যে শিক্ষক ভদ্রলােক বিম্ব গাছটির বিষয়ে আমাকে প্রথম জানিয়েছিলেন, মাসখানিক পরে তার সঙ্গে আবার দেখা। তিনি একটি তেলাকুচার চারা নিয়ে এসেছেন। চারাটি যত্ন করে লাগানাে হয়েছে। একটু বড় হলেই আমি এর পাতা খেয়ে ডায়াবেটিস সারাবাে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
করমচা
বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালীতে চলে যাই। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। অপু–দুর্গা বৃষ্টিতে ভিজছে। বৃষ্টি কমার জন্যে তারা একমনে জপছে—
‘যা বৃষ্টি ধরে যা।
লেবুর পাতায় করমচা।‘ ‘নেবুর পাতায় করমচা’ বলা হচ্ছে, কারণ এই গাছের পাতা লেবুপাতার মতো। ফুল সাদা, দেখতে সুঁই ফুলের মতো।
এই হলাে আমাদের অতি পরিচিত করমচা। সংস্কৃত নাম করমর্দক। শিবকালীর বইতে করমচা বিষয়ে মজার তথ্য পেয়েছি। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে কিছু ফলের ওপর ট্যাক্স বসেছিল। ফলগুলি হলাে— তেঁতুল, আম, ডালিম, ফলসা, বড়ই, আমলকী, লেবু এবং করমচা। প্রাচীন ভারতে করমচা দিয়ে মদ বানানো হতো।
এই ফলে চিনি নেই বললেই হয়, ভারপরেও মদ কীভাবে বানানাে হতে কে জানে। আমার ধারণা মদ তৈরির বিশেষ কোনাে উপাদান হিসেবে এর ব্যবহার ছিল। বৈদিক শ্লোকে আছে আমার কাঁচা, পাকা ও শুকনাে ফল দ্রাক্ষা ফলের মতো পৃথক শক্তির আধার।’
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
করমচার বােটানিক্যাল নাম Carss carandus Linn. পরিবার হলাে Apocynaceae, নএয়াজেশ আহমেদ বাংলার বনফুল বইতে বলছেন করমচার ১৫টি প্রজাতি আছে। গুলা যেমন আছে, বৃক্ষ আছে, লতানাে গাছও আছে।
এবার এই গাছের রসায়নে আসা যাক।
এই গাছের মূলে আছে চারটি cardioactive componds : Carssore, Beta-Sitosterol, Triterpene a Carindone. 4243 WIC FSA স্টেরয়েড় গ্লাইকোসাইড় । থাইল্যান্ডের এক বিশ্ববিদ্যালয় (মইফোল ইউনিভার্সিটি) করমচার মূলের উপর ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
করমচরি ফন্সে আছে প্রচুর পরিমাণে Ascorbic acid এবং Salicylic add,
190 200 W Alkaloid, Terpenoids 97 Steroidal glycosides. ব্যবহার আধুনিক পরীক্ষায় দেখা গেছে গাছের মূল Histarnins releasing.
Hypotensive. Cardiotonic, Antiscorbic 1 anthalmintic. P Astringent at Antiscorbic.
প্রাচীন ভেষজে এই গাছের উল্লেখযােগ্য কোনাে ব্যবহার পানি না। অরুচিতে, শিকারে ব্যবহার আছে।
সবচে‘ মজার ব্যবহার হলাে হাই তােলা রোগে। যারা বারবার হাই তােলেন, তারা করমচা সেদ্ধ পানি খেয়ে হাই তােলা রোগ সারাতে পারেন। অক্সিজেনের ঘাটতি হলে আমরা হাই তুলি বলে অানতাম, আয়ুর্বেদশাস্ত্রীরা এই বিষয়ে ভিন্নমত পােষণ করেন। তাদের মতে হাই হলাে সর্বশরীর ব্যাপী সঞ্চরণশীল বায়ু (ধাতুগত অগ্নিপ্রবাহ)।
অপু–দুর্গার কাছে করমচার ব্যবহার বৃষ্টি কমানাে। আমি এই ফল টক স্বাদের জন্যে খাই। বাংলাদেশের কিছু নার্সারি মিষ্টি করমচার বিদেশী চারা বিক্রি করছে। নুহাশ পল্লীতে এরকম একটা চারা আছে। তার পাকা ফল খেয়ে দেখেছি, দেশী করমচার চেয়েও টক!
