঃকষ্ট, মনোবেদনা দিতেই তো তাহারা কারবালায় আসিয়াছে, আমার জীবন বিনাশ করিবার জন্যই তো তাহারা ফোরাতকূল আবদ্ধ করিয়াছে।”

সাহারবানু বলিলেন, “তাহা যাহাই বলুন, বাঁচিয়া থাকিতে কী বলিয়া এই দুগ্ধপোষ্য সন্তান দুগ্ধ-পিপাসায়;-শেষ জল-পিপাসায় প্রাণ হারাইবে, ইহা কিরূপে স্বচক্ষে দেখিব!” হোসেন আর দ্বিরুক্তি করিলেন না। সত্বর উঠিয়া গিয়া অশ্ব সজ্জিত করিয়া আনিয়া বলিলেন, “দাও! আমার ক্রোড়ে দাও! দেখি আমার সাধ্যানুসারে যত্ন করিয়া দেখি!”-এই বলিয়া হোসেন অশ্বে উঠিলেন। সাহারবানু সন্তানটি হস্তে লইয়া অশ্বপৃষ্ঠে স্বামীর ক্রোড়ে বসাইয়া দিলেন। হোসেন পুত্রকে ক্রোড়ে লইয়া অশ্বে কশাঘাত করিলেন। মুহূর্তমধ্যে ফোরাত নদীতীরে উপস্থিত হইয়া নদীতীরস্থ সৈন্যগণকে বলিলেন, “ভাই সকল! তোমাদের মধ্যে যদি কেহ মুসলমান থাক, তবে এই দুগ্ধপোষ্য শিশুর মুখের দিকে চাহিয়া কিঞ্চিৎ জল দান কর। পিপাসায় ইহার কণ্ঠতালু শুকাইয়া একেবারে নীরস কাষ্ঠের ন্যায় হইয়াছে! এ সময়ে কিঞ্চিৎ জলপান করাইতে পারিলেও বোধ হয় বাঁচিতে পারে! তোমাদের ঈশ্বরের দোহাই, এই শিশুসন্তানটির জীবন রক্ষার্থ ইহার মুখের প্রতি চাহিয়া কিঞ্চিৎ জল দান কর। এই দুগ্ধপোষ্য শিশুর প্রাণরক্ষা করিলে পরমেশ্বর, তোমাদের প্রতি প্রসন্ন হইবেন।”

কেহই উত্তর করিল না। সকলে একদৃষ্টে হোসেনের দিকে চাহিয়া রহিল। পুনরায় হোসেন বলিতে লাগিলেন, “ভাই সকল! এ দিন চিরদিন তোমাদের সুদিন থাকিবে না: কোন দিন ইহার সন্ধ্যা হইবেই হইবে। ঈশ্বরের অনন্ত ক্ষমতার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত কর; তাঁহাকে একটু ভয় কর। ভ্রাতৃগণ! পিপাসায় জল দান মহাপুণ্য তাহাতে আবার অল্পবয়স্ক শিশু। ভ্রাতৃগণ! ইহার জীবন আপনাদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিতেছে। আমি সামান্য সৈনিকপুরুষ নহি; আমার পিতা মহামান্য হজরত আলী, মাতামহ নূরনবী হজরত মোহাম্মদ, মাতা ফাতেমা-জোহরা খাতুন জান্নাত; এই সকল পুণ্যাত্মাদিগের নাম স্মরণ করিয়াই এই শিশু সন্তানটির প্রতি অনুগ্রহ কর। মনে কর, যদি আমি তোমাদের নিকটে কোন অপরাধে অপরাধ হইয়া থাকি, কিন্তু এই দুগ্ধপোষ্য বালক তোমাদের কোন অনিষ্ট করে নাই; তোমাদের নিকট কোন অপরাধে অপরাধী হয় নাই। ইহার প্রতি দয়া করিয়াই ইহার জীবন রক্ষা কর।”

সৈন্যগণ মধ্য হইতে একজন বলিল, “তোমার পরিচয়ে জানিলাম, তুমি হোসেন। তুমি সহস্র অনুনয় বিনয় করিয়া বলিলেও জল দিব না। তোমার পুত্র জল পিপাসায় জীবন হারাইলে তাহাতে তোমার দুঃখ কী? তোমার জীবন তো এখনই যাইবে; সন্তানের দুঃখে না কাঁদিয়া তোমার নিজের প্রাণের জন্য একবার কাঁদ;-অসময়ে পিপাসায় কাতর হইয়া কারবালায় প্রাণ হারাইবে, সেই দুঃখে একবার ক্রন্দন কর, শিশুসন্তানের জন্য জন্য আর কষ্ট পাইতে হইবে না। এই তোমার সকল জ্বালাযন্ত্রণা একেবারে নিবারণ করিয়া দিতেছি।” এই বলিয়া সেই ব্যক্তি হোসেনের বক্ষ লক্ষ্য করিয়া এক বাণ নিপে করিল। ক্ষিপ্তহস্ত-নিপ্তি সেই সুতীক্ষ্ণ বাণ হোসেনের বক্ষে না লাগিয়া ক্রোড়স্থ শিশুসন্তানের বক্ষ বিদারণ করিয়া পৃষ্ঠদেশ পার হইয়া গেল। হোসেনের ক্রোড় রক্তে ভাসিতে লাগিল।

হোসেন বলিতে লাগিলেন, “ওরে পাষাণহৃদয়! ওরে শর নিক্ষেপকারী! কী কার্য করিলি! এই শিশুসন্তান বধে তোর কী লাভ হইল? হায় হায়! আমি কোন্ মুখে ইহাকে লইয়া যাইব! সাহারবানুর নিকট গিয়াই-বা কী উত্তর করিব।” হোসেন মহাখেদে এই কথা কয়েকটি বলিয়াই সরোষে অশ্বচালনা করিলেন। শিবির সম্মুখে আসিয়া মৃত-সন্তান ক্রোড়ে করিয়াই লম্ফ দিয়া অশ্ব হইতে অবতরণ করিলেন। সাহারবানুর নিকট গিয়া বলিলেন, “ধর! তোমার পুত্র ক্রোড়ে লও! আজ বাছাকে স্বর্গের সুশীতল জল পান করাইয়া আনিলাম!” সাহারবানু সন্তানের বুকের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াই অজ্ঞান হইয়া ভূতলে পতিতা হইলেন! পরে বলিলেন, “ওরে! কোন্ নির্দয় নিষ্ঠুর এমন কার্য করিল! কোন্ পাষাণহৃদয় এমন কোমল শরীরে লৌহশর নিক্ষেপ করিল! ঈশ্বর! সকলই তোমার খেলা! যে দিন মদিনা পরিত্যাগ করিয়াছি, সেই দিনই দুঃখের ভার মাথায় ধরিয়াছি।”

শিবিরস্থ পরিজনেরা সকলেই সাহারবানুর শিশুসন্তানের জন্য কাঁদিতে লাগিল। কেহ কাহাকেও সান্ত্বনা করিতে সক্ষম হইল না। মদিনাবাসীদিগের মধ্যে আবদুল ওহাব নামক একজন বীরপুরুষ হোসেনের সঙ্গী লোক মধ্যে ছিলেন, আবদুল ওহাবের মাতা স্ত্রীও সঙ্গে আসিয়াছিলেন। হোসেনের এবং তাঁহার পরিজনগণের দুঃখ দেখিয়া আবদুল ওহাবের মাতা সরোষে তাহাকে বলিতে লাগিলেন, “আবদুল ওহাব! তোমাকে কি জন্য গর্ভে ধারণ করিয়াছিলাম? হোসেনের এই দুঃখ দেখিয়া তুমি এখনো বসিয়া আছ? এখনো তোমাকে অস্ত্রে সুসজ্জিত দেখিতেছি না?-এখনো তুমি অশ্ব সজ্জিত করিয়া ইহার প্রতিশোধ লইতে অগ্রসর হইতেছ না? জল বিহনে সকলেই মরিবে, আর কতক্ষণ বাঁচিবে? ধিক্ তোমার জীবনে! কেবল কি বন্য পশু বধের জন্যই শরীর পুষিয়াছিলে? এখনো স্থির হইয়া আছ? ধিক্ তোমার জীবনে! ধিক্ তোমার বীরত্বে! হায়! হায়! হোসেনের দুগ্ধপোষ্য সন্তানের প্রতি যে হাতে তীর মারিয়াছে, আমি কি সেই পাপীর সেই হাতখানা দেখিয়াই পরিতৃপ্ত হইব, তাহা মনে করিয়ো না। তোমার শরসন্ধানে সেই বিধর্মী নারকীর তীরবিদ্ধ মস্তক আজ আমি দেখিতে ইচ্ছা করি। হায় হায়! এমন কোমল শরীর যে নরাধম তীর বিদ্ধ করিয়াছে, তাহার শরীরে মানুষী রক্ত, মানুষী ভাব,-কিছুই নাই। আবদুল ওহাব! তুমি স্বচে সাহারবানুর ক্রোড়স্থ সন্তানের সাংঘাতিক মৃত্যু দেখিয়াও নিশ্চিন্তভাবে আছ! শিশুশোকে শুদ্ধ নয়নজলই ফেলিতেছ! নিতান্ত আক্ষেপের বিষয়! বিপদে দুঃখে তোমরাই যদি কাঁদিয়া অনর্থ করিলে তবে আমরা আর কি করিব? অবলা নিঃসহায়া স্ত্রীজাতির জন্যই বিধাতা কান্নার সৃষ্টি করিয়াছেন। বীরপুরুষের জন্য নহে।”

মাতার উৎসাহসূচক ভর্ৎসনায় আবদুল ওহাব তখনই সজ্জিত হইয়া আসিলেন। মাতার চরণ চুম্বন করিয়া বলিলেন, “আবদুল ওহাব আর কাঁদিবে না। তাঁহার চক্ষের জল আর দেখিবেন না; ফোরাত নদীর কূল হইতে শত্রুদিগকে তাড়াইয়া মোহাম্মদের আত্মীয়স্বজন পরিবারদিগের জলপিপাসা নিবারণ করিবে, আর না হয় কারবালাভূমি আবদুল ওহাবের শোণিতে আজ অগ্রেই রঞ্জিত হইবে? কিন্তু মা! এমন কঠিন প্রতিজ্ঞা পরিপূর্ণাশয়ে যুদ্ধেক্ষেত্র গমন সময়ে আমার সহধর্মিণীর মুখখানি একবার দেখিয়া যাইতে ইচ্ছা করি।”

মাতা বলিলেন, “ছি ছি! বড় ঘৃণার কথা! যুদ্ধযাত্রীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শোভা রমণীর নয়নতৃপ্তির জন্য নহে। বীর-বেশ বীরপুরুষেরই চক্ষুরঞ্জক। বিশেষ, এই সময়ে যাহাতে মনে মায়ার উদ্রেক হয়, জীবনাশা বৃদ্ধি হয়, এমন কোন স্নেহপাত্রের মুখ দেখিতেও নাই, দেখাইতেও নাই। ঈশ্বর-প্রসাদে ফোরাতকূল উদ্ধার করিয়া অগ্রে হোসেন-পরিবারের জীবন রক্ষা কর, মদিনাবাসীদিগের প্রাণ বাঁচাও তাহার পর বিশ্রাম। বিশ্রাম সময়ে বিশ্রামের উপকরণ যাহা, তাহা সকলই পাইবে। বীরপুরুষের মায়া মমতা কি? বীরধর্মে অনুগ্রহ কি? একদিন জন্মিয়াছ একদিন মরিবে,-শত্রুসম্মুখীন হইবার অগ্রে স্ত্রীমুখ দেখিবার অভিলাষ কি জন্য? তুমি যদি মনে মনে স্থির করিয়া থাক যে এই শেষ যাত্রা, আর ফিরিব না, জন্মশোধ স্ত্রীর মুখখানি দেখিয়াই যাই, তবে তুমি কাপুরুষ, বীরকুলের কণ্টক, বীরবংশের গ্লানি, বীরকুলের কুলাঙ্গার।”

আবদুল ওহাব আর একটি কথাও না বলিয়া জননীর চরণচুম্বনপূর্বক ঈশ্বরের নাম করিয়া অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ফোরাতকূলে যাইয়া বিপক্ষগণকে বলিতে লাগিলেন, “ওরে পাষাণহৃদয় বিধর্মিগণ! যদি প্রাণের মমতা থাকে, যদি আর কিছুদিন জগতে বাস করিবার ইচ্ছা থাকে, তবে শীঘ্র নদীকূল ছাড়িয়া পলায়ন কর। দেখ, আবদুল ওহাব নদীকূল উদ্ধার করিয়া দুগ্ধপোষ্য শিশুহন্তার মস্তক নিপাত জন্য আসিয়াছে। তোদের বুদ্ধিজ্ঞান একেবারেই দূর হইয়াছে, তোরা কি এই অকিঞ্চিৎকর জীবনকে চিরজীবন মনে করিয়া রহিয়াছিস্? এই জীবনের কি আর অন্ত নাই? ইহার কি শেষ হইবে না? শেষ দিনের কথা কি একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছিস্? যেদিন স্বর্গাসনে বিচারপতি স্বয়ং বিচারাসনে বসিয়া জীব মাত্রের পাপ পুণ্যের বিচার করিবেন, বল তো কাফের সে দিন আর তোদিগকে কে রক্ষা করিবে? সেই সহস্র সহস্র সূর্য কিরণের অগ্নিময় উত্তাপ হইতে কে বাঁচাইবে? সেই বিষম দুর্দিনে অনুগ্রহবারি সিঞ্চনে কে আর তোদের পিপাসা নিবারণ করিয়া শান্তি দান করিবে? বল্‌ত, কাফের কাহার নাম করিয়া সেই দুঃসহ নরকাগ্নি হইতে রক্ষা পাইবি? অর্থের দাস হইলে কি আর ধর্মাধর্মের জ্ঞান থাকে না? যদি যুদ্ধের সাধ থাকে সে সাধ আজ অবশ্য মিটাইব। এখনো বলিতেছি, ফোরাতকূল ছাড়িয়া দিয়া সেই বিপদকাণ্ডারী প্রভু হজরত মোহাম্মদের পরিজনগণের প্রাণরক্ষা কর। অবলা অসহায়দিগকে শুষ্ককণ্ঠ করিয়া মারিতে পারিলেই কি বীরত্ব প্রকাশ হয়? এই কি বীর ধর্মের নীতি? দুগ্ধপোষ্য শিশু-সন্তানকে দূর হইতে চোরের ন্যায় বধ করাই কি তোদের বীরত্ব? যদি যথার্থ যুদ্ধের সাধ থাকে, যদি যথার্থই বীরত্ব দেখাইয়া মরিতে ইচ্ছা থাকে, আবদুল ওহাবের সম্মুখে আয়। যদি মরিতে ভয় হয় তবে ফোরাতকূল ছাড়িয়া পলায়ন কর। ন্যূনতা স্বীকার কিংবা যাচ্ঞা করিলে আবদুল ওহাব পরম শত্রুকেও তাহার প্রাণ ভিক্ষা দিয়া থাকে। মদিনাবাসীরা তোদের ন্যায় যুদ্ধে শিক্ষিত নহে। এই অহঙ্কারেই তোরা মাতিয়া আছিস্। কিন্তু ঈশ্বর প্রসাদে তাহারা যথার্থ বীর ও যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী।”

আবদুল ওহাব অশ্বে কশাঘাত করিয়া শত্রুদল সম্মুখে চক্রাকারে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, কেহই তাঁহার সম্মুখে আসিতে সাহস করিল না, নদীকূলও ছাড়িয়া দিল না। আবদুল ওহাব পুনরায় সক্রোধে বলিতে লাগিলেন, “যোদ্ধাই হউক, বীরেন্দ্রই হউক, উদ্যোগী পুরুষই হউক, সেই ধন্য, যে সময়কে অতি মূল্যবান জ্ঞান করে। তোদের সকল বিষয়েই জ্ঞান আছে দেখিতেছি। যদি সাহস থাকে, যদি আবদুল ওহাবের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে কাহারো ইচ্ছা হয়, তবে শীঘ্র আয়। আবদুল ওহাব আজ বিধর্মীর রক্তপাতে ফোরাতজল রক্তবর্ণে রঞ্জিত করিয়া দ্বিগুণ রঞ্জন বৃদ্ধি করিবে, এই আশয়েই তোদের সম্মুখে আসিয়াছে। শত্রুসম্মুখীন হইতে এত বিলম্ব? শত্রু যুদ্ধপ্রার্থী তোরা বিশ্রামপ্রার্থী! ধিক্ তোদের বীরত্বে! ধিক্ তোদের সাহসে! আজ সাত রাত নয় দিন আবদুল ওহাব জলস্পর্শ করে নাই, ফোরাত নদীতীরে মহানন্দে ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ করিয়া রহিয়াছিস্। ইহাতেও এত বিলম্ব, এত ভয়! শীঘ্র আয়, একে একে তোদের সকলকেই নরকে প্রেরণ করিতেছি।”

বিপক্ষদল হইতে দীর্ঘকার এক বীরপুরুষ বহির্গত হইয়া অতি উচ্চ লোহিতবর্ণ অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণপূর্বক বিশেষ দক্ষতার সহিত অসিচালনা করিতে করিতে আবদুল ওহাবের সম্মুখীন হইয়া বলিতে লাগিল, “মূর্খেরাই দর্প করে! কাপুরুষেরাই অহঙ্কার প্রদর্শন করিয়া থাকে। শৃগাল! বাক্চাতুরী ছাড়িয়া পুনরায় শিবিরে প্রস্থান কর-তোকে মারিয়া কী হইবে? আবদুল ওহাব, তুই কাহার সন্তান, তোর জননী কাহার কন্যা, সেই সকল পরিচয় লইয়া আসিতেই আমার একটু বিলম্ব হইয়াছে। তুই কেন এই নবযৌবনে পরের জন্য আপন প্রাণ হারাইবি? তোকে বধ করিলে এজিদের নিকট যশলাভ হইবে না। তোদের হোসেনকে যুদ্ধক্ষেত্রে আসিতে বল, তুই যদি কিছুদিন সংসারে বাস করিতে বাসনা করিস, ফিরিয়া যা, তোকে চাহি না!”