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
ব্রিটিশরা চীনের সঙ্গে দু’বার যুদ্ধ করেছে শুধুমাত্র ‘আফিম’–এর ব্যবসা সমস্যা নিয়ে। প্রথমবার ১৮৪১ সনে। দ্বিতীয়বার ১৮৫৮ সনে। দু’বার চীন পরাজিত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চীনে আফিম সুপ্তানির একচ্ছত্র অধিকার লাভ করে। এই আফিম যেত ভারতবর্ষ থেকে। কোম্পানির তত্ত্বাবধায়নে আফিম গাছের চাষ হতাে। আফিম সংগ্রহ করে রপ্তানি করা যেত।
আমি যখন খুব ছােট (বয়স ৫–৮ বছর) তখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় আফিম বিক্রির দোকান দেখেছি। আফিমখােররা দোকান থেকে আফিম কিনতেন। তবে তার জন্যে লাইসেন্স করতে হতাে। মাদক গ্রহণের জন্যে লাইসেন্স প্রথা এখনাে বাংলাদেশে আছে। সরকারের আবগারী বিভাগ সমাজের বিশিষ্টজনদের মদ খাবার জন্যে লাইসেন্স {!) দেন।
মােঘল রাজপরিবারের সদস্যদের আফিমের নেশা ছিল অতি পছন্দের নেশা। বল সমাজেও আফিম খেয়ে নেশা করার সামাজিক স্বীকৃতি ছিল। বয়স্করা সন্ধ্যার পর ‘আফিমের একটা গুলি খেয়ে মৌতাত করবেন, এতে কেউ দোষ ধরত না ।
গত ত্রিশ হাজার বছর ধরে মানুষ এই ভয়ঙ্কর নেশা করে যাচ্ছে। তবে এখন ‘গেল গেল‘ রব উঠেছে। আফিমের নানা উপাদানের নানা ব্যবহার তারপরেও বের হচ্ছে। বিশুদ্ধ এইসব উপাদানে হুকড়‘ হয়ে যাওয়া জনগােষ্ঠীর সামনে গাঢ় অন্ধকার ছাড়া কিছুই নেই। যে গাছটির থেকে এই আফিম তৈরি হচ্ছে, তার নাম পপি। প্রতিবছর ফুলের সৌন্দর্যের জন্যে নুহাশ পল্লীসহ সারা পৃথিবীতেই এই গাছের চাষ করা হয়। বর্ষজীবি এই গাছে শীতের সময় অদ্ভুত সুন্দর ফুল ফোটে। ফুলের পাপড়ি লালচে, গােলাপি, নীলচে, গাঢ় নীল বর্ণের হয়। ফলগুলি হয় ক্যাপসুলের মতো।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
ফল ব্লেড দিয়ে লম্বালৰিভাবে চিরে দিলে সেখান থেকে সােনালি রঙের আঠা বের হয়। এই আঠা রােদে শুকিয়ে আফিম বানানাে হয়। ফলের বীজগুলি কিন্তু আমরা তরকারি হিসেবে ব্যবহার করি। বীজের নাম পােস্তদানা । বাংলা রান্নার যে-কোনাে বইয়ে পােস্তদানার উল্লেখ থাকবেই।
বীজগুলি বাজারে সরাসরি আসে না। পানিতে ফলসহ বীজ একবার সেদ্ধ হয়ে আসে। সেই সেদ্ধ পানিও নেশা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলের
খােসাগুলিও বিক্রি হয়। খােসার নাম পােস্তড়েী ।
গাছটির বােটানিক্যাল নাম Papaver sarmierum Linn, পরিবার– Papaveraceae,
আফিমে যেসব বিষাক্ত বস্তু থাকে তার মধ্যে আছে ১.৫ ভাগ মরফিন, ০.৫ ভাগ নারকোটিন, ০.১ ভাগ কোডেইন, ০.১ ভাগ পেপারেন, ০.৫ ভাগ থিবেইন। আফিমের ত্রিশটি প্রজাতি থেকে পেপাভিরুবিনস জাতীয় একশ’র বেশি এলকালয়েডস পাওয়া গেছে। (সূত্র : বিষাক্ত গাছ থেকে সাবধান, প্রশান্ত কুমার ভট্টাচার্য।
আরবের মহান চিকিৎসক ইবনে সিনা তাঁর বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থ মানসিক এবং শারীরিক অসুখ আরােগ্যের ওষুধ হিসেবে আফিমের ব্যবস্থা দিয়েছেন। হােমার তার ইলিয়াড় মহাকাব্যে আফিমকে ব্যথা উপশম এবং ক্ষত নিরাময়ের ওষুধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ভারতীয় ভেষজে যকৃতের ব্যথায় আফিম ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে ।
স্নায়ুঘটিত রোগ, বহুমূত্র, একশিরা, অদ্রিায় এর ব্যবহারের বিধান দেয়া হয়েছে।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
আফিমের যে ব্যবহার জেনে আমার মজা লেগেছে, তা হলাে– ইচ্ছাশক্তি বর্ধক হিসেবে ব্যবহার। ভারতীয় যােগীরা দুধের সঙ্গে নিয়মিত সামান্য মাত্রায় আফিম খেয়ে থাকেন। এতে ইচ্ছাশক্তি, নিজের মনের ওপর দখল না–কি বাড়ে।
আফিমের ঔষধি গুণাবলি সব জেনেও বলছি, এই ভয়ঙ্কর গাছ থেকে শত হস্ত দূরেৎ‘ শত হস্ত দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়।
উদয়পদ্ম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরার মহারাজার বাড়িতে প্রথম এই গাছ দেখেন। বিদেশী গুলজাতীয় গাছ। অপূর্ব ফুল। এ বি এম জাওয়ায়ের হােসেন অবশ্যি তার বই ঔষধি গাছগাছড়ায় লিখেছেন এটি একটি বৃক্ষ। ২০ থেকে ২৫ ফুট লম্বা হয়। রবীন্দ্রনাথ এই গাছের কোনাে বাংলা নাম নেই দেখে নিজেই নাম রাখেন উদয়পদ্ম।
উদয়পদ্ম নুহাশ পল্পীতে আছে, বৃক্ষপ্রেমিকদের উদয়পদ্ম দেখার নিমন্ত্রণ।
পাছটির বােটানিক্যাল নাম Magnolia grandiflora. পরিবার Magnoliaceae.
গাছটির কোনাে ঔষধি ব্যবহার কোথাও খুঁজে পাই নি। অপূর্ব ফুল মন ভালাে করে দেয়। এটাই বা কম কী ?