আবদুল ওহাব ক্রোধে অধীর হইয়া বলিলেন, “বিধর্মী কাফের! এত বড় আস্পর্ধা তোর! অগ্রে তুই হোসেনকে যুদ্ধক্ষেত্রে আহ্‌বান করিস্? আবদুল ওহাবের পদাঘাতে কি কিছুমাত্র বল নাই? রে ক্ষুদ্রকীট! চরণশরণাগত দাস বাঁচিয়া থাকিতে প্রভুকে আহ্‌বান কেন? অগ্রে আবদুল ওহাবের পদাঘাত সহ্য কর, তাহার পর অন্য কথা।”-সদর্পে এই কথা বলিয়া আবদুল ওহাব অশ্ব ঘুরাইয়া বিধর্মীর নিকট যাইয়া এমনি জোরে তরবারির আঘাত করিলেন যে একাঘাতে অশ্ব সহিত তাহাকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অশ্ব চক্র দিয়া শত্রুবিনাশী আবদুল ওহাব প্রত্যেক চক্র পরিবর্তনে বিপক্ষগণকে আহ্‌বান করিতে লাগিলেন। একে একে সত্তরজন বিধর্মীকে নরকে প্রেরণ করিয়া পুনরায় পরিক্রমণের জন্য শত্রুগণকে আহ্‌বান করিতে লাগিলেন। কিন্তু কেহই তাহার সম্মুখে আর অগ্রসর হইল না। দূর হইতে শর নিক্ষেপ করিয়া পরাস্ত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। আবদুল ওহাব ভীত হইলেন না,-দুই হস্তে অসি চালনা করিয়া নিক্ষিপ্ত শর খণ্ডে খণ্ডে বিচ্ছিন্ন করিতে লাগিলেন। মধ্যে মধ্যে শত্রু-নিপ্তি শর আবদুল ওহাবের গাত্রে বিদ্ধ হইয়া রক্তধারা প্রবাহিত করিতে লাগিল। সেদিকে আবদুল ওহাবের দৃষ্টি নাই, কেবল শত্রু-বিনাশ কৃতসঙ্কল্প।

বহু পরিশ্রম করিয়া আবদুল ওহাব পিপাসায় আরো কাতর হইলেন। কি করেন, কোন উপায় না পাইয়া বেগে যুদ্ধক্ষেত্র হইতে হোসেনের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “হজরত বড় পিপাসা! এই সময় ওহাবকে যদি একবিন্দু জল দান করিতে পারেন, তাহা হইতে শত্রুকুল-”

“জল? জল আমি কোথায় পাইব ভাই?” অধিকতর কাতর দেখিয়া বলিতে লাগিলেন, “ভাই! যদি সেই ক্ষমতাই থাকিত, তবে তোমার আর এমন দশা হইবে কেন?”

দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া মহা উত্তেজিত কণ্ঠে আবদুল ওহাবের জননী বলিতে লাগিলেন, “আবদুল ওহাব! যুদ্ধক্ষেত্র হইতে কি ফিরিতে আছে? তুমি যদি ইচ্ছা করিয়াও না ফিরিয়া থাক, কাহারো আদেশেও যদি ফিরিয়া থাক, তাহা হইলেও কি শত্রু হাসিবে না? কী ঘৃণা! কী লজ্জা! কেন তুমি আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলে? শত্রুকে পিঠ দেখাইয়া সামান্য জল-পিপাসায় প্রাণ রক্ষা করিতে যুদ্ধ ছাড়িয়া ফিরিয়া আসিলে! তোমার ও কলঙ্কিত মুখ আমি আর দেখিব না। আমি তোমাকে জীবিত ফিরিয়া আসিবার জন্য যুদ্ধে পাঠাই নাই। হয় ফোরাতকূল উদ্ধার করিয়া হোসেনের পুত্রপরিজনকে রক্ষা করিবে দেখিব, না হয় রণক্ষেত্র-প্রত্যাগত তোমার মস্তকশূন্য দেহ দেখিয়া এই বৃদ্ধ বয়সে জীবন শীতল করিব, এই আমার আশা ছিল। তুমি বীরকুলকলঙ্ক, আমার আশা ফলবতী হইতে দিলে না।”

সভয়ে কম্পিত হইয়া আবদুল ওহাব কহিলেন, “জননী! আবার আমি যাইতেছি, আর ফিরিব না-হয় নদীকূল উদ্ধার, নয় আবদুল ওহাবের মস্তক দান। কিন্তু জননী! পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত! পিপাসা নিবারণ করিবার আর উপায় নাই! একটিমাত্র নিবেদন, চরণদর্শনে পিপাসা শান্তি। আর-একবার আমার স্ত্রীর মুখখানি।”

“হাঁ বুঝিয়াছি সেই মুখখানি!-মুখখানি দেখিতে পার, কিন্তু অশ্ব হইতে নামিতে পারিবে না।” মাতার আজ্ঞানুযায়ী সেই অবস্থাতেই আবদুল ওহাব আপন স্ত্রীর নিকট যাইয়া বলিলেন, “জীবিতেশ্বরী! আমি যুদ্ধযাত্রী! যুদ্ধ করিতে করিতে তোমার কথা মনে পড়িল, পিপাসাতেও প্রাণ আকুল। ভাবিলাম তোমাকে দেখিলে বোধ হয় কিছু শ্রান্তি দূর হইবে, পিপাসাও নিবারণ হইবে। এই মনে করিয়াই আসিয়াছি, কিন্তু অশ্ব হইতে নামিবার আদেশ নাই! মাতার আজ্ঞা, অশ্বপৃষ্ঠে বসিয়াই সাক্ষাৎ।”

পতিপরায়ণা পতিব্রতা সতী পতির নিকট যাইয়া অশ্ববল্গা ধারণপূর্বক মিনতি বচনে কহিতে লাগিলেন, “জীবিতেশ্বর! সমরাঙ্গণে অঙ্গনার কথা মনে করিতে নাই। যুদ্ধেক্ষেত্র অন্তঃপুরের কথা যাহার মনে পড়ে, সে আবার কেমন বীর?-শত্রুকে পৃষ্ঠ দেখাইয়া যে যোদ্ধা স্ত্রীর মুখ দেখিতে আইসে, সেই বা কেমন বীর? প্রাণেশ্বর আমি নারী, আমি তো ইহার মর্ম কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। প্রভু মোহাম্মদের বংশধরগণের বিপদ সময়ে সাহায্য করিতে স্ত্রীপরিবার সন্তান-সন্ততির কথা যে যোদ্ধৃপুরুষ মনে করে, তাহাকে আমি বীরপুরুষ বলি না। যদি আপনারা যুদ্ধক্ষেত্রকে ভয় করেন, তবে আমরাই,-এই আমরাই এলোচুলে রণরঙ্গিণী রণবেশে সমরাঙ্গণে অসিহস্তে নৃত্য করিব। রণরঞ্জিত বস্ত্রে আমরাও রণসাজে সাজিতে কুণ্ঠিত হইব না। দেখি, কোন্ বিপক্ষ যোদ্ধা আমাদের সম্মুখে অগ্রসর হইতে পারে? দেখার দিন, কথার দিন, বিশ্রামের দিন, ঈশ্বর-প্রসাদে যদি পাই, তবে মনের আনন্দে আপনাকে সেবা করিব। হোসেনের বিপদ চিরকাল থাকিবে না, কিন্তু এমন দিন পাইয়া আপনি আর খোয়াইবেন না; এমন দিন আপনি আর পাইবেন না। এমন সময়ে কি বিলম্ব করা উচিত? ছি! ছি! বীরপুরুষ! তোমারে ছি ছি! শত্রু যুদ্ধার্থী হইয়া অপেক্ষা করিতেছে, তুমি কি না কাপুরুষের মত অবরোধপুরে আসিয়া অবরোধবাসিনী কুলবালার মুখ দেখিতে অভিলাষী হইয়াছ? ছিঃ তোমাকে!”

অশ্ব হইতেই নতশিরে সাধ্বী-সতীর কপোল চুম্বন করিয়া আবদুল ওহাব আর তাঁহার দিকে ফিরিয়াও চাহিলেন না। সতীর মিষ্ট ভর্ৎসনায় অন্তরে অন্তরে লজ্জিত হইয়া সজোরে অশ্বে কশাঘাত করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন করিলেন। শত্রুগণকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “রে বিধর্মী কাফেরগণ। ভাবিয়াছিলি যে, আবদুল ওহাব পলাইয়াছে। আবদুল ওহাব পলায় নাই! ঈশ্বরের নামে অতি অল্প সময় এই জগৎ দেখিতে আমি তোমাদিগকে অবসর দিয়াছিলাম। আয় দেখি, কতজনে আবদুল ওহাবের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে আসিবি আয়।”

আবদুল ওহাবের মাতা তাহার অজ্ঞাতে যুদ্ধক্ষেত্রের নিকটে যাইয়া আবদুল ওহাবের যুদ্ধ দেখিতে লাগিলেন। পূর্বেই সেনাপতি ওমর সকলকেই বলিয়া রাখিয়াছিলেন যে আবদুল ওহাব কোন কারণবশতঃ ফিরিয়া গিয়াছে, এখনই আবার আসিবে। এবার সকলে একত্রে হইয়া আবদুল ওহাবকে আক্রমণ করিতে হইবে। যাহার যে অস্ত্র আয়ত্ত আছে, সে সেই অস্ত্র আবদুল ওহাবের প্রতি নিক্ষেপ করিবে।

রণেক্ষেত্র একেবারে একযোগে বহু সংখ্যক সৈন্য মণ্ডলাকারে চতুর্দিক ঘিরিয়া একেশ্বর আবদুল ওহাবের প্রতি অস্ত্র বর্ষণ করিতে লাগিল। বীরবর আবদুল ওহাব শত্রুবেষ্টিত হইয়া দুই হস্তে অসি চালনা করিতে লাগিলেন। এজিদের সৈন্যের অন্ত নাই; কত মারিবেন! শেষে শত্রুপক্ষের অস্ত্রাঘাতে আবদুল ওহাবের মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া বহুদূরে বিনিক্ষিপ্ত হইল! সেই ছিন্ন মস্তক আবদুল ওহাবের মাতার সম্মুখে গিয়া পড়িল। বীরজননী পুত্রশির ক্রোড়ে লইয়া ত্রস্তে শিবিরে আসিয়া নির্জনকে হোসেনের সম্মুখে রাখিয়া দিলেন। এই অবসরে আবদুল ওহাবের শিক্ষিত অশ্ব শিরশূন্য দেহ লইয়া অতিবেগে শিবিরের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। শিরশূন্য দেহ অশ্বপৃষ্ঠ হইতে সকলের সম্মুখে মৃত্তিকায় পড়িয়া গেল। আবদুল ওহাবের মাতা শোণিতাক্ত হস্ত উত্তোলন করিয়া ঈশ্বরসমীপে প্রার্থনা করিলেন এবং আবদুল ওহাবের উদ্দেশে আশীর্বাদ করিলেন যে, “আবদুল ওহাব! তুমি ঈশ্বর-কৃপায় স্বর্গীয় সুখভোগে সুখী হও, হোসেনের বিপদ সময়ে প্রাণ দিয়া সাহায্য করিলে। প্রভু মোহাম্মদের বংশধরগণের পিপাসাশান্তিহেতু কাফেরের হস্তে জীবন বিসর্জন করিলে, তোমার শত শত আশীর্বাদ! তুমি যে জননীর গর্ভে জন্মিয়াছিলে, তাহারও সার্থক জীবন। তোমার মস্তক দেহ হইতে কে বিচ্ছিন্ন করিল?” আবদুল ওহাবের মাতা আবদুল ওহাবের মস্তক লইয়া পতিত দেহে সংলগ্ন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “আবদুল ওহাব! বৎস! প্রাণাধিক! অশ্ব সজ্জিত আছে, তোমার হাতের অস্ত্র হাতেই রহিয়াছে, বিধর্মী রক্তে অস্ত্র রঞ্জিত করিয়াছ, তবে আর ধুলায় পড়িয়া কেন? বাছা!-দুঃখিনীর জীবন সর্বস্ব! উঠিয়া অশ্বে আরোহণ কর। প্রাণাধিক! -এইবার যুদ্ধক্ষেত্র হইতে ফিরিয়া আসিলে আর আমি তোমাকে যুদ্ধে পাঠাইব না। ঐ দেখ তোমার অর্ধাঙ্গরূপিণী বনিতা তোমার যুদ্ধবিজয় সংবাদ শুনিবার জন্য সতৃষ্ণ শ্রবণে সতৃষ্ণ নয়নে অপেক্ষা করিতেছে।”

আবদুল ওহাবের বিয়োগে হোসেন কাঁদিলেন। হোসেনের পরিজনবর্গ ডাক ফুকারিয়া কাঁদিলেন। আবদুল ওহাবের মাতা অশ্রুনয়নে রোষভরে বলিতে লাগিলেন, “আবদুল ওহাব! এত ডাকিলাম, উঠিলে না? তোমার মায়ের কথা আর শুনিলে না?” শোকাবেগে এই কথা বলিয়া বৃদ্ধা পুনরায় পুত্রমস্তক বক্ষে ধারণ করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “আমার পুত্রহন্তা কে? আবদুল ওহাব কাহার হস্তে জীবন বিসর্জন করিল? কে আমার আবদুল ওহাবের মস্তক আমার ক্রোড়ে আনিয়া নিক্ষেপ করিল? দেখি, দেখি, দেখিব দেখিব!!” বলিয়া আবদুল ওহাব-জননী তখনি ত্বরিত পদে আবদুল ওহাবের অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। হোসেন অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া নিষেধ করিলেন, কিছুই শুনিলেন না। -পুত্রমস্তক কোলে করিয়াই অশ্বপৃষ্ঠে যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “কোন্ কাফের, কোন্ পাপাত্মা, কোন্ শৃগাল আমার পুত্রের মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়াছে? ঈশ্বরের দোহাই, এই যুদ্ধক্ষেত্রে একবার আসিয়া সেই পাপাত্মা, সেই পিশাচ, সেই কাফের সম্মুখে দেখা দিক!”

ঈশ্বরের দোহাই শুনিয়া আবদুল ওহাব-হন্তা যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়া দর্পসহকারে বলিতে লাগিল, “আমারই এই শাণিত অস্ত্রে আবদুল ওহাবের মস্তক সেই পাপদেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে।” আর কোন কথা হইল না। আবদুল ওহাব-জননী পুত্রঘাতককে দেখিয়া সক্রোধে আবদুল ওহাবের মস্তক এমন জোরে তাহার মস্তক লক্ষ্য করিয়া মারিলেন যে, ঐ আঘাতেই কাফেরের মস্তক ভগ্ন হইয়া মজ্জা নির্গত হইতে লাগিল। তখনই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি।

এই ঘটনা দেখিয়া ওমর মহারোষে আবদুল ওহাবের জননীর চতুর্দিকে সৈন্য বেষ্টন করিলেন। বৃদ্ধা বলিতে লাগিলেন, “বৎসগণ! তোমাদের মঙ্গল হউক! আমার জীবনে মায়া নাই। পুত্রশোক নিবারণ করিবার জন্য এই বৃদ্ধবয়সে যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়াছি। তোমরা আমাকে নিপাত কর। যে পথে আমার আবদুল ওহাব গিয়াছে, আমিও সেই পথে যাই। কিন্তু আকাশে যদি কোন বিচারকর্তা থাকেন, তিনি তোমাদের বিচার করিবেন।” অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আবদুল ওহাব-জননী শত্রুহস্তে প্রাণত্যাগ করিয়া স্বর্গবাসিনী হইলেন।

আবদুল ওহাবের মাতা প্রাণত্যাগ করিতে গাজী রহমান হোসেনের পদচুম্বন করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইলেন। তিনিও বহুসংখ্যক বিধর্মীকে জাহান্নমে পাঠাইয়া শত্রুহস্তে শহীদ হইলেন। -ক্রমে জাফর প্রভৃতি প্রধান প্রধান বীরগণ হোসেনের সাহায্য জন্য শত্রুসম্মুখীন হইয়া যুদ্ধ করিলেন, কিন্তু কেহই জয়লাভে কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। প্রায় দেড় লক্ষ বিপক্ষসৈন্য বিনাশ করিয়া মদিনার প্রধান প্রধান যোদ্ধামাত্রেই শত্রুহস্তে আত্মসমর্পণ করিয়া স্বর্গধামে মহাপ্রস্থিত হইলেন।

বিষাদ সিন্ধু – মীর মশাররফ হোসেন মহরম পর্ব ২৫ প্রবাহ

সূর্যদেব যতই ঊর্ধ্বে উঠিতেছেন, তাপাংশ ততই বৃদ্ধি হইতেছে। হোসেনের পরিজনেরা বিন্দুমাত্র জলের জন্য লালায়িত হইতেছে, শত শত বীরপুরুষ শত্রুহস্তে প্রাণত্যাগ করিতেছে। ভ্রাতা, পুত্র, স্বামীর শোণিতাক্ত কলেবর দেখিয়া কামিনীরা সময়ে সময়ে পিপাসায় কাতর হইতেছেন, চক্ষুতে জলের নামমাত্রও নাই, সে যেন এক প্রকার বিকৃত ভাব, কাঁদিবারও বেশি শক্তি নাই। হোসেন চতুর্দিক চাহিয়া দেখিলেন, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে আর কেহই নাই। রণসজ্জায় সজ্জিত হইয়া জয়লাভের জন্য শত্রুসম্মুখীন হইতে আদেশ অপেক্ষায় তাঁহার সম্মুখে আর কেহই আসিতেছেন না। হোসেন এক দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “হায়! একমাত্র বারি প্রত্যাশায় এত আত্মীয় বন্ধুবান্ধব হারাইলাম, তথাচ পরিজনগণের পিপাসা নিবারণ করিতে পারিলাম না। কারবালা ভূমিতে রক্তস্রোত বহিতেছে, তথাচ স্রোতস্বতী ফোরাত শত্রুহস্ত হইতে উদ্ধার করিতে পারিলাম না। এক্ষণে আর বাঁচিবার ভরসা নাই, আশাও নাই, আকাঙ্খাও নাই।”

হাসানপুত্র কাসেম পিতৃব্যের এই কথা শুনিয়া সুসজ্জিত বেশে সম্মুখে করজোড়ে দণ্ডায়মান হইয়া বিনীতভাবে বলিতে লাগিলেন, “তাত! কাসেম এখনো জীবিত আছে। আপনার আজ্ঞাবহ চিরদাস আপনার সম্মুখে দণ্ডায়মান আছে। অনুমতি করুন, শত্রুকুল নির্মূল করি।”

হোসেন বলিলেন, “কাসেম! তুমি পিতৃহীন; তোমার মাতার তুমিই একমাত্র সন্তান; তোমায় এই ভয়ানক শত্রুদল মধ্যে কোন্ প্রাণে পাঠাইব?”

কাসেম বলিল, “ভয়ানক!-আপনি কাহাকে ভয়ানক শত্রু জ্ঞান করেন? পথের ক্ষুদ্র মক্ষিকা, পথের ক্ষুদ্র পিপীলিকাকে আমি যেমন ক্ষুদ্র জ্ঞান করি, আপনার অনুমতি পাইলে এজিদের ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সৈন্যধ্যগণকেও সেইরূপ তৃণজ্ঞান করিতে পারি। কাসেম যদি বিপক্ষ ভয়ে ভয়ার্তচিত্ত হয়, হাসানের নাম ডুবিবে, আপনারও নাম ডুবিবে। অনুমতি করুন, একা আমি সশস্ত্র হইয়া সহস্র সহস্র লক্ষ লক্ষ রিপু বিনাশ সমর্থ।”

হোসেন বলিলেন, “প্রাণাধিক! আমার বংশে তুমি সকলের প্রধান, তুমি ইমাম বংশের বহুমূল্য রত্ন, তুমি পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র, তুমি সৈয়দ বংশের অমূল্য নিধি। তুমি তোমার মাতার একমাত্র সন্তান, তাঁহার সম্মুখে থাকিয়া তাঁহাকে এবং সমুদয় পরিজনকে সান্ত্বনা কর। আমি নিজেই যুদ্ধ করিয়া ফোরাতকূল উদ্ধার করিতেছি।”

কাসেম বলিলেন, “আপনি যাহাই বলুন, কাসেমের প্রাণ দেহে থাকিতে আপনাকে অস্ত্র ধারণ করিতে হইবে না। কাসেম এজিদের সৈন্য দেখিয়া কখনোই ভীত হইবে না। যদি ফোরাতকূল উদ্ধার করিতে না পারি, তবে ফোরাতনদী আজ লোহিতবর্ণে রঞ্জিত হইয়া এজিদের সৈন্য-শোণিতে যোগ দিয়া মহাসমুদ্রে প্রবাহিত হইবে।”

হোসেন বলিলেন, “বৎস! আমার মুখে এ-কথার উত্তর নাই। তোমার মাতার আদেশ লইয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই কর।”

হাসনেবানুর পদধূলি গ্রহণ করিয়া মহাবীর কাসেম যুদ্ধযাত্রা প্রার্থনা জানাইলে তিনি কাসেমের মস্তক চুম্বন করিয়া আশীর্বাচন প্রয়োগপূর্বক বলিলেন, “যাও বাছা! যুদ্ধে যাও! তোমার পিতৃঋণ পরিশোধ কর। পিতৃশত্রু এজিদের সৈন্যগণের মস্তক চূর্ণ কর, যুদ্ধে জয়ী হইয়া ফোরাতকূল উদ্ধার কর, তোমার পিতৃবাক্য রক্ষা কর। তোমার আর আর ভ্রাতা-ভগ্নীগণ তোমার মুখাপেক্ষা করিয়া রহিল। যাও বাপ! তোমায় আজ ঈশ্বরের পদতলে সমর্পণ করিলাম।”

হাসনেবানুর নিকট হইতে বিদায় হইয়া পিতৃব্যের পদচুম্বনপূর্বক কাসেম অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিবেন, এমন সময়ে হোসেন বলিলেন, “কাসেম! একটু বিলম্ব কর।”

অনুজ্ঞা শ্রবণমাত্র অশ্ববল্গা ছাড়িয়া কাসেম তৎক্ষণাৎ পিতৃব্যসম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন। হোসেন বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! তোমার পিতার নিকট আমি এক প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ আছি, আমাকে সেই প্রতিজ্ঞা হইতে উদ্ধার করিয়া যুদ্ধে গমন কর। যুদ্ধে যাইতে আমার আর কোন আপত্তি নাই। তোমার পিতা প্রাণবিয়োগের কিছু পূর্বে আমাকে করারে আবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, আমার কন্যা সখিনার সহিত তোমার বিবাহ দিব। তুমি সখিনাকে বিবাহ না করিয়া যুদ্ধে যাইতে পারিবে না। তোমার পিতার আজ্ঞা প্রতিপালন, আমাকেও প্রতিজ্ঞা হইতে রক্ষা কর, উভয়ই তোমার সমতুল্য কার্য।”

কাসেম মহা বিপদে পড়িলেন। এতাদৃশ মহাবিপদসময়ে বিবাহ করিতে হইবে, ইহা ভাবিয়াই অস্থিরচিত্ত। কী করেন কোন উপায় না করিয়া মাতার নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত বলিলেন।

হাসনেবানু বলিলেন, “কাসেম! আমিও জানি, আমার সম্মুখে তোমার পিতা তোমার পিতৃব্যের নিকট এই বিবাহের প্রস্তাব করিয়া তাঁহাকে করারে আবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। শোক তাপ এবং উপস্থিত বিপদে আমি সমুদয় ভুলিয়া গিয়াছিলাম। ঈশ্বরানুগ্রহে তোমার পিতৃব্যের স্মরণ ছিল বলিয়াই তোমার পিতার উপদেশ প্রতিপালিত হইবে বোধ হইতেছে। ইহাতে আর কোন আপত্তি উত্থাপন করিয়ো না। এখনই বিবাহ হউক। প্রাণাধিক, এই বিষাদ-সমুদ্র মধ্যে ক্ষণকালের জন্য একবার আনন্দস্রোত বহিয়া যাউক্।”

কাসেম বলিলেন, “জননী! পিতা মৃত্যুকালে আমাকে একখানি কবচ দিয়া বলিয়া গিয়াছেন যে, যে সময় তুমি কোন বিপদে পড়িবে, নিজ বুদ্ধির দ্বারা যখন কিছুই উপায় স্থির করিতে না পারিবে, সেই সময় এই কবচের অপর পৃষ্ঠ দেখিয়া তদুপদেশমত কার্য করিয়ো। আমার দক্ষিণহস্তে যে কবচ দেখিতেছেন, ইহাই সেই কবচ। আপনি যদি অনুমতি করেন, তবে আজ এই মহাঘোর বিপদসময়ে কবচের অপর পৃষ্ঠ পাঠ করিয়া দেখি কি লেখা আছে!”

হাসনেবানু বলিলেন, “এখনই দেখ! তোমার আজিকার বিপদের ন্যায় আর কোন বিপদই হইবে না। কবচের অপর পৃষ্ঠ দেখিবার উপযুক্ত সময়ই এই।” এই কথা বলিয়াই হাসনেবানু কাসেমের হস্ত হইতে কবচ খুলিয়া কাসেমের হস্তে দিলেন। কাসেম সম্মানের সহিত কবচ চুম্বন করিয়া অপর পৃষ্ঠ দেখিয়াই বলিলেন, “মা! আমার আর কোন আপত্তি নাই। এই দেখুন, কবচে কি লেখা আছে।”-পরিজনেরা সকলেই দেখিলেন, কবচে লেখা আছে-“এখনই সখিনাকে বিবাহ কর।” কাসেম বলিলেন, “আর আমার কোন আপত্তি নাই; এই বেশেই বিবাহ করিয়া পিতার আজ্ঞা পালন ও পিতৃব্যের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিব।”

প্রিয় পাঠকগণ! ঈশ্বরানুগ্রহে লেখনী-সহায়ে আপনাদের সহিত আমি অনেক দূর আসিয়াছি। কোন দিন ভাবি নাই, একটু চিন্তাও করি নাই, লেখনীর অবিশ্রান্ত গতি ক্রমেই আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে বিষাদ-সিন্ধুর পঞ্চবিংশ প্রবাহ পর্যন্ত আসিয়াছি। আজ কাসেমের বিবাহ-প্রবাহ মহাবিপদে পড়িলাম। কি লিখি কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না।

হাসনেবানু বলিয়াছেন, ‘বিষাদ-সমুদ্রে আনন্দস্রোত!’ এমন কঠিন বিষয় বর্ণনা করিতে মস্তক ঘুরিতেছে, লেখনী অসাড় হইতেছে, চিন্তার গতিরোধ হইতেছে, কল্পনাশক্তি শিথিল হইতেছে। যে শিবিরে স্ত্রীপুরুষেরা, বালকবালিকারা দিবা রাত্রি মাথা ফাটাইয়া ক্রন্দন করিতেছে, পুত্রমিত্রশোকে জগৎসংসার অন্ধকার দেখিতেছে, প্রাণপতির চিরবিরহে সতী নারীর প্রাণ ফাটিয়া যাইতেছে, ভ্রাতার বিয়োগযন্ত্রণায় অধীর হইয়া প্রিয় ভ্রাতা বক্ষ বিদারণ করিতেছে, শোকে তাপে স্ত্রীপুরুষ একত্রে দিবানিশি হায় হায় রবে কাঁদিতেছে, জগৎকেও কাঁদাইতেছে; আবার মুহূর্ত পরেই পিপাসা, সেই পিপাসারও শান্তি হইল না;-সেই শিবিরেই আজ বিবাহ! সেই পরিজন মধ্যেই এখন বিবাহ উৎসব।-বিষাদ-সিন্ধুতে হাসিবার কোন কথা নাই, রহস্যের নামমাত্র নাই, আমোদ-আহ্‌লাদের বিন্দুবিসর্গ সম্পর্কও নাই, আদ্যন্ত কেবল বিষাদ, ছত্রে ছত্রে বিষাদ, বিষাদেই আরম্ভ এবং বিষাদেই সম্পূর্ণ। কাসেমের ঘটনা বড় ভয়ানক। পূর্বেই বলিয়াছি যে, মহাবীর কাসেমের ঘটনা বিষাদ-সিন্ধুর একটি প্রধান তরঙ্গ।

কাহার মুখে হাসি নাই, কাহারো মুখে সন্তোষের চিহ্ন নাই। বিবাহ, অথচ বিষাদ! পুরবাসিগণ সখিনাকে ঘিরিয়া বসিলেন। রণবাদ্য তখন সাদীয়ানা বাদ্যের কার্য করিতে লাগিল। অঙ্গরাগাদি সুগন্ধি দ্রব্যের কথা কাহারো স্মরণ হইল না;-কেবল কণ্ঠবিনির্গত নেত্রজলেই সখিনার অঙ্গ ধৌত করিয়া পুরবাসিনীরা পরিষ্কৃত বসনে সখিনাকে সজ্জিত করিলেন। কেশগুচ্ছ পরিপাটী করিয়া বাঁধিয়া দিলেন, সভ্য প্রদেশ প্রচলিত বিবাহের চিহ্ন স্বরূপ দুই একখানি অলঙ্কার সখিনার অঙ্গে ধারণ করাইলেন। সখিনা পূর্ণবয়স্কা, সকলই বুঝিতেছেন। কাসেম অপরিচিত নহে। প্রণয়, ভালবাসা উভয়েরই রহিয়াছে। ভ্রাতাভগ্নী মধ্যে যেরূপ বিশুদ্ধ ও পবিত্র প্রণয় হইয়া থাকে, তাহা কাসেম-সখিনার বাল্যকাল হইতেই রহিয়াছে। কাহার স্বভাব কাহারো অজানা নাই, বাল্যকাল হইতেই এই উপস্থিত যৌবনকাল পর্যন্ত একত্র ক্রীড়া, একত্রে ভ্রমণ, একত্র বাসনিবন্ধন উভয়েরই মনে সবিশেষ সরল প্রণয় জন্মিয়াছে। উভয়েই এক পরিবার, এক বংশসম্ভূত, উভয়ের পিতা পরস্পর সহোদর ভ্রাতা, সুতরাং লজ্জা, মান, অভিমান অপর স্বামী-স্ত্রীতে যেরূপ হইবার সম্ভাবনা, তাহা উহাদের নাই। লগ্ন সুস্থির হইল। ওদিকে এজিদের সৈন্য মধ্যে ঘোর রবে যুদ্ধবাজনা বাজিতে লাগিল। ফোরাত-নদীর কূল উদ্ধার করিতে আর কোন বীরপুরুষই হোসেনের পক্ষ হইতে আসিতেছে না দেখিয়া আজিকার যুদ্ধে জয়সম্ভব বিবেচনায় তুমুল শব্দে বাজনা বাজিতে লাগিল। সেই শব্দে ফোরাতকূল হইতে কারবালার অন্তসীমা পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। হোসেনের শিবিরে পতিপুত্রশোকাতুরা অবলাগণের কাতরনিনাদে সপ্ততল আকাশ ভেদ করিতে লাগিল। সেই কাতরধ্বনি ঈশ্বরের সিংহাসন পর্যন্ত যাইতে লাগিল। হোসেন বাধ্য হইয়া এই নিদারুণ দুঃখের সময় কাসেমের হস্তে প্রাণাধিকা দুহিতা সখিনাকে সমর্পণ করিলেন। বিধিমত বিবাহ কার্য সম্পন্ন হইল। শুভ কার্যের পর আনন্দাশ্রু অনেকের চক্ষে দেখা যায়, কিন্তু হোসেনের শিবিরস্থ পরিজনগণের চক্ষে কোন প্রকার অশ্রুই দেখা যায় নাই। কিন্তু কাসেমের বিবাহ বিষাদ-সিন্ধুর সর্বাপেক্ষা প্রধান তরঙ্গ। সেই ভীষণ তরঙ্গে সকলেরই অন্তর ভাসিয়া যাইতেছিল। বরকন্যা উভয়েই সমবয়স্ক। স্বামী-স্ত্রীতে দুই দণ্ড নির্জনে কথাবার্তা কহিতেও আর সময় হইল না। বিবাহকার্য সম্পন্ন করিয়াই গুরুজনগণের চরণ বন্দনা করিয়া, মহাবীর কাসেম অসিহস্তে দণ্ডায়মান হইয়া বলিলেন, “এখন কাসেম শত্রু-নিপাতে চলিল।” হাসেনবানু কাসেমের মুখে শত শত চুম্বন দিয়া আর আর সকলের সহিত দুই হস্ত তুলিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, “হে করুণাময় জগদীশ্বর! কাসেমকে রক্ষা করিয়ো। আজ কাসেম বিবাহ-সজ্জা, বাসরসজ্জা পরিত্যাগ করিয়া চিরশত্রুসৈন্যসম্মুখে যুদ্ধসজ্জায় চলিল। পরমেশ্বর! তুমিই রক্ষাকর্তা; তুমিই রণক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষক হইয়া পিতৃহীন কাসেমকে এ বিপদে রক্ষা কর!”

কাসেম যাইতে অগ্রসর হইলেন; হাসনেবানু বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! একটু অপেক্ষা কর। আমার চিরমনসাধ আমি পূর্ণ করি। তোমাদের দুইজনকে একত্রে নির্জনে বসাইয়া আমি একটু দেখিয়া লই। উভয়কে একত্রে দেখিতে আমার নিতান্তই সাধ হইয়াছে।” এই বলিয়া সখিনা ও কাসেমকে বস্ত্রাবাস মধ্যে একত্র বসাইয়া বলিলেন, “কাসেম! তোমার স্ত্রীর নিকট হইতে বিদায় লও।” হাসনেবানু শিরে করাঘাত করিতে করিতে তথা হইতে বাহির হইয়া কাসেমের গম্য পথে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

কাসেম সখিনার হস্ত ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। কাহারো মুখে কোন কথা নাই। কেবল সখিনার মুখপানে চাহিয়া কাসেম স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। অনেকক্ষণ পরে কাসেম বলিলেন, “সখিনা! প্রণয়-পরিচয়ের ভিখারী আমরা নহি; এক্ষণে নূতন সম্বন্ধে পূর্ব প্রণয় নূতন ভাবে আজীবন কাল পর্যন্ত সমভাবে রক্ষার জন্যই বিধাতা এই নূতন সম্বন্ধ সৃষ্টি করাইলেন। তুমি বীরকন্যা-বীরজায়া; এ সময় তোমার মৌনী হইয়া থাকা আমার অধিকতর দুঃখের কারণ। পবিত্র প্রণয় তো পূর্ব হইতেই ছিল, এক্ষণে তাহার উপর পরিণয়সূত্রে বন্ধন হইল, আর আশা কি? অস্থায়ী জগতে আর কি সুখ আছে বল তো?”

সখিনা বলিলেন, “কাসেম! তুমি আমাকে প্রবোধ দিতে পারিবে না। তবে এইমাত্র বলি, যেখানে শত্রুর নাম নাই, এজিদের ভয় নাই, কারবালা প্রান্তরও নাই, ফোরাতজলের পিপাসাও যেখানে নাই, সেই স্থানে যেন আমি তোমাকে পাই, আমার প্রার্থনা। প্রণয় ছিল, পরিণয় হইল, আর কী আশা?”-কাসেমের হস্ত ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে সখিনা পুনঃপুনঃ বলিলেন, “কাসেম! প্রণয় ছিল, পরিণয় হইল, আর কী আশা?”

প্রিয়তমা ভার্যাকে অতি স্নেহসহকারে আলিঙ্গন করিয়া মুখের নিকটে মুখ রাখিয়া কাসেম বলিতে লাগিলেন, “আমি যুদ্ধযাত্রী, শত্রু-শোণিত-পিপাসু, আজ সপ্তদিবস একবিন্দুমাত্র-জলও গ্রহণ করি নাই, কিন্তু এখন আমার ক্ষুধা পিপাসা কিছুই নাই। তবে যে পিপাসায় কাতর হইয়া চলিলাম, বোধ হয় এ জীবনে তাহার তৃপ্তি নাই, হইবেও না। তুমি কাঁদিয়ো না। মনের আনন্দে আমাকে বিদায় কর। একবার কান পাতিয়া শুন দেখি, শত্রুদলের রণবাদ্য কেমন ঘোর রবে বাদিত হইতেছে। তোমার স্বামী মহাবীর হাসানের পুত্র, হজরত আলীর পৌত্র কাসেম তোমার স্বামী, এই কাসেম কি ঐ বাদ্য শুনিয়া নববিবাহিতা স্ত্রীর মুখপানে চাহিয়া বসিয়া থাকিতে পারে? সখিনা! আমি এক্ষণে বিদায় হই।”

সখিনা বলিতে লাগিলেন, “তোমাকে ঈশ্বরে সঁপিলাম। যাও কাসেম!-যুদ্ধে যাও! প্রথম মিলন রজনীর সমাগম আশয়ে অস্তমিত সূর্যের মলিন ভাব দেখিয়া প্রফুল্ল হওয়া সখিনায় ভাগ্যে নাই। যাও কাসেম! যুদ্ধে যাও!”

কাসেম আর সখিনার মুখের দিকে তাকাইতে পারিলেন না। আয়তলোচনে বিষাদিত ভাব চক্ষে দেখিতে আর ক্ষমতা হইল না। কোমলপ্রাণা সখিনার সুকোমল হস্ত ধরিয়া বারংবার চুম্বন করিয়া বিদায় হইলেন। সখিনার আশা-ভরসা যে মুহূর্তে অঙ্কুরিত হইল সেই মুহূর্তেই শুকাইয়া গেল। কাসেম দ্রুতপদে শিবির হইতে বাহির হইয়া এক লম্ফে অশ্বে আরোহণপূর্বক সজোরে অশ্বপৃষ্ঠে কশাঘাত করিলেন। অশ্ব বায়ুবেগে দৌড়িয়া চলিল।-সখিনা চমকিয়া উঠিলেন-হৃদয়ে বেদনা লাগিল।

কাসেম সমরক্ষেত্রে যাইয়া বলিতে লাগিলেন, “যুদ্ধ সাধ যদি কাহারো থাকে, যৌবনে যদি কাহারো অমূল্য জীবন বিড়ম্বনা জ্ঞান হইয়া থাকে, তবে কাসেমের সম্মুখে অগ্রসর হও।”

সেনাপতি ওমর পূর্ব হইতেই কাসেমকে বিশেষরূপে জানিতেন। কাসেমের তরবারি সম্মুখে দাঁড়াইতে পারে এমন বলবান বীর তাঁহার সৈন্যমধ্যে এক বর্জক ভিন্ন আর কেহই ছিল না। বর্জককে সম্বোধন করিয়া তিনি বলিলেন, “ভাই বর্জক! হাসানপুত্র কাসেমের সহিত যুদ্ধ করিতে আমাদের সৈন্যদল মধ্যে তুমি ভিন্ন আর কেহই নাই। ভাই! কাসেমের বলবীর্য, কাসেমের বলবিক্রম, কাসেমের বীরত্বপ্রতাপ সকলই আমার জানা আছে! তাহার সম্মুখে যাহাকে পাঠাইব, সে আর শিবিরে ফিরিয়া আসিবে না। আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, কোন ক্রমেই কাসেমের হস্ত হইতে সে আর রক্ষা পাইবে না। নিরর্থক সৈন্যক্ষয় করা যুক্তিসিদ্ধ নহে। আমার বিবেচনায় তুমিই কাসেম অপেক্ষা মহাবীর। তুমিই কাসেমের জীবনপ্রদীপ নির্বাণ করিয়া আইস।”

বর্জক বলিলেন, “বড় ঘৃণার কথা! শামদেশে মহা মহা বীরের সম্মুখে আমি দাঁড়াইয়াছি, মিশরের প্রধান প্রধান মহারথীরা বর্জকের বীরত্ববীর্য অবগত আছে, আজ পর্যন্ত কেহই সম্মুখ যুদ্ধে অগ্রসর হইতে সাহস করে নাই; এখন কি-না, এই সামান্য বালকের সহিত ওমর আমাকে যুদ্ধ করিতে আদেশ করেন, বড়ই ঘৃণার কথা! হোসেনের সম্মুখে সমরক্ষেত্রে দণ্ডায়মান হইলে বরং কথঞ্চিৎ শোভা পায়; আর এ কি-না, কাসেমের সহিত যুদ্ধ। বালকের সঙ্গে সংগ্রাম! কখনোই না, কখনোই না! কখনোই আমি কাসেমের সহিত যুদ্ধ করিতে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা দিব না।”

ওমর বলিলেন, “তুমি কাসেমকে জান না। তাহাকে অবহেলা করিয়ো না। তাহার তুল্য মহাবীর মদিনায় আর নাই। ভাই বর্জক! তুই ভিন্ন কাসেমের অস্ত্রাঘাত সহ্য করে এমন বীর আমাদের দলে আর কে আছে?”

হাসিতে হাসিতে বর্জক বলিলেন, “কাহাকে তুমি কি কথা বল! ক্ষুদ্র কীট, ক্ষুদ্র পতঙ্গ কাসেম; তাহার মাথা কাটিয়া আমি কি বিশ্ববিজয়ী বীরহস্ত কলঙ্কিত করিব? কখনোই না, কখনোই না! সিংহের সহিত সিংহের যুদ্ধ হয়, শৃগালের সহিত সিংহ কোন কালে যুদ্ধ করে ওমর? সিংহ-শৃগাল! তুলনা করিলে তাহাও নহে। বর্জক সিংহ, কাসেম একটা পতঙ্গ মাত্র। কী বিবেচনায় ওমর! কী বিবেচনায় তুমি সেই তুচ্ছ পতঙ্গ কাসেমের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করিতে পাঠাও? আচ্ছা, তোমার যদি বিশ্বাস হইয়া থাকে কাসেম মহাবীর, আচ্ছা, আমি যাইব না। আমার অমিততেজা চারি পুত্র বর্তমান, তাহারা রণক্ষেত্রে গমন করুক, এখনই কাসেমের মাথা কাটিয়া আনিবে।”

তাহাই, ওমরের তথাস্তু! আদেশমত বর্জকের প্রথম পুত্র যুদ্ধে গমন করিল। যুদ্ধক্ষেত্রে বর্শা চালাইতে আরম্ভ করিল। বিপক্ষ পরাস্ত হইল না। অবশেষে অসিযুদ্ধ! সম্মুখে কাসেম। উভয়ে মুখোমুখি হইয়া দণ্ডায়মান আছেন। বর্জকের পুত্র অস্ত্র প্রহার করিতেছেন কাসেম হাস্য করিতেছেন। বর্জকের পুত্রের তরবারিসংযুক্ত বহুমূল্য মণিমুক্তা দেখিয়া সহাস্য আস্যে কাসেম কহিলেন, “কী চমৎকার শোভা! মণিময় অস্ত্র প্রদর্শন করিলেই যদি মহারথী হয়, তবে বল দেখি, মণিমস্তক কালসর্প কেন মহারথী না হইবে?”

কথা না শুনিয়াই বর্জকের পুত্র কাসেমের মস্তক লক্ষ্য করিয়া অস্ত্র নিক্ষেপ করিলেন। অস্ত্র ব্যর্থ হইয়া গেল। পুনর্বার আঘাত। কাসেমের চর্ম বিদ্ধ হইয়া বাম হস্ত হইতে শোণিতের ধারা ছুটিল। ত্রস্তহস্তে শিরস্ত্রাণ ছিন্ন করিয়া ক্ষতস্থান বন্ধনপূর্বক ক্ষতযোদ্ধা পুনর্বার অস্ত্র ধারণ করিলেন। বর্জকের পুত্র বর্শা ধারণ করিয়া বলিলেন, “কাসেম! তলোয়ার রাখ। তোমার বামহস্তে আঘাত লাগিয়াছে। চর্ম ধারণে তুমি অক্ষম। অসিযুদ্ধেও তুমি এখন অক্ষম। বর্শা ধারণ কর, বর্শাযুদ্ধই এখন শ্রেয়ঃ।”

বক্তার কথা মুখে থাকিতে থাকিতে কাসেমের বর্শা প্রতিযোদ্ধার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া পৃষ্ঠ পার হইল। বর্জকের পুত্র শোণিতাক্ত শরীরে অশ্বপৃষ্ঠ হইতে ভূতলে পড়িয়া গেল। তাহার কটিবন্ধের মহামূল্য অসি সজোরে আকর্ষণ করিয়া কাসেম বলিলেন, “কাফের! মূল্যবান অস্ত্রের ব্যবহার দেখ।” এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই বর্জক-পুত্রের মস্তক যুদ্ধক্ষেত্রে বিলুণ্ঠিত হইল। কাসেম বলিতে লাগিলেন, “রে বিধর্মী কাফেরগণ! আর কারে রণক্ষেত্রে কাসেমের সম্মুখে পাঠাবি, পাঠা।”

পাঠাইবার বেশি অবসর হইল না। দেখিতে দেখিতে মহাবীর কাসেম বর্জকের অপর তিন পুত্রকে শীঘ্র শীঘ্র শমনসদনে পাঠাইলেন। পুত্র-শোকাতুর বর্জক সেনাপতির আদেশের অপেক্ষা না করিয়া ভীম-গর্জনে স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা দিলেন। বীরদর্পে বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! তুমি ধন্য! ক্ষণকাল অপো কর। তুমি আমার চারিটি পুত্র নিধন করিয়াছ, তাহাতে আমার কিছুমাত্র দুঃখ নাই। কাসেম! তুমি বালক। এত যুদ্ধ করিয়া অবশ্যই ক্লান্ত হইয়াছে। সপ্তাহকাল তোমার উদরে অন্ন নাই কণ্ঠে জলবিন্দু নাই, এ অবস্থায় তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করা কেবল বিড়ম্বনা মাত্র।”

কাসেম বলিলেন, “বর্জক! সে ভাবনা তোমার ভাবিতে হবে না। তুমি পুত্রশোকে যে প্রকার বিহ্বল হইয়াছ দেখিতেছে, তাহাতে তোমার পক্ষে এ সময় সংগ্রাম লিপ্ত হওয়াই বিড়ম্বনা।” বর্জক বলিলেন, “কাসেম! আমি তোমার কথা স্বীকার করি, পুত্র-শোকে অতি কঠিন হৃদয়ও বিহ্বল হয়; কিন্তু পুত্রহন্তার মস্তক লাভের আশা থাকিলে, এখনই পুত্রমস্তকের পরিশোধ হইবে, নিশ্চয় জানিতে পারিলে, বীরহৃদয়ে বিহ্বলতাই-বা কী? দুঃখই-বা কী? কাসেম! বল তো, তুমি ঐ তরবারিখানি কোথায় পাইলে? ও তরবারি আমার, আমি বহু যত্নে, বহুব্যয়ে মণিমুক্তা সংযোগে সুসজ্জিত করিয়াছি।”

কাসেম বলিলেন, “বেশ করিয়াছ!-তাহাতে দুঃখ কী? তোমার মণিমুক্তাসজ্জিত তরবারি দ্বারা তোমারই চারি পুত্র বিনাশ করিয়াছি। নিশ্চয় বলিতেছি, তুমিও এই মূল্যবান তরবারি আঘাত হইতে বঞ্চিত হইবে না। নিশ্চয় জানিয়ো, অন্য তরবারিতে, অন্যের হস্তে তোমার মস্তক বিচ্ছিন্ন হইবে না! আপেক্ষা করিয়ো না। তোমার এই মহামূল্য অসি তোমার জীবন বিনাশের নির্ধারিত অস্ত্র মনে করিয়ো।”

বর্জক মহাক্রোধে বর্শা ঘুরাইয়া বলিতে লাগিল, “কাসেম! তোমার বাক্চাতুরী এই মুহূর্তেই শেষ করিতেছি! তুমিও নিশ্চয় জানিয়ো, বর্জকের হস্ত হইতে আজ তোমার রক্ষা নাই।” এই বলিয়া সজোরে বর্শা আঘাত করিল। কাসেম বর্মদ্বারা বর্শাঘাত ফিরাইয়া বর্জকের বক্ষ লক্ষ্য করিয়া বর্শা উত্তোলন করিতেই বর্জক লঘুহস্ততা-প্রভাবে কাসেমকে পুনরায় বর্শাঘাত করিলেন। বীরবর-কাসেম বিশেষ চতুরতার সহিত বর্জকের বর্শা ফিরাইয়া আপন বর্শার দ্বারা বর্জককে আঘাত করিলেন। তরবারি ঘাত-প্রতিঘাতে উভয়ের বর্ম হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল। কাসেমকে ধন্যবাদ দিয়া বর্জক বলিতে লাগিল, “কাসেম্! আমি রুম, শাম, মিশর, আরব, আর-আর বহু দেশে বহু যোদ্ধার তরবারিযুদ্ধ দেখিয়াছি, কিন্তু তোমার ন্যায় তরবারিধারী বীর কুত্রাপি কখনোই আমার নয়নগোচর হয় নাই। ধন্য তোমার বাহুবল! তোমার শিক্ষাকৌশল! যাহা হউক, কাসেম! এই আমার শেষ আঘাত। হয় তোমার জীবন, না হয় আমার জীবন।” এই শেষ কথা বলিয়া বর্জক কাসেমের শির লক্ষ্য করিয়া তরবারি আঘাত করিলেন। কাসেম সে আঘাত তাচ্ছিল্যভাবে বর্মে উড়াইয়া দিয়া বর্জক সরিতে সরিতেই তাহার গ্রীবাদেশে অসি-প্রহার করিলেন। বীরবর কাসেমের আঘাত বর্জকের শির রণক্ষেত্রে গড়াইয়া পড়িল। এই ভয়াবহ ঘটনা দৃষ্টে এজিদের সৈন্যমধ্যে মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল।

বর্জকের নিপাত দর্শনে এজিদের সৈন্যমধ্যে কেহই আর সমরাঙ্গণে আসিতে সাহসী হইল না। কাসেম অনেকক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়া, বিপদিগকে দেখিতে না পাইয়া একেবারে ফোরাত-তীরে উপস্থিত হইলেন। নদী রক্ষকেরা কাসেমের অশ্বপদধ্বনিশ্রবণে মহাব্যতিব্যস্ত হইয়া মহাশঙ্কিত হইল। কাসেম কাহাকেও কিছু বলিলেন না। তরবারি, তীর, নেজা, বল্লম, যাহা দ্বারা যাহাকে মারিতে সুবিধা পাইলেন, তাহার দ্বারা তাহাকে ধরাশায়ী করিয়া ফোরাতকূল উদ্ধারের উপক্রম করিলেন। ওমর, সীমার ও আবদুল্লাহ্ প্রভৃতিরা দেখিল, নদীকূল-রীরা কাসেমের অস্ত্র-সম্মুখে কেহই টিকিতেছে না। ইহারা কয়েকজনে একত্র হইয়া সমরপ্রাঙ্গণের সমুদয় সৈন্যসহ কাসেমকে পশ্চাদ্দিক হইতে ঘিরিয়া শর নিক্ষেপ করিতে লাগিল। অনবরত তীর কাসেমের অঙ্গে আসিয়া বিদ্ধ হইতেছে; কাসেমের সে দিকে দৃকপাত নাই; কেবল ফোরাতকূল উদ্ধার করিবেন, এই আশয়েই সম্মুখস্থ শত্রুগণকে সংহার করিতেছেন। কাসেমের শ্বেতবর্ণ অশ্ব তীরাঘাতে রক্তধারায় লোহিতবর্ণ হইয়াছে! শোণিতধারা অশ্বপদ বহিয়া মৃত্তিকা রঞ্জিত করিতেছে। ক্রমেই কাসেম নিস্তেজ হইতেছেন;-শোণিত প্রবাহে চতুর্দিকেই অন্ধকার দেখিতেছেন। শেষে নিরুপায় হইয়া অশ্ববল্গা ছাড়িয়া দিলেন। শিক্ষিত অশ্ব কাসেমের শরীরের অবসন্নতা বুঝিতে পারিয়া দ্রুতপদে শিবির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, হাসনেবানু ও সখিনা, শিবির মধ্য হইতে অশ্বপদধ্বনি শুনিতে পাইয়া, বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, কাসেমের পরিহিত শুভ্রবসন লোহিতবর্ণে রঞ্জিত হইয়াছে, শোণিতধারা অশ্বপদ বহিয়া পড়িতেছে। কাসেম অশ্ব হইতে নামিয়া সখিনাকে বলিলেন, “সখিনা! দেখ তোমার স্বামীর সাহানা (লাল পোশাক।) পোশাক দেখ! আজ বিবাহ সময়ে উপযুক্ত পরিচ্ছদে তোমায় বিবাহ করি নাই, কাসেমের দেহবিনির্গত শোণিতধারা শুভ্রবসন লোহিতবর্ণে পরিণত হইয়া বিবাহবেশ সম্পূর্ণ করিয়াছে। এই বেশ তোমাকে দেখাইবার জন্যই বহুকষ্টে শত্রুদল ভেদ করিয়া এখানে আসিয়াছি। আইস, এই বেশে তোমাকে একবার আলিঙ্গন করিয়া প্রাণ শীতল করি। সখিনা! আইস, এই বেশেই আমার মানসের চিরপিপাসা নিবারণ করি।”

কাসেম এই কথা বলিয়াই সখিনাকে আলিঙ্গন করিবার নিমিত্ত হস্ত প্রসারণ করিলেন। সখিনাও অগ্রবর্তিনী হইয়া স্বামীকে আলিঙ্গন করিলেন। কাসেমের দেহ-বিনির্গত শোণিত-প্রবাহে সখিনার পরিহিত বস্ত্র রক্তবর্ণ হইল। কাসেম সখিনার গলদেশে বাহু বেষ্টন করিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন, নিজ বশে আর দাঁড়াইবার শক্তি নাই। শরাঘাতে সমুদয় অঙ্গ জর জর হইয়া সহস্র পথে শোণিতধারা শরীর বহিয়া মৃত্তিকায় পড়িতেছে। সজ্জিত মস্তক ক্রমশঃই সখিনার স্কন্ধদেশে নত হইয়া আসিতে লাগিল। সখিনার বিষাদিত বদন নিরীক্ষণ করা কাসেমের অসহ্য হইল বলিয়াই যেন চক্ষু দুটি নীলিমাবর্ণ ধারণ করিয়া ক্রমেই বন্ধ হইয়া আসিতে লাগিল। সে সময়ও কাসেম বলিলেন, “সখিনা! নব অনুরাগে পরিণয়সূত্রে তোমার প্রণয়-পুষ্পহার কাসেম আজ গলায় পরিয়াছিল; বিধাতা আজই সে হার ছিন্ন করিয়া ফেলিলেন। জগতে তোমাকে ছাড়িয়া যাইতেছি; দৈহিক সম্বন্ধগ্রন্থি ছিঁড়িয়া গেল, কিন্তু সখিনা! সে জন্য তুমি ভাবিয়ো না;-কেয়ামতে অবশ্যই দেখা হইবে। সখিনা! নিশ্চয় জানিয়ো ইহা আর কিছুই নহে, কেবল অগ্রপশ্চাৎ মাত্র। ঐ দেখ, পিতা আমার অমরপুরীর সুবাসিত শীতলজল-পরিপূরিত মণিময় সুরাহী হস্তে আমার পিপাসা শান্তির জন্য দাঁড়াইয়া আছেন। আমি চলিলাম।”

কাসেমের চক্ষু কেবারে বন্ধ হইল!-প্রাণবিহঙ্গ দেহপিঞ্জর হইতে অনন্ত আকাশে উড়িয়া হাসানের নিকট চলিয়া গেল। শূন্যদেহ সখিনার দেহযষ্টি হইতে স্খলিত হইয়া ধরাতলে পতিত হইল। পুরবাসীরা সকলেই কাসেমের মৃতদেহ স্পর্শ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন।

সখিনা স্বামীর মৃতদেহ অঙ্গে ধারণ করিয়া করুণস্বরে বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! একবার চাহিয়া দেখ, তোমার সখিনা এখনো সেই বিবাহ-বেশ পরিয়া রহিয়াছে! কেশগুচ্ছ যে ভাবে দেখিয়াছিলে, এখনো সেইভাবে রহিয়াছে। তাহার এক গাছিও স্থানভ্রষ্ট হয় নাই। লোহিতবসন পরিধান করিয়া বিবাহ হয় নাই; প্রাণেশ্বর! তাই আপন শরীরের রক্তভারে সেই বসন রঞ্জিত করিয়া দেখাইলে! আমি আর কী করিব? জীবিতেশ! জগতে সখিনা বাঁচিয়া থাকিতে তোমার দেহ-বিনির্গত শোণিতবিন্দু মৃত্তিকা-সংলগ্ন হইতে দিবে না!” এই বলিয়া কাসেমের দেহবিনির্গত শোণিতবিন্দু সখিনা সমুদয় অঙ্গে মাখিতে লাগিলেন। মাখিতে মাখিতে কহিতে লাগিলেন, “বিবাহ সময়ে এই হস্তদ্বয় মেহেদি দ্বারা সুরঞ্জিত হয় নাই,-একবার চাহিয়া দেখ!-কাসেম! একবার চাহিয়া দেখ! তোমার সখিনার হস্ত তোমারই রক্তধারে কেমন শোভিত হইয়াছে। জীবিতেশ্বর! তোমার এ পবিত্র রক্ত মাখিয়া সখিনা চিরজীবন এই বেশেই থাকিবে! যুদ্ধজয়ী হইয়া আজ বাসরশয্যায় শয়ন করিবে বলিয়াছিলে, সে সময় তো প্রায় আগত;-তবে ধূলিশয্যায় শয়ন কেন হৃদয়েশ?-বিধাতা, আজই সংসার-ধর্মের মুখ দেখাইলে, আজই সংসারী করিলে, আবার আজই সমস্ত সুখ মিটাইলে!-দিন এখনো রহিয়াছে। সে দিন অবসান না-হইতেই সখিনার এই দশা করিলে! যে সূর্য সখিনার বিবাহ দেখিল, সেই সূর্যই সখিনার বৈধব্য দশা দেখিয়া চলিল! সূর্যদেব! যাও, সখিনার দুর্দশা দেখিয়া যাও। সৃষ্টিকাল হইতে আজ পর্যন্ত প্রতিদিন তুমি কত ঘটনা, কত কার্য কত সুখ, কত দুঃখ দেখিয়াছ, কিন্তু দিনকর! এমন হরিষে বিষাদ কখনো কি দর্শন করিয়াছ? সখিনার তুল্য দুঃখিনী কখনো কি তোমার চক্ষে পড়িয়াছে? যাও সূর্যদেব! সখিনার সদ্যবৈধব্য দেখিয়া যাও।”

সখিনা এইরূপ নানাপ্রকার বিলাপ করিতে করিতে অস্থির হইয়া পড়িলেন। কাসেমের অবস্থা দর্শনে হোসেন একেবারে অচৈতন্য হইয়া পড়িয়াছিলেন, কিঞ্চিৎ পরে সংজ্ঞা পাইয়া বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! তুমি আমার কুলপ্রদীপ, তুমি আমার বংশের উজ্জ্বল মণি, তুমিই আমার মদিনার ভাবী রাজা,-আমি অভাবে তোমার শিরেই রাজমুকুট শোভা পাইত। বৎস! তোমার বীরত্বে,-তোমার অস্ত্র-প্রভাবে মদিনাবাসীরা সকলেই বিমুগ্ধ। আরবের মহা মহা যোদ্ধাগণ তোমার নিকট পরাস্ত; তুমি আজ কাহার ভয়ে রণক্ষেত্র হইতে ফিরিয়া আসিয়া, লোহিতবসনে নিস্পন্দভাবে ধরাশায়ী হইয়া রহিলে! প্রাণাধিক!-বীরেন্দ্র! ঐ শুন, শত্রুদল মহানন্দে রণবাদ্য বাজাইতেছে। তুমি সমরাঙ্গণ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছ বলিয়া তোমাকে তাহারা ধিক্কার দিতেছে। কাসেম, গাত্রোত্থান কর-তরবারি ধারণ কর। ঐ দেখ, তোমার প্রিয় অশ্ব ক্ষতবিক্ষত শরীরে, শোণিতাক্ত কলেবরে তোমাকে ধরাশায়ী দেখিয়া অবিশ্রান্ত অশ্রুবর্ষণ করিতেছে! শরাঘাতে তাহার শ্বেতকান্তি পরিবর্তিত হইয়া শোণিতধারায় লোহিতবর্ণ ধারণ করিয়াছে। তথাপি রণক্ষেত্রে যাইবার জন্য উৎসাহের সহিত তোমারই দিকে চাহিয়া রহিয়াছে, সম্মুখস্থ পদদ্বারা মৃত্তিকা উৎপ্তি করিতেছে। কাসেম! একবার চক্ষু মেলিয়া দেখ, তোমার প্রিয়তম অশ্বের অবস্থা একবার চাহিয়া দেখ! কাসেম! আজি আমি তোমার বিবাহ দিয়াছি। যাহার সঙ্গে কোন দিন কোন সম্বন্ধ ছিল না, পরিচয় ছিল না, প্রণয় ছিল না, এমন কোন কন্যা আনিয়া তোমাকে সমর্পণ করি নাই, আমার হৃদয়ের ধনকেই তোমার হস্তে দিয়াছি। তোমারই পিতৃ-আদেশে সখিনাকে তোমার হস্তে সমর্পণ করিয়াছি।”

হাসানকে উদ্দেশ করিয়া হোসেন অতি কাতরস্বরে বলিতে লাগিলেন, “ভ্রাতঃ! জগৎ পরিত্যাগের দিন ভাল উপদেশ দিয়া গিয়াছিলেন! যেদিন বিবাহ সেই দিনই সর্বনাশ! যদি ইহাই জানিয়াছিলে, যদি সখিনার অদৃষ্টলিপির মর্ম বুঝিতে পারিয়াছিলে, তবে কাসেমের সঙ্গে সখিনার বিবাহের উপদেশ কেন দিয়াছিলে ভাই! তুমি তো স্বর্গসুখে রহিয়াছ, এ সর্বনাশ একবার চক্ষে দেখিলে না!-এই অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে বলিয়াই কি অগ্রে চলিয়া গেলে? ভাই! মৃত্যুসময়ে তোমার যত্নের রত্ন, হৃদয়ের অমূল্য মণি কাসেমকে আমার হাতে হাতে দিয়া গিয়াছিলে, আমি এমনি হতভাগ্য যে, সেই অমূল্য নিধিটি রক্ষা করিতে পারিলাম না। আর কি বলিব! তোমার প্রাণাধিক পুত্র কাসেম একবিন্দু জলের প্রত্যাশায় শত্রুহস্তে প্রাণ হারাইল। কাসেম বিন্দুমাত্র জল পাইলে এজিদের সৈন্যের নাম মাত্র অবশিষ্ট থাকিত না, দেহসমষ্টি শোণিতপ্রবাহের সহিত ফোরাত প্রবাহে ভাসিয়া কোথায় চলিয়া যাইত, তাহার সন্ধানও মিলিত না। আর সহ্য হয় না। সখিনার মুখের দিকে আর চাহিতেই পারি না। কই আমার অস্ত্র শস্ত্র কোথায়? কাসেমের শোকাগ্নি আজ শত্রুশোণিতে পরিণত হউক। সখিনার বৈধব্যসূচক চিরশুভ্র-বসন শত্রুশোণিতে রঞ্জিত করিয়া চিরকাল সধবার চিহ্নে রাখিব!-কই আমার বর্ম কোথায়? কই আমার শিরস্ত্রাণ কোথায়? (জোরে উঠিয়া) কই আমার অশ্ব কোথায়? এখনি অন্তর জ্বালা নিবারণ করি!-শত্রুবধ করিয়া কাসেমের শোক ভুলিয়া যাই!” পাগলের মত এই সকল কথা বলিয়া হোসেন যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হইতে চলিলেন।

হোসেন পুত্র আলী আকবর করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “পিতঃ! এখনো আমরা চারি ভ্রাতা বর্তমান! যদিও শিশু, তথাপি মরণে ভয় করি না। আমরা বর্তমান থাকিতে, আপনি অস্ত্র ধারণ করিবেন? বাঁচিবার আশা তো একরূপ শেষ হইয়াছে; পিপাসায় আত্মীয় স্বজনের শোকাগ্নি-উত্তাপে জিহ্বা, কণ্ঠ, বক্ষ, উদর সকলই তো শুষ্ক হইয়াছে; এরূপ অবস্থায় আর কয়দিন বাঁচিব? নিশ্চয়ই মরিতে হইবে। বীরপুরুষের ন্যায় মরাই শ্রেয়ঃ। স্ত্রীলোকের ন্যায় কাঁদিয়া মরিব না।” এই কথা বলিয়া পিতৃচরণে প্রণাম করিয়া আলী আকবর অশ্বে আরোহণ করিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যাইয়া দ্বৈরথ যুদ্ধে কাহাকেও আহ্বান না করিয়া একেবারে ফোরাতকূল রক্ষকদিগের প্রতি অস্ত্রবর্ষণ করিতে লাগিলেন। রক্ষীরা ফোরাতকূল ছাড়িয়া পলাইতে আরম্ভ করিল। এজিদের সৈন্যে মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। আলী আকবর যেমন বলবান তেমনি রূপবান ছিলেন। তাঁহার সুদৃশ্য রূপলাবণ্যের প্রতি যাহার চক্ষু পড়িল, তাহার হস্ত আর আলী আকবরের প্রতি আঘাত করিতে উঠিল না! যে দেখিল, সেই আকবরের রূপে মোহিত হইয়া তৎপ্রতি অস্ত্রচালনায় বিরত হইল। অস্ত্রচালনা দূরে থাকুক, পিপাসায় আক্রান্ত, শীঘ্রই মৃত্যু হইবে, এই ভাবিয়াই অনেক বিধর্মী দুঃখ করিতে লাগিল! আলী আকবর বীরত্বের সহিত নদীকূলরীদিগকে তাড়াইয়া অশ্বপৃষ্ঠে থাকিয়াই ভাবিতেছেন, কি করি। সমুদয় শত্রু শেষ করিতে পারিলাম না। যাহারা পলাইতে অবসর পাইল না তাহারাই সম্মুখে দাঁড়াইল। ঐশ্বরী মায়ায় তাহাদের পরমায়ুও শেষ হইল। কিন্তু অধিকাংশ রক্ষীরাই প্রাণভয়ে নদীকূল ছাড়িয়া জঙ্গলে পলাইল। আমি এখন কী করি!

ঈশ্বরের মায়া বুঝিতে মানুষের সাধ্যমাত্র নাই। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ তাহার লক্ষাধিক সৈন্য লইয়া সেই সময়েই ফোরাত-তীরে আসিয়া আলী আকবরকে ঘিরিয়া ফেলিল! তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল! জেয়াদের সৈন্য আলী আকবরের তরবারির সম্মুখে শ্রেণীবদ্ধরূপে পড়িয়া যাইতে লাগিল। এ পর্যন্ত আলী আকবরের অঙ্গে শত্রুপক্ষেরা কোন অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে পারে নাই; কিন্তু আলী আকবর সাধ্যানুসারে বিধর্মী মস্তক নিপাত করিয়াও শেষ করিতে পারিলেন না। যাহারা পলাইয়াছিল, তাহারাও জেয়াদের সৈন্যের সহিত যোগ দিয়া আলী আকবরের বিরুদ্ধে দাঁড়াইল। আকবর সৈন্যচক্র ভেদ করিয়া দ্রুতগতিতে শিবিরে আসিলেন। পিতার সম্মুখীন হইয়া বলিতে লাগিলেন, “ফোরাতকূল উদ্ধার হইতে ইতে কিন্তু কুফা হইতে আবদুল্লাহ্ জেয়াদ লক্ষাধিক সৈন্য লইয়া এজিদের সৈন্যের সাহায্যার্থে পুনরায় নদীতীর বন্ধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে। যে উপায়ে হয়, আমাকে একপাত্র জল দিন, আমি এখনই জেয়াদকে সৈন্যসহ শমনভবনে প্রেরণ করিয়া আসি। এই দেখুন আমার তরবারি কাফের-শোণিতে রঞ্জিত হইয়াছে। ঈশ্বরকৃপায় এবং আপনার আশীর্বাদে আমার অঙ্গে কেহ এ পর্যন্ত একটিও আঘাত করিতে পারে নাই। কিন্তু পিপাসায় প্রাণ যায়।”

হোসেন বলিলেন, “আকবর! আজ দশ দিন কেবল চক্ষের জল ব্যতীত এক বিন্দু জল চক্ষে দেখি নাই। সেই চক্ষের জলও শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। জল কোথায় পাইব বাপ?”

আলী আকবর বলিলেন, “আমার প্রাণ যায়, আর বাঁচি না।” এই বলিয়া পিপাসার্ত আলী আকবর ভূমিতলে শয়ন করিলেন। হোসেন বলিতে লাগিলেন, “হে ঈশ্বর! জীবনে মানবজীবন রক্ষা হইবে বলিয়া জলের নাম তুমি জীবন দিয়াছ! জগদীশ্বর! সেই জীবন আজ দুর্লভ! জগজ্জীবন! সেই জীবনের জন্য আজ মানবজীবন লালায়িত। কার কাছে জীবন ভিক্ষা করি দয়াময়?-আশুতোষ! তোমার জগজ্জীবন নামের কৃপায় শিশু কেন বঞ্চিত হইবে জগদীশ?-করুণাময়! তুমি জগৎ সৃষ্টি করিয়াছ। ভূগোল বলে, স্থলভাগের অপেক্ষা জলের ভাগই অধিক। আমরা এমনি পাপী যে, জগতের অধিকাংশ পরিমাণ যে জল, যাহা পশুপীরাও অনায়াসে লাভ করিতেছে, তাহা হইতেও আমরা বঞ্চিত হইলাম! ষষ্টি সহস্র লোকের প্রাণ বোধ হয়, এ জলের জন্যই বিনাশ হইল! মায়াময়! সকলই তোমার মায়া।”

আলী আকবরের নিকট যাইয়া হোসেন বলিলেন, “আকবর! তুমি আমার এই জিহ্‌বা আপন মুখের মধ্যে দিয়া একটু শান্তিলাভ কর। জিহ্‌বাতে রস আছে, উহাতে যদি তোমার পিপাসার কিছু শান্তি হয়, দেখ!-বাপ! অন্য জলের আশা আর করিয়ো না।”

আলী আকবর পিতার জিহ্বা মুখের মধ্যে রাখিয়া কিঞ্চিৎ পরেই বলিলেন, “প্রাণ শীতল হইল। পিপাসা দূর হইল। ঈশ্বরের নাম করিয়া আবার চলিলাম।”

এই বলিয়াই আলী আকবর পুনরায় অশ্বে আরোহণপূর্বক সমরক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। অতি অল্প সময় মধ্যেই বহুশত্রু নিপাত করিয়া ফেলিলেন। এদ্দর্শনে জেয়াদ্ এবং ওমর প্রভৃতি পরামর্শ করিল যে, “আলী আকবর আর ক্ষণকাল এইরূপ যুদ্ধ করিলেই আমাদিগকে এক প্রকার শেষ করিবে। আলী আকবরকে যে গতিকেই হউক, বিনাশ করিতে হইবে। সম্মুখযুদ্ধে আকবরের নিকটে অগ্রসর হইয়া কেহই জয়লাভ করিতে পারিবে না। দূর হইতে গুপ্তভাবে আমরা কয়েকজন উহাকে লক্ষ্য করিয়া বিষাক্ত শর সন্ধান করিতে থাকি, অবশ্যই কাহারো শর আকবরের বক্ষ ভেদ করিবেই করিবে।” এই বলিয়াই প্রধান প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষেরা বহুদূর হইতে শরনিক্ষেপ করিতে লাগিল। আলী আকবর কাফেরবধে একেবারে জ্ঞানশূন্য হইয়া মাতিয়া গিয়াছেন। শরসন্ধানীরা শর নিক্ষেপ করিতেছে। একটি বিষাক্ত শর আলী আকবরের বক্ষ ভেদ করিয়া পৃষ্ঠদেশ পার হইয়া গেল। আলী আকবর সমুদয় জগৎ অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। পিপাসাও অধিকতর বৃদ্ধি হইল। জলের জন্য কাতরস্বরে বারবার পিতাকে ডাকিতে লাগিলেন। সম্মুখে দেখিতে পাইলেন যেন, তাঁহার পিতৃব্য জলপাত্র হস্তে করিয়া বলিতেছেন, “আকবর! শীঘ্রই আইস! আমি তোমার জন্য সুশীতল পবিত্রবারি লইয়া দণ্ডায়মান আছি।” আলী আকবর জলপান করিতে যাইতেছিলেন; পিপাসায় তাঁহার কণ্ঠ শুষ্ক হইতেছিল; কিন্তু ততদূর পর্যন্ত যাইতে হইল না, জলপিপাসা শান্তি করিতেও হইল না, জন্মের মত জীবন-পিপাসা ফুরাইয়া গেল। আলী আকবর অশ্ব হইতে পতিত হইলেন। প্রাণবায়ু বহির্গত-শূন্যপৃষ্ঠ অশ্ব শিবিরাভিমুখে দৌড়িল। অশ্বপৃষ্ঠ শূন্য দেখিয়া, আলী আকবরের ভ্রাতা আলী আসগর এবং আবদুল্লাহ্ ভ্রাতৃশোকে শোকাকুল।-তিলার্ধকালও বিলম্ব না করিয়া, জিজ্ঞাসা কি অনুমতি অপেক্ষা না রাখিয়া তাঁহারা দুই ভ্রাতা দুই অশ্বরোহণে শত্রু সম্মুখীন হইলেন। ক্ষণকাল মহাপরাক্রমে বহুশত্রু বিনাশ করিয়া রণস্থলে বিধর্মীহস্তে শহীদ্ হইলেন। যুগল অশ্ব শূন্যপৃষ্ঠে শিবিরাভিমুখে ছুটিল। অশ্বপৃষ্ঠে পুত্রদ্বয়কে না দেখিয়া, হোসেন আহত সিংহের ন্যায় গর্জিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “এখনো কী আমি বসিয়া থাকিব? এ সময়ও কী শত্রুনিপাতে অস্ত্রধারণ করিব না? পুত্র, ভ্রাতৃষ্পুত্র সকলেই শেষ হইয়াছে, আমি কেবল বসিয়া দেখিতেছি; আমার মত কঠিন প্রাণ জগতে কি আর কাহারো আছে?”

হোসেনের কনিষ্ঠ সন্তান জয়নাল আবেদীন ভ্রাতৃশোকে কাতর হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে শিবির হইতে দৌড়িয়া বাহির হইলেন। হোসেন পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িয়া গিয়া তাহাকে ধরিয়া আনিলেন, অনেক প্রবোধ দিয়া বুঝাইতে লাগিলেন। মুখে শত শত চুম্বন করিয়া ক্রোড়ে লইয়া সাহারবানুর নিকট আসিয়া বলিলেন, “জয়নাল যদি শত্রুহস্তে প্রাণত্যাগ করে, তবে মাতামহের বংশ জগৎ হইতে একেবারে নির্মূল হইবে, সৈয়দবংশের নাম আর ইহজগতে থাকিবে না। কেয়ামতের দিন পিতা এবং মাতামহের নিকট কী উত্তর করিব? তোমরা জয়নালকে সাবধানে রক্ষা কর; সর্বদাই চক্ষে চক্ষে রাখ। কোন ক্রমেই ইহাকে শিবিরের বাহির হইতে দিয়ো না।”

হোসেন কাহারো জন্য আর দুঃখ করিলেন না। ঈশ্বরের উদ্দেশে আকাশ পানে তাকাইয়া দুই হস্ত তুলিয়া বলিতে লাগিলেন, “দয়াময়! তুমি অগতির গতি, তুমি সর্ব-শক্তিমান, তুমি বিপদের কাণ্ডারী, তুমি অনুগ্রাহক, তুমিই সর্বরক্ষক। প্রভো! তোমার মহিমায় অনন্ত জগতের সৃষ্টি হইয়াছে। দানব, মানব, পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ, তরু, তৃণ, কীটাণু এবং পরমাণু পর্যন্ত স্থাবর জঙ্গম সমস্ত চরাচর তোমার গুণগান করিতেছে। তুমি মহান্, তুমি সর্বত্রব্যাপী, তুমিই স্রষ্টা, তুমিই সর্বকর্তা, তুমি সর্বপালক, তুমিই সর্বসংহারক। দয়াময়! জগতে যে দিকেই নেত্রপাত করি সেই দিকেই তোমার করুণা এবং দয়ার আদর্শ দেখিতে পাই। কি কারণে-কি অপরাধে আমার এ দুর্দশা হইল, বুঝিতে পারি না। বিধর্মী এজিদ্ আমার সর্বনাশ করিয়া একেবারে নিঃশেষ করিল, একেবারে বংশনাশ করিল! দয়াময়! তুমি কি ইহার বিচার করিবে না?”

হোসেন শূন্যপথে যাহা দেখিলেন তাহাতে অমনি চুবন্ধ করিয়া ফেলিলেন-আর কোন কথাই কহিলেন না। ঈশ্বরের উদ্দেশে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া কৃতজ্ঞতার সহিত উপাসনা করিলেন। উপাসনা শেষ করিয়া সমরসজ্জায় প্রবৃত্ত হইলেন।

মণিময় হীরকখচিত স্বর্ণমণ্ডিত বহুমূল্য সুসজ্জায় সে সজ্জা নহে! হোসেন যে সাজ আজ অঙ্গে ধারণ করিলেন, তাহা পবিত্র ও অমূল্য! যাহা ঈশ্বর প্রসাদাৎ হস্তগত না হইলে জগতের সমুদয় ধনেও হস্তগত হইবার উপায় নাই, জীবনান্ত পর্যন্ত চেষ্টা বা যত্ন করিলেও যে সকল অমূল্য পবিত্র পরিচ্ছদ লাভে কাহারো ক্ষমতা নাই, হোসেন আজ সেই সকল বসন ভূষণ পরিধান করিলেন। প্রভু মোহাম্মদের শিরস্ত্রাণ, হজরত আলীর কবচ; হজরত দাউদ পয়গম্বরের কোমরবন্ধ, মহাত্মা সোয়েব পয়গম্বরের মোজা, এই সকল পবিত্র পরিচ্ছদ অঙ্গে ধারণ করিয়া যুদ্ধের আর আর উপকরণে সজ্জিত হইলেন। রণবেশে সুসজ্জিত হইয়া ইমাম হোসেন শিবিরের বাহিরে দাঁড়াইলে স্ত্রী, কন্যা, পরিজন সকলই নির্বাকে কাঁদিয়া তাঁহার পদলুণ্ঠিত হইতে লাগিলেন। উচ্চরবে কাঁদিবার কাহারো শক্তি নাই। কত কাঁদিতেছেন, কত দুঃখ করিতেছেন, এক্ষণে প্রায় সকলেরই কণ্ঠস্বর বন্ধ হইয়া যাইতেছে। ইমাম হোসেন সকলকেই সবিনয় মিষ্টবাক্যে একটু আশ্বস্ত করিয়া বলিতে লাগিলেন, পরিজনেরা ইমামের সম্মুখে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিলেন। হোসেন বলিলেন, “মদিনা পরিত্যাগ করিয়া কুফায় আগমন সঙ্কল্প তোমাদের অজানা কিছুই নাই। তোমরা আমার শরীরের এক-এক অংশ। তোমাদের দুঃখ দেখিয়া আমার প্রাণ এতক্ষণ যে কেন আছে, তাহা আমি জানি না।”

সকলে সেই এক প্রকার অব্যক্ত হু-হু স্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন। ইমাম পুনর্বার বলিতে লাগিলেন, “ইহাতে নিশ্চয় বোধ হইতেছে, যে ঈশ্বরের কোন আজ্ঞা আমার দ্বারা সাধিত হইবে, মাতামহের ভবিষ্যৎবাণী সফল হইবে! আমি ঈশ্বরের দাস, ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্যে আমি বাধ্য। সেই কার্য সাধনে আমি সন্তোষের সহিত সম্মত। মানুষ জন্মিলেই মরণ আছে, তবে সেই দয়াময় কি অবস্থায় কখন কাহাকে কালের করাল গ্রাসে প্রেরণ করেন তাহা তিনিই জানেন। ইহাও সত্য যে, এজিদের আদেশক্রমে তাঁহার সৈন্যগণ আমাদের পিপাসাশান্তির আশাপথ একেবারে বন্ধ করিয়াছে। জীবনে বিহনে জীবনশক্তি কয়দিন জীবনে থাকে? জীবনই মানুষের একমাত্র জীবন। এই অবস্থাতে শিবিরে বসিয়া কাঁদিলে আর কি হইবে?-পুত্রগণ, মিত্রগণ এবং অন্যান্য হৃদয়ের বন্ধুগণ, যাঁহারা আজ প্রভাত হইতে এই সময়ের মধ্যে বিধর্মীহস্তে সহিদ হইয়াছেন, তাঁহাদের জন্য নীরবে বসিয়া কাঁদিলে আর কি হইবে? আজ না হয় কাল এই পিপাসাতেই মরিতে হইবে।”

আবার সকলে নীরবে হু-হু শব্দে কাঁদিতে লাগিলেন। ইমাম আবার বলিতে লাগিলেন, “যদি নিশ্চয়ই মরিতে হইল, তবে বীরপুরুষের ন্যায় মরিব। আমি হজরত আলীর পুত্র মহাবীর হাসানের ভ্রাতা; আমি কি স্ত্রীলোকের সঙ্গী হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে মরিব?-তাহা কখনই হইবে না। পুত্রমিত্রগণের অকালমৃত্যুজনিত শোকের যাতনা শত্রু-বিনাশে নিবারণ করিয়া প্রাণত্যাগ করিব। আজ কারবালা প্রান্তরে মহানদী,-মহানদী কেন-ঐ শোকে মহাসমুদ্রস্রোতে মহারক্তস্রোত বহাইয়া প্রাণত্যাগ করিব। জগৎ দেখিবে, বৃক্ষপত্র দেখিবে, আকাশ দেখিবে, আকাশের চন্দ্র সূর্য দেখিবে, হোসেনের ধৈর্য, শান্তি ও বীর-প্রতাপ কতদূর!-আজি এই সূর্যকেই আদি মধ্য শেষ,-তাহার পরেও যদি কিছু থাকে, তাহাও দেখাইব। তোমরা আমার জন্য কেহ কাঁদিয়ো না। যদি এই যাত্রাই এ জীবনের শেষ যাত্রা হয়, বার বার বলিতেছি, আর যুদ্ধ করিও না। আর কোন প্রাণীকেও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাইও না, জয়নালকে মুহূর্তের জন্য হাতছাড়া করিয়ো না। আমি তোমাদিগকে সেই দয়াময় বিপত্তারণ জগৎকারণ জগদীশ্বরের চরণে সমর্পণ করিলাম,-তিনি রক্ষা করিবেন। আমি প্রার্থনা করিতেছি, তোমরাও কায়মনে সেই জগৎপিতার সমীপে প্রার্থনা কর, শত্রু বিনাশ করিয়া তোমাদিগকে যেন উদ্ধার করিতে পারি।”

পৌরজনমাত্রেই দুই হাত তুলিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, “হে করুণাময়! হে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডেশ্বর! আমাদিগকে আজ এই ঘোর বিপদ হইতে উদ্ধার কর। হে পরম কারুণিক পরমেশ্বর! আমাদিগকে দুরন্ত এজিদের দৌরাত্ম্য হইতে রা কর।” হোসেন বলিতে লাগিলেন, “যদি তোমাদের সঙ্গে আমার এই দেখাই শেষ দেখা হয়, তবে তোমরা কেহই আমার জন্য দুঃখ করিয়ো না-ঈশ্বরের নিন্দা করিয়ো না। আমার মরণই তোমাদের মঙ্গল। আমি মরিলে অবশ্যই তোমরা সুখী হইবে, আমি তোমাদের কষ্টের এবং দুঃখের কারণ ছিলাম!”

পরিজনগণকে এই পর্যন্ত বলিয়া জয়নালকে ক্রোড়ে লইয়া হোসেন বলিতে লাগিলেন, “আমি বিদায় হইলাম, আমার জন্য কাঁদিয়ো না। কেয়ামতে আমার সঙ্গে অবশ্যই দেখা হইবে। তুমিও তোমার মায়ের নিকট থাকিয়ো; কখনোই শিবিরের বাহির হইও না, এজিদ্ তোমাদের কিছুই করিতে পারিবে না।”

জয়নালের মুখচুম্বনপূর্বক সাহারবানুর ক্রোড়ে দিয়া সখিনাকে সম্বোধনপূর্বক হোসেন বলিলেন, “মা! আমি এক্ষণে বিদায় হইলাম। কাসেমের সংবাদ আনিতে যাই। আর দুঃখ করিও না, ঈশ্বর তোমাদের দুঃখ দূর করিবেন। আর একটি বীর পুরুষ হানুফা নগরে এখনও বর্তমান আছেন। যদি কোন প্রকারে এই লোমহর্ষণ সংবাদ তাঁহার কর্ণগোচর হয়, প্রাণান্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি তোমাদের এই কষ্টের প্রতিশোধ লইতে কখনো পরামুঙ্খ হইবেন না;-কখনোই এজিদ্‌কে ছাড়িবেন না;-হয় তোমাদিগকে উদ্ধার করিবেন, নয় এজিদের হস্তে প্রাণত্যাগ করিবেন।”

সখিনাকে এইরূপে প্রবোধ প্রদানপূর্বক অবশেষে সাহারবানুর হস্ত ধরিয়া রণবেশী রণযাত্রী পুনরায় বলিলেন, “বোধ হয় আমার সঙ্গে এই তোমার শেষ দেখা। সাহারবানু! মায়াময় সংসারের দশাই এইরূপ। তবে অগ্রপশ্চাৎ এইমাত্র প্রভেদ-ঈশ্বরে নির্ভর করিয়া জয়নালকে সাবধানে রাখিয়ো। আমার আর কোন কথা নাই-চলিলাম।”

শিবিরের বাহিরে আসিয়া ইমাম হোসেন অশ্বে আরোহণ করিলেন। ওদিকে শিবির মধ্যে পরিজনেরা একপ্রকার বিকৃতস্বরে হায় হায় রবে ধূলায় গড়াগড়ি যাইতে লাগিলেন।

বিষাদ সিন্ধু – মীর মশাররফ হোসেন মহরম পর্ব ২৬ প্রবাহ

ইমাম হোসেনের অশ্বের পদধ্বনি শ্রবণ করিয়া এজিদের সৈন্যগণ চমকিত হইল। সকলের অন্তর কাঁপিয়া উঠিল। সকলেই দেখিতে লাগিল, হোসেন স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে আসিতেছেন। দেখিতে দেখিতে চক্ষেরে পলকে মহাবীর হোসেন যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “ওরে বিধর্মী পাপাত্মা এজিদ্! তুই কোথায়? তুই নিজে দামেস্কে থাকিয়া নিরীহ সৈন্যদিগকে কেন রণস্থলে পাঠাইয়াছিস? আজ তোকে পাইলে জ্ঞাতি-বধ বেদনা, ভ্রাতুষ্পুত্র কাসেমের বিচ্ছেদ-বেদনা এবং স্বীয় পুত্রগণের বিয়োগ-বেদনা, সমস্তই আজ তোর পাপ শোণিতে শীতল করিতাম-তোর প্রতি লোমকূপ হইতে হলাহল বাহির করিয়া লোমে লোমে প্রতিশোধ লইতাম। জানিলাম, কাফেরমাত্রেই চতুর। রে নৃশংস! অর্থলোভ দেখাইয়া পরের সন্তানগণকে অকালে নিধন করিবার নিমিত্ত পাঠাইয়াছিস্। ওরে অর্থলোভী পিশাচেরা! ধর্মভয় বিসর্জন দিয়া আমার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিয়াছিস! আয় দেখি, কে সাহস করিয়া আমার অস্ত্রের সম্মুখে আসিবি, আয়! আর বিলম্ব কেন? যাহার পক্ষে ইহজগৎ ভারবোধ হইয়া থাকে, যে হতভাগ্য আপন মাতাকে অকালে পুত্রশোকে কাঁদাইতে ইচ্ছা করিয়া থাকে, যৌবনে কুলস্ত্রীর বৈধব্য কামনা যাহার অন্তরে উদয় হইয়া থাকে, সে শীঘ্র আয়! আর আমার বিলম্ব সহ্য হইতেছে না।”

এজিদ্-পক্ষীয় সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা আবদুর রহমান-হোসেনের সহিত যুদ্ধ করিতে তাহার চিরসাধ। অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া সেই আবদুর রহমান অসি চালনা করিতে করিতে হোসেনের সম্মুখে আসিয়া বলিতে লাগিল, “হোসেন! তুমি আজ শোকে তাপে মহাকাতর; বোধ হয়, আজ দশ দিন তোমার পেটে অন্ন নাই; পিপাসায় কণ্ঠতালু বিশুষ্ক; এই কয়েক দিন যে কেন বাঁচিয়া আছ বলিতে পারি না। আর কষ্টভোগ করিতে হইবে না, শীঘ্রই তোমার মনের দুঃখ নিবারণ করিতেছি। বড় দর্পে অশ্বচালনা করিয়া বেড়াইতেছ; এই আবদুর রহমান তোমার সম্মুখে দাঁড়াইল, যত বল থাকে, অগ্রে তুমিই আমাকে আঘাত কর। লোকে বলিবে যে, ক্ষুৎপিপাসাকুল, শোকতাপবিদগ্ধ, পরিজন-দুঃখকাতর, উৎসাহহীন বীরের সহিত কে না যুদ্ধ করিতে পারে? এ দুর্নাম আমি সহ্য করিব না। -তুমিই অগ্রে আঘাত কর। তোমার বল বুঝিয়া দেখি; যদি আমার অস্ত্রঘাত সহ্য করিবার উপযুক্ত হও, আমি প্রতিঘাত করিব; নতুবা ফিরিয়া যাইতে তোমার ন্যায় হীন, ক্ষীণ দুর্বল যোদ্ধাকে খুঁজিয়া তোমার সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাইয়া দিব।”

হোসেন বলিলেন, “এত কথার প্রয়োজন নাই! আমার বংশমধ্যে কিংবা জাতিমধ্যে অগ্রে অস্ত্র নিক্ষেপের রীতি থাকিলে তুমি এত কথা কহিবার সময় পাইতে না। হারামজাদ্! বেঈমান! কাফের, শীঘ্র যে কোন অস্ত্র হয়, আমার প্রতি নিক্ষেপ কর। সমরক্ষেত্রে আসিয়া বাক্বিণ্ডতার দরকার কি? অস্ত্রই বলপরীক্ষার প্রধান উপকরণ! কেন বিলম্ব করিতেছিস্? যে কোন অস্ত্র হউক, একবার নিক্ষেপ করিলেই তোর যুদ্ধসাধ মিটাইতেছি। বিলম্বে তোর মঙ্গল বটে, কিন্তু আমার অসহ্য।”

হোসেনের মস্তক লক্ষ্য করিয়া তরবারি উত্তোলনপূর্বক “তোমার মস্তকের মূল্য লক্ষ টাকা!” এই বলিয়াই আবদুর রহমান ভীম তরবারি আঘাত করিলেন। হোসেনের বর্মোপরি আবদুর রহমানের তরবারি সংলগ্ন হইয়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বহির্গত হইল। রহমান লজ্জিত হইয়া পলায়নের উপক্রম করিল। হোসেন বলিলেন, “অগ্রে সহ্য কর্, শেষে পলায়ন করিস্।” এই কথা বলিয়াই এক আঘাতে রহমানের অশ্ব সহিত দেহ দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলিলেন। এই ঘটনা দেখিয়া এজিদের সৈন্যগণ মহাভয়ে কম্পিত হইতে লাগিল। কেহই আর হোসেনের সম্মুখীন হইতে সাহস করিল না। বলিতে লাগিল, “যদি হোসেন আজ এ সময় পিপাসা নিবারণ করিতে বিন্দুমাত্রও জল পায়, তাহা হইলে আমাদের একটি প্রাণীও ইহার হস্ত হইতে প্রাণ বাঁচাইতে পারিবে না। যুদ্ধ যতই হউক, বিশেষ সতর্ক হইয়া দ্বিগুণ সৈন্য দ্বারা ফোরাতকূল এখন ঘিরিয়া রাখাই কর্তব্য। যে মহাবীর একাঘাতে আবদুর রহমানকে নিপাত করিল, তাহার সম্মুখে কে সাহস করিয়া দাঁড়াইবে? আমরা রহমানের গৌরবেই চিরকাল গৌরব করিয়া বেড়াই, তাহারই যখন এই দশা হইল, তখন আমরা তো হোসেনের অশ্বপদাঘাতেই গলিয়া যাইব।” পরস্পর এইরূপ বলাবলি করিয়া সকলেই একমতে দ্বিগুণ সৈন্য দ্বারা বিশেষ সুদৃঢ়রূপে ফোরাতকূল বন্ধ করিল।

হোসেন অনেকণ পর্যন্ত সমরপ্রাঙ্গণে কাহাকেও না পাইয়া শত্রুশিবিরাভিমুখে অশ্বচালনা করিলেন। তদ্দর্শনে অনেকেরই প্রাণ উড়িয়া গেল। কেহ অশ্বপদাঘাতে নরকে গমন করিল, কেহ কেহ সাহসের উপরে নির্ভর করিয়া হোসেনের সম্মুখে সশস্ত্র হইয়া দাঁড়াইল। কিন্তু হাতের অস্ত্র হাতেই রহিয়া গেল, মস্তকগুলি দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া দূরে দূরে বিনিক্ষিপ্ত হইল।

মহাবীর হোসেন বিধর্মীদিগকে যেখানে পাইলেন, যে অস্ত্র যে সুযোগে যাহাকে মারিতে পারিলেন, সেই অস্ত্রের দ্বারাই তাহাকে মারিয়া নরক পরিপূর্ণ করিতে লাগিলেন। শিবিরস্থ অবশিষ্ট সৈন্যগণ প্রাণভয়ে যাহারা যে দিকে সুবিধা ঊর্ধ্বশ্বাসে সেই দিকে দৌড়াইয়া প্রাণ রক্ষা করিল। যাহারা তাঁহার সম্মুখে দৌড়াইয়া আসিল, তাহারা কেহই প্রাণরক্ষা করিতে পারিল না। সকলেই হোসেনের অস্ত্রে দ্বিখণ্ডিত হইয়া পাপময় দেহ পাপরক্তে ভাসাইয়া নরকগামী হইল। অবশিষ্ট সৈন্যগণ র্কাবালাপার্শ্বস্থ বিজন বনমধ্যে পলাইয়া প্রাণরক্ষা করিল; ওমর, সীমার, আবদুল্লাহ্ জেয়াদ প্রভৃতি সকলেই হোসেনের ভয়ে বনমধ্যে লুকাইল।

শত্রুপক্ষের শিবিরস্থ সৈন্য একেবারে নিঃশেষিত করিয়া হোসেন ফোরাতকূলের দিকে অশ্ব চালাইলেন। ফোরাত-রক্ষীরা হঠাৎ পলাইল না, কিন্তু অতি অল্পক্ষণ হোসেনের অসির আঘাত সহ্য করিয়া আর তিষ্ঠিবার সাধ্য হইল না। কেহ জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িল, কেহ জঙ্গলে লুকাইল, কেহ কেহ অন্য দিকে পলাইল, কিন্তু বহুতর সৈন্যই হোসেনের অস্ত্রাঘাতে দ্বিখণ্ডিত হইয়া রক্তস্রোতের সহিত ফোরাত-স্রোতে ভাসিয়া চলিল। কোন স্থানে শত্রুসৈন্যের নাম মাত্রও নাই, রক্তস্রোত মধ্যে শরীরের কোন কোন ভাগ লক্ষিত হইতেছে মাত্র। যে এজিদের সৈন্যকোলাহলে প্রচণ্ড কারবালা প্রান্তর, সুপ্রশস্ত ফোরাতকূল ঘনঘন বিকম্পিত হইত; এক্ষণে হোসেনের অস্ত্রাঘাতে সেই কার্‌বালা একেবারে জনশূন্য নীরব প্রান্তর, হোসেন ব্যতীত প্রাণিশূন্য। ফোরাত-তীর প্রকৃতিদেবীর বক্ষক্ষেত্রস্থ স্বাভাবিক শোভা একেবারে পরিবর্তিত হইয়া লোহিতবর্ণ ধারণ করিয়া। নিন্মভূমিতে রক্তের স্রোত কল কল শব্দে প্রবাহিত হইতেছে। রক্তমাখা খণ্ডিত দেহ ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। হোসেন জলপিপাসায় এমনি কাতর হইয়াছেন যে, আর কথা কহিবার শক্তি নাই। এতক্ষণ কেবল শত্রুবিনাশের উৎসাহে উৎসাহিত ছিলেন বিধর্মীয় রক্তস্রোত বহাইয়া পিপাসার অনেক শান্তি হইয়াছিল, এখন শত্রু শেষ হইল, পিপাসাও অসহ্য হইয়া উঠিল। শীঘ্র শীঘ্র ফোরাতকূলে যাইয়া অশ্ব হইতে অবতরণপূর্বক একেবারে জলে নামিলেন। জলের পরিষ্কার স্নিগ্ধভাব দেখিয়া ইচ্ছা করিলেন যে, এককালে নদীর সমুদয় জল পান করিয়া ফেলেন। অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলিয়া মুখে দিবেন, এমন সময় সমুদয় কথা মনে পড়িল। আত্মীয় বন্ধুর কথা মনে পড়িল, কাসেমের কথা মনে পড়িল, আলী আক্‌বর প্রভৃতির কথা মনে পড়িল, পিপাসার্ত দুগ্ধপোষ্য শিশুর কথা মনে পড়িল। “একবিন্দু জলের জন্য ইহারা কত লালায়িত হইয়াছে, কত কাতরতা প্রকাশ করিয়াছে, কত কষ্টভোগ করিয়াছে, এই জলের নিমিত্তই আমার পরিজনেরা পুত্রহারা, পতিহারা, ভ্রাতাহারা হইয়া মাথা ভাঙ্গিয়া মরিতেছে, আমি এখন শত্রুহস্ত হইতে ফোরাতকূল উদ্ধার করিয়া সর্বাগ্রেই নিজে সেই জলপান করিব!-নিজের প্রাণ পরিতৃপ্ত করিব!-আমার প্রাণের মায়াই কি এত অধিক হইল। ধিক্ আমার প্রাণে! -এই জলের জন্য আলী আক্‌বর আমার জিহ্‌বা পর্যন্ত চুষিয়াছে। এক পাত্র জল পাইলে আমার বংশের উজ্জ্বল মণি মহাবীর কাসেম আজ শত্রুহস্তে প্রাণত্যাগ করিত না। এখনো যাহারা জীবিত আছে তাহারা তো শোকতাপে কাতর হইয়া পিপাসায় মৃতবৎ হইয়া রহিয়াছে। -এ জল আমি কখনোই পান করিব না,-ইহজীবনেই আর পান করিব না।” এই কথা বলিয়া হস্তস্থিত জল নদীগর্ভে ফেলিয়া দিয়া তীরে উঠিলেন। কি ভাবিলেন তিনিই জানেন। একবার আকাশের দিকে লক্ষ্য করিয়া পবিত্র শিরস্ত্রাণ শির হইতে দূরে নিক্ষেপ করিলেন। দুই এক পদ অগ্রসর হইয়াই কোমর হইতে কোমরবন্দ খুলিয়া দূরে ফেলিয়া দিলেন। সেই পবিত্র মোজা আর পায়ে রাখিলেন না। ভ্রাতৃশোক, পুত্রশোক, সকল শোক একত্র আসিয়া তাঁহাকে যেন দগ্ধ করিতে লাগিল। কি মনে হইল, তাহাতেই বোধ হয়, পরিচিত পায়জামা মাত্র অঙ্গে রাখিয়া আর আর সমুদয় বসন খুলিয়া ফেলিলেন। অস্ত্রশস্ত্র দূর নিক্ষেপ করিয়া ফোরাতস্রোতের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন। হোসেনের অশ্ব প্রভুর হস্ত, পদ ও মস্তক শূন্য দেখিয়াই যেন মহাকষ্টে দুই চক্ষু হইতে অনবরত বাষ্পজল নির্গত করিতে লাগিল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্, ওমর, সীমার আর কয়েকজন সৈনিক যাহারা জঙ্গলে লুকাইয়াছিল তাহার দূর হইতে দেখিল যে, ইমাম হাসেন জলে নামিয়া অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলিয়া পুনরায় ফেলিয়া দিলেন। পান করিলেন না। তদনন্তর তীরে উঠিয়া সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র, অবশেষে অঙ্গের বসন পর্যন্ত দূরে নিক্ষেপ করিয়া শূন্যশির শূন্যশরীরে অশ্বের নিকট দণ্ডয়মান আছেন। এতদ্দর্শনে ঐ কয়েকজন একত্রে ধনুর্বাণ হস্তে হোসেনকে ঘিরিয়া ফেলিল। হোসেন স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া আছেন, কাহাকেও কিছু বলিতেছেন না। স্থিরভাবে স্থিরনেত্রে ধনুর্ধারী শত্রুদিগকে দেখিতেছেন, মুখে কোন কথা নাই। এখন নিরস্ত্র অবস্থায় শত্রুহস্তে পতিত হইয়া মনে কোন প্রকার শঙ্কাও নাই! অন্যমনস্কে কি ভাবিতেছেন, তাহা ঈশ্বরই জানেন, আর তিনিই জানেন। ক্ষণকাল পরে তিনি ফোরাতকূল হইতে অরণ্যাভিমুখে দুই এক পদ অগ্রসর হইতে লাগিলেন। শত্রুগণ চতুষ্পার্শ্বে দূরে দূরে তাঁহাকে ঘিরিয়া চলিল। যাইতে যাইতে জেয়াদ্ পশ্চাদ্দিক হইতে তাঁহার পৃষ্ঠ লক্ষ্য করিয়া এক বিষাক্ত লৌহস্বর নিক্ষেপ করিল। ভাবিয়াছিল যে, এক শরে পৃষ্ঠবিদ্ধ করিয়া বক্ষস্থল ভেদ করিবে, কিন্তু ঘটনাক্রমে সে শর হোসেনের বামপার্শ্ব দিয়া চলিয়া গেল, গাত্রে লাগিল না। শব্দ হইল, সে শব্দেও হোসেনের ধ্যানভঙ্গ হইল না। তাহার পর ক্রমাগতই শর নিপ্তি হইতে লাগিল। কিন্তু একটিও ইমামের অঙ্গে বিদ্ধ হইল না। সীমার শরসন্ধানে বিশেষ পারদর্শী ছিল না বলিয়াই খঞ্জর (খঞ্জর-এক প্রকার ছোরা, ইহার দুই দিকেই ধার।) হস্তে করিয়া যাইতেছিল। এত তীর নিক্ষিপ্ত হইতেছে, একটিও হোসেনের অঙ্গে লাগিতেছে না। কী আশ্চর্য! সীমার এই ভাবিয়া জেয়াদের হস্ত হইতে তীরধনু গ্রহণপূর্বক হোসেনের পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করিয়া এক শর নিক্ষেপ করিল। তীর পৃষ্ঠে না লাগিয়া গ্রীবাদেশের এক পার্শ্ব ভেদ করিয়া চলিয়া গেল। সেদিকে হোসেনের ভ্রূপে নাই। এমন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন আছেন যে, শরীরের বেদনা পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছেন। যাইতে যাইতে অন্যমনস্কে একবার গ্রীবাদেশের বিদ্ধস্থান হস্ত দিয়া ঘর্ষণ করিলেন। জলের ন্যায় বোধ হইল;-করতলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন, জল নহে, গ্রীবানিঃসৃত সদ্যরক্ত! রক্তদর্শনে হোসেন চমকিয়া উঠিলেন। আজ ভয়শূন্য মানসে ভয়ের সঞ্চার হইল। সভয়ে চতুর্দিকে চাহিয়া দেখিলেন, আবদুল্লাহ্ জেয়াদ্, অলীদ, ওমর, সীমার এবং আর কয়েকজন সেনা চতুর্দিক ঘিরিয়া যাইতেছে। -সকলের হস্তেই তীরধনু। ইহা দেখিয়াই চমকিত।-যে সমুদয় বসনের মাহাত্ম্যে নির্ভরহৃদয়ে ছিলেন-তৎসমুদয় পরিত্যাগ করিয়াছেন; তরবারি, তীর, নেজা, বল্লম, বর্ম, খঞ্জর কিছুই সঙ্গে নাই, কেবল দুখানি হাত মাত্র। অন্যমনস্কভাবে দুই এক পদ করিয়া চলিলেন; শত্রুরাও পূর্ববৎ ঘিরিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিল।

কিছু দূরে যাইয়া হোসেন আকাশপানে দুই-তিন বার চাহিয়া ভূতলে পড়িয়া গেলেন। বিষাক্ত তীরবিদ্ধ ক্ষতস্থানের জ্বালা, পিপাসার জ্বালা, শোকতাপ,-বিয়োগদুঃখ,-নানা-প্রকার জ্বালায় অধীর হইয়া পড়িলেন। জেয়াদ্ এবং ওমর প্রভৃতি ভাবিল যে, হোসেনের মৃত্যু হইয়াছে। কিছুণ পরে হস্তপদ সঞ্চালনের ক্রিয়া দেখিয়া নিশ্চয় হোসেনের মৃত্যু মনে করিল না, মৃত্যু নিকটবর্তী জ্ঞান করিয়া কিঞ্চিৎ দূরে স্থিরভাবে দণ্ডায়মান রহিল।

হোসেন ভূমিতলে পড়িয়া রহিয়াছেন। সীমারের সামান্য শরাঘাতে তাদৃশ মহাবীরের প্রাণবিয়োগ হইবে, অসম্ভব ভাবিয়া কেহই হোসেনের নিকট যাইতে সাহসী হইল না; কেহ কেহ নিশ্চয় মৃত্যু অনুমান করিতেছে; মুখেও বলিতেছে যে, “হোসেন আর নাই! চল, হোসেনের মস্তক কাটিয়া আনি।” দুই এক পদ যাইয়া আর অগ্রসর হইতে সাহস হয় না। হোসেনের মৃত্যু সংবাদ এজিদের নিকট লইয়া গেলে কোন লাভই নাই। এজিদ্ সে সংবাদ বিশ্বাস করিয়া কখনোই পুরস্কার দান করিবেন না। মস্তক চাই! ভাবিয়া ভাবিয়া সীমার বলিল, “জেয়াদ্! তুমি তো খুব সাহসী, তুমিই মৃত হোসেনের মাথা কাটিয়া আন!”

জেয়াদ্ বলিল, “হোসেনের মাথা কাটিতে আমার হস্ত স্থির থাকিবে না, সাহসও হইবে না! আমি উহা পারিব না। যদি দুর্বলতাবশতঃ হোসেন ধরাশায়ী হইয়া থাকে কিংবা অন্য কোন অভিসন্ধি করিয়া মড়ার ন্যায় মাটিতে পড়িয়া থাকে, আমাকে হাতে পাইলে, বল তো আমার কী দশা ঘটিবে? যাহার ভয়ে জঙ্গলে পলাইয়া প্রাণরক্ষা করিয়াছি, ইচ্ছা করিয়া তাহার হাতে পড়িব? আমি তো কখনোই যাইব না! মাথা কাটিয়া আনা তো শেষের কথা, নিকটেও যাইতে পারিব না!”

অলীদকে সম্বোধন করিয়া সীমার বলিলেন, “ভাই অলীদ! তোমার অভিপ্রায় কী? তুমি হোসেনের মাথা কাটিয়া আনিতে পারিবে না কি?”

অলীদ উত্তর করিল, “আমি হোসেনের বিরুদ্ধে যাহা করিয়াছি, তাহাই যথেষ্ট হইয়াছে! এজিদের বেতনভোগী হইয়া আজ কার্‌বালা প্রান্তরে যাহা আমি করিলাম, জগৎ বিলয় না হওয়া পর্যন্ত মানবহৃদয়ে সমভাবে তাহা পাষাণাঙ্কবৎ খোদিত থাকিবে! ইহার পরিণামফল কি আছে, তাহা,-ভবিতব্য কি আছে, তাহা কে জানে ভাই?-ভাই তোমরা আমায় মার্জনা কর, আমি পারিব না! হোসেনের মাথাও আমি কাটিতে চাহি না, লক্ষ টাকা পুরস্কারেরও আশা করি না। যাহার হৃদয়ে রক্তমাংসের লেশমাত্রও নাই, লক্ষ টাকার লোভে সেই এই নিষ্ঠুর কার্য করুক!”

সদর্পে সীমার বলিয়া উঠিল, “দেখিলাম তোমাদের বীরত্ব! -দেখিলাম তোমাদের সাহস! -বুঝিলাম তোমাদের ক্ষমতা! -এই দেখ, আমি এখনই হোসেনের মাথা কাটিয়া আনি!”-এই কথা বলিয়াই সীমার খঞ্জরহস্তে একলম্ফে হোসেনের বক্ষের উপর গিয়া বসিল। যে সীমারের নামে অঙ্গ শিহরিয়া উঠিয়াছিল, যে সীমারের নামে হৃদয় কাঁপিয়া উঠিয়াছিল, পাঠক! এই সেই সীমার! সুধার খঞ্জর-হস্তে সেই সীমার, ঐ হোসেনের বরে উপর বসিয়া গলা কাটিতে উদ্যত হইল!!!

হোসেন জীবিত আছেন। উঠিবার শক্তি নাই। অন্যমনস্কে কি চিন্তায় অভিভূত ছিলেন, তিনিই জানেন। চক্ষু মেলিয়া বক্ষের উপর খঞ্জর হস্তে সীমারকে দেখিয়া বলিতে লাগিলেন, “তুমি ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব-তুমি আমার বক্ষের উপর বসিলে। নূরনবী মোহাম্মদের মতাবলম্বী হইয়া ইমাম হোসেনের বক্ষের উপর পা রাখিয়া বসিলে! তোমার কী পরকাল বলিয়া কিছুই মনে নাই? এমন গুরুতর পাপের জন্য তুমি কী একটুও ভয় করিতেছ না?”

সীমার বলিল, “আমি কাহাকেও ভয় করি না!-আমি পরকাল মানি না। নূরনবী মোহাম্মদ কে? আমি তাহাকে চিনি না। তোমার বুকের উপর বসিয়াছি বলিয়া পাপের ভয় দেখাইতেছ? সে ভয় আমার নাই! কারণ আমি এখনই এই খঞ্জরে তোমার মাথা কাটিয়া লইব। যাহার মাথা কাটিয়া লক্ষ টাকা পুরস্কার পাইব, তাহার বুকের উপর বসিতে আবার পাপ কি? সীমার পাপের ভয় করে না।”

“সীমার! আমি এখনই মরিব। বিষাক্ত তীরের আঘাতে আমি অস্থির হইয়াছি। বক্ষের উপর হইতে নামিয়া আমায় নিশ্বাস ফেলিতে দাও। একটু বিলম্ব কর!-একটু বিলম্বের জন্য কেন আমাকে কষ্ট দিবে? আমার প্রাণ বাহির হইয়া গেলে মাথা কাটিয়া লইও। দেহ যত খণ্ড করিতে ইচ্ছা হয়, করিয়ো। একবার নিশ্বাস ফেলিতে দাও! আজ নিশ্চয়ই আমার মৃত্যু। এই কার্‌বালা-প্রান্তরেই হোসেনের জীবনের শেষ কার্য সমাপ্ত। জীবনের শেষ এই র্কাবালায়। ভাই সীমার! তুমি নিশ্চয়ই আমার মাথা কাটিয়া লইতে পারিবে। আমি আশীর্বাদ করিতেছি, এই কার্য করিয়া তুমি জগতে বিখ্যাত হইবে। ক্ষণকাল অপেক্ষা কর।”

অতি কর্কশস্বরে সীমার বলিল, “আমি তোমার বুকের উপর চাপিয়া বসিয়াছি, মাথা না কাটিয়া উঠিব না। যদি অন্য কোন কথা থাকে, বল। বুকের উপর হইতে একটুও সরিয়া বসিব না।” এই বলিয়া সীমার আরো দৃঢ়রূপে চাপিয়া বসিয়া হোসেনের গলায় খঞ্জর চালাইতে লাগিল।

হোসেন বলিতে লাগিলেন, “সীমার! আমার প্রাণ এখনই বাহির হইবে; একটু বিলম্ব কর।-এই কষ্টের উপর আর কষ্ট দিয়া আমাকে মারিয়ো না।”

সীমার তীক্ষ্ণধার খঞ্জর হোসেনের গলায় সজোরে চালাইতে লাগিল, কিন্তু চুল পরিমাণ কাটিতে পারিল না। বারবার খঞ্জরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল। হস্তদ্বারা বারংবার খঞ্জরের ধার পরীক্ষা করিয়া দেখিল। পুনরায় অধিক জোরে খঞ্জর চালাইতে লাগিল। কিছুতেই কিছুই হইল না-তিলমাত্র চর্মও কাটিল না। সীমার অপ্রস্তুত হইল। আবার খঞ্জরের প্রতি ঘনঘন দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল। আবার ভাল করিয়া দেখিয়া খঞ্জরের ধার পরীক্ষা করিল।

হোসেন বলিলেন, “সীমার! কেন বারবার এ সময় আমাকে কষ্ট দিতেছ! শীঘ্রই মাথা কাটিয়া ফেল! আর সহ্য হয় না। অনর্থক আমাকে কষ্ট দিয়া তোমার কী লাভ হইতেছে? বন্ধুর কার্য কর।-শীঘ্রই আমার মাথা কাটিয়া ফেল।”

“আমি তো কাটিতে বসিয়াছি। সাধ্যানুসারে চেষ্টাও করিতেছি। খঞ্জরে না কাটিলে আমি আর কি করিব! এমন সুতীক্ষ্ণ খঞ্জর তোমার গলায় বসিতেছে না, আমার অপরাধ কি-আমি কি করিব?

হোসেন বলিলেন, “সীমার! তোমার বসন খোল দেখি?”

“কেন?”

“কারণ আছে। তোমার বক্ষ দেখিলেই জানিতে পারিব যে, তুমি আমার কাতেল (হন্তা) কি-না।”

“তাহার অর্থ কী?”

“অর্থ আছে। অর্থ না থাকিলে বৃথা তোমাকে এমন অনুরোধ করিব কী জন্য?-তোমরা সকলে জান,-অন্ততঃ শুনিয়া থাকিবে, হোসেন কখনো বৃথা বাক্য ব্যয় করে না।-মাতামহ বলিয়া গিয়াছেন, রক্ত-মাংসে গঠিত হইলেও যে বক্ষ লোমশূন্য, সে বক্ষ পাষাণময়, সেই লোমশূন্য বক্ষই তোমার কাতেল; যাহার বক্ষ লোমশূন্য তাহার হস্তেই তোমার নিশ্চয় মৃত্যু। মাহামহের বাক্য অলঙ্ঘনীয়। সীমার! তোমার বক্ষের বস্ত্র খুলিয়া ফেল।-আমি দেখি, যদি তাহা না হয়, তবে তুমি বৃথা চেষ্টা করিবে কেন? তোমার জীবনকাল পর্যন্ত আমাকে এ প্রকারে যন্ত্রণা দিয়া;-সহস্র চেষ্টা করিলেও, দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন করিতে পারিবে না।”

সীমার গাত্রের বসন উন্মোচন করিয়া হোসেনকে দেখাইল। নিজেও দেখিল। হোসেন সীমারের বক্ষের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দুই হস্তে দুই চক্ষু আবরণ করিলেন। সীমার সজোরে হোসেনের গলায় খঞ্জর দাবাইয়া ধরিল। এবারেও কাটিল না। বার বার খঞ্জর ঘর্ষণে হোসেন বড়ই কাতর হইলেন। পুনরায় সীমারকে বলিতে লাগিলেন, “সীমার! আর একটি কথা; আমার মনে হইয়াছে, বুঝি তাহাতেই খঞ্জরের ধার ফিরিয়া গিয়াছে, তোমারও পরিশ্রম বৃথা হইতেছে, আমিও যারপরনাই কষ্টভোগ করিতেছি। সীমার! মাহামহ জীবিতাবস্থায় অনেক সময় স্নেহ করিয়া আমার এই গলদেশে চুম্বন করিতেন। সেই পবিত্র ওষ্ঠের চুম্বনমাহাত্ম্যেই তীক্ষ্ণধার অস্ত্র ব্যর্থ হইয়া যাইতেছে। আমার মস্তক কাটিতে আমি তোমাকে বারণ করিতেছি না; আমার প্রার্থনা এই যে, আমার কণ্ঠের পশ্চাদ্ভাগে,-যেখানে তীরের আঘাতে শোণিত প্রবাহিত হইতেছে, সেইখানে খঞ্জর বসাও; অবশ্যই দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন হইবে।”

“না, তাহা কখনো হইবে না। আমি অবশ্যই এই প্রকারে তোমার মাথা কাটিব।”

“সীমার! আমাকে এ প্রকার কষ্ট দিয়া তোমার কী লাভ? এরূপে কিছুতেই কার্য সিদ্ধি হইবে না। আমি মিনতি করিয়া বলিতেছি, আমার গলার সম্মুখদিকে আর খঞ্জর চালাইও না। তোমার যত্ন নিষ্ফল হইবে, আমিও কষ্ট পাইব, অথচ মাথা কাটিতে পারিবে না। দেখ, নিশ্বাস ফেলিতে আমার বড় কষ্ট হইতেছে। শীঘ্র শীঘ্র তোমার কার্য শেষ করিলে তোমারও লাভ, আমারও কষ্ট নিবারণ। এ জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলি নাই। তুমি ঐ তীরবিদ্ধ স্থানে খঞ্জর বসাও, এখনই ফল দেখিতে পাইবে। আমাকে এ প্রকারে কষ্ট দিলে এজিদের অঙ্গীকৃত লক্ষ টাকা অপেক্ষা তোমার আর অধিক লাভ কী হইবে?”

“তোমার কথা শুনিলে আমার কী লাভ হইবে?”

“অনেক লাভ হইবে! তুমি আমার প্রতি সদয় হইয়া এই অনুগ্রহ কর যে, আমার গলার এদিকে আর খঞ্জর চালাইয়ো না, তীরবিদ্ধ স্থানে অস্ত্র বসাইয়া আমার মস্তক কাটিয়া লও।-আমি ধর্মতঃ প্রতিজ্ঞা করিতেছি, পরকালে তোমাকে আমি অবশ্যই মুক্ত করাইব।-বিনাবিচারে তোমাকে স্বর্গসুখে সুখী করাইব। পুনঃপুনঃ ঈশ্বরের নাম করিয়া আমি ধর্মতঃ প্রতিজ্ঞা করিতেছি, তোমাকে স্বর্গে লইয়া যাইতে না পারিলে, আমি কখনোই স্বর্গের দ্বারে পদনিক্ষেপ করিব না। ইহা অপেক্ষা তুমি আর কি চাও ভাই?”

হোসেনের বক্ষ পরিত্যাগ করিয়া সীমার তাঁহার পৃষ্ঠোপরি বসিল। ইমামের দুখানি হস্ত দুই দিকে পড়িয়া গেল।-যেন বলিতে লাগিলেন, “জগৎ দেখুক, আমি কি অবস্থায় চলিলাম!-নূরনবী মোহাম্মদের দৌহিত্র,-মদিনার রাজা, মহাবীর আলীর পুত্র হইয়া শূন্যহস্তে সীমারের অস্ত্রঘাতে কি ভাবে আমি ইহসংসার হইতে বিদায় হইলাম! জগৎ দেখুক!” সীমার যেমন তীরবিদ্ধ স্থানে খঞ্জর স্পর্শ করিল, অমনি হোসেনের শির, দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল! আকাশ, পাতাল, অন্তরী, অরণ্য, সাগর, পর্বত বায়ু ভেদ করিয়া চতুর্দিক হইতে রব হইতে লাগিল, “হায় হোসেন! হায় হোসেন!! হায় হোসেন!!!”

সীমার ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে হোসেনের শির লইয়া প্রস্থান করিল। রক্তমাখা খঞ্জর ইমামের দেহের নিকট পড়িয়া রহিল।

[মহরম পর্ব সমাপ্ত ]

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *